ইমাম হোসেইন (আ.)-এর জন্য শোক প্রকাশ
শেইখ আবু জাফর তূসি তার ধারাবাহিক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে খালিদ বিন সাঈদ থেকে বর্ণনা করেছেন যে , সে বলেছে যে , আমি ইমাম জাফর আস- সাদিক্ব (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলাম , কোন ব্যক্তি কি তার পিতা , ভাই অথবা আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুর কারণে নিজের জামার কলার ছিঁড়তে পারে ? ইমাম (আ.) বললেন , এতে কোন সমস্যা নেই। নবী মূসা (আ.) নিজের জামার কলার ছিঁড়েছিলেন তার ভাই হারুন (আ.)-এর মৃত্যুতে। একজন পিতা তার সন্তানের মৃত্যুতে এবং একজন স্বামী তার স্ত্রীর মৃত্যুতে জামার কলার নাও ছিঁড়তে পারেন , কিন্তু একজন স্ত্রী তার স্বামীর মৃত্যুতে পারেন। এরপর আরও বললেন , ফাতেমা (আ.)-এর পরিবার হোসেইন (আ.)-এর জন্য জামার কলার ছিঁড়েছিলেন এবং চেহারায় হাত দিয়ে চাপড় মেরেছিলেন এবং তিনি এতই মূল্যবান ছিলেন যে তার মৃত্যুতে কলার ছেঁড়া এবং চেহারায় হাত দিয়ে চাপড় মারা উচিত ছিলো।
বারক্বী বর্ণনা করেছেন যে , যখন ইমাম হোসেইন (আ.)-কে হত্যা করা হলো , বনি হাশিমের নারীরা কালো কাপড় ও শোকের পোশাক পরেছিলেন এবং উত্তাপ বা ঠাণ্ডার বিষয়ে কোন অভিযোগ করেন নি এবং ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.) তাদের শোকের অনুষ্ঠানের খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন।
আবু রায়হান [আল বিরুনী] তার‘
আসারুল বাক্বিয়াহ ’ গ্রন্থে বলেছেন যে , দশ মুহাররাম আরবদের কাছে পবিত্র বিবেচিত ছিলো যতক্ষণ পর্যন্ত না ঐ দিনে ইমাম হোসেইন (আ.)-কে হত্যা করা হলো। এরপর তারা তার ও তার সাথীদের সাথে এমন ব্যবহার করলো যে , কোন জাতিই তাদের নিকৃষ্ট লোকদের সাথে এ আচরণ করে নি যা তারা তাদের সাথে করলো ক্ষুধা ও পিপাসায় , তরবারি , [তাঁবুতে] আগুন , বর্শার আগায় মাথাগুলো তোলা এবং তাদের দেহগুলোর ওপর ঘোড়া ছোটানোর বিষয়ে ; তাই তারা [শিয়ারা] এ দিনটিকে অকল্যাণের দিন বিবেচনা করতো , কিন্তু বনি উমাইয়া সেদিন আনন্দ উৎসব করতো এবং নুতন পোশাক পরতো এবং ভোজসভা ও আনন্দ উৎসবের আয়োজন করতো। তারা মিষ্টি প্রস্তুত করতো এবং সুগন্ধি বিতরণ করতো। যতদিন বনি উমাইয়ার রাজত্ব ছিলো এ সংস্কৃতি আম্মাহর [ ইয়াজিদি মুসলমানদের] মধ্যে চলতে থাকলো। তাদের রাজত্বের সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও‘
আম্মাহ ’ -এর মধ্যে এ সংস্কৃতি চলতে থাকলো। আর শিয়ারা , ইমাম হোসেইন (আ.)-এর শাহাদাতের শোকে শোকগাঁথা আবৃত্তি করে এবং আহাজারি করে। আর এ সংস্কৃতি‘
