কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্ 0%

কোরআনের মু‘জিযাহ্ লেখক:
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 46673
ডাউনলোড: 4355

পাঠকের মতামত:

কোরআনের মু‘জিযাহ্
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 60 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 46673 / ডাউনলোড: 4355
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

সামঞ্জস্যের বিচারে কোরআনের অলৌকিকতা

কোরআনে স্ববিরোধিতা নেই

বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন , তথ্যাভিজ্ঞ ও অভিজ্ঞতার অধিকারী যে কোনো লোকই অত্যন্ত ভালোভাবেই জানেন যে , যে কেউই মিথ্যা ও মনগড়া ভিত্তির ওপর নির্ভর করে আইন-কানূন ও ধর্মীয় বিধিবিধান রচনা করবে বা কোনো বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করবে তার বক্তব্যে এবং তার রচিত আইন-কানূন ও ধর্মীয় বিধিবিধানে অবশ্যই বহু বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা বিদ্যমান থাকবে। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি আক্বীদাহ্-বিশ্বাস , নৈতিকতা ও চরিত্র সম্বন্ধে দিকনির্দেশনা প্রদান করে এবং মানুষের জীবনধারা ও সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন সূক্ষ্ম বিষয়ে আইন রচনা করে ও মিথ্যার ব্যবসায়ে অবতীর্ণ হয় , আর তার আইন-বিধানের আওতা সর্বজনীন হয় , তাহলে এ স্ববিরোধিতা ও বৈপরীত্য অধিকতর প্রকট রূপ ধারণ করবে। কারণ , ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়ই হোক , মিথ্যাবাদী তার বক্তব্যে স্ববিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবেই। এ থেকে বাঁচার কোনো পথই তার সামনে খোলা থাকে না। কারণ , এটাই মানবিক প্রকৃতির দাবী। তাই প্রবাদ বাক্যে যথার্থভাবেই বলা হয়েছে : মিথ্যাবাদীর স্মরণশক্তি থাকে না।

কিন্তু কোরআন মজীদ মানবজীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে এবং তা-ও অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তারিতভাবে মতামত ব্যক্ত করা সত্ত্বেও এতে সামান্যতম বৈপরীত্য বা স্ববিরোধিতার অস্তিত্ব নেই।

কোরআন মজীদ আল্লাহ্ তা আলার পরিচয় উপস্থাপন করেছে , নবুওয়াত্ প্রসঙ্গে আলোচনা করেছে এবং রাজনৈতিক বিষয়াদি , সমাজ ও সভ্যতার পরিচালনা এবং চরিত্র , নৈতিকতা ও এতদসহ মানবজীবনের সমস্ত দিক-বিভাগের ওপর আইন-বিধান প্রণয়ন করেছে। তেমনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয় , যেমন : নক্ষত্রবিজ্ঞান , ইতিহাস , যুদ্ধ ও শান্তির বিধান , আসমান ও যমীনের বিভিন্ন সৃষ্টি , যেমন : ফেরেশতা , গ্রহ-নক্ষত্র , বায়ু , সমুদ্র , উদ্ভিদ , পশু-পাখী ও মানুষ - সব কিছু সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছে এবং বিভিন্ন ধরনের উপমা উপস্থাপন করেছ , এছাড়া ক্বিয়ামতের বিভীষিকাময় দৃশ্যাবলী তুলে ধরেছে এবং অন্য যে কোনো কঠিন বিষয়েই বক্তব্য উপস্থাপন করেছে।

কিন্তু এতো বেশী ও বিচিত্র ধরনের বিষয়ে কথা বলা সত্ত্বেও কোরআন মজীদের উপস্থাপিত আইন-কানুন , ধর্মীয় বিধিবিধান ও পেশকৃত মতামতে সামান্যতম স্ববিরোধিতারও অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে এ সমস্ত বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে কোরআন মজীদ কোথাওই বিচারবুদ্ধি ও প্রজ্ঞাময়তার সীমারেখা লঙ্ঘন করে নি।

