কোরআনের অলৌকিকতা
(ই‘
জাযুল্ কোরআন)
ই‘
জায্-এর তাৎপর্য
আরবী অভিধানেاعجاز
(ই‘
জাায্) পরিভাষাটি বেশ কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ।
(1) কোনো কিছু হাতছাড়া হওয়া। যেমন , বলা হয় :اعجزه الامرُ الفلانی
-“
অমুক বিষয়টি তার হাতছাড়া হয়ে গেছে।”
(2) অন্যের মাঝে অক্ষমতা লক্ষ্য করা। যেমন , বলা হয় :اعجزت زيداً
-“
আমি যায়েদকে অক্ষম দেখতে পেলাম।”
(3) অপর পক্ষকে অক্ষম করে দেয়া। এ ক্ষেত্রেاعجاز
কথাটিتعجيز
(তা‘
জীয্) অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন :اعجزت زيداً
-“
আমি যায়েদকে অক্ষম করে দিলাম।”
কিন্তু কালামশাস্ত্রবিদদের পরিভাষায় ই‘
জায্-এর মানে হচ্ছে : যিনি আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে কোনো পদে মনোনীত হয়েছেন বলে দাবী করেন , তিনি তাঁর এ দাবীর সত্যতা প্রমাণের লক্ষ্যে প্রাকৃতিক আইনের ব্যতিক্রমে এমন কোনো কাজ সম্পাদন করেন যা সম্পাদনে অন্যরা অক্ষম (عاجز
-‘
আাজেয্) হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় এ অসাধারণ কাজকেمعجزة
(মু‘
জিযাহ্ - অলৌকিক কাজ) এবং এ কাজ সম্পাদন করাকে“
ই‘
জায্”
(اعجاز
- অলৌকিক কাজ সম্পাদন) বলা হয়।
[উল্লেখ্য ,‘
আক্বাএদের অর্থাৎ ঈমানের তিনটি মূল বিষয় তাওহীদ , আখেরাত ও নবুওয়াত এবং এর শাখাগত অন্যান্য বিষয়াদি সম্পর্কিত বিস্তারিত শাস্ত্রকেعلم کلام
(‘
ইলমে কালাাম্) এবং এ শাস্ত্রের পণ্ডিতকেمتکلم
(মুতাকাল্লিম্ - কালাম্শাস্ত্রবিদ) বলা হয়। আল্লাহ্ তা‘
আলার কালাম্ তাঁর সত্তাগত গুণ , নাকি কর্মগত গুণ - এ প্রশ্নে দীর্ঘ বিতর্ক থেকে এ শাস্ত্রের উদ্ভব বিধায় পুরো শাস্ত্রটির নামইعلم کلام
হয়েছে - এটাই প্রধান মত।]
মু‘
জিযাহর শর্তাবলী
কোনো অসাধারণ কাজকে কেবল তখনই মু‘
জিযাহ্ বলা হয় যখন তাতে নিম্নোক্ত শর্তাবলী বিদ্যমান থাকে :
(1) তিনি আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে কোনো পদে মনোনীত হয়েছেন বলে দাবী করেন এবং তাঁর এ দাবীর সত্যতা প্রমাণের লক্ষ্যে উক্ত অসাধারণ কাজ সম্পাদন করেন।
(2) এ ব্যক্তি নিজের জন্য যে পদ দাবী করছেন তা মানবিক বিচারবুদ্ধির বিচারে মানুষের জন্য সম্ভব বলে গণ্য হতে হবে। সুতরাং কেউ যদি নিজের জন্য এমন কোনো পদ দাবী করে যে দাবী মিথ্যা হবার ব্যাপারে বিচারবুদ্ধি অভ্রান্ত , সুনিশ্চিত ও অকাট্য দৃঢ়তার সাথে রায় প্রদান করে , তাহলে এমতাবস্থায় সে তার দাবী প্রমাণ করার জন্য যে কাজই সম্পাদন করুক না কেন , না সে কাজ তার দাবীর সত্যতার প্রমাণ রূপে গণ্য হবে , না সে কাজকে মু‘
জিযাহ্ বলা যাবে , তা অন্যরা সে কাজ সম্পাদনে যতোই অক্ষম প্রমাণিত হোক না কেন। যেমন : কেউ যদি খোদায়ী দাবী করে , সে ক্ষেত্রে এ দাবীতে তার সত্যবাদী হওয়া পুরোপুরি অসম্ভব ব্যাপার। কারণ , বিচারবুদ্ধির অভ্রান্ত ও অকাট্য রায়ই এ ব্যাপারে তার মিথ্যাবাদিতা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণ করে।
(3) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষ থেকে যে পদ দাবী করা হচ্ছে তা শর‘
ঈ (ধর্মীয়) দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো পদের দাবী করে যে ক্ষেত্রে সন্দেহাতীত ও অকাট্য ধর্মীয় দলীলের ভিত্তিতে তার মিথ্যাবাদিতা প্রমাণিত হয় , সে ক্ষেত্রেও তার দ্বারা অসাধারণ কাজ সম্পাদন তার দাবীর সত্যতা প্রতিপন্ন করবে না এবং তার ঐ কাজকে মু‘
