কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্ 5%

কোরআনের মু‘জিযাহ্ লেখক:
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের মু‘জিযাহ্
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 60 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 49588 / ডাউনলোড: 4867
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

আরবী ভাষার প্রকাশক্ষমতার দৃষ্টান্ত

এবার আমরা আরবী ভাষার বাক্যগঠন বৈচিত্র্যের প্রতি দৃষ্টি দেবো যা কথক বা লেখককে তার বাঞ্ছিত ভাব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য সহকারে প্রকাশ করতে সহায়তা করে।

এ প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় যে , আরবী ভাষায় বাক্যের ভিতরে ভূমিকা ভেদে ক্রিয়া ও বিশেষ্য-বিশেষণের শেষ বর্ণের স্বরচিহ্ন পরিবর্তনের মাধ্যমে বাক্যের তাৎপর্যে পরিবর্তন ঘটানো হয়। এ ক্ষেত্রে স্বরচিহ্নের ভূমিকাকে রাফ্ (رَفع ), নাছ্বব্ (نَصب ) , জায্ম্ (جَزم ) ও জার্র্ (جَرّ ) বলা হয়। এর মধ্যে প্রথম দু টি ক্রিয়া ও বিশেষ্য-বিশেষণ উভয় ক্ষেত্রে , তৃতীয়টি শুধু ক্রিয়ার ক্ষেত্রে এবং চতুর্থটি শুধু বিশেষ্য-বিশেষণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

কর্তা ও কর্মভেদে এগুলোর বিবিধ ব্যবহার নিয়ে আলোচনা এখানে খুব বেশী যরূরী নয়। তবে জার্র্ (جَرّ ) সম্পর্কে কিছুটা ধারণা লাভ ছাড়া আরবী ভাষার প্রকাশক্ষমতা সম্পর্কিত ধারণা হবে খুবই অসম্পূর্ণ ও অগভীর। কারণ জার্র্ (جَرّ ) হচ্ছে এমন একটি ব্যাকরণিক নিয়ম আরবী ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় যার ব্যবহার নেই। জার্র্-এর দ্বারা আরবী ভাষায় এমনভাবে সংক্ষেপে ভাব প্রকাশ করা হয় যে জন্য অন্যান্য ভাষায় বাক্যে অতিরিক্ত শব্দ যোগ করতে হয়। স্মর্তব্য , অভিন্ন ভাব দুর্বোধ্যতা ছাড়াই অপেক্ষাকৃত সংক্ষেপে প্রকাশ করতে পারা যে কোনো ভাষা বা বক্তা বা লেখকের কৃতিত্ব বা গৌরব বলে পরিগণিত হয়ে থাকে।

এখানে বাংলা ও ইংরেজী অর্থ সহ আরবী ভাষায় জার্র্-এর ব্যবহার সহ সংক্ষেপে ভাব প্রকাশের কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো :

رَأيتُ زيداً ( রাআইতু যাইদান্ ) - আমি যায়েদকে দেখলাম। I saw Zayd.এ বাক্যে আরবীতে ২ শব্দ , বাংলায় ৩ শব্দ ও ইংরেজীতে ৩ শব্দ।

مَرَرتُ بِزَيدٍ ( মারারতু বিযাইদিন্ ) - আমি যায়েদকে অতিক্রম করে গেলাম ; আমি যায়েদের পাশ ঘেঁষে গেলাম। I passed accross Zayd.জারর নিয়মের এ আরবী বাক্যে শব্দসংখ্যা ২টি , বাংলা বাক্যে ৫টি এবং ইংরেজী বাক্যে ৪টি।

এবারجحد ক্রিয়াপদ যোগে গঠিত বাক্যের উদাহরণ :

لَم يَضرِب زَيدٌ عَلياً / لَمَّا يَضرِب زَيدٌ عَلياً ( লাম্ ইয়াযরিব্ যাইদুন্ আলীয়্যান্ / লাম্মা ইয়াযরিব্ যাইদুন্ আলীয়্যান্ ) - এ উভয় বাক্যেরই মানে হচ্ছে : যায়েদ এখনো আলীকে মারে নি - Still Zayd has not beaten Ali.এখানে লক্ষ্য করার বিষয় , উভয় আরবী বাক্যেই শব্দসংখ্যা ৪টি , বাংলায় ৫টি এবং ইংরেজীতে ৬টি।

কিন্তু উপরোক্ত আরবী বাক্যে বতিক্রমধর্মী যে তাৎপর্য প্রচ্ছন্ন রয়েছে তা হচ্ছে , যায়েদ এখনো আলীকে মারে নি বটে , কিন্তু পরে মারতে পারে। তবে প্রথম বাক্যে এ তাৎপর্যও নিহিত রয়েছে যে , যায়েদ পরে আলীকে মারতেও পারে , না-ও মারতে পারে। অন্যদিকে দ্বিতীয় বাক্যে এ তাৎপর্য নিহিত রয়েছে যে , যায়েদ পরে আলীকে মারবে - এ সম্ভাবনাই বেশী।

উপরোক্ত উভয় বাক্য কর্তা-কর্ম অগ্র-পশ্চাত করে এভাবেও বলা যেতে পারে :لَم يَضرِب عَلياً زَيدٌ / لَمَّا يَضرِب عَلياً زَيدٌ (লাম্ ইয়াযরিব্ আলীআন্ যাইদুন্ / লাম্মা ইয়াযরিব্ আলীআন্ যাইদুন্) সে ক্ষেত্রে প্রথম বাক্যে এ তাৎপর্যও নিহিত রয়েছে যে , আলীকে এখনো যায়েদ মারে নি , তবে অন্য কেউ মেরে থাকতে পারে। আর দ্বিতীয় বাক্যে এ তাৎপর্যও নিহিত রয়েছে যে , আলীকে এখনো যায়েদ মারে নি , তবে পরে মারবে।

কিন্তু আরবী ভাষায় কর্তা-কর্ম অগ্র-পশ্চাত করেও ভাব প্রকাশে বিরাট পরিবর্তন করা হয়। যেমন :ضرب زَيدٌ عَلياً (যারাবা যাইদুন্ আলীয়্যান্) না বলেضرب عَلياً زَيدٌ (যারাবা আলীয়্যান্ যাইদুন্) বলা যেতে পারে। এ উভয় বাক্যের অর্থই যায়েদ আলীকে মেরেছে। কিন্তু পার্থক্য এখানে যে , প্রথম বাক্যে বক্তা কর্তার ওপর এবং দ্বিতীয় বাক্যে কর্মের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছেন।

ব্যাকরণে আলাদাভাবে আলোচনা করা না হলেও বাংলা ভাষায় কোনো কোনো অঞ্চলের গ্রামের লোকদের মধ্যে তাৎপর্যের ভিন্নতা বুঝানোর জন্য এভাবে কর্তা-কর্ম অগ্র-পশ্চাত করার প্রচলন রয়েছে। যেমন : আমি ভাত খাই (সাধারণ তথ্য/ সংবাদ)। কিন্তু অনেক সময় বলা হয় : আমি খাই ভাত। এর মানে : আমি (প্রধান খাদ্য হিসেবে) অন্য কিছু বা অন্য কোনো সুনির্দিষ্ট খাবার খাই না। যেমন বলা হয় : আমি খাই ভাত , সে খায় রুটি। ইংরেজী ভাষায়ও এ ধরনের প্রচলন কিছুটা থাকলেও তা ব্যাকরণে স্বতন্ত্র গুরুত্ব না পাওয়ায় এর ব্যবহার খুবই কম।

