মু
‘
জিযাহর দাবী প্রত্যাখ্যানের দলীল -
2
হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) কোরআন মজীদ ছাড়া আর কোনো মু‘
জিযাহর অধিকারী ছিলেন না বলে যে সব আয়াতের দলীল পেশ করা হয় তার মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ের আয়াত সমূহ হচ্ছে :
)
و قالوا لن نؤمن لک حتی تفجر لنا من الارض ينبوعا. او تکون لک جنة من نخيل و عنب فتفجر الانهار خلالها تفجيراً. او تسقط السماء کما زعمت علينا کسفاً او تأتي بالله و الملائکة قبيلاً. او يکون لک بيت من زخرف او ترقی فی السماء و لن نؤمن لرُقيک حتی تنزل علينا کتابا نقرؤه. قل سبحان ربی هل کنت الا بشرا رسولا(.
“
তারা (মোশরেকরা) বললো : আমরা ততোক্ষণ পর্যন্ত তোমার ওপর ঈমান আনবো না যতোক্ষণ না তুমি আমাদের জন্য ভূমি থেকে একটি ঝর্ণা প্রবাহিত করো , অথবা তুমি খেজুর ও আঙ্গুরের বাগানের অধিকারী হও - যার মধ্য থেকে ঝর্ণা প্রবাহিত হবে , অথবা আসমানকে টুকরো টুকরো করে আমাদের মাথার ওপরে আপতিত করো , অথবা আল্লাহ্ ও ফেরেশতাদেরকে আমাদের সামনে হাযির করো , অথবা তুমি স্বর্ণনির্মিত গৃহের আধিকারী হও , অথবা তুমি আকাশে উড্ডয়ন করো , আর এ অবস্থায়ও আমরা কখনোই তোমার ওপরে ঈমান আনয়ন করবো না যদি না তুমি আসমান থেকে আমাদের জন্য একটি লিখিত গ্রন্থ বা পত্র নাযিল্ করাও যা আমরা পড়ে দেখবো। (হে রাসূল! এদেরকে) বলুন : আমার প্রভু পরম প্রমুক্ত। আর আমি একজন মানুষ রাসূল ছাড়া আর কী ?”
(সূরাহ্ বানী ইসরাাঈল্ : 90-93)
হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) কোরআন মজীদ ছাড়া অন্য কোনো মু‘
জিযাহর অধিকারী ছিলেন না বলে যারা দাবী করে তাদের বক্তব্য : এ আয়াত সমূহ থেকে বোঝা যায় , মোশরেকরা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর কাছে মু‘
জিযাহ্ প্রদর্শনের জন্য দাবী জানিয়েছিলো। কিন্তু তিনি এ সব মু‘
জিযাহ্ আনয়নে অস্বীকৃতি জানান ও তা আনা থেকে বিরত থাকেন এবং মোশরেকদের সামনে স্বীয় অক্ষমতা জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন :“
আমি একজন মানুষ বৈ নই। আর মানুষ এ জাতীয় কাজ সম্পাদনে একেবারেই অক্ষম।”
এ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) কোরআন মজীদ ব্যতীত অন্য কোনো মু‘
জিযাহর অধিকারী ছিলেন না।
জবাব : এ বক্তব্যের অনেকগুলো জবাব দেয়া চলে। এখানে আমরা অত্যন্ত সংক্ষেপে এরূপ কয়েকটি জবাবের উল্লেখ করবো :
অত্র আয়াত সমূহের বক্তব্য অনুযায়ী মোশরেকরা বেশ কতোগুলো মু‘
জিযাহ্ প্রদর্শনের দাবী করেছিলো। আর এগুলো হচ্ছে সেই সব মু‘