জিযাহ্ বলা যাবে না। যেমন : কেউ যদি রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর পরে নবুওয়াতের দাবী করে , তাহলে সে তার এ দাবীতে নিঃসন্দেহে মিথ্যাবাদী। কারণ , কোরআন মজীদের ঘোষণা এবং হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) ও আহলে বাইতের নিষ্পাপ ইমামগণের (‘
আঃ) পক্ষ থেকে আমাদের নিকট যে সব ছ্বহীহ্ হাদীছ ও রেওয়াইয়াত্ পৌঁছেছে তদনুযায়ী হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) নবুওয়াতে অভিষিক্ত হবার সাথে সাথেই নবুওয়াতে অভিষিক্ত হবার ধারাবাহিকতার পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং তাঁর পরে আর কেউ নবুওয়াতে অভিষিক্ত হবেন না। [রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর শেষ নবী হওয়ার প্রমাণ অত্র গন্থের‘
কোরআন কেন আরবী ভাষায় নাযিল হলো’
অধ্যায়ের‘
রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ) ও কোরআনের বিশ্বজনীনতা’
উপশিরানামে সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে।]
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে ,بعثت
(বি‘
ছাত্) মানে উত্থান ঘটানো , জাগ্রত করা , অনুপ্রাণিত করা এবং পারিভাষিক অর্থে অভিষেক। বলা বাহুল্য যে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর শেষ নবী হিসেবে আগমনের বিষয়টি আল্লাহ্ তা‘
আলার সৃষ্টিপরিকল্পনাতেই নির্ধারিত ছিলো ; এ ব্যাপারে মসলমানদের বিভিন্ন হাদীছে ও বারনাবাসের ইনজীলে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লিখিত আছে। এ কারণেই নবী হিসেবেই তাঁর জন্ম হয়। কিন্তু তাঁর এ নবুওয়াতের বিষয়টি তাঁর চল্লিশ বছর বয়সে একটি নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে তাঁকে জানানো হয় এবং তাঁকে এ দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। একেইبعثت
বলা হয়। এর দিন-তারিখ নিয়ে বিতর্ক আছে। যদি তাঁকে নবুওয়াতের দায়িত্ব প্রদানের কথা জানানো ও পুরো কোরআন মজীদ তাঁর হৃদয়ে নাযিল করার ঘটনা একই সময় হয়ে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে তা ছিলো লাইলাতুল ক্বাদরে , আর যদি তা ভিন্ন ভিন্ন দিনে হয়ে থাকে তাহলে তাঁরبعثت
হয় এর আগে ; কোনো কোনো মতে 27শে রজব তারিখে (এবং এর দশ বছর পরে এ তারিখেই তিনি মি‘
রাজ গমন করেন)।
অতএব , বিচারবুদ্ধির রায় অথবা অকাট্যভাবে নির্ভরযোগ্য উদ্ধৃতিযোগ্য দলীলের মাধ্যমে নতুন নবুওয়াতের দাবী মিথ্যা প্রমাণিত হবার পর এ মিথ্যা পদের দাবীর সপক্ষে কোনো প্রমাণ বিবেচনাযোগ্য হতে পারে না। আর যেহেতু বিচারবুদ্ধির দলীল বা উদ্ধৃতিযোগ্য দলীলের মাধ্যমেই তার দাবী মিথ্যা হওয়ার দাবীটি সুস্পষ্ট ও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে , সেহেতু তার দাবী যে মিথ্যা - এটা আলাদাভাবে প্রমাণ করা আল্লাহ্ তা‘
আলার জন্য যরূরী নয়।
[কোনো বিষয় প্রমাণের জন্য দুই ধরনের বা এ দুই ধরনের মধ্য থেকে যে কোনো এক ধরনের দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করা যেতে পারে। তা হচ্ছে : (1) বিচারবুদ্ধি (‘
আক্বল্)-এর রায় অর্থাৎ যুক্তি প্রয়োগ।‘
আক্বল্ থেকে নিস্পন্ন প্রমাণ হিসেবে একে‘
বিচারবুদ্ধির দলীল’
(دليل عقلی
) বলা হয়। (2) বিতর্কে লিপ্ত উভয় পক্ষ বা আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের নিকট সমানভাবে বা প্রায় সমানভাবে গ্রহণযোগ্য লিখিত বা মৌখিকভাবে বর্ণিত বক্তব্য। উদ্ধৃত করা সম্ভব বিধায় এ ধরনের দলীলকে‘
