সপ্তম অধ্যায়
আল্লাহর বন্ধুদের পরোপকার
অন্যদের সেবা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় যা হাদীসগুলোতে খুব জোর দেয়া হয়েছে। রাসূল (সাঃ) বলেন :
“
মানুষের মধ্যে তারাই শ্রেষ্ঠ যারা অন্যের জন্য উপকারী।”
সৃষ্টির রহস্য
হযরত শেইখ এ বিষয়টিকে খুব জোর দিয়েছেন। তার এক শিষ্য বলেছেন যে তিনি বলেন :
“
আমার একবার আল্লাহর নৈকট্য এলো ; আমি তাঁকে অনুনয় করলাম সৃষ্টির রহস্য কী বলার জন্য। আমাকে বলা হলো (ঐশী প্রেরণার মাধ্যমে) যে সৃষ্টির রহস্য হচ্ছে জনগণের প্রতি কল্যাণ।”
ইমাম আলী (আঃ) বলেছেন :
“
তোমাদের আদেশ করা হচ্ছে আল্লাহকে ভয় করার জন্যে এবং তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে অন্যের কল্যাণ করা ও (আল্লাহকে) মান্য করার জন্য।”
হযরত শেইখের এক শিষ্য বলেন : একবার আমি তাকে বললাম ,“
হে শেইখ! আমাকে কিছু বলুন যা আমার উপকার করবে! তিনি আমার কান মলে দিলেন এবং বললেন :
“
মানুষের সেবা , মানুষের সেবা!”
হযরত শেইখ বলতেন :“
যদি তোমরা চাও একত্ববাদের সত্যপথ পেতে তাহলে মানুষের কল্যাণ করো। একত্ববাদের বোঝা খুব ভারী এবং সমস্যাসংকুল , এবং সবাই এর বোঝা সহ্য করার ক্ষমতা রাখে না। যা হোক অন্যের কল্যাণ এ ভার বহনকে সহজ করে দেয়।”
এবং তিনি মাঝে মাঝে হাস্যরসের সাথে বলতেন :
“
দিনের বেলা আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য করো এবং রাতের বেলা ভিক্ষা চাও তাঁর দরজার গোড়ায়।”
মরহুম ফায়েদ কাশানী (রঃ) তার একটি কবিতায় তুলে এনেছেন :
‘
সারা রাত বিলাপ করো বিনয়ের সাথে রিয্ক দাতার দোর গোড়ায় , যখন সকাল হয়ে যায় , সাহায্য করো যারা অন্তরে আঘাত প্রাপ্ত ও ভগ্ন হৃদয়ের।’
দারিদ্র্যের মধ্যেও দান করা
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা হাদীসে জোর দেয়া হয়েছে তা হলো অন্যের কল্যাণ করা ও দারিদ্র্যের মধ্যেও সাহায্য দেয়া। নবী (সাঃ) বলেছেন :
“
বিশ্বাসের তিনটি নিদর্শন রয়েছে : দারিদ্র্যের মাঝে থেকে দান করা , অন্যের প্রতি ইনসাফ , এবং জ্ঞান সন্ধানকারীকে জ্ঞান দান করা।”
দারিদ্র্যের ভেতর থেকেও দান করা আত্মগঠনের উপর কী প্রভাব ফেলে তা বর্ণনা করে হাফিয বলেন :‘
দারিদ্র্যের ভিতর থেকে সংগ্রাম করো হাসি খুশী ও পূর্ণ সত্তার মাতাল হতে , এ সঞ্জীবনী সুরা একজন দরিদ্রকে ক্বারুনে (মূসা (আঃ)-এর সময়কার বিরাট ধনী ব্যক্তি) পরিণত করে।’
রোযা রাখো ও ভিক্ষা দাও
ইমাম কাযেম (আঃ) এর এর এক সাথী বলেছেন :
আমি হযরতের কাছে আমার দারিদ্র্য নিয়ে অভিযোগ করলাম এবং বললাম যে আমি এত দরিদ্রতায় ভুগছি যে অমুক তার নিজের জামা খুলে আমাকে পড়তে দিয়েছে। হযরত ইমাম (আঃ) বললেন :“
রোযা রাখো ও ভিক্ষা দাও!”
