কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্ 0%

কোরআনের মু‘জিযাহ্ লেখক:
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 46594
ডাউনলোড: 4351

পাঠকের মতামত:

কোরআনের মু‘জিযাহ্
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 60 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 46594 / ডাউনলোড: 4351
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

সাত : কোরআনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করার পক্ষে যুক্তি

কোরআন মজীদের বিরোধীরা বলে : আরবরা যে কোরআনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জে অবতীর্ণ হয় নি এবং কোরআনের বিকল্প গ্রন্থ রচনা করে নি তা এ জন্য নয় যে , কোরআনের বিকল্প গ্রন্থ রচনায় তারা অক্ষম ছিলো। বরং কোরআনের বিরুদ্ধে আরবদের চ্যালেঞ্জে অবতীর্ণ না হওয়ার পিছনে অন্যবিধ কারণ ছিলো।

এ সব কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই যে , মুসলমানরা তাদের রাসূলের যুগে ও খলীফাদের যুগে প্রভুত শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী ছিলো। মুসলমানদের এ শক্তি ও ক্ষমতার ভয়ই মূর্তিপূজক আরবদেরকে কোরআনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ প্রদান ও অন্য যে কোনো ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন থেকে বিরত রেখেছিলো। কারণ , তারা জানতো যে , তারা যদি কোরআনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জে অবতীর্ণ হয় এবং কোরআনের বিকল্প গ্রন্থ রচনার প্রয়াস পায় তাহলে তাদের ওপরে মুসলমানদের পক্ষ থেকে অপূরণীয় ক্ষতি ও বিপদ চেপে বসবে এবং তাদের জান ও মাল ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অন্যদিকে চার খলীফাহর যুগ শেষ হওয়ার সাথে সাথে তাঁদের শক্তি ও প্রভাবের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বানী উমাইয়ার হাতে চলে যায়। কিন্তু তখন একদিকে যেমন উমাইয়াহ্ খলীফাহরা ইসলামের দাও আত বিস্তার নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাতো না , অন্যদিকে সাধারণ জনমনে কোরআনের শব্দাবলীর সৌন্দর্য এবং এর বলিষ্ঠতা ও অর্থপূর্ণ বক্তব্য দারুণ প্রভাব বিস্তার করে বসেছিলো , ফলে সকলেই কোরআন-প্রেমিকে পরিণত হয়েছিলো। কোরআনের শাব্দিক ও তাৎপর্যগত সৌন্দর্য মানুষের হৃদয়ে বিশেষভাবে স্থান করে নেয়। ফলে মানুষ কোরআনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জের মানসিকতা হারিয়ে ফেলে এবং কোরআনের বিকল্প রচনার জন্য আর কেউ অগ্রসর হয় নি।

জবাব : এ আপত্তি কয়েক দিক থেকে দুর্বল , ত্রুটিপূর্ণ ও প্রত্যাখ্যানযোগ্য :

(1) হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) এমন এক সময় মানুষকে কোরআনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জের ও তার বিকল্প রচনার আহবান জানান যখন তিনি মক্কায় অবস্থান করছিলেন এবং ঐ সময় ইসলামের শক্তি-ক্ষমতা ও শৌর্যবীর্যের কোনো নামগন্ধও ছিলো না। ইসলাম তখন কোনো ধরনের শক্তিরই অধিকারী ছিলো না। অন্যদিকে কোরআনের দুশমনরা শক্তি ও ক্ষমতার পুরোপুরি অধিকারী ছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের অধিকারী আরবদের মধ্য থেকে একজন লোকও কোরআনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ও তার অনুরূপ গ্রন্থ রচনার জন্য অগ্রসর হয় নি।

(2) আপত্তিকারীরা যে ভয়-ভীতির কথা উল্লেখ করেছে , ইতিহাস সাক্ষী , এ ধরনের ভয়-ভীতির অস্তিত্ব কখনো ছিলো না। কাফের ও কোরআনে অবিশ্বাসী ব্যক্তি কোরআন ও ইসলামের বিরুদ্ধে তার কুফর্ ও শত্রুতা প্রকাশ করবে এবং কোরআনের অস্বীকৃতি ও স্বীয় আক্বীদাহ্-বিশ্বাস প্রকাশ করবে - এর পথে আদৌ কোনো বাধা ছিলো না। কারণ , আরব উপদ্বীপে ও ইসলামী হুকুমতের অন্যান্য এলাকায় আহলে কিতাবরা মুসলমানদের মাঝে অত্যন্ত আরাম-আয়েশ ও নিরুদ্বেগ-নির্বিঘ্নতার মাঝে বসবাস করতো। তারা পরিপূর্ণ স্বাধীনতার অধিকারী ছিলো। বিশেষ করে আমীরুল মু মিনীন হযরত আলী ( আঃ)-এর যুগে ন্যায়বিচার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত ছিলো এবং তাঁর ন্যায়বিচার , তাঁর মর্যাদা ও তাঁর জ্ঞানের বিষয় বন্ধু ও দুশমন নির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করে থাকে।

উল্লিখিত যুগ সমূহে অর্থাৎ হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) ও চার খলীফাহর যুগে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত ছিলো। এ সময় সামান্যতম ভয়ভীতিরও অস্তিত্ব ছিলো না। এ সময় কেউ যদি কোরআন মজীদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ প্রদান ও এর বিকল্প উপস্থাপনে সক্ষম হতো তাহলে অবশ্যই সে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করতো এবং তার প্রচেষ্টার ফসল লোকদেরকে প্রদর্শন করতো।

