কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্ 5%

কোরআনের মু‘জিযাহ্ লেখক:
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের মু‘জিযাহ্
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 60 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 48518 / ডাউনলোড: 4702
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

কোরআন মজীদের বালাগ্বাত্ - ফাছ্বাহাত্ ও জ্ঞানগর্ভতার একটি দৃষ্টান্ত

কোরআন মজীদের মু জিযাহর একটি অন্যতম প্রধান দিক হচ্ছে এই যে , সমগ্র কোরআন মজীদে যে জ্ঞান ও শিক্ষা উপস্থাপন করা হয়েছে প্রতিটি সূরায়ই তার সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হয়েছে , কিন্তু তা এমনভাবে ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয়েছে যার ফলে বিভিন্ন সূরাহ্ পাঠের সময় পাঠক-পাঠিকার কাছে তার পুনরাবৃত্তিকে মোটেই পুনরাবৃত্তি বলে অনুভূত হয় না। আর ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , কোরআনের মু জিযাহর আরেকটি প্রধান দিক হচ্ছে তার ভাষার গতিশীলতা ও প্রাঞ্জলতা ব্যাহত না করেই বিভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তুর সমাহার ঘটানো। কোরআনের তৃতীয় আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , তার ভাষা না কবিতা , না গদ্য , বরং বিভিন্ন ধরনের কবিতার ভাষায় ব্যবহার্য মাধুর্য ও বলিষ্ঠতার সমন্বয় ঘটিয়ে কাব্যসৌন্দর্যমণ্ডিত গদ্যে স্বীয় বক্তব্য উপস্থাপন - যার ফলে বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের মহানায়কগণও এর সাথে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে।

বলা বাহুল্য যে , কোরআন মজীদ কোনো প্রথাগত গ্রন্থের মতো গ্রন্থ নয় এবং এর সূরাহ্গুলোও কোনো প্রথাগত গ্রন্থের অধ্যায়ের মতো বা কোনো প্রবন্ধের মতো নয়। বরং কোরআন মজীদ ও তার সূরাহ্ সমূহের বক্তব্য ও ভাষা অনেকটা ভাষণের বক্তব্য ও ভাষার ন্যায় , কিন্তু তার সাহিত্যকুশলতা এমনই যার ফলে বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের মহানায়কগণ এর মোকাবিলায় দিশাহারা ও হতভম্ব হয়ে পড়তে বাধ্য।

এখানে আমরা কোরআন মজীদের একটি সূরাহর উদ্ধৃতি দিয়ে তার প্রকাশকুশলতার প্রতি সংক্ষেপে দৃষ্টি দেবো - যা থেকে আমাদের উপরোক্ত বক্তব্যের অকাট্য প্রমাণ মিলবে।

আমরা এখানে কোরআন মজীদের সূরাহ্ আল্-মুল্ক্ উদ্ধৃত করছি :

) بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ. تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (١) الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ (٢) الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا مَا تَرَى فِي خَلْقِ الرَّحْمَنِ مِنْ تَفَاوُتٍ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَى مِنْ فُطُورٍ (٣) ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ يَنْقَلِبْ إِلَيْكَ الْبَصَرُ خَاسِئًا وَهُوَ حَسِيرٌ (٤) وَلَقَدْ زَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيحَ وَجَعَلْنَاهَا رُجُومًا لِلشَّيَاطِينِ وَأَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابَ السَّعِيرِ (٥) وَلِلَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ عَذَابُ جَهَنَّمَ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ (٦) إِذَا أُلْقُوا فِيهَا سَمِعُوا لَهَا شَهِيقًا وَهِيَ تَفُورُ (٧) تَكَادُ تَمَيَّزُ مِنَ الْغَيْظِ كُلَّمَا أُلْقِيَ فِيهَا فَوْجٌ سَأَلَهُمْ خَزَنَتُهَا أَلَمْ يَأْتِكُمْ نَذِيرٌ (٨) قَالُوا بَلَى قَدْ جَاءَنَا نَذِيرٌ فَكَذَّبْنَا وَقُلْنَا مَا نَزَّلَ اللَّهُ مِنْ شَيْءٍ إِنْ أَنْتُمْ إِلا فِي ضَلالٍ كَبِيرٍ (٩) وَقَالُوا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِي أَصْحَابِ السَّعِيرِ (١٠) فَاعْتَرَفُوا بِذَنْبِهِمْ فَسُحْقًا لأصْحَابِ السَّعِيرِ (١١) إِنَّ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ كَبِيرٌ (١٢) وَأَسِرُّوا قَوْلَكُمْ أَوِ اجْهَرُوا بِهِ إِنَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ (١٣) أَلا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ (١٤) هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الأرْضَ ذَلُولا فَامْشُوا فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُوا مِنْ رِزْقِهِ وَإِلَيْهِ النُّشُورُ (١٥) أَأَمِنْتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يَخْسِفَ بِكُمُ الأرْضَ فَإِذَا هِيَ تَمُورُ (١٦) أَمْ أَمِنْتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يُرْسِلَ عَلَيْكُمْ حَاصِبًا فَسَتَعْلَمُونَ كَيْفَ نَذِيرِ (١٧) وَلَقَدْ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَكَيْفَ كَانَ نَكِيرِ (١٨) أَوَلَمْ يَرَوْا إِلَى الطَّيْرِ فَوْقَهُمْ صَافَّاتٍ وَيَقْبِضْنَ مَا يُمْسِكُهُنَّ إِلا الرَّحْمَنُ إِنَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ بَصِيرٌ (١٩) أَمْ مَنْ هَذَا الَّذِي هُوَ جُنْدٌ لَكُمْ يَنْصُرُكُمْ مِنْ دُونِ الرَّحْمَنِ إِنِ الْكَافِرُونَ إِلا فِي غُرُورٍ (٢٠) أَمْ مَنْ هَذَا الَّذِي يَرْزُقُكُمْ إِنْ أَمْسَكَ رِزْقَهُ بَلْ لَجُّوا فِي عُتُوٍّ وَنُفُورٍ (٢١) أَفَمَنْ يَمْشِي مُكِبًّا عَلَى وَجْهِهِ أَهْدَى أَمْ مَنْ يَمْشِي سَوِيًّا عَلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ (٢٢) قُلْ هُوَ الَّذِي أَنْشَأَكُمْ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالأبْصَارَ وَالأفْئِدَةَ قَلِيلا مَا تَشْكُرُونَ (٢٣) قُلْ هُوَ الَّذِي ذَرَأَكُمْ فِي الأرْضِ وَإِلَيْهِ تُحْشَرُونَ (٢٤) وَيَقُولُونَ مَتَى هَذَا الْوَعْدُ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (٢٥) قُلْ إِنَّمَا الْعِلْمُ عِنْدَ اللَّهِ وَإِنَّمَا أَنَا نَذِيرٌ مُبِينٌ (٢٦) فَلَمَّا رَأَوْهُ زُلْفَةً سِيئَتْ وُجُوهُ الَّذِينَ كَفَرُوا وَقِيلَ هَذَا الَّذِي كُنْتُمْ بِهِ تَدَّعُونَ (٢٧) قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ أَهْلَكَنِيَ اللَّهُ وَمَنْ مَعِيَ أَوْ رَحِمَنَا فَمَنْ يُجِيرُ الْكَافِرِينَ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ (٢٨) قُلْ هُوَ الرَّحْمَنُ آمَنَّا بِهِ وَعَلَيْهِ تَوَكَّلْنَا فَسَتَعْلَمُونَ مَنْ هُوَ فِي ضَلالٍ مُبِينٍ (٢٩) قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ أَصْبَحَ مَاؤُكُمْ غَوْرًا فَمَنْ يَأْتِيكُمْ بِمَاءٍ مَعِينٍ(

