কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্ 0%

কোরআনের মু‘জিযাহ্ লেখক:
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 46617
ডাউনলোড: 4351

পাঠকের মতামত:

কোরআনের মু‘জিযাহ্
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 60 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 46617 / ডাউনলোড: 4351
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

কোরআন অবিনশ্বর মু জিযাহ্

কোরআন মজীদ যে আল্লাহ্ তা আলার কালাম্ তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। কোরআন হচ্ছে এক অবিনশ্বর মু জিযাহ্ বা অলৌকিক বাস্তবতা যা সব সময়ের জন্য এ প্রমাণ বহন করছে যে , এ গ্রন্থ কোনো মানুষের রচিত নয় , অতএব , তা আল্লাহর কালাম্ এবং এ গ্রন্থ যিনি মানুষের কাছে পেশ করেছেন তিনি অনিবার্যভাবেই আল্লাহর নবী। কোরআন মজীদ তার এ বৈশিষ্ট্য সহকারে ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

কোরআন মজীদ স্বয়ং তার প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে এই বলে চ্যালেঞ্জ করেছে যে , তারা যদি একে মানুষের রচিত গ্রন্থ বলে মনে করে থাকে তাহলে তারা এর বিকল্প রচনা করুক। তারা যেরূপ দাবী করে থাকে , এক ব্যক্তি [রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)] যদি এ গ্রন্থ রচনা করে থাকতে পারেন তাহলে তারা সবাই মিলে এর বিকল্প একটি গ্রন্থ পেশ করুক ; এমনকি তা যদি না পারে তো এর যে কোনো সূরাহর সমমানসম্পন্ন একটি বিকল্প সূরাহ্ রচনা করে আনুক।

কোরআন মজীদ প্রদত্ত এ চ্যালেঞ্জের বিভিন্ন দিক হচ্ছে : এ গ্রন্থের উন্নততম ভাষা ও রচনাশৈলী , স্বল্পতম কথায় ব্যাপকতর তাৎপর্য এবং তত্ত্ব , তথ্য , আইন , জ্ঞান ও পথনির্দেশের ব্যাপক সমাহার।

বিগত চৌদ্দশ বছরে কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ ও আল্লাহর কালাম্ হওয়া সম্পর্কে বহু ইসলামী মনীষী আলোচনা করেছেন। তাঁরা প্রধানতঃ কোরআন মজীদের উপরোক্ত দিকগুলোকে কেন্দ্র করেই আলোচনা করেছেন। এছাড়া এ গ্রন্থের ভবিষ্যদ্বাণী সমূহের বাস্তবায়িত হওয়া , এতে নিহিত বৈজ্ঞানিক তথ্যাদি ইত্যাদিকেও অনেকে এর মু জিযাহ্ হওয়ার প্রমাণ স্বরূপ উল্লেখ করে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তাঁদের কেউই 19 সংখ্যার দ্বারা কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ প্রমাণের চেষ্টা করেন নি।

কিন্তু হঠাৎ করে ড. রাশাদ খালীফাহ্ 19 সংখ্যার দ্বারা কোরআনের মু জিযাহ্ প্রমাণের দাবী করে বসলেন। আর সাথে সাথে , ইসলাম ও আরবী ভাষার চর্চা যাদের মধ্যে খুবই কম এমন মুসলমানদের মধ্যে এ ধারণাটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেললো। আর বিভিন্ন ভাষায় তাঁর এতদসংক্রান্ত পুস্তকের অনুবাদ করা হলো এবং একে ভিত্তি করে বিভিন্ন ভাষায় বহু পুস্তিকা ও প্রবন্ধ রচিত হলো।

তবে ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞানের অধিকারী ওলামায়ে কেরাম , ইসলামী চিন্তাবিদ ও মনীষীদের নিকট বিষয়টি পাত্তা পায় নি। তাঁদের মতে , কোরআন মজীদ স্বীয় মু জিযাহ্ প্রমাণের জন্য 19 বা অন্য কোনো সংখ্যার মুখাপেক্ষী নয়। বিশেষ করে ইসলামের ইতিহাসে বা হাদীছে কাফের-মুশরিকদেরকে 19 সংখ্যা দ্বারা চ্যালেঞ্জ করার কোনো ঘটনা উল্লিখিত নেই। তাঁদের মতে , হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সময় এ ধরনের কোনো চ্যালেঞ্জ প্রদানের ঘটনা সংঘটিত হলে হাদীছ ও ইতিহাসের গ্রন্থসমূহে তা অবশ্যই উল্লিখিত থাকতো।

