চতুর্থ অধ্যায়
নিস্বার্থ উৎসর্জন
হযরত শেইখের আধ্যাত্মিক সাধনা ও উৎসর্জন ছিলো নীতিগতভাবে লোক দেখানো সুফিদের থেকে আলাদা। তিনি কখনোই সুফিদের তরিকত সমর্থন করেন নি। তার আধ্যাত্মিক পদ্ধতি ছিলো আহলে বায়েত (আঃ) এর নীতিমালার প্রতি উৎসর্গ হওয়া , তাই তিনি শুধু ওয়াজিব কাজগুলো করতেন না বরং মুস্তাহাব কাজগুলোও করতেন।
সকাল বেলায় তিনি জেগে থাকতেন এবং সূর্য ওঠার পর আধা ঘন্টা বা পুরো এক ঘন্টার জন্য ঘুমাতেন। কোন কোন সময় তিনি মধ্যাহ্নের পর অল্প বিশ্রাম নিতেন।
যদিও নিজেই ছিলেন আধ্যাত্মিক বিষয় সন্ধানকারী তবু তিনি বলতেনঃ‘‘
অনুভূতিলব্ধ জ্ঞান বিশ্বাস করো না এবং নির্ভর করো না। আমাদের উচিত সব সময় আমাদের ইমামদের অনুসরণ করা , কথায় ও কাজে দৃষ্টান্ত হিসাবে গ্রহণ করা।”
প্রকাশ্য সমাবেশগুলোতে হযরত শেইখ সবসময় কোরআনের এ আয়াতটি বলতেন :
)
إِن تَنصُرُوا اللَّـهَ يَنصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ(
“
যদি তোমরা আল্লাহর পথে চেষ্টা করো তিনি তোমাদের সাহায্য করবেন ও তোমাদের পা-কে দৃঢ় করবেন (তাঁর পথে কম্পমান অবস্থা থেকে”
। (সুরা মুহাম্মাদঃ 7)
এবং তিনি বলতেন :
“
আল্লাহর নিজের কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহর রাস্তায় চেষ্টা কর তার আদেশ অনুযায়ী এবং তার রাসুলের (সাঃ) হাদিস অনুযায়ী।”
এবং তিনি বলতেন :“
(আল্লাহর) আদেশের মত আর কোন কিছু মানুষের সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন ঘটায় না।”
হযরত শেইখ সব সময় বলতেন :
“
মিম্বারে যা প্রচার করা হয় তা হচ্ছে সত্যের ধর্ম। কিন্তু তাতে দু’
টো বিষয়ের অভাব থাকে : আন্তরিকতা ও খোদা প্রেম , এ দু’
টো অবশ্যই প্রচারের সময় যুক্ত করতে হবে।”
তিনি বলেছেন :
“
সৎকর্মশীল লোকেরা সবাই ভালো (কাজ) করছে কিন্তু তাদের উচিত অহংকারকে‘
আল্লাহ’
দিয়ে প্রতিস্থাপন করা।”
এবং তিনি বলেছেনঃ
“
যদি বিশ্বাসীরা অহংবোধ ছেড়ে দেয় তারা কিছু অর্জন করবে (উচ্চতর মাক্বাম)।”
তিনি আরো বলতেনঃ
“
যদি মানুষ আল্লাহর কাছে আত্মসর্মপণ করে , নিজের মতামত ও গোঁড়ামী পরিত্যাগ করে এবং আন্তরিকভাবে আল্লাহতে বিশ্বাস রাখে , তবে আল্লাহ তাকে শিখাবেন এবং তাকে তাঁর পথে পরিচালিত করবেন।”
তাক্বলীদ (বিশিষ্ট মুজতাহিদদের অনুসরণ)
বাস্তব ইবাদাতের নীতিমালা অনুযায়ী হযরত শেইখ ছিলেন তার সময়কার বিশিষ্ট মারজা , আয়াতুল্লাহ হুজ্জাতের মুকাল্লিদ বা অনুসারী। তিনি তার মারজা খুঁজে নেয়ার ঘটনাটি এভাবে বলেনঃ
“
আমি ক্বোমে গেলাম এবং সব মারজার সাথে সাক্ষাত করলাম এবং আমি কাউকে আগা হুজ্জাতের মত এত আত্ম -উৎসর্গিত পাই নি।”
