প্রথম অধ্যায়
আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ
হযরত শেইখের আধ্যাত্মিক মাক্বাম ও নৈতিক গুণাবলী তাদের সবার কাছেই সুস্পষ্ট ছিলো যারা তার বৈঠকগুলোতে উপস্থিত থেকে তার কথা শুনতেন ও তাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন।
প্রশ্ন হলো এ বিশাল আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব কী করে এত উঁচু মর্যাদা পেলেন। কীভাবে একজন সাধারণ মানুষ যিনি আনুষ্ঠানিক বিদ্যাবহির্ভূত ছিলেন এবং হাওযার (ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র) কোন অভিজ্ঞতা তার ছিলো না , অথচ তিনি এত উঁচু মাক্বাম অর্জন করলেন যে শুধু সাধারণ জনগণই নয় এমনকি হাওযা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞ ব্যক্তিরাও তার পথ প্রদর্শন উপভোগ করেছে ? কী সেই গোপন রহস্য যা হযরত শেইখকে এক লাফে দীর্ঘপথ এগিয়ে দিয়েছিলো ? এবং সবশেষে : কে তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং কে ছিলো তার আধ্যাত্মিক শিক্ষক ?
শেইখের উস্তাদগণ
যদিও হযরত শেইখের আনুষ্ঠানিক কোন জ্ঞান ছিলো না যা বিশ্ববিদ্যালয় ও হাওযাগুলোতে অর্জন করা যায় , তবুও তিনি কিছু বিশিষ্টজনের সাহচর্য পেয়েছেন , যারা জ্ঞানে ও আধ্যাত্মিকতায় ছিলেন বিখ্যাত ব্যক্তি , যেমন , আয়াতুল্লাহ মুহাম্মদ আলী শাহ আবাদী। যিনি ইমাম খোমেনী (রঃ) এর শিক্ষক ছিলেন
, এবং মরহুম আয়াতুল্লাহ মির্যা মুহাম্মদ তাক্বী বাফক্বী এবং মরহুম আয়াতুল্লাহ মির্যা জামাল ইসফাহানী।
তিনি আরো দু’
জন বিজ্ঞ লোকের কাছে শিক্ষা লাভ করেন। তারা হলেন আগা সাইয়্যেদ আলী মুফাস্সির এবং সাইয়্যেদ আলী গারাভী যিনি ছিলেন কোরআন ব্যাখ্যাকারী এবং তেহরানের উপকন্ঠে মসজিদে সাল সাবিলের ইমাম।
এ অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার ফলে তিনি পবিত্র কোরআন ও হাদীসের সাথে ভালোভাবেই পরিচিত হন এবং পবিত্র কোরআন হাদীস এবং দোয়াসমূহ অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করতেন। অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে তা উপস্থাপন করতেন ও যথাযথ মন্তব্য করতেন যে বিষয়ে অন্যরা ছিলেন কম সচেতন। এভাবে হযরত শেইখের ইসলামী জ্ঞান লাভ ছিলো বিশিষ্ঠ ব্যক্তিদের সান্নিধ্য লাভের ফলাফল। কিন্তু তার এক লাফে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে যাওয়া ও আধ্যাত্মিক উন্নতির কারণ অন্য জায়গায়। তার জীবনের মোড় যেখানে ঘুরে যায় তা হলো যখন হযরত শেইখ বলেছেন :“
আমার কোন শিক্ষক ছিলেন না ,”
তখন তিনি এ কথাটিই ইঙ্গিত করেছেন।
তার ভক্তদের একজন বলেছেন যে হযরত শেইখ বলেছেনঃ
“
আমার কোন শিক্ষক ছিলো না। আমি শেইখ মোহাম্মদ তাক্বী বাফক্বীর
আলোচনায় উপস্থিত থাকতাম যা হযরত আব্দুল আযীম (আঃ) এর পবিত্র মাজারের উঠানে সন্ধ্যা রাতে অনুষ্ঠিত হতো। তিনি ছিলেন এক আধ্যাত্মিক লোক। একদিন তিনি শ্রোতাদের মধ্যে আমাকে সম্বোধন করে বললেন :“
আপনি একটি (উচ্চ) মাক্বাম অর্জন করবেন।”
জীবন সন্ধিক্ষণ
