দামেস্কে নবী পরিবারের বন্দীরা
আবু রায়হান [আল বিরুনী] তার‘
আসারুল বাক্বিয়াহ ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে , সফর মাসের প্রথম দিন ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথা দামেস্কে আনা হলো। ইয়াযীদ এটি তার সামনে রাখলো এবং এর দাঁতগুলোতে হাতের লাঠি দিয়ে খোঁচা দিয়ে বলছিল , আহ , কতইনা ভালো হতো আমার গোত্রের মধ্য থেকে যারা বদরে নিহত হয়েছিল এবং যারা [ওহুদের যুদ্ধে] খাযরাজ গোত্রকে দুমাথা ওয়ালা বর্শার আঘাতে আহত হয়ে চিৎকার করতে দেখেছিল , যদি তারা আজ এখানে উপস্থিত থাকতো। তারা আমাকে উচ্চকণ্ঠে অভিনন্দন জানাতো এবং বলতো ,‘
হে ইয়াযীদ , তোমার হাত যেন অলস না হয়ে যায় , কারণ আমরা তার [রাসূলুল্লাহ-সা.] গোত্রের সর্দারকে হত্যা করেছি। আমি তা করেছি বদরের প্রতিশোধ হিসাবে , তা এখন পরিপূর্ণ হয়েছে। বনি হাশিম সার্বভৌমত্ব নিয়ে একটি খেলা খেলেছে। কোন রিসালাহ [আল্লাহর কাছ থেকে সংবাদ] আসে নি , না এসেছে কোন ওহী। আমি খন্দক পরিবারের একজন থাকতাম না যদি আহমাদ-এর বংশধরের ওপর প্রতিশোধ না নিতাম তাদের কৃতকর্মের জন্য। ’
আবি মাখনাফ এর‘
মানাক্বিব ’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে , যখন ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথা ইয়াযীদের কাছে আনা হলো , এ থেকে একটি সুবাস ছড়িয়ে পড়লো এবং অন্য সব সুবাসকে শুষে ফেললো।
‘ বিহার ’ এবং‘
মানাক্বিব ’ -এও বর্ণিত হয়েছে ধারাবাহিক বর্ণনাকারীদের মাধ্যমে যাইদ থেকে , যে বর্ণনা করেছে তার পূর্বপুরুষ থেকে যে , সাহল বিন সা ’ আদ বলেছে , আমি আমার বাড়ির উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম , যখন সিরিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলে প্রবেশ করলাম তখন আমি একটি শহরে প্রবেশ করলাম যেখানে বেশ কিছু পানির স্রোতধারা বইছিল এবং সবুজ গাছ-গাছালি ছিলো। আমি দেখলাম শহরটিকে সাজানো হয়েছে এবং চারিদিকে আনন্দ-উল্লাস চলছে। নারীরা তাম্বুরীন ও ঢাক বাজাচ্ছিলো এবং আনন্দ-ফুর্তিতে ব্যস্ত ছিলো। আমি নিজেকে বললাম সিরিয়াবাসীদের উৎসব সম্পর্কে আমি ভালোভাবেই অবগত , অথচ এ দিনটি কোন উৎসবের দিন নয়। আমি একদল লোককে দেখলাম পরস্পর কথা বলছে। আমি তাদের কাছে গেলাম এবং বললাম , আপনারা সিরিয়াতে উৎসব করছেন অথচ এ সম্পর্কে আমি জানি না। তারা বললো , যেন তুমি মরুভূমি থেকে এসেছো ? আমি বললাম , আমি সাহল বিন সা ’ আদ , মুহাম্মাদ (সা.)-এর একজন সাহাবী। তারা বললো , হে সাহল , খুবই আশ্চর্য যে আকাশগুলোর রক্ত বৃষ্টি ঝরছে না , না পৃথিবী এর অধিবাসীদের গিলে ফেলছে। আমি তাদেরকে বললাম তারা কেন একথা বলছে , তারা বললো , কী আশ্চর্য! হোসেইনের মাথা ইরাক থেকে উপহার হিসেবে আনা হয়েছে , আর এ লোকেরা উল্লাস করছে ? আমি জিজ্ঞেস করলাম , তাদের কোন তোরণ দিয়ে প্রবেশ করানো হয়েছে ? তারা একটি তোরণের দিকে ইশারা করলো যার নাম ছিলো‘
বাব আস সা ’ আত ’ ।
হঠাৎ দেখলাম একটির পর একটি সামরিক পতাকা প্রবেশ করছে এবং একজন ঘোড়সওয়ার একটি লম্বা ফলাবিহীন বর্শা বহন করছে যার আগায় একটি মানুষের মাথা বসানো আছে। যার গালগুলোর সাথে , আর যে কোন ব্যক্তির চাইতে সবচেয়ে বেশী মিল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে। মাথার পেছনে আসছিলো নারীরা , গদীবিহীন উটের ওপরে। আমি তাদের কাছে গেলাম এবং তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম , কার কন্যা তুমি ? সে বললো , আমি সাকিনাহ , হোসেইনের কন্যা। আমি বললাম , তুমি কি কিছু চাও ? আমি সাহল বিন সা ’ আদ তোমার প্রপিতামহ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একজন সাহাবী। সে উত্তর দিলো , মাথা বহনকারীদের বলুন যেন তারা আমাদের মাঝ থেকে সরে যায় , যেন জনতা সেদিকে তাকিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবার তাদের দৃষ্টি থেকে মুক্তি পায়। আমি মাথা বহনকারীর কাছে গেলাম এবং বললাম , তুমি কি আমার আশা পূরণ করার পরিবর্তে চারশ আশরাফী নিতে চাও ? সে জিজ্ঞেস করলো তা কী ? আমি বললাম , এ মাথাটি এই নারীদের মাঝ থেকে দূরে সরিয়ে নাও। সে রাজী হলো এবং আশরাফীগুলো নিলো। তখন তারা মাথাটিকে একটি ট্রাঙ্কে ভরলো এবং ইয়াযীদের কাছে নিয়ে গেলো এবং আমিও তাদের সাথে সাথে গেলাম। ইয়াযীদ সিংহাসনে বসা ছিলো একটি মুকুট পরে যা ছিলো মুক্তা ও লালমনি পাথরে সজ্জিত। আর একদল গণ্যমান্য কুরাইশ ব্যক্তি তার কাছে বসা ছিলো। মাথা বহনকারী সেখানে প্রবেশ করলো এবং বললো , আমার ঘোড়ার ব্যাগ ভরে দিন সোনা ও রূপা দিয়ে। কারণ , আমি হত্যা করেছি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের সর্দারকে।
