নবী পরিবারের বন্দীদের কুফা থেকে দামেস্কে প্রেরণ
ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথা পাঠিয়ে দেওয়ার পর উবায়দুল্লাহ শিশুদের এবং নারীদের প্রস্তুত করলো এবং ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.) এর গলায় একটি লোহার বেষ্টনি পরালো এবং তাদেরকে মাথার পিছনে রওয়ানা করিয়ে দিলো মাখফার বিন সা ’ লাবাহ আ ’ য়েযী এবং শিমর বিন যিলজাওশানকে দিয়ে এবং তারা একসময়ে মাথাগুলো বহনকারী কাফেলার সাথে যুক্ত হলো। ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) পথে তাদের সাথে কোন কথা বললেন না সিরিয়া পৌঁছা পর্যন্ত।
‘
তারীখুল খামীস ’ গ্রন্থ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে যে , তারা [মাথা বহনকারীরা] এগিয়ে যেতে থাকলো একটি গির্জাতে পৌঁছানো পর্যন্ত এবং সেখানে তারা দুপুর পর্যন্ত বিশ্রাম নেয়ার জন্য প্রবেশ করলো। সেখানে তারা দেখলো দেয়ালে লেখা আছে ,“
যে উম্মত হোসেইনকে হত্যা করেছে , এরপরও তারা আশা করে যে কিয়ামতের দিন তার নানা তাদের জন্য সুপারিশ করবে ? তারা একজন পাদ্রীকে জিজ্ঞেস করলো , কে এ বাক্যগুলো লিখেছে ? সে বললো , এগুলো নবুয়ত ঘোষণার একশত পঞ্চাশ বছর আগে এখানে লেখা হয়েছিল।”
সিবতে ইবনে জাওযী তার ধারাবাহিক বর্ণনাকারীদের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন আবু মুহাম্মাদ আব্দুল মালিক বিন হিশাম নাহউই মিসরি থেকে , একটি হাদীসের মধ্যে আছে যে , তারা [মাথা বহনকারীরা] যখনই তাদের জিনিসপত্র নামাতো প্রতিবারই ট্রাংক থেকে পবিত্র মাথাটিও বের করে বর্শার ওপরে ওঠাতো। তারা সারা রাত পাহারা দিত ― সকাল পর্যন্ত এবং যাত্রা শুরুর আগে তা আবার ট্রাংকে ঢুকিয়ে রাখতো এবং সামনে অগ্রসর হতো। তাদের কোন এক যাত্রা বিরতির সময় এক পাদ্রীর গির্জার কাছে এলো। বরাবরের মতো তারা মাথাটি বর্শার ওপরে ওঠালো এবং একে পাহারা দিলো , আর বর্শাটিকে গির্জার দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখলো। মধ্যরাতে পাদ্রী দেখলো একটি আলোর রশ্মি মাথা থেকে বেরিয়ে আসছে এবং আকাশে পৌঁছে গেছে। সে গির্জার ওপর থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে বললো , তোমরা কারা ? তারা উত্তর দিলো , আমরা ইবনে যিয়াদের সাথী। সে বললো , এটি কার মাথা ? তারা বললো , এটি হোসেইনের , আলী বিন আবি তালিব ও আল্লাহর নবীর কন্যা ফাতেমার সন্তান। সে বললো , তোমরা বলতে চাও তোমাদের নবী ? তারা হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলো। একথা শুনে সে বললো , তোমরা মানুষের মধ্যে নিকৃষ্ট। যদি মসীহর [ঈসা-আ.] কোন পুত্র-সন্তান থাকতো আমরা তাকে আমাদের চোখের ওপর রাখতাম [আমরা তাকে অনেক সম্মান দিতাম] । আরো বললো , তোমরা কি কিছু চাও , আমাকে কি একটা উপকার করতে পারো ? তারা জিজ্ঞেস করলো তা কী ? সে বললো , আমার দশ হাজার আশরাফী আছে , তোমরা তা নিতে পারো যদি মাথাটি আমাকে দাও। সকাল পর্যন্ত তা আমার কাছে রাখতে দিবে এবং যখন তোমরা আবার যাত্রা করবে তখন তা আমার কাছ থেকে ফেরত নিয়ে নিও। তারা বললো , এতে আমাদের কোন ক্ষতি নেই। একথা বলে তারা মাথাটি তার কাছে হস্তান্তর করলো এবং সে [পাদ্রী] বিনিময়ে তাদেরকে আশরাফীগুলো দিলো। পাদ্রী মাথাটি পানি দিয়ে ধুয়ে নিলো। এতে সুগন্ধি মাখালো এবং তা তার উরুর ওপর রেখে সকাল পর্যন্ত অনেক কাঁদলো। যখন সকাল হলো সে বললো ,“
হে মাথা , আমার নিজের ওপরে ছাড়া আমার আর কোন ক্ষমতা নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং আপনার নানা আল্লাহর রাসূল। আপনি সাক্ষী থাকুন যে আমি আপনার বন্ধু ও গোলাম। এরপর সে গির্জা ও এর ভেতরে যা ছিলো সব পরিত্যাগ করলো এবং আহলুল বাইত (আ.)-এর গোলামদের সারিতে প্রবেশ করলো।”
