মানুষ খোদায়ী পথনির্দেশের মুখাপেক্ষী
এ ধরনের বাঞ্ছিত জীবন যাপনের জন্য মানুষ কতক বিষয়ে সহজাত পথনির্দেশের অধিকারী এবং কতক বিষয়ে তার বিচারবুদ্ধি
(عقل
- Reason)তাকে পথনির্দেশ দানে সক্ষম। কিন্তু কতক বিষয়ে সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে নিপতিত হয়। এছাড়া বিভিন্ন কারণে তার সহজাত প্রকৃতি বিকৃত হতে পারে এবং বিচারবুদ্ধি ভুল করতে পারে। এ কারণে সে এ সব ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা
‘
আলার কাছ থেকে পথনির্দেশের প্রয়োজন অনুভব করে। মানুষের বিচারবুদ্ধি এ উপসংহারে উপনীত হয় যে
,
আল্লাহ্ তা
‘
আলা যখন তাকে পথনির্দেশের মুখাপেক্ষী করেছেন এবং তিনি পথনির্দেশ প্রদানে অক্ষম হবার মতো দুর্বলতা থেকে উর্ধে তখন নিশ্চয়ই তিনি কোনো না কোনো ভাবে এবং কোথাও না কোথাও এ পথনির্দেশ নিহিত রেখেছেন।
বলা বাহুল্য যে , এ ধরনের পথনির্দেশ প্রতিটি মানুষের কাছে আসা অপরিহার্য নয়। কারণ , তাহলে তা হতো সহজাত , ফলে মানুষ কোনো বিষয়েই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতো না এবং মানবপ্রকৃতিতে পথনির্দেশের আকাঙ্ক্ষাও জাগ্রত হতো না। অতএব , বিচারবুদ্ধির রায় অনুযায়ী আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে কতক সীমিত সংখ্যক ব্যক্তির কাছে এ পথনির্দেশ আসবে এবং তাঁরা অন্যদের নিকট তা পৌঁছে দেবেন। এই পথনির্দেশেরই নাম নবুওয়াত্ ও রিসালাত্ এবং এ পথনির্দেশ যাদের নিকট আসে তাঁরা হলেন নবী ও রাসূল।
মু‘
জিযাহ্ : নবী চেনার মাধ্যম
এর পরই প্রশ্ন জাগে : নবী বা রাসূল কে ? কোনো ব্যক্তি নিজেকে নবী বলে দাবী করলে কী করে বোঝা যাবে যে , তিনি সত্যিকারের নবী , নাকি নবী হওয়ার মিথ্যা দাবীদার ?
হ্যা , নবী হওয়ার দাবীদার কোনো ব্যক্তি সত্যি সত্যিই নবী কিনা তা জানার কয়েকটি পন্থা রয়েছে। এ সব পন্থার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মু‘
জিযাহ্ বা অলৌকিকতা।
মু‘
জিযাহ্ অর্থাৎ অলৌকিকতা বা অলৌকিক ঘটনা হচ্ছে এমন অস্বাভাবিক অবস্থা বা ঘটনা যা একজন সত্যিকারের নবীর নবুওয়াত্ প্রমাণের জন্য আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে সরাসরি বা নবীর মাধ্যমে ঘটানো হয় বা সৃষ্টি করা হয়। এ ধরনের ঘটনা ঘটানো বা এ ধরনের অবস্থা সৃষ্টিতে কোনো রকমের মানবিক জ্ঞান-বিজ্ঞান , চর্চা , সাধনা বা যোগ্যতা-প্রতিভা অথবা এ ব্যাপারে কার্যকরভাবে ব্যবহারযোগ্য কোনো পার্থিব উপায়-উপকরণের ভূমিকা থাকে না। যেমন : মৃতকে জীবিতকরণ , অন্ধকে দৃষ্টিদান , লাঠিকে জীবন্ত সাপে পরিণতকরণ , চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিতকরণ ইত্যাদি।
এখানে নবী-রাসূলগণের (‘
আঃ) মু‘
জিযাহর কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হলো মাত্র এবং বিভিন্ন নবী-রাসূল (‘
আঃ) এ জাতীয় আরো অনেক মু‘
জিযাহর অধিকারী ছিলেন। কিন্তু এ জাতীয় মু‘
জিযাহ্ ছিলো সাময়িক এবং সীমিত ক্ষেত্রে তথা সীমিত সংখ্যক লোককে প্রদর্শনের উপযোগী। অর্থাৎ মৃতকে জীবন দান , মাটি দিয়ে পাখী তৈরী করে তাকে প্রাণশীল করে উড়িয়ে দেয়া , লাঠিকে জীবন্ত সাপে পরিণত করা , চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিতকরণ ইত্যাদি মু‘
