নবম অধ্যায়
আল্লাহর বন্ধুদের হজ্ব
হযরত শেইখ অর্থনৈতিক কারণে কখনো বাধ্যতামূলক হজ্বে যেতে পারেন নি। তারপরও কিছু হজ্ব যাত্রীর প্রতি তার দিক নির্দেশনা ইঙ্গিত দেয় যে তিনি আল্লাহর বন্ধুদের হজ্বের রহস্য সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন তখনই প্রকৃতপক্ষে হজ্ব সংগঠিত হবে যখন হাজ্বী কাবার প্রভুর সাথে প্রেমে থাকবে যেন সে হজ্বের আনুষ্ঠানিকতাগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কেও বুঝতে পারে। তাই একজন তার সাথে একত্রে হজ্বে যেতে চায় শুনে তিনি বলেন :
“
প্রথমে জানো কীভাবে একজন প্রেমিক হতে হয়। এরপর মক্কায় একত্রে যাওয়ার জন্য আসো ।”
হজ্ব যাত্রীদের প্রতি হযরত শেইখের উপদেশ
1. হযরত ওয়ালী আল আসর (আঃ) সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা
হযরত শেইখের এক পুরানো শিষ্য বলেন : প্রথম বার যখন আমি হজ্বের জন্য মক্কা যাচ্ছিলাম আমি তার কাছে গেলাম দিক নির্দেশনা পাওয়ার জন্য :
“
তোমার রওয়ানা দেয়ার সময় থেকে চল্লিশ দিন এ আয়াতে কারিমা পড়ো :
)
رَبِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِي مُخْرَجَ صِدْقٍ وَاجْعَلْ لِي مِنْ لَدُنْكَ سُلْطَانًا نَصِيرًا(
‘
হে আমার রব আমাকে প্রবেশ করান সত্য ও সম্মানের দরজা দিয়ে এবং একইভাবে বের করে আনুন সত্য ও সম্মানের দরজা দিয়ে এবং আমাকে দান করুন আপনার কাছ থেকে অনুমোদন ও সাহায্য।’
(সূরা বনি ইসরাইল : 80)
হয়তোবা তুমি হযরত মাহদী (আঃ) এর সাক্ষাত পাবে। তিনি আরো বলেন :“
এটি কীভাবে সম্ভব যে একজনকে কারো বাসায় দাওয়াত করা হবে আর সে বাড়ির মালিককে দেখবে না! ? পূর্ণ সতর্ক হও যেন সেই মহিমান্নিত ইমাম (আঃ)-কে দেখতে পাও হজ্বের কোন একটি আনুষ্ঠানিকতার সময় , ইনশাআল্লাহ।”
2. ইহরাম অবস্থায় আল্লাহ ছাড়া আর কোন কিছুর ভালোবাসা হারাম করে নাও
“
যে ব্যক্তি মিক্বাতে ইহরাম পড়বে তার জানা উচিত যে , সে এখানে এসেছে নিজেকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু থেকে বিরত রাখতে এবং যে মুহূর্ত থেকে সে বলে‘
লাব্বায়েক’
সে আল্লাহর দাওয়াত গ্রহণ করেছে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুকে নিজের জন্য হারাম করেছে। আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কোন বিষয়ে আগ্রহ হারাম এবং তার জীবনের শেষ পর্যন্ত তার উচিত নয় আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুতে মনোযোগ দেয়া।”
3. আল্লাহকে প্রাথমিকভাবে জানা সম্পূর্ণ করে নেয়া কাবা প্রদক্ষিণ করার সময়
“
কাবাকে প্রদক্ষিণ করা মানে বাইরের দিক থেকে ঘরের চারদিকে ঘোরা , কিন্তু তোমাদের জানা উচিত যে এই প্রদক্ষিণের অর্থ হচ্ছে আল্লাহকে একজন মানুষের জীবনের অক্ষরেখা বানিয়ে নেয়া এবং তাঁর মাঝে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাওয়া। চেষ্টা করো একটি আধ্যাত্মিক অবস্থা পেতে যেন তোমরা তাঁকে প্রদক্ষিণ করো এবং তাঁর জন্য উৎসর্গ হয়ে যাও।”
4. কাবার ছাদের পানি পড়ার নলের নীচে দোয়া
“
হিজরে ইসমাইল এবং কাবার ছাদের পানি পড়ার সোনালী রঙের নলের নীচে যেখানে হাজীরা আল্লাহর কাছে অনুনয় করে তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য তুমি সেখানে বলো :‘
হে আল্লাহ , আমাকে প্রশিক্ষণ দিন আপনার দাসত্ব করার জন্য এবং আপনার ওয়ালী হুজ্জাত ইবনুল হাসান (আঃ) কে সাহায্য করার জন্য।’
5. মিনাতে শরীরী নফসকে হত্যা করা
“
তোমরা যখন মিনাতে যাও , কোরবানীর জায়গায় তোমরা কী কর ? তোমরা কী জানো কোরবানীর দর্শন কী ? তোমাদের উদ্বুদ্ধকারী শরীরী নফসকে উৎসর্গ করো!