জিযাহরই অন্তর্ভুক্ত মোশরেকরা জিদ , গোঁয়ার্তুমি ও অন্ধ বিদ্বেষ বশতঃ যা প্রদর্শনের দাবী করেছিলো। হুজ্জাত্ পরিপূর্ণ হওয়ার ও সত্য অকাট্যভাবে প্রস্ফূটিত হওয়ার পরে একগুঁয়েমিবশতঃ তারা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর নিকট এ সব মু‘
জিযাহ্ প্রদর্শনের দাবী জানিয়েছিলো। আর দাবীকৃত মু‘
জিযাহর (معجزات اقتراحی
) প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে আলোচিত আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছি।
অতএব , অত্র আয়াত সমূহও ইতিপূর্বে আলোচিত আয়াতের ন্যায় দাবীকৃত মু‘
জিযাহ্ সম্পর্কিত - যা মোশরেকরা একগুঁয়েমি ও গোঁয়ার্তুমি বশতঃ দাবী করেছিলো। এ আয়াতগুলো প্রাথমিক পর্যায়ের মু‘
জিযাহ্ সংক্রান্ত নয় যা নবুওয়াত প্রমাণ ও মানুষের পথনির্দেশের জন্য আনীত হয়। কারণ ,
প্রথমতঃ তারা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণের জন্য তাদের পসন্দসই উল্লিখিত কয়েকটি মু‘
জিযাহর মধ্য থেকে একটি আনয়নের দাবী জানায় এবং তাঁর নবুওয়াত স্বীকার করার জন্য এ মু‘
জিযাহ্ প্রদর্শনের শর্ত আরোপ করে। সত্যি সত্যিই যদি তারা তাঁর নবুওয়াত সম্পর্কে নিশ্চিত হতে আগ্রহী থাকতো এবং জেনে বুঝে সত্যের বিরুদ্ধে জিদ ও একগুঁয়েমির পরিচয় না দিতো তাহলে নবীর নবুওয়াত প্রমাণে সক্ষম যে কোনো মু‘
জিযাহকেই তারা তাঁর নবুওয়াতকে মেনে নেয়ার জন্য যথেষ্ট মনে করতো এবং সে পন্থায়ই তাঁর নবুওয়াতের সত্যতা স্বীকার করে নিতো। এ ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ মু‘
জিযাহ্ নির্দিষ্ট করে দেয়ার ও তা প্রদর্শনের দাবী করার পিছনে কোনো যৌক্তিকতা নেই।
দ্বিতীয়তঃ তারা বলেছিলো :“
অথবা তুমি আকাশে উড্ডয়ন করো , আর এ অবস্থায়ও আমরা তোমার ওপরে ঈমান আনয়ন করবো না যদি না তুমি আসমান থেকে আমাদের জন্য একটি লিখিত গ্রন্থ বা পত্র নাযিল্ করাও যা আমরা পড়ে দেখবো।”
আসলেই তারা যদি সত্যান্বেষী হতো তাহলে এভাবে তাদের অযৌক্তিক শর্তারোপ ও একগুঁয়েমির আশ্রয় গ্রহণের এবং আসমান থেকে গ্রন্থ বা পত্র আসার দাবী ও ছুতার আশ্রয় গ্রহণের পিছনে কী কারণ ছিলো ? শুধু আকাশে উড্ডয়নই কি মু‘
জিযাহ্ হিসেবে যথেষ্ট ছিলো না ? এবং তা কি তাঁর নবুওয়াত প্রমাণে যথেষ্ট হতো না ? তাদের এ ধরনের অর্থহীন ও অযৌক্তিক প্রস্তাব - যা নেহায়েতই তাদের খেয়ালখুশীর ওপর ভিত্তিশীল ছিলো এবং বিচারবুদ্ধির দাবী ছিলো না - এগুলো কি তাদের জিদ ও একগুঁয়েমি এবং সত্যের মোকাবিলায় তাদের অন্ধ গোয়ার্তুমির পরিচায়ক ছিলো না ?