দৈনিক একটির কম আয়াত

এখানে স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে , কোনো গ্রন্থের বর্ণ , শব্দ ও বাক্য সমূহ 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য হলেই তাকে ঐশী বাণী বলে মানুষের বিচারবুদ্ধি গ্রহণ করতে বাধ্য কি ? মানুষের পক্ষে কি 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য বর্ণ , শব্দ ও বাক্য সম্বলিত রচনা তৈরী করা অসম্ভব ? মানুষ যদি চতুর্দশপদী , অষ্টাদশপদী ইত্যাদি কবিতা রচনা করতে পারে , তো ঊনবিংশপদী কবিতা বা বাক্য সম্বলিত অথবা বর্ণ , শব্দ , নাম ইত্যাদির সংখ্যা 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য এমন প্রবন্ধ বা গ্রন্থ রচনা করতে পারবে না কেন ? একজনের পক্ষে যদি সম্ভব না-ও হয় , তো অনেকের পক্ষে মিলে রচনা করা অসম্ভব হবার কোনো কারণই নেই। বরং 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য গ্রন্থ মানুষের পক্ষে রচনা করা অসম্ভব বলে দাবী করা একটি হাস্যকর দাবী বৈ নয়।

কোরআন মজীদকে দীর্ঘ 23 বছরে অল্প অল্প করে মানুষের সামনে পেশ করা হয়েছে , এ কারণে সহজেই একে 19 সংখ্যা দ্বারা নিঃশেষে বিভাজিত রূপে বিন্যস্ত করা সহজ হয়েছে - কোরআন-বিরোধীরা এরূপ দাবী করে বসলে তা খণ্ডন করার কোনো উপায় আছে কি ?

কোরআন-বিরোধীরা যদি বলে , কোরআন দীর্ঘ 23 বছরে অর্থাৎ আট হাজার দিনেরও বেশী সময় ধরে মানুষের কাছে পেশ করা হয়েছে। এর মানে , গড়ে একেকটি আয়াতের জন্য এক দিনের বেশী সময় হাতে পাওয়া গেছে। অতএব , কোরআনের রচয়িতা ধীরে সুস্থে হিসাব করে এমনভাবে শব্দচয়ন ও বাক্যবিন্যাস করেছেন যে , সহজেই তার বর্ণ , শব্দ ও বাক্য সমূহ 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য হয়েছে। তাদের এ ধরনের দাবী খণ্ডন করার জন্য কোনো উপযুক্ত জবাব আছে কি ?

এভাবে কোরআন মজীদকে গ্রহণযোগ্য করানোর জন্য যে 19 সংখ্যার আশ্রয় নেয়া হচ্ছে তা-ই কোরআন মজীদের ঐশিতা সম্পর্কে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমতাবস্থায় কোরআন মজীদের অলৌকিকতাকে এহেন একটি কাল্পনিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো কোনো মতেই সঙ্গত নয়।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে হয় যে , যদিও দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে কোরআন মজীদের আয়তন বিশিষ্ট একটি গ্রন্থের বর্ণ , শব্দ ও বাক্য 19 সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্যরূপে রচনা করা সম্ভব , তাই বলে কোরআন-বিরোধীরা যদি মনে করে যে , দীর্ঘ 23 বছর সময়ের কারণেই অতুলনীয় গ্রন্থ রূপে কোরআনকে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে তাহলে তারা 23 বছর নয় , বরং আরো অনেক বেশী সময় নিয়ে এবং বহুসংখ্যক পণ্ডিত ব্যক্তির একটি টীম সমগ্র কোরআন মজীদের নয় , বরং এর ক্ষুদ্রতম সূরাহ্টির বিকল্প রচনার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আর এ ক্ষেত্রে তা 19 সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য হওয়ার কোনোই প্রয়োজন নেই ; এ ক্ষেত্রে ভাষার প্রাঞ্জলতা , ওজস্বিতা , তাৎপর্যের গভীরতা ও ব্যাপকতা এবং বক্তব্যের সংক্ষিপ্ততাই হবে বিকল্প পরীক্ষার মানদণ্ড।

বাহাইদের ষড়যন্ত্র নয় তো ?