অন্যদিকে আরবী ভাষায় সাধারণ বাক্য ক্রিয়াপদ দ্বারা শুরু করার নিয়ম থাকলেও কর্তা বা কর্ম দ্বারাও শুরু করা যয়। সে ক্ষেত্রে তাৎপর্যে যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটে। যেমন : কোনো বাক্য ক্রিয়াপদ দ্বারা শুরু না করে কর্তা বা কর্ম দ্বারা শুরু করলে এবং ক্রিয়াপদটিকে তার পরে স্থান দিলে (যেমন :زَيدٌ ضرب عَلياً বাعَلياً ضرب زَيدٌ ) তাৎপর্যে সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটে , তা হচ্ছে , এ ক্ষেত্রে ক্রিয়ার তুলনায় কর্তা বা কর্মকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়।

তেমনি সামান্য ওপরেجحد ক্রিয়াপদের উদাহরণস্বরূপ উল্লিখিত বাক্য দু টি কর্তা-কর্ম অগ্র-পশ্চাত করে এভাবেও বলা যেতে পারে :لَم يَضرِب عَلياً زَيدٌ / لَمَّا يَضرِب عَلياً زَيدٌ (লাম্ ইয়াযরিব্ আলীয়্যান্ যাইদুন্/ লাম্মা ইয়াযরিব্ আলীয়্যান্ যাইদুন্) সে ক্ষেত্রে কর্তার তুলনায় কর্মের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা ছাড়াও প্রথম বাক্যে এ তাৎপর্যও নিহিত রয়েছে যে , আলীকে এখনো যায়েদ মারে নি , তবে অন্য কেউ মেরে থাকতে পারে। আর দ্বিতীয় বাক্যে এ তাৎপর্যও নিহিত রয়েছে যে , আলীকে এখনো যায়েদ মারে নি , তবে পরে মারবে।

বাংলা ভাষায় এ ধরনের বাক্যরীতির সাধারণ প্রচলন না থাকলেও অন্ততঃ অংশতঃ হলেও এ ধরনের ভাব প্রকাশের জন্যে কর্তা - কর্ম অগ্র - পশ্চাত করে বাক্য গঠনের মতো প্রশস্ততা রয়েছে। কিন্তু ইংরেজী ভাষায় অতিরিক্ত শব্দ যোগ না করে বা কর্তৃবাচ্য বাক্যকে কর্মবাচ্যে রূপান্তরিত না করে তা প্রকাশের সুযোগ নেই। কারণ , যদি বলি যে , Still Ali has not beaten Zayd..তাহলে এর অর্থই উল্টে যাবে। আর যদি বলি যে , Still Ali has not been beaten by Zayd.তাহলে বাক্যটি শুধু কর্তৃবাচ্য থেকে কর্মবাচ্যেই রূপান্তরিত হবে না , বরং তার শব্দসংখ্যা বেড়ে ৮টিতে দাঁড়াবে। এই একটি বিষয়ের ওপরে আরো দীর্ঘ আলোচনা করা যেতে পারে।

অন্যান্য ভাষার ন্যায় আরবী ভাষায় কর্তৃবাচ্য ও কর্মবাচ্যের ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য ভাষার সাথে আরবী ভাষায় এর ব্যবহারের পার্থক্য এখানে যে , আরবী ভাষায় কর্মবাচ্যের ব্যবহারের পিছনে সাধারণতঃ বক্তার উদ্দেশ্য থাকে কর্তাকে গুরুত্ব না দেয়া ; কেবল কর্মকে গুরুত্ব দেয়া। এ কারণে কর্মবাচ্যে সাধারণতঃ কর্তাকে আদৌ উল্লেখ করা হয় না। যেমন :ضُرِبَ علیٌّ (যুরিবা আলীয়্যুন্)- আলী প্রহৃত হলো (কার দ্বারা প্রহৃত হলো তা বলার জন্যে বক্তার কোনো আগ্রহ নেই)।

আরবী ভাষায় বাক্য গঠনের ধরনের আরেকটি দৃষ্টান্ত দেখা যাক :

نَشَرَ زَيدٌ کِتاباً (৩ শব্দ)। যায়েদ একটি বই প্রকাশ করলো (৫ শব্দ)। Zayd published a book (৪ শব্দ)।نُشِرَ کِتابٌ (২ শব্দ)। একটি বই প্রকাশিত হলো (৪ শব্দ)। A book is published (৪ শব্দ)।الکِتابُ مَنشورٌ (২ শব্দ)। বইটি প্রকাশিত (২ শব্দ)। The book is published (৪ শব্দ)।

আরবী বাক্য প্রকরণেحال (হাাল্- অবস্থা) একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা অন্য ভাষায় অনুপস্থিত না থাকলেও পরিবর্তিত ভাবপ্রকাশের জন্য আরবী ভাষায় এর যে ব্যবহার তা অন্যান্য ভাষায় দেখা যায় না এবং এ কারণেই অন্যান্য ভাষার ব্যাকরণে এটি আলাদা বিষয় হিসেবে আলোচিত হতে দেখা যায় না।

حال মানে হচ্ছে একটি ক্রিয়া কী অবস্থায় সংঘটিত হচ্ছে। এ অবস্থাটা কর্তা , কর্ম উভয়েরই হতে পারে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক :

جاء رجول راكب - (যাআ রাজূলুন্ রাাকেব্ - একজন অশ্বারোহী লোক এলো।) এখানেراكب হচ্ছেصفت - বিশেষণ।

جاء رجول راكباً - (যাআ রাজূলুন্ রাাকেবান্ - অশ্বারূঢ় অবস্থার অধিকারী একজন লোক এলো।) এখানেراكباً হচ্ছেصفت - বিশেষণ।

جاء الرجول الراكب - (যাআর্ রাজূলুর্ রাাকেব্ - অশ্বারোহী লোকটি এলো।) এখানেالراكب হচ্ছেصفت - বিশেষণ।

جاء الرجول راكباً - (যাআর্ রাজূলু রাাকেবান্ - লোকটি অশ্বারূঢ় অবস্থায় এলো।) এখানেراكباً হচ্ছেحال - অবস্থা।

এ বিষয়ে আরো অনেক আলোচনা করা যেতে পারে। আরবী ভাষার বিস্ময়করভাবে ব্যাপক ও সুগভীর ভাব প্রকাশ সম্পর্কে সাধারণ ধারণা লাভের জন্য মোটামুটি এতোটুকুই যথেষ্ট বলে মনে হয়।

