কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্ 0%

কোরআনের মু‘জিযাহ্ লেখক:
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 46611
ডাউনলোড: 4351

পাঠকের মতামত:

কোরআনের মু‘জিযাহ্
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 60 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 46611 / ডাউনলোড: 4351
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মু জিযাহর দাবী প্রত্যাখ্যানের দলীল - 3

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) কোরআন মজীদ ছাড়া অন্য কোনো মু জিযাহর অধিকারী ছিলেন না বলে যারা দাবী করে তাদের এ দাবীর সপক্ষে তৃতীয় পর্যায়ের যে আয়াতটিকে দলীল হিসেবে পেশ করে থাকে তা হচ্ছে :

) و يقولون لو لا انزل عليه آية من ربه. فقل انما الغيب لله فانتظروا. انی معکم من المنتظرين( .

আর তারা (মোশরেকরা) বলে : কেন তার ওপর মু জিযাহ্ নাযিল্ হয় না ? (হে রাসূল!) বলে দিন : অদৃশ্য (গ্বায়ব্/ মু জিযাহ্) তো আল্লাহরই এখতিয়ারে। অতএব , তোমরা অপেক্ষা করতে থাকো ; আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষায় থাকলাম। (সূরাহ্ ইউনুস : 20)

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর জন্য কোরআন মজীদ ভিন্ন অন্য মু জিযাহ্ অস্বীকারকারীদের বক্তব্য : এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে , মোশরেকরা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর নিকট মু জিযাহ্ প্রদর্শনের দাবী করেছিলো। কিন্তু জবাবে তিনি তাদেরকে বলেন (অবশ্য আল্লাহর নির্দেশে) : মু জিযাহ্ আমার এখতিয়ারভুক্ত বিষয় নয় , বরং তা আল্লাহ্ তা আলারই এখতিয়ারে । এ জবাব থেকে প্রমাণিত হয় যে , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) কোরআন মজীদ ছাড়া অন্য কোনো মু জিযাহর অধিকারী ছিলেন না।

অবশ্য একই বিষয়বস্তু সম্বলিত আরো কয়েকটি আয়াত রয়েছে যা তাৎপর্যের দিক থেকে উপরোক্ত আয়াতের সমার্থক বা কাছাকাছি। তা হচ্ছে :

) و يقولون الذين کفروا لو لا انزل عليه آية من ربه. انما انت منذر و لکل قوم هاد( .

আর যারা কাফের হয়েছে তারা বলে : কেন তার রবের পক্ষ থেকে তার ওপর মু জিযাহ্ নাযিল্ হয় না ? কিন্তু (হে রাসূল!) অবশ্যই আপনি সতর্ককারী ; আর প্রতিটি জনগোষ্ঠীর জন্যই পথপ্রদর্শনকারী রয়েছে। (সূরাহ্ আর্-রা দ্ : 7)

) و قالوا لو لا نُزل عليه آية من ربه قل ان الله قادر علی ان ينزل آية و لکن اکثرهم لا يعلمون( .

তারা বলো : কেন তার রবের পক্ষ থেকে তার ওপর মু জিযাহ্ নাযিল্ হয় না ? (হে রাসূল!) বলে দিন : অবশ্যই আল্লাহ্ মু জিযাহ্ নাযিল্ করতে সক্ষম , কিন্তু তাদের মধ্য থেকে অধিকাংশ লোকই (প্রকৃত ব্যাপার) জানে না। (সূরাহ্ : আল্-আন্ আাম্ : 37)

জবাব : উপরোক্ত তিনটি আয়াত থেকে যে ধারণা করা হয় , দুইভাবে তার জবাব দেয়া যায় :

প্রথম জবাব : এ আয়াত সমূহে যে মু জিযাহর কথা বলা হয়েছে তার লক্ষ্য সমস্ত রকমের মু জিযাহ্ নয় , বরং কেবল দাবীকৃত মু জিযাহ্ সমূহ - যে সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