)
فَتُوبُوا إِلَى بَارِئِكُمْ فَاقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ(
‘
তাই ফেরো (অনুতপ্ত হয়ে) তোমার সৃষ্টিকর্তার দিকে এবং নিজেদের হত্যা করো (জালেমদের)।’
(সূরা আল বাকারা -54)
তোমার শরীরী নফসের মাথা আলাদা করে দাও এবং ফিরে আসো। তোমার শরীরী নফসকে বিদায় করে দাও , বরং তা না হলে ফিরে আসার পর তা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে।”
একমাত্র জায়গা যেখানে তারা ভালোবাসা প্রদর্শন করলো
(হজ্ব থেকে) ফিরে এসে আমি হযরত শেইখের সাক্ষাতে গেলাম এবং বললাম :
‘
আমি জানতে চাই এর ফলাফল কী’
।
তিনি বললেন :
“
তোমার মাথা নীচু করো ও আল-হামদ তেলাওয়াত করো!”
তখন তিনি এক মুহূর্ত ভাবলেন এবং বললেন , আমি মসজিদুল হারামের কোন জায়গা দিয়ে অতিক্রম করেছি এবং আমার অবস্থান সম্পর্কেও এমনভাবে যে তিনি বললেন :
“
একমাত্র জায়গা যেখানে তারা তোমার প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছে তা হচ্ছে বাক্বী কবরস্থানে যেখানে তুমি এমন অবস্থায় ছিলে এবং এগুলো দাবী করেছিলে।”
আমি সেখানে আল্লাহকে যা অনুরোধ করেছি তা তার কাছে প্রকাশ করা হয়েছে।
‘
হজ্ব থেকে ফেরার পর ভোজ’
হজ্ব থেকে ফেরার পর আমি হযরত শেইখকে ও অন্যান্য কয়েকজনকে আমার বাড়িতে‘
হজ্ব ফেরত ভোজে’
দাওয়াত করলাম। আমরা ভোজের জন্য‘
চেলো কাবাব’
তৈরী করেছিলাম। আমরা বারান্দায় একটি আলাদা দস্তরখান দিলাম হযরত শেইখের জন্য ও কিছু ব্যক্তিগত মেহমানের জন্য। তা লক্ষ্য করে শেইখ আমাকে ডাকলেন এবং বললেন :
“
কেন তুমি লোক দেখাও ? নিজের বিষয়ে বেশী গর্ব করো না। লোকদের মাঝে পার্থক্য করো না ; তাদের সাথে সমানভাবে আচরণ করো। কেন তুমি কিছু লোককে বেশী মূল্য দিবে ? না , আমি অন্যদের সাথে মিশে যাবো। আলাদা করা যাবে না।”
হজ্বের রহস্যাবলী ইমাম খোমেইনী (রঃ)-এর বক্তব্যে
এটি জানা যথাপোযুক্ত হবে যে হযরত শেইখ হজ্বের যে দর্শন উল্লেখ করেছেন নিজের অতিন্দ্রীয় জ্ঞানের মাধ্যমে তা ইমাম খোমেইনী (রঃ) হজ্বের রহস্য উল্লেখ করে যা বলেছেন তার খুবই কাছাকাছি। এখানে তা উল্লেখ করা হলো :
বার বার‘
লাব্বায়েক’
বলার রহস্য
বার বার লাব্বায়েক বলা তাদের জন্য সত্য যারা আল্লাহর ডাক শুনেছে তাদের কান দিয়ে ও তাদের সত্তা দিয়ে এবং তারা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিচ্ছে তার সব নামের সার সংক্ষেপ নাম নিয়ে। বিষয়টি হচ্ছে‘
পরম উপস্থিতির’
সামনে উপস্থিত হওয়া এবং মাশুকের সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করা। যদিও যিকরকারী এ মুহূর্তে নিজের ভেতর হারিয়ে গেছে এবং বার বার ডাকে সাড়া দিচ্ছে এবং এর পর পরই অস্বীকার করছে সম্পর্ক (আল্লাহ ছাড়া অন্যের সাথে) এর পরম অর্থে (এবং) শুধু খোদার সাথে সম্পর্ক স্বীকার করা নয় যা আল্লাহর জন্য উৎসর্গিতরা জানে। সম্পর্ক ছেদ করা সব ধাপকে অন্তর্ভুক্ত করে এ পৃথিবী বিলীন হয়ে যাওয়া পর্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তিদের দৃষ্টিতে এবং অন্তর্ভুক্ত করে সব সতর্কতামূলক ও পছন্দনীয় বিষয়সমূহ। উদাহরণ স্বরূপ : আল হামদ লাকা ওয়াল নি’