উদ্ধৃতিযোগ্য দলীল’
(دلیل نقلی
) বলা হয়। যেমন : মুসলমানদের সকল ফিরক্বাহ্ ও মায্হাবের নিকট কোরআন মজীদ ও মুতাওয়াতির্ হাদীছ (যে হাদীছ বর্ণনার প্রতিটি স্তরে এতো বেশী সংখ্যক বর্ণনাকারী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে , বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে তাদের পক্ষে মিথ্যা রচনার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া বা মতৈক্যে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়)।]
(4) সংঘটিত অসাধারণ কাজটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সত্যতা প্রমাণকারী হতে হবে , তাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণকারী হবে না। অতএব , কেউ যদি আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে কোনো পদে মনোনীত হয়েছে বলে দাবী করে এবং সে দাবী প্রমাণের জন্য কোনো অসাধারণ কাজ সংঘটিত করে - যা সম্পাদনে অন্যরা অক্ষম , কিন্তু তা তার সত্যবাদিতার পরিবর্তে মিথ্যাবাদিতা প্রমাণ করে , তাহলে তাকে মু‘
জিযাহ্ বলা হবে না।
এ ব্যাপারে মুসায়লামাহর ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। বর্ণিত আছে যে , নবুওয়াতের দাবীদার মুসায়লামাহ্ তার দাবীর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে মু‘
জিযাহ্ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে কূপের পানি বৃদ্ধি করবে (পানির স্তর আরো উপরে তুলে আনবে) বলে তার মুখের থুথু একটি কূপে নিক্ষেপ করে। কিন্তু এর ফল হয় বিপরীত ; পানি বৃদ্ধি পাবার পরিবর্তে কূপটি শুকিয়ে যায়। এছাড়া সে হুনাইফাহ্ গোত্রের কতক শিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় এবং আরো কিছু কাজ করে - যার ফলে প্রথমোক্তদের মাথায় টাক পড়ে যায় এবং অপর একদল তোৎলা হয়ে যায়।
এ ধরনের অবস্থায় যেহেতু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাজই তার মিথ্যাবাদিতা ও তার দাবীর ভিত্তিহীনতা প্রমাণ করে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো পন্থায় তার দাবীর অসত্যতা প্রমাণ করা আল্লাহ্ তা‘
আলার জন্য যরূরী নয়।
(5) সংশ্লিষ্ট কাজ কোনো ধরনের বিজ্ঞান , প্রযুক্তি , প্রকৌশল , কারিগরী বিদ্যা ও শিল্পদক্ষতার ওপর ভিত্তিশীল হবে না এবং তা শিক্ষাদান বা শিক্ষা করার উপযোগী হবে না। কেউ যদি কোনো বিজ্ঞান , প্রযুক্তি , প্রকৌশল বা শিল্পদক্ষতার ভিত্তিতে কোনো অসাধারণ কাজ সম্পাদন করে , সে ক্ষেত্রে ঐ কাজকে মু‘
জিযাহ্ বলা যাবে না , তা অন্যরা এ কাজ সম্পাদনে যতোই না অক্ষম হোক। এমনকি এ ক্ষেত্রে মু‘
জিযাহর অন্যান্য শর্ত পাওয়া গেলেও এই শর্তটি পূরণ না হওয়ায় তা মু‘
জিযাহ্ রূপে গণ্য হবে না।
অতএব , জাদুকর , ম্যাজিশিয়ান ও বিজ্ঞানের কোনো কোনো রহস্যের সাথে পরিচিত ব্যক্তিরা যে সব অসাধারণ কাজ সম্পাদন করে তা মু‘
জিযাহর অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং এ সব কাজকে ভণ্ডুল করে দেয়া এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তার মিথ্যা দাবীর অপরাধে অপদস্ত করা আল্লাহ্ তা‘