আমাদের মতে হযরত শেইখের একবারে দীর্ঘপথ অতিক্রম করা , উন্নতির শুরু এবং জীবনের বাঁক একটি ঘটনার মাঝে নিহিত যা খুবই প্রভাব বিস্তারকারী ও শিক্ষণীয়।
যুবক বয়সের প্রথম দিকে হযরত শেইখের জীবনে কিছু ঘটেছিলো যা অনেকটা ইউসূফ (আঃ) এর ঘটনার মত। এ ঘটনা এবং যা পরবর্তীতে ঘটেছিলো তা হলো হযরত শেইখের বাস্তব তাওহীদের পথ অনুশীলন। কোরআনে হযরত ইউসূফের (আঃ) ঘটনার শেষ দিকে এসে এই আয়াতে বলা হয়েছে :
)
إِنَّهُ مَن يَتَّقِ وَيَصْبِرْ فَإِنَّ اللَّـهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ(
“
নিশ্চয় যে সৎকর্মশীল ও ধৈর্যশীল , আল্লাহ তার সৎকর্মের পুরস্কারকে কখনোই হারিয়ে যেতে দেবেন না।”
(সূরাইউসূফঃ90)
এটি একটি সাধারণ নিয়ম যা শুধু নবী ইউসূফ (আঃ) এর জন্যই নয়।
নবী মূসা (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কোরআন বলছেঃ
)
وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَاسْتَوَىٰ آتَيْنَاهُ حُكْمًا وَعِلْمًا وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ(
“
যখন সে পূর্ণ বয়স্ক হলো এবং দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো , (জীবনে) আমরা তাকে দিলাম ক্ষমতা ও জ্ঞান ; এভাবে আমরা তাদের পুরস্কার দেই যারা সৎকাজ করে।”
(আল কাসাসঃ14)
এটিও এক সাধারণ নিয়ম। কোরআন অনুযায়ী সব সৎকর্মশীল ও পরোপকারী ব্যক্তিগণ প্রজ্ঞার আলো ও সুনির্দিষ্ট আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধি লাভ করে থাকেন।
নবী ইউসুফ (আঃ) এর মত একটি ঘটনা
হযরত শেইখ কদাচিৎ এ ঘটনাটির পূর্ণ বিবরণ দিতেন। যাহোক কিছু কিছু সময় তিনি সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত দিয়েছেনঃ
“
আমার কোন উস্তাদ ছিলো না , কিন্তু আমি বলেছিলামঃ
হে আল্লাহ! আমি এ থেকে নিবৃত্ত রইলাম আপনাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এবং আমি নিজেকে নিবৃত্ত করলাম এ আশায় যে আপনি আমাকে প্রশিক্ষণ দেবেন শুধু আপনার জন্য।”
এ ঘটনাটির উল্লেখ করে সুবিখ্যাত ফক্বিহ আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হাদি মিলানী (রঃ) বলেছেন : শেইখকে নেয়ামত দেয়া হয়েছে আর তা হচ্ছে এ কারণে যে তিনি যুবক বয়সে আত্মনিয়ন্ত্রণ করেছেন।
হযরত শেইখ নিজেই এ ঘটনাটি বলেছেন মর্যাদাবান ফক্বিহ আয়াতুল্লাহ মিলানীর কাছে। সেই বৈঠকে আয়াতুল্লাহ মিলানী (রঃ) ছেলে হাজ্ব , সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ আলী মিলানীও উপস্থিত ছিলেন , যিনি বলেছেন যে হযরত শেইখ এ ঘটনাটি এ ভাবে বলেছেন :
‘
আমার যুবক বয়সে আমার এক আত্মীয়ের এক সুন্দরী কন্যা আমার প্রেমে পড়েছিলো এবং আমাকে এক নির্জন জায়গায় একা পেয়েছিলো। আমি নিজেকে বললামঃ‘
রজব আলী! আল্লাহ তোমাকে অনেকবার পরীক্ষা করতে পারেন ; কেন তুমি একবার আল্লাহকে পরীক্ষা করো না। ? নিবৃত্ত থাকো এক অবৈধ আনন্দের কাজ থেকে আল্লাহরই জন্য!’
এরপর আমি আল্লাহকে বললাম :
“
হে খোদা! আমি এ গুনাহ থেকে নিবৃত্ত রইলাম এবং এর বদলে তুমি আমাকে তোমার জন্য প্রশিক্ষণ দাও!”