আমি বললাম :“
আমি কি ভিক্ষা দিতে পারি যা আমি ভিক্ষা হিসেবে পেয়েছি , তা যত অল্পই হোক ?”
ইমাম (আঃ) বললেন :“
দান করো যা তোমাকে আল্লাহর রিয্ক হিসেবে দান করেন , এমনকি যদি তা তোমার নিজের জন্য খরচ করা উচিত।”
বড় পরিবারের কারণে বেকার ব্যক্তির জটিলতায় থাকা অবস্থায় তাকে সাহায্য করা
হযরত শেইখের এক বন্ধু বলেন : আমি বেকার ছিলাম এবং খুব হতাশ ছিলাম কিছু সময়ের জন্য। তাই আমি তার বাসায় গেলাম এ অবস্থা থেকে মুক্তির পথ পেতে। আমি হযরত শেইখের ঘরে ঢোকার সাথে সাথে তিনি বললেন :
“
তুমি এমন আবরণের নীচে পড়েছো যে আমি এরকম আর দেখি নি! কেন তুমি আল্লাহতে নির্ভর করা ছেড়ে দিয়েছো ? শয়তান তোমাকে এক আবরণে ঢেকে দিয়েছে যে তুমি অনুভব করতে অক্ষম।”
তার কথা আমাকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করলো এবং আমার অন্তরে চাপ সৃষ্টি করলো। তিনি বললেন :‘
তোমার আবরণ দূর হয়েছে , কিন্তু সতর্ক থাকো যেন তা ফেরত না আসে।’
এরপর তিনি বললেন :“
কেউ একজন বেকার এবং অসুস্থ এবং তাকে দুটো পরিবার চালাতে হয়। যদি পার , যাও তার সন্তানদের জন্য কিছু কাপড় কিনে আনো এখানে।”
যদিও আমি বেকার ও কপদর্কহীন ছিলাম আমি এক পুরনো বন্ধুর কাপড়ের দোকানে গেলাম এবং বাকীতে কিছু কাপড় কিনলাম এবং শেইখের কাছে নিয়ে গেলাম। যখন আমি কাপড়ের প্যাকেটটি তার সামনে রাখলাম , হযরত শেইখ আমার দিকে তাকালেন এবং আমার প্রচেষ্টাকে খুব প্রশংসা করলেন।
ডঃ সুবাতি বলেন :
‘
তিনি যে জিনিসটিতে খুব বেশী জোর দিতেন তা হলো অন্যের কল্যাণ করা। তিনি একে খুব বেশী মূল্যবান ভাবতেন এবং আল্লাহর দিকে পথ চলতে তা খুব কার্যকরী বলে মনে করতেন। যখন কেউ আধ্যাত্মিক পথে ব্যর্থ হতো তিনি পরামর্শ দিতেন :
“
অন্যের কল্যাণে অবহেলা করো না এবং অন্যের ভালো করো যতটুকু তোমার পক্ষে সম্ভব।”
‘
অভাবীদের সেবা করো জীবনে যতদিন পারো।
হয় তোমার কথা দিয়ে , পয়সা , কালাম অথবা উদ্যোগ দিয়ে।’
তিনি নিজে ছিলেন অন্যের কল্যাণে অগ্রপথিক। কেউ একজন সমস্যায় পড়লো , সে হযরত শেইখের সাক্ষাতে গেলো। তিনি বললেন :
“
এ লোক তার আত্মীয়দের সাহায্য করে শুধু খুমস দিয়ে এবং তাদের জন্য আর কোন উপকার করে না।”
এর অর্থ হলো শুধু খুমস দেয়াই যথেষ্ট নয়।
বোনের প্রতি কল্যাণ
হযরত শেইখের এক শিষ্য বলেন :
‘
একদিন আমি হযরত শেইখকে অনুরোধ করলাম আমার মৃত বাবার রুহের সাথে যোগাযোগ করার জন্য এবং তাকে জিজ্ঞেস করতে যদি আমি তার জন্য কিছু করতে পারি। হযরত শেইখ বললেন :‘