তিনি অন্য কোন এক জায়গায় বলেছেনঃ“
আমি তার হৃদয়কে পেয়েছিলাম উচ্চাশা ও পদের লোভ বিবর্জিত।”
হযরত শেইখ তার বন্ধুদের সতর্ক করেছিলেন তরীকতগুলো সম্পর্কে যা উপরোল্লিখিত পথ থেকে সরে গিয়েছে। শেইখ এর একজন বন্ধু বলেন : আমি তাকে তরীকতগুলো
সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম এবং তাতে তিনি উত্তর দিয়েছিলেনঃ
“
আমি কারবালাতে ছিলাম , আমি দেখলাম একটি দল পাশ দিয়ে যাচ্ছে , শয়তান তার লাগাম ধরে আছে যে বাকীদের পথ দেখাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম তারা কারা। তারা বললো...।”
হযরত শেইখ বিশ্বাস করতেন যারা আহলুল বায়েত (আঃ) এর কাছ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখে তাদের আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে তাদের কাছে প্রকৃত আসমানী জ্ঞানের দরজা বন্ধ থাকবে।
হযরত শেইখের এক ছেলে বলেনঃ
“
আমার বাবা ও আমি‘
বিবি শাহরবানু’
পাহাড়ে গিয়েছিলাম। পথে আমরা দেখা পেলাম একজন তথাকথিত সাধকের যার ছিলো কিছু উচ্চ দাবী। আমার বাবা তাকে জিজ্ঞেস করলেন : তোমার সাধনার পর এ পর্যন্ত কী বেরিয়ে এসেছে ? তখন ঐ ব্যক্তি নিচু হয়ে মাটি থেকে এক টুকরো পাথর তুলে নিলো এবং একে একটি নাসপাতিতে পরিণত করলো। এরপর আমার বাবাকে বললোঃ নিন খান!
আমার বাবা বললেনঃ“
ভালো , এটি তুমি আমার জন্য করেছো , এখন বলো তুমি আল্লাহর জন্য কি করেছো ? তাঁর জন্য কী করেছো ?!”
তা শুনে সাধক কেঁদে ফেললো।
আল্লাহর জন্য কাজকে উৎসর্গ করা
হযরত শেইখ এর এক বন্ধু তার উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে তিনি বলেছেন :“
সন্ধ্যা রাতগুলোতে আমি তেহরানে মসজিদে জুমাতে বসতাম লোকজনের সুরা হামদ ও সুরা তাওহীদ শুদ্ধ করতে। একদিন দুটো বাচ্চা ঝগড়া করছিলো এবং একটি অপরটিকে মারছিলো। বাচ্চাটি মার খাওয়া এড়াতে আমার পাশে এসে বসলো। আমি সুযোগটি নিলাম এবং তাকে সুরা হামদ ও সুরা তাওহীদ তেলাওয়াত করতে বললাম এবং সেগুলো শুদ্ধ করতে তাকে সাহায্য করলাম । এটি সে রাতে আমার সমস্ত সময় নিয়ে নিলো। পরের রাতে এক দরবেশ আমার কাছে এলো এবং বললোঃ আমি জ্ঞান রাখি কিমিয়ার (রসায়ন শাস্ত্রের) , সিমিয়ার (দৃশ্য দেখাবার শক্তি) , হিমিয়ার (আত্মার নিয়ন্ত্রণের) , এবং লিমিয়ার (যাদুর) , এবং এসেছি সেগুলো তোমার কাছে অর্পণ করতে ঐ পুরস্কারের বদলে যা তুমি গত রাতে অর্জন করেছো।”
আমি তাকে উত্তর করলাম : না ! এগুলোর যদি কোন প্রয়োজন থাকতো তুমি নিজেই তা নিজের জন্য রাখতে!”