(3) যুক্তির খাতিরে যদি ধরে নেই যে , ইসলামের বিরোধীদের জন্য ভয়ভীতির অস্তিত্ব ছিলো যা তাদেরকে প্রকাশ্যে কোরআন মজীদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা থেকে বিরত রেখেছিলো , সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে , ঐ সময় গোপনে কোরআনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ও এর বিকল্প রচনার পথে আহলে কিতাবদের সামনে কী বাধা বিদ্যমান ছিলো ? তারা তো নিজেদের ঘরে এবং নিজস্ব বিশেষ বৈঠকে-সমাবেশে গোপনে হলেও কোরআন মজীদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ও এর বিকল্প রচনা করতে পারতো।

এরূপ ক্ষেত্রে স্বয়ং আহলে কিতাবের পণ্ডিত লোকেরা সে চ্যালেঞ্জ ও কোরআনের বিকল্পের হেফাযত করতে পারতো এবং পরবর্তীকালে কথিত বাধাবিঘ্ন দূরীভূত হওয়া ও ভয়ভীতির যুগ শেষ হয়ে যাবার পর তা প্রকাশ করতে পারতো। তারা যখন তাওরাত্ ও ইনজীল্ বলে দাবীকৃত পুস্তকগুলোর উদ্ভট ও গাঁজাখুরী কল্পকাহিনীগুলো হেফাযত করতে ও পরে তা প্রকাশ করতে পেরেছে , তখন সম্ভব হলে গোপনে কোরআনের বিকল্প রচনা , সংরক্ষণ ও পরে তা প্রকাশের পথে কোনোই বাধা ছিলো না। কিন্তু এরূপ কোনো পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করে নি।

(4) মানুষের প্রকৃতিই এমন যে , পুনরাবৃত্তি যে কোনো জিনিসকেই তার কাছে বিরক্তিকর ও ক্লান্তিকর করে তোলে। কোনো বক্তব্য - তা বালাগ্বাতের বিচারে যতোই উচ্চতর মানের হোক না কেন , বার বার শুনলে ধীরে ধীরে তার সৌন্দর্য ও মিষ্টতার মাত্রা শ্রোতার কাছে কমে যেতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তার কাছে তা একটি সাধারণ , বরং বাজে ও ক্লান্তিকর বক্তব্য বলে মনে হতে থাকে।

এ কারণেই আমরা দেখতে পাই , মানুষ যদি কোনো সুন্দর-সুমধুর কবিতা বার বার শোনে তাহলে তার কাছে তা বিরক্তিকর হয়ে ওঠে , এমনকি অনেক সময় অতি পুনরাবৃত্তির ফলে তা কষ্টদায়ক ও ক্রোধ উদ্রেককারী হয়ে ওঠে। এ সময় যদি তার সামনে অন্য কোনো কবিতা পাঠ করা হয় তাহলে তা তার কাছে প্রথমোক্ত কবিতার তুলনায় অধিকতর সুন্দর ও শ্রুতিমধুর বলে মনে হয়। কিন্তু বার বার পুনরাবৃত্তি করা হতে থাকলে এ দ্বিতীয়োক্ত কবিতাটিও শেষ পর্যন্ত প্রথমটির ন্যায় মনে হতে থাকে। এরপর শ্রোতার কাছে দু টি কবিতার মধ্যকার পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।

বস্তুতঃ মানুষের এ বৈচিত্র্যপিয়াসিতা শুধু তার শ্রবণেন্দ্রিয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং মানুষের সমস্ত রকমের স্বাদ-আস্বাদন ও ভোগ-আনন্দের ক্ষেত্রেই , যেমন : খাদ্য , পোশাক ও অন্য সমস্ত কিছুতেই এ বিধি কার্যকর। এমতাবস্থায় কোরআন মজীদ যদি মু জিযাহ্ না হতো , তাহলে মানুষের বৈচিত্র্যপ্রিয়তা ও নতুনত্বপ্রিয়তার বিধি কোরআন মজীদের ক্ষেত্রেও কার্যকর হতো এবং কালের প্রবাহে ও অতি পুনরাবৃত্তির ফলে শ্রোতার কাছে তা স্বীয় মিষ্টতা ও মাধুর্য হারিয়ে ফেলতো , বরং তা শ্রোতার কাছে বিরক্তিকর ও কষ্টকর বলে মনে হতো। আর তাহলে কোরআনকে মোকাবিলার জন্য তা-ই হতো সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাই যে , কোরআন মজীদের যতো বেশী পুনরাবৃত্তি করা হয় ততোই শ্রোতার কাছে তার সৌন্দর্য ও নতুনত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। তেমনি কোরআন মজীদ যতো বেশী তেলাওয়াত্ করা হয় ততোই তেলাওয়াতকারীর আত্মা উর্ধতর জগতসমূহে আরোহণ করে এবং তার ঈমান- আক্বীদাহ্ পূর্বাপেক্ষা অধিকতর দৃঢ় ও মযবূত হয়।

অন্য সমস্ত রকমের কালামের বিপরীতে কোরআন মজীদের এই যে একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য , তা কোরআনের অলৌকিকত্বকে ক্ষুণ্ন তো করেই না , বরং এ বৈশিষ্ট্যটি কোরআন মজীদের অলৌকিকত্বেরই অন্যতম অকাট্য প্রমাণ ও নিদর্শন।