সূরা হামদ পড়ো।
আমি যখন সূরা হামদ পড়লাম তিনি সাথে সাথেই আমার বাবার চেহারা ও আকার আকৃতি বর্ণনা করলেন যিনি চল্লিশ বছর আগে ইন্তেকাল করেছিলেন। এরপর তিনি আমার বাবার কথা বললেন :
“
আমার কোন কিছুর প্রয়োজন নেই , আমার ছেলেকে বলুন তার ছোট বোনকে ঘরের প্রয়োজনে সাহায্য করতে।”
হযরত শেইখ ও অন্যের সেবা
হযরত শেইখের জীবনের বিভিন্ন দিক গবেষণা করে দেখা যায় যে এ ঐশী ব্যক্তিত্ব ছিলেন দুর্দশাগ্রস্ত লোকদের সেবায় ও তাদের সমস্যা সমাধানের এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। তার পরোপকারের উপর এ বইয়ের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে প্রথম অংশে তৃতীয় অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে আরো কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হলো :
হযরত ওয়ালী আল আসর (আঃ)- এর নির্দেশে ইমামে জুমাকে প্রতিদান
হযরত শেইখের এক শিষ্য বলেন : মরহুম সুহাইল
(রঃ) বলতেন :
আমার দোকান ছিলো তেহরানে আব্বাসী চৌরাস্তায়। একবার গ্রীষ্মের এক গরম দিনে হযরত শেইখ আমার দোকানে এলেন তাড়াহুড়া করে এবং আমাকে কিছু টাকা দিয়ে বললেন :
‘
কোন সময় নষ্ট করো না , এখনই এ টাকা সাইয়্যেদ বেহেশতীর কাছে নিয়ে যাও।’
তিনি ছিলেন আরিয়ানা এভিনিউর মসজিদে হাজ্ব আমজাদের ইমাম। আমি ততক্ষণাৎ তার বাসায় গেলাম ও তাকে টাকাটি দিলাম। পরে আমি সাইয়্যেদকে জিজ্ঞেস করলাম ঘটনাটি কী। তিনি বললেন :
‘
সেদিন আমার ঘরে একজন মেহমান ছিলো এবং আমার ঘরে কোন খাবার ছিলো না। আমি অন্য ঘরে গেলাম এবং হযরত মাহদী (আঃ)-এর (ওয়ালী আল আসর) কাছে আবেদন করলাম এবং তখন এ টাকা আমার কাছে পাঠানো হলো।
হযরত শেইখ নিজে বলেছেন :“
হযরত ওয়ালী আল আসর (আঃ) আমাকে আদেশ করেছিলেন এ টাকাটা সাইয়্যেদ বেহেশতির কাছে তৎক্ষণাৎ দিয়ে আসতে।”
খাবার পরিবেশনের জন্য উপদেশ
বিভিন্নভাবে মানুষের সমস্যা সমাধানের চেষ্টার সাথে সাথে তিনি তার ছোট্ট বাড়িতে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে মেহমান গ্রহণ করতেন। বিশেষ করে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে এবং বিশ্বাসীদের জন্য বাড়িতে খাবার পরিবেশন করার উপরে বিশেষ জোর দিয়েছিলেন।
তিনি তার (শিষ্যদের) পরামর্শ দিতেন তাদের বাড়িতে খাবার পরিবেশন করতে। তিনি বলতেন দরিদ্রকে টাকা দেয়া তাদের বাড়ীতে রান্না করা খাবার পরিবেশনের মতো মূল্যবান নয়।
ডঃ ফারযাম বলেন :
‘
