আধ্যাত্মিক বিস্ময় : শেইখ রজব আলী খাইয়্যাত

আধ্যাত্মিক বিস্ময় : শেইখ রজব আলী খাইয়্যাত0%

আধ্যাত্মিক বিস্ময় : শেইখ রজব আলী খাইয়্যাত লেখক:
: মুহাম্মদ ইরফানুল হক
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ: দর্শন এবং আধ্যাত্মিকতা

আধ্যাত্মিক বিস্ময় : শেইখ রজব আলী খাইয়্যাত

লেখক: মুহাম্মাদ রেইশাহরি
: মুহাম্মদ ইরফানুল হক
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ:

ভিজিট: 28916
ডাউনলোড: 5752

পাঠকের মতামত:

আধ্যাত্মিক বিস্ময় : শেইখ রজব আলী খাইয়্যাত
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 34 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 28916 / ডাউনলোড: 5752
সাইজ সাইজ সাইজ
আধ্যাত্মিক বিস্ময় : শেইখ রজব আলী খাইয়্যাত

আধ্যাত্মিক বিস্ময় : শেইখ রজব আলী খাইয়্যাত

লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বাংলা

তৃতীয় অধ্যায়

আত্মত্যাগ

হযরত শেইখ এর জীবনের বৈশিষ্ট্যগুলোর মাঝে অন্যতম ছিলো অভাবী লোকদের সেবা করা এবং নিজের অভাবের দিনগুলোতেও আত্মত্যাগ করা। ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী আত্মত্যাগ ও পরার্থবাদ হলো সবচেয়ে সুন্দর কল্যাণ ভাবনা , বিশ্বাসের সর্বোচ্চ স্তর এবং সর্বোৎকৃষ্ট নৈতিক নেয়ামত।15

হযরত শেইখ তার দর্জি পেশা থেকে সামান্য মজুরী সত্ত্বেও ছিলেন খুবই দয়ালু , উদার ও পরার্থবাদী। এ লোকটির আত্মত্যাগ সত্যিই বিস্ময়কর ও শিক্ষণীয়।

অন্যদের সন্তানদের প্রতি আত্মত্যাগ

হযরত শেইখ এর এক সন্তান তার মা এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে তার মা বলেছেন : তখন ছিলো দুর্ভিক্ষের সময়। হাসান ও আলী16 বাড়ির ছাদে একটি আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত ছিলো। আমি ওপরে গিয়েছিলাম তারা কি করছে তা দেখতে। আমি দেখলাম তারা একটি চামড়ার ব্যাগ নিয়েছে তা পুড়িয়ে খাওয়ার জন্য। আমি এরকম দৃশ্য দেখে কেঁদে ফেললাম। আমি ছাদ থেকে নেমে কিছু তামা এবং ব্রোন্জ (এর পাত্র) নিয়ে গেলাম কাছের বাজারে। তা বি ক্রি করলাম এবং কিছু রান্না করা ভাত কিনলাম। ফেরার পথে আমি আমার ভাই কাসিম খানের দেখা পেলাম যে ছিল একজন ধনী ব্যক্তি। সে দেখলো আমি খুব অশান্তির মধ্যে আছি। সে আমার অশান্তির কারণ জিজ্ঞাসা করলো। যখন সে ঘটনাটি জানতে পারলো সে বললো : তুমি কি বলছো ? আমি দেখলাম শেইখ রজব আলী লোকেদের মাঝে একশটি চেলো কাবাবের টোকেন বিলি করছে। দান খয়রাত ঘরে শুরু হওয়া উচিত! এ লোক... ? এটা সত্য যে তিনি একজন আত্ম -উৎসর্গকৃত ও সাধক ব্যক্তি , কিন্তু তার এ ধরনের আচরণ (নিজের পরিবারকে অবহেলা করা ) সঠিক নয়।