(5) যুক্তির খাতিরে যদি বিরোধীদের এ কথাকে মেনে নেই যে , কালের প্রবাহে ও পুনরাবৃত্তির ফলে মানুষ কোরআনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে ও তাদের এ অবস্থাই তাদেরকে কোরআনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ থেকে বিরত রেখেছে , তাহলে এ কথা কেবল মুসলমানদের বেলায়ই প্রযোজ্য হতে পারে যারা কোরআন মজীদকে আল্লাহর কালাম্ বলে বিশ্বাস করে - যে কারণে পুনরাবৃত্তি সত্ত্বেও তারা আগ্রহ সহকারে কোরআন শ্রবণ করবে , কিন্তু বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের অধিকারী অমুসলিম আরবদের মধ্যেও পুনরাবৃত্তির ফলে কোরআনের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পাবে - এরূপ দাবী নেহায়েতই উদ্ভট ও অর্থহীন দাবী। এমতাবস্থায় তারা কেন কোরআনের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করা থেকে বিরত থেকেছে এবং কোরআনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ প্রদানে ও এর বিকল্প রচনায় এগিয়ে আসে নি ? অথচ কোরআন মজীদের এ চ্যালেঞ্জ কোনো অমুসলিম লেখকের পক্ষ থেকে মোকাবিলা করা হলেও তা গ্রহণযোগ্য হতো নিঃসন্দেহে।

আট : কোরআন মু জিযাহ্ হলে সাক্ষ্যের প্রয়োজন হতো না

আপত্তিকারীরা আরো বলে : ইতিহাসে আছে , খলীফাহ্ হযরত আবূ বকর যখন কোরআন সংকলিত করতে চাইলেন , তখন হযরত ওমর বিন্ খাত্বত্বাব্ ও হযরত যায়েদ বিন্ ছাবেত্ আনছ্বারীকে এ মর্মে আদেশ দিলেন যে , তাঁরা যেন মসজিদের দরযার পাশে বসেন এবং যে কোনো বক্তব্য কোরআনের আয়াত বলে দু জন লোক সাক্ষ্য প্রদান করবে তা-ই লিপিবদ্ধ করে নেন। এভাবেই কোরআন সংকলিত হয়। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে , কোরআন কোনো মু জিযাহ্ বা অসাধারণ বক্তব্য নয়। কারণ কোরআন যদি মু জিযাহ্ হতো তাহলে তার এ অসাধারণত্বই তার অলৌকিকতা প্রমাণ করতো এবং তা সংকলনের ক্ষেত্রে এটাই ভিত্তিস্বরূপ হতো। সে ক্ষেত্রে অন্যদের নিকট থেকে সাক্ষ্য গ্রহণের প্রয়োজন হতো না।

জবাব : এ আপত্তি বিভিন্ন দিক থেকে দুর্বল , ত্রুটিপূর্ণ ও ভিত্তিহীন। তা হচ্ছে :

(1) কোরআন মজীদের অলৌকিকতা তার বালাগ্বাত্-ফাছ্বাহাত্ ও সাহিত্যিক সৌন্দর্যে , আলাদা আলাদাভাবে একেকটি শব্দের মধ্যে নয় (যেহেতু এ শব্দগুলো তো মানুষের ভাষারই শব্দ এবং অন্যদেরও আয়ত্তযোগ্য)। এমতাবস্থায় , যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেই যে , দু জন লোকের সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই কোরআন মজীদের আয়াত সমূহ সংগ্রহের কথা সত্য , তাহলে বলতে হয় যে , কোরআন সংকলনের সময় কিছু শব্দের কমবেশী হবার সম্ভাবনা থাকতো , ফলে সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হতো ; কমপক্ষে দু জন লোকের সাক্ষ্য গ্রহণের ফলে এ আশঙ্কা দূরীভূত হয়।

(2) এছাড়া , মানুষ কোরআন মজীদের কোনো সূরাহর সমতুল্য সূরাহ্ রচনায় অক্ষম - এ কথার মানে এ নয় যে , কোরআন মজীদের কোনো বাক্যের সমতুল্য বাক্য বা কোনো আয়াতের বিকল্প আয়াত রচনায়ও অক্ষম হবে। বরং কোরআন মজীদের বাক্য বা আয়াতের সমতুল্য বাক্য বা আয়াত রচনা মানুষের পক্ষে সম্ভব এবং মুসলমানরাও একে অসম্ভব বলে দাবী করে নি। তেমনি কোরআন মজীদও একটি আয়াত রচনার চ্যালেঞ্জ প্রদান করে নি , বরং কমপক্ষে একটি সূরাহ্ রচনার চ্যালেঞ্জ প্রদান করেছে। অতএব , (দু -দু জন লোকের সাক্ষ্য গ্রহণের কথা যুক্তির খাতিরে সত্য ধরে নিলে) বিচ্ছিন্নভাবে জাল আয়াত তৈরী ও তা কোরআনের নামে চালিয়ে দেয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে দু -দু জন লোকের সাক্ষ্য প্রয়োজন ছিলো।

(3) কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে , দু -দু জন ছ্বাহাবীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আয়াত লিপিবদ্ধ করে কোরআনের সংকলন করা হয়েছে বলে যে সব হাদীছে উল্লেখ করা হয়েছে সে সব হাদীছ মুতাওয়াতির্ নয় , বরং খবরে ওয়াহেদ। আর এহেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো মতেই খবরে ওয়াহেদ পর্যায়ের হাদীছকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করা চলে না।

(4) উক্ত হাদীছগুলো অপর কতগুলো হাদীছের সাথে সাংঘর্ষিক যাতে বলা হয়েছে যে , কোরআন মজীদ হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর জীবদ্দশায়ই সংকলিত হয়েছে , প্রথম খলীফাহ্ হযরত আবূ বকরের যুগে নয়। (অত্র গ্রন্থকারের কোরআনের পরিচয় গ্রন্থে এ বিষয়ে মোটামুটি বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। তবে অত্র গ্রন্থের বিষয়বস্তুর জন্য এ বিষয়ে এখানে প্রদত্ত আভাসটুকুই যথেষ্ট বলে মনে হয়।)

