কতিপয় বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণী
কোরআন মজীদে ভবিষ্যত আবিষ্কার-উদ্ভাবন ও বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্বন্ধে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। তৎকালীন বিশ্ব বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির যে স্তরে অবস্থান করছিলো তার পরিপ্রেক্ষিতে এ সব ভবিষ্যদ্বাণী সরাসরি করা হলে তা অবিশ্বাস্য বলে মনে হতো এবং অনেকে হয়তো এগুলোকে কল্পকাহিনী মনে করে তার ভিত্তিতে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াত্ ও কোরআন মজীদকে প্রত্যাখ্যান করতো। সম্ভবতঃ এ কারণে এ সব ভবিষ্যদ্বাণী বিশেষ প্রকাশকৌশলের আশ্রয়ে প্রচ্ছন্নভাবে করা হয়েছে - যা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাগবেষণার ফলে পরবর্তীকালে যথাসময়ে উপযুক্ত ব্যক্তিদের কাছে প্রকাশ পাওয়া সম্ভব। আমরা এখানে উদাহরণস্বরূপ এ ধরনের কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করছি :
খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিস্ময়কর অগ্রগতি :
[ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে“
কোরআন ও নুযূলে কোরআন”
অধ্যায়ের“
সাত যাহের্ ও সাত বাত্বেন্”
উপশিরোনামে নিম্নোক্ত আয়াতটি উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং এ থেকে প্রমাণিত বিষয়বস্তু উল্লেখ করা হয়েছে। অত্র অধ্যায়ের দাবী অনুযায়ী এখানে পুনরুক্তি করা হলো।]
)
مثل الذين ينفقون اموالهم فی سبيل الله کمثل حبة انبتت سبع سنابل فی کل سنبلة مائة حبة. و الله يضاعف لمن يشاء. و الله واسع عليم(
.
“
যারা আল্লাহর পথে তাদের ধনসম্পদ ব্যয় করে তাদের (এ কাজের) উপমা হচ্ছে , যেন একটি শস্যদানায় সাতটি শীষ উদ্গত হলো - যার প্রতিটি শীষে একশ’
টি করে দানা হলো। আর আল্লাহ্ যাকে চান বহু গুণ বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ্ অসীম উদার ও সদাজ্ঞানময়।”
(সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 261)
এ আয়াতে একটি প্রচ্ছন্ন ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। তা হচ্ছে , একটি শস্যদানা থেকে সাতশ’
বা তার বেশী সংখ্যক শস্যদানা উৎপন্ন হওয়া সম্ভব এবং ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে যখন একটি শস্যদানা থেকে সাতশ’
বা তার বেশী শস্যদানা উৎপন্ন হবে।
উক্ত আয়াত থেকে যে আমরা এরূপ তাৎপর্য গ্রহণ করছি তার কারণ এই যে , আল্লাহ্ তা‘
আলা তাঁর প্রাকৃতিক বিধানের আওতায় অসম্ভব এমন কিছুর উদাহরণ দেবেন - তাঁর সম্পর্কে এরূপ ধারণা করা সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , কোরআন মজীদ নাযিলের যুগের কৃষিব্যবস্থায় একটি ধান বা গম অথবা অন্য কোনো দানা জাতীয় শস্য থেকে সাতশ’
দানা উৎপন্ন হওয়ার বিষয়টি ছিলো অকল্পনীয় , কিন্তু সে যুগেও একটি ফলের বীজ থেকে গজানো গাছে শুধু এক বার নয় , বরং প্রতি বছর সাতশ’