কারণ , মোশরেকরা এটা দাবী করে নি যে , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) তাঁর নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা প্রমাণে সক্ষম এমন যে কোনো মু জিযাহ্ প্রদর্শন করুন। বরং তাদের দাবী ছিলো , তিনি যেন তাদের দাবী অনুযায়ী বিশেষ বিশেষ মু জিযাহ্ প্রদর্শন করেন - যা তারা জিদ ও একগুঁয়েমি বশতঃ বা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে বিদ্রুপ করার লক্ষ্যে দাবী করেছিলো।

কোরআন মজীদ বেশ কয়েক জায়গায় সুস্পষ্ট ভাষায় এ বিষয়টি উল্লেখ করেছে এবং তাদের মু জিযাহ্-দাবীর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তুলে ধরেছে। এ জাতীয় কতক আয়াত আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। এবারে আরো কয়েকটি আয়াত উদ্ধৃত করবো :

) و قالوا لو لا انزل عليه ملک( .

আর তারা বললো : কেন তার ওপর ফেরেশতা নাযিল্ হয় না ? (সূরাহ্ আল্-আন্ আাম্ : 8)

) و قالوا يا ايها الذی نزل عليه الذکری انک لمجنون. لو ما تأتينا بالملائکة ان کنت من الصادقين( .

আর তারা বললো : হে ঐ ব্যক্তি যার ওপরে স্মারক (কোরআন) নাযিল্ হয়েছে! নিশ্চয়ই তুমি পাগল। নচেৎ তুমি যদি (তোমার নবুওয়াত-দাবীর ব্যাপারে) সত্যবাদীদের অন্যতম হতে তাহলে কেন তুমি ফেরেশতাদের সহ আমাদের কাছে আসছো না ? (সূরাহ্ আল্-হিজর্ : 6-7)

) و قالوا مال هذا الرسول يأکل الطعام و يمشی فی الاسواق. لو لا انزل اليه ملک فيکون معه نذيرا. او يُلقی اليه کنز او تکون له جنة يأکل منها. و قال الظالمون ان تتبعون الا رجلا مسحورا(

আর তারা বলে : এ আবার কেমন রাসূল , যে খানা খায় এবং বাজার সমূহের মাঝে পথ চলে ? কেন তার প্রতি একজন ফেরেশতা নাযিল্ হয় না যে তার সাথে থেকে (লোকদেরকে) সতর্ক করতো ? অথবা তার কাছে বিশাল ধনভাণ্ডার চলে আসে না কেন ? অথবা তার জন্য কেন একটি বাগান হচ্ছে না যেখান থেকে সে ভক্ষণ করতো ? আর যালেম লোকেরা (ঈমানদারদেরকে) বলে : তোমরা তো একজন জাদুগ্রস্ত ব্যক্তির অনুসরণ করছো। (সূরাহ্ আল্-ফুরক্বাান্ : 7-8)

এ আয়াত সমূহ থেকে প্রমাণিত হয় যে , মোশরেকরা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর নিকট থেকে বিশেষ ধরনের মু জিযাহ্ দাবী করেছিলো যা বিচারবুদ্ধির ওপরে ভিত্তিশীল ছিলো না। ইতিপূর্বেও আমরা এ প্রসঙ্গে আলোচনা করেছি এবং বলেছি যে , একজন রাসূলের জন্য এ ধরনের প্রস্তাবে সাড়া দেয়া এবং নেহায়েতই একগুঁয়েমিবশতঃ দাবীকৃত মু জিযাহ্ প্রদর্শনে সম্মত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।

বস্তুতঃ মোশরেকরা সত্য অনুধাবনের লক্ষ্যে নয় , বরং জিদ ও একগুঁয়েমি বশতঃই হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর নিকট তাদের খেয়ালখুশী মতো বিভিন্ন মু জিযাহ্ প্রদর্শনের দাবী জানিয়েছিলো। অন্যথায় তারা যদি হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে তাঁর নবুওয়াত-দাবী প্রমাণে সক্ষম যে কোনো মু জিযাহ্ প্রদর্শনের জন্য অনুরোধ জানাতো এবং তার ভিত্তিতে ঈমান আনয়নে প্রস্তুত থাকতো তাহলে তিনি নেতিবাচক জবাব দিতেন না। বরং অন্ততঃপক্ষে কোরআন মজীদকে - যা বেশ কয়েক জায়গায় বিকল্প বা অনুরূপ মানের গ্রন্থ বা সূরাহ্ রচনার জন্য চ্যালেঞ্জ প্রদান করেছে - তাদের সামনে মু জিযাহ্ রূপে উপস্থাপন করতেন।

