45. ইমামতের তাৎপর্য :
আমরা বিশ্বাস করি : ইমামত শুধুমাত্র বাহ্যিক সরকার প্রধানের পদের নামই নয়। বরং ইমামতের পদমর্যাদা অনেক উঁচু আধ্যাত্মিক ও আত্মিক জগতে বিস্তৃত ও বিরাজমান। ইমাম , ইসলামী সরকারের নেতৃত্ব ছাড়াও দ্বীন ও দুনিয়ার সকল বিষয়ের পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। মানুষের মন ও চিন্তাকে পরিশুদ্ধ করেন এবং রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর শরীয়াতকে সব রকমের বিকৃতি ও পরিবর্তন থেকে রক্ষা করেন। আর রাসূল (সাঃ) যে উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন তা বাস্তবায়ন করেন।
ইমামত সে সুমহান ও সুউচ্চ পদমর্যাদা-যা মহান আল্লাহ্ হযরত ইব্রাহীমকে (আঃ) নবুয়্যত ও রিসালত এর মত মহা মর্যাদাবান পথ অতিক্রম করার পর এবং বহু সংখ্যক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উওীর্ণ হবার পর দান করেছেন। তিনিও তাঁর বংশধরকে এ পদে নিয়োগের ধারা অব্যাহত রাখার আবেদন জানালেন। জবাবে আল্লাহ্ বললেন যে , জালিম ও গুনাহ্গারের জন্যে এ পদ প্রজোয্য নয়। আর কোরআনে বিষয়টি এভাবে এসেছে :
‘
স্মরণ কর সে সময়ের কথা-যখন ইব্রাহীমকে তাঁর প্রভূ বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা নিয়েছিলেন আর তিনি প্রত্যেকটি পরিক্ষায় সম্পূর্ণরূপে সফলতার সাথে উওীর্ণ হলেন। তখন আল্লাহ্ বললেন : আমি তোমাকে মানব জাতীর ইমাম বানাব , তিনি বললেন , অমার বংশধর থেকেও ? আল্লাহ্ বলেন : আমার প্রতিশ্রুতি (ইমামতের এ ধারা) কখনও জালিম ও পাপীদের ক্ষেত্রে প্রজোয্য হবে না (কেবলমাত্র তোমারই বংশধর থেকে যারা মা‘
সুম হবেন তাদেরকেই ইমামতের পদে নিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গিকার প্রদান করলাম’
(সূরা : আল-বাকারাহ , আয়াত নং 124)।
স্বতঃসিদ্ধ যে , এমন একটি মহা মর্যাদাবান পদবী শুধুমাত্র রাষ্ট্রসরকারের নেতৃত্ব দানের মধ্যেই সীমিত থাকার বিষয় নয়। আর ইমামতের বিষয়টিকে আমরা এখন যেভাবে তুলে ধরলাম যদি সেভাবে বিশ্লেষণ করা না হয় তাহলে উপরোক্ত আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্য অস্পষ্ট থেকে যায়।
আমরা বিশ্বাস করি : সমস্ত উলুল আজম (উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ও দৃঢ় প্রত্যয়ী) নবীগণ ইমামতের পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁরা তাঁদের রিসালত ও নবুয়্যতের সাথে যা কিছু উপস্থাপন করতেন তা বাস্তবে রূপায়ন করতেন। তাঁরা মানুষের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক এবং বাহ্যিক ও গোপন নেতা ছিলেন। বিশেষতঃ বিশ্ব নবী (সাঃ) তাঁর নবুয়্যতের সূচনালগ্ন থেকেই ইমামতের সুউচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং খোদায়ী নেতৃত্বের পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর দায়িত্ব কেবলমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সংবাদ পরিবেশন করা পর্যন্তই সীমিত ছিল না।
আমরা বিশ্বাস করি : ইমামতের এ ধারা রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর পরও তাঁরই বংশধরের এক মা‘
সুম ধারার মাধ্যমে অব্যাহত আছে।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথা খুব ভালভাবে জানা গেল যে , ইমামতের এ মহা মর্যাদায় পৌছাঁর জন্যে অনেক কঠিন শর্তাবলী রয়েছে। তাকওয়া বা খোদাভীরুতার দিক থেকে এমন হতে হবে যে , সর্বপ্রকারের গুনাহ্ মুক্ত ও মা‘
সুম থাকবেন। এমনকি ছোট কোন পাপও করবেন না। আবার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দিক থেকে এমন হতে হবে যে , দ্বীনের সমস্ত বিধান ও আইন-কানুন এবং দ্বীনের যাবতীয় অন্য সকল বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। সর্বস্ত রের মানুষ সম্পর্কে ও মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদা সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। সময়-কাল , পরিবেশ , পরিস্থিতি ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে।
