কোরআনে স্ববিরোধিতা নেই
বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন , তথ্যাভিজ্ঞ ও অভিজ্ঞতার অধিকারী যে কোনো লোকই অত্যন্ত ভালোভাবেই জানেন যে , যে কেউই মিথ্যা ও মনগড়া ভিত্তির ওপর নির্ভর করে আইন-কানূন ও ধর্মীয় বিধিবিধান রচনা করবে বা কোনো বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করবে তার বক্তব্যে এবং তার রচিত আইন-কানূন ও ধর্মীয় বিধিবিধানে অবশ্যই বহু বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা বিদ্যমান থাকবে। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি‘
আক্বীদাহ্-বিশ্বাস , নৈতিকতা ও চরিত্র সম্বন্ধে দিকনির্দেশনা প্রদান করে এবং মানুষের জীবনধারা ও সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন সূক্ষ্ম বিষয়ে আইন রচনা করে ও মিথ্যার ব্যবসায়ে অবতীর্ণ হয় , আর তার আইন-বিধানের আওতা সর্বজনীন হয় , তাহলে এ স্ববিরোধিতা ও বৈপরীত্য অধিকতর প্রকট রূপ ধারণ করবে। কারণ , ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়ই হোক , মিথ্যাবাদী তার বক্তব্যে স্ববিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবেই। এ থেকে বাঁচার কোনো পথই তার সামনে খোলা থাকে না। কারণ , এটাই মানবিক প্রকৃতির দাবী। তাই প্রবাদ বাক্যে যথার্থভাবেই বলা হয়েছে : মিথ্যাবাদীর স্মরণশক্তি থাকে না।
কিন্তু কোরআন মজীদ মানবজীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে এবং তা-ও অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তারিতভাবে মতামত ব্যক্ত করা সত্ত্বেও এতে সামান্যতম বৈপরীত্য বা স্ববিরোধিতার অস্তিত্ব নেই।
কোরআন মজীদ আল্লাহ্ তা‘
আলার পরিচয় উপস্থাপন করেছে , নবুওয়াত্ প্রসঙ্গে আলোচনা করেছে এবং রাজনৈতিক বিষয়াদি , সমাজ ও সভ্যতার পরিচালনা এবং চরিত্র , নৈতিকতা ও এতদসহ মানবজীবনের সমস্ত দিক-বিভাগের ওপর আইন-বিধান প্রণয়ন করেছে। তেমনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয় , যেমন : নক্ষত্রবিজ্ঞান , ইতিহাস , যুদ্ধ ও শান্তির বিধান , আসমান ও যমীনের বিভিন্ন সৃষ্টি , যেমন : ফেরেশতা , গ্রহ-নক্ষত্র , বায়ু , সমুদ্র , উদ্ভিদ , পশু-পাখী ও মানুষ - সব কিছু সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছে এবং বিভিন্ন ধরনের উপমা উপস্থাপন করেছ , এছাড়া ক্বিয়ামতের বিভীষিকাময় দৃশ্যাবলী তুলে ধরেছে এবং অন্য যে কোনো কঠিন বিষয়েই বক্তব্য উপস্থাপন করেছে।
কিন্তু এতো বেশী ও বিচিত্র ধরনের বিষয়ে কথা বলা সত্ত্বেও কোরআন মজীদের উপস্থাপিত আইন-কানুন , ধর্মীয় বিধিবিধান ও পেশকৃত মতামতে সামান্যতম স্ববিরোধিতারও অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে এ সমস্ত বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে কোরআন মজীদ কোথাওই বিচারবুদ্ধি ও প্রজ্ঞাময়তার সীমারেখা লঙ্ঘন করে নি।
কোরআন মজীদ ক্ষেত্রবিশেষে কোনো একটি বিষয়ে দুই জায়গায় বা ততোধিক জায়গায় বক্তব্য রেখেছে , কিন্তু তা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উপস্থাপিত বিভিন্ন বক্তব্যের মধ্যে কোনোরূপ স্ববিরোধিতার অস্তিত্ব নেই। দৃষ্টান্ত স্বরূপ , কোরআন মজীদে হযরত মূসার (‘
আঃ) প্রসঙ্গটি লক্ষ্য করা যেতে পারে। কোরআন মজীদে এ প্রসঙ্গটি পুনঃপুনঃ এবং বেশ কয়েক বার উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই , যেখানেই হযরত মূসার (‘
আঃ) প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে সেখানেই তা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী - যে বৈশিষ্ট্যটি অন্য যেখানে এ প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে সেখানে বিদ্যমান নেই। অথচ তা সত্ত্বেও মূল বিষয় তথা কাহিনীর প্রশ্নে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপস্থাপিত বক্তব্যের মধ্যে কোনোরূপ বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা বিদ্যমান নেই।