মোট কথা , উল্লিখিত আয়াত সমূহে মু জিযাহ্ প্রদর্শনে অস্বীকৃতি সূচক যে কথা রয়েছে তা থেকে আমরা নিম্নোক্ত উপসংহারে উপনীত হতে পারি :

(1) যতো রকমের মু জিযাহ্ সম্ভব তার মধ্যে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) শুধু কোরআন মজীদকেই সমগ মানব জাতির প্রতি চ্যালেঞ্জ সহকারে পেশ করেছেন। ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , এ ছাড়া অন্য কোনো মু জিযাহকে চ্যালেঞ্জ সহকারে উপস্থাপন সম্ভব ছিলো না। কারণ , চিরন্তন ও বিশ্বজনীন নবুওয়াতের অনিবার্য দাবী হচ্ছে চিরন্তন ও বিশ্বজনীন মু জিযাহ্। আর এ জাতীয় মু জিযাহ্ কোরআন মজীদ ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। কারণ , অন্যান্য মু জিযাহর পক্ষে চিরকালীন ও বিশ্বজনীন হওয়া সম্ভবপর নয়।

(2) মু জিযাহ্ আনয়ন করা কোনো নবী-রাসূলের এখতিয়ারাধীন বিষয় নয়। নবী শুধু নবুওয়াতের পদমর্যাদায় অভিষিক্ত। মু জিযাহ্ সহ সমস্ত বিষয়ে তিনি আল্লাহ্ তা আলার ইচ্ছা ও আদেশের অধীন। এমনকি , এ ক্ষেত্রে মানুষ মু জিযাহ্ দাবী করলেও কিছু আসে যায় না। অর্থাৎ নবীর এমন কোনো ক্ষমতা থাকে না যে , তিনি চাইলেই মু জিযাহ্ নিয়ে আসতে পারবেন।

এ অবস্থা শুধু হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয় , বরং সমস্ত নবী-রাসূলই ( আঃ) এ বিধির আওতাভুক্ত ; আল্লাহ্ তা আলার অনুমতিক্রমে ব্যতীত কোনো নবী-রাসূলই ( আঃ) মু জিযাহ্ প্রদর্শনে সক্ষম ছিলেন না। যেমন : আল্লাহ্ তা আলা এ প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন:

) و ما کان لرسول ان يأتی بآية الا باذن الله. لکل اجل کتاب(

কোনো রাসূলই আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত মু জিযাহ্ আনয়নে সক্ষম নয়। আর প্রত্যেক নির্ধারিত সময়ের জন্যই নির্ধারিত বিধি রয়েছে। (সূরাহ্ আর্-রা দ্ : 38)

) و ما کان لرسول ان يأتی بآية الا باذن الله. فاذا جاء امر الله قضی بالحق و خسر هنالک المبطلون( .

কোনো রাসূলই আল্লাহর অনুমতিক্রমে ব্যতীত মু জিযাহ্ আনয়নে সক্ষম নয়। অতঃপর যখন আল্লাহর ফরমান এসে যাবে তখন সত্যতা ও ন্যায়নীতি সহকারে ফয়ছ্বালা হয়ে যাবে এবং বাতিলপন্থীরা ক্ষতির সম্মুখীন হবে। (সূরাহ্ আল্-মু মিন্ : 78)

দ্বিতীয় জবাব : হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে কোরআন মজীদ ছাড়া অন্য কোনো মু জিযাহ্ দেয়া হয় নি বলে কোরআন মজীদের কতক আয়াতের ভিত্তিতে যে দাবী করা হয় তার জবাবে স্বয়ং কোরআন মজীদ থেকেই আরো কিছু আয়াত উদ্ধৃত করা সম্ভব - যা প্রমাণ করে যে , তিনি কোরআন মজীদ ছাড়াও আরো অনেক মু জিযাহর অধিকারী ছিলেন। যেমন :

) اقتربت الساعة و انشق القمر. و ان يروا آية يعرضوا و يقولوا سحر مستمر(

নির্ধারিত সময় এসে গেলো আর চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হলো। আর তারা যদি কোনো মু জিযাহ্ দেখে তাহলে পাশ কাটিয়ে যায় এবং বলে : এ হচ্ছে এক অব্যাহত জাদু। (সূরাহ্ আল্-ক্বামার্ :1 -2)

) و اذا جائتهم آية قالوا لن نؤمن حتی نؤتی مثل ما اوتی رسول الله( .

