পরিশিষ্ট - 1
কোরআনে ফির্‘
আউনের উক্তির উদ্ধৃতি কি মু
‘
জিযাহ্ ?
কোরআন মজীদের মু‘
জিযাহ্ প্রসঙ্গে জনৈক বন্ধুর সাথে আলোচনাকালে তিনি এ প্রসঙ্গে তাঁর অন্তরে জাগ্রত একটি প্রশ্নের কথা বলেন যার জবাব তিনি খুঁজে পান নি। তিনি বলেন : কোরআন মজীদে হযরত মূসা (‘
আঃ) , ফির্‘
আউন্ এবং আরো অনেকের বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে ; এগুলো কী করে মু‘
জিযাহর অন্তর্ভুক্ত হয় ? বিশেষ করে অনারবদের বক্তব্যের উদ্ধৃতি মু‘
জিযাহর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে কিনা ?
এ প্রশ্নটি হয়তো আরো অনেকের মনে জাগ্রত হতে পারে। অবশ্য কোরআন মজীদের মু‘
জিযাহ্ সম্পর্কে আমাদের আলোচনা থেকে এ প্রশ্নের মোটামুটি জবাব মিলে। তা হচ্ছে এই যে , কোরআন মজীদ একটি গ্রন্থ হিসেবে এবং এর একেকটি সূরাহ্ মু‘
জিযাহ্ , বিচ্ছিন্নভাবে এর আয়াত সমূহ মু‘
জিযাহ্ নয়। তথাপি বিষয়টিকে অধিকতর সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার লক্ষ্যে , প্রশ্নকর্তা বন্ধুকে যে জবাব দিয়েছিলাম এখানে মোটামুটি তা-ই উল্লেখ করছি।
কোরআন মজীদ যে মু‘
জিযাহ্ তার কারণ এ নয় যে , তার প্রতিটি বাক্যই স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘
আলার প্রত্যক্ষ উক্তি। বরং এতে যেমন আল্লাহ্ তা‘
আলার নিজের প্রত্যক্ষ উক্তি রয়েছে , তেমনি তিনি অন্যদের অনেক উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। এ ক্ষেত্রে যাদের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে তারা আরব কি অনারব তাতে খুব বেশী পার্থক্য হবার কারণ নেই । কারণ , আল্লাহ্ তা‘
আলা যখন উদ্ধৃতি দিয়েছেন তখন সংশ্লিষ্ট উক্তিসমূহের ভাব ও তাৎপর্যের পরিবর্তন না ঘটিয়ে সংক্ষেপণ ও পরিমার্জন করেছেন তথা বাহুল্যবর্জিত করেছেন যাতে তা বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের মানদণ্ডের বিচারে আল্লাহর কালামের সাথে সামঞ্জস্যশীল হয়।
এ কাজকে মোটামুটিভাবে একজন সুযোগ্য সম্পাদক কর্তৃক কোনো লেখকের লেখার সম্পাদনার সাথে তুলনা করা যেতে পারে - যাতে মূল লেখকের প্রতিপাদ্য বিষয় পুরোপুরি ঠিক রেখে তাঁর বক্তব্য সংক্ষেপণ ও পরিমার্জন করা হয়। তেমনি অনেক ক্ষেত্রে লেখক যা বলতে চেয়েছেন বলে বোঝা যায় অথচ সে জন্য যথোপযুক্ত শব্দাবলী ব্যবহার ও বাক্যবিন্যাস সম্ভব হয় নি , সম্পাদক সে ঘাটতি মোটামুটি পূরণ করে দেন ও লেখকের বক্তব্যকে এমনভাবে ত্রুটিমুক্ত ও প্রাঞ্জল করে দেন যে , এ প্রতিপাদ্য বিষয়ে স্বয়ং সম্পাদক লিখলে এমনটিই লিখতেন।
