ইমাম হোসেইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর
মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার
ইমাম হোসেইন (আ.)-এর শাহাদাত
মহান আল্লাহর সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রিয় নাতি ইমাম হোসেইন (আ.) ছিলেন ইমাম আলী (আ.) ও হযরত ফাতিমার (আ.) প্রিয় সন্তান যাকে কারবালায় হিজরী 61 সনের 10ই মুহাররম নির্মমভাবে পিপাসার্ত , ক্ষুধার্ত ও অসহায় অবস্থায় শহীদ করা হয়। সাইয়েদুশ্ শুহাদা ইমাম হোসেইন (আ.) সম্পর্কে মহানবীর (সা.) সবচেয়ে সুপরিচিত হাদীস যা সেখানকার উপস্থিত হত্যাকারীরা পর্যন্ত জানতো যে ,“
হাসান ও হোসেইন বেহেশতের যুবকদের সর্দার।”
[জামে আত-তিরমিযী , হাদীস-3720]
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন ,‘
আর হোসেইনের (আ.) বিষয়ে — সে আমার থেকে , সে আমার সন্তান , আমার বংশ , মানবজাতির মধ্যে তার ভাইয়ের পরে শ্রেষ্ঠ। সে মুসলমানদের ইমাম , মুমিনদের অভিভাবক , জগতসমূহের রবের প্রতিনিধি , তাদের সাহায্যকারী যারা সাহায্য চায় , তাদের আশ্রয় যারা আশ্রয় খোঁজে , [সে] আল্লাহর প্রমাণ তাঁর পুরো সৃষ্টির ওপরে , সে বেহেশতের যুবকদের সর্দার , উম্মতের নাজাতের দরজা। তার আদেশই হলো আমার আদেশ। তার আনুগত্য করা হলো আমারই আনুগত্য করা। যে-ই তাকে অনুসরণ করে সে আমার সাথে যুক্ত হয় এবং যে তার অবাধ্য হয় সে আমার সাথে যুক্ত হতে পারে না। ’ [মীযান আল-হিকমাহ , হাদীস-428]
ইমাম হোসেইন (আ.) ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার , বিনয়ী , জ্ঞানী , সাহসী এবং স্বাধীনতাকামী একজন নেতা। তিনি তার নানা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের সংশোধনের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে উদ্দ্যোগ নেন। কিন্তু সে সময়ের খলিফা [শাসক] ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়া তা অপছন্দ করে এবং তার সব ধরনের অন্যায় ও অপকর্মকে সম্মতি দিয়ে তার প্রতি আনুগত্য করার আদেশ দেয়। আর তা করা না হলে তাকে হত্যা করা হবে বলে জানিয়ে দেয়। ইমাম হোসেইন (আ.) তার সব অপকর্মের প্রতিবাদ করেন এবং আনুগত্য করতে অস্বীকার করেন।
কিন্তু তিনি জানতে পারেন ইয়াযীদ হজ্বের সময় তাকে হত্যার জন্য মক্কায় তার দূত পাঠিয়েছে। পবিত্র কাবা ঘরের কোন স্থানে তার রক্ত ঝরুক এটি তিনি পছন্দ করেন নি। তাই হজ্ব না করেই 8ই জিলহজ্ব ইমাম হোসেইন (আ.) মক্কা থেকে মরুভূমির দিকে বেরিয়ে পড়েন। [বর্তমান ইরাকের] কুফা এলাকা থেকে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ইমাম হোসেইন (আ.)-কে চিঠি পাঠিয়েছিলেন যেন তিনি কুফায় যান এবং সেখানে গিয়ে তাদের ধর্মীয় নেতৃত্ব দেন। এতে ইসলাম ধ্বংস ও বিকৃতি থেকে রক্ষা পাবে। এসব চিঠির কারণে ইমাম হোসেইন (আ.) মক্কা ত্যাগ করে কুফার দিকে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু পথে ইয়াযীদের নিয়োগ করা গভর্নর উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের আদেশে হুর বিন ইয়াযীদ ইমামকে বাধা প্রদান করে এবং কারবালা প্রান্তরে নিয়ে যায়। এখানে শত্রুরা প্রায় ত্রিশ হাজার সসস্ত্র সৈন্য মোতায়েন করে এবং ইমাম হোসেইন (আ.)-কে জোরপূর্বক বাইয়াত [আনুগত্য] করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। তারা জানায় যে , যদি তা না করা হয় তাহলে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে।
ইমাম হোসেইন (আ.)-এর সাথে ছিলো কেবল অল্প ক ’ জন বন্ধু ও সাহায্যকারী এবং তার পরিবারের নারী ও শিশুরা। যুদ্ধ করতে পারেন এমন পুরুষের সংখ্যা ছিলো 70 জনেরও কম। তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে সত্য ইসলামকে রক্ষার জন্য [আত্মরক্ষার] যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
শত্রুরা ইমাম হোসেইন (আ.)-কে কাবু করার জন্য পাশেই বয়ে যাওয়া ফোরাত নদীর তীর ঘেরাও করে রাখে যাতে ইমাম হোসেইন (আ.) ও তার সাথীরা পানি থেকে বঞ্চিত হন। একটানা কয়েক দিন ইমামের পরিবারের নারী , শিশুরা ও সাথীরা পানি থেকে বঞ্চিত হয়। শিশুরা পানির পিপাসায় কাতর হয়ে যায়। এমন অবস্থায় শত্রুরা 9ই মহররম ইমামকে যুদ্ধ শুরুর জন্য অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে এবং ইমামের তাবুর দিকে তীর নিক্ষেপ করতে থাকে। ইমাম হোসেইন (আ.) শত্রুদের কাছে তার দূত পাঠালেন এ বলে যে , তিনি একটি রাত ইবাদতের জন্য সময় চান। শত্রুরা এক রাতের জন্য তাকে সময় দেয়।