শান্তির শহর ’ বাগদাদে এবং অন্যান্য শহরেও বজায় আছে এবং এ দিনে তারা কারবালার প্রশান্তিপূর্ণ কবরগুলোতে যিয়ারাতে যায়। অন্যদিকে আম্মাহ [ ইয়াজিদি মুসলমান] এ দিনে নুতন ঘটি বাটি এবং আসবাপত্র কেনা কল্যাণকর মনে করে।
শেইখ আবুল ক্বাসিম জাফর বিন ক্বাওলাওয়েইহ কুম্মি যুহরি থেকে বর্ণনা করেছেন যে , যখন ইমাম হোসেইন (আ.)-কে হত্যা করা হয়েছিল , তখন বাইতুল মুকাদ্দাসে এমন কোন নুড়িপাথর ছিলো না যার নিচে তাজা রক্ত পাওয়া যায় নি।
হুরেইম আ’
ওয়ার বর্ণনা করেছে যে , ইমাম আলী (আ.) বলেছেন , আমার পিতা-মাতা হোসেইন (আ.)-এর জন্য কোরবান হোক , যাকে হত্যা করা হবে কুফার পেছনে। আল্লাহর শপথ , আমি যেন দেখতে পাচ্ছি পশুদের বিভিন্ন জাতি তার কবরে গলা লম্বা করে দিচ্ছে এবং কাঁদছে ও তার জন্য আহাজারি করছে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। তাই যখন তা ঘটবে তখন প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত অত্যাচার ও অকৃতজ্ঞতা থেকে দূরে থাকা।
যুরারাহ বর্ণনা করেছে ইমাম জাফর আস সাদিক্ব (আ.) থেকে যে তিনি বলেছেন , হে যুরারাহ , নিশ্চয়ই আকাশগুলো চল্লিশ সকাল রক্ত অশ্রু ফেলেছে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর জন্য। পৃথিবী চল্লিশ সকাল অন্ধকারে পরিণত হয়েছিল এবং সূর্যগ্রহণ হয়েছিল ও চল্লিশ সকাল পর্যন্ত লাল হয়ে গিয়েছিল , আর পর্বতগুলো ভেঙ্গে পড়েছিল এবং গুড়ো হয়ে গিয়েছিল এবং সমুদ্র বিস্ফোরিত হয়েছিল। ফেরেশতারা চল্লিশ সকাল ধরে কেঁদেছিল ইমাম হোসেইন (আ.)-এর জন্য এবং যতদিন মাথাটি আমাদের কাছে পৌঁছায় নি , আমাদের নারী-স্বজনরা তাদের চুলে কলপ বা তেল দেয় নি , না তারা কাজল ব্যবহার করেছে অথবা চুলে চিরুনী চালিয়েছে। তার পরে আমরা সব সময় শোকাবিভূত ছিলাম। আর আমার পিতামহ [ইমাম যায়নুল আবেদীন-আ.] কাঁদতেন যখনই তিনি তার কথা মনে করতেন , যতক্ষণ পর্যন্ত না তার অশ্রুতে তার দাড়ি ভিজে যেতো। যে-ই তাকে দেখতো দুঃখবোধ করতো এবং কাঁদতো। তার কবরের মাথার কাছে ফেরেশতারাও কাঁদে এবং তারাও যারা সে পরিবেশে উপস্থিত থাকে এবং আকাশগুলোও তাদের কান্নার কারণে কাঁদে।
বলা হয়েছে যে , কোন অশ্রু অথবা চোখ নেই যা আল্লাহর কাছে এত প্রিয় এ চোখগুলোর চাইতে যেগুলো তার জন্য অশ্রু ফেলে। এরপর যে ব্যক্তি তার জন্য কাঁদে , ফাতেমা (আ.) এ বিষয়ে সংবাদ লাভ করেন , আর এটি তার প্রশান্তি লাভের কারণ হয়। আর এ খবর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছেও পৌঁছায় এবং তা যেন এমন যে সে আমাদের অধিকার পূর্ণ করেছে। কোন মানুষ নেই যে কিয়ামতের দিন কাঁদতে কাঁদতে উঠবে না , শুধু তারা ছাড়া যারা আমার প্রপিতামহের জন্য কাঁদে , আর তারা জাগ্রত হবে আলোকিত আত্মা ও আলোকিত চোখ এবং আনন্দিত চেহারা নিয়ে। লোকজন ভীতির ভেতওে থাকবে , আর এরা থাকবে শান্তিতে। অন্যরা হিসাব দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে , কিন্তু তারা থাকবে হোসেইন (আ.)