কোরআনকে জাদু বলার কারণ
এ প্রসঙ্গে মক্কাহর মোশরেকদের পক্ষ থেকে কোরআন মজীদকে জাদু হিসেবে আখ্যায়িত করার বিষয়টি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
বলা বাহুল্য যে , জাদুবিদ্যার বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার আছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সম্মোহনী মানসিক শক্তির দ্বারা অন্যকে নিয়ন্ত্রিত ও নিজের ইচ্ছাধীন করে কোনো কাজ করতে বাধ্য করা। এর আরেকটি কাজ হচ্ছে যা বাস্তবে নেই বা ঘটছে না তাকে আছে বা ঘটছে বলে দেখানো। অবশ্য জাদুর এ দ্বিতীয়োক্ত প্রভাব হয় খুবই স্বল্পস্থায়ী। খুব তাড়াতাড়ি জাদুর ঘোর কেটে যায় এবং সাথে সাথে প্রকৃত অবস্থা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ কারণে স্বয়ং জাদুকররাও স্বীকার করে থাকে যে , তারা যা দেখাচ্ছে তা হচ্ছে জাদু ; প্রকৃত নয়।
কিন্তু জাদুবিদ্যার দ্বারা যে কোনো কাল্পনিক মায়াদৃশ্যই দেখানো সম্ভব হোক না কেন , এর সাহায্যে কোরআন মজীদের মতো গ্রন্থ রচনা সম্ভব হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। জাদুবিদ্যার সাহায্যে বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের মানদণ্ডে উচ্চতম স্তরের এবং সেই সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তত্ত্ব-দর্শনে পরিপূর্ণ এমন একখানি অনন্যসুন্দর সুখপাঠ্য ও শ্রুতিমধুর গ্রন্থ রচনা তো দূরের কথা , মানব প্রজাতির পুরো ইতিহাসে কোনো দিন কোথাও একটি সাধারণ সুখপাঠ্য গ্রন্থও রচিত হবার কথা কারো জানা নেই। স্বয়ং জাদুকররাও এমন দাবী কোনোদিন পেশ করে নি। বস্তুতঃ এটা আদৌ জাদুবিদ্যার আওতাভুক্ত কোনো বিষয় নয়। কারণ , মানুষের দ্বারা যে কোনো বিষয়ে উঁচু মানের গ্রন্থ রচনার বিষয়টি প্রতিভা ও চর্চার ওপর নির্ভরশীল ; জাদুবিদ্যাবলে কারো মধ্যে প্রতিভাসৃষ্টি বা চর্চার অভাব পূরণ আদৌ সম্ভব নয়।
এ কারণে স্বভাবতঃই এ প্রশ্ন জাগে যে , আরবদের মোশরেকদের পক্ষ থেকে , বিশেষ করে ওয়ালীদ বিন্ মুগ্বীরাহর ন্যায় শ্রেষ্ঠ বালীগ্ব্ ও ফাছ্বীহ্ ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোরআন মজীদকে জাদু হিসেবে অভিহিত করার উদ্দেশ্য কী এবং এহেন ভিত্তিহীন দাবী অন্ততঃ কিছু লোকের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে - তাদের পক্ষ থেকে এমনটা আশা করার পিছনে কী বাস্তবতা নিহিত ছিলো ?
যেহেতু বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের বিচারে কোরআন মজীদ চরমতম উন্নত অবস্থানের অধিকারী সেহেতু তৎকালীন আরবের বালীগ্ব্ ও ফাছ্বীহ্ ব্যক্তিদের পক্ষে তার মোকাবিলা করা এবং তার সাথে তুলনীয় গ্রন্থ রচনা তো দূরের কথা , তার সূরাহর সাথে তুলনীয় একটি ছোট্ট সূরাহ্ও রচনা করা সম্ভব হয় নি। এমতাবস্থায় তারা যে কোরআন মজীদকে মানুষের রচিত অর্থাৎ হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর নিজের রচিত বলে দাবী করেছিলো তা লোকদেরকে বিশ্বাস করানো সম্ভব ছিলো না। যেহেতু রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) লিখতে-পড়তে জানতেন না সেহেতু তিনি এ গ্রন্থ রচনা করেছেন এ কথা বলে তারা আদৌ সুবিধা করতে পারে নি।
এমতাবস্থায় তারা একেক সময় এর একেক ধরনের ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করতো। বিশেষ করে তারা অনেক সময় এ ব্যাপারে এমন ধরনের হাস্যষ্কর উক্তি করতো যা কোনো লোকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হবার কারণ ছিলো না। নিরক্ষর নবী করীম (ছ্বাঃ) কীভাবে এহেন কোরআন পেশ করতে সক্ষম হচ্ছেন ? - এর একটি যৌক্তিক (!) ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে গিয়ে কোনো কোনো সময় তারা দাবী করতো যে , কেউ একজন রাতের বেলা মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে কোরআন শিক্ষা দিয়ে যায় আর তা-ই তিনি দিনের বেলা পড়ে শোনান। অথচ কোরআন মজীদের মতো গ্রন্থ কোনো ব্যক্তির পক্ষে রচনা করা সম্ভব হলে তার পক্ষ থেকে তা নবী করীম (ছ্বাঃ)কে শিক্ষা দেয়ার কোনো কারণ ছিলো না। কারণ , এহেন অত্যুন্নত গ্রন্থ পেশ করে সে নিজেই আরব জাহানের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী , বালীগ্ব্ ও ফাছ্বীহর মর্যাদা দখল করতে পারতো।