46. ইমাম পাপ-তাপের উর্ধে :
আমরা বিশ্বাস করি : ইমামকে সকল প্রকারের গুনাহ্ থেকে মুক্ত ও মা‘
সুম হতে হবে। উপরোক্ত আয়াতের যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমরা এখানে উপস্থাপন করেছি , এ ছাড়াও অমা‘
সুম বা পাপ-তাপ বিশিষ্ট ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গরূপে মানুষের নিকট নির্ভর যোগ্য হতে পারে না। দীনের মৌলিক ও শাখা-প্রশাখাগত বিষয়াদিও তার কাছ থেকে গ্রহণ করা যেতে পারে না। এ কারণেই আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে : ইমামের কথা ও বক্তব্য তাঁর অনুমোদিত বিষয়াদী ইসলামী শরীয়তের হুজ্বাত ও দলীল। (তাঁর অনুমোদনের অর্থ হচ্ছে : তাঁর সামনে কোন কাজ কেউ সম্পাদন করেছে আর তিনি তাতে নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। এর অর্থ হল তিনি অনুমোদন করেছেন)।
47. ইমাম শারীয়াতের রক্ষক :
আমরা বিশ্বাস করি : ইমাম নতুন কোন শারীয়াত ও নতুন কোন আইন বিধান নিয়ে আসবেন না। বরং তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে রাসুলে আকরাম (সাঃ) এর অনুসৃত শারীয়াত ও আইন-বিধানের সংরক্ষণ করা। তাঁর কাজ হচ্ছে এ পবিত্র জীবনাদর্শের প্রচার-প্রসার , শিক্ষা- দীক্ষা , দীনের হেফাজত , দ্বীনের পরিচিতি তুলে ধরা ও মানুষকে হেদায়েতের দিকে আহ্বান করা।
48. ইমাম ইসলামের সব চেয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তি :
আমরা আরও বিশ্বাস করি : ইমামকে ইসলামের মৌলিক ও শাখা-প্রশাখাগত হুকুম- আহ্কাম ও আইন-বিধান ও কোরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গরূপে অবগত থাকতে হবে। তাঁর নিকট যে ইলম ও জ্ঞান থাকবে সেটা খোদা প্রদত্ত এবং রাসূল আকরাম (আঃ) এর মাধ্যমে তাঁর নিকট পৌঁছবে। হ্যাঁ ইমামের জ্ঞান-প্রজ্ঞা এমন যে , সম্পূর্ণরূপে মানুষের আস্থা ও নির্ভরতা অর্জন করতে সক্ষম। ইসলামের হাকিকত সম্পর্কে জানার জন্যে মানুষ তার উপর পুরাপুরি ভরসা করতে পারে।
49. ইমাম আল্লাহর মনোনীত হতে হবে :
আমরা বিশ্বাস করি : ইমাম তথা রাসূলের উওরসুরী আল্লাহর পক্ষ থেকে মানসূব হতে হবে। অর্থাৎ রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও অক্যট্য বক্তব্যসমূহ এবং প্রত্যেক ইমামই তাঁর পরবর্তী ইমাম সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিবেন , এ পদ্ধতিতে ইমাম নির্দিষ্ট হবেন। অন্যভাবে কথাটি এরূপ : ইমামও রাসূল (সাঃ) এর মত আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়োগ ও নিযুক্ত হতে হবে। যেমন পূর্বোল্লেখিত আয়াতে ইব্রাহীম (আঃ) এর ইমামত সম্পর্কে আমরা জেনেছি :অর্থাৎ‘
আমিই তোমাকে মানুষের ইমাম নিয়োগকারী’
। এ মনোনয়ন পদ্ধতি ছাড়াও নিষ্পাপ-নিস্কলঙ্ক থাকার মত তাকওয়া-পরহেযগারী এবং আল্লাহর দ্বীনের সকল বিষয়ের শিক্ষা-দীক্ষায় , হুকুম-আহ্কাম ও আইন-বিধানের ক্ষেত্রে কোন প্রকার ভুল-ভ্রান্তি ব্যতিরেকে সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী হবেন। আল্লাহ্ ও রাসূল ব্যতীত অপর কেউ তঁদের চেয়ে জ্ঞানি হবে না। এ কারণেই আমরা এ মা‘
সুম ইমামগণের ইমামত বা নেতৃত্বের বিষয়টি গণ নির্বাচনের মাধ্যমে বিশুদ্ধ বলে জানি না।
50. ইমামগণ আল্লাহর রাসূল কর্তৃক নির্দিষ্ট :
আমরা বিশ্বাস করি : হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) তাঁর পরর্বতী ইমামগণকে নিজেই মনোনীত ও নির্দিষ্ট করে গেছেন। এক স্থানে তিনি বিরাট জন সমুদ্রের সন্মুখে বিখ্যাত“
হাদীসে সাকালাইনে”
