দ্বিতীয় অধ্যায়
পেশা
দর্জির পেশা ইসলামে একটি সম্মানিত পেশা , জ্ঞানী লুকমান (আঃ) এ পেশা নিজের জন্য পছন্দ করেছিলেন
। পবিত্র নবী (সঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে , তিনি বলেছেন :
عمل الأبرار من الرجال من أمتي الخياطة ، و عمل الأبرار من أمتي من النساء المغزل
“
সৎকর্মশীল লোকের কাজ হচ্ছে দর্জির কাজ এবং সৎকর্মশীল নারীর কাজ হচ্ছে (চরকায়) সূতাকাটা।”
হযরত শেইখ এ কাজ পছন্দ করেছিলেন জীবিকা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে। তখন থেকেই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন শেইখ রজব আলী খাইয়্যাত (দর্জি) হিসেবে। মজার বিষয় হলো তার সেই সাধারণ ছোট্ট বাড়িটি , যা আমরা আগে বর্ণনা করেছি , তার কর্মশালা হিসাবেও ব্যবহৃত হতো।
এ বিষয়ে তার সন্তানদের একজন বলেন : প্রথমে আমার বাবার একটি কক্ষ ছিল কারাভানসেরিতে যেখানে তিনি তার দর্জির কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। একদিন বাড়ির মালিক এসে তাকে জায়গাটি ছেড়ে দিতে বললেন। পরদিন কোন তর্ক ছাড়াই এবং কোন অধিকার দাবী করা ছাড়াই আমার বাবা তার সেলাই মেশিন ও সেলাই টেবিল বেধেঁ নিলেন এবং আমাদের বাসায় নিয়ে এলেন ; আর কক্ষটি বাড়ি ওয়ালাকে ফেরত দিয়ে দিলেন। তখন থেকে তিনি তার বাড়ির প্রবেশদ্বারের পাশেই একটি কক্ষকে তার কর্মশালা করে নেন।
তার কাজে অধ্যাবসায়
হযরত শেইখ তার কাজে ছিলেন অত্যন্ত মনোযোগী ও অধ্যাবসায়ী। তিনি তার জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন তার জীবিকা অর্জনের জন্য। যদিও তার শিষ্যরা আন্তরিক ভাবে প্রস্তুত ছিলো তার সাধারণ জীবনপোকরণগুলো সরবরাহ করার জন্য , কিন্তু তিনি তা কখনোই গ্রহণ করেন নি।
পবিত্র নবী (সঃ) বলেছেন :
مَنْ أَكَلَ مِنْ كَدِّيَدِهِ كانَ يَوْمُ الْقِيامَةِ فِي أَعْدادِ الْأَنْبِياءِ وَ يَأْخُذُ ثَوابَ الْأَنْبِياءِ
“
যারা তাদের জীবিকা নিজে উপার্জন করে ক্বিয়ামাতের দিন তাদেরকে নবীদের মর্যাদা দেয়া হবে এবং তাদেরকে নবীদের পুরস্কার দেয়া হবে।”
অন্য এক হাদীসে তিনি বলেছেন :
“
ইবাদতের দশটি অংশ আছে। নয়টি অংশই হালাল উপার্জনের মাঝে”
।
হযরত শেইখের এক বন্ধু বলেন :
“
আমি ঐ দিনটি কখনো ভুলবো না যেদিন আমি হযরত শেইখকে পরিশ্রমে চেহারা ফ্যাকাসে অবস্থায় বাজারে দেখেছিলাম। তিনি সেলাইয়ের যন্ত্রপাতি ও সামগ্রী কিনে বাড়িতে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি তাকে বললাম :‘
জনাব একটুখানি বিশ্রাম নিন , আপনি ভাল বোধ করছেন না।”
তিনি বললেন ,
“
তাহলে আমি কি করবো আমার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ?!”
