ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.)-এর খোতবা
দামেস্কে বন্দী থাকা অবস্থায় ইমাম আলী ইবনে হোসেইন (আ.) ইয়াযিদকে বলেছিলেন সে যেন জুমার দিনে খুতবার দেওয়ার অনুমতি দেয়।‘
বিহার আল আনওয়ার ’ গ্রন্থে উদ্ধৃত আছে এবং‘
মানাক্বিব ’ -এর লেখক এবং অন্যান্যরা বর্ণনা করেছেন যে , ইয়াযীদ একটি মিম্বর তৈরী করতে বললো এবং এরপর একজন বক্তাকে ডেকে পাঠালো। সে তাকে আদেশ করলো ইমাম হোসেইন (আ.) ও ইমাম আলী (আ.)-কে তিরস্কার করার জন্য এবং তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে জনতার সামনে বলার জন্য। বক্তা মিম্বরে উঠলো এবং আল্লাহর হামদ ও তাসবিহ করলো এবং ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হোসেইন (আ.)-কে প্রচুর গালিগালাজ করলো। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে মুয়াবিয়া ও ইয়াযীদের প্রশংসা করলো এবং তারা অনেক ভালো কাজ করেছে বলে উল্লেখ করলো। তখন ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.) তাকে উচ্চকণ্ঠে বললেন ,“
হে তুমি , যে ওয়াজ করছো , দুর্ভোগ হোক তোমার , তুমি সৃষ্টিকর্তার ক্রোধ ডেকেছো সৃষ্টিকে খুশী করতে গিয়ে , আর তোমার স্থান হলো জাহান্নামে। এরপর তিনি ইয়াযীদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন , তুমি কি আমাকে অনুমতি দিচ্ছো কিছু বলার জন্য যা আল্লাহর জন্য সন্তুষ্টির এবং যারা উপস্থিত আছে তাদের জন্য হবে পুরস্কার ?”
ইয়াযীদ তা প্রত্যাখ্যান করলো , কিন্তু জনতা বললো ,“
তাকে অনুমতি দিন মিম্বরে ওঠার জন্য , হয়তোবা আমরা তার কাছ থেকে [মূল্যবান] কিছু শুনতে পাবো।”
ইয়াযীদ বললো ,“
যদি আমি তাকে অনুমতি দিই মিম্বরে ওঠার জন্য সে তা থেকে নামবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে আমাকে ও আবু সুফিয়ানের বংশকে অপমানিত করবে।”
তারা বললো , কিভাবে এ অসুস্থ যুবক তা করবে ? ইয়াযীদ বললো ,“
সে এমন এক পরিবার থেকে এসেছে যারা শিশুকালেই দুধের সাথে প্রজ্ঞা পান করেছে।”
তারা তাকে চাপ দিতে থাকলো যতক্ষণ না সে তাতে রাজী হলো। ইমাম (আ.) মিম্বরে উঠলেন , তিনি আল্লাহর হামদ ও তাসবিহ করলেন এবং একটি খোতবা দিলেন যা চোখগুলোকে কাঁদালো এবং হৃদয়গুলোকে কাঁপিয়ে দিলো। এরপর তিনি বললেন ,
“
হে জনতা , আমাদেরকে ছয়টি গুণাবলী ও সাতটি মর্যাদা দেওয়া হয়েছে [আল্লাহর পক্ষ থেকে] ― জ্ঞান , সহনশীলতা , উদারতা , বাগ্মিতা , সাহস ও বিশ্বাসীদের অন্তরে আমাদের জন্য ভালোবাসা ― যা আমাদের মাঝে উপস্থিত। আর আমাদের মর্যাদাগুলো হলো যে , যে রাসূল দায়িত্বে আছেন তিনি আমাদের মাঝ থেকে ; সত্যবাদী [ইমাম আলী] আমাদের মাঝ থেকে ; যিনি ওড়েন [জাফর আত তাইয়ার] তিনি আমাদের মাঝ থেকে , আল্লাহর সিংহ এবং তাঁর রাসূলেরও ― আমাদের মাঝ থেকে ; আর উম্মতের দুই সিবত আমাদের মাঝ থেকে। যারা আমাকে জানে তারাতো আমাকে জানেই ; যারা