পরম দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে। পরম বরকতময় তিনি যার হাতে রয়েছে (আসমান-যমীনের) সকল রাজত্ব ; আর তিনি প্রতিটি জিনিসের ওপরই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী - যিনি তোমাদের মধ্যে কর্মের বিচারে কে অধিকতর উত্তম হবে তা পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন ; আর তিনি মহাপরাক্রান্ত ও ক্ষমাশীল। তিনি স্তরে স্তরে বিন্যস্ত করে সপ্ত উর্ধলোক সৃষ্টি করেছেন ; তুমি পরম দয়াবানের সৃষ্টিতে কোনো পার্থক্য (খুঁত) দেখতে পাবে না। আরেক বার দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখো , কোনো ফাঁক (অসম্পূর্ণতা) দেখতে পাও কি ? কিছুক্ষণ পরে তুমি দ্বিতীয় বারের জন্য (সেদিকে) দৃষ্টি ফেরাও ; তোমার দৃষ্টি ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে ফিরে আসবে। আর আমি পৃথিবীর আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা অলঙ্কৃত করে রেখেছি এবং আমি তাকে শয়ত্বানদের জন্য ক্ষেপণাস্ত্রস্বরূপ করেছি , আর প্রস্তুত করে রেখেছি তাদের জন্য প্রজ্জ্বলিত অগ্নির শাস্তি , আর যারা তাদের রবকে অস্বীকার করেছে তাদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি। আর তা কতোই না নিকৃষ্ট স্থান! আর যখন তারা তাতে নিক্ষিপ্ত হবে তখন তারা তার উৎক্ষিপ্ত গর্জন শুনতে পাবে। তখন তা (জাহান্নাম) আক্রোশে ফেটে পড়ার উপক্রম হবে। কোনো গোষ্ঠীকে যখন তাতে নিক্ষেপ করা হবে তখন তার প্রহরীরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে : তোমাদের কাছে কি কোনো সতর্ককারী আসেন নি ? তারা বলবে : হ্যা , আমাদের কাছে সতর্ককারী এসেছিলেন , কিন্তু আমরা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম এবং বলেছিলাম : আল্লাহ্ কোনো কিছুই নাযিল করেন নি। (দোযখের প্রহরীরা বলবে :) তোমরা তো বড় ধরনের গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিলে। তখন তারা (পরিতাপের সাথে) বলবে : আমরা যদি (মনোযোগের সাথে) শ্রবণ করতাম এবং বিচারবুদ্ধি কাজে লাগাতাম তাহলে আমরা দোযখবাসীদের অন্তর্ভুক্ত থাকতাম না! অতঃপর তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করবে। দূর হোক দোযখবাসীরা। (অন্যদিকে) যারা তাদের রব-কে না দেখেও ভয় করে নিঃসন্দেহে তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও বিরাট শুভ প্রতিদান। আর তোমরা তোমাদের কথা গোপন কর বা প্রকাশ কর (তাঁর কাছে তা সমান , কারণ ,) অবশ্যই তিনি অন্তরস্থ বিষয়াদি সম্বন্ধে সদাজ্ঞাত। সাবধান! যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি জানেন না ? বরং তিনি তো সূক্ষ্মদর্শী সর্বজ্ঞ। তিনিই হচ্ছেন সেই সত্তা যিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য সুগতিসম্পন্ন করে বানিয়েছেন , সুতরাং তোমরা তার স্কন্ধে বিচরণ কর এবং তাঁর রিয্ক্ব্ ভক্ষণ কর ; আর তাঁর কাছেই তোমাদের পুনরুত্থান। উর্ধলোকে যিনি আছেন তিনি তোমাদেরকে ভূগর্ভে প্রোথিত করে দেবেন এবং তা প্রকম্পিত হতে থাকবে - এ ব্যাপারে কি তোমরা নিঃশঙ্ক হয়ে গিয়েছো ? অথবা , যিনি উর্ধলোকে আছেন তিনি তোমাদের ওপর প্রস্তর বর্ষণ করবেন , অতঃপর তোমরা অচিরেই জানতে পারবে আমার সতর্কীকরণ কেমন ছিলো - এ ব্যাপারে কি তোমরা নিঃশঙ্ক হয়ে গিয়েছো ? বস্তুতঃ তাদের পূর্ববর্তীরা (আমার সতর্কবাণীকে) প্রত্যাখ্যান করেছিলো ; অতঃপর কেমন ছিলো আমার অস্বীকৃতি! তারা কি তাদের (মাথার) ওপরে উড়ন্ত পাখীদেরকে দেখে নি - যারা পাখা বিস্তার করে ও গুটিয়ে নেয় ? বস্তুতঃ পরম দয়াবান ব্যতীত কেউই তাদেরকে স্থির রাখে না ; নিঃসন্দেহে তিনি প্রতিটি জিনিসের প্রতি দৃষ্টি রাখেন। তোমাদের সাহায্য করবে পরম দয়াবান ব্যতীত তোমাদের জন্য এমন কোন্ বাহিনী আছে ? কাফেররা তো কেবল আত্মপ্রতারণার কবলে নিপতিত বৈ নয়। তিনি যদি রিয্ক্ব্ বন্ধ করে দেন তাহলে এমন কে আছে যে তোমাদেরকে রিয্ক্ব্ প্রদান করবেন ? বরং তারা জিদের বশে অবাধ্যতায় ও বিমুখতায় নিমজ্জিত রয়েছে। যে ব্যক্তি মুখ থুবড়ে পড়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলে সে-ই কি অধিকতর সঠিক পথ প্রাপ্ত , নাকি যে ব্যক্তি মেরুদণ্ড সোজা করে সরল-সুদৃঢ় পথে চলে ? (হে রাসূল!) বলুন , তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের জন্য শ্রবণশক্তি , দৃষ্টিশক্তি ও অন্তঃকরণ বানিয়েছেন , কিন্তু তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো। (হে রাসূল!) বলুন , তিনিই তোমাদেরকে ধরণীর বুকে ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাঁর কাছেই তোমরা সমবেত হবে। আর তারা বলে : কখন এ প্রতিশ্রুতি (বাস্তবায়িত হবে) যদি তোমরা (এ প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে) সত্যবাদী হয়ে থাকো ? (হে রাসূল!) বলুন , অবশ্যই তার জ্ঞান কেবল আল্লাহরই কাছে , আর আমি তো কেবল সুস্পষ্ট ভাষায় সতর্ককারী বৈ নই। অতঃপর তারা যখন তা (সেই প্রতিশ্রুতি) আসন্ন দেখতে পাবে তখন কাফেরদের চেহারাগুলো কালিমালিপ্ত হয়ে যাবে এবং (তাদেরকে) বলা হবে : এই হলো তা-ই যা তোমরা চাচ্ছিলে। (হে রাসূল!) বলুন , তোমরা কি চিন্তা করে দেখেছো যে , আল্লাহ্ যদি আমাকে ও আমার সঙ্গীসাথীদেরকে ধ্বংস করে দেন বা অনুগ্রহ করেন , তো কে কাফেরদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে রক্ষা করবে ? (হে রাসূল!) বলুন , তিনি পরম দয়াবান ; আমরা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাঁর ওপরই ভরসা করেছি ; তোমরা অচিরেই জানতে পারবে কে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে রয়েছে। তোমরা কি ভেবে দেখেছো যে , তিনি যদি তোমাদের পানিকে (ভূগর্ভে) শুষিয়ে দেন , তো কে তোমাদের জন্য প্রবহমান পানির ব্যবস্থা করবে ?