উল্লেখ্য , বাহাই ধর্মমত কাদীয়ানী ধর্মমমতের মতোই ইসলাম থেকে বিচ্যুত ও ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী একটি ধর্মমত এবং কাদীয়ানী ধর্মমমতের মতোই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রের ফসল হিসেবে এ ধর্মমত অস্তিত্বলাভ করে। অতঃপর ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও আন্তর্জাতিক যায়নবাদী চক্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এ ধর্মটি টিকে আছে এবং মুসলমানদের ঈমান ধ্বংসের তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। বর্তমানে বাহাই ধর্মাবলম্বীদের প্রধান দফতর ইসরাঈলের হাইফা বন্দরে অবস্থিত।

বৃটিশ সামরাজ্যবাদীদের এজেন্ট বাহাাউল্লাহ্ বাাব্ এ ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা। বাহাাউল্লাহ্ বাাব্ - এর আসল নাম মীর্যা আলী মোহাম্মাদ শীরাযী। সে নিজেকে প্রথমে হযরত ইমাম মাহ্দী ( আল্লাহ্ তাঁর আবির্ভাব ত্বরান্বিত করুন )- এর প্রতিনিধি বলে দাবী করে এবং এ অ র্থে নিজেকে ইমাম মাহ্দী ( আঃ ) ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগের দরযা ( باب ) রূপে আখ্যায়িত করে। পরে সে নিজেকে নবী বলে দাবী করে এবং সবশেষে খোদা হওয়ার দাবীও পেশ করে। ( Baha`ism by Mujtaba Shirazi, Islamic Propagation Organization, Tehran, 1985. Pp. 14-15)

বাহাই ধর্মের লোকদের নিকট 19 একটি পবিত্র সংখ্যা ; তারা 19 দিনে সপ্তাহ গণনা করে থাকে। মুসলমানরা যেমন সপ্তাহে একদিন জুম্ আ নামায আদায় করে , তার পরিবর্তে বাহাইরা তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিটি মহল্লায় প্রতি 19তম দিনে সামাজিক ভোজের আয়োজন করে থাকে। এটা তাদের ধর্মের বাধ্যতামূলক অনুষ্ঠান। তেমনি তাদের ধর্মীয় মাস এ ধরনের 19 সপ্তাহে এবং তাদের ধর্মীয় বছর এ ধরনের 19 মাসে। সুতরাং কোরআনের মু জিযাহ্ প্রমাণের নামে এভাবে 19 সংখ্যার গুরুত্ব বৃদ্ধি করার পিছনে বাহাইদের ষড়যন্ত্র নিহিত নেই তো ?

যদিও কোরআন মজীদের কিছু কিছু বিষয় , যেমন : সূরাহ্-সংখ্যা 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য , তবে এ গ্রন্থের সব কিছু 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য নয়। এমতাবস্থায় 19 সংখ্যাকে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করা হলে কোরআন মজীদের যা কিছু 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য নয় সে সব বিষয় সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। অর্থাৎ এ মর্মে সন্দেহ সৃষ্টি হবে যে , যা 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য নয় নিশ্চয়ই তাতে বিকৃতি বা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

অতএব , এ 19-সংখ্যার তত্ত্ব উপস্থাপনের পিছনে বাহাই ষড়যন্ত্র কার্যকর থাকার বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত।

তার ওপরে ঊনিশ

19 সংখ্যার মু জিযাহর প্রবক্তাদের পক্ষ থেকে সূরাহ্ আল্-মুদ্দাছছির্-এর 30 নং আয়াতকে এ দাবীর ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ আয়াতে আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

