তৃতীয় অধ্যায়
আত্মগঠনের অমোঘ ওষুধ
আত্মগঠন ও সমৃদ্ধির অমোঘ ওষুধ হচ্ছে প্রেম। সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রেম সব নৈতিক কদর্যতা থেকে পুরোপুরি আরোগ্য করে এবং সব ভালো গুণ প্রেমিককে দান করে। প্রেমের অমোঘ ওষুধ আশেককে মাশুকের প্রতি এতই বিমোহিত করে ফেলে যে আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছুর সাথে এর সর্ম্পক ছিন্ন হয়ে যায়।
আশেকদের মোনাজাতে ইমাম জয়নুল আবেদীন (আঃ) বলেন :
‘
হে আমার ইলাহ , কে আছে যে আপনার প্রেমের মিষ্টতা লাভ করেছে এরপর অন্যকে চেয়েছে আপনার জায়গায় ? কে আপনার সাথে ঘনিষ্ট হয়েছে এরপর আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চেয়েছে ?
প্রেম মোহিতকারী এবং যখন তা সত্তায় প্রবেশ করে , তা মাশুক ছাড়া সবকিছুর প্রতি দরজা বন্ধ করে দেয়।’
ইমাম সাদিক (আঃ) থেকে একটি হাদীসে বলা হয়েছে :
“
যখন আল্লাহর প্রতি প্রেমের জ্যোতি কোন নিবেদিত ব্যক্তির অন্তরে জ্বলজ্বল করে , তা তাকে তার সব চিন্তা থেকে মুক্ত করে ; আল্লাহকে স্মরণ ছাড়া সবকিছুই অন্ধকার। আল্লাহ প্রেমিক আল্লাহর দাসদের মধ্যে সবচেয়ে আন্তরিক , কথায় সবচেয়ে সত্যবাদী এবং শপথ ও অঙ্গীকারে সবচেয়ে বিশ্বস্ত।”
বিচ্ছিন্নতার প্রথম ধারায় শরীরী আকাঙ্ক্ষার নফস মারা যায় এবং যুক্তি নির্ভর জীবন শুরু হয় এবং এর উচ্চতম ধাপে অন্তরের চোখ আলোকিত হয় আল্লাহর সাথে মিলনের আলোতে এবং মানুষ অর্জন করে একত্ববাদের সর্বোচ্চ স্থান যা‘
উলুল ইলম’
এর মাক্বাম। আমরা মোনাজাতে শাবানিয়াতে পড়ি :
“
হে আমার ইলাহ! আপনার দিকে ছাড়া আমাকে বিচ্ছিন্ন করুন সব দিক থেকে এবং আমাদের অন্তরের চোখকে আলোকিত করুন আপনার দিকে তাকিয়ে থাকার আলো দিয়ে।”
প্রকৃত উজ্জীবিতকারী ওষুধ
আল্লাহ প্রেম যে প্রকৃত উজ্জীবীতকারী ওষুধ তা উল্লেখ করে হযরত শেইখ একটি আনন্দদায়ক ঘটনা বর্ণনা করেন :“
একবার আমি রসায়নের বিশেষ জ্ঞান খোঁজ করছিলাম ; আমি আত্ম -সংযম অনুশীলন করলাম একটি সময় পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি পথের শেষে উপস্থিত হলাম কোন লাভ ছাড়াই। তখন একটি আধ্যাত্মিক অবস্থায় আমাকে এই আয়াতটি জানানো হলো :
)
مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعِزَّةَ فَلِلَّهِ الْعِزَّةُ جَمِيعًا(
“
যদি কেউ সম্মান ও ক্ষমতা চায় তাহলে সমস্ত সম্মান ও শক্তি আল্লাহর।”
(সূরা ফাতির-10)
আমি বললাম আমি রসায়নের বিশেষ জ্ঞান খোঁজ করছি। আমাকে এলহামের মাধ্যমে বলা হলো :
“
তারা রসায়ন চায় সম্মান ও ক্ষমতার জন্য ; সম্মান ও ক্ষমতার বাস্তবতা হচ্ছে এ আয়াতে।”
এতে আমার মন শান্ত হয়ে গেলো।
বেশ কিছুদিন পর দু’
ব্যক্তি (আত্ম সংযম পালনের পর) আমার বাসায় এলো এবং আমার সাক্ষাত চাইলো। যখন দেখা করলাম তারা বললোঃ
‘
দু’
বছর ধরে আমরা চেষ্টা করছি রসায়নের বিশেষ জ্ঞান লাভের জন্যে কিন্তু ফল পাই নি। আমরা হযরত ইমাম রেজা (আঃ) এর কাছে আবেদন করলাম তিনি আমাদেরকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।’
হযরত শেইখ তাদের উপরোক্ত ঘটনাটি উল্লেখ করে বললেনঃ
“
আমি স্থায়ী ভাবে (এ উচ্চাশা থেকে) তা থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। রসায়নের বাস্তবতা হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন।”
কোন কোন সময় হযরত শেইখ উপরোক্ত রায়ের (সিদ্ধান্তের) পক্ষে দোয়ায়ে আরাফাহ থেকে নীচের অংশ আবৃত্তি করে শোনাতেনঃ
“
যে আপনাকে পায়নি (জানেনি) সে কী পেয়েছে ? এবং যে আপনাকে পেয়েছে সে কী পায় নি ?”
ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) আল্লাহ প্রেমের উজ্জীবনী ওষুধের কথা দোয়ায়ে মাকারিমুল আখলাকের শেষ দিকে এসে উল্লেখ করেছেনঃ
“
আমার জন্য আপনার প্রেমের দিকে একটি মসৃণ পথ খুলে দিন এবং আমার জন্য আপনার এ পৃথিবী ও পরকালের কল্যাণ সম্পূর্ণ করুন।”
হাফিয খুব সুন্দরভাবে তার গযলে এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেনঃ
“
হে নির্বোধ! চেষ্টা করো অর্ন্তদৃষ্টি সম্পন্ন হতে।
তুমি নেতা হতে পারবেনা , যদি না তুমি [নিজেই প্রথমে] পথে সন্ধানকারী হও।
সত্যের বিদ্যালয়ে এবং প্রেমের শিক্ষকের সাহায্যে চেষ্টা করো
হে বৎস , একদিন বাবা হওয়ার জন্য।
তোমার অস্তিত্বের জামা পরিত্যাগ করো ঐ লোকদের মত যারা পথের উপরে আছে।
যেন তুমি প্রেমের ওষুধ আবিষ্কার করো এবং তাকে সোনায় পরিণত করো যদি তোমার অন্তরে ও সত্তায় প্রেমের আলো জ্বলে উঠে আল্লাহর ক্বসম তুমি আকাশের সূর্যের চাইতে বেশী উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।”
হযরত শেইখের শ্রেষ্ঠ শিল্প
হযরত শেইখের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ও কৌশল ছিলো তার“
প্রেমের ওষুধ।”
এর অনুশীলনে তিনি ছিলেন বিশেষজ্ঞ এবং নিঃসন্দেহে এর সুস্পষ্ট প্রকাশ এই কথায় :
)
يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ(
“
যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালোবাসবে।”
(সূরা মায়েদাহঃ 54)
এবং
)
وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ(
“
কিন্তু যারা বিশ্বাসী তারা আল্লাহর ভালোবাসায় উপচে পড়ে।”
(সূরা বাকারাঃ 165)
যেই তার কাছে আসতো সেই কোন না কোনভাবে প্রেম সূধা উপভোগ করতেন। হযরত শেইখ বলেছেনঃ
“
আল্লাহর প্রেম হচ্ছে দাসত্বের শেষ ধাপ। প্রেমে মোহাচ্ছন্ন হওয়ার চাইতে বেশী। মোহাচ্ছন্ন হওয়া আকস্মিক বিষয়। কিন্তু প্রেম হচ্ছে অপরিহার্য ; মোহাচ্ছন্ন ব্যক্তি মাশুক থেকে সরে যেতে পারে কিন্তু প্রকৃত প্রেমিক এরকম নয়। যদি মোহাচ্ছন্ন ব্যক্তির মাশুক প্রতিবন্ধী হয় অথবা তাদের গুণ হারায় তাদের মোহাচ্ছন্নতা হারাতে পারে কিন্তু একজন মা তার প্রতিবন্ধী ছেলেকেও ভালোবাসে।”
তিনি বলতেনঃ
তিনি তখন জিজ্ঞেস করলেনঃ
“
কাজের মূল্যায়নের মানদণ্ড হচ্ছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি প্রেমের পরিমাণ।”
“
যে প্রেমের বীজ বপন করে নি সে পূর্ণতার একটি শস্য দানাও লাভ করবে না।”
শিরিন ও ফরহাদ
কোন কোন সময় হযরত শেইখ শিরিন ও ফরহাদের কাহিনী তার শিষ্যদের কাছে উল্লেখ করতেন রুপক হিসেবে বোঝানোর জন্যঃ
‘
গাইতির প্রত্যেক আঘাতের সাথে ফরহাদ শিরিনকে স্মরণ করতো।’
“
তোমরা যাই করো তোমাদের এ অবস্থা থাকা উচিত কাজটি শেষ হওয়া পর্যন্ত ; তোমাদের সব চিন্তা ও স্মরণ হবে আল্লাহর জন্য , নিজের জন্য নয়।”
‘
মাশুকের জন্য লিখো’
হযরত শেইখের এক শিষ্য বলেনঃ
“
আমি এক ট্রেডিং কোম্পানীতে সে ক্রে টারী ছিলাম। একদিন হযরত শেইখ আমার কাছে এলেন এবং বললেনঃ
“
কার জন্য তুমি এ সব নোটবুকে লিখছো ?”
আমি বললাম ,‘
আমার মনিবের জন্য’
। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ
‘
তুমি যদি তোমার নাম লিখো এ বইগুলোতে , তোমার মনিব কি কোন আপত্তি করবে
আমি উত্তর দিলামঃ অবশ্যই তিনি (আপত্তি) করবেন।
এর পর তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ
‘
যে কাপড় তুমি মাপজোক করছো , কার জন্য মাপছো ? তোমার জন্য নাকি তোমার মনিবের জন্য।’
আমি বললামঃ‘
তার (আমার মনিবের) জন্য’
।
তিনি তখন জিজ্ঞেস করলেনঃ
“
তুমি কি বুঝেছো ?”
আমি বললাম ,‘
না’
।
এরপর তিনি বললেনঃ
“
গাইতির প্রত্যেক আঘাতের সাথে সাথে ফরহাদ বলতোঃ‘
আমার প্রিয়তম শিরিন!’
এবং সে শিরিনের নাম ছাড়া কোন কিছু বলতো না। তাই তুমিও লেখো এ বইগুলোতে মাশুকের ভালোবাসায়! কাপড় মাপো তাকে স্মরণ করে! ফলে এ সব কিছু মিলনের দিকে প্রথম পদক্ষেপ। এমনকি তোমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসকে অবশ্যই হতে হবে তার স্মরণে।”
‘
আল্লাহর কোন ক্রেতা নেই!’
আল্লাহর জন্য ক্রে তা খুঁজতে হযরত শেইখ বলতেন :
“
ইমাম হুসাইন (আঃ) এর যত ক্রে তা আছে ; হয়তোবা এরকমই অন্যান্য ইমাম (আঃ) দের বেলায়ও আছে ; কিন্তু আল্লাহর জন্য আছে খুব অল্প সংখ্যক ক্রে তা! আমি আল্লাহর জন্য করুণা বোধ করি এত অল্প ক্রে তা থাকায়। খুব কমই আসে বলতেঃ আমি আল্লাহকে চাই ; আমি আল্লাহর সাথে পরিচিত হতে চাই।”
কোন কোন সময় তিনি বলতেন :“
যখন তোমরা আল্লাহর প্রয়োজন অনুভব করো , তিনি তোমাদের প্রেমে পড়ে আছেন!”
হাদীসে ক্বুদসীতে আছে :
“
হে আদমের সন্তান! আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই তুমি আমাকে ভালোবাসো।”
আরো একটি হাদীসঃ
“
আমার দাস! আমি আমার অধিকারের কসম দেই যে আমি তোমাকে ভালোবাসি , তাই , ভালোবাসো আমাকে তোমার উপরে আমার অধিকারের মাধ্যমে।”
মাঝে মধ্যে তিনি বলতেনঃ
“
ইউসুফ দেখতে সুন্দর কিন্তু তার কথা চিন্তা করো যে ইউসুফকে সৃষ্টি করেছে , সমস্ত সৌন্দর্য তাঁর।”
“
এই পৃথিবীতে কেউ ইউসুফের চেয়ে সুন্দর কিছু দেখে নি
(পরম) সৌন্দর্য তাঁর যিনি ইউসুফকে সৃষ্টি করেছেন।”
‘
প্রেমের শিক্ষা দাও’
হযরত শেইখের এক শিষ্য বর্ণনা করেনঃ
মরহুম শেইখ আহমদ সাইদী যিনি একজন প্রখ্যাত মুজতাহিদ এবং মরহুম আগা বোরহানের
‘
খারিজ’
(পি , এইচ ,ডি) শিক্ষার শিক্ষক ছিলেন , তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ
‘
তুমি কি তেহরানের কোন দর্জিকে চেনো যে আমার জোব্বা বানিয়ে দিতে পারে ?’