অন্যদিকে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর বহু সংখ্যক ছ্বাহাবী কোরআন মজীদ পুরোপুরি মুখস্ত করেছিলেন এবং কত লোক যে আংশিক মুখস্থ করেছিলেন তার সংখ্যা একমাত্র আল্লাহ্ তা আলা ছাড়া আর কেউ জানে না। এমতাবস্থায় এবং কোরআন মজীদের এতো বিপুল সংখ্যক হাফেয্ (মুখস্তকারী)-এর বর্তমানে কোরআনের আয়াত প্রমাণের জন্য দু -দু জন করে লোকের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে - এ কথা কোনো মতেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।

এছাড়া বিচারবুদ্ধির দলীলের দ্বারাও , বিরোধীদের হাতের হাতিয়ার স্বরূপ উক্ত হাদীছ সমূহের অসত্যতা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। কারণ , কোরআন মজীদ হচ্ছে মুসলমানদের হেদায়াতের সবচেয়ে বড় মাধ্যম যা তাদেরকে মূর্খতা ও দুর্ভাগ্যের অন্ধকার থেকে জ্ঞান , সৌভাগ্য ও সঠিক পথের আলোয় নিয়ে এসেছে। এ কারণে মুসলমানরা কোরআন মজীদের প্রতি পরিপূর্ণরূপে অনুরাগী ছিলেন এবং একে সব কিছুর ওপরে গুরুত্ব দিতেন। তাঁরা দিনরাত কোরআন অধ্যয়নে মশগুল থাকতেন এবং কোরআনের আয়াতকে গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক মনে করতেন। তাঁরা কোরআনের আয়াত ও সূরাহর মাধ্যমে কল্যাণ হাসিলের চেষ্টা করতেন। আর এ সব ক্ষেত্রে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)ও তাঁদেরকে পুরোপুরি উৎসাহিত করতেন।

এমতাবস্থায় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষ ধারণা করতে পারে কি যে , মুসলমানরা কোরআন মজীদের আয়াত সম্পর্কে সন্দেহ-সংশয়ে ভুগছিলেন - যা নিরসনের জন্য দু জন দু জন করে সাক্ষ্য গ্রহণের প্রয়োজন ছিলো ?

কোরআন মজীদের খোদায়ী ওয়াহী হওয়ার বিষয়টিকে কেউ স্বীকার করতে পারে , আবার কেউ স্বীকার না-ও করতে পারে। কিন্তু কোরআন মজীদ যে বর্তমানে যেভাবে প্রচলিত আছে ঠিক সেভাবেই হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) কর্তৃক উপস্থাপিত হয়েছে - ইসলাম ও কোরআনের ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকেফহাল কোনো ব্যক্তির পক্ষেই তাতে বিন্দুমাত্রও সন্দিহান হওয়া সম্ভব নয়।

এখানে বিশেষভাবে মনে রাখার বিষয় এই যে , কোরআন মজীদ হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর যুগ থেকেই তিনি নিজে যেভাবে বিন্যস্তরূপে পড়েছেন ঠিক সে বিন্যাস সহকারে লিপিবদ্ধভাবে ও কণ্ঠস্থভাবে প্রচলিত আছে। কিন্তু তাঁর মুখের অন্যান্য বাণী - যা হাদীছ রূপে পরিগণিত - এভাবে সুবিন্যস্ত ও পুরোপুরি লিপিবদ্ধভাবে তাঁর যুগ থেকে চলে আসে নি। বরং বর্তমানে প্রচলিত হাদীছ গ্রন্থাবলী হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে শুরু করে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে সুবিন্যস্তভাবে সংকলিত হয়েছে। এভাবে শুরু থেকেই কোরআন ও হাদীছের মধ্যে গুরুত্ব প্রদানের দিক থেকে আসমান-যমীন পার্থক্য করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কোরআন মজীদের সন্দেহাতীত অবস্থা সম্পর্কে কয়েকটি প্রমাণ উল্লেখ করা যায়। তা হচ্ছে :

প্রথমতঃ অসংখ্য হাদীছের সত্যাসত্য বা বক্তব্যের হুবহু অবস্থা সম্পর্কে মুসলিম মনীষীদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও কোরআন মজীদের একটি শব্দের ব্যাপারেও মায্হাব্ ও ফিরক্বাহ্ নির্বিশেষে সামান্যতম মতপার্থক্যও নেই। এমনকি কোরআন মজীদের প্রতিটি সূরাহর শুরুতে বিসমিল্লাহির্ রাহমানির্ রাহীম্ থাকা সত্ত্বেও সূরাহ্ আত্-তাওবাহর শুরুতে তা নেই এবং এ ব্যাপারে কোনো মতপার্থক্য হয় নি। কারণ , যেহেতু হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) ঐ সূরাহটি বিসমিল্লাহির্ রাহমানির্ রাহীম্ সহযোগে শুরু করেন নি , সেহেতু কেউ বলে নি যে , এর শুরুতে বিসমিল্লাহির্ রাহমানির্ রাহীম্ পড়া উচিত। তেমনি কতোগুলো সূরাহর শুরুতে কিছু বিচ্ছিন্ন হরফ (হুরূফে মুক্বাত্বত্বা আত্) রয়েছে আরবী ভাষার অভিধান থেকে যার অর্থোদ্ধার করা সম্ভব নয়। তথাপি কেউ এ বর্ণসমষ্টি বাদ দিয়ে ঐ সব সূরাহ্ পড়েন নি। কারণ , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) যখন ঐ বর্ণসমষ্টি সহকারে সংশ্লিষ্ট সূরাহ্গুলো পড়েছেন তখন তা বাদ দিয়ে পড়ার চিন্তা কেউ করেন নি।