এ কথা শুনে আমি আরো হতাশ হয়ে গেলাম। যখন রাতে হযরত শেইখ ঘরে এলেন তার সাথে আমার তর্ক হলো... এবং ঘুমাতে গেলাম উত্তেজিত হয়ে এবং ক্ষুব্ধ হয়ে। মধ্য রাতে আমাকে ডাকা হলো উঠার জন্য। আমি দেখলাম (স্বপ্নে) আমিরুল মুমিনীন মাওলা আলী (আঃ) , যিনি নিজের পরিচয় দিলেন এবং বললেন : সে অন্যদের সন্তানদের দেখাশোনা করছিলো এবং আমরা তোমার সন্তানদের দেখাশোনা করছিলাম। যখন তোমার সন্তান না খেয়ে মারা যাবে তখন অভিযোগ করো।

দেউলিয়া হয়ে যাওয়া প্রতিবেশীর জন্য আত্মত্যাগ

হযরত শেইখের এক সন্তান বলেন : এক রাতে আমার পিতা আমাকে ডেকে তুললেন এবং একত্রে আমরা দু ব্যাগ চাল তুলে নিলাম , তিনি একটি এবং আমি একটি। আমরা ব্যাগ দু টো বহন করে নিলাম আমাদের এলাকার সবচেয়ে ধনী লোকের বাড়িতে। ব্যাগ দু টো বাড়ির মালিকের কাছে তুলে দিয়ে বললেন :

প্রিয় ভাই! তোমার কি মনে আছে বৃটিশরা লোকদেরকে তাদের দূতাবাসের দরজায় নিয়ে গিয়েছিলো ও তাদের চাল দিয়েছিল এবং ফেরত নিয়েছিলো প্রত্যেক দানার বিপরীতে একগাধা বোঝাই (চাল)17 এবং এরপরেও তারা তাদের ছাড়ে নি ?

এই কৌতুকের পর আমরা চাল হস্তান্তর করে বাড়ি ফেরত এলাম। পর দিন সকালে তিনি আমাকে ডাক দিলেন : মাহমুদ! তোমার মাকে অর্ধেক ভাঙা দু শ পঞ্চাশ গ্রাম চাল এবং দুই রিয়াল পরিমান চর্বি তেল কিনে দাও রান্না করার জন্য।

ঐ সময়গুলোতে আমার বাবার এ ধরণের আচরণ ছিলো খুবই কষ্টের ও এর অর্থ বোঝা কঠিন , কেন আমরা আমাদের বাসায় থাকা চাল দিয়ে দিবো অথচ দুপুরের খাবারের জন্য অর্ধেক ভাঙা চাল কিনবো ?!

পরে আমি জানতে পারলাম যে ঐ লোক দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলো এবং একই সাথে তার এক বড় ভোজ দেয়ার কথা ছিলো।

বৎসরের প্রথম সন্ধ্যায় আত্মত্যাগঃ

মরহুম শেইখ আব্দুল করিম হামিদ বর্ণনা করেন : আমি হযরত শেইখের দোকানে দিনে এক তোমানের বিনিময়ে কাজের ছেলে হিসেবে কাজ করতাম। নববর্ষের সন্ধ্যায় হযরত শেইখের কাছে ছিল পনেরো তোমান , তিনি আমাকে কিছু তোমান দিয়ে কিছু ঠিকানায় চাল দেয়ার জন্য বললেন এবং শেষে পাঁচ তোমান ছিল যা তিনি আমাকে দিলেন।

আমি ভাবছিলাম : তিনি কি খালি হাতে নববর্ষের সন্ধ্যায় বাড়িতে যাবেন ? এবং একই সময় তার ছেলের প্যান্টের পা ছেঁড়া ছিলো। তাই আমি তোমানগুলো তার ড্রয়ারে রেখে দৌড়ে পালালাম। শেইখ চিৎকার করে কি বললেন আমি শুনলাম না। যখন আমি বাসায় ফিরলাম দেখলাম তিনি আমার পিছু নিয়েছিলেন। তিনি বললেন : কেন তুমি তোমানগুলো নিলে না ? এরপর তিনি জোর করে আমাকে তোমানগুলো দিলেন।

