কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্ 7%

কোরআনের মু‘জিযাহ্ লেখক:
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের মু‘জিযাহ্
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 60 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 48403 / ডাউনলোড: 4688
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

জাহেলী আরবদের পথনির্দেশনায় কোরআনের ভূমিকা

কোরআন মজীদ আরো একটি বিশিষ্ট মর্যাদা ও একক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আর এ বৈশিষ্ট্যের কারণে কোরআন মজীদ সমস্ত নবী-রাসূলের ( আঃ) সমস্ত মু জিযাহর ওপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। তা হচ্ছে মানবতার পথনির্দেশ ও নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ এবং পূর্ণতা ও মানবতার চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে তাদেরকে পরিচালিতকরণ। কারণ , কোরআন মজীদ হচ্ছে সেই মহাগ্রন্থ যা উদ্ধত , দুর্ধর্ষ ও দুর্বৃত্ত আরবদেরকে পথের দিশা দেখিয়েছিলো এবং তাদেরকে পুতুলপূজা ও নৈতিক-চারিত্রিক অধঃপতন ও অনাচার থেকে মুক্তি দিয়েছিলো , যুদ্ধ ও রক্তক্ষয় রূপ জাহেলী যুগে গৌরবজনক বিবেচিত বিষয়গুলো থেকে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে তাদেরকে মুক্তি দিয়েছিলো , আর এহেন রক্তপিপাসু মূর্খ লোকদের মধ্য থেকে এমন একটি জাতির উদ্ভব ঘটিয়েছিলো যে জাতির লোকেরা সমুন্নত সংস্কৃতি , স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস এবং পরিপূর্ণ চারিত্রিক ও মানবিক গুণাবলীর অধিকারী হতে পেরেছিলো।

যে কেউ ইসলামের ও হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সঙ্গী-সাথীদের গৌরবময় ইতিহাস অধ্যয়ন করবেন এবং যেভাবে তাঁরা ইসলামের জন্য হাসিমুখে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছেন তা নিয়ে চিন্তা করবেন , তিনি-ই কোরআন মজীদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং পথনির্দেশনা ও পরিচালনার মর্যাদা সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন। তাহলে তাঁর কাছে কোরআন মজীদের হেদায়াতের গুরুত্ব এবং তৎকালীন আরব জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব ও পথনির্দেশনার ক্ষেত্রে এর বিস্ময়কর প্রভাব সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়বে। তিনি বুঝতে পারবেন যে , কেবল এই কোরআন মজীদের পক্ষেই তাঁদেরকে জাহেলী জীবনধারার পঙ্কিলতা থেকে উদ্ধার করে জ্ঞান , পূর্ণতা ও মানবতার সমুন্নততম স্তরে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে এবং তাঁদেরকে দ্বীন , জীবনের সমুন্নত লক্ষ্য ও ইসলামের প্রাণসঞ্জীবনী আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য আত্মোৎসর্গের শিক্ষা প্রদান করা সম্ভব হয়েছে যার ফলে এ পথে আত্মোৎসর্গ করতে গিয়ে তাঁরা পার্থিব ধনসম্পদ হাতছাড়া করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না এবং স্বীয় সন্তান ও জীবনসাথীর মৃত্যুতে সামান্যতমও দুঃখিত হতেন না।

এ প্রসঙ্গে , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) যখন বদর যুদ্ধে গমন প্রশ্নে মুসলমানদের সাথে পরামর্শ করছিলেন তখন ছ্বাহাবী হযরত মিক্ব্দাদ্ তাঁকে উদ্দেশ করে যে অভিমত ব্যক্ত করেন তাকে আমরা আমাদের উক্ত বক্তব্যের সপক্ষে এক অকাট্য প্রমাণ রূপে তুলে ধরতে পারি।

হযরত মিক্ব্দাদ্ বলেছিলেন : হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ্ তা আলা আপনাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন আপনি তার ভিত্তিতেই অগ্রসর হোন ; আমরা মুসলমানরা মৃত্যুর পেয়ালা পান করা পর্যন্ত এ পথে আপনার সাথে এগিয়ে যাবো। আল্লাহর শপথ , আমরা তেমন কথা কখনোই বলবো না যা বানী ইসরাঈলের লোকেরা হযরত মূসা ( আঃ)কে উদ্দেশ করে বলেছিলো , যে : তুমি যাও ; তোমার রবের সহায়তা নিয়ে যুদ্ধ করো ; আমরা এখানে তোমার অপেক্ষায় বসে থাকলাম। বরং আমরা বলছি : আপনি আপনার রবের ওপর ভরসা করে এগিয়ে যান ও যুদ্ধ শুরু করুন ; আমরাও আপনার সাহায্যের জন্য আপনার সাথে এগিয়ে যাবো এবং জানপ্রাণ দিয়ে আপনার শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করবো। সেই রবের শপথ যিনি আপনাকে সত্য সহ পাঠিয়েছেন , আপনি যদি আমাদেরকে তরঙ্গসঙ্কুল ও বিপদজনক সমুদ্রের ওপর দিয়ে হাবশার দিকে এগিয়ে যাবার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন , তাহলে আমরা সেখানে পৌঁছা পর্যন্ত আপনার সঙ্গে থাকবো।

এতে খুশী হয়ে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) মিক্ব্দাদকে ধন্যবাদ জানান এবং তাঁর কল্যাণের জন্য দো আ করেন। (تاريخ طبری، الطبعة الثانية، ٢/١٤١ .)

ইনি হচ্ছেন মুসলমানদেরই একজন এবং সেই সব লোকদের দৃষ্টান্ত স্বরূপ যারা নিজেদের দৃঢ় প্রত্যয় ও অনড় সিদ্ধান্তের কথা এভাবে প্রকাশ করেন এবং যারা সত্য ও স্বাধীনতার সঞ্জীবন ও শিরক্-পৌত্তলিকতার বিলুপ্তির লক্ষ্যে আত্মোৎসর্গের প্রস্তুতির কথা এভাবেই ঘোষণা করেন। আর তৎকালীন মুসলমানদের মধ্যে , আপদমস্তক নিষ্ঠা , আন্তরিকতা , ঈমান এবং পূত-পবিত্র ও সুদৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারী লোকের সংখ্যা ছিলো প্রচুর।

আর এ ছিলো কোরআন মজীদেরই অবদান ; কোরআন মজীদই এই মূর্তিপূজক ও রক্তপিপাসু জাহেলী যুগের লোকদের অন্ধকার হৃদয়গুলোকে এভাবে জ্যোর্তিময় করে তুলেছিলো। আর জাহেলী যুগের এ নির্দয় ও বন্য লোকদেরকেই এমন জাগ্রতহৃদয় লোক রূপে গড়ে তুলেছিলো যারা দুশমন ও মূর্তিপূজকদের মোকাবিলায় ছিলেন কঠোর , কিন্তু তাওহীদ্বাদী ও মুসলমানদের জন্যে ছিলেন অত্যন্ত দয়ার্দ্র। আর এই কোরআন মজীদেরই বদৌলতে মাত্র অচিরেই তাঁরা এমন সব বিজয়ের অধিকারী হন অন্যরা শত শত বছরেও যার অধিকারী হতে পারে নি।

কেউ যদি হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সঙ্গীসাথীদের ইতিহাসকে পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের ( আঃ) সঙ্গীসাথীদের ইতিহাসের সাথে তুলনা করেন তাহলে তিনি জানতে পারবেন যে , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সঙ্গীসাথীদের এ দ্রুত অগ্রগতি ও নযীরবিহীন বিজয়ের পিছনে এক ঐশী রহস্য , মনোজাগতিক সত্য ও গূঢ় রহস্য নিহিত ছিলো যার উৎস হচ্ছে আল্লাহর কিতাব্ কোরআন মজীদ - যা হৃদয়সমূহকে আলোকিত করে এবং অন্তঃকরণ ও আত্মাসমূহকে সৃষ্টিকুলের উৎস মহাসত্তার ওপর দৃঢ় প্রত্যয় ও দ্বীনী মহান লক্ষ্যের পথে দৃঢ়তাকে সংমিশ্রিত করে।

অন্যদিকে হযরত ঈসা ( আঃ)-এর সঙ্গীসাথীগণের এবং অন্যান্য নবী-রাসূলের ( আঃ) সঙ্গীসাথীগণের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে জানা যাবে যে , তাঁরা কীভাবে নিজেদের নবী-রাসূলগণকে ( আঃ) লজ্জিত করেছেন এবং ভয়ভীতির পরিস্থিতিতে ও সম্ভাব্য বিপদের ক্ষেত্রে কীভাবে তাঁদেরকে দুশমনদের সামনে একা ফেলে সরে পড়েছেন। এ কারণেই অতীতের নবী-রাসূলগণের ( আঃ) বেশীর ভাগই নিজ নিজ যুগের যালেম-অত্যাচারীদের মোকাবিলায় অগ্রসর হতে পারেন নি এবং সাধারণতঃ তাঁদের দুশমনদের ভাগ্যেই বিজয়মাল্য জুটেছে। বরং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা জনালয় থেকে পালিয়ে নির্জন প্রান্তর বা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হন।

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সঙ্গীসাথীগণের এ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোরআন মজীদের বিস্ময়কর প্রভাবেরই ফল যা কোরআন মজীদের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য প্রমাণ করে।