-এর সাথে , তার সঙ্গীদের সাথে , আরশের নিচে এর ছায়াতে। আর তারা হিসাব দেয়ার অনিষ্টের ভয়ে থাকবে না। তাদেরকে বলা হবে , বেহেশতের দিকে যাও। তারা কোন কথায় কান দিবে না এবং তাদের হৃদয় ইমাম হোসেইন (আ.)-এর সাহচর্য থেকে এবং তার সাথে কথা বলা থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। হুরীরা তাদের কাছে আমন্ত্রণ পাঠাবে যে , তারা এবং তাদের সাথে‘
অপরিবর্তনীয় বয়সের ’ গোলামরা তাদেরকে একনজর দেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছে , কিন্তু তারা মাথা তুলেও তাকাবে না এবং তারা ইমাম হোসেইন (আ.)-এর সাহচর্যের আনন্দ ও রহমতে ডুবে থাকবে। এসময় তার কিছু শত্রুকে তাদের এলামেলো চুল ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে , এবং কিছু চিৎকার করে বলবে যে তাদের কোন সুপারিশকারী ও কোন বন্ধু নেই তাদের প্রয়োজনে। তাদের বন্ধুরা বেহেশতে তাদের [উচ্চ] মর্যাদা দেখতে পাবে , কিন্তু তারা তাদের কাছে যেতে পারবে না এবং তাদেরকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারবে না। বেহেশতের ফেরেশতারা তাদের জন্য সুসংবাদ বয়ে আনবে তাদের সঙ্গীদের [হুর] কাছ থেকে এবং তাদের ধনসম্পদের রক্ষকদের কাছ থেকে যে তাদের জন্য কী আনন্দজনক বিষয়সমূহ অপেক্ষা করছে। তারা উত্তর দিবে যে , ইনশাআল্লাহ আমরা তোমাদের কাছে আসবো। ফেরেশতারা হুরীদের কাছে সংবাদ পৌঁছে দিবে , যাদের আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পাবে তাদের মর্যাদা সম্পর্কে জেনে যা তারা ইমাম হোসেইন (আ.)-এর নৈকট্য পাওয়ার কারণে লাভ করেছে। তখন তারা বলবে , আলহামদুলিল্লাহ , আল্লাহ আমাদেরকে বিরাট বিপর্যয় থেকে এবং কিয়ামতের ভয়ানক মরুভূমি থেকে রক্ষা করেছেন এবং রক্ষা করেছেন আমাদেরকে তা থেকে যার ভয় আমরা করতাম। এরপর তাদের বাহন আনা হবে এবং তারা এগুলোর ওপর বসবে এবং আল্লাহর , যিনি প্রশংসাযোগ্য , প্রশংসা করতে থাকবে এবং দরুদ পড়বে মুহাম্মাদ ও তার বংশধরের ওপরে এবং তাদের গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।
বিশ্বাসীদের আমির আলী (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে , তিনি রাহবাহতে ছিলেন এবং এ আয়াতটি আবৃত্তি করলেন:‘
তাই তাদের জন্য আকাশগুলো ও পৃথিবী কাঁদলো না , না তাদের সময় দেওয়া হলো। ’ সাথে সাথে ইমাম হোসেইন (আ.) তার কাছে এলেন মসজিদের একটি দরজা দিয়ে। তাকে দেখে ইমাম আলী (আ.) বললেন , এ সেই ব্যক্তি , যাকে হত্যা করা হবে এবং আকাশগুলো ও পৃথিবী তার জন্য কাঁদবে।