কোরআন মজীদে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ না করার ব্যাপারে ছ্বাহাবীগণের এ ধরনের সতর্কতা থেকে প্রমাণিত হয় যে , কোরআন মজীদকে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) যেভাবে পেশ করেছেন ঠিক সেভাবেই চলে আসছে ; এতে বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো লোক সন্দেহ পোষণ করতে পারে না। এমতাবস্থায় দুইশ বছর পরে সংকলিত হাদীছ সমূহে যদি এমন কিছু পাওয়া যায় যা কোরআন মজীদের প্রামাণ্যতাকে দুর্বলরূপে তুলে ধরে বা স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর যুগে ও প্রথম খলীফাহর যুগে কোরআন মজীদ খুবই কম প্রচলিত ছিলো বলে প্রতিপন্ন করে (দু জন দু জন লোকের সাক্ষ্য দ্বারা কোরআনের আয়াত প্রমাণের দাবীর এ ছাড়া আর কী অর্থ হতে পারে ?), তাহলে সে সব হাদীছ যে ইসলামের দুশমনদের দ্বারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে রচিত ও মুসলিম সমাজে প্রক্ষিপ্ত তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ থাকতে পারে না।

বস্তুতঃ কোরআন মজীদের চেয়ে বহু গুণে কম গুরুত্বপূর্ণ কোনো কোনো মুতাওয়াতির্ হাদীছ যেখানে শত শত ছ্বাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে , সেখানে কোরআন দু জন দু জন লোকের সাক্ষ্যের ওপর নির্ভরশীল হবে এরূপ দাবী শুধু উদ্ভটই নয় , বরং পাগলামির শামিল।

দ্বিতীয়তঃ ইসলামের সকল মায্হাব্ ও ফিরক্বাহর সূত্রে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীছের ভিত্তিতে তাদের অভিন্ন মত এই যে , কোরআন মজীদ লিপিবদ্ধ করার জন্য হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) কয়েক জন ছ্বাহাবীকে লিপিকার হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। তাঁদের কেউ না কেউ সব সময়ই তাঁর কাছে থাকতেন এবং কোনো আয়াত বা সূরাহ্ নাযিল্ হওয়ার সাথে সাথেই তা লিপিবদ্ধ করতেন। নবী করীম (ছ্বাঃ) স্বয়ং কোরআন মজীদের তখন পর্যন্ত নাযিল্ হওয়া অংশের মধ্যে ঐ সময় নাযিল্ হওয়া আয়াত বা সূরাহ্টির অবস্থান জানিয়ে দিতেন এবং তিনি ও ছ্বাহাবীগণ এ বিন্যাসেই কোরআন তেলাওয়াত্ করতেন এবং সে বিন্যাসেই রামাযান মাসে নামাযে তা ধারাবাহিকভাবে পড়তেন। এভাবে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের আগেই পুরো কোরআন মজীদের লিপিবদ্ধকরণ ও সংকলন সমাপ্ত হয়।

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের মোটামুটি তিন মাস আগে বিখ্যাত বিদায় হজ্বের সময় কোরআন মজীদের সর্বশেষ আয়াত সমূহ নাযিল্ হয় এবং কোরআন নাযিল্ সমাপ্ত হয়। এ সময় তাঁর ছ্বাহাবীর সংখ্যা ছিলো লক্ষাধিক। এদের মধ্যে অনেকের কোরআন মজীদ পুরোপুরি মুখস্ত ছিলো এবং কারো কারো কাছে কোরআনের নিজস্ব কপি ছিলো।

এ পরিস্থিতিতে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া লিখিত কোরআন মজীদের উপস্থিতিতে হযরত আবূ বকরের পক্ষ থেকে নতুন করে কোরআন সংকলন করার এবং বহু সংখ্যক ছ্বাহাবীর কোরআন মজীদ মুখস্থ থাকা সত্ত্বেও মাত্র দু জন লোকের সাক্ষ্যকে কোরআনের আয়াত প্রমাণের জন্য মানদণ্ড রূপে গ্রহণ করার প্রশ্নই ওঠে না। তারপরও যদি তিনি এরূপ পদক্ষেপ নিতেন তাহলে অবশ্যই তিনি ছ্বাহাবীদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদের সম্মুখীন হতেন।

তৃতীয়তঃ হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কোরআন মজীদের সংকলন বিভিন্ন ধরনের ও আকৃতির বস্তুর ওপর লিখিত হয়েছিলো - এ কারণে হযরত আবুবকর যদি ব্যবহারের জন্য সুবিধাজনক একটি কপি তৈরী করতে চাইতেন তো হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া সংকলন থেকে হাল্কা ও অভিন্ন সাইজের তৎকালে প্রাপ্ত কাগজে কপি করাতেন - হযরত উছ্মান্ যেরূপ করিয়েছিলেন - এবং অন্যদের দ্বারা তা যাচাই করিয়ে নিতেন , নতুন সংকলন করার কাজে হাত দিতেন না ; দিলেও প্রতিবাদের সম্মুখীন হতেন।

এ থেকে প্রমাণিত হয় যে , হযরত আবুবকরের নির্দেশে কোরআন মজীদ সংকলিত হয় বলে যে সব হাদীছে উল্লিখিত রয়েছে সে সব হাদীছ পরবর্তীকালে রচিত মিথ্যা হাদীছ সমূহের অন্যতম।