কোরআন মজীদ ক্ষেত্রবিশেষে কোনো একটি বিষয়ে দুই জায়গায় বা ততোধিক জায়গায় বক্তব্য রেখেছে , কিন্তু তা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উপস্থাপিত বিভিন্ন বক্তব্যের মধ্যে কোনোরূপ স্ববিরোধিতার অস্তিত্ব নেই। দৃষ্টান্ত স্বরূপ , কোরআন মজীদে হযরত মূসার ( আঃ) প্রসঙ্গটি লক্ষ্য করা যেতে পারে। কোরআন মজীদে এ প্রসঙ্গটি পুনঃপুনঃ এবং বেশ কয়েক বার উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই , যেখানেই হযরত মূসার ( আঃ) প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে সেখানেই তা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী - যে বৈশিষ্ট্যটি অন্য যেখানে এ প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে সেখানে বিদ্যমান নেই। অথচ তা সত্ত্বেও মূল বিষয় তথা কাহিনীর প্রশ্নে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপস্থাপিত বক্তব্যের মধ্যে কোনোরূপ বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা বিদ্যমান নেই।

অন্যদিকে এ বিষয়টির প্রতি যদি লক্ষ্য করা হয় যে , কোরআন মজীদের আয়াত সমূহ একবারে নাযিল্ হয় নি , বরং সুদীর্ঘ তেইশ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে এবং সমকালীন ঘটনাবলীকে উপলক্ষ্য করে নাযিল্ হয়েছে , তাহলে তা থেকেও এটা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হবে যে , কোরআন মজীদ মহান আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিল্ হয়েছে এবং এরূপ গ্রন্থ রচনা করা মানবিক প্রতিভার ক্ষমতা বহির্ভূত। কারণ , কালের প্রবাহ ও সময়ের ব্যবধানের দাবী এই যে , এরূপ দীর্ঘ সময় ধরে মানুষ কোনো গ্রন্থ রচনা করলে তার বিভিন্ন অংশের মধ্যে স্ববিরোধিতা ও বৈপরীত্য , কমপক্ষে অসামঞ্জস্য , থাকতেই হবে।

এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , বড় বড় মনীষী ও কবি-সাহিত্যিকগণ পর্যন্ত সাধারণতঃ দীর্ঘদিন সময় নিয়ে কোনো গ্রন্থ রচনা করলে শেষের দিকে গিয়ে প্রথম দিকের লেখা কম-বেশী সংশোধন করেন। এ সংশোধন যেমন হয় তথ্যগত দিক থেকে , তেমনি ভাষার মান ও প্রকাশ-সৌন্দর্যের দিক থেকে। মতামত , পর্যালোচনা , পরিকল্পনা ও উপদেশ থাকলেও তাতেও কম-বেশী সংশোধন করা হয়। আর বক্তব্যের সাথে যদি চলমান ঘটনাবলীর সম্পর্ক থাকে সে ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন অনেক বেশী সাধিত হয়। শুধু তা-ই নয় , এমনকি একবার প্রকাশিত গ্রন্থ লেখকের জীবদ্দশায় দ্বিতীয় বার প্রকাশিত হলে লেখক তা পরিমার্জিত করেন। কারণ , কালের ব্যবধানে স্বয়ং লেখকের কাছেও তাঁর লেখার কিছু , দুর্বলতা , ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা ধরা পড়ে এবং তিনি বুঝতে পারেন যে , এটি আরো ভালো হওয়া উচিত , তাই তিনি তা সংশোধন করেন।

কিন্তু কোরআন মজীদ খোদায়ী গ্রন্থ বিধায়ই তেইশ বছর আগে এ গ্রন্থের যে অংশ পরিবেশন করা হয়েছে তেইশ বছর পরে পরিবেশিত অংশের সাথে তার কোনো সাংঘর্ষিকতা দেখা দেয় নি বা মানগত দিক থেকে পূর্ববর্তী অংশ সমূহ ও পরবর্তী অংশসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য পূর্ববর্তী অংশসমূহের পরিমার্জনের প্রয়োজন হয় নি।

কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি , এ দুই দৃষ্টিকোণের বিচারেই কোরআন মজীদ স্বীয় অলৌকিকতা রক্ষা করেছে। অর্থাৎ কোরআন মজীদ যখন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এবং খণ্ড-খণ্ড ভাবে নাযিল্ হয়েছে , তখন খণ্ড-খণ্ডরূপেই তা মু জিযাহ্ ছিলো , আর যখন তা খণ্ড-খণ্ড রূপ পরিত্যাগ করে একত্রে গ্রথিত হলো তখন তাতে অলৌকিকতার আরেকটি দিক ফুটে উঠেছে।

স্বয়ং কোরআন মজীদও তার এ বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছে। এরশাদ হয়েছে:

) افلا يتدبرون القرآن و لو کان من عند غير الله لوجدوا فيه اختلافاً کثيراً(

তারা কি কোরআন সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করে না ? এ কোরআন যদি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে হতো তাহলে অবশ্যই এতে বহু বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা পাওয়া যেতো। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 82)

কোরআন মজীদের এ আয়াত মানুষকে একটি স্বভাবসম্মত ও বিচারবুদ্ধিগ্রাহ্য বিষয়ের দিকে পথনির্দেশ করেছে। তা হচ্ছে , যে কেউই তার দাবীতে ও বক্তব্যে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করবে তার প্রকাশিত মতামতে অবশ্যই স্ববিরোধিতা থাকবে। কিন্তু আসমানী গ্রন্থ কোরআন মজীদে কোনোরূপ স্ববিরোধিতার অস্তিত্ব নেই। অতএব , নিঃসন্দেহে প্রমাণিত যে , এ গ্রন্থ মানবিক প্রতিভার ফসল নয় এবং মিথ্যার ওপরে ভিত্তি করে উপস্থাপিত হয় নি।

বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা থেকে কোরআন মজীদের মুক্ততার বিষয়টি এতোই সুস্পষ্ট ও অকাট্য যে , এর সপক্ষে নতুন করে কোনো দলীল-প্রমাণ উপস্থাপনের প্রয়োজন নেই। কারণ , ইসলামের দুশমন তৎকালীন আরবরা পর্যন্ত কোরআন মজীদের এ বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ্য করেছিলো এবং তাদের মধ্যকার কাব্য , সাহিত্য ও ভাষণশিল্পের শ্রেষ্ঠতম প্রতিভাসমূহ তা স্বীকার করেছিলো।

অন্যদিকে আসমানী কিতাব্ নামে অভিহিত বর্তমানে প্রচলিত বাইবেলের পুরাতন নিয়ম নতুন নিয়ম ভুক্ত পুস্তকসমূহ অভিনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করলে এবং এতে পরিদৃষ্ট স্ববিরোধিতা সমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে যে কারো নিকট সত্য অত্যন্ত সুস্পষ্টরূপে ধরা পড়বে এবং সত্য ও মিথ্যা উভয়ই স্ব স্ব চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হবে।

প্রচলিত ইনজীলে স্ববিরোধিতা

এবারে আমরা বর্তমানে প্রচলিত ইনজীল্ হওয়ার দাবীদার পুস্তকসমূহ থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি :

(1) ইনজীলের লুক্ পুস্তকে বলা হয়েছে , মাসীহ্ [হযরত ঈসা ( আঃ)] বলেছেন : যে কেউ আমার সাথে না থাকবে সে আমার বিরুদ্ধে রয়েছে। (লুক্ : একাদশ অধ্যায় ও মথি : দ্বাদশ অধ্যায়)

কিন্তু এ ইনজীলেরই অন্যত্র বলা হয়েছে , মাসীহ্ বলেছেন : যে কেউ আমাদের বিরুদ্ধে নয় সে-ই আমার সাথে রয়েছে। (মার্ক্ : নবম অধ্যায় ও লুক্ : নবম অধ্যায়)