ইমাম জাফর আস-সাদিক্ব (আ.) বলেন যে , আকাশগুলো ও পৃথিবী ইমাম হোসেইন (আ.)-এর জন্য কেঁদেছিল ও লালবর্ণ ধারণ করেছিল। তারা কারো জন্যে কাঁদে নি একমাত্র নবী ইয়াহইয়া বিন যাকারিয়া (আ.) এবং হোসেইন (আ.) ছাড়া। অন্য এক স্থানে তার কাছ থেকেই উদ্ধৃত করা হয়েছে যে , ইয়াহইয়া বিন যাকারিয়া (আ.)-এর হত্যাকারী ছিলো এক জারজ সন্তান , এবং ইমাম হোসেইন (আ.)-এর হত্যাকারীও। আকাশগুলো ও পৃথিবী কারো জন্যে কাঁদে নি এ দুজনের জন্য ছাড়া। বর্ণনাকারী জিজ্ঞেস করলো , আকাশগুলোর কান্না বলতে কী বোঝায় ? ইমাম বললেন , সূর্য উদয় হলো লাল রঙ নিয়ে এবং অস্ত গেলো একইভাবে।
উসমান বিন আবি শাইবাহ বর্ণনা করেছে যে , ইমাম হোসেইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর আকাশ এমন হয়ে গেলো যে সাত দিন ধরে দেয়ালগুলো গাঢ় লাল রঙের লিনেন কাপড়ের মতো দেখালো এবং মনে হচ্ছিলো নক্ষত্রগুলো পরস্পরের সাধে ধাক্কা খাচ্ছে।
ইবনে জাওযী বর্ণনা করেছেন ইবনে সিরীন থেকে যে , বিশ্বজগত অন্ধকার হয়ে গেলো তিন দিনের জন্য এবং আকাশে লাল রঙ দেখা গেলো।
আবু সাঈদ বলেছে যে , পৃথিবীতে এমন কোন পাথর ওল্টানো হয় নি যার নিচে তাজা রক্ত দেখা যায় নি। আকাশগুলো থেকে রক্তবৃষ্টি ঝরেছে এবং এর দাগ দীর্ঘ দিন পোশাকে ছিলো।
এটিও বর্ণিত হয়েছে যে , খোরাসান , সিরিয়া ও কুফার দেয়ালগুলো ও বাড়িগুলোর ওপরে রক্ত বৃষ্টি হয়েছিল। আর যখন ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথা ইবনে যিয়াদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় তার দেয়াল থেকে রক্ত বেয়ে পড়ছিল।
সিবতে ইবনে জাওযির‘
তাযকিরাহ ’ গ্রন্থে হিলাল বিন যাকওয়ান থেকে বর্ণিত হয়েছে যে , যখন ইমাম হোসেইন (আ.)-কে হত্যা করা হলো , আমরা দেয়ালগুলোকে দেখলাম যেন রক্তে মেখে দেওয়া হয়েছে প্রায় দু অথবা তিন মাস ধরে ― ফজরের নামাযের সময় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। আমরা এক সফরে বের হয়েছিলাম এবং হঠাৎ করে বৃষ্টি হলো , যার দাগ রক্তের মতো আমাদের পোশাকে লেগে রইলো।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:“
নিশ্চয়ই প্রত্যেক মু ’ মিনের হৃদয়ে হোসেইনের শাহাদাতের ব্যাপারে এমন ভালোবাসা আছে যে , তার উত্তাপ কখনো প্রশমিত হয় না।”
[মুস্তাদরাক আল-ওয়াসাইল , খণ্ড-10 , পৃষ্ঠা-318]
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন:“
সমস্ত চোখ কিয়ামতের দিন কাঁদতে থাকবে , নিশ্চয়ই কেবল সেই চোখ ছাড়া যা হোসেইনের বিয়োগান্ত ঘটনায় কাঁদবে ; ঐ চোখ সেদিন হাসতে থাকবে এবং তাকে জান্নাতের সুসংবাদ ও বিপুল নেয়ামত প্রদান করা হবে।”
[বিহারুল আনওয়ার , খণ্ড-44 , পৃষ্ঠা-193]