জিযাহ্ যাদের সামনে সংঘটিত হয়েছে তাদের জন্য তা অকাট্যভাবে প্রত্যয়উৎপাদক ছিলো। কিন্তু যারা তা অন্যের কাছ থেকে শুনেছে তাদের কাছে এ সবের অকাট্যতা নির্ভর করে বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে শ্রবণকারীর প্রত্যয় ও তার মাত্রার ওপর। এ ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষকারীর প্রত্যয় ও শ্রবণকারীর প্রত্যয়ের মধ্যে যথেষ্ট মাত্রাভেদ হয়ে থাকে।
কোরআন মজীদ স্থান-কালোর্ধ মু‘
জিযাহ্
তবে সমস্ত নবী-রাসূলের (‘
আঃ) প্রদর্শিত বা তাঁদের অনুকূলে সংঘটিত সকল মু‘
জিযাহর মধ্যে সর্বশেষ নবী রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কর্তৃক পেশকৃত মহাগ্রন্থ কোরআন মজীদ হচ্ছে এমন একটি অনন্য মু‘
জিযাহ্ যা স্থানগত ও কালগত সীমাবদ্ধতার উর্ধে। অর্থাৎ কোরআন মজীদ নাযিল্ হওয়ার সময় যেমন মু‘
জিযাহ্ ছিলো দীর্ঘ চৌদ্দশ’
বছর পরেও এখনো তদ্রƒ
প মু‘
জিযাহ্ই রয়েছে। তেমনি দেশ-জাতি নির্বিশেষে সমগ্র মানবপ্রজাতির জন্যই তা মু‘
জিযাহ্ ; অতীতে যেমন ছিলো , বর্তমানে যেমন রয়েছে তেমনি ভবিষ্যতেও তা মু‘
জিযাহ্ই থাকবে।
কোরআন মজীদের ভাষা ও সাহিত্যমান , বিষয়বস্তু , ভবিষ্যদ্বাণী এবং আরো অনেক বৈশিষ্ট্যের বিচারে এ গ্রন্থ যে কোনো মহাপ্রতিভাধর মানবিক লেখনিশক্তির উর্ধে। তাই কোরআন মজীদে চ্যালেঞ্জ প্রদান করা হয়েছে যে , সমস্ত মানুষ ও জ্বিন্ মিলে চেষ্টা করে দেখতে পারে কোরআনের অনুরূপ কোনো গ্রন্থ , নিদেন পক্ষে এর কোনো একটি সূরাহর সাথে তুলনীয় মানের (ক্ষুদ্রতম সূরাহটির সাথে তুলনীয় হলেও আপত্তি নেই) কোনো সূরাহ্ রচনা করতে পারে কিনা। অবশ্য ইসলামের বিরোধী পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে চেষ্টা করাও হয়েছে , কিন্তু তাদের এ সংক্রান্ত সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।
মু‘
জিযাহ্ নির্বাচনে খোদায়ী নিয়ম
এখানে মু‘
জিযাহ্ প্রসঙ্গে আরো দু‘
টি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। প্রথমতঃ আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে নবী-রাসূলগণকে (‘
আঃ) মু‘
জিযাহ্ প্রদানের ক্ষেত্রে একটি নিয়ম লক্ষ্য করা যায়। তা হচ্ছে , সংশ্লিষ্ট নবী যে জাতির মধ্যে আবির্ভূত হতেন বা যে জাতির হেদায়াতের জন্য দায়িত্ব পালন করতেন সে জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান বা শিল্পকুশলতার যে দিকটিতে সর্বাধিক অগ্রসর থাকতো সংশ্লিষ্ট নবীকে প্রদত্ত মু‘
জিযাহ্ সমূহের মধ্যে অন্ততঃ সর্বপ্রধান মু‘
জিযাহটি সে বিষয়েই দেয়া হতো। এ ক্ষেত্রে নবীর মু‘
জিযাহর মোকাবিলায় ঐ জাতির মধ্যকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ক শ্রেষ্ঠতম বিশেষজ্ঞদেরকে অপারগ প্রমাণ করে দেয়া হতো। এভাবেই সংশ্লিষ্ট নবীর নবুওয়াতের সত্যতা তুলে ধরা হতো এবং ঐ জাতির পরাজিত শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞগণ মুখে অথবা স্বীয় অক্ষমতার মাধ্যমে উক্ত নবীর নবুওয়াতের সত্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হতেন।
নবী-রাসূলগণকে (‘
আঃ) মু‘
