শহীদদের পবিত্র মাথাগুলোকে কুফায় উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের কাছে প্রেরণ
[‘
মানাক্বিব ’ ,‘
ইরশাদ ’ ও‘
মালহুফ ’ গ্রন্থে আছে] এরপর উমর বিন সা ’ আদ ইমাম হোসেইন (আ.)
-এর মাথাটি আশুরার দিনই উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের কাছে পাঠালো। তারপর সে ইমামের সাথীদের ও আত্মীয়দের মাথাগুলো জমা করলো যাদের সংখ্যা ছিলো বাহাত্তর। এরপর সে সেগুলো শিমর বিন যিলজাওশন , ক্বায়েস বিন আল-আশ ’ আস , আমর বিন হাজ্জাজ এবং উযরাহ বিন ক্বায়েসকে দিয়ে পাঠালো , যারা তা উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের কাছে পৌঁছালো।
তাবারি বলেন যে , খাওলি ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথাটি [কুফার] রাজপ্রাসাদে নিয়ে এলো এবং দেখলো যে তার তোরণ বন্ধ আছে। সে মাথাটি তার নিজের বাসায় নিয়ে গেলো এবং তা কাপড় ধোয়ার ড্রামের নিচে রাখলো। তার স্ত্রী ছিলো দুজন। এদের একজন ছিলো বনি আসাদ গোত্রের এবং অন্যজন ছিলো বনি হাযরাম গোত্রের যার নাম ছিলো নাওয়ার , সে ছিলো মালিক বিন আক্বরাবের কন্যা। সেদিন ছিলো নাওয়ারের দিন [স্বামীর সাথে থাকার] ।
হিশাম [বিন মুহাম্মাদ কালবি] বলে যে , আমার পিতা নাওয়ার থেকে শুনেছে যে , খাওলি ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথাটি এনে উঠানে কাপড় ধোয়ার একটি ড্রামের নিচে ঢেকে রেখেছিল। এরপর সে ঘরে প্রবেশ করলো এবং বিছানার ওপর বিশ্রাম নেওয়ার জন্য শুয়ে পড়লো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম ,“
তুমি কী খবর এনেছো ?”
সে জবাব দিলো ,“
আমি তোমার জন্য প্রচুর সম্পদ নিয়ে এসেছি। এটি হলো হোসেইনের মাথা যা তোমার বাড়ির উঠানে পড়ে আছে।”
আমি বললাম ,“
তোমার ওপর দুর্ভোগ হোক , মানুষ সোনা ও রুপা আনে , আর তুমি এনেছো রাসূলুল্লাহর (সা.) নাতির মাথা ? আল্লাহর শপথ , আমি কখনোই বিছানার ওপর তোমার পাশে মাথা রাখবো না।”
এরপর আমি বিছানা থেকে দূরে সরে গেলাম এবং বাড়ির উঠানে এলাম। এরপর সে [খাওলি] তার অন্য স্ত্রীকে ডেকে পাঠালো , যে ছিলো বনি আসাদ গোত্রের এবং সে তার বিছানায় উঠলো , আর আমি বসে রইলাম মাথাটির দিকে তাকিয়ে। আল্লাহর শপথ , আমি দেখলাম একটি আলোর স্তম্ভ একটি পাতের মত উঠান থেকে আকাশের দিকে উঠে গেছে ― আর কিছু সাদা রঙের পাখি তা তাওয়াফ করছে। এরপর যখন সকাল হলো সে তা [উবায়দুল্লাহ] ইবনে যিয়াদের কাছে নিয়ে গেলো।
সাইয়েদ ইবনে তাউস তার‘
ইক্ববাল ’ গ্রন্থে বলেন , জেনে রাখো যে , আশুরার সন্ধ্যায় ইমাম হোসেইন (আ.)-এর পরিবার , কন্যারা ও শিশু সন্তানরা শত্রুদের হাতে বন্দী হন। তারা শোক , দুঃখ ও কান্নার মাঝে ঘেরাও হয়ে পড়লেন। তারা সারা দিন যে অবস্থায় পার করেছেন সে ব্যাথা ও অসম্মান বর্ণনা করা আমার কলমের শক্তির বাইরে। তারা রাত কাটালেন পরিত্যক্ত অবস্থায় এবং কোন সাহায্যকারী ও তাদের পুরুষদের অনুপস্থিতির মাঝে। অন্যদিকে শত্রুরা তাদেরকে চরম ঘৃণা করছিল এবং তাদেরকে ঘৃণ্য মনে করে ফেলে রেখেছিল। এর মাধ্যমে তারা মুরতাদ [ধর্মত্যাগী] উমর বিন সা ’ আদ-এর নৈকট্য চেয়েছিল , যে মুহাম্মাদ (সা.)-এর সন্তানদের এতিম করেছিল এবং যে তাদের হৃদয়কে আহত করেছিল ― আর [নৈকট্য] চেয়েছিল উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের যে ছিলো নাস্তিক এবং ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়ার [নৈকট্য] , যে ছিলো বিদ্রোহী ― ধর্মদ্রোহী কথায় ও ঔদ্ধত্যের চুড়ায়।
এরপর তিনি বলেন যে , আমি‘