জ্ঞানী-বিজ্ঞানী-মনীষী জন্মদানে কোরআনের অবদান

কোরআন মজীদের এ মানুষ গড়ার দৃষ্টান্ত কেবল নিষ্ঠাবান মানুষ গড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় , বরং কোরআনের ছায়াতলে অনেক অবিস্মরণীয় জ্ঞানী-গুণী , বিজ্ঞানী , মনীষী ও দার্শনিক গড়ে ওঠেন - মানবজাতির ইতিহাসে অন্য কোনো নবীর ও ধর্মগ্রন্থের বা অন্য কোনো আদর্শের প্রভাবে যে ধরনের নযীর নেই। এদের মধ্যে সর্বপ্রথম ব্যক্তিত্ব ছিলেন হযরত আলী ( আঃ) - স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং তাঁর পুরো নবুওয়াতী যিন্দেগীর সাহচর্যে থেকে যিনি গড়ে ওঠেন।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হযরত আলী ( আঃ) ছিলেন এমন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব যার শ্রেষ্ঠত্বের কথা কেবল মুসলমানরাই নয় , অমুসলিমরাও স্বীকার করে থাকে। তৎকালীন আরবে যখন না জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোনো প্রতিষ্ঠানিক চর্চা ছিলো , না কোনো বড় মনীষী , দার্শনিক বা বস্তুবিজ্ঞানী ছিলেন যার কাছে তিনি জ্ঞানচর্চা করতে পারতেন , না তিনি আরবের বাইরে কোথাও গিয়ে জ্ঞানার্জন করেছিলেন।

এহেন পরিস্থিতিতে তাঁর মতো এতো বড় জ্ঞানী ব্যক্তিত্বের গড়ে ওঠা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। এ ধরনের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠা কীভাবে সম্ভব হলো তার কোনো জবাব অমুসলিম পণ্ডিত-গবেষক ও ইতিহাসবিদগণ দিতে পারেন নি। প্রকৃত ব্যাপার হলো কোরআন মজীদ ও রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর প্রত্যক্ষ সাহচর্যের কারণেই তাঁর মতো জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠা সম্ভবপর হয়েছিলো।

হযরত আলী ( আঃ) নিজেও স্বীকার করেছেন যে , তাঁর যে জ্ঞান তা তিনি কোরআন মজীদ ও রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নিকট থেকে লাভ করেছেন এবং তিনি খোদায়ী ওয়াহী হিসেবে কোরআন মজীদের সামনে মাথা অবনত করে দিয়েছেন।

এখানে হযরত আলী ( আঃ)-এর জ্ঞান-মনীষা সম্পর্কে কিছুটা আভাস দেয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

হযরত আলী ( আঃ) আরবী ভাষার বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাত্ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিকে বিস্ময়কর ও মৌলিক অবদান রেখে গেছেন - বিশ্বের অসংখ্য বড় বড় জ্ঞানী-গুণী , বিজ্ঞানী , দার্শনিক ও কবি-সাহিত্যিক যাতে অবগাহন করে ধন্য হয়েছেন। বিশেষতঃ তাঁর বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাত্ এবং ব্যাপক তাৎপর্যবহ বক্তব্য নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করতে গিয়ে বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের বিশেষজ্ঞগণ বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছেন।

হযরত আলী ( আঃ) তাঁর বক্তৃতা-ভাষণে যখনই যে বিষয়ে কথা বলেছেন , সে বিষয়ে শেষ কথাটি বলেছেন। তাঁর কথা নিয়ে চিন্তা-গবেষণার পরে তাঁর বক্তব্যের অন্যথা কেউ নির্দেশ করতে পারেন নি। প্রশ্ন হচ্ছে , এ জ্ঞানের উৎস কী ? সন্দেহ নেই যে , কোরআনী আদর্শ ও কোরআনী উৎস এবং কোরআনের উৎসস্থলই তাঁর এ জ্ঞান ও বৈশিষ্ট্যের উৎস। তাই তিনি তাঁর এতো সব বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও কোরআন মজীদের সামনে খোদায়ী ওয়াহীর স্বীকৃতি সহকারে মাথা নত করে দিয়েছেন।

হযরত আলী ( আঃ)কে শুধু জ্ঞানী-গুণীরূপে নয় , বরং অন্য দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখা যেতে পারে। তা হচ্ছে , যে কেউ তাঁর জীবনেতিহাসের দিকে তাকাবে এবং তাঁর জীবনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মধ্য থেকে মাত্র একটি বৈশিষ্ট্যের প্রতি মনোযোগ দেবে সে-ই মনে করতে বাধ্য যে , তিনি বুঝিবা তাঁর সারাটি জীবন শুধু এ বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা ও চর্চা করে কাটিয়ে দিয়েছেন এবং বিষয়টিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন , আর এমতাবস্থায় নিশ্চয়ই তিনি শুধু ঐ একটি বিষয়েই বিশেষজ্ঞ ছিলেন। আর যে ব্যক্তি তাঁর জীবনের অপর একটি বৈশিষ্ট্য বা তাঁর জ্ঞানের অপর একটি দিক সম্পর্কে চিন্তা করবে সে তাঁর জ্ঞানের এ দিকটির ভিত্তিতে তাঁর সম্পর্কে অনুরূপ ধারণা পোষণ করবে - এতে সন্দেহ নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে , এর রহস্য কী ? এর রহস্য হচ্ছে , তিনি কোরআনী তথা আসমানী উৎস থেকে জ্ঞান আহরণ করেছিলেন। কারণ , যে কেউ তৎকালীন আরবের ইতিহাসের সাথে পরিচিত , বিশেষ করে ইসলাম-পূর্ব হেজায্ ভূখণ্ড সম্পর্কে অবগত , তিনিই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে , হযরত আলী ( আঃ)-এর চিঠিপত্র , বাণী ও বক্তৃতা-ভাষণ (যা নাহ্জুল্ বালাাগ্বাহ্ নামে সংকলিত হয়েছে) এবং এতে প্রতিফলিত জ্ঞান-বিজ্ঞান ঐশী ওয়াহীর সাথে সম্পর্ক ব্যতিরেকে অন্য কোনো উৎস থেকে সংগৃহীত হওয়া সম্ভব নয় (এবং সে যুগের আরব উপদ্বীপে এ ধরনের জ্ঞান আহরণের কোনো উৎসও ছিলো না) ।

কতোই না চমৎকার অথচ যথার্থ কথা বলেছেন তিনি যিনি নাহ্জুল্ বালাাগ্বাহর ভাষা সম্পর্কে বলেছেন : এটা স্রষ্টার কালামের তুলনায় নিম্নতর ও সৃষ্টির কালামের তুলনায় উর্ধে ! বস্তুতঃ কেবল অবিনশ্বর খোদায়ী মু জিযাহ্ কোরআন মজীদের সাথে সর্বাধিক সম্পৃক্ততার কারণেই তাঁর বক্তব্য মানের দিক থেকে এমন এক সমুন্নত পর্যায়ে উন্নীত হওয়া সম্ভবপর হয়েছিলো। আর তিনি নিজেই তা অকপটে স্বীকার করেছেন।

তাছাড়া হযরত আলী ( আঃ)-এর জীবনেতিহাসের সাথে যারা পরিচিত , ইসলামের বন্ধু-দুশমন নির্বিশেষে তাঁদের সকলেই স্বীকার করেন যে , তিনি ছিলেন নীতিনিষ্ঠ - তাক্ব্ওয়া-পরহেযগারীর চরম-পরম দৃষ্টান্ত। শুধু তা-ই নয় , তিনি স্বীয় অনুভূতি , চিন্তা-চেতনা ও মতামতের ব্যাপারে ছিলেন আপোসহীন। এছাড়া দুনিয়া এবং দুনিয়ার ক্ষমতা , শক্তি ও সম্পদের ব্যাপারে তিনি একেবারেই নিস্পৃহ ছিলেন। এহেন ব্যক্তির পক্ষে অন্য কোনো উৎস থেকে জ্ঞান আহরণ করে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে কোরআন মজীদ ও হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) থেকে তা আহরণের কথা বলা বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে একেবারেই অসম্ভব।

হযরত আলী ( আঃ)-এর জ্ঞান-মনীষার আওতা সম্পর্কে যাদের খুব বেশী ধারণা নেই তাঁদের জানার সুবিধার্থে এখানে কিছুটা সংক্ষিপ্ত আভাস দেয়া যেতে পারে।

নিঃসন্দেহে হযরত আলী ( আঃ) ছিলেন কোরআন মজীদের শ্রেষ্টতম ফসল। এ কারণেই হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) এরশাদ করেন :انا مدينة العلم و علي بابها - আমি জ্ঞানের নগরী , আর আলী তার দরযাহ্।

হযরত আলী ( আঃ) জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় সর্বোচ্চ দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে সব শাখা-প্রশাখায় দক্ষতার অধিকারী ছিলেন তার সবগুলোর নামও কোনো একজন মনীষীর আয়ত্ত নেই। জ্ঞানের নগরীর দরযাহ্ হযরত আলী ( আঃ) তাঁর নিজের জ্ঞানের আওতা সম্পর্কে বলেছেন : রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ) আমাকে জ্ঞানের এক হাজার শাখা (বা অধ্যায়) শিক্ষা দিয়েছেন এবং আমি তার প্রতিটি থেকে এক হাজার করে উপশাখা (বা উপ-অধ্যায়) উদ্ভাবন করেছি। এ থেকেই তাঁর জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যেতে পারে।