আমি হযরত শেইখকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম।
কিছু দিন পর তিনি আমাকে দেখার সাথে সাথে বললেনঃ
‘
তুমি আমাকে কী করেছো ? কোথায় পাঠিয়েছিলে আমাকে ?’
আমি বললামঃ‘
কেন ? কী হয়েছে ?’
তিনি বললেনঃ‘
আমি যেই ভদ্রলোকের কাছে গেলাম যাকে তুমি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলে আমার একটি জোব্বা বানিয়ে দেয়ার জন্য , তিনি আমার মাপ নেয়ার সময় আমাকে আমার কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম আমি একজন তালাবা (মাদ্রাসার ছাত্র)। তিনি বললেনঃ
“
আপনি কি পড়েন না কি শিক্ষা দেন ?”
আমি উত্তর দিলাম , আমি শিক্ষা দেই। তিনি জিজ্ঞেস করলেন , আমি কী শিক্ষা দেই। আমি বললাম আমি‘
খারিজ’
(পি , এইচ ,ডি) স্তরে শিক্ষা দেই। তিনি একমত হয়ে মাথা দোলালেন এবং বললেনঃ“
তা ভালো , কিন্তু শিক্ষা দিন প্রেমের শিক্ষা!”
তার এ কথা আমাকে একেবারে একজন নুতন মানুষে পরিবর্তন করে ফেললো ; এটি আমার জীবনকে পরিবর্তন করে ফেললো।’
এ ঘটনার পর মরহুম সাইদী হযরত শেইখের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন এবং তার বৈঠকে উপস্থিত হতেন। আমার জন্য দোয়া করতেন কারণ তাকে আমি হযরত শেইখের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম।
“
মথ
(এক ধরনের প্রজাপতি) থেকে প্রেম শেখো!”
হযরত শেইখের এক শিষ্য বলেন যে তিনি বলেছেন :
“
এক রাতে আমি ব্যস্ত ছিলাম মোনাজাতে এবং মাশুকের কাছে দোয়া ও অনুনয় করাতে। আমি খেয়াল করলাম এর মধ্যে এক মথ হারিকেনটির দিকে এগিয়ে এলো এবং একে বার বার ঘিরে উড়তে থাকলো এবং এক সময় এর দেহের একপাশ হারিকেনে আঘাত করলো এবং পড়ে গেলো। কিন্তু ,সেটি মরে গেলো না। অনেক কষ্টে তা নড়া চড়া করলো এবং আবার হারিকেনের দিকে উড়ে এলো এবং আঘাত করলো হারিকেনকে তার দেহের অন্য পাশটি দিয়ে। এবার সে তার জীবন দিয়ে দিলো। এ ঘটনা আমার ভিতরে ঐশী প্রেরণার সৃষ্টি করলোঃ‘
হে অমুক! প্রেম শেখো এ পোকাটির কাছ থেকে ; কোন কপটতা অথবা কোন দাবী করা যেন তোমার ভেতরে না থাকে। প্রেম ও ভালোবাসার সত্য এ পোকাটি পূর্ণ করেছে।’
আমি এ অদ্ভূত দৃশ্য থেকে অনেক কিছু শিখলাম এবং আমার (আধ্যাত্মিক) জীবন সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেলো।”
আল্লাহ প্রেমের মৌলিক শত
সর্বশক্তিমান আল্লাহকে জানার মৌলিক শর্ত হলো‘
তাঁকে জানা’
। এটি প্রায় অসম্ভব যে , কেউ আল্লাহকে জানবে অথচ তার প্রেমে পড়বে নাঃ
‘
যদি তুমি তাকে (ইউসূফকে) দেখো এবং বলতে পারো কমলা ও (এর খোসা খুলতে ব্যস্ত) তোমার হাতের পার্থক্য তাহলে জুলাইখাকে তিরষ্কার করা হবে অনুমোদনযোগ্য।’
ইমাম হাসান আল মুজতাবা (আঃ) বলেন :
‘
যে আল্লাহকে জানে সে তাঁকে ভালোবাসে।’
হযরত শেইখ বলেনঃ
“
প্রধান বিষয় হলো যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ আল্লাহর বিষয়ে অতিন্দ্রীয় জ্ঞান অর্জন না করে সে (তাঁর) প্রেমে পড়বে না। যদি সে জ্ঞান অর্জন করে সে দেখতে পায় সব ভালো আল্লাহর মাঝে জমা আছে।
)
آللَّهُ خَيْرٌ أَمَّا يُشْرِكُونَ(
“
কে ভালো ? আল্লাহ না কি মিথ্যা ইলাহরা যা তারা শরীক করে (তাঁর সাথে)।”
(সূরা নামল-59)
এরকম হলে এটি সম্ভব নয় যে সে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দিকে মনোযোগ দিবে।”
পবিত্র কোরআনে দুটি দলের উল্লেখ রয়েছে যাদের মহিমান্বিত সর্বশক্তিমান আল্লাহ সম্পর্কে অতিন্দ্রীয় জ্ঞান আছে- একটি ফেরেশতাদের দল ও অপরটি যারা‘
জ্ঞানপ্রাপ্ত’
।
)
شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ(
“
কোন ইলাহ নাই আল্লাহ ছাড়া। এটি আল্লাহর , তাঁর ফেরেশতাদের এবং জ্ঞানপ্রাপ্তদের সাক্ষ্য।”
(সূরা আলে ইমরান-18)
প্রথম দলটি তার জ্ঞানের মিষ্টতা ও তাঁর প্রেমের তৃষ্ণা নিবারণকারী পেয়ালার স্বাদ পেয়েছে বলে ইমাম (আঃ) উল্লেখ করেছেনঃ
“
এরপর মহিমান্বিত আল্লাহ তার আকাশগুলোতে থাকার জন্য এবং তার রাজ্যের উচ্চতর স্তরগুলোতে বসবাস করার জন্য নুতন ধরণের প্রাণী সৃষ্টি করলেন , যেমন ফেরেশতা- তাঁর ইবাদাতে নিয়োজিত থাকার কারণে তারা অন্যান্য দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে এবং বিশ্বাসের বাস্তবতা তাদের সাথে ও তাঁর জ্ঞানের সাথে সংযোগ তৈরী করেছে। তাঁর প্রতি তাদের বিশ্বাস তাদেরকে তাঁর প্রতি মনোযোগী করেছে। তারা কোন কিছুর আকাঙ্ক্ষা করে না , তাঁর কাছে যা আছে তা ছাড়া। তারা তাঁর জ্ঞানের মিষ্টতার স্বাদ পেয়েছে এবং তাঁর প্রেমের তৃষ্ণা নিবারণকারী পেয়ালা থেকে পান করেছে”
।
অতিন্দ্রীয় জ্ঞান অর্জন