আর যখনই তাদের কাছে মু জিযাহ্ এসে যায় তখন তারা বলে : আমরা কিছুতেই ঈমান আনবো না যতোক্ষণ না আমাদেরকেও তা-ই দেয়া হয় যা দেয়া হয়েছে আল্লাহর রাসূলকে। (সূরাহ্ আল্-আন্ আাম্ : 124)

উক্ত আয়াত সমূহে উল্লিখিতآية শব্দটিآية تکوينی (খোদায়ী সৃষ্টিক্ষমতার নিদর্শন) এবং মু জিযাহ্ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে , কোরআন মজীদের আয়াত অর্থে নয়। কারণ , এখানে কোরআন মজীদের আয়াত অর্থে ব্যবহৃত হলে শোনা শব্দ ব্যবহৃত হতো , কিন্তু তা ব্যবহৃত হয় নি। বরং প্রথম আয়াতে সুস্পষ্ট ভাষায় চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হবার কথা বলা হয়েছে এবং তার পরবর্তী আয়াতেই দেখার কথা বলা হয়েছে। আর শেষোক্ত আয়াতেও আয়াত এসে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এভাবে তিনটি আয়াতেই আয়াত শব্দটি মু জিযাহ্ এবংآية تکوينی (খোদায়ী সৃষ্টিক্ষমতার নিদর্শন) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

অতএব , দেখা যাচ্ছে , উপরোক্ত আয়াত সমূহের বক্তব্য অনুযায়ী , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) কোরআন মজীদ ছাড়াও আরো অনেক মু জিযাহর অধিকারী ছিলেন। বরংسحر مستمر (অব্যাহত জাদু) কথাটি থেকে প্রমাণিত হয় যে , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) থেকে অনবরত এ জাতীয় মু জিযাহ্ প্রকাশ পেতো।

এই শেষোক্ত আয়াত সমূহের তাৎপর্য অনুযায়ী , ইতিপূর্বে উল্লিখিত মু জিযাহ্ প্রদর্শনে অস্বীকৃতি মূলক আয়াত সমূহ থেকে যদি আমরা সমস্ত রকমের মু জিযাহ্ প্রদর্শনে অস্বীকৃতির অর্থ গ্রহণ করি (যদিও এ অর্থ ঠিক নয় এবং আমরা প্রমাণ করেছি যে , সংশ্লিষ্ট আয়াত সমূহে শুধু দাবীকৃত মু জিযাহর কথা বলা হয়েছে - যা প্রদর্শিত হলে তা প্রত্যাখ্যানের অনিবার্য পরিণতি ছিলো আযাব নাযিল) , তাহলে এ দুই ধরনের আয়াতের সমন্বয় থেকে আমাদেরকে এ উপসংহারে উপনীত হতে হয় যে , যে সব আয়াতে মু জিযাহ্ প্রদর্শনে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে তা শুধু একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের সাথে সংশ্লিষ্ট যখন হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর পক্ষ থেকে মু জিযাহ্ প্রদর্শিত হতো না , আর যে সব আয়াতে মু জিযাহ্ প্রদর্শিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে তা পরবর্তী যুগের সাথে সংশ্লিষ্ট - যখন তিনি মু জিযাহ্ প্রদর্শন শুরু করেন। আর এ ক্ষেত্রেও , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) কোরআন মজীদ ছাড়া অন্য কোনো মু জিযাহর অধিকারী ছিলেন না - এ ধারণার ভিত্তিহীনতা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়।

আলোচনার সংক্ষিপ্তসার

বর্তমান প্রসঙ্গে এ পর্যন্ত যা কিছু আলোচিত হলো তার সংক্ষিপ্ত উপসংহারে আমরা বলতে পারি :