নবী (সঃ) বলেছেন :
“
আল্লাহ তাঁর দাসকে হালাল উপার্জনের পথে পরিশ্রান্ত দেখতে ভালবাসেন।”
“
অভিশপ্ত সে যে তার পরিবারের ভরণপোষণ দেয় না।”
মজুরী গ্রহণের সাম্যতা
হযরত শেইখ কাপড় সেলাইয়ের বিনিময়ে সঠিক মজুরী গ্রহণ করতেন। তিনি যে পরিমাণ সেলাই করতেন এবং যে পরিমাণ কাপড়ের কাজ করতেন ঠিক সে পরিমাণ মজুরী গ্রহণ করতেন। কোনভাবেই তিনি তার কাজের চেয়ে বেশী মজুরী গ্রহণ করতেন না। এ জন্য কেউ যদি বলতো :‘
হযরত শেইখ আমাকে একটু বেশী মজুরী দিতে দিন ,’
তিনি তা গ্রহণ করতেন না।
হযরত শেইখ তার ক্রে তাদের কাছে মজুরী দাবী করতেন ইসলামী চুক্তি (ভাড়ার) আইন অনুযায়ী।
কিন্তু যেহেতু তিনি কখনই তার কাজের চেয়ে বেশী মজুরী নিতে চাইতেন না এবং কোন কারণে যদি কাজ শেষে দেখতে পেতেন যে তিনি যা ভেবেছিলেন তার চেয়ে কম কাজ করতে হয়েছে তাহলে তিনি সেই অতিরিক্ত টাকা ফেরত দিতেন যা তার প্রকৃত মজুরীর চেয়ে বেশী বলে মনে হতো।
একজন আলেম বলেনঃ আমি কিছু কাপড় নিয়ে গেলাম হযরত শেইখ এর কাছে (একটি আবা , একটি জোব্বা ও একটি মোটা জোব্বা) বানানোর জন্য। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম , কত দিব ?
তিনি বললেন ,
“
এটি দু’
দিনের কাজ , তাই মজুরী হবে চল্লিশ তোমান।”
দুদিন পর আমি পোশাকগুলোর জন্য গেলাম , তিনি বললেনঃ মজুরী শুধু বিশ তোমান।
আমি জিজ্ঞাস করলামঃ‘
আপনিতো বলেছিলেন চল্লিশ তোমান ?’
তিনি বললেনঃ“
প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তা দু’
দিনের কাজ , কিন্তু তা শেষ করতে শুধু এক দিন লাগলো!”
অন্য একজন বলেনঃ আমি তার কাছে কিছু কাপড় নিয়ে গেলাম দু’
টো প্যান্ট বানানোর জন্য। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম তার মজুরী কত আসবে। তিনি বললেনঃ‘
দশ তোমান।’
আমি তাকে তখনই মজুরী দিয়ে দিলাম। যখন কিছু সময় পরে আমি প্যান্টগুলো আনতে গেলাম তিনি একটি দুই তোমানের নোট সেগুলোর উপরে রাখলেন এবং বললেন“
মজুরী হয়েছে আট তোমান।”
হযরত শেইখ এর সন্তান বলেন : একবার তিনি এক ক্রে তার সাথে একটি আবা বানানোর মজুরী পঁয়ত্রিশ তোমান সাব্যস্ত করলেন। কিছুদিন পর ঐ ক্রে তা আবার জন্য এলেন। যখনই ক্রে তা আবাটি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন আমার বাবা তার পিছনে পিছনে ছুটলেন ও তাকে পাঁচ তোমান ফেরত দিয়ে বললেন :“
আমি ভেবেছিলাম এ আবাটি বানাতে আমার আরো বেশী সময় লাগবে , কিন্তু তা লাগেনি।”
ইনসাফের (সাম্যতা) জন্য পুরস্কার
সব কাজে ইনসাফ করাকে একটি জরুরী বিষয় হিসেবে ইসলামে জোর দেয়া হয়েছে , বিশেষতঃ লেনদেনের ক্ষেত্রে। ইমাম আলী (আঃ) বলেছেনঃ
“
ইনসাফ নৈতিক গুণগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ।”
এবং তিনি আরো বলেছেনঃ
“
সবচেয়ে বড় পুরস্কার দেয়া হয় ইনসাফ (সাম্য) এর জন্য।”