নয় : কোরআন বালাগ্বাতে ভিন্ন রীতির অনুসারী

কোরআন মজীদের অলৌকিতা সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপনকারীরা আরো বলে : কোরআন এক বিশেষ ও নিজস্ব সাহিত্যরীতির অনুসারী - যা আরবী ভাষার বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাত্-এর নায়কগণ ও বাগ্মীদের অনুসৃত ও তাঁদের মধ্যে বহুলপ্রচলিত রীতিসমূহ থেকে ভিন্নতর , বরং তার বিপরীত। কারণ , কোরআন বহু বিষয়কে একত্রে মিশ্রিত করেছে এবং যে কোনো সুযোগেই যে কোনো বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। যেখানে ইতিহাস নিয়ে কথা বলেছে সেখানে সহসাই সুসংবাদ প্রদান ও সতর্ককরণে প্রবৃত্ত হয়েছে অথবা জ্ঞানমূলক কথা বলেছে বা জ্ঞানমূলক উপমা প্রদান করেছে। কোরআন যদি বিভিন্ন সুবিন্যস্ত অধ্যায় ও বিভাগে বিভক্ত থাকতো এবং প্রতিটি অধ্যায়ে একেক ধরনের আয়াত সংকলিত হতো তাহলে তা অধিকতর উপকারী প্রমাণিত হতো এবং তা থেকে কল্যাণ হাছ্বিল্ সহজতর হতো।

জবাব : কোরআন মজীদ হেদায়াতের গ্রন্থ। মানুষকে পার্থিব ও পরকালীন জীবনের কল্যাণ ও সৌভাগ্যের দিকে পরিচালিত করার লক্ষ্যে এ গ্রন্থ নাযিল্ করা হয়েছে। কোরআন মজীদ ফিক্ব্হী , ঐতিহাসিক , আখ্লাক্বী বা এ জাতীয় অন্যান্য বিষয় ভিত্তিক গ্রন্থের অনুরূপ কোনো গ্রন্থ নয় যে , প্রতিটি বিষয় একেকটি অধ্যায়ে বর্ণিত হবে এবং বিষয়বস্তুকে এ নিয়মে বিন্যস্ত করা হবে।

এতে সন্দেহের বিন্দুমাত্রও অবকাশ নেই যে , কোরআন মজীদে যে সাহিত্যরীতি ও বিষয়বস্তু বিন্যাস অনুসৃত হয়েছে কেবল তা-ই এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সবচেয়ে ভালোভাবে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম । কারণ , কেউ যদি কোরআন মজীদের মাত্র অল্প কয়েকটি সূরাহ্ও অধ্যয়ন করে , তাহলে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই এবং বলতে গেলে অনায়াসেই কোরআন মজীদের অনেক লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে পরিচিত হতে পারে। একটি সূরাহ্ অধ্যয়ন করেই সে সৃষ্টির উৎস ও সূচনা এবং পরকাল ও পুনরুত্থানের প্রতি মনোসংযোগ করতে পারে , তেমনি অতীতের লোকদের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হতে পারে এবং তাদের পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। অন্যদিকে সে কাম্য ও উত্তম চরিত্র ও আচরণ এবং সমুন্নত জীবনধারা সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করে সৌভাগ্যবান হতে পারে। সাথে সাথে সেই একই সূরাহ্ থেকে সে তার করণীয় দায়িত্ব-কর্তব্য এবং ইবাদত-বন্দেগী ও সামাজিক জীবন সম্পর্কে কোরআন মজীদের আদেশ-নিষেধের অংশবিশেষ জানতে পারে।

হ্যা , এতো সব বিষয় কেবল একটি সূরাহ্ থেকেই হাছ্বিল্ করা যেতে পারে। অথচ এ সত্ত্বেও কালামের বিন্যাসে কোনোরূপ দুর্বলতা সঞ্চারিত হয় নি , বরং সূরাহটির প্রতিটি অংশে ও স্তরেই বক্তব্যের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সামঞ্জস্য এবং গতিশীলতা ও বক্তব্যের ধাঁচের দাবী রক্ষিত হয়েছে , আর সমুন্নততম প্রাঞ্জল বাচনভঙ্গির দাবীও পূরণ হয়েছে।

এর পরিবর্তে কোরআন মজীদ যদি বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক অধ্যায়ে বিন্যস্ত হতো তাহলে তা থেকে এতো সব কল্যাণ হাছ্বিল্ সম্ভব হতো না এবং তা এতোখানি ফলপ্রসু হতো না। সে অবস্থায় পাঠক-পাঠিকারা কেবল পুরো কোরআন মজীদ অধ্যয়ন সাপেক্ষেই এর মহান ও সমুন্নত লক্ষ্যসমূহের সাথে পরিচিত হতে পারতো। কিন্তু এমনও হতে পারতো যে , পুরো কোরআন অধ্যয়নের পথে কেউ হয়তো কোনো বাধা বা সমস্যার সম্মুখীন হতো , ফলে পুরো কোরআন অধ্যয়ন করতে না পারায় সে কোরআন থেকে খুব সামান্যই কল্যাণ হাছ্বিল্ করতে পারতো।

সত্যি কথা বলতে কি , কোরআন মজীদের অনুসৃত বক্তব্য উপস্থাপন রীতির অন্যতম শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য এখানেই নিহিত - যা কোরআনকে বিশেষভাবে মাধুর্যমণ্ডিত ও আকর্ষণীয় করেছে। কোরআন মজীদ পরস্পরবিচ্ছিন্ন বিভিন্ন বিষয়কে পাশাপাশি বর্ণনা করা সত্ত্বেও তাকে এমনভাবে পেশ করেছে যে , এ সব বিষয়ের মধ্যে পুরোপুরিভাবে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর কোরআন মজীদের বাক্যসমূহ মহামূল্য মুক্তানিচয়ের ন্যায় বিশেষ বিন্যাস সহকারে পরস্পর পাশাপাশি গ্রথিত হয়েছে এবং এক বিস্ময়কর বিন্যাসপদ্ধতি অনুসরণে পরস্পর সংযুক্ত ও সম্পর্কিত হয়েছে।