“
... অথবা আকাশে উড্ডয়ন করো”
বলার পরই বলা যে , তা করলেও তারা তাঁকে নবী হিসেবে মানবে না , বরং আসমান থেকে গ্রন্থ বা পত্র নাযিলের শর্তারোপ থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে , আকাশে উড্ড্য়ন ও গ্রন্থ বা পত্র আনয়ন - উভয়টি সম্পাদিত হলেও তারা ঈমান আনতো না , বরং নতুন কোনো ছুতা বের করতো। হয়তো তারা বলে বসতো :“
আকাশে উড্ড্য়ন ও গ্রন্থ বা পত্র আনয়ন - উভয়ই জাদু।”
অতএব , এ মু‘
জিযাহ্ দেখিয়ে তাদের হেদায়াতের কোনোই আশা ছিলো না।
(2) আমাদের দ্বিতীয় জবাব হচ্ছে এই যে , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে যে জবাব দানের জন্য আলোচ্য আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাতে তাঁকে মু‘
জিযাহ্ আনয়নে অক্ষমতা প্রকাশের নির্দেশ দেয়া হয় নি , বরং রাসূলের যবানীতেسبحان ربی
বাক্যটির মাধ্যমে এ কথাই বুঝাতে চাওয়া হয়েছে যে , কোনো অলৌকিক কাজ সম্পাদনে অক্ষমতা থেকে আল্লাহ্ তা‘
আলা মুক্ত ও পবিত্র এবং মানবিক বিচারবুদ্ধিতে যা সম্ভব এমন যে কোনো কাজ সম্পাদনেই তিনি সক্ষম। কিন্তু তিনি দৃষ্ট হওয়ার মতো দুর্বল বৈশিষ্ট্যের উর্ধে , তেমনি শরীরী রূপে মানুষের সামনে আবির্ভূত হবার মতো সসীমও তিনি নন। আর তিনি এমনই সুমহান যে যে কোনো মানুষের যে কোনো অর্থহীন খেলো প্রস্তাবেই তিনি সাড়া দেন না। তেমনি নবীও মানুষ বৈ নন যিনি আল্লাহ্ তা‘
আলারই আদেশ-নিষেধের আজ্ঞাবহ এবং তাঁর নির্দেশের জন্য অপেক্ষমান থাকেন। আর সমস্ত বিষয়ই সেই একমেবাদ্বিতীয়ম্ আল্লাহ্ তা‘
আলার হাতে ; তিনি যা চান তা-ই সম্পাদন করেন এবং যেভাবে চান সেভাবেই করেন।
মোশরেকরা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর নিকট যে সব মু‘
জিযাহ্ প্রদর্শনের জন্য দাবী জানিয়েছিলো - যা উক্ত আয়াত সমূহে উল্লিখিত হয়েছে , তার মধ্যে কতোগুলো হচ্ছে অসম্ভব ধরনের দাবী। আর বাকীগুলো যদিও অসম্ভব ধরনের নয় , কিন্তু তা নবুওয়াতের সত্যতার সপক্ষে দলীল স্বরূপ হতে পারে না। সুতরাং দাবীকৃত মু‘
জিযাহ্ প্রদর্শনযোগ্য হলেও এ ধরনের দাবী পূরণ করা অর্থহীন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে , আলোচ্য আয়াত সমূহ অনুযায়ী , মোশরেকরা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সামনে ছয়টি মু‘
জিযাহ্ প্রদর্শনের জন্য দাবী জানিয়েছিলো। দাবীকৃত এ ছয়টি মু‘
জিযাহর মধ্যে তিনটি মু‘
জিযাহর দাবী বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে নেহায়েতই অসম্ভব ধরনের দাবী , আর বাকী তিনটি মু‘
জিযাহর দাবী যদিও অসম্ভব ধরনের নয় , কিন্তু তা নবুওয়াত প্রমাণের জন্য দলীল স্বরূপ হতে পারে না।
মোশরেকদের দাবীকৃত তিনটি অসম্ভব মু‘
জিযাহ্ হচ্ছে :
(1) আসমান ভেঙ্গে পড়া :
নভোমণ্ডলের টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া ও ধরণীপৃষ্ঠে পতিত হওয়া একটা অসম্ভব ধরনের দাবী। কারণ , এ কাজের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে ধরণীপৃষ্ঠে এক বীভৎস ধ্বংসাত্মক অবস্থার সৃষ্টি এবং পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী-প্রজাতির বিলুপ্তি। আর এ ধরনের ঘটনা কেবল তখনই সংঘটিত হবে যখন এ বিশ্বের আয়ুষ্কাল সমাপ্ত হয়ে যাবে।
হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) এ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন এবং কোরআন মজীদেও এ সম্পর্কে আভাস দেয়া হয়েছে :
)
اذا السماء انشقت(
.
“
যখন নভোমণ্ডল বিদীর্ণ হয়ে যাবে।”
(সূরাহ্ আল্-ইনশিক্বাাক্ব্ : 1)
)
اذا السماء انفطرت(
.