এখানে অবশ্য উদ্ধৃতিতে পরিবর্তনের প্রশ্ন উঠতে পারে। তার জবাব হচ্ছে এই যে , ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর যুগের আরবরা , বিশেষ করে আরব উপদ্বীপের পূর্বাঞ্চলের অধিবাসী যাযাবর বেদুঈন আরবরা নির্ভুল ও প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলতো। এ কারণেই পরবর্তীকালে রচিত আরবী ব্যাকরণে বিভিন্ন ব্যাকরণিক নিয়মের সপক্ষে প্রমাণ পেশ করতে গিয়ে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর যুগের ও জাহেলী যুগের আরবদের , বিশেষ করে বিভিন্ন বেদুঈন যাযাবর আরব গোত্রের বক্তব্য ও এ দুই যুগে রচিত কবিতা সমূহের উদ্ধৃতি দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে আরবী ভাষার ওপর অনারবদের প্রভাবের আশঙ্কায় তৎকালীন শহুরে আরবদের ও পরবর্তী যুগের আরবদের বক্তব্য বা কবিতাকে দলীল হিসেবে অগ্রহণযোগ্য বলে বা অপরিহার্য ক্ষেত্রে দুর্বল মানের দলীল হিসেবে গণ্য করা হয়।
এমতাবস্থায় , আরবী ভাষা মানব জাতির ভাষাসমূহের মধ্যে প্রাঞ্জলভাবে ও সংক্ষিপ্ততম কথায় সূক্ষ্মতম , গভীরতম ও ব্যাপকতম ভাব প্রকাশের একমাত্র ভাষা বিধায় কোরআন মজীদে যে সব আরবের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে তাতে তেমন বেশী একটা সংক্ষেপণ বা পরিমার্জনের প্রয়োজন হয়েছে বলে মনে হয় না। অবশ্য যেহেতু আল্লাহ্ তা‘
আলা কোনো মানবীয় ভাষায় কালাম্ নাযিল্ করলে বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের মানদণ্ডে তা অনিবার্যভাবেই সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত মানের অধিকারী হবে সেহেতু তিনি আরবদের বক্তব্য উদ্ধৃত করলে তাকে পরিমার্জিত করে স্বীয় কালামের সমমানদণ্ডে উন্নীত করবেন এটাই স্বাভাবিক , তা সে পরিমার্জন যতো কমই হয়ে থাক না কেন। এ ধরনের পরিমার্জন মানবীয় সংস্কৃতিতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে। উদাহরণস্বরূপ , কোনো পত্রিকার একজন সংবাদদাতা যখন তাঁর কোনো প্রতিবেদনে কোনো লোকের কথা উদ্ধৃত করেন তখন সাধারণতঃ সে ব্যক্তির আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণ বা উপভাষিক উচ্চারণ সহ তার উক্তি হুবহু উদ্ধৃত না করে পরিমার্জিত করে স্বীয় ভাষার সমপর্যায়ে উন্নীত করে উদ্ধৃত করেন।
অন্যদিকে ভিন্ন ভাষাভাষী কারো বক্তব্যের উদ্ধৃতি মানেই হচ্ছে তার তরজমা বা অনুবাদের উদ্ধৃতি , মূলের নয়। আর তরজমা বা অনুবাদ সর্বাবস্থায়ই মূল বক্তার বক্তব্যের ভাবের প্রতিনিধিত্ব করে , শব্দ বা ধ্বনির প্রতিনিধিত্ব করে না। এ ক্ষেত্রে অনুবাদক উভয় ভাষায় যতো বেশী সুদক্ষ হবেন তিনি ততো বেশী নিখুঁতভাবে বক্তার বক্তব্যের ভাবের প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হবেন। ফলে মূল বক্তার বক্তব্য সাহিত্যিক মানের বিচারে প্রাঞ্জল , সুন্দর ও বলিষ্ঠ না হলেও অনুবাদ এ সব দুর্বলতা থেকে মুক্ত হবে এটাই স্বাভাবিক।
এরপর প্রশ্ন উঠতে পারে যে , আরবদের উক্তি যদি কোরআন মজীদে হুবহু বা প্রায় হুবহু উদ্ধৃত হয়ে থাকে তাহলে ঐ সব উক্তি গ্বায়রুল্লাহর উক্তি হওয়া সত্ত্বেও মু‘
জিযাহ্ কিনা ?