শুধু জানার জন্য যে কীভাবে লেনদেনে ইনসাফ আত্মগঠনে কাজে লাগে এবং হযরত শেইখ এর উপর আল্লাহর নেয়ামত যে অতিরঞ্জিত কথা নয় তা বোঝার জন্য নিচের ঘটনাটি নিয়ে চিন্তা করা যথাযথ হবেঃ
লোকজনের প্রতি ইনসাফ এবং হযরত ওয়ালী আল আসর (আঃ ফাঃ) সাথে সাক্ষাত :
একজন জ্ঞানী ব্যক্তি চাইছিলেন হযরত বাকিয়াতুল্লাহ ইমাম মাহদী (আঃ) এর সাথে সাক্ষাত করবেন এবং অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন যে এরকম সুযোগ তাকে দেয়া হয় নি। দীর্ঘ সময়ের জন্য তিনি কঠোর আত্ম -নিয়ন্ত্রণ অনুশীলন করেছিলেন এবং আধ্যাত্মিক সাহায্য চেয়েছিলেন।
নাজাফে আশরাফের হাওযার ছাত্র ও ইমাম আলী (আঃ) এর মাযারের আলেমগণের কাছে এটি সুপরিচিত যে , কেউ যদি মসজিদে সাহলাতে মাগরীব ও ইশার নামায পর পর চল্লিশ মঙ্গলবার পড়ার সম্মান লাভ করে তবে সে ইমাম আল মাহদী (আঃ) এর সাথে সাক্ষাত পাবে। কিছু সময়ের জন্য তিনি এভাবে সংগ্রাম করলেন কিন্তু কোন লাভ হলো না। তখন তিনি গ্রহ নক্ষত্র বিদ্যা এবং সংখ্যা তত্ত্বের স্মরণাপন্ন হলেন এবং নির্জনে আত্ম -সংযম ও অন্যান্য আধ্যাত্মিক সাধনা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে লাগলেন। তিনি ব্যাকুল ভাবে অদৃশ্য ইমামের (আঃ) সাক্ষাত চাইছিলেন। কিন্তু সবই ব্যর্থ হলো। যা হোক , তার রাতের নামায , কান্না ও সকালের বিলাপের কারণে তার কিছুটা অন্তর্দৃষ্টি ও অতিন্দ্রীয় অনুভুতির সৃষ্টি হলো এবং মাঝে মাঝেই আলোর ঝলক তাকে দান করা হলো। তিনি ভাবাবেশ ও পরম আত্মিক আনন্দে পড়তে শুরু করলেন এবং মাঝে মাঝেই কিছু দৃশ্য দেখতে ও কিছু সূক্ষ্ণ বিষয় শুনতে লাগলেন।
এরকম এক আধ্যাত্মিক অবস্থায় তাকে বলা হলোঃ“
হযরত ওয়ালী আল আসর (আঃ) এর সাক্ষাত তুমি লাভ করতে পারবে না যদি না তুমি অমুক শহরে যাও।”
প্রথমে তা কঠিন মনে হলেও পবিত্র উদ্দেশ্যের কারণে তা অনেক সহজ হয়ে গেলো।
ইমাম আল আসর (আঃ ফাঃ) কামারের বাজারে
বেশ কয়েকদিন পর উপরোল্লেখিত ব্যক্তি সে শহরে এলেন এবং সেখানেও তিনি আত্ম -সংযম এবং আধ্যাত্মিক অনুশীলন নির্জনে চালিয়ে যেতে লাগলেন যা চল্লিশ দিন পর্যন্ত করার নিয়ত ছিলো তার। সাঁইত্রিশতম দিনে তাকে বলা হলো : ঠিক এখনই হযরত বাকিয়াতুল্লাহ ইমাম আল আসর (আঃ ফাঃ) কামারদের বাজারে আছেন এক বৃদ্ধ কামারের দোকানে , তাই তাড়াতাড়ি যাও এবং তার সাক্ষাত লাভের চেষ্টা করো।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং তিনি ভাবাবেশের মাঝে যে দৃশ্য দেখেছিলেন সে অনুযায়ী বৃদ্ধ লোকটির দোকানে দ্রুত চলে গেলেন। সেখানে তিনি দেখতে পেলেন পবিত্র ইমাম (আঃ) বসে রয়েছেন এবং সেই বৃদ্ধ তালাওয়ালার সাথে কথা বলছেন। তিনি সালাম দিলে পবিত্র ইমাম জবাব দিলেন এবং ইশারা করলেন চুপ থেকে [আভাস দিয়ে] বিস্ময়কর ঘটনা দেখার জন্য।
বৃদ্ধ তালা ওয়ালার ইনসাফ
এ সময় আমি দেখলাম একজন কুজোঁ হয়ে যাওয়া , ভেঙ্গে পড়া বৃদ্ধা তার হাতের লাঠি নিয়ে এলেন এবং কম্পিত হাতে একটি তালা দেখালেন এবং বললেন :“