অতিন্দ্রীয় জ্ঞান অর্জনের কোন পথ নেই অন্তরের আয়না থেকে অনুচিত কাজগুলোর দাগ মুছে ফেলা ছাড়া। আবু হামযা সুমালী বর্ণিত এক দোয়ায় ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) বলেছেন :
“
আপনার সন্ধানকারী আপনার নিকটেই আছে। আপনি আপনার সৃষ্ট প্রাণী থেকে দূরে নন , যদি না (তাদের অনুচিত) কাজগুলো আপনাকে আড়াল করে রাখে তাদের কাছ থেকে।”
আল্লাহ পর্দায় ঢাকা নন। আমাদের নিজেদের কাজ তাঁকে আমাদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখে , যদি অপ্রীতিকর কাজগুলোর পর্দা অন্তর থেকে সরিয়ে ফেলা যায় তা মহিমান্নিত আল্লাহর রাজকীয় সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করবে এবং তার প্রেমে পড়বে।
‘
মাশুকের সৌন্দর্য পর্দামুক্ত ও উম্মুক্ত হয়েছে , তোমার পথের উপর ধূলাকে নেমে যেতে দাও যেন তাঁর সৌন্দর্য দেখতে পাও।’
পথের উপরে ধূলোকে নেমে যেতে দিতে ও অন্তরকে অশোভন কাজ থেকে পরিস্কার করতে অন্তরকে অবশ্যই দুনিয়ার ভালোবাসা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে , কারণ দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসাই সব অহংবোধ ও খারাপের উৎস।
আল্লাহর প্রেমের পথে চোরাই গর্ত
আল্লাহর প্রেমের পথে প্রকৃত চোরাই গর্ত হচ্ছে দুনিয়ার প্রেম। হযরত শেইখের শিক্ষা অনুযায়ী যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর জন্য পৃথিবী চায় এটি হবে প্রাথমিক পদক্ষেপ তাঁর সাথে মিলনের। আর যদি তা হয় আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্যে তাহলে তা হবে তাঁর ভালোবাসার পথে চোরাই গর্ত । সেক্ষেত্রে পৃথিবীতে হালাল ও হারাম এর কোন পার্থক্য থাকবে না। অবশ্য পৃথিবীর হারাম উপার্জন ও আনন্দ মানুষকে আল্লাহর কাছ থেকে আরো বেশী দূরে নিয়ে যায়।
মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছে :
‘
পৃথিবীর ভালোবাসা ও আল্লাহর ভালোবাসা একটি ক্বলবে কখনো জমা হয় না।’
ইমাম আলী (আঃ) এ বিষয়ে বলেছেন :
‘
যেভাবে সূর্য ও রাত মিলিত হয় না সেভাবে আল্লাহর ভালোবাসা ও পৃথিবীর ভালোবাসা মিলিত হয় না।’
অন্য একটি হাদীসে তিনি বলেন :
“
কীভাবে একজন ব্যক্তি আল্লাহ প্রেমের দাবী করে অথচ পৃথিবীর প্রেম তার অন্তরে বাসা বেঁধেছে।”
হযরত শেইখ তার উদাহরণগুলোতে সব সময় পৃথিবীকে ডাইনী বুড়ির সাথে তুলনা করতেন এবং মাঝে মাঝে তার কোন শিষ্যের দিকে ফিরে বলতেনঃ“
আমি দেখছি তুমি ডাইনী বুড়ির কারণে জটিলতায় পড়েছো!”
তারপর তিনি হাফিযের এ কবিতাটি বর্ণনা করতেন :
‘
কেউ নেই ঐ বৃত্তাকার জালে জড়িয়ে পড়ে নি।
কে আছে যার পথে এরকম পরীক্ষার ফাঁদ বিছানো নেই ?
প্রকৃতপক্ষে হযরত শেইখ তুলনাটি এ হাদীস থেকে দিয়েছেন :
“
এ পৃথিবীর বাস্তবতাকে দেখানো হয়েছিলো ঈসা (আঃ) কে। তিনি এটিকে দেখলেন এক বৃদ্ধা হিসাবে যে তার সব দাঁত হারিয়েছে এবং তার গায়ে ছিলো সব ধরনের অলংকার। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন :
‘
তোমার কতজন স্বামী আছে ? সে বললো :‘
আমি গুনি নি !’
তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন :‘
তোমার সব স্বামী কি মারা গেছে না তারা তোমাকে তালাক দিয়েছে ?’
সে উত্তর দিলো :‘
না , বরং আমি তাদের সকলকে হত্যা করেছি!’
ঈসা (আঃ) বললেন :‘
দূর্ভোগ তোমার ভবিষ্যত স্বামীদের প্রতি যারা তোমার অতীত স্বামীদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নি ; কীভাবে তুমি তাদের প্রত্যেককে হত্যা করেছো এবং তারা তোমার কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়নি।”
হযরত শেইখ বার বার বলতেন :
‘
যারা আমার কাছে আসে তারা ঐ ডাইনী বুড়ির
খোঁজে আসে। কেউ এখানে এটি বলার জন্য আসে না যে , আমার আল্লাহর সাথে ভালো সম্পর্ক নেই , আমাকে তাঁর সাথে মিলিয়ে দিন।’
দুনিয়া লোভী মানুষের অভ্যন্তরীণ চেহারা
হযরত শেইখ যিনি মানুষের গভীরতম চেহারা দেখতে পেতেন। তিনি তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বলতেন :
“
যারা পৃথিবীকে অবৈধ পন্থায় চায় তাদের ভিতরের চেহারা কুকুরের মত। যারা আখেরাত চায় তাদের চেহারা নিরপেক্ষ এবং যারা আল্লাহকে চায় তারা পৌরুষদীপ্ত।”
আল্লাহ প্রকাশকারী অন্তর
হযরত শেইখ বলেছেন :
“
অন্তর ইঙ্গিত দেয় সে কী চায়। চেষ্টা করো যেন তোমার অন্তর আল্লাহকে ইঙ্গিত করে! মানুষ যা চায় তার ছবি তার অন্তরে প্রতিফলিত হবে , যেন যারা ঐশী জ্ঞানে জ্ঞানী তারা তার অন্তর দেখে বুঝতে পারে বারযাখে সে কোন অবস্থায় থাকবে। যদি তারা কারোর বাইরের সৌন্দর্য দেখে মোহাচ্ছন্ন হয় অথবা অর্থ ও সম্পদে খুব আগ্রহী থাকে তাহলে তারা বারযাখে সেই আকার লাভ করবে যে জিনিস তারা পৃথিবীতে ভালোবাসতো।”
“
তুমি কী করেছো ?”
