দশম অধ্যায়
আল্লাহর বন্ধুদের ভয়
আল্লাহর প্রেম আলোচনা করার পর প্রথম যে বিষয়টি আসে তা হলো যদি আল্লাহ দয়ালু ও স্নেহশীল হন এবং তার প্রেম যদি বিবর্তনের জন্য সবচে’
গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হয় তাহলে কেন ইসলামী কিতাবগুলোতে আল্লাহভীতিকে এত জোর দেওয়া হয়েছে। কেন পবিত্র কোরআনে আল্লাহভীতিকে আলেমদের সবচে’
সম্মানীয় গুণ বলা হয়েছে ? সবশেষে ভালোবাসা ও ভয় কি সাযুজ্যপূর্ণ ?
উত্তর হচ্ছে‘
হ্যাঁ’
; হযরত শেইখ একটি আনন্দদায়ক উদাহরণ দিয়েছেন ভয় ও প্রেমের সাযুজ্যের উপর যা এ অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে। তার আগে ভয় ও আল্লাহ প্রেমের অর্থ আরেকবার দেখে নেই।
আল্লাহর ভয়-এর অর্থ
ঐশী ভয় ও প্রেম ব্যাখ্যার প্রথম বিষয়টি হচ্ছে আল্লাহর ভয় গুনাহ ও খারাপ কাজ করার ভয়। ইমাম আলী (আঃ) বলেছেন :
‘
ভয় পেয়ো না নিজের গুনাহ ছাড়া এবং আশা করো না তোমার রবকে ছাড়া।’
আল্লাহকে ভয় করো না
একদিন আলী (আঃ) কারো মুখোমুখি হলেন যার চেহারা ভয়ে পরিবর্তন হয়ে গেছে , তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন :
“
তোমার কী হয়েছে ?”
লোকটি বললো :
‘
আমি আল্লাহর ভয়ে ভীত।’
ইমাম আলী (আঃ) বললেন :
“
আল্লাহর বান্দাহ! তোমার গুনাহকে ভয় করো এবং ভয় করো ঐশী ন্যায়বিচারের। তাঁর দাসদের বিরুদ্ধে তোমার অন্যায়ের বিচারে! আল্লাহকে মানো যা তিনি তোমার জন্য বাধ্যতামূলক করেছেন এবং অবাধ্য হয়ো না যা তোমার জন্য ভালো সে বিষয়ে। তাই , আল্লাহকে ভয় করো না কারণ তিনি কখনও কারো প্রতি অবিচার করেন না এবং কাউকে শাস্তি দেন না তার প্রাপ্য পরিমাণ ছাড়া।”
বিচ্ছেদের ভয়
তাই কারো উচিত না আল্লাহকে ভয় করা এবং আমাদের উচিত ভয় করা আমাদেরকেই যেন আমরা জটিলতায় জড়িয়ে না যাই আমাদেরই অনুচিত কাজের কারণে। আল্লাহর বন্ধুদের অনুচিত কাজের শাস্তির ভয় সাধারণ মানুষের ভয়ের চাইতে ভিন্ন । যারা তাদের অন্তর থেকে আল্লাহ ছাড়া আর সব কিছুর ভালোবাসা বিতাড়িত করেছে তাদের আল্লাহর প্রতি আনুগত্য না জাহান্নামের ভয়ে , না জান্নাতের আশায় ; তাদের একমাত্র ভয় বিচ্ছেদ। তাদের জন্য আল্লাহর সাথে বিচ্ছেদের কষ্ট জাহান্নামের কষ্টের চেয়ে কষ্টদায়ক। তাই আল্লাহর ওয়ালীদের নেতা আমিরুল মুমিনিন আলী (আঃ) বিলাপ করেন তার দোয়াতে আল্লাহর কাছে এভাবে-
“
তাই যদি আপনি আমাকে শাস্তি দেন আপনার শত্রুদের সাথে , জড়ো করেন আপনার শাস্তিপ্রাপ্ত লোকদের সাথে এবং আমাকে বিচ্ছিন্ন করেন আপনার বন্ধু ও পছন্দনীয়দের কাছ থেকে , তাহলে মনে করুন , হে আল্লাহ , আমার প্রভু , আমার নিরাপত্তারক্ষক এবং আমার রব যে আমি হয়তো আপনার শাস্তি সহ্য করতে পারলাম কিন্তু কীভাবে আমি আপনার বিচ্ছেদ সহ্য করবো (দোয়ায়ে কুমাইল)
হযরত শেইখ তাফসীর করেছেন এ আয়াতেরঃ
)
يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا(
“
তারা ডাকে তাদের রবকে ভয়ে ও আশায়”
(সূরা সাজদাহ-16)
এভাবে :
“
ভয় ও আশা কী ? বিচ্ছেদের ভয় ও তাঁর সাথে মিলনের আশা। এরকমই কথা আমিরুল মুমিনিন হযরত আলীর (আঃ) দোয়ায়ে কুমাইলে :
“
তাই মনে করুন , আমার আল্লাহ----কীভাবে আমি সহ্য করবো আপনার কাছ থেকে বিচ্ছেদ ?”