কোরআন মজীদের প্রকাশক্ষমতার মু জিযাহ্

আরবী ভাষায় একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে :خير الکلام ما قلَّ دلَّ - (ভাষা-সাহিত্যের মানগত বিচারে) সর্বোত্তম কথা হলো যা সংক্ষিপ্ত ও তাৎপর্যবহ। এটা যে কোনো ভাষায়ই সর্বজনস্বীকৃত। এ প্রসঙ্গে যে কোনো ভাষায় রচনাপ্রতিযোগিতার দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। রচনা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে সকল প্রতিযোগীই রচনা তৈরী করে। এ ক্ষেত্রে রচনা বিচারের বেলায় যে বিষয়গুলো দেখা হয় তা হচ্ছে : (১) বিষয়বস্তুর জন্য উপযোগী সর্বোত্তম শব্দাবলী নির্বাচন , (২) স্বল্পতম আয়তন , (৩) গভীরতম , ব্যাপকতম ও সূক্ষ্মতম ভাব প্রকাশ , (৪) গতিশীলতা তথা প্রাঞ্জলতা বজায় রেখে উন্নততম রচনাশৈলী ব্যবহার ও (৫) বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যশীল আলঙ্কারিকতা।

কোরআন মজীদ তার বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য ও ব্যাপকতার বিচারে খুবই সংক্ষিপ্ত একটি গ্রন্থ , অথচ সীমাহীন তাৎপর্যের অধিকারী। কারণ , শব্দচয়ন , শব্দপ্রয়োগ ও বাকরীতির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে অবলম্বিত এক বিস্ময়কর রচনাকৌশলের আশ্রয়ে এ সংক্ষিপ্ত গ্রন্থে আক্বাএদ্ , আহ্কাম , আইন-কানুন , নৈতিকতা , দর্শন , ভবিষ্যদ্বাণী , উপদেশ , প্রার্থনা , ইতিহাস , রাজনীতি , অর্থনীতি , সমাজবিজ্ঞান , সমাজতত্ত্ব , মনস্তত্ত্ব , যুদ্ধ , সন্ধি , প্রকৃতিবিজ্ঞান , বস্তুবিজ্ঞান ইত্যাদি অসংখ্য বিষয়ে কথা বলা হয়েছে। অতএব , উপরোক্ত মানদণ্ডের বিচারে কোরআন মজীদ হচ্ছে পূর্ণতম ভাব প্রকাশের চরমতম নিদর্শন।

বস্তুতঃ আরবী ভাষা ভাব প্রকাশের বিচারে প্রায় সীমাহীন সম্ভাবনার অধিকারী। অবশ্য আক্ষরিক অর্থে মানুষের ভাষা সীমাহীন সম্ভাবনার অধিকারী হতে পারে না , কিন্তু ব্যবহারিক অর্থে তা সীমাহীনই বটে। কারণ , কোনো মানুষের পক্ষেই আরবী ভাষার সকল সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার করে একই কথা বা রচনায় সূক্ষ্মতম তাৎপর্য প্রকাশ , স্বল্পতম শব্দের ব্যবহার নিশ্চিতকরণ ও উন্নততম সাহিত্যিক সৌন্দর্য - এ তিনটি বৈশিষ্ট্যই বজায় রাখা সম্ভব নয় , বিশেষ করে বিষয়বস্তু যদি নিরেট সাহিত্য বা ইতিহাস না হয় , বরং জ্ঞানমূলক হয়।

সুদক্ষ বাগ্মী বক্তা বা সুসাহিত্যিক লেখক অনেক সময় অনেক পরিশ্রম করে উপযুক্ততম শব্দাবলী ও উন্নততম বাক্যরীতি ব্যবহার করে কথা বা রচনা পেশ করার পর , এ ভাষার এই প্রায় সীমাহীন প্রকাশ সম্ভাবনার কারণে দেখা যায় , পরবর্তীতে অন্যদের পর্যালোচনায় ধরা পড়ে যে , তা আরো উন্নত হতে পারতো। এমতাবস্থায় কোনো মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখাপ্রশাখা নিয়ে কথা বলতে চাইলে - কোরআন মজীদে যেরূপ বলা হয়েছে - তার পক্ষে সংক্ষিপ্ততা , প্রাঞ্জলতা , সহজবোধ্যতা ও সাহিত্যিক আলঙ্কারিকতা বজায় রেখে কোনো গ্রন্থ রচনা করা পুরোপুরি অসম্ভব ব্যাপার। কারণ , মানবিক প্রতিভার পক্ষে এ ধরনের গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে একদিক বজায় রাখতে গেলে আরেক দিক বজায় রাখা সম্ভব হবে না। কিন্তু কোরআন মজীদে এর সব দিকই বজায় রাখা হয়েছে। তাই কোরআন মজীদের চ্যালেঞ্জের সামনে সকল যুগের সকল অমুসলিম পণ্ডিত , ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক সম্মিলিতভাবে মোকাবিলার সুযোগ পেয়েও ব্যর্থতার কলঙ্ক বহন করতে বাধ্য হয়েছেন। সৃষ্টিলোকের ধ্বংস পর্যন্ত এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না।

রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ) ও কোরআনের বিশ্বজনীনতা

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াতের ও কোরআন মজীদের বিশ্বজনীনতা ও সর্বজনীনতা সম্পর্কে সংক্ষেপে এতোটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে , আল্লাহ্ তা আলা পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব্ ও ছ্বহীফাহ্ সমূহ সংরক্ষণের জন্য কোনো নিশ্চিত ব্যবস্থা নেন নি , কিন্তু কোরআন মজীদকে অবিকৃতভাবে সংরক্ষণ করেছেন। এমনকি যারা রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াত স্বীকার করে না তারাও স্বীকার করতে বাধ্য যে , কোরআন মজীদ তিনি যেভাবে পেশ করে গেছেন কোনোরূপ বিকৃতি বা পরিবর্তন ছাড়াই হুবহু সেভাবেই বর্তমান আছে।

এছাড়া আল্লাহ্ তা আলা কোরআন মজীদের সর্বশেষ নাযিলকৃত আয়াতে দ্বীনকে পূর্ণতা দানের কথা বলেছেন এবং বিভিন্ন আয়াতে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে সমগ্র মানবকুলের জন্য নবী , শেষ নবী ও জগতসমূহের বা সকল জগতবাসীর জন্য রহমত বলে উল্লেখ করেছেন। অতএব , নবী করীম (ছ্বাঃ) ও কোরআন মজীদ যে তাঁর যুগ থেকে শুরু করে ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত স্থান-কাল ও পরিবেশ-পরিস্থিতি নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের জন্য নবী ও হেদায়াত তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।

এ প্রসঙ্গে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর শেষ নবী হওয়া ও তাঁর নবুওয়াতের বিশ্বজনীনতা প্রসঙ্গে সংক্ষেপে হলেও কিছুটা আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। কারণ , ইয়াহূদী ও খৃস্টানরা তাঁকে নবী হিসেবে মানে না এবং কাদিয়ানীরা তাঁকে শেষ নবী হিসেবে স্বীকার করে না।

রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াত ও তাঁর নবুওয়াতের বিশ্বজনীনতার প্রমাণ এই যে , বিচারবুদ্ধির রায় অনুযায়ী মানুষের জন্য আল্লাহ্ তা আলার কাছ থেকে পথনির্দেশ পাওয়া অপরিহার্য। এমতাবস্থায় পূর্বে আগত পথনির্দেশ হারিয়ে গেলে বা বিকৃত হয়ে গেলে পুনরায় পথনির্দেশ আসাও অপরিহার্য। স্বয়ং ইয়াহূদী-খৃস্টান পণ্ডিতগণও স্বীকার করেন যে , তাওরাত্ ও ইনজীল্ সহ বাইবেলের পুস্তকগুলোতে পরিবর্তন ও বিকৃতি ঘটেছে। বিশেষ করে বাইবেলের বিভিন্ন পুস্তকে নবী-রাসূলগণের ( আঃ) অনেকের চরিত্রের ওপর এমন কলঙ্ক লেপন করা হয়েছে যা বিশ্বাস করলে তাঁদেরকে নবী-রাসূল ( আঃ) বলে গ্রহণ করা যায় না। শুধু তা-ই নয় , ঐ সব পুস্তক যে সব নবী-রাসূলের ( আঃ) নামে উল্লিখিত হয়েছে সে সব পুস্তক যে তাঁরা রেখে গেছেন তা অকাট্যভাবে ও ঐতিহাসিক ধারাক্রমে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। এ সব পুস্তকের সবগুলোই তাঁদের পরে লিখিত বা পুনর্লিখিত হয়েছে। শুধু তা-ই নয় , সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ যে ঐতিহাসিক চরিত্র ছিলেন এবং নবী ছিলেন তা-ও অকাট্যভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। অবশ্য মুসলমানরা তাঁদেরকে নবী-রাসূলরূপে স্বীকার করে ও শ্রদ্ধা করে , তবে তা ঐতিহাসিকভাবে তাঁদের অস্তিত্ব ও নবুওয়াত প্রমাণিত হবার কারণে নয় , বরং কোরআন মজীদে উল্লিখিত থাকার কারণে।

এহেন পরিস্থিতিতে দীর্ঘ শত শত বছরেও কি আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে মানব জাতির জন্য কোনো নবীর আগমন অপরিহার্য ছিলো না ?

বিগত প্রায় দুই হাজার বছরের মধ্যে [হযরত ঈসা ( আঃ)-এর ঊর্ধলোকে আরোহণের পর/ খৃস্ট মতে , ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর পর] নবুওয়াতের দাবীদারদের মধ্যে একমাত্র হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) ছাড়া বিচারবুদ্ধির আলোকে আর কারো মধ্যেই নবুওয়াতের বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় যদি তাঁকে নবী হিসেবে এবং কোরআন মজীদকে আল্লাহর কিতাব্ হিসেবে স্বীকার করা না হয় তাহলে বলতে হবে আল্লাহ্ তা আলা মানুষের জন্য পথনির্দেশের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে পথনির্দেশ বিহীন ফেলে রেখেছেন। কিন্তু তাঁর মহান সত্তা সম্বন্ধে এরূপ ধারণা করা অন্যায়।

তাছাড়া বিকৃতি সত্ত্বেও তাওরাত্ , ইনজীল্ ও আরো অনেক প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে আরবের বুকে শেষ নবী হিসেবে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী এখনো বিদ্যমান আছে। বিগত প্রায় দুই হাজার বছরের মধ্যে নবুওয়াতের দাবীদার এমন দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে নি যার সম্পর্কে এ সব ভবিষ্যদ্বাণী প্রযোজ্য হতে পারে এবং ইয়াহূদী-খৃস্টান পণ্ডিত ও ধর্মনেতাগণ কাউকে উক্ত ভবিষ্যদ্বাণীসমূহে কথিত পারাক্লিতাস বা মেসিয়াহ্ বলে চিহ্নিত করেন নি। এমতাবস্থায় ঐশী গ্রন্থের দাবীদার একমাত্র অবিকৃত গ্রন্থ কোরআন মজীদ ও তাঁর উপস্থাপক হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াত প্রত্যাখ্যান একান্তই অন্ধত্ব ও অযৌক্তিকতার পরিচায়ক। আর কোরআন মজীদ সমগ্র মানব প্রজাতির জন্য নিজেকে পথনির্দেশ এবং হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে বিশ্বজনীন নবী ও শেষ নবী বলে দাবী করেছে - যা প্রত্যাখ্যানের কোনো যুক্তিই তাদের কাছে নেই।

অন্যদিকে কাদিয়ানীরা রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে স্বীকার করলেও শেষ নবী হিসেবে স্বীকার করে না। তাদের এ দাবী মিথ্যা হওয়া সম্পর্কে সংক্ষেপে বলতে হয় যে , আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ হেদায়াত-গ্রন্থ নাযিল্ হওয়ার এবং তা সংরক্ষিত থাকার পর নতুন নবীর প্রয়োজনীয়তা বিচারবুদ্ধির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

কোরআন মজীদে যে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে খাতামুন্নাবীয়্যীন্ (নবীগণের মোহর) বলে উল্লেখ করা হয়েছে কাদিয়ানীরা এর বিকৃত ব্যাখ্যা করে এই যে , তাঁর মোহর ধারণ করে নতুন নবীর আগমনের ধারা বহাল আছে। তারা তাঁর মোহর ধারণ -এর ব্যাখ্যা করে এই যে , গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে স্বীকার করেছে। অথচ এর মানে দাঁড়ায় এই যে , গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তাঁকে নবী হিসেবে স্বীকার করলো , তিনি গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী হিসেবে স্বীকার করেন নি। কোরআন মজীদে যদি গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী থাকতো কেবল তাহলেই বলা যেতো যে , সে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর মোহরধারী নতুন নবী।

মোদ্দা কথা , ইয়াহূদী , খৃস্টান ও কাদিয়ানীদের পক্ষ থেকে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর শেষ নবী হওয়ার সত্যতা অস্বীকার বিশেষ কোনো স্বার্থে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে সত্যকে প্রত্যাখ্যান বৈ নয়।

বুদ্ধিবৃত্তিক জবাবের পর্যালোচনা

কোরআন মজীদ কেন আরবী ভাষায় নাযিল্ হলো ? এ প্রশ্নের বুদ্ধিবৃত্তিক জবাব দিতে গিয়ে অনেকে বলেছেন : যেহেতু হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) আরবদের মধ্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাঁর মাতৃভাষা ছিলো আরবী সেহেতু আল্লাহ্ তা আলা আরবী ভাষায় কোরআন নাযিল্ করেছেন। তিনি যদি অন্য ভাষাভাষী কোনো জাতির মধ্যে (উদাহরণস্বরূপ , ইংরেজীভাষীদের মধ্যে) আবির্ভূত হতেন তাহলে কোরআন মজীদ সে ভাষাতেই নাযিল্ হতো।