চতুর্থ অধ্যায়

নিস্বার্থ উৎসর্জন

হযরত শেইখের আধ্যাত্মিক সাধনা ও উৎসর্জন ছিলো নীতিগতভাবে লোক দেখানো সুফিদের থেকে আলাদা। তিনি কখনোই সুফিদের তরিকত সমর্থন করেন নি। তার আধ্যাত্মিক পদ্ধতি ছিলো আহলে বায়েত (আঃ) এর নীতিমালার প্রতি উৎসর্গ হওয়া , তাই তিনি শুধু ওয়াজিব কাজগুলো করতেন না বরং মুস্তাহাব কাজগুলোও করতেন।

সকাল বেলায় তিনি জেগে থাকতেন এবং সূর্য ওঠার পর আধা ঘন্টা বা পুরো এক ঘন্টার জন্য ঘুমাতেন। কোন কোন সময় তিনি মধ্যাহ্নের পর অল্প বিশ্রাম নিতেন।

যদিও নিজেই ছিলেন আধ্যাত্মিক বিষয় সন্ধানকারী তবু তিনি বলতেনঃ‘‘ অনুভূতিলব্ধ জ্ঞান বিশ্বাস করো না এবং নির্ভর করো না। আমাদের উচিত সব সময় আমাদের ইমামদের অনুসরণ করা , কথায় ও কাজে দৃষ্টান্ত হিসাবে গ্রহণ করা।

প্রকাশ্য সমাবেশগুলোতে হযরত শেইখ সবসময় কোরআনের এ আয়াতটি বলতেন :

) إِن تَنصُرُ‌وا اللَّـهَ يَنصُرْ‌كُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ(

যদি তোমরা আল্লাহর পথে চেষ্টা করো তিনি তোমাদের সাহায্য করবেন ও তোমাদের পা-কে দৃঢ় করবেন (তাঁর পথে কম্পমান অবস্থা থেকে । (সুরা মুহাম্মাদঃ 7)18

এবং তিনি বলতেন :

আল্লাহর নিজের কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহর রাস্তায় চেষ্টা কর তার আদেশ অনুযায়ী এবং তার রাসুলের (সাঃ) হাদিস অনুযায়ী।

এবং তিনি বলতেন : (আল্লাহর) আদেশের মত আর কোন কিছু মানুষের সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন ঘটায় না।

হযরত শেইখ সব সময় বলতেন :

মিম্বারে যা প্রচার করা হয় তা হচ্ছে সত্যের ধর্ম। কিন্তু তাতে দু টো বিষয়ের অভাব থাকে : আন্তরিকতা ও খোদা প্রেম , এ দু টো অবশ্যই প্রচারের সময় যুক্ত করতে হবে।

তিনি বলেছেন :

সৎকর্মশীল লোকেরা সবাই ভালো (কাজ) করছে কিন্তু তাদের উচিত অহংকারকে আল্লাহ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা।

এবং তিনি বলেছেনঃ

যদি বিশ্বাসীরা অহংবোধ ছেড়ে দেয় তারা কিছু অর্জন করবে (উচ্চতর মাক্বাম)।

তিনি আরো বলতেনঃ

যদি মানুষ আল্লাহর কাছে আত্মসর্মপণ করে , নিজের মতামত ও গোঁড়ামী পরিত্যাগ করে এবং আন্তরিকভাবে আল্লাহতে বিশ্বাস রাখে , তবে আল্লাহ তাকে শিখাবেন এবং তাকে তাঁর পথে পরিচালিত করবেন।

তাক্বলীদ (বিশিষ্ট মুজতাহিদদের অনুসরণ)

বাস্তব ইবাদাতের নীতিমালা অনুযায়ী হযরত শেইখ ছিলেন তার সময়কার বিশিষ্ট মারজা , আয়াতুল্লাহ হুজ্জাতের মুকাল্লিদ বা অনুসারী। তিনি তার মারজা খুঁজে নেয়ার ঘটনাটি এভাবে বলেনঃ

আমি ক্বোমে গেলাম এবং সব মারজার সাথে সাক্ষাত করলাম এবং আমি কাউকে আগা হুজ্জাতের মত এত আত্ম -উৎসর্গিত পাই নি।

তিনি অন্য কোন এক জায়গায় বলেছেনঃ আমি তার হৃদয়কে পেয়েছিলাম উচ্চাশা ও পদের লোভ বিবর্জিত।