এ প্রশ্নের জবাবে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে , যে কোনো গ্রন্থের তাৎপর্যের কয়েকটি দিক আছে। প্রথমতঃ প্রতিটি শব্দেরই তাৎপর্য রয়েছে। অবশ্য অনেক শব্দেরই একাধিক তাৎপর্য রয়েছে , তবে শব্দটি তার কোন্ তাৎপর্যে ব্যবহৃত হয়েছে তা কেবল বাক্যমধ্যে তার ভূমিকা দৃষ্টেই নির্ণয় করা সম্ভব।
একটি গ্রন্থে ব্যবহৃত শব্দাবলী সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষী জনগণের মধ্যে প্রচলিত থাকে , বা এর মধ্য থেকে কতক শব্দ তেমন একটা প্রচলিত না থাকলেও তা অভিধানগ্রন্থে বিদ্যমান থাকে। এ সব শব্দ শিখে নিয়ে লেখায় বা কথায় প্রয়োগ করা - যারা তা শিখেছে তাদের পক্ষে - অবশ্যই সম্ভবপর , তা তারা কবি-সাহিত্যিকই হোন বা অশিক্ষিত লোকই হোক। তাই কোনো ভাষার কোনো শব্দ কেবল একটি শব্দ হিসেবে শুদ্ধ , সুন্দর ও প্রাঞ্জল অথবা অশুদ্ধ ও অসুন্দর কোনোটাই হতে পারে না।
দ্বিতীয়তঃ প্রতিটি বাক্যের একটি তাৎপর্য থাকে যা সংশ্লিষ্ট বাক্যে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দের তাৎপর্য থেকে স্বতন্ত্র। এমনকি গেঁয়ো , সেকেলে বা অশ্লীল হিসেবে বিবেচিত শব্দাবলীও বাক্যের মধ্যে বক্তার উদ্দেশ্যকে সর্বোত্তমভাবে তুলে ধরতে পারে যদি তার যথাযথ প্রয়োগ করা সম্ভব হয়। কারণ , কথা বা লেখার মধ্যে তথাকথিত সুন্দর সুন্দর ও উচ্চাঙ্গের শব্দাবলী ব্যবহারের মধ্যে বাহাদুরী নেই , বরং বক্তা যে ভাব প্রকাশ করতে চায় তা কতো সংক্ষেপে কতো নিখুঁতভাবে প্রকাশ করতে পারে তাতেই বক্তা বা লেখকের বাহাদুরী নিহিত।
তৃতীয়তঃ অনেকগুলো বাক্য মিলে একটি কবিতা , ভাষণ , প্রবন্ধ , নিবন্ধ , অনুচ্ছেদ বা পরিচ্ছেদ তৈরী হয়। এভাবে বাক্যগুলো মিলে যে একটি বৃহত্তর ও ব্যাপকতর তাৎপর্য সৃষ্টি করে তা সংশ্লিষ্ট বাক্যগুলোর তাৎপর্য থেকে স্বতন্ত্র। অর্থাৎ বাক্যগুলোকে সুনির্দিষ্ট বিন্যাসে বিন্যস্ত না করে এলোমেলোভাবে পাশাপাশি বসালে প্রতিটি বাক্যের তাৎপর্য ঠিক থাকবে বটে , কিন্তু সংশ্লিষ্ট কবিতা , ভাষণ , নিবন্ধ বা পরিচ্ছেদের তাৎপর্য তা থেকে নিষ্পন্ন হবে না।
চতুর্থতঃ একটি গ্রন্থের সবগুলো পরিচ্ছেদ বা অধ্যায় বা নিবন্ধ সমূহ মিলিয়ে আরেকটি পূর্ণাঙ্গ তাৎপর্য পাওয়া যাবে প্রতিটি পরিচ্ছেদ বা অধ্যায় বা নিবন্ধকে স্বতন্ত্র ও পরস্পর সম্পর্কহীনভাবে অধ্যয়ন করলে তা পাওয়া যাবে না।