মাসাবীহ ’ -এ একটি হাদীস দেখেছি যা ইমাম জাফর আস-সাদিক্ব (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে , আমার পিতা ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী [আল বাক্বির] (আ.) আমাকে বলেছেন যে: আমি আমার পিতা আলী ইবনে হোসেইন [যায়নুল আবেদীন] (আ.)-কে বহনের জন্য ইয়াযীদ যে বাহন পাঠিয়েছিলো সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন , আমি একটি দুর্বল ও উলঙ্গ উটের পিঠে [হাওদার আসন ছাড়া] চড়েছিলাম , আর ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথাটি একটি বাঁশের মাথায় উঠিয়ে রাখা হয়েছিল। আর আমার পিছনে নারীদের বসানো হয়েছিল জিন ছাড়া খচ্চরের ওপর। একই সময়ে রক্ষীরা আমাদের মাথার পিছনে এবং চারিদিক থেকে ঘেরাও করেছিল বর্শা লম্বা করে। যদি আমাদের কারো চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি পড়েছে , তাহলে তাদের মাথায় আঘাত করা হয়েছে বর্শা দিয়ে , যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা দামেশকে প্রবেশ করলাম , একজন ঘোষক ঘোষণা দিচ্ছিলো , হে সিরিয়াবাসীরা , এরা হলো অভিশপ্ত পরিবারের বন্দীরা। [আউযুবিল্লাহ]
[তাবারির গ্রন্থে আছে] আযদি বলেন যে , আবু যুহাইর আবাসি বর্ণনা করেছে কুররাহ বিন ক্বায়েস তামিমি থেকে যে , সে বলেছে , আমি পাহারায় ছিলাম যখন [ইমাম] পরিবারের নারী ও শিশুদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো ইমাম হোসেইনের শাহাদাতের স্থানটির পাশ দিয়ে। তারা উচ্চকণ্ঠে কাঁদতে লাগলেন এবং নিজেদের চেহারাতে আঘাত করতে লাগলেন। আমি সবই ভুলতে পারি কিন্তু ঐ সময়টিকে ভুলতে পারি না যখন ফাতিমা (আ.)-এর কন্যা যায়নাব তার ভাই হোসেইনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলেন। তিনি চিৎকার করে বললেন ,“
হে মুহাম্মাদ , হে মুহাম্মাদ , আকাশের ফেরেশতাদের সালাম আপনার ওপরে , এ হলো হোসেইন যে রক্তে ভিজে গেছে এবং কর্তিত অবস্থায় মরুভূমিতে গড়িয়ে পড়েছে , হে মুহাম্মাদ , আপনার কন্যাদের বন্দী করা হয়েছে এবং আপনার বংশ শহীদ হয়ে পড়ে আছে ; আর বাতাস তাদের লাশের উপর বালি ছিটিয়ে দিচ্ছে।”
সে [কুররাহ] বলে যে ,“
আল্লাহর শপথ , তার কথাগুলো প্রত্যেক বন্ধু ও শত্রুকে কাঁদিয়েছে।”
যায়েদাহ থেকে একটি সুপরিচিত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে , ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেছেন যে , আমাদের ওপর যা আপতিত হয়েছিল কারবালার সমতলে , তা যখন ঘটলো ― আমার পিতা ও তার সন্তানদের মাঝে তার সাথীরা , ভাইয়েরা এবং অন্যান্যরা শহীদ হয়ে গেলেন। আর তার নারী-স্বজনদের এবং পরিবারকে উটগুলোয় উঠানো হলো যেগুলোতে বসার জন্য কোন আসন ছিলো না এবং কুফার দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। আমার দৃষ্টি পড়লো শহীদদের ওপর যারা মাটিতে পড়েছিলেন এবং তাদেরকে কেউ দাফন করে নি ― আমার হৃদয় চাপে সংকুচিত হয়ে গেলো। তা আমার ওপরে এত মারাত্মক ছিলো যে আমি শোকে প্রায় মৃত্যুর কাছে চলে গিয়েছিলাম। আমার ফুফু যায়নাব (আ.) , যিনি ছিলেন আলী (আ.)-এর কন্যা , আমার অবস্থা অনুভব করতে পারলেন এবং বললেন , হে আমার নানা , বাবা ও ভাইয়ের প্রতিচ্ছবি , কেন তুমি তোমার জীবনকে বিপদাপন্ন করছো ? আমি জবাব দিলাম , কেন আমি অস্থির হবো না , কেন আমি আমার জীবনকে বিপদাপন্ন করবো না , যখন আমি দেখছি আমার মাওলা , আমার ভাইয়েরা , চাচারা , চাচাতো ভাইয়েরা এবং আমার পরিবার রক্ত আর ধুলায় মেখে মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে , আবরণহীন ও বস্ত্রহীন অবস্থায় , মরুভুমিতে ? তাদের কাফনও পরানো হয় নি , দাফনও করা হয় নি। কেউ তাদের পাশে নেই , না কোন মানুষ তাদের চারপাশে ঘুরছে ― যেন তারা তুর্কী অথবা