বা তার বেশী ফলের উৎপাদন অসম্ভব ছিলো না। আরব দেশে উৎপন্ন জলপাই , খেজুর , আঞ্জির (ডুমুর) , আঙ্গুর ইত্যাদি ছিলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এমতাবস্থায় যদি উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য হতো শুধু আল্লাহর পথে ব্যয়ের শুভ প্রতিফল বর্ণনা করা তাহলে এ ক্ষেত্রে ফলের বীজের উদাহরণই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা‘
আলা দানা জাতীয় শস্যের উদাহরণ দিয়েছেন এবং এভাবে দানা জাতীয় ফসলের উৎপাদন বিস্ময়করভাবে বৃদ্ধির ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।
এ ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই কোরআন মজীদ নাযিলের যুগের পাঠক-পাঠিকাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় নি। তাই তাঁরা উক্ত আয়াতের প্রথম বাহ্যিক তাৎপর্য (দানের প্রতিদানের অঙ্গীকার) নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু বর্তমান যুগে ধান ও গমের বহু উচ্চফলনশীল জাত আবিষ্কৃত হওয়ায় ইতিমধ্যেই একটি দানা থেকে সাতশ’
দানা বা তার বেশী উৎপন্ন হচ্ছে।
নভোলোকে পরিভ্রমণ :
)
يا معشر الجن و الانس ان استطعتم ان تنفذوا من اقطار السماوات الارض فانفذوا. لا تنفذون الا بسلطان(
“
হে জিন্ ও মানব গোষ্ঠী! তোমরা যদি আসমান সমূহ ও ধরণীর পরিধিকে ভেদ করে যেতে সক্ষম হও তো ভেদ করে যাও। কিন্তু (যথাযথ) ক্ষমতা ছাড়া তোমরা ভেদ করবে না।”
(সূরাহ্ আর্-রাহমাান্ : 33)
এ আয়াতে ভবিষ্যদ্বাণী নিহিত রয়েছে যে , এক সময় মানুষের পক্ষে আসমান সমূহ ও পৃথিবীর পরিধি ভেদ করে যাওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু কোরআন নাযিলের যুগের লোকদের পক্ষে এ কথা কল্পনা করা সম্ভব ছিলো না। তাই এ আয়াতের অর্থ করা হতো যে , এতে অক্ষমতা প্রমাণের জন্য তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ আয়াতের বাচনভঙ্গি নেতিবাচক নয় , ইতিবাচক। এ থেকে বুঝা যায় যে , কোরআন মজীদ আসমান-যমীনের পরিধিকে ভেদ করা মানুষের জন্য অসম্ভব বলে নি , তবে কাজটি সহজ নয় ; এ জন্য যথাযথ প্রস্তুতি পয়োজন হবে।
দ্বিতীয়তঃ আয়াতের পূর্বাপর থেকে এমন কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না যে কারণে লোকদেরকে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা চলে। বিশেষ করে কথাটি যখন কেবল কাফেরদেরকে উদ্দেশ করে বলা হয় নি , বরং সকল মানুষকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে তখন এটাকে চ্যালেঞ্জ বলে গণ্য করা কঠিন।
তৃতীয়তঃ তৎকালীন মানবসমাজ যে কাজকে মানুষের আওতাবহির্ভূত বলে মনে করতো এমন কাজ সম্পাদনের জন্য তাদেরকে চ্যালেঞ্জ প্রদান যুক্তিসঙ্গত বিবেচিত হতো না। বরং এ ধরনের চ্যালেঞ্জ দেয়া হলে কাফেররা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারতো যে , তিনি যখন নিজেকে আল্লাহর নবী বলে দাবী করছেন তখন তিনিই আসমান সমূহ ও পৃথিবীর অক্ষ ভেদ করে দেখান। কিন্তু ইতিহাসে বা হাদীছে এ ধরনের কোনো চ্যালেঞ্জ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কোনো বিতর্ক বা আলোচনার তথ্য পাওয়া যায় না।
অবশ্য এর পরবর্তী এক আয়াতের আলোকে চ্যালেঞ্জের অর্থ গ্রহণ করা হয়ে থাকতে পারে। কারণ , এরশাদ হয়েছে :
)
يرسل عليکما شواظ من نار و نحاس فلا تنتصران(
.