বর্তমান যুগে দ্বীনী ও মানবিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে সব শাখা-প্রশাখা রয়েছে ও তদ্সংশ্লিষ্ট যে সব আনুষঙ্গিক শাস্ত্র রয়েছে সে সবের নাম মোটামুটি অনেকেরই জানা আছে। এর মধ্যে রয়েছে আরবী ব্যাকরণ , জাহেলী যুগের আরবী সাহিত্য , বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাত্ , ভাষাতত্ত্ব , তাৎপর্য বিজ্ঞান , যুক্তিবিজ্ঞান , দর্শন , ইতিহাস , ইলমে আক্বাাএদ , তাফ্সীর , হাদীছ , ফিক্বাহ্ , চরিত্রবিজ্ঞান , রাষ্ট্রবিজ্ঞান , অর্থনীতি , সমাজতত্ত্ব , মনোবিজ্ঞান , আইন ও দণ্ডবিধি ইত্যাদি অনেক কিছু। বর্তমান যুগে এবং পূর্ববর্তী যুগেও এ সব শাস্ত্রের যে কোনো একটিতে অত্যন্ত উঁচু স্তরের দক্ষতার অধিকারী ব্যক্তি বিশ্ববিখ্যাত মনীষী হিসেবে পরিগণিত ; কদাচিৎ দেখা যায় যে , একই ব্যক্তি এ সব বিষয়ের মধ্য থেকে একাধিক বিষয়ে উঁচু স্তরের দক্ষতার অধিকারী। কিন্তু হযরত আলী ( আঃ) এ সব জ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায়ই সুউচ্চ দক্ষতার অধিকারী ছিলেন এবং তিনি এ সব বিষয়ে যে সব কথা বলেছেন পরবর্তী কালে কোনো মনীষীই তার মধ্য থেকে কোনো কথাই ভুল বা ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রমাণ করতে পারেন নি।

কিন্তু হযরত আলী ( আঃ)-এর জ্ঞান কেবল দ্বীনী ও মানবিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখা ও তদ্সংশ্লিষ্ট আনুষঙ্গিক শাস্ত্রসমূহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। বরং তিনি প্রাকৃতিক ও বস্তুবিজ্ঞান সমূহেও সমান দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। নক্ষত্রবিজ্ঞান , ভূবিজ্ঞান , পদার্থবিজ্ঞান , রসায়ন শাস্ত্র , প্রাণিবিজ্ঞান , উদ্ভিদবিজ্ঞান , শরীর বিজ্ঞান , চিকিৎসা শাস্ত্র তথা কোনো কিছুই তাঁর আওতার বাইরে ছিলো না।

বস্তুবিজ্ঞান সমূহের মধ্যে রসায়নশাস্ত্রে তাঁর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কোনো কোনো সূত্রের বর্ণনা অনুযায়ী , তিনি রাসায়নিক পদ্ধতিতে স্বর্ণ তৈরী করতে সক্ষম ছিলেন। কিন্তু তাঁর এ দক্ষতা ছিলো তাঁর যুগের চাইতে অনেক বেশী অগ্রগামী। ফলে তাঁর রসায়নশাস্ত্রের শিষ্যগণ এ ফর্মুলা সঠিকভাবে আয়ত্ত করতে ও কাজে লাগাতে পারেন নি।

অতএব , যে মহাগ্রন্থ এহেন ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে সক্ষম - ঐশী গ্রন্থ হবার দাবীদার অন্য কোনো গ্রন্থই যা পারে নি , সে গ্রন্থের ঐশী গ্রন্থ হবার ব্যাপারে কোনো বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষেও অবিশ্বাস পোষণ করা আদৌ সম্ভব নয়।

তবে হযরত আলী ( আঃ) কোরআন মজীদের শ্রেষ্ঠতম ফসল হলেও জ্ঞানী-মনীষী সৃষ্টির ব্যাপারে কোরআন মজীদ কেবল একজন আলী তৈরী করে নি , বরং বিগত চৌদ্দশ বছরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় অসংখ্য উঁচু স্তরের মনীষী তৈরী করে মানব প্রজাতিকে উপহার দিয়ে ধন্য করেছে। আর তাঁরা কেবল বু আলী সীনা , আল্-বিরুনী , ফারাবী , রাযী , খাওয়ারিযমী , জাবের ইবনে হাইয়ান , জাবের ইবনে হাইছাম , প্রমুখ কয়েক জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন , বরং বিভিন্ন শাখার এ সব জ্ঞানী-মনীষীদের তালিকা এতোই দীর্ঘ যে , শুধু কোন্ বিষয়ের মনীষী তার উল্লেখ সহ তাঁদের নামের তালিকা তৈরী করতে হলেও বহু খণ্ড বিশিষ্ট বিশালায়তন গ্রন্থ তৈরী করতে হবে।

এটা অনস্বীকার্য যে , আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সকল শাখাই মুসলমানরা উদ্ঘাটন করেছেন। আর মুসলমানরা কোরআন চর্চা করতে গিয়েই জ্ঞান-বিজ্ঞানের এ সব শাখা আবিষ্কার করেছেন এবং এক বিরাট বিশ্বসভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেছেন।

যখন আমেরিকা আবিষ্কৃত হয় নি এবং ইউরোপ ছিলো অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত তখন মুসলমানরা শুধু ধর্মশাস্ত্র , দর্শন , ইতিহাস , রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদিতেই উন্নতি করে নি , বরং পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান সহ সকল প্রকার বস্তুবিজ্ঞানেও উন্নতির সুউচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিলো। অতঃপর ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা মুসলমানদের কাছ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে তাদেরই কাছ থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ থেকে পুঁজি বিনিয়োগ করে এবং স্বীয় ধর্মীয় (খৃস্টবাদের) নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণায় হাত দেয় - যার ফসল হচ্ছে বিশ্বের বর্তমান বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে , মুসলমান ও খৃস্টান সম্প্রদায় যখন নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থকে আঁকড়ে ধরেছিলো তখন মুসলমানরা সারা বিশ্বকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবদানে ধন্য করেছে এবং ইতিহাসবিশ্রুত শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানীদেরকে উপহার দিয়েছে , আর তখন খৃস্টানরা অজ্ঞতার তিমিরে নিমজ্জিত ছিলো। অন্যদিকে খৃস্টানরা যখন তাদের ধর্মগ্রন্থের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলো এবং বাইবেল ও তার ধারক-বাহকদের আধিপত্যকে গীর্জার চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী করে ফেললো এবং মুসলমানদের কাছ থেকে তাদের কোরআনকে গ্রহণ না করলেও কোরআনের ফসল জ্ঞান-বিজ্ঞানসমূহকে গ্রহণ করলো ও তার ভিত্তিতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় ঝাঁপিয়ে পড়লো , তখন তারা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্ববাসীর জন্য পতাকাবাহী হয়ে দাঁড়ালো। আর রাজ্যহারা লুণ্ঠিতসর্বস্ব মুসলমানদের কাছ থেকে উপনিবেশবাদী দখলদাররা তাদের ধনসম্পদ কেড়ে নিয়েই ক্ষান্ত থাকে নি , তাদের কোরআন-কেন্দ্রিক ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও বন্ধ করে দিয়ে সচ্ছল শিক্ষিত মুসলিম জাতিকে দরিদ্র অশিক্ষিতে পরিণত করলো এবং তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পুঁজির অভাবে কোরআন-চর্চার ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে প্রায় সম্পর্কহীন হয়ে পড়লো। ঔপনিবেশিক শক্তিবর্গের ষড়যন্ত্রের ফলে কোরআনের সাথে তাদের সম্পর্ক শিথিল হয়ে পড়লো এবং এক সময় তারা দখলদার শত্রুদেরকে উন্নততর সভ্যতার অধিকারী গণ্য করে তাদের মানসিক গোলামে পরিণত হয়ে গেলো।

কিন্তু খৃস্টান পাশ্চাত্য জগত কোরআনের ফসল জ্ঞান-বিজ্ঞানকে গ্রহণ করে তার চর্চা করে অনেক দূর এগিয়ে নিলেও তারা কোরআনের আদর্শিক ও নৈতিক শিক্ষাকে গ্রহণ করে নি। ফলে পাশ্চাত্য জনগণের মধ্যে পার্থিব ও নৈতিক-আধ্যাত্মিক দিকের মধ্যে যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে তা তাদেরকে চরম ভোগবাদে নিমজ্জিত করেছে। এর ফলে তারা নিজেদের ধ্বংস ও বিলুপ্তির জন্য প্রহর গুণছে যা সেখানকার রাষ্ট্রনেতা , রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদেরকে শঙ্কিত করে তুলেছে এবং তাঁরা তাঁদের জনগণকে এ থেকে ফেরাবার জন্য যতোই চেষ্টা করছেন ও পদক্ষেপ নিচ্ছেন তা কোনোই সুফল দিচ্ছে না।

এ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা প্রমাণ করছে যে , কোরআন মজীদ হচ্ছে মানব প্রজাতির জন্য সার্বিক উন্নতি-অগ্রগতির উৎস ; কোরআন-চর্চা ও তার ফসলকে গ্রহণের মধ্যেই উন্নতি এবং তার সাথে সম্পর্ক ছিন্নকরণের মধ্যেই পশ্চাদপদতা ও ধ্বংস নিহিত। এ হচ্ছে কোরআন মজীদের অবিনশ্বর মু জিযাহরই অন্যতম দিক।

হাতির বছরের গোলযোগ

কোন জাতির মধ্যে যে মহাঘটনা সংঘটিত হয় এবং কখনো কখনো যা ধর্মীয় ভিত্তিমূল এবং কখনো কখনো জাতীয় ও রাজনৈতিক ভিত্তিমূলের অধিকারী তা সাধারণ জনগণের আশ্চর্য ও বিস্ময়বোধের কারণে তারিখ ও গণনার সূচনা বা উৎস বলে গণ্য হয়। যেমন ইয়াহুদী জাতির মুক্তির জন্য হযরত মূসা (আ.)-এর আন্দোলন,খ্রিষ্টানদের জন্য হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম তারিখ এবং মুসলমানদের ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর হিজরত হচ্ছে তারিখ গণনার উৎস যা দিয়ে প্রতিটি ধর্মের অনুসারিগণ তাদের জীবনের ঘটনাসমূহের উদ্ভবের সময়কাল নির্ণয় ও পরিমাপ করে থাকে।