হযরত শেইখের এক শিষ্য বলেন :
এক রাতে আমি নারীঘটিত আনন্দদায়ক স্বপ্ন দেখলাম। যা আমার মনে সারা দিন ঘুরতে লাগলো। পর দিন সকালে আমি হযরত শেইখের সাক্ষাতে গেলাম। আমাকে দেখে তিনি আবৃত্তি করলেন :
“
যদি মনে করো তোমার বন্ধুর সাথে মেলা মেশা বন্ধ করবে না তাহলে (প্রেমের) সূতোতে ধরে থাকো যেন তিনিও তা ধরে রাখেন। হে অন্তর এমনভাবে জীবিকা অর্জন করো , যেন যদি তোমার পা পিছলে যায় ফেরেশতারা তোমাকে রক্ষা করবে দোয়ার দু’
হাত দিয়ে।’
আমি বুঝলাম যে তিনি কিছু অনুভব করেছেন। তিনি এ কবিতা আবৃত্তি করবেন না উদ্দেশ্য ছাড়া। আমি কিছুক্ষণ বসে রইলাম। হযরত শেইখ সেলাইতে ব্যস্ত ছিলেন। আমি বললাম :“
এতে কোন কিছু আছে (আপনি যা বলতে চান) ?”
তিনি বললেন :“
তুমি কী করেছো যে তোমার চেহারা মেয়েদের মত হয়ে গেছে ?”
আমি বললাম আমি স্বপ্নে এক সুন্দর মহিলা দেখেছি এবং এর স্মৃতি আমার ভিতর রয়ে গেছে। তখন তিনি বললেন :“
হ্যা সেটাই! আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও!”
“
আমি তোমার মাঝে কী দেখছি ?!”
হযরত শেইখের এক ভক্ত বলেন :
আমি একবার হযরত শেইখের সাথে দেখা করতে বাড়ি থেকে বের হলাম। পথে আমি একজন বোরখাবিহীন মহিলাকে দেখলাম যে আমার মনোযোগ কাড়লো। আমি হযরত শেইখের বাড়িতে গেলাম এবং তার পাশে বসলাম। তিনি আমার দিকে তাকালেন এবং বললেন :
“
হে অমুক! আমি তোমার মাঝে কী দেখছি ?!”
আমি মনে মনে বললাম :‘
ইয়া সাত্তারাল উয়ুব (হে ত্রুটি গোপনকারী)!’
হযরত শেইখ মুচকি হাসলেন এবং বললেন :
“
তুমি কী করেছো যে আমি যা দেখছিলাম তা চলে গেলো ?!”
পুরুষ যারা মহিলায় পরিণত হলো!
ডঃ হাজ্ব হাসান তাওয়াক্কুলি বর্ণনা করলেন : একদিন আমি ক্লিনিক (ডেন্টিষ্ট এর) থেকে বের হলাম কোথাও যাওয়ার জন্য , আমি একটি বাসে উঠলাম এবং যখন তা ফেরদৌসী স্কোয়ারে এসে থামলো , কিছু লোক বাসে উঠলো এবং তখন আমি দেখলাম ড্রাইভার একজন মহিলা এবং আমি আরো দেখলাম সবাই মহিলা। তাদের সবার চেহারা এক ও একই পোষাক! আমি দেখলাম আমার পাশেও এক মহিলা বসে আছে। আমি নিজেকে সরিয়ে নিলাম এবং ভাবলাম আমি ভুল বাসে উঠে পড়েছি। এটি হয়তো মহিলা কর্মচারীদের বাস সার্ভিস। বাসটি থামলো এবং একজন মহিলা নেমে গেলো। মহিলা যখন নেমে গেলো (বাসের) সবাই পুরুষে পরিণত হয়ে গেলো।
যদিও আমি প্রথমে হযরত শেইখের কাছে যাওয়ার ইচ্ছা করি নি কিন্তু বাস থেকে নেমে আমি হযরত শেইখের কাছে গেলাম। আমি কিছু বলার আগেই হযরত শেইখ বললেন :
“
তুমি সব পুরুষকে মহিলা হয়ে যেতে দেখেছো! যেহেতু সবার মনোযোগ কেড়েছিলো ঐ মহিলা তাই সবাই মহিলাতে পরিণত হয়েছিলো!”
তখন তিনি আরো বললেন :
“
মৃত্যুর সময় ব্যক্তি যে দিকে মনোযোগ রাখবে তাই তার চোখের সামনে বাস্তবে পরিণত হবে। আমিরুল মুমিনীন আলী (আঃ) সম্পর্কে ভালোবাসা নাজাতের দিকে নিয়ে যাবে।”
“
কতই না সুন্দর আল্লাহর সৌন্দর্যে নিমজ্জিত হওয়া-
যাতে তুমি এমন কিছু দেখো যা অন্যরা দেখে না ও এমন কিছু শোন যা অন্যরা শোনে না।”
“
টেবিলটি কী ?”
ডঃ সুবাতি বললেন : সাইয়্যেদ জাফর নামে একজন মূচি ছিলেন । যিনি এখন মৃত। তিনি বলেছেন :
‘
একবার আমার বাসায় একটি বড় টেবিল ছিলো যা রাখার মত ভালো কোন জায়গা আমি পাই নি এবং ভাবছিলাম তা নিয়ে কী করি। সন্ধ্যা রাতে আমি বৈঠকে গেলাম এবং আমাকে দেখার সাথে সাথেই হযরত শেইখ নীচু স্বরে বললেন অন্তরের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে :
“
এটা কিসের টেবিল যা তুমি ওখানে রেখেছো”
মূচি সাইয়্যেদ জাফর হঠাৎ বুঝতে পারলেন হযরত শেইখ কী বোঝাচ্ছেন ; তিনি হাসলেন এবং বললেন :
“
হযরত শেইখ! ওটা রাখার মত কোন জায়গা আমি পাইনি তাই তা এখানে রেখেছি!!”