(2) ইনজীলে বলা হয়েছে , মাসীহ্-কে যখন কল্যাণময় শিক্ষক বলে সম্বোধন করা হলো তখন তিনি বললেন : কেন কল্যাণময় বলছো ? সদাপ্রভু ছাড়া কোনো কল্যাণময়ের অস্তিত্ব নেই। (মথি : 19তম অধ্যায় , মার্ক্ : 10ম অধ্যায় ও লুক্ : অষ্টাদশ অধ্যায়)

কিন্তু ইনজীলের অন্যত্র এর ঠিক বিপরীত কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে , মাসীহ্ বললেন : আমি হচ্ছি কল্যাণময় প্রহরী। তিনি আবার বললেন : কিন্তু আমি হচ্ছি সেই কল্যাণময় প্রহরী। (যোহন : 27তম অধ্যায়)

(3) ইনজীলের মথি পুস্তকে বলা হয়েছে , যে দু জন চোরকে মাসীহর সাথে শূলে চড়ানো হয় তাদের উভয়ই মাসীহ্-কে তিরস্কার করে এবং তাঁর প্রতি বিষাক্ত বাক্যবাণ নিক্ষেপ করে। (মথি : 27 তম অধ্যায়)

কিন্তু ইনজীলেরই অন্যত্র ঠিক এর বিপরীত কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে , উক্ত দু জন অপরাধীর মধ্যে একজন মাসীহ্-কে বললো : তুমি যদি মাসীহ্ হয়ে থাকো তাহলে তোমার নিজেকে এবং সেই সাথে আমাদেরকেও শূলে চড়িয়ে হত্যা করা থেকে রক্ষা করো। তখন দ্বিতীয় অপরাধী বললো : তোমার কি সদাপ্রভুর আর তাঁর শাস্তির ভয় নেই যে , মাসীহ্-কে তিরস্কার করছো ? (লুক্ : 23তম অধ্যায়)

(4) ইনজীলের যোহন পুস্তকে বলা হয়েছে , মাসীহ্ বললেন : আমি যদি আমার নিজের পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করি তাহলে আমার সে সাক্ষ্য সঠিক হবে না। (যোহন : 5ম অধ্যায়)

এ হচ্ছে বর্তমানে প্রচলিত ইনজীল্ নামধারী পুস্তকসমূহে বিদ্যমান স্ববিরোধিতাসমূহের কিছু দৃষ্টান্ত মাত্র। ইনজীল্ নামে প্রচলিত স্বল্পায়তন বিশিষ্ট পুস্তকগুলোতে পরিদৃষ্ট এ সব সুস্পষ্ট স্ববিরোধিতাই অন্ধত্ব থেকে মুক্ত সত্যান্বেষী সুস্থ বিবেকের অধিকারী লোকদের সামনে ঐ সব পুস্তকের স্বরূপ সন্দেহাতীত রূপে তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট।

কোরআনের বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাত্

নিখুঁত ও বিস্ময়কর সামঞ্জস্যের বিচারে কোরআন মজীদের অলৌকিকতা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত। এরই অন্যতম দিক হচ্ছে এর বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাত্। এ প্রসঙ্গে ওয়ালীদ্ বিন্ মুগ্বীরাহর বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। [ বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাত্ কী ? এ সম্বন্ধে গ্রন্থের শুরুর দিককার একই শিরোনামের নিবন্ধ দ্রষ্টব্য।]

আবূ জেহেল্ কোরআন মজীদ সম্পর্কে ওয়ালীদ্ বিন্ মুগ্বীরাহর মতামত জানতে চাইলে ওয়ালীদ বলে : কোরআন সম্পর্কে আমি কী বলবো! আল্লাহর শপথ! তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে আরবী ভাষার কবিতা ও ক্বাছীদাহর সাথে আমার মতো এতোখানি পরিচিত। আরবী ভাষার ফাছ্বাহাত্ ও বালাগ্বাত্ এবং কবিতা ও গৌরবগাথার সূক্ষ্ম রহস্য সম্পর্কে জ্ঞানের ক্ষেত্রে কেউ আমার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারে নি। আমি যে কোনো ধরনের কবিতা , এমনকি জ্বিনদের কবিতা সম্পর্কেও অন্যদের তুলনায় বেশী ওয়াকেফহাল। কিন্তু আল্লাহর শপথ! মুহাম্মাদ যে সব কথা বলে তা এ সবের কোনো একটির সাথেও মিলে না। আল্লাহর শপথ! মুহাম্মাদের বক্তব্যের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে যা ফাছ্বাহাত্ ও বালাগ্বাতের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ যে কোনো বক্তব্যকেই হার মানিয়ে দেয় এবং সমস্ত বক্তব্যের ওপরে তা শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী - যার ওপরে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী বক্তব্য কল্পনাও করা যায় না।