কখনো কখনো কোন জাতি মৌলিক ইতিহাস ও তারিখের অধিকারী হওয়ার কারণে কিছু কিছু ঘটনাকেও তাদের তারিখ গণনার ভিত্তি ও উৎস হিসাবে নির্ধারণ করেছে। যেমন পাশ্চাত্যের দেশসমূহে মহান ফরাসী বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে 1917 খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরের কম্যুনিস্ট আন্দোলন ঐ সব দেশে যে সব ঘটনাপ্রবাহের উদ্ভব হয় সেগুলোর অনেক কিছুর তারিখ গণনার ভিত্তি বা উৎস হিসাবে গণ্য করা হযেছে। যে সব অনগ্রসর জাতি এ ধরনের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলন থেকে বঞ্চিত সে সব জাতি স্বাভাবিকভাবে অসাধারণ ঘটনাবলীকে তাদের ইতিহাস ও তারিখ গণনার ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করে। এ কারণেই জাহেলী আরবগণ সঠিক কৃষ্টি ও সভ্যতার অধিকারী না হওয়ায় যুদ্ধ,ভূমিকম্প,দুর্ভিক্ষ অথবা অলৌকিক ঘটনাবলীকে নিজেদের ইতিহাস ও তারিখ গণনার উৎস হিসাবে গণ্য করেছে। এ কারণেই ইতিহাসের পাতায় পাতায় আমরা আরব জাতির তারিখ গণনার ভিন্ন ভিন্ন ভিত্তি দেখতে পাই। এসব ভিত্তির মধ্যে সর্বশেষ ভিত্তি হচ্ছে হাতির বছরের ঘটনা এবং পবিত্র কাবাগৃহকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে আবরাহার মক্কা আক্রমণের ঘটনা যা অন্যান্য ঘটনার তারিখ গণনার ভিত্তি হিসাবে গণ্য হয়েছে। এখন আমরা 570 খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত মহাঘটনাটির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করব এবং এখানে স্মর্তব্য যে,মহানবী (সা.)ও এই একই বছরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

এ ঘটনার উৎস

আসহাবে ফীল অর্থাৎ হস্তিবাহিনীর ঘটনা পবিত্র কোরআনে সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণিত হয়েছে। আর আমরা এ ঘটনা বর্ণনা করার পর যে সব আয়াত এ ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে তা উল্লেখ করব। ইতিহাস রচয়িতাগণ এ ঘটনার মূল কারণ সম্পর্কে লিখেছেন : ইয়েমেনের বাদশাহ্ যূনুওয়াস তার সরকারের ভিত্তি মজবুত করার পর কোন এক সফরে মদীনা অতিক্রম করছিল। তখন মদীনা এক অতি উত্তম ধর্মীয় মর্যাদার অধিকারী ছিল। সে সময় একদল ইয়াহুদী ঐ শহরে বসতি স্থাপন করে প্রচুর মন্দির ও ইবাদাতগাহ্ নির্মাণ করেছিল। সুযোগসন্ধানী ইয়াহুদিগণ বাদশার আগমনকে এক সুবর্ণ সুযোগ মনে করে বাদশাহকে ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানায়। তাদের এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্যে ছিল নব্য ইয়াহুদী ধর্মে দীক্ষিত বাদশাহ্ যূনুওয়াসের শাসনাধীনে রোমের খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিক আরবের হামলা থেকে নিরাপদ থাকা এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করা। এ ব্যাপারে তাদের প্রচার খুব ফলপ্রসূ হয়েছিল। যূনুওয়াস ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহণ করল এবং এ ধর্ম প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছিল। অনেকেই ভীত হয়ে তার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। সে একদল জনতাকে বিরোধিতা করার জন্য কঠোর শাস্তি প্রদান করে। তবে নাজরানের অধিবাসিগণ যারা বেশ কিছুদিন আগেই খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা কোনক্রমেই খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে ইয়াহুদী ধর্মের অনুশাসন অনুসরণ করতে প্রস্তুত ছিল না।ইয়েমেনের বাদশার বিরুদ্ধাচরণ এবং অবজ্ঞা করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ছিল। বাদশাহ্ যূনুওয়াস এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে নাজরানের বিদ্রোহীদেরকে দমন করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। সেনাপতি নাজরান শহরের পাশে সেনা শিবির ও তাঁবু স্থাপন করে এবং পরিখা খনন করার পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়;আর বিদ্রোহীদেরকে ঐ আগুনে জীবন্ত দগ্ধ করার হুমকি প্রদর্শন করতে থাকে। নাজরানের অকুতোভয় সাহসী জনতা যারা মনে-প্রাণে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা এতে মোটেও ভীত না হয়ে মৃত্যু ও জীবন্ত দগ্ধ হওয়াকে সানন্দে বরণ করে নেয়। তাদের দেহগুলো সেই আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়েছিল।110

ইসলামী ইতিহাসবেত্তা ইবনে আসীর জাযারী লিখেছেন : এ সময় দূস নামক একজন নাজরানবাসী খ্রিষ্টধর্মের গোঁড়া সমর্থক রোমান সম্রাট কাইসারের কাছে গমন করে তাঁকে পুরো ঘটনা অবহিত করল এবং রক্তপিপাসু যূনুওয়াসকে শাস্তি প্রদান এবং অত্র এলাকায় খ্রিষ্টধর্মের ভিত মজবুত ও শক্তিশালী করার আবেদন জানাল। রোমের অধিপতি গভীর দুঃখ ও সমবেদনা প্রকাশ করে বলেন, আপনাদের দেশ থেকে আমার সাম্রাজ্যের রাজধানী অনেক দূরে অবস্থিত বিধায় এ ধরনের অত্যাচারের প্রতিকার বিধানার্থে হাবাশার বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে একটি চিঠি লিখছি যাতে করে তিনি ঐ রক্তপিপাসু নরপিশাচের কাছ থেকে নাজরানের নিহতদের প্রতিশোধ নিতে পারেন। ঐ নাজরানবাসী কাইসারের চিঠি নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব হাবাশার দিকে রওয়ানা হয়ে গেল এবং বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে পুরো ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করল। ফলে বাদশার শিরা ও ধমনীতে তীব্র আত্মসম্মানবোধ ও চেতনাবোধের রক্ত প্রবাহিত হয়ে গেল। তিনি আবরাহাতুল আশরাম নামক এক হাবাশী সেনাপতির নেতৃত্বে 70 হাজারের এক বিশাল সেনাবাহিনী ইয়েমেনের দিকে প্রেরণ করেন। হাবাশার উক্ত সুশৃঙ্খল ও সুসজ্জিত সেনাবাহিনীটি সমুদ্রপথে ইয়েমেনের সৈকতে তাঁবু স্থাপন করে। এ ব্যাপারে সচেতন না থাকার কারণে যূনুওয়াসের আর কিছুই করার ছিল না। সে যতই চেষ্টা করল তাতে কোন ফল হলো না। প্রতিরোধ ও যুদ্ধ করার জন্য যতই গোত্রপতিদের নিকট আহবান জানাল তাতে তাদের পক্ষ থেকে সে কোন সাড়া পেল না। পরিণতিতে আবরাহার এক সংক্ষিপ্ত আক্রমণের মুখে যূনুওয়াসের প্রশাসনের ভিত ধসে পড়ে এবং সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী ইয়েমেন হাবাশাহ্ সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে যায়।