এ সূরাহটির বাচনভঙ্গিতে একই সাথে যে মাধুর্য ও ওজস্বিতার সমাহার ঘটেছে এবং এর ভাষায় যে ধরনের বিমোহিতকর ঝর্ণাধারার গতি ও ঝঙ্কার রয়েছে তা এর মূল (আরবী) পাঠের যে কোনো পাঠক-পাঠিকার কাছেই সুস্পষ্ট। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় যে , মাত্র ৩০টি আয়াত বিশিষ্ট স্বল্পায়তনের এ সূরাহটিতে অনেকগুলো পয়েন্ট স্থান পেয়েছে এবং বক্তব্যে এক পয়েন্ট থেকে আরেক পয়েন্টে গমনের বিষয়টি তাসবীহ্-মালার একটি দানা থেকে আরেকটি দানায় স্থানান্তরের ন্যায় এমনভাবে ঘটেছে যে , বক্তব্যের গতিশীলতায় কোথাওই কোনো ধরনের ছেদ অনুভূত হয় না।

এ সূরায় যে সব পয়েন্ট স্থান পেয়েছে আমরা তার একটা ফিরিস্তি তৈরী করার চেষ্টা করি :

০ এতে আল্লাহ্ তা আলার নিম্নোক্ত গুণাবলী উল্লেখ করা হয়েছে : তিনি দয়াময় , মেহেরবান , পরম বরকতময় , আসমান-যমীনের সকল রাজত্বের অধিপতি , সব কিছুর ওপরে ক্ষমতাবান , মৃত্যু ও জীবনের স্রষ্টা , মহাপরাক্রান্ত , ক্ষমাশীল , অদৃশ্য , অন্তরস্থ বিষয়ে অবগত , সকল কিছুর স্রষ্টা , সৃষ্টির সব কিছু সম্পর্কে অবগত , সূক্ষ্মদর্শী , সর্বজ্ঞ , প্রতিটি জিনিসের প্রতি দৃষ্টি রাখেন এবং বান্দাহকে সাহায্যকারী।

এছাড়া এতে অপর যে পয়েন্ট্গুলো উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে :

০ মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য (কর্মের পরীক্ষা)

০ স্তরে স্তরে বিন্যস্ত সপ্ত উর্ধলোক সৃষ্টি

০ আল্লাহর সৃষ্টিতে কোনো পার্থক্য নেই (সবই নিখুঁত)।

০ আল্লাহর সৃষ্টিতে অসম্পূর্ণতা নেই।

০ পৃথিবীর আকাশ প্রদীপমালা (নক্ষত্রমালা) দ্বারা অলঙ্কৃত করা হয়েছে।

০ শয়ত্বানের উর্ধলোকে অনুপ্রবেশ প্রতিহত করার ব্যবস্থা আছে।

০ প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা (উল্কা) সৃষ্টি

০ কাফেরদের জন্য জাহান্নামের শাস্তির ব্যবস্থা

০ জাহান্নাম নিকৃষ্ট স্থান

০ জাহান্নামের গর্জন

০ জাহান্নামে প্রহরী আছে।

০ আল্লাহ্ তা আলা সতর্ককারী (নবী) পাঠিয়েছেন।

০ কাফেররা নবীকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

০ কাফেররা সতর্ককারী আগমন ও তাদের পক্ষ থেকে তাঁকে প্রত্যাখ্যানের কথা স্বীকার করবে।

০ কাফেররা স্বীকার করবে যে , তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে বাণী নাযিলের সম্ভাবনার বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছিলো।

০ কাফেররা গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিলো।

০ কাফেররা নবীর দাও আত্ মনোযোগ দিয়ে শোনে নি এবং আক্বল্ দ্বারা বিবেচনা করে নি।

০ কাফেররা নবীর দাও আত্ অন্ধভাবে প্রত্যাখ্যানের জন্য আফসোস্ করবে।

০ (মানুষের উচিত যে কোনো কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা ও আক্বল্ দ্বারা বিবেচনা করা।)

০ দোযখবাসীদের প্রতি আল্লাহর ধিক্কার

০ ঈমানদারদের জন্য আল্লাহ্ তা আলার ক্ষমা ও শুভ প্রতিদান

০ পৃথিবী সুগতিসম্পন্ন ও বিচরণের উপযোগী

০ আল্লাহ্ সকলের জন্য রিয়ক্বের ব্যবস্থা রেখেছেন।

০ সকলকেই আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে।

০ পুনরুত্থান সংঘটিত হবে।

০ আল্লাহর আযাব : ভূগর্ভে প্রোথিত করণ

০ আল্লাহর আযাব : প্রস্তরবৃষ্টি

০ পানি ছাড়া প্রাণী বাঁচে না (ইঙ্গিত)।

০ আল্লাহ্ পানি মাটিতে শুষিয়ে দিয়ে আযাব দিতে পারেন।

০ পূর্ববর্তীরা আল্লাহকে অস্বীকার করেছিলো।

০ আল্লাহ্ পাখীদেরকে আকাশে উড্ডয়নকারী বানিয়েছেন।

০ কাফেররা আত্মপ্রতারিত।

০ কাফেররা জিদের বশে অবাধ্য ও বিমুখ হয়ে আছে।

০ আল্লাহ্ কর্তৃক নির্দেশিত সরল-সুদৃঢ় পথই সঠিক পথ।

০ মানুষকে শ্রবণশক্তি , দৃষ্টিশক্তি ও অন্তঃকরণ দেয়া হয়েছে।

০ মানুষ খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

০ মানুষ ধরণীর বুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

০ কাফেররা আল্লাহর প্রতিশ্রুতিকে (ক্বিয়ামত্ সম্পর্কে) উড়িয়ে দেয়।

০ ক্বিয়ামত্ কখন সংঘটিত হবে সে সম্পর্কিত জ্ঞান কেবল আল্লাহ্ তা আলারই আছে।

০ রাসূল (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সতর্ককারী মাত্র (জবরদস্তিকারী নন)।

০ ক্বিয়ামতের দিনে কাফেরদের চেহারা কালিমালিপ্ত হবে।

০ কাফেরদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করতে হবে।

০ নবী ও ঈমানদারগণ পরম দয়াবান আল্লাহর ওপর ভরসা করেন।

এখানে উক্ত সূরাহর বক্তব্যকে কেবল এতে সন্নিবেশিত তথ্যাদির দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হয়েছে। এ সূরাহর বক্তব্যের বালাগ্বাত্-ফাছ্বাহাতের সৌন্দর্য সম্বন্ধে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা যেতে পারে। এছাড়াও আরো বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এ সূরাহটি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।

বাইবেলে আল্লাহ্ ও নবীদের ( আঃ ) পরিচয়

আল্লাহ্ তা আলার একত্ব ও গুণাবলী এবং নবী-রাসূলগণের ( আঃ) মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে কোরআন মজীদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার পর এখন আমরা দেখবো এ দু টি বিষয়ে বাইবেলের পুরাতন নিয়ম নতুন নিয়ম ভুক্ত পুস্তক সমূহ কী বলছে। তাহলে আমাদের কাছে দু টি বিষয় পরিস্কার হয়ে যাবে। প্রথমতঃ বাইবেলের পুস্তকগুলো বিকৃত হয়ে গেছে ; এখন আর নির্ভেজাল ঐশী কিতাব্ আকারে বর্তমান নেই , দ্বিতীয়তঃ এ সব পুস্তক অধ্যয়ন করে তার সাহায্যে কোরআন মজীদের ন্যায় গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে উভয় নিয়ম -এর বিভিন্ন পুস্তকে প্রচুর বক্তব্য রয়েছে। কিন্তু কোরআন মজীদ যতোখানি আল্লাহ্ তা আলার পবিত্রতা বর্ণনা করেছে ও তাঁকে দোষ-ত্রুটি-দুর্বলতা থেকে মুক্তরূপে তুলে ধরেছে এবং নবী-রাসূলগণকে ( আঃ) যেভাবে মানবিক মর্যাদার সুউচ্চতম চূড়ায় উন্নীত করে তুলে ধরেছে , উক্ত পুস্তকসমূহ (এগুলোর বিদ্যমান বিকৃত রূপ) ঠিক ততোখানিই আল্লাহ্ তা আলার মর্যাদাকে নীচে নামিয়ে এনেছে এবং যে কোনো ধরনের গর্হিত কাজকেই নবী-রাসূলগণের ( আঃ) প্রতি আরোপ করেছে।