এ কথা শুনে আবূ জেহেল বললো : আল্লাহর শপথ! তুমি যদি এর (কোরআনের) বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য না রাখো তাহলে তোমার গোত্রের লোকেরা এবং তোমার আত্মীয়-স্বজনরা তোমার ওপর সন্তুষ্ট হবে না।

তখন ওয়ালীদ বললো : তাহলে কিছুটা অপেক্ষা করো যাতে এ ব্যাপারে ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করতে পারি।

পরে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করার পর ওয়ালীদ বললো : আসলে কোরআন হচ্ছে এক ধরনের জাদু ; মুহাম্মাদ তা অন্য জাদুকরদের কাছ থেকে শিক্ষা করেছে। (تفسير طبری- ٢٩/٩٨ .)

কোনো কোনো সূত্রের বর্ণনা অনুযায়ী ওয়ালীদ ইবনে মুগ্বীরাহ্ কোরআন মজীদ সম্পর্কে বলেছিলো :

) و ان له لحلاوة و ان عليه لطلاوة و ان اعلاه لمثمر و ان اسفله لمغدق و انه ليعلوا و لا يعلی عليه و ما يقول هذا البشر(

নিঃসন্দেহে এর (কোরআনের) রয়েছে সুমিষ্টতা , নিঃসন্দেহে এর রয়েছে অসাধারণ সৌন্দর্য , অবশ্যই এর রয়েছে সমুন্নত তাৎপর্য , অবশ্যই এর গভীরতা সীমাহীন , নিঃসন্দেহে এ অত্যন্ত উঁচু মানের (কথা) এবং এর চেয়ে উন্নততর ও উচ্চতর মানের (কথা) সম্ভব নয়। আর (প্রকৃত সত্য হলো) এ কথা কোনো মানুষ বলে নি। (تفسير طبری- ١٩/٧٢ .)

[ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর মনীষী আবদুল ক্বাহের্ জুরজানী তাঁর লিখিতالرسالة الشافية فی الاعجاز গ্রন্থে এই দ্বিতীয়োক্ত ওয়ালীদকে ওয়ালীদ বিন্ উক্ববাহ্ বলে উল্লেখ করেছেন।]

ধর্মীয় বিধান ও আইন প্রণয়নে কোরআন

জাহেলী আরবদের বিস্ময়কর পরিবর্তন

এ এক সন্দেহাতীত ঐতিহাসিক সত্য যে , ইসলামের প্রদীপ্ত সূর্যের উদয়ের পূর্বে ইতিহাসের এক অন্ধকার বিভীষিকাময় যুগ বিরাজ করছিলো। সে যুগের মানুষ অজ্ঞতা-মূর্খতায় নিমজ্জিত ছিলো এবং তারা জ্ঞান ও চারিত্রিক দিক থেকে যেমন সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো , তেমনি বন্যতা ও পৈশাচিকতার মধ্যে হাবডুবু খাচ্ছিলো। সে অন্ধকার যুগে বিশ্বের সকল জাতির মধ্যে বর্ণ ও শ্রেণী বিভেদ এবং শক্তির আইন , রক্তচোষা নীতি ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা শিকড় গেড়ে বসেছিলো। সকলের মাথায় থাকতো লুটতরাজ ও পরস্ব অপহরণের চিন্তা এবং যখন-তখনই তারা যুদ্ধ , হত্যাকাণ্ড ও রক্তপাতের দিকে ধেয়ে যেতো।

