পরস্পরকে জানার প্রয়োজনীয়তা
)
وجعلناکم
شعوبا وقبائل لتعارفوا
(
এবং আমি তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও।
ইসলামের আবির্ভাবের সময় জাতি ও গোত্রসমূহ পরস্পর অপরিচিত ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত ছিল। আরো যথার্থ বললে তারা পরস্পর বিদ্বেষী এবং দ্বন্দ-সংঘাত ও যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। কিন্তু একত্ববাদী ধর্ম ইসলামের শিক্ষার কারণে তাদের এই পরস্পর অপরিচিতি পরিচিতিতে
,
দ্বন্দ-সংঘাত সহযোগিতায় এবং অনৈক্য ঐক্যে পরিণত হয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতে একক মহান জাতি হিসেবে তারা আবির্ভূত হয়েছিল এবং এক মহান সভ্যতার জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছিল। সেই সাথে শোষক ও অত্যাচারীদের হাত হতে বিভিন্ন জাতিকে রক্ষা করেছিল এবং এই উম্মাহ বিশ্বের জাতিগুলোর কাছে সম্মানের পাত্র হয়েছিল। এর বিপরীতে অত্যাচারী ও সীমালংঘনকারীদের জন্য তারা আতঙ্ক ও চক্ষুশূল হয়েছিল।
এ সকল সফলতা কখনই অর্জিত হত না যদি না তাদের মধ্যে ঐক্য থাকত এবং ইসলামের ছায়ায় আশ্রয়গ্রহণকারী জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও সম্প্রীতি বিরাজ করত। যদিও তারা ছিল বিভিন্ন জাতির
,
তাদের মধ্যে ছিল মতের ভিন্নতা
,
সাংস্কৃতিক পার্থক্য
,
প্রথাগত অমিল
,
রীতি ও আচারের বিচিত্রতা কিন্তু মৌলনীতি ও আবশ্যকীয় বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে তারা ছিল সমবিশ্বাসী ও ঐকমত্য। তারা বুঝত একতাই শক্তি আর বিভেদই দুর্বলতা।
এ রীতিই অনুসৃত হচ্ছিল কিন্তু যুগের পরিবর্তনে পুনরায় এ পরিচিতি অপরিচিতিতে
,
সমঝোতা ঘৃণায় পরিণত হল
,
মাজহাবভিত্তিক দল ও গোষ্ঠীসমূহ একে অপরকে কাফের প্রতিপন্ন করল
,
পরস্পরের উপর আঘাত হানতে লাগল
।
ফলে মর্যাদা ভূলুন্ঠিত হল
,
গৌরব লুপ্ত হল
,
ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হল এবং তাগুতী শক্তি নেতৃত্ব ও দিক নির্দেশনাদানকারী এ জাতিকে তুচ্ছ ও হীন মনে করল। এ বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌছল যে এ জাতির মধ্যে শৃগালের ন্যায় ধূর্ত ও নেকড়ের ন্যায় হিংস্র ব্যক্তিবর্গের বিচরণ শুরু হল
,
আল্লাহর অভিশপ্ত ও মানব জাতি কর্তৃক ধিকৃত বিজাতীয় শত্রুরা ইসলামী ভূখণ্ডে গুপ্তচরবৃত্তিতে লিপ্ত হল। ফলে এ ভূখণ্ডের সম্পদসমূহ ব্যাপকভাবে লুন্ঠিত হল
,
পবিত্র বিশ্বাসসমূহ অসম্মানিত হল
,
এর অধিবাসীদের সম্মান লম্পট ব্যক্তিদের করুণার অধীন হয়ে গেল
,
এ জাতির পতনের পর পতন ঘটতে লাগল
,
পরাজয়ের পর পরাজয় তাদের ললাটে কালিমা এঁকে দিল। সেদিন স্পেন (খৃষ্টানদের হাতে গ্রানাডায়)
,
সামারকান্দ
,
বোখারা
,
তাসখন্দ ও বাগদাদে (মোগলদের হাতে) আমরা তা লক্ষ্য করেছি আর আজ ইরাক
,
আফগানিস্তান ও ফিলিস্তিনে একই চিত্র দেখছি।
এ ঘটনাগুলোতে সেই হাদিসগুলোর কথাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে যে