কিন্তু কী-ই বা করার আছে! ইসলামের অন্ধ দুশমনদের কাছে এটাও একটা আপত্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে! অন্ধ দুশমনী তাদের চোখকে অন্ধ এবং তাদের কানকে বধির করে ফেলেছে। তাই সৌন্দর্য তাদের কাছে কুৎসিতরূপে প্রতিভাত হচ্ছে এবং পূর্ণতা তাদের কাছে ত্রুটি ও দুর্বলতা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।

এতদসত্ত্বেও , কোরআন মজীদকে যদি বিষয়বস্তু ভিত্তিক বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভক্ত ও বিন্যস্ত করা হতো , তাহলে সে ক্ষেত্রে একটি সমস্যার সৃষ্টি হতো। তা হচ্ছে , কোরআন মজীদে কিছু কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা বিভিন্ন কারণে বিশেষ সামঞ্জস্য সহকারেই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গে একই ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু যে সব ঘটনা বিভিন্ন প্রসঙ্গে ও বিভিন্ন ভঙ্গিতে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে , তা যদি একটিমাত্র অধ্যায়ে সংকলিত হতো , সে ক্ষেত্রে যে সব উপলক্ষ্য নিয়ে এগুলোর পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে তা অর্থহীন হয়ে পড়তো , বরং পুনরাবৃত্তি বিরক্তিকর বলে পরিগণিত হতো।

দশ : কোনো গ্রন্থেরই বিকল্প রচনা সম্ভব নয়

কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকারকারীদের অনেকে কোরআন মজীদের অনুরূপ অর্থাৎ সম মানের বিকল্প গ্রন্থ বা এর কোনো সূরাহর সম মানের বা বিকল্প কোনো সূরাহ্ রচনা করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় - এ দাবীর জবাবে বলে : শুধু কোরআনই নয় , বরং কোনো গ্রন্থেরই সম মান সম্পন্ন বা বিকল্প গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব নয়। যদি উপস্থাপিত গ্রন্থের কিছু শব্দের রদবদল করে বিকল্প গ্রন্থ রচনা করা হয় তাহলে তা কোনো মৌলিক গ্রন্থ হবে না , বরং তা হবে উপস্থাপিত গ্রন্থের অনুসৃতি মাত্র এবং অনুসৃতি হবার কারণেই তা দুর্বল মানের বলে প্রতিপন্ন হবে। অন্যথায় তা হবে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থ - যাকে উপস্থাপিত প্রথমোক্ত গ্রন্থের সাথে তুলনা করে তার মান বিচার করা যুক্তিসঙ্গত কাজ হবে না। উদাহরণস্বরূপ : কেউ যদি গীতাঞ্জলির বিকল্প রচনা করতে চায় তাহলে তা হবে অনেকটা গীতাঞ্জলির প্যারোডির ন্যায় - যা কোনো মৌলিক কাব্যগ্রন্থ বলে বিবেচিত হবে না এবং গীতাঞ্জলির অনুসৃতির কারণেই মানের দিক থেকে দুর্বল বলে পরিগণিত হবে। নয়তো তা গীতাঞ্জলি থেকে এমনই পার্থক্যের অধিকারী হবে যে , দু টি গ্রন্থের মধ্যে তুলনা ও বিচার করা চলবে না। কারণ , তা গীতাঞ্জলির তুলনায় উন্নততর মানেরই হোক বা নিম্নতর মানেরই হোক , তা গীতাঞ্জলির বিকল্পরূপে পরিগণিত হবে না।

জবাব : কোনো গ্রন্থের বিকল্প রচনার মানে এ নয় যে , ঐ গ্রন্থের বাক্যগঠন প্রণালী , ব্যবহৃত শব্দাবলী , রচনারীতি , (কবিতার ক্ষেত্রে) ছন্দ ও মাত্রা ইত্যাদি হুবহু অনুসৃত হতে হবে। বরং ঐ গ্রন্থের বিষয়বস্তুর অভিন্ন বিষয়বস্তু সম্বলিত গ্রন্থ নিজস্ব ধাঁচে বাক্যগঠন , শব্দ চয়ন ও প্রয়োগ , (কবিতার ক্ষেত্রে) ছন্দ ও মাত্রা এবং ভিন্ন ধরনের রচনারীতি ব্যবহারের মাধ্যমে রচনা করা যায়। সে ক্ষেত্রে সাহিত্যরসিকগণ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তু সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞগণ বিচার করে বলতে পারবেন একই বিষয়বস্তুর ওপরে রচিত দু টি গ্রন্থের মধ্যে কোনটি বিষয়বস্তুর উন্নততর উপস্থাপনে অধিকতর সফল এবং বাক্যগঠন , শব্দচয়ন , শব্দপ্রয়োগ , ছন্দ উপমা ইত্যাদির ক্ষেত্রে (ভিন্নতা সত্ত্বেও) কোনটি অধিকতর শক্তিশালী। এটা যেমন একই বিষয়বস্তু সম্বলিত দু টি গ্রন্থের ক্ষেত্রে সত্য , তেমনি দু টি প্রবন্ধ বা দু টি কবিতার ক্ষেত্রেও সত্য।

এ প্রসঙ্গে বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাগণ পরিচিত এমন দু টি বাংলা কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিতে চাই। ক্ষুধার প্রভাব সম্পর্কে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন :

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়

পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।

একই বিষয়ে কবি রফিক আজাদ লিখেছেন :