বলেছেন। ছহীহ্ মুসলিমে কথাটি এভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে : রাসূলে আকরাম (সাঃ) মক্কা ও মদীনার মাঝে“
খোম”
নামক স্থানে দন্ডায়মান হলেন এবং জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন : খুব শিঘ্রই আমি তোমাদের মধ্যে থেকে চলে যাব। অতঃপর বললেন :
‘
আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান দু 'টি জিনিষ তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি। তাঁর প্রথমটি হল আল্লাহর কিতাব আল-কোরআন-যার মধ্যে হেদায়েত ও নূর রয়েছে....। আর দ্বিতীয়টি হল আমার আহলে বাইত। আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি যে , আমার আহলে বাইতের ব্যাপারে তোমরা খোদাকে ভুলে যেও না’
(এ বাক্যটি তিনি তিনবার পুনঃপুনঃ উচ্চারণ করলেন )।
1- ছহীহ্ মুসলিম , খঃ-4র্থ , পৃঃ-1873। ঠিক একই অর্থে ছহীহ তিরমিযিতেও একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অধিকন্ত সেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে : যদি এ দুটিকে ভালভাবে আকঁড়ে ধরে থাক তাহলে কখনও পথভ্রষ্ট-গোমরাহ্ হবে না।
2- ছহীহ্ তিরমিযি , খঃ-5ম , পৃঃ-662। এ হাদীসটি সুনানে দারেমীতে 2য় খঃ , পৃঃ 432। খাছায়েছে নাসাঈ , পৃঃ নং 20। মুসনাদে আহমাদ 5ম খঃ , পৃঃ নং 172 ও কানযুল ওম্মাল , 1ম খঃ , পৃঃ নং 185। এ ছাড়া ও অধিকাংশ বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ সমূহে লিপিবদ্ধ আছে।
অস্বীকার করার কিংবা সন্দেহ করার কোন অবকাশ নেই যে , এ হাদীসটি একটি হাদীসে মোতাওয়াতের হিসাবে সর্বজন বিদিত। কোন মুসলমানই এ হাদীসটিকে অস্বীকার করার সাহস করতে পারে না। এ ছাড়া ও বিভিন্ন বর্ণনার মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যে , রাসূলে আকরাম (সাঃ) একবার দু 'বার নয় বরং বারবার বিভিন্ন স্থানে ও বিভিন্ন পরিবেশে এ হাদীসটি পুনঃপুনঃ বলেছেন। স্বতঃসিদ্ধ কথা যে , রাসূলের আহলে বাইতের সমস্ত লোকই এ উঁচু মর্যাদার অধিকারী হতে পারে না , যা কোরআনের পাশাপাশি ও কোরআনের সমপর্যায়ের একটি উঁচু স্থান।
সুতরাং রাসূলের বংশধরের শুধুমাত্র মা‘
সুম ইমামগণের প্রতিই এ হাদীস ইংগিত করছে। (মনে রাখতে হবে“
আহলে বাইত”
কথাটির স্থলে“
সুন্নতী”
শব্দটি প্রয়োগ করে যে হাদীস দেখতে পাওয়া যায় তা একটি দূর্বল ও সন্দেহজনক হাদীস)।
এ ছাড়া অপর একটি হাদীস ছহীহ্ বোখারী , ছহীহ্ মুসলিম , ছহীহ্ তিরমিযি , ছহীহ্ আবু দাউদ , মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল ও অন্যান্য আরও অনেক গ্রন্থে এসেছে। আমরা সে হাদীসটি দ্বারাও আমাদের স্বপক্ষে দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করব। রাসূল (সাঃ) বলেন :
‘
দ্বীন ইসলাম কিয়ামত পর্যন্ত কায়েম ও প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যে পর্যন্ত বারজন খলিফা তোমাদের উপর হুকুমত করবেন ; যাঁরা সকলেই কোরাইশ থেকে হবেন’
(ছহীহ্ মুসলিম , 3য় খঃ , 1453 নং পৃষ্টায় রাসূলে আকরাম (সাঃ) থেকে জনাব জাবের ইবনে সামারাহ্ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। সামান্য পার্থক্য সহকারে উপরোল্লেখিত সনদটি অন্যান্য গ্রন্থেও লিপিবদ্ধ হয়েছে। ছহীহ্ বোখারী , 3/1101 , ছহীহ্ তিরমিযি , 4/501 , ছহীহ্ আবু দাউদ , 4র্থ খঃ , কিতাবুল মাহদী)।
আমরা বিশ্বাস করি : এ হাদীসের ব্যাপারে আমরা ইমামিয়া শিয়ারা বার ইমাম সম্পর্কিত যে আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করি তা ব্যতীত , অন্য কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ গ্রহণ যোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার চিন্তাও করি না। একটুখানি চিন্তা-ভাবনা করে দেখুন ; এ ছাড়া অন্য কোন ব্যাখ্যা কি করা যেতে পারে ?