আল্লাহ্ তা আলা কেন হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে আরবদের মধ্যে পাঠালেন ? এ প্রশ্নেরও বুদ্ধিবৃত্তিক জবাব দেয়া হয়। তা হচ্ছে , আরবদের তৎকালীন সমাজ-পরিবেশ শেষ নবীর আবির্ভাবের জন্য সর্বাধিক উপযুক্ত ছিলো।

আসলেই কি তা-ই ? প্রকৃত ব্যাপার কি এরূপ যে , যেহেতু ঐ যুগে আরবদের সমাজ-পরিবেশ সমকালীন বিশ্বে জঘন্যতম ছিলো সেহেতু আল্লাহ্ তা আলা তাদের মধ্যে তাঁর শ্রেষ্ঠতম ও সর্বশেষ রাসূলকে (ছ্বাঃ) পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিলেন ? আর তৎকালীন বাংলাদেশের সমাজ-পরিবেশ যদি এর চেয়েও খারাপ হতো তাহলে কি আল্লাহ্ তা আলা তাঁকে বাংলাদেশে পাঠাতেন ? অথবা যদি বিশ্বের কোথাওই কখনোই ঐ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হতো তাহলে কি আল্লাহ্ তা আলা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে পাঠাতেন না এবং কোরআন মজীদ নাযিল্ করতেন না ? নাকি তাঁকে পাঠাবার উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ তা আলা স্বয়ং তৎকালীন আরবের পরিবেশকে ঐ পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছিলেন ? কিন্তু আল্লাহ্ বান্দাহর কাজে কেবল ইতিবাচক হস্তক্ষেপই করে থাকেন এবং মানুষকে পাপাচারের ও অমানবিকতা তথা জাহেলিয়াতের দিকে ঠেলে দেয়ার মতো জঘন্য কাজের দুর্বলতা থেকে তিনি পরম প্রমুক্ত।

নবীর আবির্ভাব পূর্বনির্ধারিত

তাছাড়া আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে কোনো নবীকে পাঠানোর স্থান নির্বাচনের বিষয়টি যদি এ নীতির ওপরই ভিত্তিশীল হতো যে , যখন যেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশী পাপপঙ্কিল ও যুলুম-অত্যাচারপূর্ণ তিনি সেখানে তাঁর নবী পাঠাবেন তাহলে ইতিপূর্বে একই জায়গায় (যেমন : ফিলিস্তিনে) একই সময় বা পর পর একাধিক নবী পাঠানো এবং বিশ্বের অন্যান্য স্থানে পূর্ববর্তী নবীর পর দীর্ঘদিনের ব্যবধান সত্ত্বেও নবী না পাঠানোর কারণ কী ছিলো ? তাছাড়া পূর্ববর্তী কালে নবী-রাসূলগণ ( আঃ) , আল্লাহর ওয়ালীগণ ও ভবিষ্যদ্বক্তাগণ যে আরবের বুকে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী (ছ্বাঃ)-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তা কীভাবে সম্ভব হয়েছিলো ?

এ সব ভবিষ্যদ্বাণীর মানে তো এটাই যে , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর আরবে ও আরবদের মধ্যে আবির্ভূত হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত ছিলো। আর যখন তা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত ছিলো তখন তথাকথিত পরিস্থিতির দাবী অনুযায়ী তাঁর অন্যত্র আবির্ভূত হওয়ার কথা ধারণা করা আদৌ সম্ভব কি ? এ ক্ষেত্রে কোনোরূপ যদি বলার অবকাশ থাকে কি ? এ ক্ষেত্রে বলা চলে কি তিনি যদি বাংলাভাষীদের মধ্যে আবির্ভূত বা প্রেরিত হতেন তাহলে কোরআন মজীদ বাংলা ভাষায় নাযিল্ হতো ?

[মজার ব্যাপার হলো , যারা বাংলা ভাষার কথা বলেন তাঁরা ভুলে যান যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর আবির্ভাব ও কোরআন মজীদ নাযিল কালে বাংলা ভাষার আদৌ জন্ম হয় নি। কারণ , প্রধানতঃ ঐ সময় থেকে বহিরাগত ফার্সীভাষী ও ফার্সী-জানা ব্যবসায়ী ও ইসলাম-প্রচারকদের আগমন ও এতদ্দেশের জনগণের সাথে ভাববিনিময়ের ফলে সুদীর্ঘ কয়েক শতাব্দী কালের প্রক্রিয়ায় আরবী ও ফার্সী ভাষার এবং স্থানীয় জনগণের নাম ও সাহিত্য বিহীন কথ্য আঞ্চলিক ভাষাসমূহের শব্দাবলীর সংমিশ্রণে বাংলা ভাষা জন্মলাভ করে। এ বিষয়ে মৎপ্রণীত বাংলা ভাষার মাতৃপরিচয় গ্রন্থে (অপ্রকাশিত) বিস্তারিত আলোচনা করেছি।]

অতএব , প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে , এখানে কোনো যদি র অবকাশ নেই। বরং হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) যে আরবদের মধ্যে আবির্ভূত হবেন এবং তাঁর মাতৃভাষা আরবী হবে , আর কোরআন মজীদ আরবী ভাষায় নাযিল্ হবে তা অকাট্যভাবে পূর্বনির্ধারিত ছিলো ; এর ব্যতিক্রম হওয়া সম্ভব ছিলো না।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে , আল্লাহ্ তা আলা মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি (খলীফাহ্) বানিয়েছেন। এ কারণে তিনি তাদেরকে স্বাধীনতা ও এখতিয়ার দিয়েছেন এবং তার মধ্যে ভালো-মন্দ ও উন্নতি-অধোগতির প্রায় সীমাহীন সম্ভাবনা নিহিত রেখেছেন। অন্যথায় সে সীমাহীন জ্ঞান ও ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ্ তা আলার প্রতিনিধিত্ব করার উপযুক্ত বলে গণ্য হতো না। অর্থাৎ মানুষকে কোনো ছকবাঁধা পথে চলতে বাধ্য করা আল্লাহ্ তা আলার ইচ্ছা নয় , বরং তিনি তাকে বহু বিকল্প বিশিষ্ট এক ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

এটা হচ্ছে সাধারণভাবে ও সামগ্রিকভাবে গোটা মানব প্রজাতি সংক্রান্ত অবস্থা। কিন্তু এ সৃষ্টিলোককে , বিশেষ করে মানুষকে সৃষ্টি করার পিছনে নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা আলার এক বিশেষ সৃষ্টিলক্ষ্য রয়েছে। কারণ , সকল প্রকার প্রয়োজন ও দুর্বলতা থেকে প্রমুক্ত মহান আল্লাহ্ তা আলা উদ্দেশ্যহীন কিছু করবেন এটা তাঁর সম্পর্কে কল্পনাও করা যায় না। বরং তাঁর এ সৃষ্টিকর্মের পিছনে অবশ্যই কোনো ইতিবাচক উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। আর তিনি তাঁর এ সৃষ্টিলক্ষ্য বাস্তবায়নের বিষয়টিকে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও খেয়ালখুশীর ওপর ছেড়ে দিতে পারেন না। তাই নিঃসন্দেহে তিনি তাঁর এ সৃষ্টিলক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য যা কিছু অপরিহার্য তা তিনি সৃষ্টিকর্মের সূচনার আগেই তথা সৃষ্টিকর্মের পরিকল্পনার মধ্যেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। এভাবে যা ক্বাযাায়ে ইলাহীতে (খোদায়ী সিদ্ধান্তে/ পূর্বনির্ধারণে) নির্ধারিত রয়েছে তথা সৃষ্টিপরিকল্পনায় যা অনিবার্যরূপে নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে কোনো অবস্থাতেই তার অন্যথা হতে পারে না।