“
তোমাদের জন্য অগ্নিস্ফূলিঙ্গ ও ধূম্র পাঠানো হবে ; অতঃপর তোমরা কোনোরূপ সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না।”
(সূরাহ্ আর্-রাহমাান্ : 35)
অনেকে এ আয়াতে উল্কাপাতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে মনে করেছেন। অর্থাৎ উর্ধকাশে গমনের চেষ্টা করলে উল্কা নিক্ষেপ করে প্রতিহত করা হবে (যা শয়তানদের উদ্দেশে নিক্ষেপ করা হয়ে থাকে)। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ধূম্র পাঠানোর কথাটিকে ব্যাখ্যা করা কঠিন। অন্যদিকে ধরণীর পরিধি ভেদ করার চেষ্টা করা হলে সে ক্ষেত্রেও অগ্নিস্ফূলিঙ্গ ও ধূম্র পাঠানোর বিষয়টি পুরোপুরি খাপ খায় না। বিশেষ করে এই শেষোক্ত ক্ষেত্রে‘
পাঠানো’
শব্দটির প্রয়োগ বেশ কঠিন। দৃশ্যতঃ এ আয়াতে অগ্নিগিরির অগ্ন্যুৎপাতের কথা বলা হয়েছে যাতে অগ্নিস্ফূলিঙ্গ ও ধূম্র উভয়ই শামিল থাকে। এর পর পরই নভোলোক ধ্বংসের তথা ক্বিয়ামতের কথা বলা হয়েছে। (আয়াত নং 37) তাই উপরোক্ত আয়াতে ক্বিয়ামতের পূর্বে ব্যাপকভাবে অগ্নিগিরির অগ্ন্যুৎপাতের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে - এ সম্ভাবনাই সর্বাধিক।
সৃষ্টিসূচনার প্রক্রিয়া সংক্রান্ত তথ্য উদ্ঘাটন :
)
او لم يروا کِف يُبدء الله الخلق ثم يعيده. ان ذالک علی الله يسير. قل سيروا فی الارض فانظروا کيف بدء الخلق(.
“
তারা কি দেখে নি আল্লাহ্ কীভাবে সৃষ্টির সূচনা করেন ? আর এরপর তিনিই তাকে প্রত্যাবর্তন করাবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহর জন্য এ কাজ খুবই সহজ। (হে রাসূল! তাদেরকে) বলুন , তোমরা ধরণীর বুকে পরিভ্রমণ করো এবং দেখো যে , কীভাবে তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছিলেন।”
(সূরাহ্ আল্-‘
আনকাবূত্ : 19-20)
অত্র আয়াতে এ মর্মে ইঙ্গিত রয়েছে যে , ধরণীর বুকে এমন সব নিদর্শন আছে যা নিয়ে গবেষণা করা হলে সৃষ্টির সূচনাপ্রক্রিয়া ও অগ্রগতি সম্বন্ধে জানা যাবে। তাই দৃশ্যতঃ এ উপদেশ কোরআন নাযিলের অনেক পরবর্তীকালীন এমন এক প্রজন্মের উদ্দেশে যখন বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতির ফলে মানুষের পক্ষে গবেষণা করে সৃষ্টির সূচনাপ্রক্রিয়া সম্বন্ধে জানা সম্ভব হবে। অবশ্যخلق
শব্দটি সৃষ্টিকরণ , প্রাণীকুল ও মানুষ - এ তিন অর্থেই ব্যবহৃত হয়। তবে এখানে প্রথম অর্থে অর্থাৎ সৃষ্টিকর্মের আদিসূচনা অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। মোদ্দা কথা , অত্র আয়াতে এতদসংক্রান্ত বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী নিহিত রয়েছে।
ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে , বিশেষ করে ফসিল পরীক্ষা ও জেনেটিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতির ফলে মানুষের প্রাচীনতম প্রজন্ম সংক্রান্ত অনেক তথ্য জানা সম্ভব হয়েছে। তেমনি সাম্প্রতিক কালে এমন অনেক প্রাণী প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলোকে পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীগণ প্রাচীনতম প্রজাতিসমূহের অন্যতম বলে চিহ্নিত করেছেন - যাদের বৈশিষ্ট্যে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। অতএব , সন্দেহ নেই যে , ভবিষ্যতে বিজ্ঞান সৃষ্টির আদিসূচনা সম্পর্কিত তথ্যাদিও উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হবে।