হযরত শেইখ তার বন্ধুদের সতর্ক করেছিলেন তরীকতগুলো সম্পর্কে যা উপরোল্লিখিত পথ থেকে সরে গিয়েছে। শেইখ এর একজন বন্ধু বলেন : আমি তাকে তরীকতগুলো19 সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম এবং তাতে তিনি উত্তর দিয়েছিলেনঃ

আমি কারবালাতে ছিলাম , আমি দেখলাম একটি দল পাশ দিয়ে যাচ্ছে , শয়তান তার লাগাম ধরে আছে যে বাকীদের পথ দেখাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম তারা কারা। তারা বললো...।

হযরত শেইখ বিশ্বাস করতেন যারা আহলুল বায়েত (আঃ) এর কাছ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখে তাদের আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে তাদের কাছে প্রকৃত আসমানী জ্ঞানের দরজা বন্ধ থাকবে।

হযরত শেইখের এক ছেলে বলেনঃ

আমার বাবা ও আমি বিবি শাহরবানু 20 পাহাড়ে গিয়েছিলাম। পথে আমরা দেখা পেলাম একজন তথাকথিত সাধকের যার ছিলো কিছু উচ্চ দাবী। আমার বাবা তাকে জিজ্ঞেস করলেন : তোমার সাধনার পর এ পর্যন্ত কী বেরিয়ে এসেছে ? তখন ঐ ব্যক্তি নিচু হয়ে মাটি থেকে এক টুকরো পাথর তুলে নিলো এবং একে একটি নাসপাতিতে পরিণত করলো। এরপর আমার বাবাকে বললোঃ নিন খান!

আমার বাবা বললেনঃ ভালো , এটি তুমি আমার জন্য করেছো , এখন বলো তুমি আল্লাহর জন্য কি করেছো ? তাঁর জন্য কী করেছো ?! তা শুনে সাধক কেঁদে ফেললো।

আল্লাহর জন্য কাজকে উৎসর্গ করা

হযরত শেইখ এর এক বন্ধু তার উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে তিনি বলেছেন : সন্ধ্যা রাতগুলোতে আমি তেহরানে মসজিদে জুমাতে বসতাম লোকজনের সুরা হামদ ও সুরা তাওহীদ শুদ্ধ করতে। একদিন দুটো বাচ্চা ঝগড়া করছিলো এবং একটি অপরটিকে মারছিলো। বাচ্চাটি মার খাওয়া এড়াতে আমার পাশে এসে বসলো। আমি সুযোগটি নিলাম এবং তাকে সুরা হামদ ও সুরা তাওহীদ তেলাওয়াত করতে বললাম এবং সেগুলো শুদ্ধ করতে তাকে সাহায্য করলাম । এটি সে রাতে আমার সমস্ত সময় নিয়ে নিলো। পরের রাতে এক দরবেশ আমার কাছে এলো এবং বললোঃ আমি জ্ঞান রাখি কিমিয়ার (রসায়ন শাস্ত্রের) , সিমিয়ার (দৃশ্য দেখাবার শক্তি) , হিমিয়ার (আত্মার নিয়ন্ত্রণের) , এবং লিমিয়ার (যাদুর) , এবং এসেছি সেগুলো তোমার কাছে অর্পণ করতে ঐ পুরস্কারের বদলে যা তুমি গত রাতে অর্জন করেছো। আমি তাকে উত্তর করলাম : না ! এগুলোর যদি কোন প্রয়োজন থাকতো তুমি নিজেই তা নিজের জন্য রাখতে!