51. হযরত আলীর মনোনয়ন রাসূল (সাঃ) কর্তৃক :
আমরা বিশ্বাস করি : রাসূলে আকরাম (সাঃ) বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপলক্ষে হযরত আলীকে (মহান আল্লাহর নির্দেশে) নিজের স্থলাভিষিক্ত ও উত্তাধিকারী হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তন্মধ্যে গাদীরে খোমের অনুষ্ঠান দিনের আলোর মত পরিস্কার। রাসূলে আকরাম (সাঃ) বিদায় হজ্বের সমাপ্তির পর মদীনায় প্রত্যাবর্তন কালে গাদীরে খোমে তাঁর সাহাবাদের বিরাট এক জন- সমাবেশে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি বললেন :
‘
হে লোক সকল! আমি কি তোমাদের নিজেদের ব্যাপারে তোমাদের নিজেদের চাইতে অগ্রাধিকার রাখি না ? লোকেরা বললো : জী হ্যাঁ! রাসূল (সাঃ) বললেন : তাহলে আমি যাদের উপর অগ্রাধিকার রাখি ও যাদের মাওলা (নেতা ও শাসক) , আলীও তাদের মাওলা (নেতা ও অগ্রাধিকার রাখে)।
এ হাদীসটি অসংখ্য সূত্রে রাসূলে আকরাম (সাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। এ হাদীসের বর্ণনাকারীদের সংখ্যা সাহাবাগণের মধ্যে থেকে সর্ব মোট 110 জন ও তাবেঈনদের মধ্যে থেকে 84 জন এবং 360টি প্রসিদ্ধ হাদীসও ইসলামের ইতিহাস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে , যা বিস্তারিতভাবে লেখা এভাবে সম্ভব নয়। (পায়ামে কোরআন , 9ম খঃ , পৃঃ নং 181)।
যেহেতু এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আকীদা-বিশ্বাস সংক্রান্ত এবং আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এ নয় যে , আমরা যুক্তি-তর্কের ময়দানে অবতীর্ণ হবো ; কাজেই সংক্ষেপে এতটুকুন বলব যে , উল্লেখিত হাদীসটি এমন কোন হাদীস নয় যে , যাকে খুব সহজে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারা যায়। অথবা শুধুমাত্র বন্ধুত্ব ও ভালবাসার ব্যাখ্যা করে মোড় ঘুরিয়ে দেয়া যায়। যেখানে আল্লাহর নবী (সাঃ) এত সব আয়োজন-ব্যবস্থাপনা ও গুরুত্বারোপ করেছেন।
এটা কি সে বিষয় নয়-যা জনাব ইবনে আছির তাঁর“
কামেল ইবনে আসিরে”
আলোচনা করেছেন ? তিনি লিখেন : হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) তাঁর নবুয়্যতী মিশনের প্রথম দিকে যখন এ আয়াত নাযিল হল :
‘
হে রাসূল! তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দের আল্লাহর ভয় প্রদর্শন কর। তখন রাসূল (সাঃ) তাঁর নিকটতম আত্মীয়-স্বজনদেরকে সমবেত করলেন এবং ইসলামের আহ্বান তাদের সামনে তুলে ধরলেন’
। অতঃপর বললেন :
‘
তোমাদের মধ্যে কে আছ আমার এ কাজে আমাকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে ? যাতে করে আমার ভ্রাতা ও আমার ভারপ্রাপ্ত দ্বায়িত্বশীল ও আমার খলিফা (উত্তারধিকারী) তোমাদের মাঝে থাকবে’
?
সে সময় রাসূলের এ আহ্বানে আলী ছাড়া আর কেউ সাড়া দেয়নি। আলী (আঃ) বললেন :অর্থাৎ‘
হে আল্লাহর নবী! আমি আপনার এ কাজে আপনার সাহায্যকারী ও সহযোগী থাকবো’
। রাসূলে আকরাম (সাঃ) তাঁর প্রতি ইংগিত করে বললেন :
‘
এ যুবকই আমার ভ্রাতা , আমার স্থালাভিষিক্ত দ্বায়িত্বশীল ও আমার উত্তরাধিকারী খলীফা তোমাদের মাঝে’
(কামেল ইবনে আছীর , 2য় খঃ , পৃঃ নং 630 ,বৈরূত সংস্করণ , দারূ ছাদের , সামান্য পার্থক্য সহকারে অভিন্ন অর্থে লিপিবদ্ধ আছেঃ মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল , খঃ-1ম , পৃঃ-11 এবং ইবনে আবিল হাদীদ-শারহে নাহজুল বালাগাহ্ খঃ-13 , পৃঃ- 210। আরো অনেকেই নিজ নিজ গ্রন্থে’
লিপিবদ্ধ করেছেন)।
এটা কি সে বিষয় নয়-যা রাসূলে আকরাম (সাঃ) তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে চেয়েছিলেন আরেকবার সে বিষয়টিকে বলবেন এবং এর উপর গুরুত্বারোপ করবেন ? ছহীহ্ বোখারীর ভাষ্য অনুযায়ী রাসূল (সাঃ) এভাবে নির্দেশ দিলেন :
‘
লিখার উপকরণ নিয়ে এসো তাহলে এমন এক লিপি তোমাদের জন্যে লিখে দেব , যার আলোকে তোমরা কখনও পথভ্রষ্ঠ-গোমরাহ্ হবে না। এর পর হাদীসের অব্যাহত ধারায় এসেছে যে , কোন কোন লোক এ পর্যায়ে রাসূলের সাথে বিরোধে অবতীর্ণ হয়েছে। এমনকি রাসূলের শানে অসম্মানজনক উক্তি করেছে এবং লিখার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। (ছহীহ্ বোখারী , 5ম খঃ , পৃঃ 11 ,বাবে মরাজুন্নাবী , ছহীহ্ মুসলিম 3য় খ পৃঃ নং 1259)।