ইসলাম-পূর্ব আরবের লোকেরা বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন আক্বীদাহ্-বিশ্বাস পোষণ করতো এবং তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অমানুষিক কর্মনীতি প্রচলিত ছিলো। তৎকালীন আরবদের মধ্যে না এমন কোনো অভিন্ন আক্বীদাহ্-বিশ্বাস ও ধর্মের অস্তিত্ব ছিলো যা তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারতো , না কোনো সাধারণ আইন-কানূন্ ও অভিন্ন সমাজব্যবস্থা ছিলো যা তাদের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও সমন্বয় সৃষ্টি করতে পারতো। অভ্যাস ও গতানুগতিক প্রথার অনুসরণ তাদেরকে দিশাহারায় পরিণত করেছিলো। ফলতঃ তারা যে কোনো দিকেই ঝুঁকে পড়তো। তাদের মধ্যে মূর্তিপূজা বিশেষভাবে প্রচলিত হয়ে পড়েছিলো। তারা অনেক কল্পিত দেবদেবীর মূর্তি বানিয়ে সেগুলোর পূজা করতো এবং এ সব মূর্তিকে তারা আল্লাহ্ তা আলার নিকট সুপারিশ করার জন্য মধ্যস্থরূপে গ্রহণ করতো।

তাদের মধ্যে তথাকথিত ভাগ্যের ভিত্তিতে অর্থাৎ লটারীর মাধ্যমে ধনসম্পদ বণ্টনের প্রচলিত প্রথা ছিলো। আর তাদের কাছে জুয়াখেলা ছিলো একটা সাধারণ ব্যাপার এবং তা ছিলো অত্যন্ত ব্যাপকভাবে প্রচলিত। শুধু তা-ই নয় , বরং এই জঘন্য কাজটি তাদের কাছে গৌরবের বিষয়রূপে পরিগণিত হতো। তাদের মধ্যে প্রচলিত অপর একটি ঘৃণ্য প্রথা ছিলো সৎমাকে বিবাহ করা। আর এর চেয়েও জঘন্যতর ও নৃশংস প্রথা ছিলো কন্যাসন্তানদের জীবন্ত কবর দেয়া।

ইসলাম-পূর্ব জাহেলী যুগের আরবদের মধ্যে প্রচলিত জঘন্য রীতি-প্রথাসমূহের এ হচ্ছে অংশবিশেষ মাত্র। কিন্তু আরব উপদ্বীপের বুকে রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর সোনালী প্রভাময় আবির্ভাব ও ইসলামের প্রোজ্জ্বল সূর্যের উদয়ের ফলে জাহেলী যুগের এই অন্ধকার হৃদয়গুলোই খোদায়ী জ্ঞানে আলোকিত হলো এবং পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র হলো। দেবমূর্তি ও মূর্তিপূজার স্থলাভিষিক্ত হলো তাওহীদ্ বা একেশ্বরবাদ , মূর্খতা ও অজ্ঞতার স্থলাভিষিক্ত হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং চারিত্রিক নীচতা উত্তম গুণাবলীতে আর শত্রুতা-বিরোধ মায়া-মহব্বত ও বন্ধুত্বে পরিবর্তিত হলো। আর এই ধ্বংসোন্মুখ , অপদার্থ ও অসংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠী থেকেই এমন এক ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী জাতির সৃষ্টি হলো যে , তারা সারা বিশ্বের ওপর স্বীয় প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান , সভ্যতা ও মানবতায় ভূষিত হয়ে সারা দুনিয়াকে আন্দোলিত করতে সক্ষম হলো।

ফ্রান্সের এককালীন মন্ত্রী মিঃ ডাউরী এ প্রসঙ্গে বলেন :

মুসলমানদের নবী মুহাম্মাদ স্বীয় সমুন্নত ও ঐশী শিক্ষার দ্বারা খুব সহজেই বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত আরব গোত্রসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাদের সমন্বয়ে একটি একক জাতি গঠন করে স্বীয় আধিপত্য ও শাসনকে স্পেন থেকে শুরু করে ভারত পর্যন্ত বিস্তার করতে এবং সারা বিশ্বের বুকে সভ্যতার পতাকা উড্ডীন করতে সক্ষম হন।