ইসলাম বহির্ভূত আত্মশুদ্ধিকে খণ্ডন করা

হযরত শেইখ বিশ্বাস করতেন যে , কেউ যদি সত্যিকারভাবে ইসলামের আইনকানুন অনুযায়ী কাজ করে তাহলে তারা অবশ্যই সার্বিক সম্পুর্ণতা ও আধ্যাত্মিক মাক্বাম অর্জন করবে। তিনি শক্ত বিরোধী ছিলেন সব ধরনের চরমপন্থী সাধনা ও আত্মশুদ্ধির পথের যা হাদিস ও ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিপন্থী। তার শিষ্যদের একজন বলেছেনঃ

কিছু সময়ের জন্য আমি আত্মশুদ্ধিতে নিয়োজিত ছিলাম ; নির্জনে থাকতাম আমার আলাভী (ইমাম আলী আঃ এর বংশ) স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে একটি আলাদা কক্ষে। সেখানে আমি আমার নামাজ ও জিকির করতাম এবং ঘুমাতামও। চার পাঁচ মাস পর আমার এক বন্ধু আমাকে হযরত শেইখ এর কাছে নিয়ে গেলেন। তার দরজায় চৌকাঠে যখনই তিনি আমাকে দেখলেন তিনি সাথে সাথেই বললেনঃ

তুমি কি চাও আমি বলি. . ?

আমি আমার মাথা লজ্জায় নিচু করলাম। তখন তিনি বলতে লাগলেনঃ

কেন তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে এমন আচরণ করেছো যেন তাকে তুমি পরিত্যাগ করেছো ?...এ ধরনের আত্মশুদ্ধি ও জিকির এবং তেলাওয়াত বিদায় করে দাও। যাও , এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে তোমার স্ত্রীর কাছে ফেরত যাও। সাধারণ তা কীবাত সহ যথা সময়ে তোমার নামাজ পড়।

এর পর হযরত শেইখ জোর দিলেন আহলুল বাইত (আঃ) এর হাদীসসমূহের উপর এই বলে যে যদি কোন ব্যক্তি আন্তরিকভাবে ও নিষ্ঠার সাথে চল্লিশ দিন কাজ করে তাহলে প্রজ্ঞার ঝর্ণাধারা তার অন্তর থেকে বইবে21 এবং উল্লেখ করলেনঃ

এ হাদীসগুলো অনুসরণ করে যদি কেউ তার ধর্মীয় দায়িত্বগুলো পালন করে তারা অবশ্যই কিছু আলো লাভ করবে।

হযরত শেইখের পরার্মশ অনুযায়ী সে ব্যক্তি আত্মশুদ্ধি ছেড়ে দিলো এবং সাধারণ জীবনে ফিরে গেলো।

প্রথমে তোমার খুমস দিয়ে দাও

হযরত শেইখ এর এক শিষ্য ডাঃ হামিদ ফারযাম22 হযরত শেইখ এর ধর্মীয় বিষয়ে আন্তরিকতা সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন : হযরত শেইখ সমানভাবে উৎসর্গিত ছিলেন শরিয়ত , ত্বরীকত ও হাকিকত এর জন্য। সেসব সূফিদের মত নয় যারা শরীয়তকে অস্বীকার করে। প্রথম যে জিনিস তিনি আমাকে বলেছিলেন তা হলো :

যাও তোমার খুমস দিয়ে আসো! এর পর তিনি আমাকে মরহুম আয়াতুল্লাহ শেইখ আহমাদ আশতিয়ানী (রঃ) এর কাছে পাঠালেন এ উদ্দেশ্যে। এবং কী আশ্চর্য লোকই না ছিলেন তিনি! এক সত্যিকার আল্লাহ ওয়ালা লোক যার কাছ থেকে আমি কত নেয়ামতই না লাভ করেছি এবং কত বিস্ময়কর জিনিস তার ভিতরে লক্ষ্য করেছি! যা হোক , আমি তার কাছে গেলাম যেভাবে হযরত শেইখ আমাকে আদেশ দিয়েছিলেন এবং আমার যে সাধারণ বাড়িটি ছিলো তার খুমস দিয়ে আসলাম।