পিতা-মাতার দিক বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে আমি হত্যা করেছি ― যার বংশধারা শ্রেষ্ঠ যখন বংশধারা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। একথা শুনে ইয়াযীদ বললো , তুমি যদি জানতেই যে সে ছিলো মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ , তাহলে কেন তাকে হত্যা করেছো ? সে জবাব দিলো , আপনার কাছ থেকে একটি পুরস্কারের লোভে। ইয়াযীদ আদেশ দিলো তার মাথা বিচ্ছিন্ন করতে এবং তা করা হলো। এরপর সে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথা নিজের সামনে রাখলো এবং বললো , এসব কেমন দেখছো , হে হোসেইন ?
‘ কামিলে বাহাই ’ -এ উল্লেখ করা হয়েছে যে , নবী পরিবারকে সিরিয়ার প্রবেশদ্বারে অপেক্ষায় রাখা হয়েছিল তিন দিন। আর এ সময় শহরকে এমনভাবে সাজানো হচ্ছিলো যে তা আগে আর কখনো দেখা যায় নি। পাঁচ লক্ষ সিরিয় পুরুষ ও মহিলা নতুন পোশাক পরেছিল , সাথে ছিলো তাম্বুরীন , করতাল এবং ঢাক ; তারা নিজেদের প্রস্তুত করলো এবং তাদের দিকে এগিয়ে গেলো। সেদিন ছিলো বৃহষ্পতিবার , শহরের ভেতরে ছিলো পুনরুত্থান দিবসের মত [ভীড়] এবং সেখানে জনগণ আনন্দ-উল্লাস করছিল। যখন দিবস অগ্রসর হলো , মাথাগুলোকে শহরে প্রবেশ করানো হলো। অনেক মানুষের ভীড়ের কারণে , অনেক কষ্টে দিনের শেষে তারা ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়ার প্রাসাদের দরজায় পৌঁছাতে পারলো। মূল্যবান পাথরে সজ্জিত একটি সিংহাসন ইয়াযীদের জন্য রাখা হয়েছিল এবং তার বাড়ি সাজানো হয়েছিল এবং সোনালী ও রূপালী চেয়ারগুলো তার সিংহাসনকে ঘিরে রাখা হয়েছিল। ইয়াযীদের সেবকরা মাথা বহনকারীদের প্রবেশ করতে বললো , আর তারা তা পালন করলো। তারা বললো , অধিনায়কের ইযযতের শপথ , আমরা আবু তুরাব [আলী]-এর সন্তানকে হত্যা করেছি এবং তাদের বংশধারা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছি। এরপর তারা পুরো ঘটনা বর্ণনা করলো এবং তার সামনে মাথাগুলো রাখলো। আহলে বাইত (আ.)-কে দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্দী করে রাখা হয়েছিল , ছেষট্টিদিন যাবৎ এবং এ সময়ে কেউ তাদের সালাম জানাতে পারে নি। সেদিন এক বৃদ্ধ ব্যক্তি ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.)-এর কাছে গেলো এবং বললো , সব প্রশংসা আল্লাহর যে তিনি তোমাদের হত্যা করেছেন ও ধ্বংস করেছেন এবং বিদ্রোহের আগুন নিভিয়ে দিয়েছেন।
শইখ মুফীদ বলেন যে , যখন তারা ইয়াযীদের প্রাসাদের দরজায় পৌঁছলো তখন মাখফার বিন সা ’ লাবাহ উচ্চকণ্ঠে বললো , আমি মাখফার বিন সা ’ লাবাহ , আমি এ নোংরা সীমালঙ্ঘনকারীদের [আউযুবিল্লাহ] এনেছি ইয়াযীদের কাছে।
একথা শুনে ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.) বললেন , মাখফারের মায়ের সন্তান হলো সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং সবচেয়ে নীচ।
অত্যাচারী সিরিয়ার নাগরিকরা বললো , আমরা কখনো এত সুন্দর বন্দী দেখি নি। তোমরা কারা ? ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কন্যা সাইয়েদা সাকিনাহ (আ.) উত্তর দিলেন ,“
আমরা মুহাম্মাদ (সা.)-এর বন্দী পরিবার।”
তাদেরকে এবং ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.)-কে আটকে রাখা হলো মসজিদের সিঁড়িঘরে। তিনি তখন অল্প-বয়সী যুবক ছিলেন। সিরিয়াবাসীদের মধ্যে এক বৃদ্ধ এগিয়ে এলো এবং বললো ,“
সব প্রশংসা আল্লাহর যে তিনি তোমাদেরকে হত্যা করেছেন ও ধ্বংস করেছেন এবং বিদ্রোহের আগুনকে নিভিয়ে দিয়েছেন।”
এরপর সে যা ইচ্ছা বলতে থাকলো এবং যখন সে চুপ হলো , ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) তাকে বললেন ,“
তুমি কি আল্লাহর কুরআন পড়েছো ?”