অর্থাৎ বিষয়টি এমন নয় যে , আল্লাহ্ তা আলা পরিস্থিতির দাবী অনুযায়ী নবী পাঠাবেন বলে তাঁর সৃষ্টিপরিকল্পনায় নির্ধারণ করে রাখেন। বরং প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে , কোথায় কখন কোন্ নবীকে পাঠাবেন এবং তাঁদের পূর্বাপর ধারাক্রম ইত্যাদি কী হবে তা তিনি পূর্বেই নির্ধারিত করে রেখেছিলেন। তাই তাঁদের অনেকের সম্পর্কে , বিশেষ করে রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর আবির্ভাব সম্পর্কে পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ ( আঃ) সুনির্দিষ্টভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করে যান। অতএব , নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর আরবী ভাষাভাষী হওয়া এবং কোরআন মজীদের আরবী ভাষায় নাযিল্ হওয়া যে পূর্বনির্ধারিত ছিলো তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। সেই সাথে এ-ও সন্দেহাতীত বিষয় যে , কোরআন নাযিলের জন্য উপযোগী ভাষার বিকাশ সাধন তথা আরবী ভাষার উৎপত্তি ও চূড়ান্ত বিকাশও আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

আরবী ভাষার বিকাশে খোদায়ী হস্তক্ষেপ

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , আল্লাহ্ তা আলা কোরআন মজীদের জন্য আরবী ভাষাকে বেছে নিলেন কেন ? অন্য কোনো ভাষাকে কেন বেছে নিলেন না ?

এ প্রশ্নের জবাবে প্রথমে পাল্টা প্রশ্ন করতে হয় , আসলে কোরআন মজীদের মতো মহাগ্রন্থ - যাতে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে মানুষকে দেয়ার উপযোগী সকল জ্ঞানের সমাহার ঘটানো হয়েছে তা আরবী ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় নাযিল্ হওয়া আদৌ সম্ভব কি ?

বলা হতে পারে , আল্লাহ্ তা আলার পক্ষে অসম্ভব কিছুই নেই। নিঃসন্দেহে। তবে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভাষার বিকাশপ্রক্রিয়াকে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করতে হতো যার ফলে তা আরবী ভাষায় পরিণত হতো। কারণ , কোরআন মজীদের ন্যায় সংক্ষিপ্ত আয়তনের গ্রন্থে সীমাহীন জ্ঞানের সমাহার ঘটাবার ও তাকে ক্বিয়ামত্ পর্যন্তকার স্থান-কাল নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য মু জিযায় পরিণত করার জন্যে এহেন প্রায় সীমাহীন সম্ভাবনার অধিকারী ভাষার উদ্ভব ঘটানো ছিলো অপরিহার্য।

যেহেতু আল্লাহ্ তা আলার এ গ্রন্থ নাযিলের জন্য এহেন সম্ভাবনাময় একটি ভাষার উদ্ভব অপরিহার্য ছিলো সেহেতু তিনি একটি ভাষার সূচনা ও বিকাশকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছেন যাতে সে ভাষায় কোরআন মজীদ নাযিল্ করা সম্ভবপর হয়। যেহেতু সৃষ্টিলক্ষ্য বাস্তবায়ন বা সৃষ্টির জন্যে প্রয়োজন ব্যতিরেকে আল্লাহ্ তা আলা মানুষের স্বাধীন কর্মক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করেন না এবং তাঁর সৃষ্টিপরিকল্পনার বাস্তবায়নের জন্য এ ধরনের একটি ভাষার বিকাশ ঘটানো অপরিহার্য ছিলো সেহেতু তিনি একটিমাত্র ভাষার বিকাশকে এ লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রিত করেন। একাধিক ভাষাকে এ পর্যায়ে বিকশিত করানো অপরিহার্য ছিলো না বিধায় তিনি তা করেন নি। তাই অন্যান্য ভাষার সম্ভাবনার বিকাশ মানবিক প্রতিভা-প্রচেষ্টার ফলে যতোখানি সম্ভবপর ততোখানি সম্ভব হয়েছে বা হচ্ছে অথবা হবে। তাছাড়া মানুষের সকল ভাষাকে অভিন্ন মাত্রায় বিকশিত করলে শেষ পর্যন্ত তা একটিমাত্র ভাষায় পরিণত হতো এবং সে ক্ষেত্রে ভাষাবৈচিত্র্যের মধ্যে যে মহান লক্ষ্য নিহিত রয়েছে তা হাছ্বিল্ হতো না।

বিস্ময়কর সম্ভাবনাময় ভাষা আরবী

বস্তুতঃ মানুষের ভাষাসমূহের মধ্যে আরবী ভাষার প্রকাশক্ষমতার সম্ভাবনা বিস্ময়কর , বরং পারিভাষিক অর্থে (যদিও আক্ষরিক অর্থে নয়) সীমাহীন বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রকাশক্ষমতার সম্ভাবনার তুলনামূলক বিচারে অন্যান্য ভাষার মধ্যে সর্বোচ্চ প্রকাশক্ষমতার অধিকারী ভাষাকেও আরবীর সাথে তুলনা করলে এক বনাম একশ র অনুপাতও খুবই কম বলে মনে হবে। হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই আরবরা আরবী ভাষার এ প্রকাশসম্ভাবনা ও তার মোকাবিলায় অন্যান্য ভাষার দৈন্য সম্পর্কে অবগত ছিলো। এ কারণে তারা অন্যান্য ভাষাভাষী লোকদেরকে বলতোالاعجم (আল্-আ জাম্)- বোবা বা অস্পষ্টভাষী।

শুধু তা-ই নয় , মূলতঃ আরবী ভাষা (اللغة العربية ) বলতে তারা আরব উপদ্বীপের জনগণের ভাষা বুঝাতো না , বরং উচ্চাঙ্গের ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাব প্রকাশক গতিশীল প্রাঞ্জল ভাষা বুঝাতো। আর এর বিপরীতে নিম্ন মানের ভাষার অধিকারী , অস্পষ্টভাষী বা দুর্বোধ্যভাষী বুঝাতে জাম্ বলতো।

এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে , আমরা যাকে আরবী ( ভাষা ) বলি তা এ ভাষার গুণ বা পরিচিতি বাচক নাম , প্রকৃত নাম ( Proper Name)নয়। বরং অনারব লোকেরাই এ নামটিকে প্রকৃত নাম ( Proper Name)- এ পরিণত করেছে। কারণ , আরবী ভাষায় আল্ - আরাবী (العربی )বিশেষ্য নয় , বিশেষণ। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলো যা থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে :

[আরবী ভাষায় বাক্যের বাইরে কেবল একটি শব্দ হিসেবে বিশেষ্য-বিশেষণের শেষ বর্ণে কোনো স্বরচিহ্ন থাকে না , যদি না তা উহ্য ক্রিয়াপদ বিশিষ্ট বাক্য বলে পরিগণিত হয়। কেবল বাক্যমধ্যে শব্দটির ভূমিকার ভিত্তিতেই স্বরচিহ্ন নির্ধারিত হয়। এছাড়া আরবী ভাষায় বাক্যশেষের স্বরচিহ্ন উচ্চারিত হয় না। কিন্তু বাংলাভাষীদের অনেকেই বাক্যবহির্ভূত আরবী বিশেষ্য-বিশেষণের এবং বাক্যশেষের স্বরচিহ্ন উচ্চারণ করে থাকে। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে শেষের স্বরচিহ্ন ছাড়া বাংলা ভাষায় আরবী শব্দের মৌখিক উচ্চারণে শব্দটির প্রকৃত লিখিত রূপ বুঝতে সমস্যা হতে পারে। তাই নীচের উদাহরণগুলোতে কেবল এ ধরনের কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত উচ্চারণ নির্দেশের ক্ষেত্রে আরবী নিয়ম অনুসরণে বাক্যবহির্ভূত বিশেষ্য-বিশেষণের এবং বাক্যশেষের স্বরচিহ্ন উচ্চারণ নির্দেশ করা হয় নি।]

العَرَب (আল্- আরাব্)- আরব , আরব উপদ্বীপের বাশিন্দা।

العَرَبِیّ (আল্- আরাবী)- খাঁটি আরব (পুং)।

العَرَبِيّة (আল্- আরাবীয়্যাহ্)- খাঁটি আরব (স্ত্রী)।

اللُّغَةُ العَرَبِيَّة (আল্-লুগ্বাতুল্ আরাবীয়্যাহ্) - খাঁটি আরব (অর্থাৎ খাঁটি আরবদের) ভাষা।

তারা কেন নিজেদেরকে আরব বলে ?

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , খাঁটি আরবদের ভাষা কেন বলা হলো ? এটা জানতে হলে আরবরা নিজেদেরকে কেন আল্- আরাব্ বা আল্- আরাবী বলে তা জানতে হবে এবং তা জানতে হলে অভিনعرب শব্দমূল থেকে নিষ্পন্ন শব্দাবলীর ব্যবহারিক তাৎপর্যের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

এখানে অভিধান থেকে এ শব্দমূল (عرب ) হতে নিষ্পন্ন শব্দাবলীর মধ্য থেকে কয়েকটির ব্যবহারিক উদাহরণ দেয়া যাক :

عَرَبَ ( আরাবা)- সে প্রাঞ্জল ভাষায় (অর্থাৎ আরবী ভাষায়) কথা বললো ; সে খাঁটি ও প্রাঞ্জল ভাষী (অর্থাৎ আরবী ভাষী) ছিলো।

عَرِبَ الرَّجُلُ ( আরিবার্ রাজুল্) - লোকটির যবান খুলে গেলো (সে কথা বলতে পারছিলো না ; এখন কথা বলতে পারছে) ; লোকটির তোৎলামি দূর হয়ে গেলো ; লোকটির বোবা অবস্থা দূর হয়ে গেলো।

عَرَّبَ المَنطِقَ ( আররাবাল্ মানত্বিক্ব) - সে তার কথাকে প্রাঞ্জল করলো।

عَرَّبَ عَنهُ لِسَانُهُ ( আররাবা আনহু লিসানুহ্) - ঐ ব্যাপারে তার ভাষা সুস্পষ্ট ও প্রাঞ্জল হলো (সে প্রাঞ্জলভাষী না হলেও ঐ বিষয়ে প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলতে সক্ষম হলো)।

عَرَّبَ عَن صَاحِبِهِ ( আররাবা আন্ ছ্বাহিবিহ্) - সে তার বন্ধুর পক্ষ সমর্থন করে কথা বললো ; সে তার বন্ধুর পরিবর্তে তার পক্ষ থেকে কথা বললো ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করলো।

عَرَّبَ بِحُجَّتِهِ ( আররাবা বিহুজ্জাতিহ্) - সে তার যুক্তিপ্রমাণকে খুব ভালোভাবে বর্ণনা করলো।

عَرَّبَ الاِسمَ الاَعجَمِيَّ ( আররাবাল্ ইসমাল্ আ জামিয়্যা) - সে অনারব নামটিকে মু আরাব্ করলো (অর্থাৎ উচ্চারণ সংক্রান্ত ভুলভ্রান্তি দূরীকরণের লক্ষ্যে প্রতিটি বর্ণে প্রয়োজনীয় যের-যবর-পেশ বসালো - যা আরবরা একান্ত ব্যতিক্রম ছাড়া আরবী লেখায় বা আরবী শব্দের ক্ষেত্রে করে না)।

أَعرَبَ الشَّیءَ (আ রাবাশ্ শাইআ) - সে বিষয়টি বর্ণনা করলো ; সে বিষয়টিকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরলো।

أَعرَبَ کَلامَهُ (আ রাবা কালামাহ্) - সে তার বক্তব্যকে খুব ভালোভাবে ও প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করলো।

أَعرَبَ الرَّجُلُ (আ রাবার রাজুল্) - লোকটি প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বললো।

العَرَبُ مِنَ الماءِ (আল্- আরাবু মিনাল্ মাই) অথবাالعَرِبَ مِنَ الماءِ (আল্- আরিবা মিনাল্ মাই) - অনেক বেশী পরিমাণে ও সুপেয় পানি।

رَجُلٌ عَرِبٌ (রাজুলুন্ আরিব্)- (যে কোনো) প্রাঞ্জলভাষী লোক।

بِئرٌ عَرِبَةٌ (বি রুন্ আরিবাহ্)- পানিতে পরিপূর্ণ কূপ।

العَربَانُ (আল্- আরবান্)- বাক্যবাগীশ ও প্রাঞ্জলভাষী ব্যক্তি।

উপরোক্ত উদাহরণসমূহের কোনোটি থেকেইعرب শব্দমূল থেকে নিষ্পন্ন শব্দে আরব উপদ্বীপের অধিবাসী অর্থ গ্রহণ করার সুযোগ নেই। এ ধরনের আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