পঞ্চম অধ্যায়

নৈতিকতা

হযরত শেইখ ছিলেন খুবই দয়ালু , মনোরম চেহারার , ভালো মেজাজের , মার্জিত আচরণের ও বিনয়ী। তিনি সব সময় নামাযের ভঙিতে বসতেন এবং কখনই কোন গদীতে হেলান দিতেন না। তা থেকে সামান্য দূরে বসতেন। যখনই তিনি হাত মেলাতেন তিনি কখনই প্রথম ব্যক্তি ছিলেন না হাত ফিরিয়ে আনার ব্যপারে। তিনি ছিলেন স্থির ও শান্ত। যখন কথা বলতেন তিনি থাকতেন সব সময় হাসি-খুশি। তিনি খুব কমই রাগাম্বিত হতেন এবং যখন তিনি রাগ করতেন তখন শয়তান ও নফস তার দিকে আসতো। এরকম সময় , খুব বেশী রাগাম্বিত হলে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন এবং যতক্ষন পর্যন্ত না নফসের উপর বিজয়ী হতেন এবং শান্ত হতেন ততক্ষন পর্যন্ত বাড়িতে আসতেন না। যে বিষয়ে তিনি সব সময় জোর দিতেন এবং অন্যদের পরামর্শ দিতেন তা ছিলো : ভাল স্বভাব । প্রত্যেকেরই উচিৎ আল্লাহর জন্য ভাল মেজাজ সম্পন্ন হওয়া ও মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার করা।

এ বিষয়ে তিনি বলতেনঃ

বিনয়ী হও এবং ভালো মেজাজের হও আল্লাহর জন্যে , লোকজনকে খুশী করার মোনাফেকীর পরিবর্তে।

হযরত শেইখ ছিলেন কথা বলতে অনিচ্ছুক ; তার মৌন দৃষ্টিপাত পরিষ্কার ইঙ্গিত করতো যে তিনি আল্লাহর দিকে চিন্তা ও জিকিরে আছেন। তার কথার শুরুতে এবং শেষে থাকতেন আল্লাহ। তার দিকে তাকালে আল্লাহর কথা স্মরণ হতো। কোন কোন সময় তাকে জিজ্ঞেস করা হতো তিনি কোথায় ছিলেন বলতেনঃ

ইনদা মালিকিল মুকতাদির -- সার্বভৌর্ম সর্বসক্ষম প্রভুর কাছে।

দোয়ার সময় (যেমন দোয়া নুদবাহ ও দোয়া কুমাইল) তিনি অনেক কাঁদতেন ; যখনই হাফিজ ও তাক্বদীসের কবিতা আবৃত্তি করা হতো তার চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে যেতো। কান্নার মাঝেও তিনি সক্ষম ছিলেন হাসতে অথবা এমন কিছু বলতেন যা বিরক্তির পরিস্থিতিকে নরম করে হাসিখুশিতে পরিণত করতো।

তিনি আমিরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আঃ) এর জন্য গভীর প্রেম অনুভব করতেন এবং ছিলেন তার এক দৃঢ় সমর্থক ও প্রেমিক। যখনই বসতেন অথবা উঠে দাঁড়াতেন তিনি নরম করে বলতেন ইয়া আলী আদরিকনী (হে আলী! আমার দিকে দেখেন)।

বিনয়

তার এ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ড: ফারযাম বলেন : অন্যদের প্রতি তার আচরণ ছিলো বিনয় ও শ্রদ্ধাপূর্ণ। তিনি সবসময়ই আমাদের স্বাগতম জানাতে নিজে দরজা খুলে দিতেন এবং সমাবেশগুলোর জন্য প্রবেশ করতে দিতেন। এসব আমরা তার বাড়িতে করতাম। কোন কোন সময় তিনি দ্বিধাহীনচিত্তে আমাদেরকে নিয়ে যেতেন তার কর্মশালায় যেখানে তিনি সেলাইয়ের কাজ করতেন। এক শীতে , তিনি দু টো ডালিম কিনে আমাকে একটি দিলেন এবং খুব আন্তরিক ও দ্বিধাহীনচিত্তে বললেন : খাও , প্রিয় হামিদ!