আবরাহা প্রতিশোধ ও বিজয়ের মদমত্ততায় চূর ও মাতাল হয়েছিল। সে যৌনকামনা ও আমোদ-প্রমোদে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মোটেও বিরত থাকত না। সে হাবাশার বাদশার নৈকট্য ও দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ইয়েমেনের রাজধানী সানআ নগরীতে একটি জমকালো গীর্জা নির্মাণ করে যা ছিল ঐ যুগে অতুলনীয়। তারপর সে বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে এই মর্মে পত্র লেখে, গীর্জা নির্মাণ কাজ প্রায় সমাপ্ত হওয়ার পথে। ইয়েমেনের সকল অধিবাসীকে কাবার যিয়ারত করা থেকে বিরত এবং এই গীর্জাকে সাধারণ জনগণের জন্য তাওয়াফস্থল করার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছি।” চিঠিটির মূল বক্তব্য প্রচারিত হলে সমগ্র আরব গোত্রগুলোর মধ্যে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল,এমনকি বনি আফকাম গোত্রের এক মহিলা উক্ত মন্দিরের চত্বরকে নোংরা করে দিল। এ ধরনের কাজ যার মাধ্যমে আবরাহার গীর্জার প্রতি আরবদের পূর্ণ অবজ্ঞা,শত্রুতা ও অবহেলা প্রকাশ পেয়েছে তা তদানীন্তন আবরাহা প্রশাসনকে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ করে তোলে। অন্যদিকে গীর্জার বাহ্যিক সৌন্দর্য ও সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রে যত চেষ্টা চালানো হয়েছে ততই পবিত্র কাবার প্রতি জনগণের আকর্ষণ ও ভালোবাসা তীব্র হতে থাকে। এ সব ঘটনাপ্রবাহের কারণে আবরাহা পবিত্র কাবা ধ্বংস করার শপথ নেয়। এজন্য আবরাহা এক বিশাল বাহিনী গঠন করে যার সম্মুখভাগে ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুসজ্জিত অনেক লড়াকু হাতি। তাওহীদী মতাদর্শের প্রাণপুরুষ হযরত ইবরাহীম খলীল (আ.) যে গৃহটির পুননির্মাণ করেছিলেন আবরাহা তা ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিস্থিতি যে অত্যন্ত ভয়াবহ ও অতি সংবেদনশীল তা প্রত্যক্ষকরতঃ আরবের গোত্রপতিদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে,আরব জাতির স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব পতনের সম্মুখীন। কিন্তু আবরাহার অতীত সাফল্যসমূহ তাদেরকে যে কোন উপকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত রেখেছিল। এতদ্সত্ত্বেও আবরাহার গমনপথের ওপর অরব গোত্রগুলোর কতিপয় আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন নেতা পূর্ণ বীরত্বসহকারে আবরাহার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যেমন যূনাফার যিনি নিজেও এক অভিজাত বংশোদ্ভূত ছিলেন তিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদান করে তাঁর নিজ গোত্রকে পবিত্র কাবাগৃহ রক্ষা করার উদাত্ত আহবান জানান। কিন্তু অতি অল্পদিনের মধ্যেই আবরাহার বিশাল বাহিনী তাঁদের ব্যুহসমূহ ভেদ করে দেয়। এরপর নুফাইল বিন হাবীব তীব্র প্রতিরোধ ও সংগ্রাম গড়ে তোলে,কিন্তু সেও পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয় এবং আবরাহার বাহিনীর হাতে বন্দী হয়। তাকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য সে (নুফাইল) আবরাহার কাছে আবেদন জানালে আবরাহা তাকে বলেছিল, আমাদেরকে মক্কা নগরী অভিমুখে যদি তুমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও তাহলে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব।” তাই নুফাইল আবরাহাকে তায়েফ নগরী পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় এবং পবিত্র মক্কা নগরী পর্যন্ত অবশিষ্ট পথ দেখানোর দায়িত্ব নুফাইল আবু রাগাল নামক তারই এক বন্ধুর ওপর ন্যস্ত করে। নতুন পথ-প্রদর্শক আবরাহার সেনাবাহিনীকে পবিত্র মক্কা নগরীর নিকটবর্তী মাগমাস নামক স্থানে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। আবরাহার সেনাবাহিনী ঐ স্থানকে সেনা ছাউনি ও তাঁবু স্থাপন করার জন্য মনোনীত করে। আর আবরাহা তার চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী একজন সেনাপতিকে তিহামার উট ও গবাদিপশু লুণ্ঠন করার দায়িত্ব দেয়। প্রায় 200টি উট লুণ্ঠন করা হয়। লুণ্ঠিত এ সব উটের মালিক ছিলেন মক্কাপ্রধান আবদুল মুত্তালিব। অতঃপর হানাতাহ্ নামীয় এক সেনাপতিকে আবরাহা মক্কার কুরাইশ নেতা ও প্রধানের কাছে তার বাণী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব অর্পণ করে বলেছিল, কাবাগৃহ ধ্বংস করার প্রকৃত চিত্র যেন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে! আর নিশ্চিতভাবে কুরাইশরা প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তবে রক্তপাত এড়ানোর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে মক্কার পথ ধরে এগিয়ে যাবে। সেখানে পৌঁছে কুরাইশ প্রধানের খোঁজ করে সরাসরি তার কাছে গিয়ে বলবে : আমাদের মূল লক্ষ্যই হলো কাবাগৃহ ধ্বংস করা। কুরাইশরা যদি প্রতিরোধ না করে তাহলে তারা যে কোন হামলা ও আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকবে।”

আবরাহার প্রেরিত দূত পবিত্র মক্কায় পৌঁছেই কুরাইশদের বিভিন্ন দলকে আবরাহার সামরিক অভিযান সম্পর্কে আলোচনারত দেখতে পেল। মক্কাপ্রধানের খোঁজ করলে তাকে আবদুল মুত্তালিবের গৃহে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। আবদুল মুত্তালিব আবরাহার বাণী শোনার পর বললেন, আমরা কখনই প্রতিরক্ষা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলব না। কাবা মহান আল্লাহর গৃহ যার নির্মাতা হযরত ইবরাহীম খলীল (আ.)। মহান আল্লাহ্ যা কল্যাণকর তা-ই করবেন।” আবরাহার সেনাপতি কুরাইশপ্রধানের এ ধরনের কোমল ও শান্তিপূর্ণ যুক্তি যা প্রকৃত সুমহান আত্মিক ঈমানেরই পরিচায়ক তা শ্রবণ করে সন্তোষ প্রকাশ করল এবং তার সাথে আবরাহার তাঁবুতে আসার আমন্ত্রণ জানাল।

আবরাহার শিবিরে আবদুল মুত্তালিব-এর গমন

আবদুল মুত্তালিব তাঁর কয়েক সন্তানসহ আবরাহার শিবিরের দিকে রওয়ানা হলেন। কুরাইশপ্রধানের মহত্ত্ব,স্থিরতা,ধৈর্য,গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিত্ব আবরাহাকে বিস্ময়াভিভূত করে ফেলে। এ কারণেই সে আবদুল মুত্তালিবের প্রতি অত্যন্ত ভক্তি,শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শন করেছিল। এর প্রমাণস্বরূপ,সে সিংহাসন থেকে নিচে নেমে এসে আবদুল মুত্তালিবের হাত ধরে তাঁকে তার নিজের পাশে বসিয়েছিল। এরপর সে পূর্ণ ভদ্রতা ও শিষ্টাচারসহকারে দোভাষীর মাধ্যমে আবদুল মুত্তালিবকে প্রশ্ন করেছিল যে,তিনি কেন এখানে এসেছেন এবং তিনি কী চাচ্ছেন? আবদুল মুত্তালিব আবরাহার প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, তিহামার উটগুলো এবং যে দু শ’উটের মালিক আমি সেগুলো আপনার সৈন্যদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়েছে। আপনার কাছে আমার অনুরোধ এটিই যে,অনুগ্রহপূর্বক ঐ সকল উট স্ব স্ব মালিকের কাছে ফেরত দেয়ার আদেশ দিন।” আবরাহা বলল, আপনার আলোকিত বদনমণ্ডল আপনাকে আমার কাছে এক জগৎ পরিমাণ মহান ও বিরাট করে তুলেছে,অথচ (যখন আমি এসেছি আপনার পূর্বপুরুষদের ইবাদাতগাহ্ ধ্বংস করতে) তখন আপনার ছোট ও অতি সামান্য আবেদন আপনার মহত্ত্ব,উচ্চ সম্মান ও মর্যাদাকে কমিয়ে দিয়েছে। আমি আশা করেছিলাম যে,আপনি কাবার ব্যাপারে আলোচনা করবেন এবং অনুরোধ জানাবেন যে,আমার যে লক্ষ্য আপনাদের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের ওপর মারাত্মক আঘাত হানবে তা থেকে অমি যেন বিরত থাকি। না,পক্ষান্তরে আপনি কয়েকটি মূল্যহীন উটের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন এবং সেগুলো ছেড়ে দেয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন? আবদুল মুত্তালিব আবরাহার প্রশ্নের জবাবে একটি বাক্য বলেছিলেন যা আজও তাঁর নিজস্ব মহত্ত্ব,গৌরব এবং মান বজায় রেখেছে। আর ঐ বাক্যটি ছিল :

أنا ربّ الإبل و للبيت ربّ يمنعه

“আমি উটগুলোর প্রতিপালনকারী এবং পবিত্র কাবারও এমন এক প্রভু আছেন যিনি (সব ধরনের আগ্রাসন,আক্রমণ এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে) উক্ত গৃহকে রক্ষা করবেন।” আবরাহা এ কথা শোনার পর খুবই দাম্ভিকতার সাথে বলেছিল, এ পথে আমার লক্ষ্য অর্জনে বাধা দেয়ার শক্তি কারো নেই।” এরপর সে লুণ্ঠিত সব ধন-সম্পদ প্রকৃত মালিকদের কাছে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল।

অধীর আগ্রহে কুরাইশদের অপেক্ষা

সমগ্র কুরাইশ গোত্র অধীর আগ্রহে আবদুল মুত্তালিবের ফেরার অপেক্ষায় ছিল যাতে করে তারা শত্রুর সাথে তাঁর আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে অবগত হতে পারে। যখন আবদুল মুত্তালিব কুরাইশ গোত্রপতিদের মুখোমুখি হলেন তখন তিনি তাদেরকে বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের গবাদিপশু নিয়ে উপত্যকা ও পাহাড়-পর্বতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ কর। এর ফলে তোমরা সবাই যে কোন ধরনের ক্ষতি ও বিপদাপদ থেকে নিরাপদে থাকতে পারবে।” এ কথা শোনার পর অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সকল মক্কাবাসী তাদের নিজেদের ঘর-বাড়ী ছেড়ে পাহাড়-পর্বতে গিয়ে আশ্রয় নিল। মধ্যরাত্রিতে শিশু ও নারীদের ক্রন্দনধবনি এবং পশুসমূহের আর্তনাদ সমগ্র পাহাড়-পর্বতে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ঐ সময় আবদুল মুত্তালিব কয়েকজন কুরাইশসহ পর্বতশৃঙ্গ থেকে নেমে এসে পবিত্র কাবায় গেলেন। ঐ সময় তাঁর চোখের চারপাশে অশ্রুবিন্দু জমেছিল। তিনি ব্যথিত অন্তরে পবিত্র কাবার দরজার কড়া হাতে নিয়ে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন, হে ইলাহী! তাদের (আবরাহা ও তার বিশাল সেনাবাহিনী) অনিষ্ট সাধন ও ক্ষয়ক্ষতি করা থেকে নিরাপদ থাকার ব্যাপারে কেবল তুমি ছাড়া আর কারো প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র আশা নেই। হে প্রভু! তাদেরকে তোমার পবিত্র গৃহের অঙ্গন ও সীমানা থেকে প্রতিহত কর। সে-ই কাবার দুশমন যে তোমার সাথে শত্রুতা পোষণ করে। হে প্রভু! তাদেরকে তোমার পবিত্র ঘর ধ্বংস করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ করে দাও। হে প্রভু! তোমার বান্দা নিজের ঘরকে রক্ষা করে। তাই তুমিও তোমার ঘরকে রক্ষা কর। ঐ দিনকে (আমাদের কাছে) আসতে দিও না যে দিন তাদের ক্রুশ জয়যুক্ত হবে,আর তাদের প্রতারণাও সফল ও বিজয়ী হবে। 111