ঐশী রহস্য অর্জন করা
হযরত শেইখ বিশ্বাস করতেন যে প্রাথমিকভাবে , ঐশী রহস্য অর্জন করার জন্য যে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন তা হলো আল্লাহ সম্পর্কে জানা।
তিনি বলতেন :
“
যতক্ষণ আল্লাহ ছাড়া আর কোন কিছুর প্রেম অন্তরে তিল পরিমাণ থাকবে ঐশী রহস্যের কোন কিছু অর্জন অসম্ভব!”
“
আল্লাহ ছাড়া আর কিছু চেওনা!”
হযরত শেইখ দু’
জন ফেরেশতা থেকে শিখেছেন যে‘
তিনি যেন আল্লাহ ছাড়া আর কিছু না চান।’
তার এক শিষ্য বলেন যে হযরত শেইখ বলেছেন :
এক রাতে দু’
জন ফেরেশতা দু’
টি কথার মাধ্যমে আমাকে (আল্লাহর একত্বে) ফানাহ হওয়া সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। আর কথা দু’
টি হলো :
“
নিজের সম্পর্কে কিছু বলবেন না এবং আল্লাহ ছাড়া কিছু চাইবেন না!”
একইভাবে তিনি বলেছেন :
“
সচেতন হও , গোটা সৃষ্টি তোমাদের জন্যই। আল্লাহ ছাড়া আর যা কিছু চাও তা তোমার ব্যর্থতার (নিদর্শন) ।”
বুদ্ধি ও নফসের মাক্বাম
হযরত শেইখ বলেছেন : যদি মানুষ বুদ্ধির মাক্বামে থাকে সে কখনো ইবাদাত বন্দেগী পরিত্যাগ করবে না , আল্লাহর অবাধ্যতায় গুনাহ করবে না এবং হাদীস অনুযায়ী :
(বুদ্ধি হলো তা যা দিয়ে দয়ালু খোদার ইবাদাত করা হয় এবং যার মাধ্যমে বেহেশত অর্জন করা যায়)
এ ধাপে সে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু খোঁজে , যেমন- বেহেশত। কিন্তু যখন সে রুহের ধাপে পৌঁছে , এ আয়াত অনুযায়ী-
)
وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي(
“
এবং তার ভিতরে আমি রুহ ফুঁকে দিয়েছি”
(সূরা আল হিজর-29)
সে শুধু সত্যের দিকে তাকাবে এবং দ্বিতীয় কবিতাটির প্রমাণ হয়ে যায়ঃ
‘
জনগনের রোজা হচ্ছে পান ও আহার থেকে বিরত থাকা নির্বাচিতদের রোজা হচ্ছে সব ধরণের গোনাহ থেকে বিরত থাকা তার রোজা হচ্ছে বন্ধু (আল্লাহ) ছাড়া সব কিছু থেকে বিরত থাকা যা সে চায় সব তাঁরই জন্য।’
এবং কবি হাফিয বলেছেন :
“
যদি বেহেশত আমাকে দেয়া হয় কীভাবে আমি তা গ্রহণ করবো যেহেতু আমার দৃষ্টিতে‘
বন্ধু’
(আল্লাহ) বেহেশত থেকে উত্তম।”
ভালোবাসার উপর ভিত্তি করে ইবাদাত
আল্লাহকে সন্ধান করার চরম পর্যায়ে মানুষ আল্লাহর ইবাদাত করে ভালোবাসার কারণে , জান্নাত লাভ বা জাহান্নামের ভয়ে নয়। ইমাম সাদিক (আঃ) তার নিজের ইবাদাত সম্পর্কে বলেন :
“
সর্বশক্তিমান ও মহিমান্বিত আল্লাহর ইবাদাত করে মানুষ তিন দলে : একদল তার ইবাদাত করে পুরস্কারের জন্য যা লোভীদের ইবাদাত এবং তা সম্পদের লোভ ; অন্য দলটি তাঁর ইবাদাত করে জাহান্নামের ভয়ে যা দাসদের ইবাদাত এবং তা ভীতি ; কিন্তু আমি সর্বশক্তিমান ও মহিমান্বিত আল্লাহর ইবাদাত করি প্রেমে ও ভালোবাসায় যা মর্যাদাবানদের ইবাদাত এবং তা নিরাপত্তার উৎস। কারণ সর্বশক্তিমান ও মহিমান্বিত আল্লাহ বলেন :
“
এবং তারা সেদিনের ভয় থেকে মুক্ত।”
(সূরা নামল-89)
এবং সর্বশক্তিমান ও মহিমান্বিত আল্লাহ আরও বলেন :
‘
বলো , যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।’
(সূরা ইমরান- 31)
“
এভাবে যে সর্বশক্তিমান ও মহিমান্বিত আল্লাহকে ভালোবাসে , তিনিও তাকে ভালোবাসবেন এবং যাকে সর্বশক্তিমান ও মহিমান্নিত আল্লাহ ভালোবাসেন সে নিরাপদ থাকবে (বিচার দিনের আতংক থেকে)।”
হযরত শেইখ বার বার তার বন্ধুদের উদ্বুদ্ধ করতেন সংগ্রাম করার জন্য যেন তারা আল্লাহর জ্ঞান লাভে এ অবস্থা অর্জন করে যেখানে আল্লাহর প্রেম ছাড়া আর কোন কিছু তাদের ইবাদাতে উদ্বুদ্ধ না করে।
সবকিছু নিজের জন্য , এমনকি আল্লাহও
হযরত শেইখ বলতেন :
‘
হে মানুষ! কেন তোমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু দাবী করো ? তিনি ছাড়া অন্যের কাছ থেকে কী দেখেছো (পেয়েছো) ?
তিনি যদি ইচ্ছা না করেন কোন কিছুই ঘটবে না ; এবং তোমাদের প্রত্যাবর্তন হচ্ছে তাঁর দিকে।’
‘
শহরে চিনি [লাভজনক লক্ষ্য] আছে।
কিছু পথ পরিক্রমণকারী বাজপাখীরা মাছি শিকার করে সন্তষ্ট!’
তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে দিয়েছো অন্যের কারণে! কেন তোমরা নিজের চারিদিকে ঘুরছো ?! আল্লাহকে খোঁজ এবং প্রত্যেক দাবীকে একটি প্রস্তুতি বানাও তাঁর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য। সমস্যা হলো আমরা সব চাই এমনকি আল্লাহকেও নিজের জন্য!”
ধার্মিকতার সর্বোচ্চ স্তর
হযরত শেইখ ধার্মিকতার স্তর সম্পর্কে বলতেন :
“
ধার্মিকতার বিভিন্ন স্তর রয়েছে ; একদম নীচের স্তর হলো ওয়াজিব পালন করা এবং হারাম এড়িয়ে চলা , যা ঠিক আছে , এবং তা কিছূ লোকের জন্য যথপোযুক্ত ; কিন্তু সর্বোচ্চ ধার্মিকতা দাবী করে আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুকে এড়িয়ে চলা , আর তাহলো অন্তরে কোন কিছুকে মূল্য না দেয়া একমাত্র আল্লাহর প্রেম ছাড়া।”
প্রেমের বিদ্যালয়
হযরত শেইখ বিশ্বাস করতেন মানুষ মনুষত্বের চরম শিখরে পৌঁছতে পারবে না , যদি না সে অন্তরকে আল্লাহ ছাড়া অন্যদের দিক থেকে ফিরিয়ে না নেয়। যদি সে সংগ্রামও করে তার আত্মপূর্ণতা অর্জনের জন্য , তাহলে সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। এভাবে , যদি কেউ হযরত শেইখের কাছে পথ পাওয়ার জন্য আসতো তার আত্মশুদ্ধির প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলতেন :
‘
তুমি কাজ করেছো ফলাফল লাভের আশায়। অথচ এটি ফলাফলের বিদ্যালয় নয় , এটি আল্লাহমুখী হওয়ার বিদ্যালয়।”
অন্তরের চোখ খোলা
মরহুম হযরত শেইখ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখেছিলেন যে অন্তরের চোখ ও কান খুলে যাওয়া এবং অদৃশ্যের রহস্য সম্মন্ধে জানা সম্ভব হবে পূর্ণ আন্তরিকতা ও আল্লাহমূখী হওয়ার মাধ্যমে। তিনি বলতেন :
“
যদি তোমরা তোমাদের অন্তর সম্পর্কে সতর্ক থাকো এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে এতে প্রবেশ করতে না দাও তাহলে তোমরা দেখতে সক্ষম হবে যা অন্যরা দেখতে সক্ষম নয় এবং শুনবে যা অন্যরা শুনতে অক্ষম।”
যদি মানুষ তার অন্তরের চোখকে আল্লাহ ছাড়া অন্যদের কাছ থেকে সরিয়ে রাখে তিনি তাকে জ্যোতি দান করবেন এবং তাকে ঐশী সত্তার মৌলিক বিষয়গুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিবেন।
যদি কেউ আল্লাহর জন্য কাজ করে তার অন্তরের চোখ খুলে যাবে।
“
বন্ধুরা! আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো তোমাদেরকে বধিরতা ও অন্ধত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য , যতক্ষণ মানুষ আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু খোঁজ করবে সে বধির ও অন্ধ থাকবে!!”
ভিন্নভাবে বলা যায় হযরত শেইখ বিশ্বাস করতেন অতিন্দ্রীয় জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয় সুস্থ একটি অন্তর ছাড়া। একটি পূর্ণ সুস্থ অন্তর হলো যেখানে সামান্যতম দুনিয়া প্রেম নেই এবং আল্লাহ ছাড়া কিছুই চায় না। ইমাম সাদিক (আঃ) সুস্থ অন্তর সম্পর্কে যা বলেন তার সাথে একথা সঙ্গতিপূর্ণ।
)
مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ(
“
শুধু সে (সমৃদ্ধি লাভ করবে) যে আল্লাহর কাছে আনবে একটি সুস্থ অন্তর।”
(সূরা শুআরা-89)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় পবিত্র ইমাম (আঃ) বলেন :
“
তা একটি হৃদয় যা নোংরা আকাঙ্ক্ষার ভালোবাসা থেকে পবিত্র।”
অন্য একটি হাদীসে ইমাম (আঃ) বলেন :
“
আত্ম -সমর্পিত এবং পবিত্র অন্তর হলো সেটি যা রবের সাথে মিলিত হয় , যখন এতে তিনি ছাড়া কেউ থাকে না এবং শিরক ও সন্দেহ আছে এমন প্রত্যেক অন্তর ত্রুটিযুক্ত [এবং অসুস্থ]।”
অন্তরের অভ্যন্তরীণ চেহারা
হযরত শেইখ বলেছেন : যখন কোন ব্যক্তিকে ভেতরের চোখ (অন্তরের চোখ) দেয়া হয় , যখনই সে তার অন্তরে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দেয় তার ভেতরের (বারযাখীর) অন্তর সেটারই রূপ ধারণ করে। যদি তুমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু দাবী কর , তোমার মূল্য হলো ততটুকু যা তুমি দাবী করেছো ; এবং যদি তুমি আল্লাহমূখী হও তোমার মূল্য অপরিসীম। যে আল্লাহর সাথে থাকবে আল্লাহ তার সাথে থাকবেন। যদি তুমি সব সময় আল্লাহতে নিমজ্জিত থাকো ঐশী জ্যোতি তোমার উপর জ্বলবে এবং যা তুমি ইচ্ছা কর তা তুমি দেখবে ঐশী আলোতে ।
যে অন্তরে সব কিছু উপস্থিত
হযরত শেইখ বলেছেন :
“
চেষ্টা করো তোমার অন্তরকে আল্লাহর জন্য স্থাপন করতে ; যখন তোমার অন্তর আল্লাহর জন্য হবে তখন তিনি সেখানে থাকবেন ; যখন তিনি সেখানে থাকবেন তখন যা কিছু তাঁর সাথে সম্পর্কীত তা সেখানে উপস্থিত থাকবে ; যখন তুমি ইচ্ছা করবে সব ইচ্ছা তোমার সাথে থাকবে কারণ আল্লাহ সেখানে আছেন , নবী ও আওলিয়াদের রুহও সেখানে থাকবে ; তুমি যদি চাও এমনকি মক্কা ও মদিনাও তোমার সাথে থাকবে। তাই চেষ্টা করো যেন অন্তর শুধু আল্লাহর জন্য হয় যেন যা কিছু আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তা তোমার কাছে উপস্থিত থাকে!”