আলার জন্য যরূরী নয়। কারণ , বিভিন্ন নিদর্শন থেকে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে , কতোগুলো প্রাকৃতিক বিধি অনুযায়ী বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় এ সব কাজ সম্পাদিত হয়েছে - যা অর্জনযোগ্য এবং অন্য কোনো ব্যক্তির পক্ষেও তা শিক্ষা করে নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণে অনুরূপ ফল লাভ করা সম্ভব।
তবে হ্যা , এ জাতীয় কায়দা-কৌশল আয়ত্ত করা ও তার ভিত্তিতে অসাধারণ কাজ প্রদর্শন যে কোনো ব্যক্তির পক্ষেই সহজ নয়। কিন্তু এ কথা প্রায় সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই সত্য। যেমন : কতক বিস্ময়কর ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি আছে যা বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও প্রতিক্রিয়া এবং তার মিশ্রণপদ্ধতি সম্পর্কে সূক্ষ্ম ও গভীর জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল - যার রহস্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা , অনেক চিকিৎসকও অবগত নন এবং ঐ জাতীয় চিকিৎসা সম্পাদনে সক্ষম নন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এহেন বিস্ময়কর চিকিৎসা প্রক্রিয়াকে মু‘
জিযাহ্ বলা যাবে না।
এমনকি আল্লাহ্ তা‘
আলা যদি সমগ্র মানব প্রজাতির মধ্যে মাত্র এক ব্যক্তিকেও এহেন বৈজ্ঞানিক বিধি , বস্তুর বৈশিষ্ট্য ও প্রতিক্রিয়া এবং সৃষ্টিজগতের জটিল রহস্যাবলী সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান দান করেন - যে সম্পর্কে সাধারণ মানুষ চিন্তাও করতে পারে না , তাহলে তা কোনো অযৌক্তিক বা অনুচিত কাজ হয়েছে বলে মনে করা যাবে না । কারণ , কোনো ব্যক্তির দ্বারা সম্পাদিত এহেন কাজ মু‘
জিযাহর অন্তর্ভুক্ত নয় এবং তা আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে কোনো পদে মনোনীত হবার দাবী প্রমাণ করে না।
তবে হ্যা , যদিও সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব , তথাপি যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই যে , আল্লাহ্ তা‘
আলা যদি মিথ্যাবাদীর দ্বারা মু‘
জিযাহ্ সংঘটিত হতে দেন - যাতে উপরোক্ত সবগুলো শর্তই বজায় থাকবে এবং এভাবে যদি তিনি তার মিথ্যা দাবীর সপক্ষে স্বীকৃতি দেন তাহলে অবশ্যই তা হবে অনুচিত ও অযৌক্তিক কাজ। কারণ , সে ক্ষেত্রে মিথ্যাকে সত্যরূপে স্বীকৃতিদানের পরিণতিতে মানুষকে পথভ্রষ্ট করা হবে। আরتعالی الله عن ذالک علواً کبيرا
- এহেন গুরুতর বিষয় থেকে মহান আল্লাহ্ তা‘
আলা মুক্ত ও পবিত্র।
মু‘
জিযাহ্ নবুওয়াতের পৃষ্ঠপোষক
ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , বিচারবুদ্ধিজাত ও উদ্ধৃতিযোগ্য অকাট্য দলীলপ্রমাণের দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে , আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে মানব প্রজাতির জন্য দায়িত্ব-কর্তব্য ও বিভিন্ন কর্মসূচী নির্ধারিত হওয়া উচিত এবং তাদেরকে পূর্ণতা ও চিরন্তন সৌভাগ্যের দিকে পথপ্রদর্শন করা উচিত। কারণ , এ ক্ষেত্রে মানুষ খোদায়ী দায়িত্ব-কর্তব্য ও বিধি-বিধান এবং পথনির্দেশের জন্য পুরোপুরিভাবে মুখাপেক্ষী। এছাড়া পূর্ণতা ও সৌভাগ্যের কোনো স্তরেই সে কৃতকার্য হতে সক্ষম নয়।
মানুষের পূর্ণতা ও সৌভাগ্যের চাবিকাঠি স্বরূপ এ দায়িত্ব-কর্তব্য , বিধিবিধান ও পথনির্দেশ যদি আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে প্রদান করা না হয় , তাহলে মানুষের প্রয়োজন সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘
আলার অজ্ঞতা (না‘