এরপর তিনি কাবাগৃহের দরজার কড়া ছেড়ে দিয়ে পর্বতশৃঙ্গে ফিরে আসলেন এবং সেখান থেকে পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। প্রভাতে যখন আবরাহা ও তার সেনাবাহিনী মক্কাভিমুখে রওয়ানা হল তখন হঠাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি সমুদ্রের দিক থেকে আকাশে আবির্ভূত হলো যেগুলোর প্রতিটির মুখ ও পায়ে ছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাথর। পাখিদের ছায়ায় সৈন্যশিবিরের আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল। বাহ্যিকভাবে এগুলোর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্ত্র অতি বিস্ময়কর প্রভাব ও ফলাফল সৃষ্টি করল। মহান আল্লাহর নির্দেশে ঐ সব পাখি আবরাহার বাহিনীর ওপর পাথর বর্ষণ করল যার ফলে তাদের মাথা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল এবং দেহের মাংসগুলো খসে পড়ল। একটি ক্ষুদ্র পাথর আবরাহার মাথায়ও আঘাত করলে সে খুব ভয় পেয়ে গেল এবং তার দেহে কম্পন শুরু হলো। সে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারল যে,মহান আল্লাহর ক্রোধ ও গজব তাকে ঘিরে ফেলেছে। সেনাদলের দিকে তাকালে সে দেখতে পেল যে,তাদের মৃতদেহগুলো গাছের পাতা ঠিক যেভাবে মাটিতে পড়ে থাকে ঠিক সেভাবে মাটিতে পড়ে আছে। কালবিলম্ব না করে তার সেনাবাহিনীর যারা বেঁচে আছে,যে পথ ধরে তারা এসেছিল ঠিক সে পথেই ইয়েমেনের রাজধানী সানাআয় ফিরে যাবার জন্য সে নির্দেশ দিল। আবরাহার সেনাদলের মধ্যে থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া সৈন্যরা সানাআর দিকে রওয়ানা হলো। কিন্তু পথিমধ্যে অনেক সৈন্যই ক্ষত ও ভীতিজনিত কারণে প্রাণত্যাগ করল,এমনকি আবরাহাও যখন সানাআয় পৌঁছল তখন তার শরীরের মাংস খসে পড়ল এবং আশ্চর্যজনক অবস্থার মধ্যে তার মৃত্যু হলো।

বিস্ময়কর ও ভীতিপ্রদ এ ঘটনাটি পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করল। হাতিওয়ালাদের কাহিনী পবিত্র কোরআনের সূরা ফীল-এ এভাবে বর্ণিত হয়েছে : আপনি কি দেখেন নি যে,আপনার প্রভু হাতিওয়ালাদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন? তাদের ষড়যন্ত্র কি তিনি ব্যর্থ করে দেন নি? তিনি তাদের ওপর এক ঝাঁক পাখি প্রেরণ করেছিলেন যেগুলো তাদের ওপর পোড়ামাটির তৈরি কঙ্কর নিক্ষেপকরতঃ তাদেরকে চর্বিত ঘাস ও পাতার মতো পিষ্ট করে দিয়েছিল।”

) بسم الله الرّحمان الرّحيم -ألم تر كيف فعل ربّك بأصحاب الفيل-ألم يجعل كيدهم في تضليل-و أرسل عليهم طيرا أبابيل-ترميهم بحجارة من سجيل-فجعلهم كعصف مأكول(

আমরা এখন যা কিছু আলোচনা করলাম আসলে তা এ ক্ষেত্রে বর্ণিত ইসলামী ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহের সারসংক্ষেপ এবং পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বর্ণনাও ঠিক এটিই। এখন আমরা প্রখ্যাত মিশরীয় মুফাসসির মুহাম্মদ আবদুহু’এবং মিশরের ভূতপূর্ব সংস্কৃতিমন্ত্রী প্রখ্যাত পণ্ডিত (ড. হাইকাল) এতৎসংক্রান্ত যা বলেছেন তা পর্যালোচনা করে দেখব।

হাতির বছরের গোলযোগ

কোন জাতির মধ্যে যে মহাঘটনা সংঘটিত হয় এবং কখনো কখনো যা ধর্মীয় ভিত্তিমূল এবং কখনো কখনো জাতীয় ও রাজনৈতিক ভিত্তিমূলের অধিকারী তা সাধারণ জনগণের আশ্চর্য ও বিস্ময়বোধের কারণে তারিখ ও গণনার সূচনা বা উৎস বলে গণ্য হয়। যেমন ইয়াহুদী জাতির মুক্তির জন্য হযরত মূসা (আ.)-এর আন্দোলন,খ্রিষ্টানদের জন্য হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম তারিখ এবং মুসলমানদের ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর হিজরত হচ্ছে তারিখ গণনার উৎস যা দিয়ে প্রতিটি ধর্মের অনুসারিগণ তাদের জীবনের ঘটনাসমূহের উদ্ভবের সময়কাল নির্ণয় ও পরিমাপ করে থাকে।

কখনো কখনো কোন জাতি মৌলিক ইতিহাস ও তারিখের অধিকারী হওয়ার কারণে কিছু কিছু ঘটনাকেও তাদের তারিখ গণনার ভিত্তি ও উৎস হিসাবে নির্ধারণ করেছে। যেমন পাশ্চাত্যের দেশসমূহে মহান ফরাসী বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে 1917 খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরের কম্যুনিস্ট আন্দোলন ঐ সব দেশে যে সব ঘটনাপ্রবাহের উদ্ভব হয় সেগুলোর অনেক কিছুর তারিখ গণনার ভিত্তি বা উৎস হিসাবে গণ্য করা হযেছে। যে সব অনগ্রসর জাতি এ ধরনের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলন থেকে বঞ্চিত সে সব জাতি স্বাভাবিকভাবে অসাধারণ ঘটনাবলীকে তাদের ইতিহাস ও তারিখ গণনার ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করে। এ কারণেই জাহেলী আরবগণ সঠিক কৃষ্টি ও সভ্যতার অধিকারী না হওয়ায় যুদ্ধ,ভূমিকম্প,দুর্ভিক্ষ অথবা অলৌকিক ঘটনাবলীকে নিজেদের ইতিহাস ও তারিখ গণনার উৎস হিসাবে গণ্য করেছে। এ কারণেই ইতিহাসের পাতায় পাতায় আমরা আরব জাতির তারিখ গণনার ভিন্ন ভিন্ন ভিত্তি দেখতে পাই। এসব ভিত্তির মধ্যে সর্বশেষ ভিত্তি হচ্ছে হাতির বছরের ঘটনা এবং পবিত্র কাবাগৃহকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে আবরাহার মক্কা আক্রমণের ঘটনা যা অন্যান্য ঘটনার তারিখ গণনার ভিত্তি হিসাবে গণ্য হয়েছে। এখন আমরা 570 খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত মহাঘটনাটির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করব এবং এখানে স্মর্তব্য যে,মহানবী (সা.)ও এই একই বছরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

এ ঘটনার উৎস

আসহাবে ফীল অর্থাৎ হস্তিবাহিনীর ঘটনা পবিত্র কোরআনে সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণিত হয়েছে। আর আমরা এ ঘটনা বর্ণনা করার পর যে সব আয়াত এ ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে তা উল্লেখ করব। ইতিহাস রচয়িতাগণ এ ঘটনার মূল কারণ সম্পর্কে লিখেছেন : ইয়েমেনের বাদশাহ্ যূনুওয়াস তার সরকারের ভিত্তি মজবুত করার পর কোন এক সফরে মদীনা অতিক্রম করছিল। তখন মদীনা এক অতি উত্তম ধর্মীয় মর্যাদার অধিকারী ছিল। সে সময় একদল ইয়াহুদী ঐ শহরে বসতি স্থাপন করে প্রচুর মন্দির ও ইবাদাতগাহ্ নির্মাণ করেছিল। সুযোগসন্ধানী ইয়াহুদিগণ বাদশার আগমনকে এক সুবর্ণ সুযোগ মনে করে বাদশাহকে ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানায়। তাদের এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্যে ছিল নব্য ইয়াহুদী ধর্মে দীক্ষিত বাদশাহ্ যূনুওয়াসের শাসনাধীনে রোমের খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিক আরবের হামলা থেকে নিরাপদ থাকা এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করা। এ ব্যাপারে তাদের প্রচার খুব ফলপ্রসূ হয়েছিল। যূনুওয়াস ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহণ করল এবং এ ধর্ম প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছিল। অনেকেই ভীত হয়ে তার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। সে একদল জনতাকে বিরোধিতা করার জন্য কঠোর শাস্তি প্রদান করে। তবে নাজরানের অধিবাসিগণ যারা বেশ কিছুদিন আগেই খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা কোনক্রমেই খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে ইয়াহুদী ধর্মের অনুশাসন অনুসরণ করতে প্রস্তুত ছিল না।ইয়েমেনের বাদশার বিরুদ্ধাচরণ এবং অবজ্ঞা করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ছিল। বাদশাহ্ যূনুওয়াস এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে নাজরানের বিদ্রোহীদেরকে দমন করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। সেনাপতি নাজরান শহরের পাশে সেনা শিবির ও তাঁবু স্থাপন করে এবং পরিখা খনন করার পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়;আর বিদ্রোহীদেরকে ঐ আগুনে জীবন্ত দগ্ধ করার হুমকি প্রদর্শন করতে থাকে। নাজরানের অকুতোভয় সাহসী জনতা যারা মনে-প্রাণে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা এতে মোটেও ভীত না হয়ে মৃত্যু ও জীবন্ত দগ্ধ হওয়াকে সানন্দে বরণ করে নেয়। তাদের দেহগুলো সেই আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়েছিল।110