তিনি কখনই নাক উঁচু ছিলেন না এবং কখনই নিজেকে অন্যের চাইতে বড় ভাবতেন না। যদি কখনো তিনি উপদেশ দিতেন তা ছিলো শুধুমাত্র অন্যকে পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব পালন করা।

তিনি সবসময় প্রবেশদ্বারের পাশেই বসতেন এবং যে ব্যক্তিই কক্ষে প্রবেশ করতো তিনি তাকে উষ্ণ অর্ভ্যথনা জানাতেন এবং সম্মানের সাথে তাদেরকে বসতে বলতেন।

হযরত শেইখের আরেক শিষ্য বলেন : যখন তিনি তার সাথীদের সাথে কোথাও যেতেন তিনি অন্যদের আগে প্রবেশ করতেন না।

অন্য একজন বলেন : আমরা হযরত শেইখের সাথে মাশহাদ গেলাম। আমরা যখন পবিত্র মাযারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলাম মরহুম আহমেদ মুরশিদ চিলুই-র23 ছেলে হায়দার আলী মির্যা হঠাৎ করে শেইখ এর পা-এ পড়ে গেলেন তার পায়ে চুমু দেয়ার জন্য। শেইখ বললেন : এই নীচু আত্মার লোক! আল্লাহর অবাধ্যতার বিষয়ে সতর্ক হও ! নিজের বিষয়ে লজ্জিত হও! আমাকে তুমি কী মনে করো ?!

পুনরায় বন্ধুত্ব স্থাপন

গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক বিষয়গুলোর মধ্যে একটি ছিলো যে হযরত শেইখ লোকদের মধ্যে পূনরায় বন্ধুত্ব করে দিতেন। যারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছে তিনি তাদেরকে নিজের বাসায় দাওয়াত দিতেন এবং পূনরায় তাদেরকে মিলিয়ে দিতেন এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াত এবং হাদীস উল্লেখ করে।

সাইয়্যেদদের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা

ইমাম আলী (আঃ) ও মা ফাতিমা (আঃ)-দের বংশ ও সাইয়্যেদদের প্রতি ছিলেন খুবই শ্রদ্ধাশীল। তাকে সবসময় দেখা যেতো তাদের (সাইয়্যেদদের) হাতে চুমু দিতে এবং অন্যদের আদেশ দিতেন তাদের হাতে চুমু দিতে।

এক মর্যাদাবান সাইয়্যেদ প্রায়ই হযরত শেইখের সাথে দেখা করতে যেতেন। তার হুক্কা পানের স্বভাব ছিলো। যখনই তা তার জন্য তৈরী করা হতো শেইখ নিজে তাতে দু একটা টান দিতেন যদিও আসলে হুক্কা পানের অভ্যাস তার নেই , তিনি ভান করতেন পান করছেন যেন সাইয়্যেদ তা পানে লজ্জিত না হন। এরপর শেইখ তা তাকে পান করতে দিতেন।

হযরত শেইখের এক বন্ধু বলেছেনঃ একবার শীতের এক দিনে আমি হযরত শেইখ এর সাথে দেখা করলাম , তিনি বললেনঃ

চলো তেহরানের এক পুরানো এলাকায় যাই।

আমরা গেলাম এক পুরানো গলিতে। সেখানে আমরা দেখলাম এক আগোছালো দোকান যেখানে এক বৃদ্ধ সাইয়্যেদ বসে আছেন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। একজন কয়লা বি ক্রে তা হিসাবে কাজ করতেন এবং সেখানেই ঘুমাতেন তার বাড়ি হিসাবে। জানা গেলো গত রাতে তার কুরসীটি24 এবং তার কাপড় এবং কিছু জিনিসপত্র পুড়ে গেছে।

তার থাকার অবস্থা ছিলো এতই খারাপ যে অনেক মানুষই সেখানে প্রবেশ করতে ইচ্ছা করবে না। খুব বিনয়ের সাথে শেইখ তার কাছে গেলেন এবং উষ্ণ শুভেচ্ছার পর তিনি তার আধোয়া অর্ধেক পোড়া কাপড় চোপড়গুলো নিলেন ধোয়ার জন্য ও তালি দেয়ার জন্য। তখন ঐ বৃদ্ধ লোক বললো যে তার সহায় সম্বল হারিয়ে গেছে এবং তিনি কাজ চালাতে পারছেন না। শুনে শেইখ আমার দিকে ফিরলেন এবং বললেনঃ

তাকে কিছু দাও ব্যবসা নুতন করে শুরু করার জন্য!