দরিদ্র ও অভাবী মানুষের জন্য খাবার পরিবেশন করা ছিলো প্রায়ই তার পরামর্শ। একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম যদি এর পরিবর্তে টাকা দেই।
তিনি বললেন :
‘
না খাবার দেয়া একটি ভিন্ন জিনিস এবং আরো কার্যকরী।’
সবাই জানতেন পনেরই শাবান হযরত শেইখ ভোজের আয়োজন করতেন রাতের বেলা। মুরগী ও ভাত দিতেন সব শ্রেণীর মেহমানদের যারা তার (অপরের কল্যাণে) ভোজে বসতেন। হযরত শেইখ তার মেহমানদেরকে খুব সম্মান করতেন এবং তাদেরকে স্বাচ্ছন্দ্য দেয়ার চেষ্টা করতেন।
হযরত শেইখ জোর দিতেন বিশ্বাসীদের খাবার পরিবেশনে এবং তার নিজের বাড়িতে খাবার পরিবেশনে এবং অতিথেয়তার ভদ্রতা ও সৌজন্য বজায় রাখাতে যখন তিনি নিজেই ছিলেন অর্থ কষ্টে।
“
আল্লাহ চাইলে তা যথেষ্ট হবে।”
এক ভোজে হযরত শেইখের বাড়িতে এক ভীড় তৈরী হলো দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। এতে দু’
টো তলাই মেহমানে ভর্তি হয়ে গেলো। যদিও প্রায় ত্রিশ কিলোগ্রামের মত চাল রাঁধা হলো তার পরিবার দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো যে হয়তো খাবার সবার জন্য যথেষ্ট হবে না। যখন হযরত শেইখ তাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখলেন তিনি বাবুর্চির দিকে ফিরলেন -যিনি ছিলেন ক্বোমের একজন ধর্ম বিশেষজ্ঞ এবং বললেন :
‘
সাইয়্যেদ আবুল হোসেইন! তারা কী বলছে ? পাতিলের ঢাকনা সরিয়ে একবার দেখো!’
তিনি পাতিল থেকে কিছু চাল হাতে নিয়ে বললেন :
“
আল্লাহ চাইলে তা যথেষ্ট হবে!”
আশ্চর্যজনক যে খাবারে কোন কমতো পড়েই নি বরং দরজায় অনেক লোক যারা তাদের পাত্র নিয়ে হাজির হয়েছিলো তারাও খালি হাতে ফেরে নি।
অন্যের কল্যাণ করা নেয়ামত
অন্য লোকের ভালো করা একজন মানুষের আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত জীবনে অনেক নেয়ামত আনে। হযরত শেইখের মতে অন্যের কল্যাণে সবচে’
গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামত হলো অন্তরের উজ্জ্ব ¡লতা , দোয়া ও মোনাজাতের জন্য যথাযোগ্য মনের অবস্থা এবং আল্লাহর নৈকট্য।
নীচে আনন্দদায়ক ও শিক্ষামূলক স্মৃতিচারণ উল্লেখ করা হলো যা অন্যের কল্যাণ করার নেয়ামত সম্পর্কিত :
হযরত আব্দুল আযীম হাসানীর মর্যাদা
হযরত শেইখের এক বন্ধু বলেনঃ
‘
হযরত শেইখ ও আমি সাইয়্যেদ আল কারীম (আঃ)- এর যিয়ারতে গেলাম। হযরত শেইখ হযরত আব্দুল আযীম (আঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন :
“
আপনি কীভাবে এ মাক্বাম (মর্যাদা) অর্জন করলেন ?”