এ সত্যটি সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরার লক্ষ্যে এখানে বাইবেলের বিভিন্ন পুস্তক থেকে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করবো। তবে এখানে পুনরায় স্মর্তব্য যে , পুরাতন নিয়ম -এর অন্তর্ভুক্ত পুস্তকসমূহ হচ্ছে ঐশী পুস্তকের বিকৃত সংস্করণ ; মূল ঐশী পুস্তকসমূহ এ সব ত্রুটি থেকে মুক্ত ছিলো। অন্যদিকে নতুন নিয়ম ভুক্ত পুস্তকগুলো আদৌ ঐশী পুস্তক নয় , বরং পুরোপুরি মানব রচিত পুস্তক , তবে প্রথম চারটি পুস্তক হচ্ছে হযরত ঈসা ( আঃ)-এর জীবনকাহিনী যাতে ইনজীলের অনেক আয়াতও উদ্ধৃত হয়েছে।

(1) হযরত আদম ( আঃ) ও বিবি হাওয়া ( আঃ)-এর সৃষ্টি এবং বেহেশত থেকে তাঁদের বহির্গত হবার ঘটনা এভাবে বর্ণিত হয়েছে :

আর সদাপ্রভু ঈশ্বর আদমকে আদেশ দিলেন , তুমি এ বাগানের সমস্ত বৃক্ষের ফল স্বচ্ছন্দে খাও , কিন্তু সদসদ জ্ঞানদায়ক বৃক্ষের ফল খেয়ো না , কারণ , যেদিন তার ফল খাবে সেদিন মরবেই মরবে। আর সদাপ্রভু ঈশ্বর বললেন , মানুষের একাকী থাকা ভালো নয় , আমি তার জন্য তার অনুরূপ সহকারিনী বানাই। পরে সদাপ্রভু ঈশ্বর আদমকে ঘোর নিদ্রায় মগ্ন করলে সে নিদ্রিত হলো ; আর তিনি তার একখানা পাঁজর (-এর অস্থি) নিয়ে মাংস দিয়ে সে জায়গা পূরণ করলেন। সদাপ্রভু ঈশ্বর আদম হতে গৃহীত সে পাঁজর দ্বারা এক স্ত্রী তৈরী করলেন ও তাকে আদমের পাশে আনলেন। ঐ সময় আদম ও তার স্ত্রী উভয়ই উলঙ্গ থাকতো , আর তাদের লজ্জাবোধ ছিলো না। (আদি পুস্তক , 2 : 16-18 , 21-23 ও 25)

সদাপ্রভু ঈশ্বরের সৃষ্ট ভূচর প্রাণীদের মধ্যে সাপ সর্বাপেক্ষা খল ছিলো। সে ঐ নারীকে বললো : ঈশ্বর কি বাস্তবিকই বলেছেন যে , তোমরা বাগানের কোনো বৃক্ষের ফল খেয়ো না ? নারী সাপকে বললো : আমরা এ বাগানের সকল বৃক্ষের ফল খেতে পারি , কেবল বাগানের মাঝখানে যে বৃক্ষটি আছে তার ফল সম্পর্কে ঈশ্বর বলেছেন , তোমরা তা খেয়ো না - স্পর্শও করো না ; করলে মরবে। তখন সাপ নারীকে বললো : কোনোক্রমেই মরবে না। কারণ , ঈশ্বর জানেন , যেদিন তোমরা তা খাবে সেদিন তোমাদের চোখ খুলে যাবে , তাতে তোমরা ঈশ্বরের ন্যায় হয়ে সদসদ জ্ঞান প্রাপ্ত হবে। নারী যখন দেখলো , ঐ বৃক্ষ সুখাদ্যদায়ক ও চক্ষুর জন্য লোভজনক , আর ঐ বৃক্ষ জ্ঞানদায়ক বলে বাঞ্ছনীয় , তখন সে তার ফল আহরণ করে খেলো। পরে সে নিজের ন্যায় তার স্বামীকেও দিলো , আর সে-ও খেলো। এতে তাদের উভয়ের চোখ খুলে গেলো এবং তারা বুঝতে পারলো যে , তারা উলঙ্গ , আর তারা ডুমুর পাতা সেলাই করে ঘাগড়া তৈরী করে নিলো। পরে তারা সদাপ্রভু ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো ; দিনের অবসানে তিনি বাগানে পায়চারি করছিলেন। এতে আদম ও তার স্ত্রী সদাপ্রভু ঈশ্বরের সামনে থেকে বাগানের বৃক্ষসমূহের মাঝে লুকালো। তখন সদাপ্রভু ঈশ্বর আদমকে ডেকে বললেন : তুমি কোথায় ? সে বললো : আমি বাগানে তোমার কণ্ঠস্বর শুনে ভীত হয়েছি। কারণ , আমি উলঙ্গ , তাই নিজেকে লুকিয়েছি। তিনি বললেন : তুমি যে উলঙ্গ তা তোমাকে কে বললো ? যে বৃক্ষের ফল খেতে তোমাকে নিষেধ করেছিলাম তুমি কি তার ফল খেয়েছো ? আর সদাপ্রভু ঈশ্বর বললেন : দেখো , মানুষ সদসদ জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে আমাদের মতো হলো ; এখন পাছে সে হাত বাড়িয়ে জীবনবৃক্ষের ফলও আহরণ করে খেয়ে অনন্তজীবী হয় - এ কারণে সদাপ্রভু ঈশ্বর তাকে আদন্-এর (অবিনশ্বর) বাগান থেকে বের করে দিলেন যাতে সে যে মাটি থেকে সৃষ্ট তাতেই কাজ করে। এভাবে ঈশ্বর মানুষকে তাড়িয়ে দিলেন এবং জীবনবৃক্ষের পথ রক্ষা করার জন্য আদন্-এর (অবিনশ্বর) বাগানের পূর্ব দিকে দেয়াল তুলে দিলেন ও তার ওপরে ঘূর্ণায়মান খড়গ স্থাপন করলেন। (আদি পুস্তক , 3 : 1-11 ও 22-24)

এখানে লক্ষণীয় , এই তথাকথিত আসমানী গ্রন্থ কীভাবে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ তা আলার পবিত্র সত্তায় মিথ্যাবাদিতা আরোপ করছে এবং তাঁর প্রতি কূট কৌশল , ছুতা , মিথ্যা ও ভীতি আরোপ করছে - বলছে , সদাপ্রভু ঈশ্বর মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আদমকে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে নিষেধ করেছেন ও বলেছেন যে , ওটি হচ্ছে মৃত্যুর বৃক্ষ , অতঃপর যেহেতু সদাপ্রভু ঈশ্বর ভয় পেয়ে যান যে , আদম ( আঃ) হয়তো জীবনবৃক্ষের ফল খেয়ে ফেলবেন ও অবিনশ্বর জীবনের অধিকারী হবেন এবং তাঁর খোদায়ী ও আধিপত্য ব্যাহত করবেন , সেহেতু তিনি আদম ( আঃ)কে বেহেশত থেকে বের করে দেন।

অন্যদিকে এই তথাকথিত আসমানী গ্রন্থে এমন কথা বলা হয়েছে যার মানে হচ্ছে , আল্লাহ্ তা আলার শরীর আছে এবং তিনি বেহেশতের মধ্যে পদচারণা করছিলেন। তেমনি এ গ্রন্থ সর্বজ্ঞাতা আল্লাহ্ তা আলার প্রতি অজ্ঞতার অপবাদ আরোপ করছে - বলছে , আদম ( আঃ) কোথায় লুকিয়ে ছিলেন সে সম্পর্কে তিনি অনবহিত ছিলেন , তাই আদম ( আঃ)কে এই বলে ডেকেছিলেন : তুমি কোথায় ?

সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার হচ্ছে এ গ্রন্থে সাপরূপী শয়তানকে মানুষের জন্য কল্যাণকামী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। কারণ , এ গ্রন্থ বলছে যে , শয়তান আদম ( আঃ)কে উপদেশ দিয়ে (জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাইয়ে) মূর্খতা ও অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোয় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে এবং ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে শিখিয়ে দেয়।

(2) বর্তমানে বিদ্যমান তাওরাতে হযরত ইবরাহীম্ ( আঃ) ও ফির্ আউনের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

[স্মর্তব্য , দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী যাবত মিসরের সম্রাটদের উপাধি ছিলো ফির্ আউন্ । অতএব , বলা বাহুল্য যে , এখানে উল্লিখিত র্ফি আউন হযরত মূসা ( আঃ)-এর সময়কার ফির্ আউন নয় এবং এ ফির্ আউনের খারাপ বা খোদাদ্রোহী হওয়া সম্পর্কেও নিশ্চিত ধারণা পোষণ করা সঙ্গত হবে না।]

তাওরাতে বর্ণিত ঘটনাটি নিম্নরূপ :

আর দেশে দুর্ভিক্ষ হলো। তখন ইবরাহীম্ মিসরে প্রবাস করতে যাত্রা করলো। কারণ , কেন আন্ দেশে ভারী দুর্ভিক্ষ হলো। আর ইবরাহীম্ যখন মিসরে প্রবেশ করতে উদ্যত হলো তখন সে তার স্ত্রী সারাহকে বললো : দেখো , আমি জানি , তুমি দেখতে সুন্দরী ; এ কারণে মিসরীয়রা যখন তোমাকে দেখবে তখন তুমি আমার স্ত্রী বিধায় আমাকে হত্যা করবে আর তোমাকে জীবিত রাখবে। অনুরোধ করি , বলো যে , তুমি আমার বোন - যাতে তোমার অনুরোধে আমার মঙ্গল হয় ও তোমার কারণে আমার প্রাণ বেঁচে যায়। পরে ইবরাহীম্ মিসরে প্রবেশ করলে মিসরীয়রা ঐ স্ত্রীকে পরমা সুন্দরী দেখলো। আর ফির্ আউনের অধ্যক্ষগণ তাকে দেখে ফির্ আউনের সামনে তার প্রশংসা করলো। এতে সে স্ত্রী ফির্ আউনের বাড়ীতে নীত হলো। আর তার অনুরোধে সে (ফির্ আউন্) ইবরাহীমকে আদর-যত্ন করলো। এতে ইবরাহীম্ মেষ , গরু , গাধা , দাস-দাসী ও উট পেলো। কিন্তু ইবরাহীমের স্ত্রী সারাহর কারণে সদাপ্রভু ফির্ আউন্ ও তার পরিবারের ওপর কঠিন কঠিন উৎপাতের সৃষ্টি করলেন। এতে ফির্ আউন ইবরাহীমকে ডেকে বললো : আপনি আমার সাথে এ কি আচরণ করলেন! তিনি যে আপনার স্ত্রী এ কথা আমাকে কেন বলেন নি ? তাঁকে আপনার বোন বললেন কেন ? আমি তো তাকে বিবাহ করার জন্য নিয়েছিলাম। এখন আপনার স্ত্রীকে নিয়ে চলে যান। তখন ফির্ আউন লোকদেরকে তার সম্পর্কে আদেশ দিলো , আর তারা সর্বস্বের সাথে তাকে ও তার স্ত্রীকে বিদায় করলো। (আদি পুস্তক , 12 : 10-20)

বাইবেলের এ বক্তব্যের নির্গলিতার্থ দাঁড়ায় এই যে , হযরত ইবরাহীম্ ( আঃ) নিজেই নৈতিক দুর্বলতা ও চারিত্রক দুর্নীতির নায়ক ছিলেন , যে কারণে তিনি তাঁর স্ত্রীকে বোন হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন - যার ফলে ফির্ আউন তাঁকে স্ত্রীরূপে গ্রহণে উদ্যত হয়েছিলো। কিন্তু এটা একেবারেই অসম্ভব যে , আল্লাহ্ তা আলার প্রিয়তম এবং সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত নবী-রাসূলগণের ( আঃ) অন্যতম হযরত ইবরাহীম্ ( আঃ) এহেন জঘন্য কাজ করবেন যা কোনো সাধারণ মানুষও করে না।

(3) হযরত লূত্ব্ ( আঃ) ও তাঁর কন্যাদের সম্পর্কে বাইবেল যা বলে তা অধিকতর জঘন্য। বাইবেল বলেছে :

পরে লূত্ব্ ও তার দুই কন্যা সোয়র হতে পর্বতে উঠে সেখানে গিয়ে থাকলো। কারণ , সে সোয়রে বাস করতে ভয় করলো। আর সে ও তার দুই কন্যা গুহার মধ্যে বসতি করলো। পরে তার জ্যেষ্ঠা কন্যা কনিষ্ঠাকে বললো : আমাদের পিতা বৃদ্ধ এবং জগতসংসারের রীতি অনুসারে আমাদের সাথে উপগত হবে এ দেশে এমন কোনো পুরুষ নেই। অতএব , এসো , আমরা পিতাকে দ্রাক্ষারস পান করিয়ে তার সাথে শয়ন করি ; এরূপে পিতার বংশ রক্ষা করবো। তাতে তারা সে রাতে নিজ পিতাকে দ্রাক্ষারস পান করালো এবং তার জ্যেষ্ঠা কন্যা পিতার সাথে শয়ন করতে গেলো। কিন্তু তার শয়ন ও উঠে যাওয়া লূত্ব্ টের পেলো না। আর পরদিন জ্যেষ্ঠা কনিষ্ঠাকে বললো : দেখো , গত রাতে আমি পিতার সাথে শয়ন করেছি। এসো , আমরা আজ রাতেও পিতাকে দ্রাক্ষারস পান করাই। তারপর তুমি গিয়ে তাঁর সাথে শয়ন করো ; এভাবে পিতার বংশ রক্ষা করবে। এভাবে তারা সে রাতেও পিতাকে দ্রাক্ষারস পান করালো ; পরে কনিষ্ঠা উঠে গিয়ে তার সাথে শয়ন করলো। কিন্তু তার শয়ন করা ও উঠে যাওয়া লূত্ব্ টের পেলো না। এভাবে লূত্বের দুই কন্যাই আপন পিতা থেকে গর্ভবতী হলো। (আদি পুস্তক , 19 : 30-36)

এই হলো বর্তমানে তাওরাত্ নামধারী গ্রন্থের অবস্থা যা আল্লাহ্ তা আলার প্রেরিত মহান ও পবিত্র পয়গাম্বর হযরত লূত্ব্ ( আঃ) ও তাঁর কন্যাদের সম্পর্কে এ ধরনের কল্পকাহিনী ফেঁদেছে। বিচারবুদ্ধির অধিকারী যে কোনো লোকের কাছেই এর মিথ্যা ও জঘন্যতা সুস্পষ্ট।

(4) হযরত ইসহাক্ব্ ( আঃ) এবং তাঁর স্ত্রী ও দুই পুত্র সম্পর্কে বাইবেলে যা বলা হয়েছে সংক্ষেপে তা এই রূপ :