তোমরা কি আল্লাহর ওয়াস্তে আমার কাছ থেকে তিন শাহীর
বিনিময়ে এই তালাটি কিনবে ? আমার তিন শাহীর প্রয়োজন।”
বৃদ্ধ তালাওয়ালা তালাটি নিয়ে দেখলেন এবং এটিকে ব্যবহারযোগ্য দেখতে পেলেন এবং বললেন :
“
বোন আমার! এটির দাম দুই আব্বাসী।
কারণ , এর চাবি দশ দীনারের
বেশী হবে না। তাই আমাকে দশ দীনার দিন আমি এর একটি চাবি বানালে তালাটির দাম হয়ে যাবে দশ শাহী”
।
বৃদ্ধা এবার বললেন :
“
না , আমার তা প্রয়োজন নেই , শুধু তিন শাহী দরকার ; তুমি যদি তা তিন শাহীতে কিনে নাও , আমি তোমার জন্য দোয়া করবো।”
বৃদ্ধ খুব সরলভাবে বললেন , বোন আমার ! আপনি একজন মুসলমান এবং আমিও নিজেকে মুসলমান দাবী করি। তাই কেন আমি এক মুসলমানের সম্পদ এত কম দামে কিনবো এবং একজনকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবো ? এ তালাটির বর্তমান দাম হচ্ছে আট শাহী , আমি যদি তা থেকে লাভ করতে চাই তাহলে আমি তা সাত শাহীতে কিনবো। কারণ দুই আব্বাসি পরিমাণ ব্যাবসাতে এক শাহীর চাইতে বেশী লাভ করা ন্যায় বিচার নয়। আপনি যদি নিশ্চিত থাকেন যে তা আপনি বি ক্রি করবেন তাহলে তা সাত শাহীতে কিনবো এবং আমি আবার বলছি আসল দাম হচ্ছে দুই আব্বাসি , যেহেতু আমি একজন ব্যাবসায়ী আমি তা কিনবো এক শাহী কমে।
বৃদ্ধা সম্ভবত বিশ্বাস করতে পারছিল না বৃদ্ধ তালাওয়ালা কি বলছে। তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন এবং অভিযোগ করলেন যে কেউ তার কাছ থেকে তা কিনতে চায় নি। তিনি বললেন , তিনি তাদের কাছে অনুনয় করেছিলেন তিন শাহীতে তা কেনার জন্য। কারণ দশ দীনার তার জন্য যথেষ্ঠ ছিলো না। বৃদ্ধ তালাওয়ালা তাকে সাত শাহী দিলেন এবং তার কাছ থেকে তালাটি কিনে নিলেন।
আমি তাকে সাক্ষাত দিবো
যখন বৃদ্ধা পিছনে ফিরলেন চলে যাবার জন্য , ইমাম (আঃ) আমাকে বললেন : প্রিয় আমার ! এই বিস্ময়কর দৃশ্যটি দেখলেতো! তুমিও এরকম করো এবং এরকম হয়ে যাও , তখন আমি তোমাকে দেখতে আসবো। কোন প্রয়োজন নেই আধ্যাত্মিক নির্জনতার এবং ইলমে জাফর-এর (সংখ্যাতত্তের)। আত্মসংযম ও বিভিন্ন ধরণের ভ্রমণ প্রয়োজন হবে না ; বরং ভাল কাজ কর ও মুসলিম হও যেন আমি তোমার সাথে মেলামেশা করতে পারি। এ শহরের লোকের মাঝে আমি এই বৃদ্ধকে বাছাই করেছি। কারণ এ ব্যক্তি ধার্মিক ও আল্লাহকে জানে। আর তুমি দেখছো সে কী পরীক্ষার ভেতর দিয়ে গেলো। এ বৃদ্ধা মহিলা বাজারের সবাইকে অনুরোধ করেছিলো তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য , যেহেতু তারা তাকে মহিলা ও অভাবী দেখেছে তাই তারা সবাই তার তালাটি সস্তায় কিনতে চেয়েছিল ; আর তিন শাহীর বিনিময়েও কেউ তা কিনে নি। এ বৃদ্ধ ব্যক্তি এটিকে প্রকৃত দামে কিনলো , সাত শাহীতে। এভাবে আমি প্রত্যেক সপ্তাহে তাকে সাক্ষাত দেই এবং তাকে দয়া ও সৌহার্দ দেখাই।