কোরআন মজীদের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। কোরআন মজীদের প্রতিটি শব্দ , প্রতিটি বাক্য ও প্রতিটি সূরাহর এবং সমগ্র কোরআন মজীদের তাৎপর্য পরস্পর থেকে স্বতন্ত্র ও ক্রমান্বয়ে উচ্চতর স্তরের।
কোরআন মজীদ মানুষের ভাষায় নাযিল্ হয়েছে। এর শব্দাবলী আরবদের ব্যবহৃত শব্দাবলী মাত্র। অতএব , এ শব্দগুলো মু‘
জিযাহ্ নয়। তেমনি আরব কবি-সাহিত্যিক ও বাক্যবাগীশদের পক্ষে উন্নততম ভাবপ্রকাশক কতগুলো উচ্চাঙ্গের প্রাঞ্জল বাক্য বা কবিতার পঙক্তি রচনা করতে পারাও অসম্ভব কিছু ছিলো না বা নয়। অতএব , কোরআন মজীদের আয়াতের সাথে তুলনীয় সম-মানসম্পন্ন বাক্য রচনা করাও সম্ভব হতে পারে। কিন্তু একটি পূর্ণাঙ্গ বাণী পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে একটি বক্তব্য পেশের ক্ষেত্রে কোনো মানুষের পক্ষে , এমনকি সমগ্র মানবমণ্ডলীর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেও কোরআন মজীদের সমমানসম্পন্ন রচনা পেশ করা সম্ভব নয়। এ কারণেই কোরআন মজীদ ন্যূনতম যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে তা হচ্ছে , কোরআন মজীদকে যারা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর রচিত বলে মনে করে তারা যেন কোরআন মজীদের যে কোনো সূরাহর সমতুল্য (এমনকি ক্ষুদ্রতম সূরাহর সমতুল্য হলেও) একটি সূরাহ্ রচনা করে আনে।
বলা বাহুল্য যে , সম মানের হতে হলে তাকে অবশ্যই সংক্ষিপ্ততা , প্রাঞ্জলতা ও তাৎপর্য - এ তিনের বিচারে সম মানের হতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মানুষের রচনার পক্ষে এর সর্বোর্ধ দু’
টি দিক বজায় রাখা সম্ভব হলেও তিনটি দিকই বজায় রাখতে পারা সম্ভবপর নয় ; অন্ততঃ একটি দিক বজায় রাখতে মানুষের রচনা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
আল্লাহ্ তা‘
আলা তাঁর কিতাব্ কোরআন মজীদে আরব-অনারব নির্বিশেষে যাদের বক্তব্যই উদ্ধৃত করেছেন সে ক্ষেত্রে তাদের বাক্য উদ্ধৃত করেছেন মাত্র। কোনো একটি পুরো সূরাহ্ কোনো ব্যক্তির উদ্ধৃতি দ্বারা গড়ে ওঠে নি। আর যেহেতু শব্দ বা বাক্য মু‘
জিযাহ্ নয় , বরং সূরাহ্ হচ্ছে মু‘
জিযাহ্ , সেহেতু তাতে হযরত মূসার (‘
আঃ) , ফির্‘
আউনের অথবা কোনো আরবের বা কোনো অনারবের বাক্য বা বাক্যাবলী উদ্ধৃত হওয়ায় এ সব বাক্য বা বক্তব্য মু‘
জিযাহর পর্যায়ভুক্ত হবে না।