সে হ্যাঁ বললো। তিনি বললেন , তুমি কি এ আয়াত পড়েছো:
)
ق
ُل لَّا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَىٰ(
বলো [হে আমার রাসূল]: আমি তোমাদের কাছে কিছু দাবী করি না [নবুয়তের পরিশ্রমের জন্য] শুধু আমার রক্তের আত্মীয়দের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া। [সূরা শুরা: 23]
সে বললো , হ্যাঁ , আমি পড়েছি। ইমাম (আ.) বললেন , আমরাই সেই পরিবার থেকে। এছাড়া এ আয়াত তুমি কি পড়ো নি:
)
و
َآتِ ذَا الْقُرْبَىٰ حَقَّهُ(
এবং দিয়ে দাও তোমার রক্তের আত্মীয়দের অধিকার। [সূরা বনি ইসরাইল: 26]
সে বললো সে তা পড়েছে। ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বললেন , আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত। এরপর তিনি বললেন , তুমি কি এ আয়াত পড়ো নি:
)
إ
ِنَّمَا يُرِيدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا(
আল্লাহ তো শুধু চান তোমাদের কাছ থেকে অপবিত্রতা দূরে রাখতে হে আহলে বাইত এবং তোমাদের পবিত্র করতে চান পুত: পবিত্রের মতো। [সূরা আহযাব: 33]
সে বললো , কেন নয় ? ইমাম বললেন , আমরাই তারা যাদের কথা এখানে বলা হয়েছে। একথা শুনে সিরিয় ব্যক্তি তার দুহাত আকাশের দিকে তুলে বললো ,
হে আল্লাহ , আমি আপনার সামনে নিজেকে মুহম্মাদ (সা.)-এর সন্তানদের শত্রু ও হত্যাকারীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করছি। আমি সব সময় কোরআন পড়েছি কিন্তু আজকে পর্যন্ত এর ওপরে আমি গভীরভাবে ভাবি নি।
আমাদের উস্তাদ শেইখ সাদূক বর্ণনা করেছেন ফযল বিন শাযান থেকে যিনি বলেছেন যে , আমি ইমাম আলী আল রিদা (আ.)-কে বলতে শুনেছি যে ,“
যখন ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথা সিরিয়াতে নেওয়া হলো , ইয়াযীদ আদেশ দিলো তা মাটিতে রাখার জন্য এবং একটি দস্তরখান এর সামনে বিছানো হলো। সে এরপর তার সাথীদেরসহ এর দিকে ফিরে খাবার খাচ্ছিলো এবং মদ পান করেছিল। যখন তারা শেষ করলো , সে ট্রে-টিকে তার সিংহাসনের নিচে রাখতে আদেশ দিলো। এরপর সে সিংহাসনের ওপরেই পাশা খেলার বোর্ড বিছালো এবং খেলা শুরু করলো। সে টিটকারী করতে লাগলো ইমাম হোসেইন (আ.) , তার পিতা (আ.) এবং তার নানার (সা.) নাম উল্লেখ করে এবং সে জিতলো। সে এর জন্য মদ পান করলো। তিনবার সে মদ পান করলো এবং এরপর কিছুটা ট্রের কাছে ছুঁড়ে মারলো। অতএব যে আমাদের শিয়া [অনুসারী] , যখন তার দৃষ্টি পড়বে মদ ও পাশার দিকে , সে ইমাম হোসেইন (আ.)-কে স্মরণ করবে , আর ইয়াযীদ ও তার বংশকে অভিশাপ দিবে , আল্লাহ তার গুনাহগুলো ক্ষমা করে দিবেন যদি তা তারাগুলোর সংখ্যার সমানও হয়।”