আবারও বলছি : আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে সংক্ষিপ্ত যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে আমাদের আকীদা-বিশ্বাসের বিষয়টি উপস্থাপন করা। এর অধিক কিছু না। তাহলে আমাদের এ আলোচনা অন্য রকম রূপ পরিগ্রহ করত।
52. প্রত্যেক ইমামই পূর্ববর্তী ইমাম কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত :
আমরা বিশ্বাস রাখি : বার ইমামের প্রত্যেকেই পূর্ববর্তী ইমামের মাধ্যমে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে 1ম হচ্ছেন ইমাম আলী ইবনে আবী তালিব (আঃ) , 2য় হচ্ছেন তাঁরই জ্যেষ্ঠ পুত্র ইমাম হাসান (আঃ) , 3য় হচ্ছেন শহীদদের সরদার ইমাম হোসাইন (আঃ) , 4র্থ হচ্ছেন ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন (আঃ) , 5ম হচ্ছেন ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী (আঃ) , 6ষ্ঠ হচ্ছেন ইমাম জা 'ফর ইবনে মুহাম্মাদ (আঃ) , 7ম হচ্ছেন ইমাম মূসা ইবনে জা 'ফর (আঃ) , 8ম হচ্ছেন ইমাম ইমাম আলী ইবনে মূসা (আঃ) , 9ম হচ্ছেন ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী (আঃ) , 10ম হচ্ছেন ইমাম আলী ইবনে মুহাম্মাদ (আঃ) , 11তম হচ্ছেন ইমাম হাসান ইবনে আলী (আঃ) , ও 12তম হচ্ছেন ইমাম মুহাম্মাদ ইবনিল হাসান আল মাহ্দী (আঃ) এবং তিনিই সর্বশেষ ইমাম।
আমাদের আকিদা-বিশ্বাস মতে তিনি জীবিত ও অদৃশ্যে আছেন। (যেদিন আল্লাহর নির্দেশ লাভ করবেন সেদিন আত্ম প্রকাশ করবেন)। অবশ্য ইমাম মাহদী (আঃ) এর বিশ্বাসের ব্যাপারটি , যিনি পৃথিবীতে আবির্ভুত হবার পর সমগ্র দুনিয়া ব্যাপী সমাজের কানায় কানায় ন্যায়-ইনসাফ পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত করবেন যেমনটি পৃথিবী অন্যায়-অবিচারে ভরপুর ছিল ; এটা শুধুমাত্র আমাদের শিয়াদের জন্যেই নির্দিষ্ট নয় ; বরং সমস্ত মুসলমানরাই এ বিশ্বাস রাখেন। আহলে সুন্নাতের কোন কোন ওলামাগণ ইমাম মাহ্দী (আঃ) এর আগমন সম্পর্কিত হাদীস মোতাওয়াতের হওয়ার ব্যাপারে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। এমনকি ইমাম মাহ্দী (আঃ) সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে কয়েক বছর পূর্বে রাবেতায়ে আলমে ইসলামী একটি প্রবন্ধে ইমাম মাহ্দী (আঃ) এর আত্ম প্রকাশের বিষয়টি সর্বজন বিদিত সত্য বলে উল্লেখ করার সাথে সাথে এর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং বহু সংখ্যক হাদীসও বর্ণনা প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলীর উদ্ধৃতি উল্লেখ করে রাসূল (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেছে। (এ প্রবন্ধটি 24শে শাওয়াল 1396 হিজরী সালে রাবেতায়ে আলামে ইসলামীর“
ইদারাতু মাজমাউল ফেকহিল ইসলামী”
বিভাগের প্রধান জনাব মুহাম্মাদ আল মুনতাছির আল কিনানী স্বাক্ষরিত)। তবে তাদের অনেকেই বিশ্বাস করে যে , ইমাম মাহ্দী (আঃ) শেষ জামানায় জন্ম গ্রহণ করবেন। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে তিনি 12তম ইমাম এবং বর্তমানে জীবিত আছেন। আর মহান আল্লাহ যখন তাঁকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠাবেন তখন তিনি ভূ-পৃষ্ঠকে জোর-জুলুম থেকে মুক্ত করে সুবিন্যস্ত করার জন্যে এবং ন্যায়-ইনসাফ সমৃদ্ধ খোদায়ী শাসন প্রতিষ্ঠত করার জন্যে বিল্পব ঘটাবেন।
53. আলী (আঃ) শ্রেষ্ঠতম সাহাবী :