হযরত আব্দুল আযীম হাসানী উত্তর দিলেন :‘
অন্য লোকের কল্যাণ করার মাধ্যমে ; আমি কোরআনের কপি হাতে লিখতাম , খুব কষ্টে তা বি ক্রি করতাম এবং যা পেতাম তা দরিদ্রদের দিয়ে দিতাম।’
ট্যাক্সী ড্রাইভারের সেবার ফলে নেয়ামত
হযরত শেইখের এক শিষ্য বলেন : 1958 অথবা 1959 সনে আমি ট্যাক্সী ড্রাইভার হিসাবে কাজ করতাম। একবার আমি‘
বুযার জুমিহরি ঘারবি’
এভেনিউতে ছিলাম। সেদিন কোন বাস চলছিলো না। অনেক মানুষ ট্যাক্সীর জন্য লাইন ধরে ছিলো। আমি দেখলাম দুজন মহিলা , একজন লম্বা ও একজন খাটো , আমাকে থামার জন্য ইশারা করলো। তারা বললো তাদের একজন যাবে লশকর স্কোয়ারে এবং অন্যজন আরিয়ানা এভিনিউতে। প্রত্যেকেই পাঁচ রিয়াল করে দেবে। আমি তাদেরকে তাদের গন্তব্যে নিতে রাজী হলাম।
লম্বা মহিলা নেমে গেলেন এবং তার ভাড়া দিয়ে দিলেন। এরপর আমি আরিয়ানা এভিনিউর দিকে গেলাম খাটো মহিলার গন্তব্যের দিকে। সে ছিলো একজন তুর্কী এবং ফারসী বলতে পারতো না। আমি দেখলাম সে বিড় বিড় করছে :‘
হে আল্লাহ! আমি একজন তুর্কী এবং ফারসী জানি না এবং আমি জানি না কীভাবে আমার বাসায় যেতে হয়। প্রত্যেক দিন আমি বাসে উঠি এবং আমার বাসার কাছে দুই কিরানে (রিয়াল) দিয়ে নেমে যাই। আমি সকাল থেকে এতগুলো কাপড় ধুয়েছি শুধু দুই তোমানের জন্য। এখন আমাকে পাঁচ রিয়াল দিতে হবে ট্যাক্সী ভাড়ার জন্য।’
আমি তাকে বললাম :‘
চিন্তা করবেন না , আমিও একজন তুর্কী , আমি আরিয়ানা এভিনিউতে যাচ্ছি এবং আপনাকে আপনার বাড়িতে নামিয়ে দিবো।’
এতে তিনি খুব খুশী হলেন।
আমি শেষ পর্যন্ত ঠিকানা বের করলাম এবং থামলাম তার নামার জন্য। তিনি একটি দুই তোমানের নোট বের করে আমাকে সাধলেন।
আমি বললাম তার পয়সা দেয়ার দরকার নেই। খোদা হাফেজ বলে গাড়ী চালিয়ে চলে আসলাম।
দু’
দিন পর আমি হযরত শেইখের সাথে সাক্ষাত করলাম আমার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে। তিনি তার সাধারণ কক্ষটিতে বসেছিলেন অন্য কিছু লোকের সাথে। সালামের পর শেইখ আমার দিকে তাকালেন ও আমার মন পড়ে বললেন :
“
তুমি বৃহস্পতিবার রাতগুলোতে অপেক্ষা করছো ; তুমি উপস্থিত থাকবে।”
আমি প্রতিদিন (ধর্মীয়) কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করছিলাম হযরত ওয়ালী আল আসর (আঃ) এর সাথে সম্পর্কিত এবং যা তিনি বুঝিয়েছিলেন‘
তুমি উপস্থিত থাকবে’
বলে সেটা হলো আমি উপস্থিত থাকবো ইমাম মাহদী (আঃ)-এর পুনরাগমনের সময়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের করা পূর্ণ রহমতের কারণে হযরত শেইখের কথা আমাকে বিশেষ ভাবে স্পর্শ করলো এবং আমরা সকলে একত্রে অনেক কাঁদলাম , হযরত শেইখ তখন বললেনঃ
“
তুমি জানো কী ঘটেছে যে তুমি আমার কাছে এসেছো ? সেই খাটো মহিলাটি যে তোমার গাড়িতে উঠছিলো এবং তুমি তার কাছ থেকে কোন টাকা নাও নি , সে তোমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করায় সর্বশক্তিমান আল্লাহ তার দোয়ায় সাড়া দিয়েছেন এবং তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন।”
অন্ধ লোকের সাহায্য করাও অন্তরের জ্যোতি
সেই একই লোক বর্ণনা করেছেন :
‘
একদিন আমি ঐ একই ট্যক্সী চালাচ্ছিলাম সালসাবিল এভিনিউতে যখন আমি দেখলাম একজন অন্ধ মানুষ অপেক্ষা করছে রাস্তার পাশে কেউ তাকে সাহায্য করবে এ আশায়। আমি সাথে সাথে থামলাম এবং তাকে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় তিনি যেতে চান।
‘
আমি রাস্তা পার হতে চাই’
-অন্ধ লোকটি বললো।
‘
সেখান থেকে কোথায় যেতে চান ?-আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘
না আমি আপনাকে আর বিরক্ত করবো না’
, বললেন মানুষটি।
আমি নাছোড়বান্দা হওয়ায় তিনি বললেন তিনি হাশেমী এভিনিউতে যাবেন আমি তাকে তার গন্তব্যে নিয়ে গেলাম।
পর দিন আমি যখন হযরত শেইখের সাথে সাক্ষাত করতে গেলাম তিনি সাথে সাথে বলে উঠলেন:
‘
কী সেই অন্ধ লোকটির ঘটনা যাকে তুমি গতকাল গাড়ীতে পৌঁছে দিলে ?”