“
যখন নভোমণ্ডল এলোমেলো-বিশৃঙ্খল হয়ে যাবে।”
(সূরাহ্ আল্-ইনফিতার্ : 1)
)
ان نشأ نخسف بهم الارض او نسقط عليهم کسفاً من السماء(
.
“
আমি চাইলে তাদেরকে ভূগর্ভে প্রোথিত করে ফেলবো অথবা তাদের ওপরে নভোমণ্ডলের টুকরা নিপতিত করবো।”
(সূরাহ্ সাবাা’
: 9)
মোশরেকদের দাবী অনুযায়ী নভোমণ্ডলকে টুকরো টুকরো করে ভূপৃষ্ঠে নিপতিত করানো এ কারণে অসম্ভব যে , তা করা হলে এ জন্য নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই কাজটি (ক্বিয়ামত্ সংঘটন) করতে হবে। কিন্তু তা খোদায়ী পরম জ্ঞানের দাবীর পরিপন্থী। কারণ , পরম জ্ঞানময় আল্লাহ্ তা‘
আলার ইচ্ছা এই যে , তিনি এ ভূপৃষ্ঠে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মানবজাতিকে টিকিয়ে রাখবেন এবং সকল দিক থেকে তাকে পূর্ণতায় উপনীত হবার সুযোগ দেবেন ও সেদিকে পথপ্রদর্শন করবেন। আর যে কোনো প্রজ্ঞাময় ও বিচক্ষণ ব্যক্তির পক্ষেই অসম্ভব যে , অন্যকে খুশী করার জন্য স্বীয় প্রজ্ঞাময় ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের বরখেলাফ কাজ করবেন। এমতাবস্থায় পরম জ্ঞানময় আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষে তাঁর কল্যাণময় সিদ্ধান্তের পরিপন্থী কাজ সম্পাদন কী করে সম্ভব হতে পারে ?
(2) আল্লাহকে নিয়ে আসা :
এটা যে অসম্ভব কাজ তা যে কোনো সুস্থ বিবেকের নিকটই সুস্পষ্ট।
কাফেররা বলেছিলো :‘
আল্লাহকে আমাদের সামনে নিয়ে এসো যাতে আমরা তাঁকে স্বচক্ষে দেখে তাঁর ওপর ঈমান আনতে পারি।’
আর এ হচ্ছে এমন দাবী যা পূরণ করা কখনোই সম্ভব হতে পারে না। কারণ , আল্লাহ্ তা‘
আলা বস্তুগত সত্তা নন এবং দৃষ্টিশক্তি তাঁকে ধারণ করতে পারে না। অতএব , তাঁকে দেখা সম্ভবপর নয়। কারণ , আল্লাহ্ তা‘
আলাকে দর্শনযোগ্য হতে হলে অবশ্যই সসীম হতে হবে , একটি সুনির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করতে হবে এবং তাঁর রং ও সুনির্দিষ্ট আকৃতি থাকতে হবে। আর এ সব হচ্ছে সসীম ও বস্তুগত সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য ; আল্লাহ্ তা‘
আলা এ সব বৈশিষ্ট্য থেকে প্রমুক্ত। সুতরাং দেখার জন্য আল্লাহ্ তা‘
আলাকে নিয়ে এসে হাযির করা সম্ভব নয়।
অবশ্য আলোচ্য আয়াতসমূহে কাফেরদের পক্ষ থেকে ফেরেশতা নিয়ে আসার দাবীও রয়েছে। তবে তারা হয়তো আলাদাভাবে নয় , বরং আল্লাহর সাথে ফেরেশতা আনার কথা বলেছে। আর যদি ধরে নেয়া হয় যে , তারা আলাদাভাবে ফেরেশতা নিয়ে আসার দাবী করেছে , সে ক্ষেত্রে বলতে হয় :
প্রথমতঃ ফেরেশতা অবস্তুগত সত্তা , সুতরাং চর্মচক্ষে ফেরেশতাকে দেখা যেতে পারে না। কেবল নবী-রাসূলগণ (‘
আঃ) ও আল্লাহর খাছ্ব্ বান্দাহ্গণ তাদেরকে প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম। (এ প্রত্যক্ষকরণের স্বরূপও কেবল তাঁদের পক্ষেই বোঝা সম্ভব।)
দ্বিতীয়তঃ ফেরেশতারা বস্তুগত শরীর ধারণ করে হাযির হতে পারে বটে , কিন্তু সে ক্ষেত্রে তারা সত্যিই ফেরেশতা কিনা সে সম্পর্কে সাধারণ দর্শকের সন্দেহ হতে পারে। আর অস্বাভাবিক আকৃতি ধারণ করে হাযির হলেও সন্দিগ্ধমনা লোকেরা তাদেরকে জ্বিন্ , শয়ত্বান বা জাদুর প্রভাবে দৃষ্ট ভিত্তিহীন দৃশ্য মনে করতে পারে।