ইসলামী ইতিহাসবেত্তা ইবনে আসীর জাযারী লিখেছেন : এ সময় দূস নামক একজন নাজরানবাসী খ্রিষ্টধর্মের গোঁড়া সমর্থক রোমান সম্রাট কাইসারের কাছে গমন করে তাঁকে পুরো ঘটনা অবহিত করল এবং রক্তপিপাসু যূনুওয়াসকে শাস্তি প্রদান এবং অত্র এলাকায় খ্রিষ্টধর্মের ভিত মজবুত ও শক্তিশালী করার আবেদন জানাল। রোমের অধিপতি গভীর দুঃখ ও সমবেদনা প্রকাশ করে বলেন, আপনাদের দেশ থেকে আমার সাম্রাজ্যের রাজধানী অনেক দূরে অবস্থিত বিধায় এ ধরনের অত্যাচারের প্রতিকার বিধানার্থে হাবাশার বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে একটি চিঠি লিখছি যাতে করে তিনি ঐ রক্তপিপাসু নরপিশাচের কাছ থেকে নাজরানের নিহতদের প্রতিশোধ নিতে পারেন। ঐ নাজরানবাসী কাইসারের চিঠি নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব হাবাশার দিকে রওয়ানা হয়ে গেল এবং বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে পুরো ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করল। ফলে বাদশার শিরা ও ধমনীতে তীব্র আত্মসম্মানবোধ ও চেতনাবোধের রক্ত প্রবাহিত হয়ে গেল। তিনি আবরাহাতুল আশরাম নামক এক হাবাশী সেনাপতির নেতৃত্বে 70 হাজারের এক বিশাল সেনাবাহিনী ইয়েমেনের দিকে প্রেরণ করেন। হাবাশার উক্ত সুশৃঙ্খল ও সুসজ্জিত সেনাবাহিনীটি সমুদ্রপথে ইয়েমেনের সৈকতে তাঁবু স্থাপন করে। এ ব্যাপারে সচেতন না থাকার কারণে যূনুওয়াসের আর কিছুই করার ছিল না। সে যতই চেষ্টা করল তাতে কোন ফল হলো না। প্রতিরোধ ও যুদ্ধ করার জন্য যতই গোত্রপতিদের নিকট আহবান জানাল তাতে তাদের পক্ষ থেকে সে কোন সাড়া পেল না। পরিণতিতে আবরাহার এক সংক্ষিপ্ত আক্রমণের মুখে যূনুওয়াসের প্রশাসনের ভিত ধসে পড়ে এবং সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী ইয়েমেন হাবাশাহ্ সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে যায়।

আবরাহা প্রতিশোধ ও বিজয়ের মদমত্ততায় চূর ও মাতাল হয়েছিল। সে যৌনকামনা ও আমোদ-প্রমোদে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মোটেও বিরত থাকত না। সে হাবাশার বাদশার নৈকট্য ও দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ইয়েমেনের রাজধানী সানআ নগরীতে একটি জমকালো গীর্জা নির্মাণ করে যা ছিল ঐ যুগে অতুলনীয়। তারপর সে বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে এই মর্মে পত্র লেখে, গীর্জা নির্মাণ কাজ প্রায় সমাপ্ত হওয়ার পথে। ইয়েমেনের সকল অধিবাসীকে কাবার যিয়ারত করা থেকে বিরত এবং এই গীর্জাকে সাধারণ জনগণের জন্য তাওয়াফস্থল করার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছি।” চিঠিটির মূল বক্তব্য প্রচারিত হলে সমগ্র আরব গোত্রগুলোর মধ্যে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল,এমনকি বনি আফকাম গোত্রের এক মহিলা উক্ত মন্দিরের চত্বরকে নোংরা করে দিল। এ ধরনের কাজ যার মাধ্যমে আবরাহার গীর্জার প্রতি আরবদের পূর্ণ অবজ্ঞা,শত্রুতা ও অবহেলা প্রকাশ পেয়েছে তা তদানীন্তন আবরাহা প্রশাসনকে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ করে তোলে। অন্যদিকে গীর্জার বাহ্যিক সৌন্দর্য ও সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রে যত চেষ্টা চালানো হয়েছে ততই পবিত্র কাবার প্রতি জনগণের আকর্ষণ ও ভালোবাসা তীব্র হতে থাকে। এ সব ঘটনাপ্রবাহের কারণে আবরাহা পবিত্র কাবা ধ্বংস করার শপথ নেয়। এজন্য আবরাহা এক বিশাল বাহিনী গঠন করে যার সম্মুখভাগে ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুসজ্জিত অনেক লড়াকু হাতি। তাওহীদী মতাদর্শের প্রাণপুরুষ হযরত ইবরাহীম খলীল (আ.) যে গৃহটির পুননির্মাণ করেছিলেন আবরাহা তা ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিস্থিতি যে অত্যন্ত ভয়াবহ ও অতি সংবেদনশীল তা প্রত্যক্ষকরতঃ আরবের গোত্রপতিদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে,আরব জাতির স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব পতনের সম্মুখীন। কিন্তু আবরাহার অতীত সাফল্যসমূহ তাদেরকে যে কোন উপকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত রেখেছিল। এতদ্সত্ত্বেও আবরাহার গমনপথের ওপর অরব গোত্রগুলোর কতিপয় আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন নেতা পূর্ণ বীরত্বসহকারে আবরাহার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যেমন যূনাফার যিনি নিজেও এক অভিজাত বংশোদ্ভূত ছিলেন তিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদান করে তাঁর নিজ গোত্রকে পবিত্র কাবাগৃহ রক্ষা করার উদাত্ত আহবান জানান। কিন্তু অতি অল্পদিনের মধ্যেই আবরাহার বিশাল বাহিনী তাঁদের ব্যুহসমূহ ভেদ করে দেয়। এরপর নুফাইল বিন হাবীব তীব্র প্রতিরোধ ও সংগ্রাম গড়ে তোলে,কিন্তু সেও পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয় এবং আবরাহার বাহিনীর হাতে বন্দী হয়। তাকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য সে (নুফাইল) আবরাহার কাছে আবেদন জানালে আবরাহা তাকে বলেছিল, আমাদেরকে মক্কা নগরী অভিমুখে যদি তুমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও তাহলে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব।” তাই নুফাইল আবরাহাকে তায়েফ নগরী পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় এবং পবিত্র মক্কা নগরী পর্যন্ত অবশিষ্ট পথ দেখানোর দায়িত্ব নুফাইল আবু রাগাল নামক তারই এক বন্ধুর ওপর ন্যস্ত করে। নতুন পথ-প্রদর্শক আবরাহার সেনাবাহিনীকে পবিত্র মক্কা নগরীর নিকটবর্তী মাগমাস নামক স্থানে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। আবরাহার সেনাবাহিনী ঐ স্থানকে সেনা ছাউনি ও তাঁবু স্থাপন করার জন্য মনোনীত করে। আর আবরাহা তার চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী একজন সেনাপতিকে তিহামার উট ও গবাদিপশু লুণ্ঠন করার দায়িত্ব দেয়। প্রায় 200টি উট লুণ্ঠন করা হয়। লুণ্ঠিত এ সব উটের মালিক ছিলেন মক্কাপ্রধান আবদুল মুত্তালিব। অতঃপর হানাতাহ্ নামীয় এক সেনাপতিকে আবরাহা মক্কার কুরাইশ নেতা ও প্রধানের কাছে তার বাণী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব অর্পণ করে বলেছিল, কাবাগৃহ ধ্বংস করার প্রকৃত চিত্র যেন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে! আর নিশ্চিতভাবে কুরাইশরা প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তবে রক্তপাত এড়ানোর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে মক্কার পথ ধরে এগিয়ে যাবে। সেখানে পৌঁছে কুরাইশ প্রধানের খোঁজ করে সরাসরি তার কাছে গিয়ে বলবে : আমাদের মূল লক্ষ্যই হলো কাবাগৃহ ধ্বংস করা। কুরাইশরা যদি প্রতিরোধ না করে তাহলে তারা যে কোন হামলা ও আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকবে।”

আবরাহার প্রেরিত দূত পবিত্র মক্কায় পৌঁছেই কুরাইশদের বিভিন্ন দলকে আবরাহার সামরিক অভিযান সম্পর্কে আলোচনারত দেখতে পেল। মক্কাপ্রধানের খোঁজ করলে তাকে আবদুল মুত্তালিবের গৃহে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। আবদুল মুত্তালিব আবরাহার বাণী শোনার পর বললেন, আমরা কখনই প্রতিরক্ষা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলব না। কাবা মহান আল্লাহর গৃহ যার নির্মাতা হযরত ইবরাহীম খলীল (আ.)। মহান আল্লাহ্ যা কল্যাণকর তা-ই করবেন।” আবরাহার সেনাপতি কুরাইশপ্রধানের এ ধরনের কোমল ও শান্তিপূর্ণ যুক্তি যা প্রকৃত সুমহান আত্মিক ঈমানেরই পরিচায়ক তা শ্রবণ করে সন্তোষ প্রকাশ করল এবং তার সাথে আবরাহার তাঁবুতে আসার আমন্ত্রণ জানাল।