এবং ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) এর দোয়ায় :
“
আপনার সাথে মিলন হচ্ছে আমার সত্তার ইচ্ছা এবং আপনার দিকেই আমার আকাঙ্ক্ষা ।”
বিখ্যাত সাধক এবং ফক্বীহ মরহুম মুল্লা আহমদ নারাক্বী এ বিষয়ে বলেন :“
ওয়ালীদের সম্রাট দোয়াতে বলেছেন , আমার সত্তা তার জন্য কোরবানী হোক হে আমার রব , হে আল্লাহ , হয়তো আমি আপনার শাস্তি সহ্য করলাম কিন্তু কীভাবে আমি সহ্য করবো আপনার সাথে বিচ্ছেদ , হে বন্ধু ?”
ধাত্রী বাচ্চাদেরকে আগুনের ভয় দেখায় (এ বলে) খেলা করো না হে অমুক , না হয় , আমি তোমার হাতে ও পায়ে আগুন রাখবো ; ছেঁকার দাগ দিবো তোমার চেহারায় ও পিঠে। কিন্তু বিচ্ছেদের শাস্তি ভয় পাইয়ে দেয় সিংহ (হৃদয়) মানুষকে (আলী (আঃ)) , হাজারগুণ বেশী ও আতংক দিয়ে।
মাশুকের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ার ভয়
আল্লাহর বন্ধুরা ভয় করে যদিও তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে। তারা ভয় পায় হয়তো মাশুক সেগুলো পছন্দ করবে না এবং গ্রহণ করবে না :
)
وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آتَوْا وَقُلُوبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَى رَبِّهِمْ رَاجِعُونَ(
“
এবং যারা দান করে এবং তাদের অন্তর থাকে ভয়ে পরিপূর্ণ , কারণ তারা তাদের রবের কাছে ফিরবে।”
(সূরা মুমিনিন-60)
মাশুক , যিনি পরম ও নিখুঁত , তার কাছে গৃহীত হওয়া আল্লাহর ওয়ালীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ , একইভাবে তাঁর কাছ থেকে বিচ্ছেদ হৃদয়বিদারক ও তাদের সহ্য ক্ষমতার বাইরে। এটি এমন জরুরী যে তেহরানের জুময়ার ইমাম বলেছেন যে ইমাম খোমেইনী (রঃ) তার জীবনের শেষ মুহূর্তে জনগণকে বলেছেন আল্লাহর কাছে দোয়া করতে যেন তিনি তাকে গ্রহণ করেন।
এখন দেখুন হযরত শেইখ কীভাবে একটি সুক্ষ্ণ আধ্যাত্মিক বিষয় একটি সাধারণ উদাহরণ দিয়ে বোঝান।
হযরত শেইখের এক শিষ্য বলেন : একবার তিনি (হযরত শেইখ) আমাকে বললেন :
“
হে অমুক! কার জন্য নববধূ নিজেকে সাজায় ?”
আমি বললামঃ‘
স্বামীর জন্য।’
তিনি বললেন :‘
তুমি বুঝেছো ?’
আমি চুপ করে রইলাম। তখন তিনি বললেন :
“
বাসর রাতে নববধূর আত্মীয়-স্বজনরা তাকে যতটুকু সম্ভব সুন্দর করে সাজায় যেন বর তাকে পছন্দ করে। কিন্তু বধূর একটি গোপন অংশ থাকে যা অন্যরা খেয়াল করে না ; সে শংকায় থাকে সে কী করবে যদি বরের আগ্রহ সৃষ্টি করতে না পারে অথবা যদি সে (বর) তার প্রতি ঘৃণা বোধ করে।
কীভাবে একজন দাস , যে জানে না তার কাজ আল্লাহ গ্রহণ করছেন কিনা , ভয় পাবে না ও দুশ্চিন্তা করবে না ?! তুমি কি নিজেকে সাজাও তাঁর অথবা নিজের জন্য এবং লোকদের মাঝে সুনাম অর্জনের জন্য ?!
যখন মানুষ মারা যায় তারা আবেদন করে :
)
رَبِّ ارْجِعُونِ لَعَلِّي أَعْمَلُ صَالِحًا(
“
হে আমার রব! আমাকে ফেরত পাঠান (পৃথিবীর জীবনে) যেন আমি সৎকাজ করি যা আমি অবহেলা করেছি।”
(সূরা মুমিনিন- 99-100)
তাই হযরত শেইখ সব সময় আল্লাহর সাথে মিলনের ভয়ে থাকতেন এবং বলতেন :
তোমরা বলো আল্লাহর ভয় নেই ,
)
وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ(
“
তার জন্য যে তার রবের সামনে দাঁড়াতে ভয় পায়।”
(সূরা নাযিয়াত-40)
কিন্তু আমরা কী করবো যদি তিনি আমাদেরকে পছন্দ না করেন এবং আমাদের কাজ গ্রহণ না করেন ?
এর উত্তরে হযরত শেইখের ছেলে বলেন যে তিনি বলেছেনঃ“
হে রব! কিনে নিন এবং গ্রহণ করুন আমাদেরকে পুরাতন ফালতু জিনিসের মত , যেমন ফেরীওয়ালা ডাক দেয় :‘
আমি ভাঙ্গা ও ফালতু জিনিস কিনি : -হে রব গ্রহণ করুন এবং আমাদেরকে কিনে নিন।”