তৃতীয়তঃ ফেরেশতার মাধ্যমে নবীকে পরিচিত করানো খোদায়ী পরম জ্ঞানের দাবীর পরিপন্থী। কারণ , সে ক্ষেত্রে সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ের জন্য মানুষের বিচারবুদ্ধির আর কোনো ভূমিকা থাকে না , ফলে তার আর কোনো প্রয়োজনও থাকে না। শুধু তা-ই নয় , এরূপ হলে মানুষের স্বাধীনতাও থাকতো না। কারণ , সে ক্ষেত্রে মানুষ ফেরেশতার দ্বারা পরিচয়কৃত ও পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত একজন অস্বাভাবিক মানুষ হিসেবে নবীকে ভয়ের কারণে মেনে চলবে , স্বতঃস্ফূর্তভাবে নয়।
চতুর্থতঃ আকৃতি ধারণ করে ফেরেশতা আগমন করলে সে ক্ষেত্রে কাফেররা তাদেরকে জ্বিন্ , শয়ত্বান বা জাদুর প্রভাবে দৃষ্ট ভিত্তিহীন দৃশ্য মনে করে প্রত্যাখ্যান করলে দাবীকৃত মু‘
জিযাহ্ প্রদর্শিত হবার পর প্রত্যাখ্যানের অপরাধে খোদায়ী নিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘
আলা ইতিপূর্বেই ওয়াদা করেছেন যে , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) তাদের মাঝে থাকা অবস্থায় তাদেরকে আযাব দেবেন না।
(3) আল্লাহর কাছ থেকে গ্রন্থ বা পত্র আনয়ন :
এ-ও একটি অসম্ভব কাজ। কারণ , তারা আল্লাহর নিকট থেকে গ্রন্থ বা পত্র আনয়নের যে দাবী জানিয়েছিলো তার উদ্দেশ্য“
আল্লাহর ইচ্ছায় অস্তিত্বলাভকৃত কোনো গ্রন্থ বা পত্র”
ছিলো না। বরং তাদের উদ্দেশ্য ছিলো আল্লাহ্ তা‘
আলার‘
স্বহস্তে’
লিখিত গ্রন্থ বা পত্র আনয়ন। কারণ , তাদের মতে , এ ধরনের গ্রন্থ বা পত্র আনয়নের জন্যই রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর জন্য আসমানে উড্ডয়ন ও আল্লাহর কাছে গমনের প্রয়োজন ছিলো যাতে তাঁর পক্ষে আল্লাহ্ তা‘
আলার‘
স্বহস্তে’
লিখিত গ্রন্থ বা পত্র আনয়ন করা সম্ভব হয়। অন্যথায়“
আল্লাহর ইচ্ছায় অস্তিত্বলাভকৃত কোনো গ্রন্থ বা পত্র”
যদি তাদের উদ্দেশ্য হতো তাহলে তারা এ জন্য তাঁর আসমানে উড্ডয়নের শর্ত আরোপ করতো না।
আর আল্লাহর স্বহস্তলিখিত গ্রন্থ বা পত্র আনয়নের দাবী যে পূরণযোগ্য নয় তা বলাই বাহুল্য। কারণ , আল্লাহ্ মানুষের ন্যায় বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অধিকারী নন যে , কলম হাতে নিয়ে চিঠি লিখবেন।تعالی الله عن ذالک علواً کبیراً
- তাদের কল্পিত এহেন দুর্বলতার বহু উর্ধে মহান আল্লাহ্ তা‘
আলা।
বলা বাহুল্য যে , মোশরেকদের দাবীর উদ্দেশ্য যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে সৃষ্ট কোনো গ্রন্থ বা পত্রও হতো তাহলেও তা আনয়নে কোনো ফল হতো না। কারণ , উদাহরণস্বরূপ সর্বসমক্ষে যদি আকাশ থেকে কোনো গ্রন্থ বা পত্র নেমে আসতো তাহলে তারা একে জ্বিন্ বা শয়ত্বানের কাজ বলে আখ্যায়িত করতো এবং বলতো যে , মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর সাথে জ্বিন বা শয়ত্বানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে , এ কারণে জিন্ বা শয়ত্বান তা লিখে আকাশ থেকে নামিয়ে দিয়েছে। অথবা তারা যেমন হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ)কে জাদুকর বলে অভিহিত করতো , তার ভিত্তিতে তারা দাবী করতো যে , তিনি জাদুর বলে এ ধরনের একটি গন্থ বা পত্র নিজেই তৈরী করে তা আকাশ থেকে নামিয়ে এনেছেন। আর এভাবে , দাবীকৃত মু‘