ইবনে হিশাম তার‘
সীরাহ ’ -তে বলেছেন যে , তারা মাথাটি নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হলো এবং যখন দামেস্কের কাছে পৌঁছলো , তারা পরস্পরকে বলতে শুরু করলো যে , আসো আমরা আশরাফীগুলো আমাদের মাঝে ভাগ করে নেই। হয়তো ইয়াযীদ সেগুলো দেখলে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যাবে। থলেটি আনা হলো এবং খোলা হলো। তারা দেখলো তা মাটিতে পরিণত হয়েছে এবং এর এক পাশে লেখা ,
)
و
َلَا تَحْسَبَنَّ اللَّهَ غَافِلًا عَمَّا يَعْمَلُ الظَّالِمُونَ إِنَّمَا يُؤَخِّرُهُمْ لِيَوْمٍ تَشْخَصُ فِيهِ الْأَبْصَارُ(
“
এবং ভেবো না জালেমরা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ গাফেল। তিনি তাদের শুধু ঐ দিন পর্যন্ত রেহাই দেন যেদিন চোখগুলো পলকহীন তাকিয়ে থাকবে (আতঙ্কে) ।”
[সূরা ইবরাহীম: 42]
এবং অন্য পাশে লেখা:
)
و
َسَيَعْلَمُ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَيَّ مُنْقَلَبٍ يَنْقَلِبُونَ(
“
এবং শীঘ্রই জালেমরা জানতে পারবে কী খারাপ ফেরার দিকেই না তারা ফিরে আসবে।”
[সূরা আশ শুআরা: 227]
এ দেখে তারা সেগুলোকে বুরদা নদীতে নিক্ষেপ করলো।
সাইয়্যেদ ইবনে তাউস বলেন যে ইবনে লাহী ’ আহ এবং অন্যরা এ সংবাদটি দিয়েছে , যা থেকে আমরা একটি অংশ উল্লেখ করছি যতটুকু আমাদের প্রয়োজন: আমি কা ’ বা তাওয়াফ করছিলাম। তখন এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলাম , হে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করো। কিন্তু আমি জানি তুমি তা কখনো করবে না। আমি বললাম , হে আল্লাহর বান্দাহ , আল্লাহকে ভয় করো এবং এ কথা উচ্চারণ করো না। এমনও যদি হয় যে তোমার গুনাহ বৃষ্টির ফোটাগুলোর অথবা গাছগুলোর পাতার সংখ্যার সমান। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও , নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমা করে দেবেন। কারণ আল্লাহতো পরম ক্ষমাশীল ও পরম করুণাময়। সে বললো , আসো , যেন তোমাকে আমি আমার সম্পর্কে বলতে পারি। সে বললো , আমরা ছিলাম পঞ্চাশ জন যারা হোসেইনের মাথা নিয়ে সিরিয়া যাচ্ছিলাম। প্রতি রাতে আমরা হোসেইনের মাথাকে একটি ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে রাখতাম এবং একে ঘিরে থেকে মদপান করতাম। এক রাতে আমার বন্ধুরা মদপান করলো এবং মাতাল হলো এবং বেহুশ হলো , কিন্তু আমি মদ পান করি নি। যখন রাত্রির এক অংশ পার হয়ে গেলো , আমি একটি বজ্রপাতের শব্দ শুনতে পেলাম এবং বিদ্যুৎ চমকাতে দেখলাম। হঠাৎ আকাশের দরজাগুলো খুলে গেলো এবং নবী আদম (আ.) , নূহ (আ.) , ইবরাহীম (আ.) , ইসমাইল (আ.) , ইসহাক্ব (আ.) এবং আমাদের রাসূল মুহাম্মাদ (সা.) , সাথে জিবরাঈল এবং অন্যান্য ফেরেশতারা , নেমে এলেন। জিবরাঈল ট্রাঙ্কের কাছে এলেন এবং পবিত্র মাথাটি তা থেকে তুলে জড়িয়ে ধরলেন এবং চুমু দিতে লাগলেন। এরপর প্রত্যেক নবী তাকে অনুসরণ করে একই কাজ করলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তা শেষ নবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছালো। রাসূলুল্লাহ কাঁদতে শুরু করলেন এবং অন্য নবীরা তাকে সমবেদনা জানাতে লাগলেন। তখন জিবরাঈল বললেন ,“
হে মুহাম্মাদ (সা.) আমি আপনার উম্মত সম্পর্কে আপনার অনুগত। আপনি যদি আমাকে আদেশ করেন আমি তাদের ওপর জমিন উল্টিয়ে দিবো যেভাবে আমি দিয়েছি নবী লূতের (আ.) জাতিকে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন , হে জিবরাঈল , নিশ্চয়ই আল্লাহর সামনে তাদের বিরুদ্ধে হিসাব চাইবো। এরপর ফেরেশতারা আমাদের হত্যা করতে অগ্রসর হলো। আমি বললাম , আশ্রয় দিন , আশ্রয় দিন , হে আল্লাহর রাসূল। আর তিনি (সা.) বললেন , দূর হও , আল্লাহ যেন কখনো তোমাদের ক্ষমা না করেন।”