এরপর , নবী ইউসূফ (আঃ) এর মত তিনি সাহসিকতার সাথে গুনাহপূর্ণ এ লোভ থেকে নিজেকে বিরত রাখলেন , আহবানকে এড়িয়ে গেলেন এবং দ্রুত সরে গেলেন সেই বিপজ্জনক ফাঁদ থেকে।
এ আত্ম -নিয়ন্ত্রণ ও গুনাহ এড়িয়ে যাওয়া তাকে দিয়েছিলো অন্তর্দৃষ্টি ও অতিন্দ্রীয় অনুভূতি। তার অন্য জগতের দৃষ্টি খুলে গেল। তিনি এমন কিছু দেখতেন ও শুনতেন যা অন্যরা দেখতে পেতো না বা শুনতেও পেতো না। তিনি এমন পরিষ্কার অর্ন্তদৃষ্টি পেলেন যে যখনই তিনি তার বাড়ি থেকে বেরোতেন তিনি কিছু লোককে তাদের প্রকৃত চেহারায় দেখতেন এবং কিছু রহস্যকে তার কাছে খুলে ধরা হয়েছিলো
। হযরত শেইখ বলেছেনঃ
“
একদিন আমি‘
মৌলভী’
চৌরাস্তা থেকে‘
সিরাস’
এভিনিউর ভেতর দিয়ে‘
গালুবান্দাক’
(তেহরানের এক অঞ্চল) পর্যন্ত গেলাম এবং (একই পথ দিয়ে) ফিরলাম এবং দেখলাম শুধু একটি মাত্র মানুষের মুখ!”
কীভাবে তিনি আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন
ফাঁদে পড়া এক নব্য যুবকের দোয়াঃ“
হে আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য প্রশিক্ষণ দিন!”
কবুল হয়েছিলো সেই স্পর্শকাতর মুহূর্তে এবং আধ্যাত্মিক জীবনে এক লাফে এত সামনে এগিয়ে গেলেন যে অগভীর লোকেরা তা ধারণাই করতে পারে না। এই এক লাফে শেইখ রজব আলী এক রাতে একশত বছর দূরত্ব অতিক্রম করলেন এবং পরিচিত হয়ে গেলেন শেইখ রজব আলী খাইয়্যাত হিসেবে।
তার আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের প্রথম ধাপে তার চোখ , কান ও অন্তর খুলে গেলো। এতে তিনি বস্তু জগতের বাইরের এবং উচুঁ আকাশগুলো ভেদ করে দেখতে পেতেন , যা অন্যরা দেখতে পেত না ও শুনতে পেত না। এ রহস্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা শেইখের কাছে বিশ্বাসের জন্ম দেয় যে ইখলাস (আন্তরিকতা) অন্তরের চোখ ও কানকে খুলে দেয়। তিনি দৃঢ়ভাবে তার শিষ্যদের বলতেনঃ
“
যদি কেউ আল্লাহর জন্য কাজ করে তাদের অন্তরের চোখ ও কান খুলে যাবে।”
অন্তরের চোখ ও কান
কেউ হয়তো অবাক হতে পারেন অন্তরের আবার চোখ ও কান থাকতে পারে কিনা। কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে : মানুষ কি শারীরিক কান ও চোখ ছাড়া দেখতে ও শুনতে সক্ষম ?
উত্তর হচ্ছে , হ্যাঁ , এটি সত্য। শিয়া ও সুন্নী উভয়ের হাদীসের মাধ্যমে বর্ণীত হয়েছে যে এর উত্তর ইতিবাচক। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলো।
নবী (সাঃ) বলেছেন :
“
কোন দাস নেই যে তার চেহারায় দু’
টো চোখ নেই যা দিয়ে সে পৃথিবীর জিনিস দেখে এবং আরও দু’
টো চোখ তাদের অন্তরে রয়েছে পরকালের বিষয়গুলো দেখার জন্য। যখন আল্লাহ তাঁর কোন দাসের কল্যাণ চান তিনি তাদের অন্তরের দু’
টো চোখ খুলে দেন যা দিয়ে তারা তার প্রতিশ্রুত নেয়ামতগুলো দেখতে পায় এবং তারা অদৃশ্যকে বিশ্বাস করে তাদের অদৃশ্য চোখ দিয়ে।”
অন্য এক হাদীসে নবী (সাঃ) বলেছেনঃ
“
যদি তোমাদের অন্তর বিভক্ত না হতো এবং তোমরা এতো বাচাল না হতে তাহলে তোমরা সন্দেহাতীতভাবে তাই শুনতে যা আমি শুনি।”
ইমাম সাদিক (আঃ) বলেছেনঃ
“
নিশ্চয়ই অন্তরের আছে দুটো কান : ঈমানের রুহ এর একটিতে কল্যাণের কথা বলে এবং অন্যটায় শয়তান অনিষ্টের কথা ফিসফিস করে। এভাবে যেটি অন্যটির উপর বিজয়ী হবে তার উপর অধিপত্য করবে।”