এ মহান ব্যক্তি এহেন বিস্ময়কর ও সর্বাত্মক পরিবর্তন এমন এক সময় সাধন করেন যখন ইউরোপ মধ্য যুগীয় অন্ধকার ও মূর্খতায় নিমজ্জিত ছিলো।

তিনি এরপর বলেন : মধ্য যুগে একমাত্র যে জাতিটি জ্ঞান-বিজ্ঞানের অধিকারী ছিলো , অন্য কথায় , জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিযোগিতায় ময়দানে সকলের ওপরে বাজিমাত করেছিলো সে হচ্ছে আরব জাতি। এই আরবরাই ইউরোপের আকাশে পুঞ্জীভূত বন্যতা , অসভ্যতা ও বর্বরতার ঘন কালো মেঘরাশিকে বিদূরিত করে এবং এ ভূখণ্ডে (ইউরোপে) জ্ঞান-বিজ্ঞান , চরিত্র ও নৈতিকতার সভ্যতাসূর্য উদিত করে। (صفوة العرفان: محمد فرید وجدی – ١٩٩ .)

আরবদের ভাগ্যে এভাবে যে উন্নতি , অগ্রগতি , মর্যাদা ও গৌরবের অধিকারী হওয়া সম্ভব হলো তা কেবল আসমানী গ্রন্থ কোরআন মজীদের সমুন্নত শিক্ষার ফলেই সম্ভব হয়েছিলো যা অন্য সমস্ত আসমানী কিতাবের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী এবং যার আইন-কানূন্ ও বিধি-বিধান বিচারবুদ্ধির ওপর ভিত্তিশীল - যার শিক্ষার রয়েছে স্বকীয় বিশেষ আকর্ষণীয় ও ব্যতিক্রমী পদ্ধতি।

ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যম পন্থা

আইন প্রণয়ন ও বিধি-বিধান নির্ধারণে কোরআন মজীদ এক ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যম পন্থা অবলম্বন করেছে - যাতে যে কোনো ধরনের চরম পন্থা ও শিথিল পন্থা পরিহার করা হয়েছে।

কোরআন মজীদ ভারসাম্যের প্রতি এতোই গুরুত্ব আরোপ করেছে যে , সাধারণ মানুষের জন্যও ভারসাম্যকে একটা অপরিহার্য বিষয়রূপে গণ্য করেছে এবং মানুষকে আল্লাহ্ তা আলার নিকট বক্রতা , চরম পন্থা ও শিথিল পন্থা থেকে মুক্ত ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যম পন্থা প্রার্থনার শিক্ষা দিয়েছে। কোরআন মজীদে মানুষের প্রার্থনার ভাষায় এরশাদ হয়েছে :

) اهدنا الصراط المستقيم(

আমাদেরকে সরল , সঠিক , সুদৃঢ় ও ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যম পন্থায় পরিচালিত করো। (সূরাহ্ আল্-ফাাতেহাহ্ : 6) এ বাক্যটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হলেও তাৎপর্যের দিক থেকে অত্যন্ত সুগভীর।

কোরআন মজীদের বহু আয়াতেই ভারসাম্য ও মধ্যম পন্থা অনুসরণের জন্য আহবান জনানো হয়েছে এবং চরম পন্থা ও শিথিল পন্থা থেকে মুক্ত এক ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায়সম্মত পন্থার দিকে মানুষকে পথনির্দেশ করা হয়েছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে :

) ان الله يأمرکم ان تؤدوا الامانات الی اهلها و اذا حکمتم بین الناس ان تحکموا بالعدل( .