মাতা লাকা----- উৎসর্গ করে প্রশংসাকে ও নেয়ামতকে পরম সত্তাকে এবং শিরক অস্বীকার করে। এটি জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছে পরম একত্ববাদ , অর্থাৎ কোন প্রশংসা ও নেয়ামত যা ঘটে (আল্লাহ ছাড়া অন্যের)। এ উচ্চ উদ্দেশ্য বিজয়ী থাকে প্রত্যেক মওক্বীফ (অবস্থায়) এবং মাশআর (ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের স্থান) , প্রত্যেক থামা ও প্রত্যেক চলায় এবং প্রত্যেক বিশ্রাম এ প্রত্যেক কাজে। এর বিরোধিতা করা মানে সাধারণভাবে শরীক করা। যা হোক আমরা অন্ধ হৃদয়ের যারা , তারা সবাই ভুগছি।
তওয়াফের রহস্য
‘
আল্লাহর ঘরের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করার অর্থ হচ্ছে তুমি আল্লাহ ছাড়া কাউকে প্রদক্ষিণ করবে না।
আল্লাহর পবিত্র ঘরকে প্রদক্ষিণ করার সময়- যা আল্লাহকে ভালোবাসার নিদর্শন , অন্যদেরকে তোমার হৃদয় থেকে বের করে দাও এবং সমস্ত ভয়কে বিতাড়িত করো তোমার সত্তা থেকে আল্লাহর ভয় ছাড়া এবং আল্লাহর প্রেমের সাথে সংগতি রেখে অস্বীকার করো বড় ও ছোট মূর্তিদের , তাগুত ও তার সাথীদের , যেগুলি অস্বীকার করেছে আল্লাহ ও তার বন্ধুরা এবং পৃথিবীর সকল মুক্তিপ্রাপ্তরা এ থেকে মুক্ত।’
আল্লাহর কাছে বায়াত (অনুগত্যের শপথ)
“
হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করার সময় আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের শপথ করো যে তুমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের এবং ধার্মিক ও মুক্তিপ্রাপ্তদের শত্রুদের শত্রু হবে এবং তাদের মানবে না ও তাদের দাসত্ব করবে না , তারা যে-ই হোক এবং যেখানেই হোক ; এবং অন্তর থেকে আল্লাহর শত্রুদের ভয় দূর করো , যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে বড় শয়তান (যুক্তরাষ্ট্র) এমনও যদি হয় তারা খুন খারাবী , অত্যাচার ও অপরাধী কাজে অধিকতর শক্তিশালী।”
সা-ই (প্রচেষ্টা) মাশুককে পাওয়ার জন্য
“
সাফা ও মারওয়ার মাঝে‘
সা-ই’
করার সময় চেষ্টা করো আন্তরিকভাবে ও সত্যবাদীদের সাথে মাশুককে খুঁজে পেতে ; যখন তুমি তাঁকে পাবে তখন সব দুনিয়াবী গিঁট খুলে যাবে , সব সন্দেহ দূরীভূত হবে , সব পাশবিক ভয় ও আশা মুছে যাবে এবং শয়তান ও মূর্তির বাঁধন যা আল্লাহর দাসদের বন্দি করে রাখে এবং মানতে বাধ্য করে , তা ছিঁড়ে যাবে।”
মনোযোগ ও ইরফান (আধ্যাত্মিকতা) মাশ’
আরে ও আরাফাতে
“
মাশ’
আর আল-হারাম ও আরাফাতে যাও মনোযোগ ও আধ্যাত্মিক অবস্থাসহ এবং যে কোন অবস্থানেই (মওক্বীফ) নিজেকে আরো নিশ্চিত করো আল্লাহর অঙ্গীকার সম্মন্ধে এবং’
নির্যাতিতদের রাজত্বে। নিরবতা ও গাম্ভীর্যের সাথে সত্যের নিদর্শনগুলোর উপর ভাবো এবং চিন্তা করো পৃথিবীর দাম্ভিক শক্তির হাত থেকে দরিদ্র ও নির্যাতিতদের মুক্ত করার জন্য এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে অনুরোধ করো ঐ পবিত্র স্থান গুলোতে তোমার মুক্তির পথ দেখাতে।”
মীনাতে কোরবানী করার রহস্য
“
এর পর মীনাতে যাও এবং সত্যিকার আকাঙ্ক্ষা খুঁজে নাও। যা হচ্ছে তোমার সবচে’
ভালোবাসার জিনিসকে পরম মাশুকের পথে কোরবানী করার স্থান। আর জেনে রাখো তুমি পরম মাশুকের কাছে পৌঁছুবে না যতক্ষণ না তুমি ভালোবাসায় এসব জিনিসকে পরিত্যাগ করতে না পারো। যার উপরে রয়েছে আত্মপ্রেম ও এ পৃথিবীর (বস্তুর) প্রতি ভালোবাসা।”
রজম-ই-আক্বাবাত (শয়তানের প্রতি পাথর ছোঁড়া)
“
তোমরা যাও ঐশী ভ্রমণে শয়তানকে পাথর ছুঁড়তে। যদি তুমি , খোদা না করুক , শয়তানদের বাহিনীর একজন হও তুমি পাথর নিজের দিকেই ছুঁড়বে। তোমার ঐশী ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া উচিত যেন তোমার পাথর মারা , দয়ালু খোদার বাহিনীর কর্তৃক শয়তানকে পাথর ছোঁড়ার মত হয়।”