হযরত ইসহাক্ব্ ( আঃ) স্বীয় পুত্র ঈসূ-কে নবুওয়াত্ দিতে চাইলেন। কিন্তু ঐ সময় তাঁর অপর এক পুত্র ইয়া ক্বূব্ ( আঃ) ইসহাক্ব্ ( আঃ)কে ধোঁকা দিলেন এবং তাঁর সামনে ভান করলেন যে , তিনিই ঈসূ , আর তাঁকে (ইসহাক্ব্) অভ্যর্থনা করার জন্য খাদ্য ও মদ্য প্রস্তুত করলেন। ইসহাক্ব্ ( আঃ) উক্ত খাদ্য ও মদ্য গ্রহণ করলেন। এরপর , ইয়া ক্বূব্ ( আঃ) নবুওয়াত্ লাভের জন্য যে প্রতারণা ও কূট কৌশলের আশ্রয় নিলেন তার প্রভাবে ইসহাক্ব্ ( আঃ) তাঁর জন্য দো আ করলেন এবং বললেন : তুমি তোমার ভাইদের ওপর কর্তৃত্বশালী হও এবং তোমার মায়ের সন্তানরা তোমার কাছে অবনত ও ছোট হয়ে থাকুক। অভিশাপ তাদের ওপর যারা তোমাকে অভিশাপ দেয় এবং আনন্দ ও অভিনন্দন তাদের জন্য যারা তোমাকে অভিনন্দন জানায়।

এরপর বলা হয়েছে :

ঈসূ যখন এলো তখন বুঝতে পারলো যে , তার ভাই ইয়া ক্বূব্ নবুওয়াত্ ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। তখন সে তার পিতাকে বললো : পিতা আমাকেও নবুওয়াতের মর্যাদা প্রদানে ধন্য করুন। ইসহাক্ব্ বললো : তোমার ভাই চাতুরী ও কূট কৌশলে অত্যন্ত পাকা ; সে বরকত্ ও নবুওয়াত্ তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। তখন ঈসূ বললো : কেন আপনি আমার জন্য বরকত্ রাখলেন না ? ইসহাক্ব্ বললো : আমি তাকে তোমার ওপরে কর্তৃত্বশালী করে দিয়েছি এবং তোমার অন্যান্য ভাইকে তার গোলামে পরিণত করে দিয়েছি। আর তাকে গম ও পানীয় প্রদান করে সম্পদশালী ও শক্তিশালী করে দিয়েছি। পুত্র! এরপর আর তোমার জন্য কী করতে পারি! তখন ঈসূ উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করে ফেললো। (আদি পুস্তক , 27 : 1-38)

ভেবে দেখুন , নবুওয়াতের পদ ছিনিয়ে নেয়ার কথা কি কল্পনা করা যায় , নাকি বিচারবুদ্ধি তা সম্ভব বলে মনে করে ? আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে ধোঁকাবাজ ও মিথ্যাবাদীকে নবুওয়াত্ প্রদান করা আদৌ সম্ভব কি ? সত্যিই কি হযরত ইয়া ক্বূব্ ( আঃ) ধোঁকা-প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং তার সাহায্যে হযরত ইসহাক্বকে ( আঃ) প্রতারিত করেছিলেন ? আর এর ফলে আল্লাহ্ তা আলাও কি পারেন নি নবুওয়াতকে তার যথাযথ হক্ব্দারের কাছে প্রত্যর্পণ করতে ?تعالی الله عن ذالک علواً کبيراً - নিশ্চয়ই সমুন্নত মহান আল্লাহ্ এরূপ অবস্থার অনেক উর্ধে।

হয়তোবা মদ্যপানজনিত মাতলামীর ঘোরেই লোকেরা এ ধরনের বাজে কল্পকাহিনী তৈরী করে থাকবে যে কল্পকাহিনীতে হযরত ইসহাক্ব্ ( আঃ)-এর ন্যায় একজন মহান পয়গাম্বরের প্রতি মদ্যপানের দুর্নাম আরোপ করা হয়েছে।

(5) বাইবেলে আরো বলা হয়েছে যে , হযরত ইয়া ক্বূব্ ( আঃ)-এর পুত্র ইয়াহূদা স্বীয় পুত্র ইর্-এর স্ত্রী ছামার্-এর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হন ; এর ফলে ছামার্ গর্ভবতী হন এবং ফারেছ্ ও জারে নামে দু টি সন্তান জন্ম দেন। (আদি পুস্তক , 38 : 6-30)

অন্যদিকে ইনজীলের মথি পুস্তকে হযরত ঈসা ( আঃ)-এর পূর্বপুরুষদের বিস্তারিত পরিচয় উপস্থাপন করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে , হযরত ঈসা ( আঃ) এবং হযরত সোলায়মান ( আঃ) ও তাঁর পিতা হযরত দাউদ ( আঃ) হচ্ছেন ফারেছ্-এর বংশধর - আদি পুস্তকের দাবী অনুযায়ী যার জন্ম পুত্রবধুর সাথে ইয়াহূদার ব্যভিচারের ফলে।

কিন্তু বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে এটা একবোরেই অসম্ভব যে , আল্লাহ্ তা আলা ব্যভিচারের বংশধারায় নবী পাঠাবেন , তা-ও আবার পুত্রবধুর ন্যায় মাহরামের সাথে ব্যভিচারজাত বংশধারায়। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত তাওরাতের রচয়িতাদের কাছে নিজেদের কথা ও লেখারই কোনো মূল্য নেই , তাই নবী-রাসূলদের ( আঃ) সম্পর্কে ঘৃণ্য অপবাদমূলক কল্পকাহিনী রচনা করতে তাদের দ্বিধা নেই। অবশ্য অসম্ভব নয় যে , হযরত ঈসা ( আঃ)-এর নবুওয়াত অস্বীকারকারী ইয়াহূদী যাজক ও পণ্ডিতরা তাঁকে হেয় করার হীন উদ্দেশ্যে তাওরাত্ বিকৃত করে এহেন জঘন্য মিথ্যা সংযোজন করে থাকবে।

(6) বাইবেলের শামূয়িলের দ্বিতীয় পুস্তক -এ হযরত দাউদ ( আঃ) সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তা সংক্ষেপে এই :

দাউদ ( আঃ) দ্বীনদার মুজাহিদ উরিয়ার স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হলেন। ফলে উরিয়ার স্ত্রী গর্ভবতী হলো। এমতাবস্থায় বেইজ্জত হবার ভয়ে দাউদ ( আঃ) ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের অপরাধ চাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে উরিয়াকে ঘরে ফিরে গিয়ে স্বীয় স্ত্রীর সাথে মিলিত হবার নির্দেশ দিলেন যাতে তার স্ত্রীর গর্ভসঞ্চারের বিষয়টিকে স্বয়ং উরিয়ার বলে চালিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু উরিয়া ঘরে ফিরে যেতে অস্বীকার করে বললো : প্রভু আমার! ইউআব্ আর তার দাসেরা যখন এ মরুভূমির মাঝে অবস্থান করছে তখন আমি ঘরে ফিরে যাবো এবং পানাহারে অন্তরকে পরিতৃপ্ত করবো , আর স্ত্রীর সাথে মিলিত হবো ? আপনার প্রাণের শপথ! আমি কখনোই এরূপ করবো না।