উযূ বিল্লাহ্) ছাড়া এর পিছনে অন্য কোনো কারণই থাকতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘
আলা অজ্ঞতা ও নাওয়াকেফ অবস্থা থেকে পুরোপুরি মুক্ত ও পবিত্র।
অথবা এর কারণ হতে পারে এই যে , আল্লাহ্ তা‘
আলা চান না , মানুষ এহেন পূর্ণতা ও সৌভাগ্যের অধিকারী হোক। আর এ হচ্ছে কৃপণের বৈশিষ্ট্য - যা মহান দয়ালু ও মেহেরবান আল্লাহ্ তা‘
আলার ক্ষেত্রে চিন্তাও করা যায় না।
অথবা এর কারণ হতে পারে এই যে , আল্লাহ্ তা‘
আলা মানুষের জন্য পূর্ণতা ও সৌভাগ্য নিশ্চিত করতে চান , কিন্তু তা নিশ্চিত করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আর এ হচ্ছে অক্ষম ও অসমর্থ-র বৈশিষ্ট্য - যা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা‘
আলার পবিত্র সত্তা সম্পর্কে চিন্তাও করা যায় না।
অতএব , এটা অনস্বীকার্য যে , মানুষের পূর্ণতা ও সৌভাগ্য নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে আইন-বিধান ও দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণ এবং তা মানুষকে জানানো অপরিহার্য।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ উপসংহারে উপনীত হতে হয় যে , আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে মানুষের জন্য আইন-বিধান ও দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারিত হওয়া উচিত। আর এটাও অত্যন্ত সুস্পষ্ট বিষয় যে , মানব প্রজাতির মধ্যকার কোনো সদস্যের মাধ্যমেই এ বিধিবিধান মানুষকে অবগত করা উচিত এবং এই ব্যক্তির - যাকে নবী , রাসূল বা খোদায়ী দূত বলা হবে , তাঁর উচিত অন্যান্য মানুষকে তাদের পূর্ণতা ও সৌভাগ্যের জন্য আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত দায়িত্ব-কর্তব্য ও বিধিবিধান তথা হেদায়াতের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়া যাতে মানুষের ওপর আল্লাহ্ তা‘
আলার হুজ্জাত্ পরিপূর্ণ হয়ে যায় ; অতঃপর এ অকাট্য দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে যার ইচ্ছা সে সৌভাগ্য বরণ করে নিক , আর যার ইচ্ছা সে ধ্বংস ও বিপর্যয়কে গ্রহণ করে নিক।
[হুজ্জাত্ (حجة
) মানে দলীল বা প্রমাণ। আর‘
হুজ্জাত্ পূর্ণ করা’
(اتمام حجة
) মানে যুক্তিতর্ক , নিদর্শন বা অকাট্য দলীল উপস্থাপনের মাধ্যমে কোনো সত্যকে এমন অকাট্যভাবে প্রমাণ করা যে , সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে সন্দেহ বা অস্পষ্টতার অবকাশ থাকবে না।]
অর্থাৎ অকাট্য দলীল-প্রমাণের দ্বারা সত্য সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণিত হওয়া এবং সত্যকে সত্যরূপে জানতে পারার পরেও যে ব্যক্তি জেদ , প্রবৃত্তিপূজার মানসিকতা ও পার্থিব স্বার্থের কারণে ধৃষ্টতামূলকভাবে সত্যের বিরোধিতা করে , অনন্ত ধ্বংস ও বিপর্যয় থেকে রেহাই পাবার জন্যে তার হাতে কোনোই যুক্তি থাকবে না। অন্যদিকে এতো বড় মহান , দয়ালু , মেহেরবান ও সর্বশক্তিমান প্রভুর আদেশ-নিষেধ পালন করার পুরষ্কার যে সীমাহীন সৌভাগ্য হবে তাতেও সন্দেহ নেই। লক্ষণীয় ,‘
হুজ্জাত্’
হচ্ছে এমন একটি উপকরণের ন্যায় যা কারো জন্য সৌভাগ্য ও কারো জন্যে দুর্ভাগ্যের কারণ ; এ ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো পরিণতি নেই।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘
আলা এরশাদ করেন :
)
ليهلک من هلک عن بينة و يحيی من حی عن بينة(
“