ইমাম হোসেইন (আ.) ও তার সব সাথীরা জীবনের শেষ রাতটি আল্লাহর যিকির , দোয়া , নামায ও কুরআন তেলাওয়াতে কাটালেন। সকাল হলে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর বড় ছেলে হযরত আলী আকবর (আ.) আযান দিলেন এবং সবাই নামায আদায় করলেন। এরপর শত্রুরা বৃষ্টির মতো তীর ছুঁড়ে যুদ্ধ শুরু করে ইমামের একদল ক্লান্ত , ক্ষুধার্ত , পিপাসার্ত ও পরহেজগার সাথীদের বিরুদ্ধে। যাদের সংখ্যা নগন্য। ইমাম হোসেইন (আ.)-এর সাথে থাকা শিশু সহ মোট সংখ্যা প্রায় 100 লোকের বিরুদ্ধে 30 ,000 সসস্ত্র সেনাদলের যুদ্ধ। পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম অসম যুদ্ধ আর দেখা যায় না।
জোর করে চাপিয়ে দেওয়া এ যুদ্ধে ইমাম হোসেইন (আ.)-সহ মোট 72 জন শহীদ হন। শত্রুরা ইমাম হোসেইন (আ.)-এর সন্তান মাত্র 6 মাসের শিশু আলী আসগরকেও তীর নিক্ষেপ করে হত্যা করে। জঘন্য ও নিকৃষ্টতম ঐ শত্রুরা তাদেরকে হত্যার পর তাদের লাশের মাথাগুলো কেটে বর্শার মাথায় বিদ্ধ করে এবং দশ জন ঘোড়সওয়ার দেহগুলোকে ঘোড়ার পায়ের আঘাতে আঘাতে পিষ্ট করে।
তারা তাবুগুলো লুট করে ও তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। লুট করার সময় শোকার্ত পরিবারের সদস্যদের চাবুক মারে। ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মেয়ে পাঁচ বছরের শিশু সাকিনার কানের দুল কান থেকে ছিঁড়ে নেয় এবং তা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। শিশুরা ভয়ে ও ব্যাথায় কাঁদতে থাকলে তাদের গালে চড় মারে। নারীদের মাথার চাদরও [বোরখা] কেড়ে নেয়। নবী পরিবারের নির্যাতিত অসহায় এসব সম্মানিত ব্যক্তিরা মরুভূমিতে আশ্রয়হীনভাবে খোলা আকাশের নীচে চলে আসেন।
চিত্র: [....] ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মদীনা থেকে যাত্রা করে
মক্কা হয়ে কারবালায় যাওয়ার রুট।
[― ] মহানবীর (সা.) পরিবারের বন্দী অবস্থায় কারবালা থেকে
কুফা হয়ে দামেস্কে গমনের রুট।
এরপর নবী পরিবারের বেঁচে থাকা সব সদস্যদের বন্দী করা হয় এবং তাদের সাথে নিকৃষ্ট ও অপমানজনক আচরণ করা হয়। সব বন্দীদের প্রথমে কুফায় উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের প্রাসাদে নেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে সিরিয়ার দামেস্কে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার রাজপ্রাসাদে নেওয়া হয়। কারবালা থেকে কুফা ছিল প্রায় 76 কিলোমিটার এবং কুফা থেকে দামেস্ক ছিল প্রায় 1200 কিলোমিটার। কুফা থেকে দামেস্কে [শামে] যাওয়ার এ দীর্ঘ পথে কাফেলাটি বিভিন্ন যায়গায় মোট উনিশটি স্থানে বিশ্রামের জন্য থামে। থামার যায়গাগুলো ছিল‘
প্রথম বিশ্রামের স্থান’
, তাফরিত্ , মাশহাদ আল-নুকতা , ওয়াদি আল-নুখলা , মুসাল , নাসিবুন , আ ’ ইনুল ওয়ারদা , রাক্কা , জুসাক্ব , দাওয়ায়াত , হাল্ব , ক্বিন্নাসরিন , মায়াররা আল-নুমান , শিযর , কাফরি তালিব , সিবুর , হামাত , হিমাস ও বালবাক।
মহানবীর (সা.) বন্দী পরিবারের নারী , শিশু ও একমাত্র জীবিত পুরুষ [অসুস্থ] ইমাম আলী ইবনে হোসেইন (আ.)-কে প্রায় 20 দিন ধরে কয়েদিদের মতো দড়িতে হাত বাঁধা অবস্থায় জিন ছাড়া ও ছাউনি-বিহীন উটে ও খচ্চরে চড়ে ― আবার কখনোবা পায়ে হেঁটে ― মরুভূমির উত্তপ্ত দিনগুলোতে এ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
আমরা এ সংকলনটিতে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর কারবালায় বেঁচে থাকা নবী পরিবারের সম্মানিত সদস্যদের সাথে এবং ইমাম হোসেইন (আ.)-এর লাশ ও কেটে নেওয়া মাথার সাথে কি অমানবিক , অপমানজনক ও প্রতিশোধমূলক আচরণ করা হয়েছে এবং পথিমধ্যে নবী পরিবারে নির্যাতিত ও শোকার্ত সদস্যগণ যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তা বিভিন্ন ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলো থেকে উপস্থাপন করবো। এ বর্ণনাগুলো প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা শেইখ আব্বাস কুম্মি রচিত‘
শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস ’ [নাফাসুল মাহমুম] থেকে নেওয়া হয়েছে।