কোরআন মজীদকে মোকাবিলা করতে তাদের ব্যর্থতার এবং এ ধরনের অযৌক্তিক ও হাস্যকর দাবীর অসারতার পরিপ্রেক্ষিতে কোরআন মজীদকে খোদায়ী কালাম্ হিসেবে স্বীকার করার বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া , নিজেদের পরাজয় ও ব্যর্থতা চাপা দেয়া এবং লোকদেরকে কোরআনের প্রতি ঈমান আনয়ন থেকে ফিরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে তাদের জন্য কোরআন মজীদকে বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাত্ তথা ভাষা-সাহিত্যের মানদণ্ডে বিচার্য বিষয়াদির আওতাবহির্ভূত একটি বিষয় হিসেবে দেখানো অপরিহার্য ছিলো। এ কারণেই তারা কোরআন মজীদকে জাদু হিসেবে আখ্যায়িত করে।
অর্থাৎ তারা আরব জনগণকে বুঝাতে চাচ্ছিলো :‘
কোরআন হচ্ছে জাদু , আর আমরা জাদুকর নই বিধায় তার মোকাবিলা করতে পারছি না।’
অবশ্য যে কোনো সুস্থ বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন লোকের পক্ষেই এ অপযুক্তির অসারতা ও এ প্রতারণা বুঝতে পারা কঠিন ছিলো না। কিন্তু যেহেতু তৎকালীন আরবে জাদুবিদ্যার তেমন প্রচলন ছিলো না , সেহেতু জাদুবিদ্যার ক্ষমতা ও আওতা সম্বন্ধে তাদের তেমন ধারণা ছিলো না। এ কারণে অন্ততঃ কিছু লোক ধরে নিয়েছিলো যে , ওয়ালীদ বিন্ মুগ্বীরাহ্ প্রমুখের কথাই ঠিক ; কোরআন একটি জাদু এবং হয়তোবা জাদুবিদ্যার মাধ্যমে সুন্দর ও উঁচু মানের গ্রন্থ রচনা করা সম্ভবপর।
অবশ্য এ ব্যাপারে মক্কাহর মোশরেক্ নেতাদের পক্ষ থেকে আরো একটি কপট যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছিলো।‘
আল্লামাহ্‘
আব্দুল্ ক্বাহের্ জুরজানী তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ আশ্-শাাফীয়্যাতু ফীল্ ই‘
জায্-এ উল্লেখ করেছেন যে , ওয়ালীদ্ বিন্ মুগ্বীরাহ্ কোরআন মজীদকে জাদু নামে অভিহিত করার পর বলেছিলো :“
কারণ সে [মুহাম্মাদ সাঃ)] বেবিলনের জাদুকরদের ন্যায়ই স্বামী-স্ত্রী , ভাই-ভাই ও পিতা-পুত্রের মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করতে সক্ষম।”
‘
আল্লামাহ্ জুরজানী আরো উল্লেখ করেছেন যে , তৎকালীন মক্কাহর কাফেরদের মধ্যকার অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তি‘
উতবাহ্ বিন্ রাবী‘
আহ্ হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে বলেছিলো :“
তুমি আমাদের ক্বুরাইশদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করেছো।”
এখানে উল্লেখ্য যে , কেনো মানুষের কাছে যখন সুস্পষ্টরূপে ধরা পড়ে যে , কোরআন মজীদ আল্লাহ্ তা‘
আলার নাযিলকৃত গ্রন্থ এবং হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) তাঁর প্রেরিত রাসূল , তখন তার পক্ষে তাঁর ওপরে ঈমান আনা ও তাঁর দলভুক্ত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এমতাবস্থায় কেবল সেই ব্যক্তির পক্ষেই নবী করীম (ছ্বাঃ) ও কোরআন মজীদের কাছে আশ্রয় গ্রহণ না করা সম্ভব যে ব্যক্তি স্বীয় প্রবৃত্তির পূজারী এবং সত্যকে গ্রহণ করা ও না-করার বিষয়ে পার্থিব স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।
এভাবে অনেক সময় একই পরিবারের দুই ব্যক্তি আদর্শিক কারণে দুই বিপরীত মেরুতে চলে যাওয়ার ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে এবং তারা দুই শত্রুশিবিরের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। এটা ছিলো খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। দুনিয়ায় আদর্শিক ইতিহাসে সব সময়ই কমবেশী এমনটি ঘটেছে এবং এখনো ঘটছে। এর সাথে পরস্পরকে ভালোবাসে এমন দুই ব্যক্তির মধ্যে জাদুবিদ্যার সাহায্যে বিচ্ছেদ ঘটানোর কোনো তুলনা চলে কি ? বরং কোরআনকে জাদু আখ্যাদানকারী ব্যক্তিরা কেবল সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যই কোরআনের বিরুদ্ধে এহেন মিথ্যা দোষারোপ করেছিলো যা তারা নিজেরাই বিশ্বাস করতো না। বস্তুতঃ এ ধরনের অভিযোগ তুলে কার্যতঃ তারা প্রকারান্তরে তাদের পরাজয় ও ব্যর্থতাকে এবং কোরআন মজীদের খোদায়ী কিতাব্ হওয়াকেই স্বীকার করে নিয়েছিলো।