যে মানুষ কারামত সংঘটিত করে
হযরত শেইখ বিশ্বাস করতেন যদি আল্লাহ প্রেম অন্তরে আধিপত্য করে এবং তা সত্য সত্যই আল্লাহ ছাড়া আর কিছু চায় না তাহলে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধিতে পরিণত হবে এবং তার দ্বারা কারামত সংঘটিত হবে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন :
“
যদি কোন কিছু অন্য কিছুর উপর আধিপত্য করে তাহলে প্রথমটি তার বৈশিষ্টগুলো দ্বিতীয়টির উপর দান করবে। যেমন , যখন আগুনে লোহাকে রাখা হয় কিছু সময় পরে আগুন লোহার ভিতরে প্রবেশ করবে এবং লোহাকে আগুনের মত জ্বলতে সক্ষম করে। বিষয়টি মানুষ ও তার সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একই রকম।”
তিনি আরো বলেছেন :
“
আমরা অসাধারণ কিছু করি না , বরং আমরা খুঁজে নেই (তৈরী করি) সেই প্রকৃতি যা আল্লাহওয়ালা লোকদের থাকে। সব জিনিস মানুষকে দেয়া হয় রুহের মাধ্যমে। গরুর রুহ গরুর কাজ করে , মোরগের রুহ মোরগের কাজ করে। এখন আমাকে বলো , মানুষের খোদায়ি রুহ কি করবে ? ঐশী কাজইতো তাকে করতে হবে।”
)
وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي(
“
তার ভিতরে আমার রুহ ফুঁকে দিলাম।”
(সূরা হিজর-29)
এ আয়াতটি এ কথাটিই বলে।
অন্তর পরিষ্কার করা
আর এভাবে অতিন্দীয় জ্ঞান অর্জন করা যাবে না যদি অন্তরকে আল্লাহ প্রেম ছাড়া অন্য কিছু থেকে পবিত্র করা না হয় এবং মানুষ চরম পূর্ণতার অধিকারীর প্রেমে পড়বে না ঐশী জ্ঞান লাভের মাধ্যম ছাড়া। প্রধান সমস্যা হলো অন্তরকে দুনিয়াবী আকাঙ্ক্ষা থেকে পবিত্র করা সহজ কাজ নয়। কীভাবে অন্তরকে চেহারা মেক আপ করা‘
বুড়ির’
প্রেম থেকে মুক্ত করা যাবে ?
হযরত শেইখের মতে অন্তরকে পবিত্র করতে পারে ঐ একই জিনিস যা মানুষকে একত্ববাদের বাস্তবতা অর্জনে সাহায্য করে। যেমন আগের অধ্যায়ে উল্লেখিত বিষয় হলো :
1। নিরবচ্ছিন্ন উপস্থিতি (যিকর )
2। আহলে বাইত (আঃ) এর কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা
3। রাত্রে অনুনয় করা (দোয়া ও নামাযের মাধ্যমে)
4। অন্যের উপকার করা
আল্লাহকে ভালোবাসার পথ
হযরত শেইখ আল্লাহর কাছে যাওয়া
ও তাঁকে ভালোবাসার জন্য‘
অন্যের উপকার করাকে’
বিশেষ জোর দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন আল্লাহ প্রেমের মাধ্যম হচ্ছে তাঁর সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা ও অন্য লোকের সেবা , বিশেষ করে নির্যাতিত ও যারা কষ্টের মধ্যে আছে।
নবী (সাঃ) বলেছেন :
“
জনগণ হচ্ছে আল্লাহর পরিবার ; আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি হচ্ছে সে যে আল্লাহর পরিবারের কল্যাণকারী এবং যে তাদেরকে খুশী করে।”
অন্য একটি হাদীসে বলা হয় যে , নবী (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হলো :‘
কে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় ?’
নবী (সাঃ) উত্তর দিলেন :‘
যে জনগণের সবচেয়ে বেশি কল্যাণকারী।’
আরেকটি হাদীসে বলা হয় যে নবী (সাঃ) কে মেরাজের পূর্ব মুহূর্তে বলা হয়েছিলো :
“
হে আহমদ (মুহাম্মাদ)! আমাকে ভালোবাসা হচ্ছে দরিদ্রদের ভালোবাসা , তাই দরিদ্রদের তোমার কাছে টানো এবং তাদের জমায়েতে যাও কারণ দরিদ্ররা আমার বন্ধু।”
হযরত শেইখের এক শিষ্য বলেন :
‘
হযরত শেইখের পরামর্শে আমি বেশ কয়েক বার নেকা শহরে (উত্তর ইরানে) গেলাম আয়াতুল্লাহ কুহিস্তানির সাক্ষাতে। আমি একবার বাস ষ্টেশনে যাচ্ছিলাম নাসির খসরু এভিনিউতে নেকার টিকেট কিনতে যখন হযরত শেইখের সাথে দেখা হলো , তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথায় যাচ্ছি , আমি বললাম :‘
নেকাতে’
আয়াতুল্লাহ কুহিস্তানির সাথে দেখা করতে। তিনি বললেন :
“
তার পদ্ধতি হলো আত্মসংযম ; আমার সাথে আসো আমি তোমাকে আল্লাহ প্রেমের পথ দেখাচ্ছি।”
এর পর তিনি আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন (বর্তমান) ইমাম খোমেনী (রঃ) এভিনিউতে যা তখন সূর্কিতে ঢাকা ছিলো এবং কিছু দূরে এক গলিতে গিয়ে এক দরজায় টোকা দিলেন। জরাজীর্ণ বাড়িটি ছিলো কয়েকজন দরিদ্র ও হতভাগ্য শিশু ও বয়স্ক লোকের আশ্রয়। তাদেরকে দেখিয়ে হযরত শেইখ বললেন :
‘
এদের মত দারুণ অভাবী লোকদের প্রয়োজন মিটানো একজনকে আল্লাহ প্রেমিক বানায়! এটিই তোমার শিক্ষা। আয়াতুল্লাহ কুহিস্তানির কাছে তুমি আত্মসংযমের শিক্ষা পেয়েছো কিন্তু এটি হলো প্রেমের শিক্ষা।’
‘
তখন থেকে দশ বছর পর্যন্ত হযরত শেইখ ও আমি শহরের ঐ জরাজীর্ণ বস্তিতে যেতাম অভাবীদের সাহায্য করতে ; হযরত শেইখ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তাদেরকে আমার কাছে , আমি তাদের রসদ সরবরাহ করতাম।’