আমাকে চেনে না , আমি তাদের জন্য আমার বংশধারা ও পুর্বপুরুষদের পরিচয় প্রকাশ করছি যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা আমাকে চিনতে পারে। হে জনতা , আমি মক্কা ও মিনার সন্তান , আমি যমযম ও সাফা-এর সন্তান। আমি তার সন্তান যিনি কালো পাথরকে [হাজর আল আসওয়াদ] তুলেছিলেন তার কম্বলের প্রান্ত ধরে। আমি সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সন্তান যিনি সুন্দর করে পাজামা ও আলখাল্লা পড়তেন। আমি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সন্তান যিনি কাবা তাওয়াফ করেছেন , সাঈ করেছেন। আমি সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সন্তান যিনি হজ্ব করেছেন এবং তালবিয়া উচ্চারণ করেছেন। আমি তার সন্তান যাকে রাতের বেলা মাসজিদুল আকসাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল [মেরাজের সময়] , আমি তার সন্তান যাকে সিদরাতুল মুনতাহাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল , আমি তার সন্তান যে-
)
ث
ُمَّ دَنَا فَتَدَلَّىٰ(
“
এরপর নিকটবর্তী হলো এবং আরো নিকটবর্তী।”
[সূরা নাজম: 8]
আমি তার সন্তান যে ছিলো-
)
ك
َانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَىٰ(
“
দুই ধনুক পরিমাণ [পরস্পর মুখোমুখি] অথবা তার চাইতেও কাছে।”
[সূরা নাজম: 9]
আমি তার সন্তান যাকে সর্বশক্তিমান ওহী দান করেছিলেন , যা তিনি প্রকাশ করেছিলেন। আমি হোসেইন (আ.)-এর সন্তান ― যাকে কারবালায় হত্যা করা হয়েছে ; আমি আলীর সন্তান ― যিনি মুর্তাযা [অনুমোদনপ্রাপ্ত] ; আমি মুহাম্মাদের সন্তান ― যাকে বাছাই করা হয়েছিল ; আমি ফাতেমাতুয যাহরা (আ.)-এর সন্তান , আমি সিদরাতুল মুনতাহার সন্তান , আমি শাজারাতুল মুবারাকাহ [বরকতময় গাছ]-এর সন্তান , আমি তার সন্তান যার শোকে রাতের অন্ধকারে জিনরা বিলাপ করেছিল , আমি তার সন্তান যার জন্য পাখিরা শোক পালন করেছিল।”
‘ কামিলে বাহাঈ ’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে যে , ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) ইয়াযীদকে বলেছিলেন যে সে যেন তাকে জুম ’ আর দিন খোতবা দিতে দেয়। এতে সে রাজী হয়েছিল। জুম’
আর দিন ইয়াযীদ এক অভিশপ্তকে আদেশ করলো মিম্বরে উঠতে এবং ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হোসেইন (আ.)-কে যত পারে তত গালি দিতে এবং খলিফা উমর ও খলিফা আবু বকরের প্রশংসা করতে। অভিশপ্ত ব্যক্তিটি মিম্বরে উঠলো এবং তার যা ইচ্ছা বললো। তখন ইমাম (আ.) বললেন ,“
আমাকে অনুমতি দাও খোতবা দেওয়ার জন্য।”
ইয়াযীদ তার প্রতিশ্রতি রক্ষা করতে অস্বীকার করলো এবং তাকে অনুমতি দিলো না। জনতা চাপ প্রয়োগ করলো , কিন্তু সে অনুমতি দিলো না , যতক্ষণ পর্যন্ত না তার নাবালক সন্তান মুয়াবিয়া বললো , হে বাবা , তার খোতবা কোন দিকে নিয়ে যেতে পারে ? তাকে খোতবা দেওয়ার জন্য অনুমতি দিন। ইয়াযীদ বললো ,“