আমরা বিশ্বাস করি : হযরত আলী (আঃ) সাহাবাগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবী এবং নবী করিম (সাঃ) এর পর ইসলামী উম্মাহর সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কিন্তু তাঁর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জনকে আমরা হারাম বলে জানি। আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে যে , যারা হযরত আলীকে খোদার স্থলে স্থান দেয় অথবা এ জাতীয় কিছু চিন্তা-ভাবনা করে আমরা তাদেরকে কাফির ও মুশরিক এবং মুসলমানদের দল থেকে বহির্ভূত বলে মনে করি। আর তাদের প্রতি আমরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট যদিও তাদের নাম দুঃখজনক ভাবে শীয়াদের সাথে মিশ্রিত। এ ব্যাপারে কখনো কখনো ভুল-ভ্রান্তিও ছড়ানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সব সময়ই শিয়া ইমামিয়া ওলামাগণ নিজেদের বইপুস্তকে এ দলটিকে ইসলাম বিরোধী বলে গণনা করেছেন।
54. ইতিহাস ও বিবেকের দৃষ্টিতে সাহাবা :
আমরা বিশ্বাস করি : রাসূলে আকরাম (সঃ) এর সাথীগণের মধ্যে কিছু সংখ্যক সাথী ছিলেন উঁচু মর্যাদার অধিকারী , আত্মোৎসর্গকারী ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। কোরআন ও হাদীসে তাঁদের মর্যাদা সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে ,রাসূলের সমস্ত সাহাবাদেরকেই আমরা নিস্পাপ-মা‘
সুম বলে মনে করব এবং তাদের কাজ-কর্মগুলো নিয়ম বহির্ভূত কি না তা যাচাই বাছাই না করেই সঠিক বলে ধরে নেব। কেননা , কোরআন মজীদে বহু সংখ্যক আয়াতই (যেমন : সূরা বারায়াতে , সূরা নূরে , সূরা মুনাফিকীনে) মুনাফিকদের সম্পর্কে- রয়েছে। যারা রাসূলের সাহাবাদের মাঝেই ছিল। বাহ্যতঃ তারা রাসূলের সাহাবী হিসাবেই পরিগণিত হত। প্রকৃতপক্ষে আল-কোরআন খুব কঠোরভাবে তাদেরকে তিরস্কার ও ধিক্কার দিয়েছে। অপরদিকে যারা রাসূলের পরে মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধের মশাল জ্বালিয়েছে ও সমকালিন খলিফার সাথে কৃত বাইআত (শপথ) ভঙ্গ করেছে এবং হাযার হাযার মুসলমানদের রক্ত ঝরিয়েছে ; আমরা কি এ সমস্ত লোকদেরকে সবদিক থেকে পাক-পবিত্র মনে করতে পারি ?
অন্য কথায় কি করে সম্ভব যে , যুদ্ধের (যেমন জংগে জামাল ও জংগে সিফফিনের) দু 'পক্ষকেই সত্যানুসারী ও পবিত্র বলে মনে করবো ? এটাতো পরস্পর বিরোধী ব্যাপার এবং আমরা তা মেনে নিতে পারি না। যারা এ বিষয়টির বিশ্লেষণ দিতে গিয়ে ইজতেহাদ এর ব্যাপারটি যতেষ্ট মনে করে তারা বলে , দু 'পক্ষের এক পক্ষ অবশ্যই সত্যপন্থী ছিল ও অপর পক্ষ অপরাধী। কিন্তু তারা যেহেতু নিজেদের ইজতেহাদের উপর আমল করেছে , তাই খোদার নিকট তারা অক্ষম। বরং তারা তাতে পুণ্যের কাজ করেছে। এ জাতীয় কথা-বার্তা গ্রহণ করে নেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
এটা কি করে সম্ভব হতে পারে যে , ইজতেহাদের বাহানা ও ছুতা ধরে রাসূলের উত্তরাধিকারীর সাথে কৃত বাইআত (শপথ) ভঙ্গ করতে পারে , অতঃপর যুদ্ধের অগ্নি শিখা- প্রজ্বলিত করে নিরাপরাধ লোকদের রক্ত বন্যা প্রবাহিত করতে পারে ? যদি এত সব রক্তপাত ইজতেহাদের উছিলা ধরে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে জগতে এমন কোন কাজ নেই যার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায় না ?
আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলবো যে , আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে : সমস্ত মানুষই এমনকি রাসূলের সাহাবারাও নিজেদের আমল বা কাজ-কর্মেও নিয়ন্ত্রণাধীন এবং কোরআনের এ মৌলিক নীতি :
‘
তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সন্মানিত সে বক্তি , যে সব চেয়ে বেশী খোদাভীরুতার নীতি অবলম্বন করেছে। তাদের (সাহাবাদের) ক্ষেত্রেও এ নীতিই বাস্তব ও সত্য। সুতরাং তাদের অবস্থান ও তাদের আমল-অনুশীলণের ভিত্তিতে বিচার করে দেখব এবং এ পর্যায়ে তাদের ব্যাপারে একটা যুক্তিসংগত বিচার-ফয়সালার সন্ধান করব। আর বলব : যারা রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর যামানায় মোখলেছ (ঐকান্তিক) সাহাবাদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন এবং রাসূলের পরেও ইসলামের হেফাজতের চেষ্টায় মগ্ন ছিলেন ও কোরআনের সাথে কৃত অঙ্গিকারের যথাযথ অনুসরণ করেছেন , তাঁদেরকে আমরা ভাল বলে জানব এবং তাঁদের প্রতি সন্মান প্রদর্শন করবো। আর যারা রাসূলের জীবদ্দশায় মোনাফিকদের দলভুক্ত ছিল ও রাসূলের যামানায় এমন সব কাজকর্ম সম্পাদন করেছে যাতে রাসূলের পবিত্র আত্মা ব্যথিত ও বিড়ম্বিত হয়েছে ; অথবা যারা রাসূলের মৃত্যুর পর নিজেদের মত ও পথ পরিবর্তন করে এমন সব কাজ- কর্মে লিপ্ত হয়েছে যা ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতির কারণ হিসাবে দেখা দিয়েছে ,তাদেরকে আমরা ভালবাসি না । আল্লাহ্ বলেন :