(1) কোরআন মজীদের আয়াত হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর কোরআন মজীদ ছাড়া অন্য মু জিযাহ্ না থাকার কথা তো প্রমাণ করেই না , বরং কিছু আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে , তিনি বহু মু জিযাহর অধিকারী ছিলেন , যদিও বিরোধীরা তার ভিত্তিতে তাঁর ওপর ঈমান আনতে প্রস্তুত ছিলো না।

(2) মু জিযাহ্ প্রদর্শন নবী-রাসূলগণের ( আঃ) স্বীয় এখতিয়ারাধীন কোনো বিষয় ছিলো না যা একজন নবী চাইলেই প্রদর্শন করতে পারতেন। বরং মু জিযাহ্ পুরোপুরিভাবেই আল্লাহ্ তা আলার ইচ্ছা ও অনুমতির ওপর নির্ভরশীল।

(3) যিনি নবুওয়াত দাবী করেন তিনি তাঁর নবুওয়াতের দাবী প্রমাণের অপরিহার্য প্রয়োজন পরিমাণেই মু জিযাহ্ প্রদর্শন করেন এবং এভাবে সকলের জন্য তাঁর নবুওয়াতকে সুস্পষ্টভাবে ও সপ্রমাণিত রূপে তুলে ধরেন । এর চেয়ে বেশী পরিমাণ মু জিযাহ্ নবীকে প্রদান করা যেমন আল্লাহর জন্য যরূরী নয় , তেমনি নবীর জন্যও যরূরী নয় যে , অপরিহার্য প্রয়োজনের বেশী মু জিযাহ্ প্রদর্শন করবেন এবং লোকেরা তাদের খেয়ালখুশী মোতাবেক যে কোনো মু জিযাহ্ প্রদর্শনের দাবী করলেই তিনি তা দেখাবেন।

(4) যে সব মু জিযাহ্ প্রত্যক্ষ করার পরে প্রত্যাখ্যান করলে তার পরিণতিতে ধ্বংস ও বিপর্যয় অনিবার্য , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে সে ধরনের মু জিযাহ্ দেয়া হয় নি , যদিও অনেকে এ ধরনের মু জিযাহ্ প্রদর্শনের দাবী জানিয়েছিলো।

(5) সমস্ত নবী-রাসূলকে ( আঃ) প্রদত্ত সমস্ত মু জিযাহর মধ্যে একমাত্র অবিনশ্বর মু জিযাহ্ - যা ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত মু জিযাহ্ রূপে টিকে থাকবে এবং যার সাথে মোকাবিলার জন্যে ক্বিয়ামত্ পর্যন্তকার সমস্ত বিশ্ববাসীকে চ্যালেঞ্জ প্রদান করা হয়েছে , তা হচ্ছে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর ওপর নাযিলকৃত মহাগ্রন্থ কোরআন মজীদ। আর তাঁকে প্রদত্ত অন্যান্য মু জিযাহ্ যদিও সংখ্যার দিক থেকে অনেক , তথাপি তা তাঁর নিজের যুগের সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলো এবং এদিক থেকে তাঁর এ জাতীয় মু জিযাহ্ সমূহ , অবিনশ্বর না হওয়ার বিচারে অন্যান্য নবী-রাসূলকে ( আঃ) প্রদত্ত মু জিযাহ্ সমূহের সমপর্যায়ভুক্ত।

তাওরাত্ - ইনজীলে হযরত মুহাম্মাদের ( ছ্বাঃ ) নবুওয়াত্

কোরআন মজীদ বহু জায়গায় সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছে যে , হযরত মূসা ( আঃ) ও হযরত ঈসা ( আঃ) রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন এবং তাওরাত্ ও ইনজীলে তা উল্লিখিত আছে। উক্ত দুই মহান পয়গাম্বরই ( আঃ) স্ব স্ব অনুসারীদেরকে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর আগমন সম্পর্কে অবহিত করে গেছেন।

কোরআন মজীদের এ পর্যায়ের আয়াত সমূহ থেকে আমরা এখানে দু টি আয়াত উদ্ধৃত করছি :

) الذين يتبعون الرسول النبی الامی الذی يجدونه مکتوباً عندهم فی التورة والانجيل يأمرهم بالمعروف و ينهاهم عن المنکر(

যারা (মুসলমানরা) সেই রাসূলের - উম্মী নবীর - অনুসরণ করে থাকে যার কথা তারা তাওরাত্ ও ইনজীলে লিপিবদ্ধ দেখতে পেয়েছে ; তিনি তাদেরকে ভালো কাজের আদেশ করেন এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করেন। (সূরাহ্ আল্-আ রাাফ্ : 157)

) و اذ قال عيسی بن مريم يا بنی اسرائيل انی رسول الله اليکم مصدقاً لما بين يدي من التورة و مبشراً برسول يأتی من بعدی اسمه احمد( .