জিযাহ্ প্রদর্শিত হবার পরেও প্রত্যাখ্যান করার অপরাধে তাদের জন্য আযাব নাযিল করা অপরিহার্য হয়ে যেতো। ফলে লাভের কিছুই হতো না। কারণ , তারা তো স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রদর্শিত মু‘
জিযাহ্ দেখে বিচারবুদ্ধির রায় থেকে সত্যকে জানতে পেরেও নতুন করে মু‘
জিযাহ্ দাবী করেছিলো।
আর তারা অপর যে তিনটি মু‘
জিযাহ্ দাবী করেছিলো তা কার্যকর করা সম্ভব ছিলো বটে , কিন্তু তাদের এ প্রস্তাব ছিলো বিচারবুদ্ধির রায়ের সাথে সাংঘর্ষিক। তাদের দাবীগুলো ছিলো :
(1) হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) কর্তৃক ঝর্ণাধারা প্রবাহিতকরণ।
(2) হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর পানির নহর সমৃদ্ধ খেজুর ও আঙ্গুরের বাগানের অধিকারী হওয়া।
(3) হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর স্বর্ণগৃহের অধিকারী হওয়া।
যদিও আল্লাহ্ তা‘
আলার অনুমতিক্রমে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) কর্তৃক মোশরেকদের এ দাবীগলো পূরণ করা সম্ভবপর ছিলো , কিন্তু নবুওয়াতের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ , এ তো অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার যে , হতে পারে কোনো ব্যক্তি এ সবের অধিকারী , কিন্তু নবী-রাসূল হওয়া তো দূরের কথা , সে আল্লাহর ওপর ঈমানের অধিকারীও নয়। অতএব , যেহেতু এ ধরনের বিষয় নবুওয়াতের দাবীর সাথে আদৌ সম্পর্কিত নয় এবং নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা প্রমাণে সক্ষম নয় , সে ক্ষেত্রে নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা প্রমাণের লক্ষ্যে এ ধরনের কাজ সম্পাদন করা অর্থহীন বৈ নয়। আর নবী-রাসূলগণের (‘
আঃ) মাধ্যমে অর্থহীন কর্ম সম্পাদিত হওয়া সম্ভব নয়।
কেউ হয়তো ধারণা করতে পারে যে , এই শেষোক্ত তিনটি বিষয় স্বাভাবিক পন্থায় হস্তগত হলে তা নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা প্রমাণকারী হতে পারে না বটে , কিন্তু একই বিষয় অস্বাভাবিক পন্থায় হস্তগত হলে তা নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা প্রমাণকারী হতে পারে। কারণ , এ ক্ষেত্রে তা মু‘
জিযাহ্ রূপে গণ্য হবে।
কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। কারণ , যদিও এ তিনটি জিনিস অস্বাভাবিক পন্থায় হস্তগত হলে তা নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা প্রমাণকারী হতে পারে , কিন্তু মোশরেকদের দাবী তা ছিলো না। বরং তাদের অভিমত ছিলো এই যে , নবী করীম (ছ্বাঃ)কে স্বাভাবিক পন্থায়ই প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী থাকা উচিত , অস্বাভাবিক পন্থায় নয়। কারণ , তাদের অভিমত ছিলো এই যে , নবুওয়াতের পদ কিছুতেই দরিদ্র লোকের ওপর অর্পিত হওয়া উচিত নয়।
মোশরেকদের এ অভিমতের কথা কোরআন মজীদেও উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :
)
و قالوا لو لا نزل هذا القرآن علی رجل من القريتين عظيم(
.