তুমি তাদের কাজ সম্পর্কে জানো না , তারা প্রজ্ঞা ও বাগ্মীতা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। আর আমি আশঙ্কা করি তার খোতবা হয়তো বিদ্রোহের সৃষ্টি করতে পারে এবং আমাদের মাথার ওপরে ঘুরতে পারে।”
এরপর সে তাকে অনুমতি দিলো। ইমাম (আ.) মিম্বরে উঠলেন এবং বললেন ,“
প্রশংসা আল্লাহর যার কোন শুরু নেই এবং যিনি চিরস্থায়ী যার কোন শেষ নেই , তিনি সবার প্রথমে যাঁর কোন শুরু নেই এবং তিনি সবার শেষে যার শেষের কোন শেষ নেই , সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে শুধু তাঁর সত্তা ছাড়া , তিনি দিন ও রাতের পরিমাপ নির্ধারণ করেন , পরিণতি প্রস্তুত করেন এবং বরকতময় হলেন আল্লাহ , তিনিই একমাত্র বাদশাহ , সর্বজ্ঞানী।”
এরপর বললেন ,“
আল্লাহ আমাদেরকে দান করেছেন জ্ঞান , সহনশীলতা , উদারতা , বাগ্মীতা , সাহস এবং বিশ্বাসীদের অন্তরে ভালোবাসা। আর আমাদের মর্যাদা হলো , যে রাসূল দায়িত্বে আছেন তিনি আমাদের মাঝ থেকে , এ ছাড়াও শহীদদের সর্দার [হামযা] এবং জাফর , যিনি বেহেশতে ওড়েন এবং এ উম্মতের দুই সিব্ত [ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেইন-আ.] আমাদের মাঝ থেকে এবং মাহদী (আ.)-ও যিনি‘
দাজ্জাল ’ -কে হত্যা করবেন। হে জনতা , যারা আমাকে চিনে তারাতো চিনেই , আর যারা আমাকে চিনো না , তাদের জন্য আমার বংশবৃক্ষ ও পূর্বপুরুষের পরিচয় দিচ্ছি যতক্ষণ না তারা আমাকে চিনতে পারে। হে জনতা , আমি মক্কা ও মিনার সন্তান , আমি যমযম ও সাফা-এর সন্তান , আমি তার সন্তান যিনি তার কম্বলের পাশ ধরে হাজর আল-আসওয়াদ [কালো পাথর] তুলেছিলেন। আমি সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সন্তান যার কারণে পাজামা ও আলখাল্লা সৌন্দর্য পেয়েছিল। আমি সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সন্তান যারা [কা ’ বা] তাওয়াফ করেছিল এবং সাঈ করেছিল। আমি সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সন্তান যারা হজ্ব সম্পাদন করেছিল এবং তালবিয়াহ উচ্চারণ করেছিল। আমি তার সন্তান যাকে রাতে মসজিদুল আক্বসাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল [মেরাজে]। আমি তার সন্তান যাকে সিদরাতুল মুনতাহাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমি তার সন্তান যে নিকটবর্তী হলো এবং স্থির হয়ে রইলো [সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির মাঝে মেরাজের রাতে] , আমি তার সন্তান , যে ছিলো নিকটে ― দুই ধনুক পরিমাণ দূরত্বে অথবা তারও কাছে [সামনা সামনি]। আমি তার সন্তান যাকে সর্বশক্তিমান আল্লাহ ওহী পাঠিয়েছিলেন , যা তিনি প্রকাশ করেছিলেন। আমি সন্তান হোসেইন (আ.)-এর ― যাকে কারবালায় হত্যা করা হয়েছে , আমি সন্তান আলীর ― যাকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে [মুরতাযা] , আমি সন্তান মুহাম্মাদ (সা.)-এর ― যিনি ছিলেন নির্বাচিত , আমি সন্তান ফাতেমা যাহরা [জোতির্ময়] (আ.)-এর , আমি সন্তান সিদরাতুল্ মুন্তাহার , আমি সন্তান শাজারাতুল মুবারাকাহর [পবিত্র বৃক্ষের] , আমি সন্তান তার যাকে রক্তে ও বালিতে মাখা হয়েছে , আমি সন্তান তার যার জন্যে জিনরা বিলাপ করেছে রাতের অন্ধকারে , আমি সন্তান তার যার জন্যে পাখিরা শোক পালন করেছে।”