আমি তাকে ঘটনাটি বললাম। তিনি বললেন :
‘
গত কাল থেকে যখন তুমি তা করেছো সর্বশক্তিমান আল্লাহ একটি আলো সৃষ্টি করেছেন যা বারযাখকে এখনও আলোকিত করে রেখেছে।’
চল্লিশজনকে খাওয়ানো ও রোগীর আরোগ্য লাভ
হযরত শেইখের এক বন্ধু বলেন :
“
আমার ছেলে একটি দুর্ঘটনার কারণে হাসপাতালে ভর্তি ছিলো। আমি হযরত শেইখের কাছে গেলাম এবং তাকে জিজ্ঞেস করলাম কী করবো। তিনি বললেন :
“
দুশ্চিন্তা করো না। একটি ভেড়া কেনো। প্রতিবেশী চল্লিশ জন শ্রমিক জড়ো করো এবং‘
আবগুশত’
(গোস্তের তরকারী) তৈরী করে তাদেরকে পরিবেশন করো এবং একজন ধর্মপ্রচারককে ভোজের শেষে দোয়া করতে বলো। যখন ঐ চল্লিশজন লোক বলবে‘
আমিন’
তোমার ছেলে সুস্থ হয়ে যাবে ও বাসায় ফেরত আসবে।”
খরাতে বৃষ্টি
হযরত শেইখের ছেলে বলেন : বেশ কয়েকজন চাষী সারি (ইরানের মাযান্দারান প্রদেশের রাজধানী) থেকে আমার বাবার কাছে এলো এবং বললো‘
সারি’
-তে চরম খরা চলছে এবং সব গাছ শুকিয়ে গেছে এবং লোকেরা চাপের মধ্যে আছে । আমার বাবা বললেন :“
যাও একটি গরু জবাই করো ও লোকেদের খাওয়াও!”