আর যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা বললো : হে বনী ইসরাঈল্! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাছে প্রেরিত আল্লাহর রাসূল ; আমার পূর্ব থেকে বিদ্যমান তাওরাতের সত্যতা স্বীকারকারী এবং আমার পরে আহমাদ নামে যে রাসূলের আগমন ঘটবে তাঁর আগমনের সুসংবাদদাতা। (সূরাহ্ আছ্ব্-ছ্বাফ্ : 6)

উল্লেখ্য , রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর এক নাম আহমাদ। জন্মের পরই মাতা ও পিতামহ কর্তৃক তাঁর এ দু টি নাম রাখা হয়।

এ ছাড়া স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর যুগে এবং তার পরবর্তী যুগেও , বহু ইয়াহূদী ও খৃস্টান হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াত্ স্বীকার করে নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁদের ইসলাম গ্রহণের কারণ ছিলো এই যে , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর যুগে ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের মধ্যে তাওরাত্ ও ইনজীলের যে সব সংস্করণ প্রচলিত ছিলো তাতে তাঁর আগমনের সুসংবাদ ছিলো।

তৎকালে প্রচলিত তাওরাত্ ও ইনজীলে যদি তাঁর নাম না থাকতো তাহলে তা তাঁর নবুওয়াত-দাবীকে মিথ্যা প্রমাণের জন্য সবচেয়ে বড় দলীল হিসেবে গণ্য হতো। ইয়াহূদী ও খৃস্টানরা (এবং তাদের কাছ থেকে শুনে মোশরেকরাও) বলতে পারতো : এই ব্যক্তি দাবী করছে যে , সে নবী এবং তার নাম তাওরাত্ ও ইনজীলে আছে , অথচ তাওরাত্ ও ইনজীলে তার নাম নেই। অতএব , তার এ দাবী মিথ্যা এবং মিথ্যাবাদী নবী হতে পারে না তা বলাই বাহুল্য। এর ভিত্তিতে তারা তাঁর পুরো দাওয়াতী মিশনকেই বানচাল করে দিতে পারতো।

কিন্তু তাওরাত্ ও ইনজীলে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী থাকার বিষয় তৎকালীন আরব ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের দ্বারা অস্বীকৃত না হওয়া , বরং তাদের মধ্য থেকে অনেকের তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন থেকে এটা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে , ঐ যুগে প্রচলিত তাওরাত্ ও ইনজীলে অবশ্যই এ সুসংবাদ বর্তমান ছিলো।

এ থেকে আরো সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে , ইয়াহূদী ও খৃস্টান পণ্ডিত-যাজকরা ঐ সময় প্রচলিত তাওরাত্ ও ইনজীলের কপিগুলো পরবর্তীকালে লুকিয়ে ফেলেন বা নষ্ট করে ফেলেন এবং ঐ সব কপিতে মুহাম্মাদ্ আহমাদ্ নাম দু টি হুবহু উচ্চারণ সহ ব্যক্তিবাচক নাম হিসেবে উল্লিখিত থাকলেও নতুনভাবে লিখিত পরবর্তীকালীন কপিগুলোতে তাঁরা এ নাম দু টির শব্দগত অনুবাদ করেন এবং পারাক্লিতাস , শান্তিদাতা , মুক্তিদাতা , প্রশংসিত জন ইত্যাদি রূপে উল্লেখ করেন। তবে একমাত্র বারনাবাসের ইনজীলে এ নাম দু টি অনুবাদ করা হয় নি এবং বারনাবাস তা হুবহু উচ্চারণে লিখে গেছেন। এমনকি যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেয়া হয় যে , তাওরাত্ ও ইনজীলে শব্দ দু টি ব্যক্তিবাচক নাম হিসেবে নয় , বরং গুণবাচক নাম হিসেবে উল্লিখিত হয়েছিলো , তাই তার অনুবাদ যথার্থ ছিলো , সে ক্ষেত্রেও লক্ষণীয় যে , বিগত প্রায় দেড় হাজার বছরের মধ্যে এ বিশেষণ-বাচক নামগুলো একমাত্র রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) ছাড়া আর কারো জন্য প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। আর বিচারবুদ্ধির কাছে এটাও গ্রহণযোগ্য নয় যে , মানবজাতি চরম গোমরাহী ও বিভ্রান্তিতে নিপতিত হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা আলা বিগত প্রায় দুই হাজার বছরে কোনো পয়গাম্বরকে পাঠান নি।