‘
এমন কোন জাতি তুমি পাবেনা যারা আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে , তারা সে সমস্ত লোকদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছে যারা আল্লাহ্ ও রাসূলের বিরোধী। যদি ও তারা (খোদা বিরোধীরা) তাঁদের (ইমানদারদের) পিতা কিংবা তদের সন্তানাদি অথবা ভ্রাতৃবর্গ কিংবা নিকটাত্মীয়ই হোক না কেন । এরা সে সমস্ত লোক যাঁদের অন্তরে আল্লাহ্ ইমানকে দৃঢ় করে দিয়েছেন’
(মুজাদিলাহ্ : 22)।
হ্যাঁ , যারা রাসূলের জীবদ্দশায় এবং রাসূলের মৃত্যুর পর তাঁর হৃদয়কে ব্যাথিত ও আড়ম্বিত করেছে তারা আমাদের বিশ্বাস মতে প্রশংসার যোগ্য নয়।
কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে , রাসূলের সাহাবাদের মধ্যে একদল সাহাবা ইসলামের উন্নতিকল্পে বিরাট বিরাট কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রশংসার পাত্র হয়েছেন। অনুরূপভাবে যাঁরা তাঁদের পরবর্তীতে আগমন করেছেন অথবা আগামীতে কেয়ামত পর্যন্ত আগমন করবেন এবং রাসূলের খাঁটি ও সত্যিকারের সাহাবাদের নীতি-পন্থা অবলম্বন করবেন ও তাঁদের কর্মসূচীকেই অব্যাহত রাখবেন তাঁরা অবশ্যই সব রকম প্রশংসার পাত্র । আল্লাহ্ বলেন :
‘
আর যারা মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যে অগ্রবর্তী ও প্রথম , আর যাঁরা নেক কাজে তাঁহাদের অনুগামী , আল্লাহ্ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট ও রাযী , আর তাঁরাও আল্লাহর প্রতি রাযী ও সন্তুষ্ট’
(সূরা : তাওবাহ , আয়াত নং 100) ।
এ হলো সাহাবাদের সম্পর্কে আমাদের আকিদা-বিশ্বাসের সারকথা।
55. আহলে বাইতের ইমামগণের জ্ঞান রাসূল থেকে প্রাপ্ত :
আমরা বিশ্বাস করি : হাদীসে মোতাওয়াতের মোতাবেক রাসূলে আকরাম (সাঃ) কোরআন ও আহলে বাইত (আঃ) সম্পর্কে আমাদের প্রতি যে নির্দেশ প্রদান করেছেন , তা হচ্ছে আমরা যেন এ দুটি বস্তু থেকে আমাদের হাত গুটিয়ে না নেই , তাহলে আমরা হেদায়েতের পথে থাকতে পারব না। এ ছাড়াও আমরা আহলে বাইতের ইমামগণকে নিস্পাপ-মা‘
সুম বলে জানি। তাঁদের সমস্ত বলা বক্তব্য ও কাজ-কর্মসমূহকে আমাদের জন্যে হুজ্জাত ও দলীল বলে মনে করি। অনুরূপভাবে তাঁদের অনুমোদনকেও (অর্থাৎ তাঁদের সামনে কোন কাজ সম্পদিত হলে তাঁরা তাতে নিষেধ করেননি)। এরই ভিত্তিতে আমাদের ফেকহী মাসয়ালা-মাসায়েল নির্ণয়ের জন্যে কোরআন ও রাসূলের হাদীসের পর ইমামগণের কথা , কাজ ও অনুমোদনকে একটি উৎস বলে জানি ।
বহু সংখ্যক নির্ভরযোগ্য হাদীস মোতাবেক আমরা যখন আহলে বাইতের এ উক্তিটির প্রতি লক্ষ্য করি যে , তারা বলেছেন : তাঁরা যা কিছু বলেন তা তাঁদের পূর্বপূরুষদের থেকে , তাঁরা রাসূলে আকরাম (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন , তখন আমাদের নিকট পরিস্কার হয়ে যায় যে , প্রকৃতপক্ষে তাঁদের বর্ণনা রাসূলে আকরাম (সাঃ) এরই বর্ণনা। আমরা জানি নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনাকারীগণের বর্ণনা ইসলামে বিশ্বাসী সমস্ত ওলামাদের দৃষ্টিতেই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত।
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-বাকের (আঃ) জনাব জাবেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন :‘
হে জাবের! আমরা যদি কোন হাদীস আমাদের নিজের থেকে ও আমাদের প্রবৃওি থেকে তোমাদের জন্যে বর্ণনা করি তাহলে আমরা ধংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাব। কিন্তু (জেনে রেখো) আমরা যতগুলো হাদীস তোমাদের জন্যে বর্ণনা করি তা সমস্তই স্বীয় ভান্ডারের আকারে রাসূল (সাঃ) থেকে তোমাদের জন্যে সঞ্চয় করে রেখেছি’