চাষীরা‘
সারি’
তে একটি টেলিগ্রাম পাঠালো একটি গরু জবাই দেয়ার জন্য এবং এক হাজার লোককে খাওয়ানোর জন্য।
বলা হয়েছে সেই ভোজের সময় এত বেশী বৃষ্টি হয়েছিলো যে অতিথিদের জায়গামত পৌঁছাতে সমস্যা হয়েছিলো। এ ঘটনা হযরত শেইখের সাথে ঐ এলাকার লোকদের একটি সুসম্পর্ক সৃষ্টি করলো। তাকে বেশ কয়েকবার‘
সারি’
তে বৈঠকের জন্য দাওয়াত করা হয়েছিলো।
সন্তান লাভের জন্য লোক খাওয়ানো
সেই একই ব্যক্তি বর্ণনা করেন : কেউ একজন সন্তান লাভে ব্যর্থ হলো দেশের ভিতরে ও বিদেশে চিকিৎসার পরও। হযরত শেইখের এক বন্ধু তাকে হযরত শেইখের কাছে নিয়ে এলো এবং তাকে সমস্যার কথা বললো। তিনি বললেন :
“
আল্লাহ তাদেরকে দু’
টো সন্তান দিবেন এবং প্রত্যেকের জন্য একটি গরু তারা অবশ্যই জবাই করবে এবং লোকদের মাঝে বিলি করবে।”
সে জিজ্ঞেস করলো কীসের জন্য। হযরত শেইখ বললেন :
“
আমি ইমাম রেজা (আঃ) কে অনুরোধ করলাম এবং তিনি রাজী হলেন।”
যখন প্রথম সন্তানটি জন্ম গ্রহণ করলো তার বাবা একটি গরু জবাই করে হযরত শেইখের আদেশে তা লোকদের দিলেন। দ্বিতীয় সন্তানটি জন্ম নেয়ার পর তার কিছু আত্মীয় তাকে গরু জবাই করা থেকে এবং লোকদের খাওয়ানো থেকে বিরত রাখলো। এই প্রতিবাদ করে যে শেইখ রজব আলী কি কোন ইমামের সন্তান অথবা সে মোযেযা দেখাচ্ছে! সে কে এ ধরণের আদেশ দেয়ার ? এভাবে তারা তাকে বিরত রাখলো ওয়াদা রক্ষায়। হযরত শেইখের সাথে যে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো সে যখন তাকে বললো ওয়াদা রক্ষা করতে সে তাকে বললো তা সম্পূর্ণ কুসংস্কার। কিছুদিন পর দ্বিতীয় সন্তানটি মারা গেলো।
ক্ষুধার্ত পশুকে খাওয়ানোর নেয়ামত
হযরত শেইখের এক বন্ধু বলেন যে হযরত শেইখ তাকে বলেছেন :“
কেউ একজন তেহরানের পুরোন গলিগুলো পার হচ্ছিলো যখন হঠাৎ সে দেখলো একটি কুকুরকে একটি ড্রেনের ভিতরে যার বাচ্চাগুলো তার বুকে ধাক্কা দিচ্ছিলো দুধের জন্য , কিন্তু কুকুরটি ছিলো খুব ক্ষুধার্ত তাই তার দুধ ছিলো না বাচ্চাদের দেয়ার জন্য এবং খুব কষ্টে ছিলো এ কারণে। এ দৃশ্য দেখে ঐ লোকটি তখনই চলে গেলো কাছের এক কাবাবের দোকানে এবং বেশ কয়েকটি কাবাব এনে কুকুরটিকে দিলো----। সে রাতেই সকালের দিকে তাকে আল্লাহ বর্ণনাতীত এক রহমত করলেন।”
বর্ণনাকারী বলেন : যদিও হযরত শেইখ কখনো বলেন নি কে সেই ব্যক্তি ছিলো। প্রমাণ ইঙ্গিত করে যে তিনি নিজেই ছিলেন সেই ব্যক্তি।
ডঃ ফারযাম বলেন : যখনই আমি হযরত শেইখকে বিদায়ের সময় জিজ্ঞাসা করতাম তিনি আমাকে কোন উপদেশ দিবেন কিনা। তিনি বলতেন :“
মানুষের কল্যাণ করতে ভুলো না , এমনকি পশুপাখিরও।”
আল্লাহর ভালোবাসায় অন্যের কল্যাণ
অন্য লোকের কল্যাণের পিছনে কী নিয়ত ছিলো এবং কীভাবে তা সম্পাদন করা হলো তা হযরত শেইখের দৃষ্টিতে সবচে’
গুরুত্বপূর্ণ। হযরত শেইখ বিশ্বাস করতেন ইমামরা (আঃ) ও আল্লাহর বন্ধুরা যেভাবে অন্যের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন ঠিক আমাদেরও সেভাবে অন্যের সেবায় থাকতে হবে। তাদের সেবায় তাদের কোন লক্ষ্য ছিলো না একমাত্র আল্লাহর কারণে এবং তাঁর ভালোবাসা ছাড়া। এ বিষয়ে তিনি বলতেন :
“
অন্যের প্রতি কল্যাণকে অবশ্য হতে হবে আল্লাহমুখী হওয়ার কারণে ;
)
إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ(
“
আমরা তোমাদের খাওয়াই শুধু আল্লাহর কারণে।”
(সূরা ইনসান- 09)
কত ভালোবাসায়না তোমরা পয়সা ব্যয় কর তোমাদের সন্তানদের জন্য এবং তাদের ভালোবাসো! শিশু সন্তানরা কি কিছু করতে পারে তাদের পিতা-মাতার জন্য ? পিতা-মাতারা তাদের বাচ্চাদের প্রেমে থাকে এবং তাদের জন্য পয়সা খরচ করে ভালোবাসায়। কেন তোমরা তাহলে আল্লাহর সাথে একই আচরণ করো না ? কেন তোমরা তাকে ততটুকু ভালোবাসো না যতটুকু ভালোবাসো তোমাদের সন্তানদের ?! এবং যদি হঠাৎ করে তোমরা কারো উপকার করে ফেলো তোমরা তার জন্য পুরস্কার চাও!”