দায়লামি বংশ। তিনি বললেন , তুমি যা দেখছো তার কারণে স্থিরতা হারিও না , আল্লাহর শপথ , তোমার বাবা ও তোমার দাদা , রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে উপদেশ লাভ করেছেন যেন এ মারাত্মক দুর্যোগের তাপ সহ্য করেন। আর আল্লাহ এ উম্মতের একদলের কাছে অঙ্গীকার নিয়েছেন যাদেরকে এ পৃথিবীর ফেরাউনের মতো ব্যক্তিরা চেনে না , কিন্তু তারা আকাশের বাসিন্দাদের মাঝে সুপরিচিত যে , তারা এ দেহগুলোর টুকরোগুলোকে জড়ো করবে এবং দাফন করবে। আর তারা তোমার বাবার কবরের মাথার দিকে একটি নিদর্শন [গম্বুজ ও মিনার] প্রতিষ্ঠা করবে কারবালার ভূমিতে , যা চিরদিন থাকবে এবং কখনোই মুছে ফেলা হবে না। আর যদি কুফরের নেতারা এবং পথভ্রষ্টদের সমর্থকরা তা মুছে ফেলতে চায় , তাহলে এর নিদর্শন না কমে বরং প্রচুর সংখ্যায় বাড়তেই থাকবে এবং এ বিষয়টি দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
শেইখ তুসি থেকে বর্ণিত হয়েছে যে , বনি আসাদ গোত্রের লোকেরা একটি নতুন চাটাই এনে তা ইমাম হোসেইন (আ.)-এর দেহের নিচে বিছিয়ে দিয়েছিল। দীযাজ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে সে বলেছে ,“
আমি আমার দাসদের বিশেষ একদলকে নিয়ে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কবর খুঁড়ে উম্মুক্ত করলাম। আমি দেখলাম একটি নতুন চাটাইয়ের ওপর ইমাম হোসেইন (আ.)-এর দেহ শোয়ানো আছে , আর তা থেকে মেশকের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। আমি ঐ চাটাইটি আগের জায়গাতেই রেখে দিলাম যার ওপরে ইমামের দেহ শোয়ানো ছিলো। এরপর আমি আদেশ দিলাম মাটি দিয়ে ভরে দিতে এবং তার ওপর পানি ছিটিয়ে দিতে।
আবিল জারুদ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে , প্রথমে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কবর মাথার দিক থেকে উম্মোচন করা হলো , এরপর পায়ের দিকে। মেশকের সুগন্ধ তা থেকে ছড়িয়ে পড়ছিলো এবং কারো এতে সন্দেহ ছিলো না।
যায়েদাহ থেকে একটি সুপরিচিত হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে , জিবরাঈল রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বললেন , আপনার এ নাতি , তিনি তা বললেন ইমাম হোসেইন (আ.)-এর দিকে ইশারা করে , শহীদ হবে আপনার পরিবার , বংশ এবং আপনার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত ধার্মিক একদল মানুষের সাথে ফোরাত নদীর তীরে ― জায়গাটির নাম কারবালা। তিনি আরো বললেন , যখন তারা লুটিয়ে পড়বে তাদের আরামের জায়গায় , আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদের আত্মাগুলোকে নিজের হাতে হরণ করবেন , আর সপ্তম আকাশের ফেরেশতারা আসবে লালমনি ও পান্না-এর ট্রে নিয়ে যা পূর্ণ থাকবে চির জীবন লাভের পানি দিয়ে এবং থাকবে জান্নাতের চাদর ও সুগন্ধি , এরপর তারা দলে দলে তার লাশের জানাযার নামাজ পড়বে। এরপর আল্লাহ আপনার উম্মতের মধ্যে একটি দলকে ক্রিয়াশীল করবেন , যাদেরকে মুশরিকদের রাজ্য চিনতে পারবে না , না তারা তার সাথে রক্ত , বক্তব্য , ধারণা ও কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকবে। তারা তাদেরকে দাফন করবে এবং একটি নিদর্শনকে দাঁড় করাবে শহীদদের সর্দারের জন্য ঐ মরুভূমির বুকে , যা সৎকর্মশীলদের জন্য পথপ্রদর্শক হিসাবে কাজ করবে এবং বিশ্বাসীদের জন্য সম্মৃদ্ধির মাধ্যম হবে এবং প্রতিদিন প্রত্যেক আকাশ থেকে একশ লক্ষ ফেরেশতা একে তাওয়াফ করবে এবং তার প্রতি সালাম পেশ করবে। তারা আল্লাহর তাসবিহ করবে এবং তাঁকে অনুরোধ জানাবে তাদেরকে নাজাত দেওয়ার জন্য যারা তার কবর যিয়ারতে গেছে। এরপর তারা যিয়ারাতকারীদের নাম লিখে নিবে।”