“
মোশরেকরা বললো : এ কোরআন কেন দুই শহরের (মক্কাহ্ ও তায়েফের) কোনো বিরাট (ধনী ও প্রভাবশালী) ব্যক্তির ওপর নাযিল্ হলো না ?”
(সূরাহ্ আয্-যুখরূফ : 31)
এ ধারণার ওপর ভিত্তি করেই তারা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে প্রভূত ধনসম্পদের অধিকারী হতে এবং ধনসম্পদের ক্ষেত্রে অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হতে বলে। আর বলাই বাহুল্য যে , তা নবুওয়াত-দাবীর সত্যতা প্রমাণকারী হতে পারে না।
আমাদের বক্তব্যের সপক্ষে আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে এই যে , তারা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে বাগান ও স্বর্ণগৃহের অধিকারী হতে বলে এবং আরো অনেক কাজ আঞ্জাম দেয়ার শর্ত আরোপ করে। যদি ধরেও নেই যে , তারা তাঁকে অস্বাভাবিক পন্থায়ই বাগান , ঝর্ণা ও স্বর্ণগৃহের অধিকারী হতে বলেছে , তবুও তাদের দাবী গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ , তারা যদি অস্বাভাবিক পন্থায় এসব জিনিসের উদ্ভবকে মু‘
জিযাহ্ রূপে গণ্য করে তার ভিত্তিতে নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা পরীক্ষা করতে ও সত্যতা প্রমাণ সাপেক্ষে ঈমান আনয়নে প্রস্তুত থাকতো তাহলে এতো জটিল ও বহুবিধ শর্তারোপের আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিলো না। বরং এ ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক পন্থায় মাত্র এক গুচ্ছ আঙ্গুর বা এক ভরি স্বর্ণ আনয়নই মু‘
জিযাহ্ হিসেবে যথেষ্ট হতো এবং অস্বাভাবিক কাজ হিসেবে তা-ই হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াত-দাবীর সত্যতা প্রমাণে যথেষ্ট হতো।
আর মোশরেকরা যে বলেছিলো ,“
যতোক্ষণ না তুমি আমাদের জন্য ভূমি থেকে একটি ঝর্ণা প্রবাহিত করো”
, - এ কথার মানে এ ছিলো না যে , তারা তাদের নিজেদের ব্যবহারের জন্য ঝর্ণা তৈরী করতে বলেছিলো , বরং তাদের‘
আমাদের জন্য’
কথাটির উদ্দেশ্য ছিলো‘
আমাদের দাবী অনুযায়ী’
বা‘
আমাদের কথা মতো’
বা‘
আমাদের সন্তুষ্টির জন্য’
(আর আরবী বাকরীতিতে এরূপ প্রচলন আছে)। তারা বলেছিলো : আমাদের দেখানোর জন্য তুমি একটি ঝর্ণার অধিকারী হও যাতে আমরা তোমাকে নবুওয়াতের উপযুক্ত বলে মনে করতে পারি।
তাছাড়া অস্বাভাবিক পন্থায় (মু‘
জিযাহর মাধ্যমে) একজন নবীর প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হওয়া দ্বীনের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের পরিপন্থীও বটে। কারণ , সে ক্ষেত্রে একদিকে লোকেরা নবীর কাছে এসে তাদের জন্যও অনুরূপ পন্থায় পার্থিব ধনসম্পদের ব্যবস্থা করার দাবী জানাতো , অন্যদিকে স্থান-কালের ব্যবধান জনিত কারণে নবীর মাধ্যমে বিনাশ্রমে সম্পদের মালিক হতে না পারা দরিদ্র জনগণের জন্য নবীর নৈতিক শিক্ষা অনুসরণ না করার অনুকূলে তা বাহানা স্বরূপ হতো এবং তারা বলতো যে , নবীর তো কোনো অভাব ছিলো না ; তিনি বিনাশ্রমে মু‘
জিযাহর মাধ্যমে প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন বিধায় তাঁর জন্য হারাম উপার্জন বর্জন করা ও আল্লাহর‘
ইবাদত করা সহজ ছিলো।