যখন খোতবা এ পর্যায়ে পৌঁছলো জনতা কাঁদতে ও বিলাপ করতে শুরু করলো এবং ইয়াযীদ আশঙ্কা করলো এতে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যেতে পারে। সে মুয়া যযিনকে ডেকে বললো , নামাযের ঘোষণা দাও। মুয়া যযিন উঠলো এবং বললো , আল্লাহু আকবার , আল্লাহু আকবার। ইমাম বললেন ,“
আল্লাহ শ্রেষ্ঠতর এবং সর্বোচ্চ , সবচেয়ে সম্মানিত এবং সবচেয়ে দয়ালু তার চাইতে যা আমি ভয় করি এবং যা আমি এড়িয়ে যাই। এরপর সে বললো , আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। ইমাম বললেন , নিশ্চয়ই আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি অন্যদের সাথে যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং তিনি ছাড়া কোন মালিক নেই , আর আমি প্রত্যেক অস্বীকারকারীকে প্রত্যাখ্যান করি। যখন সে বললো , আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল , ইমাম নিজের মাথা থেকে পাগড়ী নামিয়ে নিলেন এবং মুয়া যযিনের দিকে ফিরে বললেন , আমি এ মুহাম্মাদের (সা.) নামে অনুরোধ করছি , এক মুহূর্ত নীরব থাকার জন্য।”
এরপর তিনি ইয়াযীদের দিকে ফিরে বললেন ,“
হে ইয়াযীদ , এ সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ রাসূল কি আমার প্রপিতামহ , নাকি তোমার ? যদি তুমি বলো যে তোমার প্রপিতামহ , তাহলে গোটা পৃথিবী জানে তুমি মিথ্যা বলছো। আর যদি তুমি বল যে তিনি আমার প্রপিতামহ , তাহলে কেন তুমি আমার পিতাকে জুলুমের মাধ্যমে হত্যা করেছো এবং তার মালপত্র লুট করেছো এবং তার নারী-স্বজনদের বন্দী করেছো ? এ কথা বলে ইমাম (আ.) নিজের জামার কলার ছিঁড়ে ফেললেন ও কাঁদলেন। এরপর বললেন , আল্লাহর শপথ , এ পৃথিবীর ওপরে আমি ছাড়া কেউ নেই যার প্রপিতামহ হলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) , কেন এ লোকগুলো আমার পিতাকে জুলুমের মাধ্যমে হত্যা করেছে এবং আমাদেরকে রোমানদের মতো বন্দী করেছে ? এরপর বললেন , হে ইয়াযীদ , তুমি এটি করে আবার বলছো যে মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল এবং তুমি ক্বিবলার দিকে মুখ ফিরাও , অভিশাপ তোমার ওপর ঐদিন যেদিন আমার প্রপিতামহ এবং পিতা তোমার ওপর ক্রোধান্বিত হবেন।”
এ কথা শুনে ইয়াযীদ মুয়া যযিনকে নামাযের ইক্বামাহ দিতে বললো। লোকজনের ভেতর গুঞ্জন উঠলো এবং তাদের ভেতর একটি তোলপাড় শুরু হলো। এরপর একটি দল তার সাথে নামাজ পড়লো এবং অন্যরা পড়লো না এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে গেলো।