(জামেউ ' আহাদীসুশ্ শীআহ্ খঃ-1ম , পৃঃ-18 , ভূমিকা থেকে , হাদীস নং 116)।
ইমাম জা 'ফর ইবনে মুহাম্মাদ আস্-সাদিক (আঃ) এর নিকট এক ব্যক্তি এসে একটি প্রশ্ন করল। ইমাম তার উত্তর দিচ্ছিলেন। ঐ লোকটি ইমামের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার জন্যে অন্য আলোচনা শুরু করল। ইমাম তাকে বললেন : এ সব কথা-বার্তা বাদ দাও। অতঃপর বললেন :
‘
এ বিষয়ে আমি তোমাকে যে জবাব দিয়েছি তা ছিল রাসূল (সাঃ) থেকে’
। (উসূলে কাফি , খঃ-1ম , পৃঃ-58 , হাদীস 121)।
এখানে আর কোন কথা বলার অবকাশ থাকে না।
একটি গুরুত্বপুর্ণ দিক ও লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এ যে , হাদীসের জগতে আমাদের এখানে নির্ভরযোগ্য কয়েকটি হাদীসের গ্রন্থ রয়েছে। যেমন উসূলে কাফি ,“
তাহযীব”
,“
আল- ইসতিবসার”
ও“
মান লা ইয়াহযুরুল ফাকীহ”
। কিন্তু হাদীস গ্রন্থসমূহ আমাদের নিকট নির্ভরযোগ্য হওয়ার অর্থ এ নয় যে , যত বর্ণনা বা হাদীসই এ গ্রন্থসমূহে আছে সবই আমাদের মতে গ্রহণযোগ্য। এর পাশাপাশি ইলম-ই-রেজালের গ্রন্থও রাখি (যে গ্রন্থে হাদীস বর্ণনাকারীদের হাল-অবস্থা সমস্ত সনদসমূহের ক্রমধারায় বিস্তারিত বর্ণনা হয়েছে)। আমাদের নিকট শুধুমাত্র সে সমস্ত হাদীস বা বর্ণনাই গ্রহণযোগ্যও বিবেচিত-যার সনদের ক্রমধারার ব্যক্তিবর্গ নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত হবেন। সুতরাং উল্লিখিত নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহে যদি কোন হাদীস এ শর্ত মোতাবেক না হয় তাহলে আমাদের নিকট গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না।
অধিকন্ত সম্ভাবনা আছে যে , এমনও বর্ণনা আছে যার সনদের ক্রমধারাও নির্ভরযোগ্য ; কিন্তু আমাদের বড় বড় ওলামা ও ফকীহগণ সে হাদীসকে উপেক্ষা করে গেছেন ও এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন , এ কারণে যে , অন্য কোন বাধা তার মধ্যে পেয়েছেন। এ জাতীয় হাদীসকে আমরা-معرض علیها
তথা“
এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে”
নামে আখ্যায়িত করেছি এবং আমাদের দৃষ্টিতে এ জাতীয় হাদীস নির্ভরযোগ্য নয়।
এখান থেকে একটি বিষয় পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে যে , যারা আমাদের আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করার জন্যে উল্লেখিত গ্রন্থসমূহের কোন কোনটি থেকে শুধুমাত্র এক দু 'টি বা কয়েকটি হাদীস নিজের পক্ষে দলীল হিসাবে উপস্থাপন করে অথচ এর সনদ ইত্যাদি কিছুই যাচাই-বাছাই ও সন্ধান করেনি , তাহলে তারা সঠিক পন্থা অবলম্বন করেনি।
অন্য কথায় , ইসলামী মাযহাবসমূহের অন্যতম প্রসিদ্ধ একটি মাযহাবের কতিপয় হাদীস গ্রন্থ রয়েছে“
ছিহাহ্”
নামে। যার হাদীসগুলোর বিশুদ্ধতার ব্যাপারে লেখক নিজেই দায়িত্ব নিয়েছেন এবং অন্যরাও এগুলো বিশুদ্ধ বলে সমর্থন করেছে। কিন্তু আমাদের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহের ব্যাপারে আমাদের নিকট তদ্রুপ নয়। বরং আমাদের হাদীসের গ্রন্থসমূহ এমন যে , যার লেখকগণ নিজেরাই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন , নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বত্ব। কিন্তু হাদীসের সনদ সংক্রান্ত বিশুদ্ধতার বিষয়টি অর্পিত হয়েছে ইলমে রিজালের কিতাবসমূহে বর্ণনাকারীর সনদের ধারা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করার উপর।
যা হোক আমাদের দৃষ্টিতে কোরআনের আয়াত ও হাদীসে রাসূল আকরাম (সাঃ) এর পর আহলে বাইতের বারজন ইমামের হাদীস নির্ভরযোগ্য। তবে এ জন্যে শর্ত হচ্ছে ইমামগণের হাদীসসমূহ প্রকাশের সূত্র ও পন্থা নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত হতে হবে।
এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা যা আলোচনা করেছি তা আমাদের আকীদা-বিশ্বাসের মৌলিক দিকগুলোর উপর ছিল। যাতে দ্বীন ইসলামের মূল বিষয়সমূহকে পরিস্কার করে তুলে ধরেছি। এ ছাড়াও আমাদের আকীদা-বিশ্বাসের আরো কিছু দিক আছে সেগুলো এখন আমরা আলোচনা করবো।