,
তোমরা দোয়া করবে কিন্তু তার কোন উত্তর পাবেনা
,
সাহায্যের আহবান জানাবে কিন্তু তা গৃহীত হবে না। কারণ যখন রোগ এক প্রকারের আর ঔষধ হল আরেক প্রকারের তখন সে ঔষধ
দিয়ে এ রোগ সারানো সম্ভব নয়
।
নিশ্চয়ই আল্লাহ কার্যকারণের নীতির বাইরে বিশ্বজগতকে পরিচালনা করেন না
।
তাই এ উম্মতের বর্তমান সমস্যার সমাধান তার প্রাথমিক যুগের সমাধানের মধ্যেই নিহিত রয়েছে
।
বর্তমানে ইসলামী উম্মাহ তার সত্তা
,
বিশ্বাস ও ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নগ্ন ও কুৎসিত হামলার শিকার। তাদের শান্তিপূর্ণ মাজহাবী সহাবস্থান ও পরমতসহিষ্ণুতার মধ্যে ফাটল সৃষ্টির মাধ্যমে বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়া হচ্ছে
।
ফলে তারা ঐক্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। এ সকল আক্রমণ দ্রুত তার পরিণতি ও মন্দ ফল বয়ে আনছে। এ মুহুর্তে তাদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত কি এটি হওয়া উচিত নয় যে
,
তারা সংঘবদ্ধভাবে পরস্পর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াবে ও তাদের মধ্যকার সম্পর্ককে মজবুত ও দৃঢ় করবে। তাদের বুঝতে হবে তাদের মধ্যে মাজহাব ও ফিরকাগত মতপার্থক্য থাকলেও ধর্মীয় উৎসের দিক থেকে তারা এক কোরআন ও সুন্নাহর অনুসারী
,
তওহীদ
,
নবুওয়াত ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তারা সমবিশ্বাসী
,
নামাজ
,
রোজা
,
হজ
,
জাকাত
,
জিহাদ
,
হালাল
,
হারাম প্রভৃতি বিষয়ে এক শরীয়তের অনুবর্তী। মহানবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা এবং তাদের শত্রুদের সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদের বিষয়ে একই মনোভাবের অধিকারী যদিও এ ক্ষেত্রে কারো মধ্যে আধিক্য ও কারো মধ্যে স্বল্পতা বিদ্যমান অর্থাৎ বন্ধনটি অপেক্ষাকৃত দুর্বলরূপে রয়েছে। একারণেই ইসলামী উম্মাহ এক হাতের অঙ্গুলীগুলির সাথে তুল্য যা পরিশেষে একক অস্থিতে সংযুক্ত হয়েছে যদিও তাদের মধ্যে দৈর্ঘ্য ও আকৃতিগত পার্থক্য রয়েছে। কিংবা কোন হাদিসে এ উম্মতকে একটি দেহের সাথে তুলনা করা হয়েছে যাতে একদিকে বিভিন্ন ধরনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে অন্যদিকে তাদের মধ্যে আকৃতিগত পার্থক্য সত্ত্বেও শারীরতাত্তিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক ও একক ভূমিকা রয়েছে যা তার অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য।
ইসলামী উম্মাহকে একবার একটি হাতের সঙ্গে আরেকবার এক দেহের সাথে তুলনা করার দর্শন সম্ভবত তাই অর্থাৎ বিষয়টি মনে হয় উপরোক্ত সত্যেরই ইঙ্গিত বহন করছে।
পূর্বে ইসলামের বিভিন্ন ফির্কা ও মাজহাবের আলেমগণ কোনরূপ দ্বন্দ-সংঘাত ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি বাস করতেন। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে তারা পরস্পরকে সহযোগিতা করতেন। তাই দেখা গেছে একজন আরেকজনের ফিকাহ বা কালামশাস্ত্রের কোন গ্রন্থের ব্যাখ্যা গ্রন্থ লিখেছেন