ইসলাম বহির্ভূত আত্মশুদ্ধিকে খণ্ডন করা
হযরত শেইখ বিশ্বাস করতেন যে , কেউ যদি সত্যিকারভাবে ইসলামের আইনকানুন অনুযায়ী কাজ করে তাহলে তারা অবশ্যই সার্বিক সম্পুর্ণতা ও আধ্যাত্মিক মাক্বাম অর্জন করবে। তিনি শক্ত বিরোধী ছিলেন সব ধরনের চরমপন্থী সাধনা ও আত্মশুদ্ধির পথের যা হাদিস ও ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিপন্থী। তার শিষ্যদের একজন বলেছেনঃ
কিছু সময়ের জন্য আমি আত্মশুদ্ধিতে নিয়োজিত ছিলাম ; নির্জনে থাকতাম আমার আলাভী (ইমাম আলী আঃ এর বংশ) স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে একটি আলাদা কক্ষে। সেখানে আমি আমার নামাজ ও জিকির করতাম এবং ঘুমাতামও। চার পাঁচ মাস পর আমার এক বন্ধু আমাকে হযরত শেইখ এর কাছে নিয়ে গেলেন। তার দরজায় চৌকাঠে যখনই তিনি আমাকে দেখলেন তিনি সাথে সাথেই বললেনঃ
“
তুমি কি চাও আমি বলি. . ?”
আমি আমার মাথা লজ্জায় নিচু করলাম। তখন তিনি বলতে লাগলেনঃ
“
কেন তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে এমন আচরণ করেছো যেন তাকে তুমি পরিত্যাগ করেছো ?...এ ধরনের আত্মশুদ্ধি ও জিকির এবং তেলাওয়াত বিদায় করে দাও। যাও , এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে তোমার স্ত্রীর কাছে ফেরত যাও। সাধারণ তা’
কীবাত সহ যথা সময়ে তোমার নামাজ পড়।”
এর পর হযরত শেইখ জোর দিলেন আহলুল বাইত (আঃ) এর হাদীসসমূহের উপর এই বলে যে যদি কোন ব্যক্তি আন্তরিকভাবে ও নিষ্ঠার সাথে চল্লিশ দিন কাজ করে তাহলে প্রজ্ঞার ঝর্ণাধারা তার অন্তর থেকে বইবে
এবং উল্লেখ করলেনঃ
“
এ হাদীসগুলো অনুসরণ করে যদি কেউ তার ধর্মীয় দায়িত্বগুলো পালন করে তারা অবশ্যই কিছু আলো লাভ করবে।”
হযরত শেইখের পরার্মশ অনুযায়ী সে ব্যক্তি আত্মশুদ্ধি ছেড়ে দিলো এবং সাধারণ জীবনে ফিরে গেলো।
প্রথমে তোমার খুমস দিয়ে দাও
হযরত শেইখ এর এক শিষ্য ডাঃ হামিদ ফারযাম
হযরত শেইখ এর ধর্মীয় বিষয়ে আন্তরিকতা সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন : হযরত শেইখ সমানভাবে উৎসর্গিত ছিলেন শরিয়ত , ত্বরীকত ও হাকিকত এর জন্য। সেসব সূফিদের মত নয় যারা শরীয়তকে অস্বীকার করে। প্রথম যে জিনিস তিনি আমাকে বলেছিলেন তা হলো :
“
যাও তোমার খুমস দিয়ে আসো!”
এর পর তিনি আমাকে মরহুম আয়াতুল্লাহ শেইখ আহমাদ আশতিয়ানী (রঃ) এর কাছে পাঠালেন এ উদ্দেশ্যে। এবং কী আশ্চর্য লোকই না ছিলেন তিনি! এক সত্যিকার আল্লাহ ওয়ালা লোক যার কাছ থেকে আমি কত নেয়ামতই না লাভ করেছি এবং কত বিস্ময়কর জিনিস তার ভিতরে লক্ষ্য করেছি! যা হোক , আমি তার কাছে গেলাম যেভাবে হযরত শেইখ আমাকে আদেশ দিয়েছিলেন এবং আমার যে সাধারণ বাড়িটি ছিলো তার খুমস দিয়ে আসলাম।”