সকলের জন্য শ্রদ্ধা

হযরত শেইখ শুধু সাইয়্যেদদের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তা নয় , বরং তিনি ছিলেন সব মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কেউ যদি ভুল করতো তাকে অন্যদের সামনে তিনি অপমান করতেন না। তিনি কাউকে কখনই তিরস্কার করেন নি তাদের ভুলের জন্য , বরং তাদের সাথে উষ্ণ ও সৌহাদ্যপূর্ণ আচরণ করতেন।

পৃথিবীর পদের বিষয়ে উদাসীনতা

হযরত শেইখের শেষ জীবনের দিকে , বেশ কয়েকজন উচ্চ পদস্থ লোক তার সাথে পরিচিত হন। তাতে শুধু হাওযা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিত ব্যক্তিত্বরাই ছিলেন না , তাতে আরো ছিলেন কিছু রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিত্বও যারা বিভিন্ন কারণে তার সাথে দেখা করতে আসতেন।

দরিদ্র , নির্যাতিত ও বিশেষ করে সাইয়্যেদের প্রতি তার বিনয় ও শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের প্রতি উদাসীন।

যখন তারা তার বাড়িতে আসতেন তিনি বলতেনঃ

তারা আসে আমার কাছে পৃথিবীর25 জন্য ; তারা দুর্দশাগ্রস্ত , ক্লান্ত এবং তাদের কেউ আছে অসুস্থ (আত্মিয়দের মাঝে) , তারা আমার কাছে আসে দোয়ার জন্য।

শেইখ এর এক ছেলে বলেনঃ আমার বাবার ভক্ত একজন জেনারেল আমাকে বললেন : জানো কেন আমি তোমার বাবাকে ভালবাসি ? কারণ আমি যখন প্রথমবার তার সাথে সাক্ষাত করতে আসি তিনি তার কক্ষে দরজার পাশেই বসে ছিলেন। আমি তাকে শুভেচ্ছা জানালাম ; এরপর তিনি আমাকে বললেনঃ যান বসুন! আমি তাই করলাম , একটু পরেই এক অন্ধ লোক এলো এবং আমি দেখলাম হযরত শেইখ উঠে দাঁড়ালেন। তাকে শ্রদ্ধার সাথে জড়িয়ে ধরলেন এবং তাকে নিজের কাছে বসালেন।

আমি যখন ঘরের চারদিকে দেখছিলাম কী হচ্ছে ; আমি দেখলাম ঐ অন্ধ লোকটি উঠে দাঁড়ালেন চলে যাওয়ার জন্য। একই সময় হযরত শেইখ তার সামনে এগিয়ে গেলেন এবং তাকে জুতা পড়তে সাহায্য করলেন। এরপর দশ তোমান তার হাতে দিলেন এবং অন্ধ লোকটি চলে গেলো। অথচ আমার বিদায় নেয়ার সময় হলে তিনি তার জায়গা থেকে নড়লেন না , শুধু বললেন : খোদা হাফেজ।

ভ্রমণে নৈতিকতা

তার নেয়ামতপূর্ণ ও অন্যদের চেয়ে উত্তম জীবনে হযরত শেইখ ভ্রমণ করেছিলেন মাশহাদ , কাশান , ইসফাহান , মাযানদারান এবং কেরমানশাহতে। ইরানের বাইরে তার একমাত্র ভ্রমণ ছিলো ইরাকে , সেখানে তিনি পবিত্র মাজারগুলোতে যিয়ারতে যান। এ ভ্রমণগুলো ছিল সাথীদের সাথে যার স্মৃতি ও শিক্ষণীয় বিষয়গুলো ভ্রমণে নৈতিকতার সাথে জড়িত হওয়ায় তা এখানে উল্লেখ করা হলো।

তার ভ্রমণের সাথীরা বলেনঃ হযরত শেইখ ছিলেন ভালো মেজাজের , আন্তরিকতায় কপটতাহীন এবং একসাথে ভ্রমণে সুখকর। তিনি কখনও নিজেকে তার শিষ্যদের ও ভক্তদের থেকে আলাদা করে দেখতেন না । কোন মালপত্র ও রসদ বহন করতে তিনি নিজেরটা নিজেই বহন করতেন এবং খরচের নিজের অংশটি নিজেই দিতেন।