যাতে তিনি তাকে ধ্বংস করে দেন যে অকাট্য প্রমাণের দ্বারা নিজেকে ধ্বংস করেছে এবং তাকে সঞ্জীবিত করেন যে অকাট্য প্রমাণের দ্বারা নিজেকে সঞ্জীবিত করেছে।”
(সূরাহ্ আল্-আনফাাল্ : 42)
[بينة
(বাইয়্যেনাহ্) ও হুজ্জাত্ উভয়ই সন্দেহ নিরসনকারী অকাট্য দলীল। তবে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে হুজ্জাত্ সাধারণতঃ ব্যক্তিক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। বাইয়্যেনাহ্ মূলতঃ এমন দলীল যার অকাট্যতা সকলের জন্য সন্দেহাতীত এবং খুব সহজেই তার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। আল্লাহর কালাম্ , বিশেষ করে কোরআন মজীদ হচ্ছে বাইয়্যেনাহ্ ; অন্যান্য গ্রন্থ ও ছ্বহীফাহ্ বিকৃত ও পরিবর্তিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাইয়্যেনাহ্ ছিলো। (স্মর্তব্য ,بيان
ক্রিয়াবিশেষ্য থেকে উদ্ভূত বিধায়بينة
বলতে মূলতঃ কোনো কিছুর প্রমাণ সম্বলিত অকাট্য লিখিত বা মৌখিক বক্তব্যকে তথা খোদায়ী কালামকে বুঝায়।)
অন্যদিকে বিচারবুদ্ধির রায় ও মুতাওয়াতির হাদীছ হচ্ছে হুজ্জাত্ পর্যায়ভুক্ত , কারণ , তা পেশ করার সাথে সাথে সকলের কাছে তার অকাট্যতা সমভাবে সুস্পষ্ট না-ও হতে পারে এবং তা সুস্পষ্ট হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র সকলের জন্য প্রস্তুত না-ও থাকতে পারে। কিন্তু কারো সামনে যখন তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়ে যায় তখন তার জন্য তা গ্রহণ করা বাইয়্যেনাহর মতোই অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কেবল নেফাক্বের মানসিকতার কারণেই কেউ বাইয়্যেনাহ্ এবং নিশ্চিত হওয়ার পরেও হুজ্জাত্ প্রত্যাখ্যান করতে পারে , আর সে ক্ষেত্রে তার জন্যে আল্লাহ্ তা‘
আলার নিকট আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগই থাকবে না।]
বলা বাহুল্য যে , নবুওয়াত ও ঐশী বার্তবাহকের পদ অত্যন্ত বিরাট মর্যাদার পদ। এ মর্যাদার দিকে বহু লোকেরই লোভাতুর দৃষ্টি থাকে এবং মিথ্যার আশ্রয় করে হলেও তারা মানুষের কাছে নবীর মর্যাদা লাভের লালসা পোষণ করে। এ কারণেই এ পদের দাবীদারের জন্য স্বীয় দাবীর সপক্ষে সুস্পষ্ট ও অকাট্য দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করা অপরিহার্য যাতে প্রতারক , মিথ্যা দাবীদার ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির নায়করা এ পদমর্যাদার অপব্যবহার করতে না পারে এবং নিজেদেরকে এর যথার্থ দাবীদার ও সত্যিকারের ঐশী পথপ্রদর্শকরূপে তুলে ধরে মানুষকে প্রতারিত করতে না পারে। তাই ঐশী পদের অধিকারী নয় এমন ব্যক্তিরা অন্য মানুষের পক্ষে সম্ভব এমন অসাধারণ কাজ সম্পাদন করতে পারে বিধায় মানুষের আয়ত্তাধীন অসাধারণ কাজ এ দাবীর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে গণ্য হতে পারে না।
অতএব , ঐশী পদের দাবীদারকে স্বীয় দাবীর সপক্ষে এমন কাজ সম্পাদন করতে হবে যা প্রাকৃতিক বিধানকে ভঙ্গ করবে এবং প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ব্যতিক্রম পন্থায় সংঘটিত হবে , আর এভাবে অনুরূপ কাজ সম্পাদনে অন্যদের অক্ষমতা প্রমাণ করে দেবে।
কেবল নবুওয়াতের প্রমাণ ও পৃষ্ঠপোষকতা হিসেবে সংঘটিত এ ধরনের অসাধারণ ঘটনাই হচ্ছে মু‘
জিযাহ্। পারিভাষিকভাবে মু‘
জিযাহ্ বা অলৌকিকতা বলতে কেবল এ উদ্দেশ্যে সম্পাদিত এ ধরনের কাজকেই বুঝানো হয় , যে কোনো উদ্দেশ্যে সম্পাদিত যে কোনো অসাধারণ কাজকে নয়।