এ থেকে সুস্পষ্ট যে , অনারবরা আরবী ভাষা বলতে যা মনে করে খোদ আরবী ভাষায় এ শব্দটি সে তাৎপর্য বহন করে না। বরং তারা আরবী ভাষা বলতে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাব প্রকাশের ক্ষমতা সম্পন্ন উচ্চাঙ্গের প্রাঞ্জল ভাষা বুঝাতো - যা ছিলো তাদের নিজেদেরই ভাষা। দুর্বল ও নিম্ন মানের ভাষা সমূহের মোকাবিলায় তারা তাদের ভাষার জন্য এ বিশেষণ ব্যবহার করতো।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে , আরবী ভাষা হচ্ছে সেমিটিক ভাষাগোষ্ঠীরই অন্যতম ভাষা। আরবী , কেন্ আানী , হিবরূ , ফিনীক্বী , আরামী ও ইথিওপীয় ভাষা এ সেমিটিক ভাষাগোষ্ঠীরই বিভিন্ন শাখা। প্রথমে এ সব ভাষার মধ্যে ব্যবধান ছিলো খুব কম। এ সব ভাষার অবস্থা ছিলো অনেকটা একই ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা ও উপভাষার সাথে তুলনীয়। কিন্তু এগুলোর মধ্য থেকে একটি আঞ্চলিক ভাষা অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চরমোৎকর্ষের দিকে এগিয়ে যায় যা শুধু উন্নততম সাহিত্যই সৃষ্টি করে নি , বরং তার কথোপকথনের ভাষাও তার সাহিত্যের ভাষার সমমানসম্পন্ন হয়ে দাঁড়ায়। এটি হচ্ছে তৎকালীন পূর্ব আরবের ভাষা। ফলে সেমিটিক ভাষাগোষ্ঠীর পিছিয়েপড়া শাখাগুলোর মোকাবিলায় এ শাখাটির জন্য اللغة العربية ( প্রাঞ্জল ভাষা ) বিশেষণটি ব্যবহৃত হতে থাকে এবং কালে এ গুণবাচক নামটি , মূলতঃ অনারবদের দ্বারা , প্রকৃত নামে ( Proper Noun)পরিণত হয়ে যায়।

এই একই অর্থের সমর্থন পাওয়া যায় এর বিপরীত তাৎপর্য বাচক আল্-আ জাম (الاَعجَم ) শব্দের ব্যবহারিক তাৎপর্য থেকেও। জাম মানে হচ্ছে বোবা বা তোৎলা বা দুর্বোধ্যভাষী বা অস্পষ্টভাষী । তাই যখন কোনো আরবীভাষী লোকও অস্পষ্ট বা দুর্বোধ্য ভাষায় বই বা চিঠি লেখে - যাতে যা বুঝাতে চায় তা ঠিক মতো বুঝাতে ও সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করতে পারে না তখন বলা হয় :

اَعجَمَ الکِتابَ (আ জামাল্ কিতাব্) অথবাعَجَّمَ الکِتابَ ( আজ্জামাল্ কিতাব্) - সে তার বই বা পত্রকে দুর্বোধ্য করে ফেলেছে।

তেমনিالاَعجَم (আল্-আ জাম্) বলতে যেমন অ-আরবীভাষী বুঝায় , তেমনি মাতৃভাষা আরবী হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি উচ্চাঙ্গ প্রাঞ্জলভাষিতার অধিকারী নয় তাকেও বুঝানো হয়। একই অর্থে শব্দটির স্ত্রীবাচকالعَجماء (আল্- আজমা ) ব্যবহৃত হয়। তেমনি চতুষ্পদ ও প্রাণী অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয় , বাংলা ভাষায় যেভাবে বোবা প্রাণী শব্দটি ব্যবহৃত হয় ঠিক সে অর্থে। এর কারণ হচ্ছে এই যে , এ সব প্রাণীর নিজস্ব ভাবপ্রকাশক ভাষা থাকা সত্ত্বেও তারা মানুষের মতো সুস্পষ্টভাবে ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তাৎপর্য সহকারে সুন্দর ভাষায় ভাব প্রকাশ করতে পারে না। তেমনি তোৎলা বুঝাতেও উপরোক্ত শব্দ দু টি (যথাক্রমে পুরুষ ও নারীর জন্য) ব্যবহৃত হয় , তা হোক না কেন তারা আরব পরিবারের সন্তান।

তেমনি লোকেরা তাদের কথায় স্বীয় উদ্দেশ্য চেপে গেলে বা গোপন করলে বলা হয়تَعاجَمَ القَومُ (তা আাজামাল্ ক্বাওম্) - লোকগুলো বোবা হওয়ার ভান করলো অর্থাৎ আসল কথা গোপন করলো।

অনুরূপভাবেتَعاجَمَ الرَّجُلُ (তা আাজামার্ রাজুল) - লোকটি তোৎলা হবার ভান করলো।

اِنعَجَمَ عَلَيهِ القَولُ (ইন্ আজামা আলাইহিল্ ক্বাওল্) - তার নিকট কথাটি দুর্বোধ্য প্রতিভাত হলো ; কথাটি তার বোধগম্য হলো না।

اِستَعجَمَ (ইস্তা জামা ) - সে কথা বলতে পারলো না ; তার কথা আটকে গেলো।

এ ব্যাপারে আরো অনেক উদাহরণ দেয়া চলে।

শুধু সেমেটিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্যান্য ভাষা নয় , বরং যেহেতু অনারব ভাষাসমূহের মধ্য থেকে কোনো ভাষাই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাব প্রকাশ ও উচ্চাঙ্গ প্রাঞ্জলভাষিতার বিচারে আরবী ভাষার ধারেকাছেও পৌঁছতে সক্ষম নয় , সেহেতু আরবরা অনারবদেরকে ও তাদের ভাষা সমূহকে ঢালাওভাবে জামী বলে অভিহিত করতো।

এ থেকে সুস্পষ্ট যে , কোরআন মজীদ যে আরবী ভাষায় নাযিল্ হয়েছে কোরআনে বার বার সে কথা উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এটাই বুঝানো যে , এ কিতাব্ অত্যন্ত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাব প্রকাশক উচ্চাঙ্গ প্রাঞ্জল ভাষায় নাযিল্ হয়েছে - যা হযরত মুহাম্মাদ ( ছ্বাঃ )- এর মতো একজন লেখাপড়া নাজানা মানুষের পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয় , বরং এর রচনাশৈলী এতোই উচ্চাঙ্গের যে , সেদিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় যে , তা কোনো মানুষের পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয়। কারণ , এ প্রাঞ্জল ভাষায় ( আরবী ভাষায় ) প্রকাশসম্ভাবনা এমনই প্রায় সীমাহীন যে , একজন মানুষ যতো বড় প্রতিভার অধিকারীই হোক না কেন এবং যতো উঁচু মাত্রার প্রাঞ্জলভাষীই হোক না কেন , তার প্রতিটি বক্তব্যের প্রতিটি দিকেই প্রকাশসম্ভাবনার উচ্চতম বহিঃপ্রকাশ ঘটবে এবং অন্য কারো পক্ষে তা সংশোধন ( editing)করে অধিকতর উন্নত করা বিন্দুমাত্রও সম্ভব হবে না - নিজের লেখা বা কথা সম্বন্ধে এ নিশ্চয়তা দেয়া কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। এটা কেবল সকল ভাষার মূল উৎস স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার পক্ষেই সম্ভব। এ কারণেই কোরআন মজীদ এ ব্যাপারেই চ্যালেঞ্জ দিয়েছে এবং কোরআন - বিরোধী সকলেই এ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় পরাস্ত হয়েছে।


8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38