[উল্লেখ্য , বিকৃত হওয়া সত্ত্বেও বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত তাওরাত্ ও ইনজীল্ হিসেবে দাবীকৃত পুস্তকগুলোতে ও এর অন্যান্য পুস্তকে এখনো রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) সম্পর্কে যে সব ভবিষ্যদ্বাণী ও তাঁর পরিচিতি বিদ্যমান রয়েছে সে সম্পর্কে আল্লামা মোহাম্মাদ ছাদেকী লিখিতبشارت عهدين গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থটি অত্র লেখক কর্তৃক বাইবেলে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) নামে বাংলায় অনূদিত হয়েছে।]

অতএব , যারা হযরত মূসা ( আঃ) ও হযরত ঈসা ( আঃ)-এর ওপর ঈমান এনেছে , তাওরাত্ ও ইনজীলের ওপর ঈমানের অনিবার্য দাবী অনুযায়ী রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ওপর ঈমান আনয়ন তাদের জন্য অপরিহার্য ; তাদের জন্য মু জিযাহর প্রয়োজন নেই।

তবে হ্যা , যারা হযরত মূসা ( আঃ) ও হযরত ঈসা ( আঃ)-এর ওপর ঈমান আনে নি এবং তাঁদের আনীত আসমানী কিতাব্ দু টিকেও খোদায়ী ওয়াহী বলে স্বীকার করে নি , তাদের জন্য রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ওপর ঈমান আনয়নে মু জিযাহর প্রয়োজন রয়েছে।

কিন্তু অতীতের আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) সব ধরনের মু জিযাহরই অধিকারী ছিলেন। তিনি একদিকে অবিনশ্বর ও বিশ্বজনীন মু জিযাহ্ কোরআন মজীদ নিয়ে আসেন - যা তাঁর নবুওয়াত-দাবীর সত্যতার অকাট্য প্রমাণ , অন্যদিকে তিনি অন্যান্য মু জিযাহরও অধিকারী ছিলেন - যা মুতাওয়াতির্ সূত্রে বর্ণিত হয়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। আর বলা বাহুল্য যে , মুতাওয়াতির্ বর্ণনা প্রত্যয় উৎপাদক।

আর হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর অন্যান্য মু জিযাহর মুতাওয়াতির্ বর্ণনা নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকে অতীতের নবী-রাসূলগণের ( আঃ) মু জিযাহ্ সমূহের বর্ণনার তুলনায় বহু গুণে শক্তিশালী ও প্রত্যয় উৎপাদক। হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর মু জিযাহ্ সমূহ একদিকে যেমন সময়ের ব্যবধানের বিচারে আমাদের অধিকতর নিকটবর্তী , অন্যদিকে প্রতিটি পর্যায়েই তা অনেক বেশী সংখ্যক বর্ণনাকারী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। (তেমনি বর্ণনাকারীদের পরম্পরা , ঐতিহাসিকতা এবং তাঁদের নির্ভরযোগ্যতা ও অনির্ভরযোগ্যতার দলীল-প্রমাণও ইতিহাসে সংরক্ষিত রয়েছে।)

কিন্তু কোরআন মজীদ হচ্ছে চিরন্তন ও বিশ্বজনীন মু জিযাহ্ - যা থেকে মু জিযাহ্ প্রত্যক্ষকরণের কল্যাণ পুরোপুরি লাভ করা যেতে পারে।