জিযাহ্ প্রদানের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা‘
আলার এ নিয়মের কারণেই দেখা যায় , মিসরে জাদুবিদ্যার চরমোন্নতির যুগে মিসরীয়দের কাছে প্রেরিত নবী হযরত মূসা (‘
আঃ) লাঠিকে এমন এক সাপে পরিণত করেন যা সেখানকার শ্রেষ্ঠতম জাদুকরদের জাদুকে খেয়ে ফেলে। ফলে জাদুকররা বুঝতে পারে যে , হযরত মূসা (‘
আঃ)-এর এ কাজ জাদুক্ষমতার উর্ধে এবং এ কারণে তারা তাঁর ওপরে ঈমান আনে।
অন্যদিকে হযরত‘
ঈসা (‘
আঃ) যখন ফিলিস্তিনে নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন করেন তখন ফিলিস্তিন ছিলো রোমানদের শাসনাধীন এবং ইতিপূর্বেকার শাসকশ্রেণী গ্রীকদের ও তৎকালীন শাসকশ্রেণী রোমানদের সভ্যতা-সংস্কৃতির দ্বারা ফিলিস্তিনীরা দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলো। ইতিপূর্বেই গ্রীকরা চিকিৎসাশাস্ত্রে দারুণ উন্নতি করেছিলো এবং ঐ সময় রোমানদের মধ্যেও চিকিৎসাশাস্ত্রের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছিলো। এ কারণে আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে হযরত‘
ঈসা (‘
আঃ)কে যে সব মু‘
জিযাহ্ দেয়া হয় অর্থাৎ মৃতকে জীবিতকরণ , মাটির তৈরী পাখীর মূর্তিকে প্রাণদান , জন্মান্ধকে দৃষ্টিদান ও কুষ্ঠরোগীকে নিরাময় দান - এগুলোর মাধ্যমে তিনি সেখানকার শ্রেষ্ঠতম চিকিৎসাবিজ্ঞানীদেরকে অপারগ প্রমাণ করে দেন।
এ বিষয়টি বিপরীতভাবে ধরে নিয়ে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। তা হচ্ছে , ধরা যাক , লাঠিকে সাপে পরিণতকরণ যদি হযরত‘
ঈসা (‘
আঃ)-এর সর্বপ্রধান মু‘
জিযাহ্ হতো এবং জন্মান্ধকে দৃষ্টিদান যদি হযরত মূসা (‘
আঃ)-এর মু‘
জিযাহ্ হতো , তাহলে তার প্রতিক্রিয়া কী হতো ? সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই মিসরীয়রা মনে করতো যে , হযরত মূসা (‘
আঃ) একজন বড় ধরনের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ; মিসরের চিকিৎসকরা তাঁর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম না হলেও এবং তাঁর রোগনিরাময় কৌশল ধরতে না পারলেও যে সব দেশ চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধিকতর উন্নত হয়তো সে সব দেশের শ্রেষ্ঠতম চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণ তাঁর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ও তাঁর সাফল্যকৌশল ধরতে সক্ষম। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের লোকেরা হযরত‘
ঈসা (‘
আঃ)কে একজন বড় ধরনের জাদুকর মনে করতো এবং বলতো : আমাদের মধ্যে কোনো বড় জাদুকর থাকলে নিশ্চয়ই সে এর সাথে মোকাবিলা করতে পারতো।
কিন্তু যে জাতির মধ্যে যে বিষয়ের শ্রেষ্ঠতম বিশেষজ্ঞদের অস্তিত্ব ছিলো সে জাতির সামনে বার বার সে বিষয়ে মু‘
জিযাহ্ প্রদর্শন করায় এবং স্বয়ং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ তা মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ায় ও সে কাজকে মুখে বা স্বীয় অক্ষমতার মাধ্যমে মানবিক ক্ষমতা ও যোগ্যতা-প্রতিভার উর্ধে বলে স্বীকার করতে বাধ্য হওয়ায় সংশ্লিষ্ট মু‘
জিযাহ্ সেখানকার সাধারণ মানুষের মাঝে প্রত্যয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।