আবরাহার শিবিরে আবদুল মুত্তালিব-এর গমন

আবদুল মুত্তালিব তাঁর কয়েক সন্তানসহ আবরাহার শিবিরের দিকে রওয়ানা হলেন। কুরাইশপ্রধানের মহত্ত্ব,স্থিরতা,ধৈর্য,গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিত্ব আবরাহাকে বিস্ময়াভিভূত করে ফেলে। এ কারণেই সে আবদুল মুত্তালিবের প্রতি অত্যন্ত ভক্তি,শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শন করেছিল। এর প্রমাণস্বরূপ,সে সিংহাসন থেকে নিচে নেমে এসে আবদুল মুত্তালিবের হাত ধরে তাঁকে তার নিজের পাশে বসিয়েছিল। এরপর সে পূর্ণ ভদ্রতা ও শিষ্টাচারসহকারে দোভাষীর মাধ্যমে আবদুল মুত্তালিবকে প্রশ্ন করেছিল যে,তিনি কেন এখানে এসেছেন এবং তিনি কী চাচ্ছেন? আবদুল মুত্তালিব আবরাহার প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, তিহামার উটগুলো এবং যে দু শ’উটের মালিক আমি সেগুলো আপনার সৈন্যদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়েছে। আপনার কাছে আমার অনুরোধ এটিই যে,অনুগ্রহপূর্বক ঐ সকল উট স্ব স্ব মালিকের কাছে ফেরত দেয়ার আদেশ দিন।” আবরাহা বলল, আপনার আলোকিত বদনমণ্ডল আপনাকে আমার কাছে এক জগৎ পরিমাণ মহান ও বিরাট করে তুলেছে,অথচ (যখন আমি এসেছি আপনার পূর্বপুরুষদের ইবাদাতগাহ্ ধ্বংস করতে) তখন আপনার ছোট ও অতি সামান্য আবেদন আপনার মহত্ত্ব,উচ্চ সম্মান ও মর্যাদাকে কমিয়ে দিয়েছে। আমি আশা করেছিলাম যে,আপনি কাবার ব্যাপারে আলোচনা করবেন এবং অনুরোধ জানাবেন যে,আমার যে লক্ষ্য আপনাদের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের ওপর মারাত্মক আঘাত হানবে তা থেকে অমি যেন বিরত থাকি। না,পক্ষান্তরে আপনি কয়েকটি মূল্যহীন উটের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন এবং সেগুলো ছেড়ে দেয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন? আবদুল মুত্তালিব আবরাহার প্রশ্নের জবাবে একটি বাক্য বলেছিলেন যা আজও তাঁর নিজস্ব মহত্ত্ব,গৌরব এবং মান বজায় রেখেছে। আর ঐ বাক্যটি ছিল :

أنا ربّ الإبل و للبيت ربّ يمنعه

“আমি উটগুলোর প্রতিপালনকারী এবং পবিত্র কাবারও এমন এক প্রভু আছেন যিনি (সব ধরনের আগ্রাসন,আক্রমণ এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে) উক্ত গৃহকে রক্ষা করবেন।” আবরাহা এ কথা শোনার পর খুবই দাম্ভিকতার সাথে বলেছিল, এ পথে আমার লক্ষ্য অর্জনে বাধা দেয়ার শক্তি কারো নেই।” এরপর সে লুণ্ঠিত সব ধন-সম্পদ প্রকৃত মালিকদের কাছে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল।

অধীর আগ্রহে কুরাইশদের অপেক্ষা

সমগ্র কুরাইশ গোত্র অধীর আগ্রহে আবদুল মুত্তালিবের ফেরার অপেক্ষায় ছিল যাতে করে তারা শত্রুর সাথে তাঁর আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে অবগত হতে পারে। যখন আবদুল মুত্তালিব কুরাইশ গোত্রপতিদের মুখোমুখি হলেন তখন তিনি তাদেরকে বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের গবাদিপশু নিয়ে উপত্যকা ও পাহাড়-পর্বতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ কর। এর ফলে তোমরা সবাই যে কোন ধরনের ক্ষতি ও বিপদাপদ থেকে নিরাপদে থাকতে পারবে।” এ কথা শোনার পর অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সকল মক্কাবাসী তাদের নিজেদের ঘর-বাড়ী ছেড়ে পাহাড়-পর্বতে গিয়ে আশ্রয় নিল। মধ্যরাত্রিতে শিশু ও নারীদের ক্রন্দনধবনি এবং পশুসমূহের আর্তনাদ সমগ্র পাহাড়-পর্বতে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ঐ সময় আবদুল মুত্তালিব কয়েকজন কুরাইশসহ পর্বতশৃঙ্গ থেকে নেমে এসে পবিত্র কাবায় গেলেন। ঐ সময় তাঁর চোখের চারপাশে অশ্রুবিন্দু জমেছিল। তিনি ব্যথিত অন্তরে পবিত্র কাবার দরজার কড়া হাতে নিয়ে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন, হে ইলাহী! তাদের (আবরাহা ও তার বিশাল সেনাবাহিনী) অনিষ্ট সাধন ও ক্ষয়ক্ষতি করা থেকে নিরাপদ থাকার ব্যাপারে কেবল তুমি ছাড়া আর কারো প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র আশা নেই। হে প্রভু! তাদেরকে তোমার পবিত্র গৃহের অঙ্গন ও সীমানা থেকে প্রতিহত কর। সে-ই কাবার দুশমন যে তোমার সাথে শত্রুতা পোষণ করে। হে প্রভু! তাদেরকে তোমার পবিত্র ঘর ধ্বংস করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ করে দাও। হে প্রভু! তোমার বান্দা নিজের ঘরকে রক্ষা করে। তাই তুমিও তোমার ঘরকে রক্ষা কর। ঐ দিনকে (আমাদের কাছে) আসতে দিও না যে দিন তাদের ক্রুশ জয়যুক্ত হবে,আর তাদের প্রতারণাও সফল ও বিজয়ী হবে। 111

এরপর তিনি কাবাগৃহের দরজার কড়া ছেড়ে দিয়ে পর্বতশৃঙ্গে ফিরে আসলেন এবং সেখান থেকে পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। প্রভাতে যখন আবরাহা ও তার সেনাবাহিনী মক্কাভিমুখে রওয়ানা হল তখন হঠাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি সমুদ্রের দিক থেকে আকাশে আবির্ভূত হলো যেগুলোর প্রতিটির মুখ ও পায়ে ছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাথর। পাখিদের ছায়ায় সৈন্যশিবিরের আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল। বাহ্যিকভাবে এগুলোর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্ত্র অতি বিস্ময়কর প্রভাব ও ফলাফল সৃষ্টি করল। মহান আল্লাহর নির্দেশে ঐ সব পাখি আবরাহার বাহিনীর ওপর পাথর বর্ষণ করল যার ফলে তাদের মাথা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল এবং দেহের মাংসগুলো খসে পড়ল। একটি ক্ষুদ্র পাথর আবরাহার মাথায়ও আঘাত করলে সে খুব ভয় পেয়ে গেল এবং তার দেহে কম্পন শুরু হলো। সে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারল যে,মহান আল্লাহর ক্রোধ ও গজব তাকে ঘিরে ফেলেছে। সেনাদলের দিকে তাকালে সে দেখতে পেল যে,তাদের মৃতদেহগুলো গাছের পাতা ঠিক যেভাবে মাটিতে পড়ে থাকে ঠিক সেভাবে মাটিতে পড়ে আছে। কালবিলম্ব না করে তার সেনাবাহিনীর যারা বেঁচে আছে,যে পথ ধরে তারা এসেছিল ঠিক সে পথেই ইয়েমেনের রাজধানী সানাআয় ফিরে যাবার জন্য সে নির্দেশ দিল। আবরাহার সেনাদলের মধ্যে থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া সৈন্যরা সানাআর দিকে রওয়ানা হলো। কিন্তু পথিমধ্যে অনেক সৈন্যই ক্ষত ও ভীতিজনিত কারণে প্রাণত্যাগ করল,এমনকি আবরাহাও যখন সানাআয় পৌঁছল তখন তার শরীরের মাংস খসে পড়ল এবং আশ্চর্যজনক অবস্থার মধ্যে তার মৃত্যু হলো।

বিস্ময়কর ও ভীতিপ্রদ এ ঘটনাটি পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করল। হাতিওয়ালাদের কাহিনী পবিত্র কোরআনের সূরা ফীল-এ এভাবে বর্ণিত হয়েছে : আপনি কি দেখেন নি যে,আপনার প্রভু হাতিওয়ালাদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন? তাদের ষড়যন্ত্র কি তিনি ব্যর্থ করে দেন নি? তিনি তাদের ওপর এক ঝাঁক পাখি প্রেরণ করেছিলেন যেগুলো তাদের ওপর পোড়ামাটির তৈরি কঙ্কর নিক্ষেপকরতঃ তাদেরকে চর্বিত ঘাস ও পাতার মতো পিষ্ট করে দিয়েছিল।”

) بسم الله الرّحمان الرّحيم -ألم تر كيف فعل ربّك بأصحاب الفيل-ألم يجعل كيدهم في تضليل-و أرسل عليهم طيرا أبابيل-ترميهم بحجارة من سجيل-فجعلهم كعصف مأكول(

আমরা এখন যা কিছু আলোচনা করলাম আসলে তা এ ক্ষেত্রে বর্ণিত ইসলামী ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহের সারসংক্ষেপ এবং পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বর্ণনাও ঠিক এটিই। এখন আমরা প্রখ্যাত মিশরীয় মুফাসসির মুহাম্মদ আবদুহু’এবং মিশরের ভূতপূর্ব সংস্কৃতিমন্ত্রী প্রখ্যাত পণ্ডিত (ড. হাইকাল) এতৎসংক্রান্ত যা বলেছেন তা পর্যালোচনা করে দেখব।


14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38