অন্যের সেবার বিষয়ে ইমাম খোমেইনী (রঃ)- এর উপদেশ
এ অধ্যায়ের শেষে অন্যের সেবার বিষয়ে ইমাম খোমেইনী (রঃ)- এর দিক নির্দেশনা যথোপযুক্ত হবে। ইমাম খোমেইনী তার ছেলে আহমদ (রঃ)-কে অসিয়ত করেছেন :
“
হে আমার সন্তান! মানবিক দায়িত্ব এড়িয়ে যেও না , তা হলো আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব পালন , জনগণের কল্যাণের আকারে। কর্মকর্তা ও জনগণের দায়িত্বে যারা রয়েছে শয়তান তাদের মাঝে এ মাঠে কম ঘোড়া চালায় না এবং পদের জন্য সংগ্রাম করো না , না আধ্যাত্মিক না পৃথিবীর পদ ঐশী জ্ঞান লাভ ও আল্লাহর বান্দাদের সেবা করার বাহানায়। এ ধরণের পদ মর্যাদার প্রতি মনোযোগই হচ্ছে শয়তানী। তার জন্য সংগ্রাম করা থেকে দূরে থাকো। আল্লাহর সতর্কবাণীতে কান দাও আন্তরিকভাবে এবং ঐ দিকেই পথ পরিক্রম করো :
)
قُلْ إِنَّمَا أَعِظُكُمْ بِوَاحِدَةٍ أَنْ تَقُومُوا لِلَّهِ مَثْنَى وَفُرَادَى(
“
বলো , আমি তোমাদের একটি বিষয়ে সতর্ক করি যে , তোমরা দাঁড়িয়ে যাও আল্লাহর সামনে (হতে পারে) জোড়ায় অথবা (হতে পারে) একাই ।”
(সূরা সাবা-46)
পথ পরিক্রমের শুরুতেই যে ব্যবস্থা নাও সেটিই আল্লাহর জন্য উত্থান। ব্যক্তিগত কাজে ও সামাজিক কর্মকাণ্ডেও ; চেষ্টা করো সফল হতে প্রথম পদক্ষেপে যা যুবক বয়সে অর্জন করা সহজ। নিজেকে তোমার বাবার মত বৃদ্ধ হতে দিও না। তাতে তুমি হয় একই জায়গাতে দাঁড়িয়ে থাকবে অথবা পিছনের দিকে যাবে। এতে দরকার সতর্ক পাহারা ও আত্ম -পর্যালোচনা। যদি কোন মানুষ জীন ও মানবজাতির সার্বভৌমত্ব অর্জন করে এক ঐশী উদ্দেশ্যে সে হলো ঐশী জ্ঞানের অধিকারী এবং এ পৃথিবীতে একজন আত্ম -সংযমী সাধক ; কিন্তু যদি সে শরীরীভাবে ও শয়তানীর কারণে উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে , সে যাই অর্জন করে , এমনকি তা যদি একটি তাসবীহও হয় তাহলে সে আল্লাহর কাছ থেকে সেই অনুপাতে দূরে সরে যাবে।”