দাউদ ( আঃ) স্বীয় কৃতকার্য চাপা দেয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সেদিনকার মতো উরিয়াকে নিজের কাছে রাখলেন এবং তাঁর সাথে খানা খাওয়ার ও মদপানের জন্য দাও আত করলেন। এভাবে তিনি উরিয়াকে মাতাল করে দিলেন এবং পরদিন তিনি সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ইউআব্-কে লিখলেন যে , উরিয়াকে যেন কোনো কঠিন যুদ্ধে সৈন্যদের অগ্রভাগে দেয়া হয় ও পরে তাকে একাকী ছেড়ে আসা হয় যাতে সে নিহত হয়। দাউদের নির্দেশ অনুযায়ী ইউআব্ তা-ই করলে উরিয়া নিহত হলো। উরিয়ার নিহত হবার খবর পাওয়ার পর দাউদ ( আঃ) উরিয়ার স্ত্রীকে নিজের গৃহে নিয়ে গেলেন এবং তার স্বামীর মৃত্যুজনিত শোক-কাল শেষ হবার পর আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে বিবাহ করলেন। (শামূয়িলের দ্বিতীয় পুস্তক , 11 : 1-27)

অন্যদিকে বাইবেলের মথি পুস্তকে বলা হয়েছে যে , আল্লাহর নবী হযরত সোলায়মান ( আঃ) হলেন নবী হযরত দাউদ ( আঃ)-এর পুত্র ; তিনি দাউদ ( আঃ)-এর উপরোক্ত স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।

এ ক্ষেত্রেও প্রায় নিশ্চিত সম্ভাবনা এই যে , হযরত ঈসা ( আঃ)-এর নবুওয়াত অস্বীকারকারী ইয়াহূদী যাজক ও পণ্ডিতরা তাঁকে হেয় করার একই হীন উদ্দেশ্যে তাওরাত্ বিকৃত করে এ মিথ্যা কাহিনী সংযোজন করে থাকবে।

এ থেকে সুস্পষ্ট যে , এই মিথ্যা রচনাকারীরা কীভাবে খোদায়ী মর্যাদার বরাবরে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে! আল্লাহ্ তা আলার প্রেরিত নবী-রাসূলদের ( আঃ) পক্ষে এ ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না , এমনকি সামান্যতম ব্যক্তিত্বের অধিকারী কোনো লোকের পক্ষেও কি এহেন জঘন্য অপকর্মে জড়িত হওয়া সম্ভব ? তাছাড়া ইনজীলে হযরত ঈসা ( আঃ) সম্পর্কে যে বলা হয়েছে : মসীহ্ (ঈসা) তাঁর পিতা (পূর্বপুরুষ) দাউদের সিংহাসনে বসলেন ; - তা এ অপবাদের সাথে কী করে সামঞ্জস্যশীল হতে পারে ?

(7) বাইবেলে হযরত সোলায়মান ( আঃ) সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা সংক্ষেপে :

সোলায়মান ( আঃ)-এর সাতশ স্ত্রী ছিলো স্বাধীনা নারী , আর তিনশ জন ছিলো উপপত্নী। এই নারীরা তাঁর অন্তরকে মূর্তি ও কল্পিত দেবদেবীদের প্রতি আকৃষ্ট করে ফেলে। ফলে সোলায়মান ( আঃ) ছাদূনীদের দেবমূর্তি আশতুরাত্ ও আমূনীদের দেবমূর্তি মালকূমের প্রতি আকৃষ্ট হলেন ও তাদের কাছে গেলেন। এতে অসন্তুষ্ট হয়ে সদাপ্রভু সোলায়মান ( আঃ)কে বললেন : আমি তোমার কাছ থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা ও বাদশাহী ছিনিয়ে নেবো এবং তোমার কৃতদাসদের মধ্য থেকে কাউকে তা দান করবো। (রাজকবৃন্দ প্রথম পুস্তক , 11 : 1-11)

হযরত সোলায়মান ( আঃ) সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে :

সোলায়মান ( আঃ) আশতুরাত্ (ছাদূনীদের দেবতা) , কামূশ্ (মুআবীদের দেবতা) ও মালকূম্ (আমূনীদের দেবতা)-এর জন্য ভিন্ন ভিন্ন জমকালো ও সুউচ্চ মন্দির নির্মাণ করেন। পরে সম্রাট ইউশিয়া উক্ত দেবমন্দিরগুলোকে অপবিত্র করেন ; তিনি সেখানকার মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে ফেলেন , সেখানকার গাছগুলোকে কেটে ফেলেন এবং উক্ত মন্দিরগুলো ও অন্যান্য দেবমন্দিরের চিহ্ন পর্যন্তও মুছে ফেলেন। (রাজকবৃন্দ দ্বিতীয় পুস্তক , 23 : 1-14)

যদিও বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে নবী-রাসূলদের ( আঃ) নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত , তথাপি যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেই যে , নবী-রাসূলগণের ( আঃ) জন্য নিষ্পাপ হওয়া অপরিহার্য নয় , তথাপি সুস্থ বিচারবুদ্ধি এটা কল্পনা করতে পারে কি যে , কোনো নবী মূর্তির পূজা করবেন এবং সুউচ্চ ও জমকালো দেবমন্দির নির্মাণ করবেন , অথচ একই সাথে তিনি মানুষকে একেশ্বরবাদ ও এক খোদার উপাসনার দিকে অনবরত আহবান জানাতে থাকবেন ? এ দু টি বিষয় কি বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে সম্ভব , নাকি এ দু টি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কোনোরূপ সামঞ্জস্য আছে ?

(8) হাওশা পুস্তকে বলা হয়েছে :

হাওশা র প্রতি সদাপ্রভুর প্রথম বাণী ছিলো এই : যাও , তোমার নিজের জন্য ব্যভিচারিনী স্ত্রী ও ব্যভিচারজাত সন্তান খুঁজে নাও। কারণ , এ ধরণীপৃষ্ঠ কার্যতঃ সদাপ্রভুর কাছ থেকে ব্যভিচারকারীদের হাতে চলে গেছে। আর হাওশা ও বালায়েম্-এর কন্যা গওহারকে গ্রহণ করলো এবং তার থেকে দু টি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলো। (হাওশা , 1 : 1-9)

একই পুস্তকে আরো বলা হয়েছে : সদাপভু হাওশা কে বললেন : তুমি ব্যভিচারিনী ও উপপতির অধিকারী নারীকে ভালোবাসো ঠিক যেভাবে সদাপ্রভু বানী ইসরাঈলকে ভালোবাসেন। (হাওশা , 3 : 1)

মানবিক বিচারবুদ্ধি কি কল্পনা করতে পারে যে , আল্লাহ্ তা আলা তাঁর নবীকে ব্যভিচারের জন্য এবং ব্যভিচারিনী নারীকে ভালোবাসার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন ?تعالی الله عن ذالک علواً کبيراً - নিশ্চয়ই সমুন্নত মহান আল্লাহ্ এরূপ অবস্থার অনেক উর্ধে।

এ সব বক্তব্য যে কত জঘন্য ও নোংরা তা এ সবের রচয়িতারা যদি লক্ষ্য না করে থাকে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু বিস্মিত হতে হয় এ কারণে যে , বর্তমান নভঃপরিভ্রমণের যুগে সুসভ্য লোকেরা , এমনকি জ্ঞানী-বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত বাইবেলের পুরাতন নিয়ম নতুন নিয়ম ভুক্ত পুস্তকসমূহে উল্লিখিত এ সব কুসংস্কারাচ্ছন্ন নোংরা বক্তব্য পড়েন কী করে এবং এরপরও এ জাতীয় বক্তব্য ও এ সব পুস্তককে ঐশী বাণী বলে বিশ্বাস করেন কী করে!