,
একজন আরেকজনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন
,
একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন এবং প্রশংসা করেছেন
,
একে অপরের মতকে সমর্থন করেছেন
,
একে অপরকে নিজের সংগৃহীত হাদিস বর্ণনা করার অনুমতি দিয়েছেন
,
কখনও কখনও এক মাজহাবের বা ফির্কার কেউ অপর মাজহাব বা ফির্কার কারো হতে হাদিস বর্ণনার অনুমতি চেয়েছেন
,
একজন আরেকজনের পিছনে নামাজ পড়েছেন
,
একে অপরের জামাআতে ইমামতি করেছেন
,
এক মাজহাবের অনুসারী অপর মাজহাবের অনুসারীকে জাকাত দিয়েছেন
,
একে অপরের মাজহাবকে স্বীকৃতি দিয়েছেন ও সত্যতাকে স্বীকার করেছেন
।
সেসময়ে সমাজের সকল পর্যায়ে বিভিন্ন ফির্কা ও মাজহাবের অনুসারীরা বন্ধুত্ব ও সৌহার্দপূর্ণ মনোভাব নিয়ে পাশাপাশি সহাবস্থান করেছে যেন তাদের মধ্যে কোন বিরোধ ও মতদ্বৈততা নেই। অথচ তারা যুক্তিপূর্ণভাবে একে অপরের মতকে খণ্ডন করতেন
,
সমালোচনা পর্যালোচনা করতেন। কিন্তু তারা তা করতেন সম্মানের সাথে এবং আদব ও শিষ্টাচার সহকারে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রেখে।
এরূপ বিস্তৃতত সহযোগিতার জীবন্ত ও ঐতিহাসিক অসংখ্য দৃষ্টান্ত সে সমাজে ছিল এবং প্রকৃতপক্ষে সেই পারস্পরিক সহযোগিতার ফলশ্রুতিতেই মুসলিম মনীষীরা ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির পত্তন করতে পেরেছিলেন। এর মাধ্যমেই তারা মাজহাবী স্বাধীনতার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এবং তাদের নিকট সম্মানের পাত্র হয়েছিলেন।
এটি এমন কোন কঠিন কাজ নয় যে
,
উম্মাহর বিশেষজ্ঞ আলেমগণ পারস্পরিক মতদ্বৈততার কোন বিষয়ে আলোচনায় বসবেন এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সততা ও নিষ্ঠার সাথে বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করবেন। সেখানে একে অপরের মত ও যুক্তিকে শ্রবণ করবেন ও সে সম্পর্কে অবহিত হবেন।
এটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও উত্তম যে
,
প্রত্যেক মাজহাব ও দলই তার চিন্তা-বিশ্বাস এবং ফিকাহগত অবস্থানকে একটি মুক্ত ও স্বাধীন পরিবেশে সুস্পষ্টরূপে উপস্থাপনের সুযোগ পাবে। এর ফলে তাদের উপর আরোপিত অভিযোগের অসারতা সহজেই প্রমাণিত
হবে ও সন্দেহসমূহের অপনোদন ঘটবে। তদুপরি প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মতৈক্য ও মতভিন্নতার বিষয়সমূহ সম্পর্কে জানতে পারবে। ফলে মুসলমানরা অনুভব করতে পারবে যে বিষয়গুলি তদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে তার পরিমাণ তাদের মতভিন্নতার বিষয় হতে অনেক বেশী যা তাদের মধ্যকার সম্পর্কের বরফ গলাতে সাহায্য করবে।
এ প্রবন্ধটি এ লক্ষ্য অর্জনের পথে একটি পদক্ষেপ। সত্যের সঠিক রূপটি সকলের নিকট তুলে ধরাই এ লেখার উদ্দেশ্য। আল্লাহই তৌফিক দানকারী।