ভাত দে হারামজাদা

নইলে মানচিত্র খাবো।

ক্ষুধা সম্পর্কে এ দু টি উদ্ধৃতি বাংলা কবিতার জগতে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠতম উদ্ধৃতি। দু টি উদ্ধৃতির বিষয়বস্তু অভিন্ন , তা হচ্ছে ক্ষুধা । কিন্তু দু টি উদ্ধৃতিতে একটি শব্দেরও মিল নেই , ছন্দেরও মিল নেই। তা সত্ত্বেও উভয় উদ্ধৃতিতেই ক্ষুধার তীব্রতা ও প্রভাব অত্যন্ত সফলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এ দু টি কবিতাংশের মধ্যে এতো পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সাহিত্যের বিচারকদের পক্ষে উভয় উদ্ধৃতি বিশ্লেষণ করে রায় দেয়া সম্ভব যে , ক্ষুধার যন্ত্রণার তীব্রতা , গভীরতা ও প্রভাব-প্রতিক্রিয়া পরিস্ফূটনের দিক থেকে এবং সেই সাথে সাহিত্যিক মানের বিচারে কোন্ কবিতাংশটি অধিকতর সফল।

কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে রচনা প্রতিযোগিতাও এর অন্যতম প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এরূপ ক্ষেত্রে একই বিষয়ে বিভিন্ন লেখকের লেখার মধ্যে মান বিচার করে শ্রেষ্ঠতম রচনা নির্বাচন করা হয়। কিন্তু এ ধরনের প্রতিযোগিতায় অন্যতম পূর্বশর্ত থাকে এই যে , একই বিষয়ে পূর্ব থেকে বিদ্যমান কোনো রচনার নকল বা অনুসরণ করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না , যদিও পূর্ব থেকে বিদ্যমান রচনা অধ্যয়ন করে তা থেকে সাহায্য নেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে না। এরূপ ক্ষেত্রে সাধারণতঃ সুদক্ষ লেখক পূর্ব থেকে বিদ্যমান শ্রেষ্ঠ রচনাবলীর তুলনায়ও উন্নততর রচনা উপস্থাপনে সক্ষম হন। কারণ , তিনি পূর্ববর্তী রচনাবলী অধ্যয়ন করে তার দুর্বল দিকগুলো উদ্ঘাটন করার এবং স্বীয় রচনাকে তা থেকে মুক্ত রাখার সুযোগ পান।

এভাবে একই বিষয়ের ওপরে কয়েক জন কবি , সাহিত্যিক বা লেখকের পক্ষে ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি কবিতা , বা প্রবন্ধ বা গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব যা বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা এবং ভাষাগত ও সাহিত্যিক মানের দিক থেকে পরস্পরের সাথে তুলনাযোগ্য হবে। এমনকি এ ধরনের লেখা বিভিন্ন ভাষায় লেখা হলেও পরস্পর তুলনাযোগ্য হতে পারে এবং এ ধরনের তুলনা প্রচলিত আছে। সুতরাং কোরআনের বিরোধীদের উত্থাপিত কূট যুক্তি সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যানযোগ্য।

এটা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট যে , কোরআন মজীদ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে ব্যাপক বিষয়বস্তুর ওপরে আলোচনা করেছে। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব , সংজ্ঞা , পরিচয় ও শক্তি-ক্ষমতা , পরকালীন জীবন ও বেহেশত-দোযখ , নবুওয়াত্ , নবী-রাসূলগণের ( আঃ) দাও আত ও আন্দোলনের ইতিহাস , চরিত্র ও নৈতিকতা , ইবাদত্-বন্দেগী , আধ্যাত্মিকতা , রাজনীতি , অর্থনীতি , সমাজতত্ত্ব , মনস্তত্ত্ব , দর্শন , জ্যোতির্বিজ্ঞান , রসায়ন , পদার্থবিজ্ঞান , উদ্ভিদবিজ্ঞান , প্রাণিবিজ্ঞান , ভূগোল , বিচার , আইন , যুদ্ধ , শান্তি , সন্ধি , অঙ্গীকার ও চুক্তি , রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা , আন্তর্জাতিক সম্পর্ক , প্রচারপদ্ধতি ইত্যাদি অসংখ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে। সেই সাথে শব্দচয়ন , শব্দপ্রয়োগ , বাক্যগঠন , বাক্যসমূহের পারস্পরিক বিন্যাস , সুর ও ঝঙ্কার ইত্যাদি সব মিলিয়ে কোরআন মজীদ এক অতুলনীয় সৌন্দর্যের অধিকারী।

বলা বাহুল্য যে , এতোগুলো দিক বজায় রেখে কোনো গ্রন্থ রচনা করা বা মহাগ্রন্থ কোরআন মজীদের কোনো সূরাহর অনুরূপ সূরাহ্ রচনা করা মানবীয় শক্তি-প্রতিভার পক্ষে সম্ভব নয়। এ কারণেই ইসলাম-বিরোধী আরব কবি-সাহিত্যিক , বাগ্মী ও বাচনশিল্পীরা কোরআন মজীদের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে অগ্রসর হন নি। বস্তুতঃ কোরআন মজীদ কোনো মানুষের রচিত গ্রন্থ হলে তার বৈশিষ্ট্য এহেন সীমাহীন মর্যাদার অধিকারী হতো না , ফলে কোরআন-বিরোধীদের পক্ষে এর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ও এ গ্রন্থের বিকল্প রচনা করা সম্ভব হতো।

আর এই সাথে এ কথাটি আবারো স্মরণ করা প্রয়োজন যে , এহেন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কোরআন মজীদ একজন নিরক্ষর ব্যক্তির মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে , সমস্ত পণ্ডিত ব্যক্তির পক্ষে সম্মিলিত সাধনায় যার একটি সূরাহর বিকল্প উপস্থাপন করা সম্ভব নয় সে মহাগ্রন্থ একজন নিরক্ষর ব্যক্তির পক্ষ থেকে রচিত হওয়ার সম্ভাবনা কল্পনাও করা যায় কি ?