হ্যা অন্ধ অনুসরণ ও অভ্যাস হচ্ছে এমন বিষয় যা নিজে নিজেই পরিবর্তিত হয়ে যায় না। এহেন অভ্যাস ও অনুসরণ থেকে নিজেকে মুক্ত করা এবং সত্যের সন্ধান করা অত্যন্ত কঠিন কাজ ; এ কাজের জন্য যথেষ্ট মানসিক শক্তি ও সাহসের প্রয়োজন।

(9) বাইবেলের নতুন নিয়ম ভুক্ত বিভিন্ন পুস্তকে বলা হয়েছে :

একদিন মাসীহ্ [হযরত ঈসা ( আঃ)] জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখছিলেন। তখন তাঁর মা ও ভাইয়েরা বাইরে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। উপস্থিত লোকদের মধ্য থেকে কেউ একজন বললো : আপনার সাথে কথা বলার জন্য আপনার মা ও ভাইয়েরা বাইরে অপেক্ষা করছেন। জবাবে মাসীহ্ বললেন : কে আমার মা ? কা রা আমার ভাই ? এরপর হাতের ইশারায় স্বীয় শিষ্যদেরকে দেখিয়ে তিনি বললেন : এরাই আমার মা , এরাই আমার ভাই। কারণ , আসমানে অবস্থানরত পিতার কথা যারা শোনে তারাই আমার ভাই , বোন ও মা। (মথি : দ্বাদশ অধ্যায় , মার্ক্স্ : তৃতীয় অধ্যায় ও লুক্স্ অষ্টম অধ্যায়)

এটা কতোই না হাল্কা ও বাজে কথা! সামান্য চিন্তা করলেই এর অসারতা বুঝতে পারা যায়। হযরত ঈসা মাসীহ্ ( আঃ)-এর পক্ষে কী করে সম্ভব হতে পারে যে , তিনি তাঁর পবিত্রা মাতাকে দূরে ঠেলে দেবেন এবং সাক্ষাৎদানে বঞ্চিত করবেন ?! এটা কী করে সম্ভব যে , তিনি তাঁর মাতার সুউচ্চ নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক মর্যাদাকে উপেক্ষা করে তাঁর ওপরে স্বীয় শিষ্যদেরকে প্রাধান্য ও অধিকতর মর্যাদা দেবেন ? অথচ হযরত ঈসা ( আঃ) তাঁর এই শিষ্যদের সম্পর্কেই বলেছেন : এদের ঈমান নেই। (মার্ক্স্ , 4 : 35-41)

তিনি তাঁর এই শিষ্যদের সম্পর্কে অন্য এক জায়গায় বলেন যে , এদের অন্তরে একটি সরিষা দানা পরিমাণ ঈমানও নেই। (মথি , 17 : 14-21)

আর হযরত ঈসা ( আঃ)-এর এই শিষ্যরা তো তাঁরাই , তাঁর ওপরে যে রাতে ইয়াহূদীরা হামলা চালায় সে রাতে না ঘুমাবার ও তাঁকে পাহারা দেয়ার জন্য তিনি তাঁদেরকে নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও এই শিষ্যরা তাঁর কথা অমান্য করেছিলেন এবং দৃশ্যতঃ ইয়াহূদীরা যখন তাঁকে গ্রেফতার করে তখন তাঁরা তাঁকে একা ফেলে যান ও সেখানে অবস্থানের পরিবর্তে পলায়নকেই অগ্রাধিকার প্রদান করেন। (মথি : 26তম অধ্যায়)

বস্তুতঃ এ হচ্ছে বর্তমানে বিদ্যমান ইনজীলে হযরত ঈসা মাসীহ্ ( আঃ)-এর শিষ্যদের লজ্জাজনক কার্যাবলীর যে বর্ণনা রয়েছে তারই দৃষ্টান্ত। তবে আমরা মনে করি , এ সব কাহিনী পুরোপুরি মিথ্যা - যা ইনজীলের বিকৃতিরই প্রমাণ বহন করছে।

(10) ইনজীলের যোহন পুস্তকে বলা হয়েছে :

মাসীহ্ একদিন এক বিবাহ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলেন। ঘটনাক্রমে তাদের মদ্য শেষ হয়ে গেলো। তখন মাসীহ্ অলৌকিকভাবে তাদের জন্য ছয় কুঁজো মদ্য তৈরী করলেন। (যোহন : 2য় অধ্যায়)

ইনজীলে অন্যত্র বলা হয়েছে : মাসীহ্ মদ্য পান করতেন এবং মদ্যপানের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করতেন। (মথি : একাদশ অধ্যায় ও লুক্ : 7ম অধ্যায়)

কিন্তু এটা একেবারেই অসম্ভব যে , হযরত ঈসা ( আঃ)-এর মতো পূতপবিত্র পয়গাম্বর এহেন অবাঞ্ছিত ও গর্হিত কাজে জড়িত হবেন। তাছাড়া বাইবেলের পুরাতন নিয়ম নতুন নিয়ম ভুক্ত বিভন্ন পুস্তকে মদ্যপানকে সুস্পষ্ট ভাষায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ , তাওরাতে বলা হয়েছে : সদাপ্রভু হারূনকে বললেন : তুমি ও তোমার সন্তানরা যখন জনসমাবেশের শিবিরে প্রবেশ করবে তখন কোনো অবস্থাতেই দ্রাক্ষারস বা অন্য কোনো নেশাকর দ্রব্য স্পর্শ করবে না যাতে তোমরা মারা না পড়ো। আর এ হচ্ছে এক চিরস্থায়ী নির্দেশ যা তোমাদের সমস্ত ভবিষ্যত বংশধরের জন্য বলবৎ থাকবে - যাতে তোমরা সুন্দর ও কুৎসিত এবং পবিত্র ও অপবিত্রের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করতে পারো। (লেভীয় পুস্তক , 10 : 8-10)

অন্যদিকে ইনজীলের লুক্ পুস্তকে যোহনের প্রশংসা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে , তিনি তাঁর প্রভুর সমীপে অত্যন্ত উচুঁ মর্যাদার অধিকারী ; তিনি কখনোই মদ্য বা অন্য কোনো নেশাকর দ্রব্য ঠোঁটে স্পর্শ করেন নি। (লুক্ : প্রথম অধ্যায়)

বস্তুতঃ বাইবেলের পুরাতন নিয়ম নতুন নিয়ম ভুক্ত পুস্তক সমূহে মদপান নিষিদ্ধ হবার সপক্ষে বহু দলীল-প্রমাণ এখনো বিদ্যমান রয়েছে। তা সত্ত্বেও নতুন নিয়ম -এ হযরত ঈসা ( আঃ)-এর মদপানের কল্পকাহিনী পরিবেশন করা হয়েছে।

এই হলো বাইবেলের পুরাতন নিয়ম নতুন নিয়ম ভুক্ত পুস্তকসমূহে পরিবেশিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন , পথভ্রষ্টতা সৃষ্টিকারী ও হাস্যষ্কর বিভিন্ন বিষয় ও বক্তব্যের অংশবিশেষ মাত্র যা কোনো সুস্থ বিচারবুদ্ধি ও যুক্তির সাথেই সামঞ্জস্যশীল নয়। আমরা মুক্তবিবেক মানুষদের খেদমতে উক্ত উদ্ধৃতিসমূহ পেশ করলাম যাতে তাঁরা স্বীয় বিচারবুদ্ধির মানদণ্ডে এগুলো বিচার করেন। তাহলেই তাঁদের সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে , রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) মানব জাতির সামনে যে জ্ঞান-বিজ্ঞান উপস্থাপন করেছেন তা , বিশেষ করে সমুন্নত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কোরআন মজীদের বিষয়বস্তু উক্ত পুস্তকসমূহ থেকে আহরণ করেছেন বলে যারা দাবী করছে তাদের সে দাবী আদৌ গ্রহণযোগ্য কিনা। অন্যদিকে যে সব পুস্তক নবী-রাসূলগণের ( আঃ) পবিত্র সত্তায় এভাবে অবাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্য ও কলঙ্ক আরোপ করেছে সে সব পুস্তককে কী করে খোদায়ী ওয়াহী বলে ধারণা করা যেতে পারে ?


19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38