অবশ্যই আল্লাহ্ তোমাদেরকে যথাযথ অধিকারীর কাছে আমানত প্রত্যর্পণের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং (এ নির্দেশ দিয়েছেন যে ,) তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচার-ফয়সালা করবে (বা শাসনকার্য চালাবে) তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে ফয়সালা করবে। (সূরাহ্ আন্-নিসাা : 58)

) اعدلوا هو اقرب للتقوی(

তোমরা ভারসাম্য ও ন্যায়নীতি অবলম্বন করো ; এ হচ্ছে (পরকালীন শাস্তি থেকে) বেঁচে থাকার নিকটতর পর্যায়। (সূরাহ্ আল্-মাাএদাহ্ : 8)

) و اذا قلتم فاعدلوا و لو کان ذا قربی(

তোমরা যখন কথা বলবে তখন ভারসাম্য ও ন্যায়নীতি বজায় রাখবে , যদিও (যার সম্পর্কে কথা বলবে) সে তোমাদের আত্মীয় হয়। (সূরাহ্ আল্-আন্ আাম্ : 152)

) ان الله يأمرکم بالعدل و الاحسان و ايتاء ذی القربی و ينهی عن الفحشاء و المنکر و البغی. يعظکم لعلکم تذکرون(

অবশ্যই আল্লাহ্ তোমাদেরকে ভারসাম্য ও সুবিচার , সৎকর্ম ও পরোপকার ও আত্মীয়-স্বজনদেরকে দানের জন্য আদেশ করছেন এবং অশ্লীলতা , পাপকর্ম ও জোর-যুলুম-ঔদ্ধত্য থেকে নিষেধ করছেন। তিনি তোমাদেরকে এ উপদেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা তা স্মরণে রেখে চলো। (সূরাহ্ আন্-নাহল : 90)

দানে উৎসাহ ও কার্পণ্যের নিন্দা

এভাবেই কোরআন মজীদ মানুষকে ভারসাম্য , ন্যায়নীতি ও সুবিচারের নির্দেশ দিয়েছে এবং স্বীয় শিক্ষায় ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যম পন্থাকে প্রস্ফূটিত করে তুলেছে। তেমনি কোরআন মজীদে বহু জায়গায় কার্পণ্য থেকে নিষেধ করা হয়েছে এবং তার ক্ষতিকারকতা ও অশুভ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে :

) و لا يحسبن الذين يبخلون بما آتاهم الله من فضله هو خيراً لهم. بل هو شر لهم. سيطقون ما بخلوا به يوم القيامة. و لله ميراث السماوات و الارض. و الله بما تعملون خبير(

যারা , আল্লাহ্ তাঁর অনুগ্রহ থেকে তাদেরকে যা কিছু দান করেছেন তার ব্যাপারে কার্পণ্যের আশ্রয় নেয় তারা যেন মনে না করে যে , এ কর্মনীতি তাদের জন্য কল্যাণকর। বরং এটা তাদের জন্য অকল্যাণকর ; তারা যা কিছুর ব্যাপারে কার্পণ্য করবে ক্বিয়ামতের দিনে তারই বোঝা তাদের ঘাড়ে জড়িয়ে থাকবে। আর আসমান ও যমীনের উত্তরাধিকার তো আল্লাহরই। আর তোমরা যা কিছু করছো আল্লাহ্ সে সম্পর্কে সদা অবগত। (সূরাহ্ আালে ইমরাান্ : 180)

তবে কোরআন মজীদ দানে উৎসাহিত ও কার্পণ্যের নিন্দা করার পাশাপাশি দানের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখা ও বাস্তবসম্মত নীতি অনুসরণ করতে বলেছে। এরশাদ হয়েছে :

) ولا تجعل يدک مغلولة الی عنقک و لا تبسط کل البسط فتقعد ملوماً محسوراً(

তোমার হাতকে (দান ও কল্যাণমূলক ব্যয় থেকে) একেবারে কণ্ঠসংলগ্ন করে রেখো না (গুটিয়ে রেখো না) , আবার এতো বেশী প্রসারিত করে দিয়ো না যে , শেষে (রিক্তহস্ত হয়ে) ধিকৃত-তিরস্কৃত হবে। (সূরাহ্ বানী ইসরাাঈল্ : 29)