অন্যদিকে এ বিষয়টির প্রতি যদি লক্ষ্য করা হয় যে , কোরআন মজীদের আয়াত সমূহ একবারে নাযিল্ হয় নি , বরং সুদীর্ঘ তেইশ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে এবং সমকালীন ঘটনাবলীকে উপলক্ষ্য করে নাযিল্ হয়েছে , তাহলে তা থেকেও এটা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হবে যে , কোরআন মজীদ মহান আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে নাযিল্ হয়েছে এবং এরূপ গ্রন্থ রচনা করা মানবিক প্রতিভার ক্ষমতা বহির্ভূত। কারণ , কালের প্রবাহ ও সময়ের ব্যবধানের দাবী এই যে , এরূপ দীর্ঘ সময় ধরে মানুষ কোনো গ্রন্থ রচনা করলে তার বিভিন্ন অংশের মধ্যে স্ববিরোধিতা ও বৈপরীত্য , কমপক্ষে অসামঞ্জস্য , থাকতেই হবে।
এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , বড় বড় মনীষী ও কবি-সাহিত্যিকগণ পর্যন্ত সাধারণতঃ দীর্ঘদিন সময় নিয়ে কোনো গ্রন্থ রচনা করলে শেষের দিকে গিয়ে প্রথম দিকের লেখা কম-বেশী সংশোধন করেন। এ সংশোধন যেমন হয় তথ্যগত দিক থেকে , তেমনি ভাষার মান ও প্রকাশ-সৌন্দর্যের দিক থেকে। মতামত , পর্যালোচনা , পরিকল্পনা ও উপদেশ থাকলেও তাতেও কম-বেশী সংশোধন করা হয়। আর বক্তব্যের সাথে যদি চলমান ঘটনাবলীর সম্পর্ক থাকে সে ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন অনেক বেশী সাধিত হয়। শুধু তা-ই নয় , এমনকি একবার প্রকাশিত গ্রন্থ লেখকের জীবদ্দশায় দ্বিতীয় বার প্রকাশিত হলে লেখক তা পরিমার্জিত করেন। কারণ , কালের ব্যবধানে স্বয়ং লেখকের কাছেও তাঁর লেখার কিছু , দুর্বলতা , ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা ধরা পড়ে এবং তিনি বুঝতে পারেন যে , এটি আরো ভালো হওয়া উচিত , তাই তিনি তা সংশোধন করেন।
কিন্তু কোরআন মজীদ খোদায়ী গ্রন্থ বিধায়ই তেইশ বছর আগে এ গ্রন্থের যে অংশ পরিবেশন করা হয়েছে তেইশ বছর পরে পরিবেশিত অংশের সাথে তার কোনো সাংঘর্ষিকতা দেখা দেয় নি বা মানগত দিক থেকে পূর্ববর্তী অংশ সমূহ ও পরবর্তী অংশসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য পূর্ববর্তী অংশসমূহের পরিমার্জনের প্রয়োজন হয় নি।
কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি , এ দুই দৃষ্টিকোণের বিচারেই কোরআন মজীদ স্বীয় অলৌকিকতা রক্ষা করেছে। অর্থাৎ কোরআন মজীদ যখন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এবং খণ্ড-খণ্ড ভাবে নাযিল্ হয়েছে , তখন খণ্ড-খণ্ডরূপেই তা মু‘
জিযাহ্ ছিলো , আর যখন তা খণ্ড-খণ্ড রূপ পরিত্যাগ করে একত্রে গ্রথিত হলো তখন তাতে অলৌকিকতার আরেকটি দিক ফুটে উঠেছে।
স্বয়ং কোরআন মজীদও তার এ বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছে। এরশাদ হয়েছে:
)
افلا يتدبرون القرآن و لو کان من عند غير الله لوجدوا فيه اختلافاً کثيراً(
“
তারা কি কোরআন সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করে না ? এ কোরআন যদি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে হতো তাহলে অবশ্যই এতে বহু বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা পাওয়া যেতো।”
(সূরাহ্ আন্-নিসাা’
: 82)
কোরআন মজীদের এ আয়াত মানুষকে একটি স্বভাবসম্মত ও বিচারবুদ্ধিগ্রাহ্য বিষয়ের দিকে পথনির্দেশ করেছে। তা হচ্ছে , যে কেউই তার দাবীতে ও বক্তব্যে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করবে তার প্রকাশিত মতামতে অবশ্যই স্ববিরোধিতা থাকবে। কিন্তু আসমানী গ্রন্থ কোরআন মজীদে কোনোরূপ স্ববিরোধিতার অস্তিত্ব নেই। অতএব , নিঃসন্দেহে প্রমাণিত যে , এ গ্রন্থ মানবিক প্রতিভার ফসল নয় এবং মিথ্যার ওপরে ভিত্তি করে উপস্থাপিত হয় নি।
বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা থেকে কোরআন মজীদের মুক্ততার বিষয়টি এতোই সুস্পষ্ট ও অকাট্য যে , এর সপক্ষে নতুন করে কোনো দলীল-প্রমাণ উপস্থাপনের প্রয়োজন নেই। কারণ , ইসলামের দুশমন তৎকালীন আরবরা পর্যন্ত কোরআন মজীদের এ বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ্য করেছিলো এবং তাদের মধ্যকার কাব্য , সাহিত্য ও ভাষণশিল্পের শ্রেষ্ঠতম প্রতিভাসমূহ তা স্বীকার করেছিলো।
অন্যদিকে আসমানী কিতাব্ নামে অভিহিত বর্তমানে প্রচলিত বাইবেলের‘
পুরাতন নিয়ম’
ও‘
নতুন নিয়ম’
ভুক্ত পুস্তকসমূহ অভিনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করলে এবং এতে পরিদৃষ্ট স্ববিরোধিতা সমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে যে কারো নিকট সত্য অত্যন্ত সুস্পষ্টরূপে ধরা পড়বে এবং সত্য ও মিথ্যা উভয়ই স্ব স্ব চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হবে।