عليها تسعة عشر

তার ওপরে আছে ঊনিশ।

এর ভিত্তিতে দাবী করা হয়েছে যে , কোরআন মজীদে ব্যবহৃত বর্ণ , শব্দ , আয়াত , নাম ইত্যাদি সব কিছু 19 সংখ্যা দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এ আয়াত থেকে তা প্রমাণিত হয় না। উদ্ধৃত আয়াতের পূর্বাপর থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে , এতে দোযখের ব্যবস্থাপক 19 জন ফেরেশতার কথা বলা হয়েছে ; এতে 19 সংখ্যা দ্বারা কোরআন মজীদের সব কিছুর নিঃশেষে বিভাজ্য হওয়ার কথা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই উল্লিখিত নেই।

প্রকৃত ব্যাপার হলো , উক্ত আয়াতে ইসলামের ঘোর দুশমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে পরকালে তাকে সাক্বার্ (দোযখ)-এ নিক্ষেপ করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে এবং সেই সাথে এর শাস্তির ভয়াবহতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। মুফাসসিরদের মতে , এ ব্যক্তির নাম ছিলো ওয়ালীদ বিন্ মুগ্বীরাহ্। সে ছিলো আরবী ভাষার ফাছ্বাহাত্ ও বালাগ্বাতের মহানায়ক এবং এ কারণে সে অকাট্যভাবে বুঝতে পারে যে , কোরআন মজীদ আল্লাহর কালাম , কিন্তু মক্কায় নিজের প্রভাব ও কর্তৃত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যে সে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে জাদুকর এবং কোরআন মজীদকে (তখন পর্যন্ত যে পরিমাণ নাযিল্ হয়েছিলো) জাদু বলে আখ্যায়িত করেছিলো।

ভুল ব্যাখ্যা

রাশাদ খলীফাহর মূল আরবী লেখাটি আমার পক্ষে দেখা সম্ভব হয় নি। তবে তাঁর লেখা অবলম্বনে বাংলা ভাষায় বেশ কিছু পুস্তক ও প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। এরূপ একটি পুস্তকে উক্ত আয়াতের অনুবাদ করা হয়েছে তদুপরি ঊনিশ।

বাংলাভাষী লেখক যদি এ আয়াতটি সরাসরি আরবী মূল থেকে অনুবাদ করে থাকেন তো বলবো , এ ধরনের অনুবাদ আরবী ভাষা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম জ্ঞানের অভাবই প্রমাণ করে থাকে। আর তিনি যদি রাশাদ খলীফাহর বই-এর ইংরেজী অনুবাদ অবলম্বনে তাঁর বইটি লিখে থাকেন এবং উক্ত আয়াতের অনুবাদও রাশাদ খলীফাহর বই-এর ইংরেজী অনুবাদ থেকে নিয়ে থাকেন , তো এ ধরনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয়ে আরবী ভাষার যথাযথ জ্ঞান ছাড়া ইংরেজী জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে বই লিখে তিনি গুরুতর অন্যায় কাজ করেছেন। আর তিনি যদি আরবী ভাষায় যথাযথ জ্ঞানের অধিকারী হয়ে থাকেন , কিন্তু রাশাদ খলীফাহ্ উক্ত আয়াতের যে ব্যাখ্যা করেছেন তার ভিত্তিতে আয়াতটির এরূপ অনুবাদ করে থাকেন তাহলে বলবো , রাশাদ খলীফাহ্ সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে উক্ত আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন এবং তিনিও এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাশাদ খলীফাহর অন্ধ অনুকরণ করে অন্যায় করেছেন।

[এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে , বাংলা ভাষায় যারাই 19 সংখ্যার তথাকথিত মু জিযাহ্ প্রমাণের জন্য পুস্তক বা প্রবন্ধ লিখেছেন সম্ভবতঃ তাঁদের সকলেই রাশাদ খলীফাহর বই-এর বা অন্য কোনো লেখকের লেখার ইংরেজী অনুবাদ বা ইংরেজীতে লেখা বই বা প্রবন্ধের ওপর নির্ভর করেছেন। 1992 খৃস্টাব্দের 3রা এপ্রিল ইরান থেকে দেশে ফিরে আসার পর আলোচ্য বাংলা পুস্তকটি পাই। ইতিমধ্যে একটি ইসলাম-সমর্থক বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকায় দক্ষিণ আফ্রিকার খ্যাতনামা ইসলামী চিন্তাবিদ মরহূম আহমাদ দীদাতের (1918-2005 খৃ.) একই বিষয়ে লেখা (অবশ্যই ইংরেজী ভাষায়) একটি প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়। মরহূম আহমাদ দীদাত নিঃসন্দেহে ইসলামের একজন বড় খাদেম ছিলেন (আল্লাহ্ তা আলা তাঁকে তাঁর এ খেদমতের শুভ প্রতিদান প্রদান করুন) , কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি আমাদের মতোই , ভুলের উর্ধে ছিলেন না। তাই তিনি কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ প্রমাণের জন্য একটি নতুন হাতিয়ার পেয়ে ত্বরিত গতিতে তা ব্যবহার করেন এবং এ ব্যাপারে গভীরভাবে তলিয়ে চিন্তা করার অবকাশ পান নি। এ বিষয়ে ভুল নির্দেশ করে ও সঠিক বিষয় তুলে ধরে একটি প্রবন্ধ লিখে উক্ত পত্রিকায় দেই এবং পত্রিকাটির সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীল সহকারী সম্পাদক লেখাটি প্রকাশ করার কথা দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লেখাটি ছাপা হয় নি। উক্ত সহকারী সম্পাদক জানান যে , পত্রিকাটির উর্ধতন কর্তাব্যক্তি এটি ছাপাতে নিষেধ করেছেন এবং বলেছেন : আমরা বিতর্ক সৃষ্টি করতে চাই না। আমি সহকারী সম্পাদক মহোদয়কে বলেছিলাম : আপনারা ইসলাম সম্পর্কে একটি ভুল জিনিস মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন , অথচ তা সংশোধন করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা না করে বলছেন বিতর্ক সৃষ্টি করতে চান না! কিন্তু তাঁর কাছে দেয়ার মতো কোনো জবাব ছিলো না। দুর্ভাগ্যজনক যে , পত্রিকাটির উক্ত সহকারী সম্পাদক মহোদয় ছাপা না হলে লেখাটি ফেরত দেবেন বলে কথা দিলেও আমার লেখাটি ফেরত দেয়ার জন্য খুঁজে পান নি! পরে একই বিষয়ে নতুন করে 19 সংখ্যার মু জিযাহর নামে বিভ্রান্তি শীর্ষক একটি প্রবন্ধটি রচনা করি - যা দৈনিক আল-মুজাদ্দেদ-এ ছাপা হয়েছিলো। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধটি দৈনিক আল-মুজাদ্দেদ-এ প্রকাশিত প্রবন্ধের কিঞ্চিৎ সম্প্রসারিত ও পরিমার্জিত রূপ।]

বাংলা ভাষায় তদুপরি শব্দের ব্যবহারিক অর্থ হচ্ছে অধিকন্তু - আর এ অর্থে তদুপরি বলা হয়ে থাকলে তা 19 সংখ্যার মু জিযাহর দাবীদারদের দাবীর সাথে সম্পর্কহীন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আভিধানিক অর্থে তদুপরি বলা হয়ে থাকলে অনুবাদ সঠিক হয়েছে বটে , তবে তা থেকেই 19 সংখ্যার মু জিযাহর দাবীদারদের দাবী খণ্ডিত হয়ে যাবে। কারণ , তদুপরি মানে যদি তার ওপরে করা হয় তাহলে তার মানে ব্যক্তি হবে না , হবে বস্তু। কিন্তু 19 সংখ্যার মু জিযাহর প্রবক্তাদের দাবী হচ্ছে এই যে , কাফেরদেরকে দোযখের ভয় দেখানোর পর বলা হয়েছে , তদুপরি তাদেরকে 19 সংখ্যার চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ব্যর্থতার লজ্জা বহন করতে হবে।

কিন্তু এখানে আয়াতে (মূল আরবী ভাষায়) না তদুপরি ( অধিকন্তু অর্থে) বলা হয়েছে , না এর দ্বারা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। বরং এ আয়াতে একটি তথ্য তুলে ধরা হয়েছে যা বাস্তবতার বর্ণনা (حکايت واقعيت ) পর্যায়ের।

এখানে উদ্ধৃত আয়াতের পূর্ববর্তী কয়েকটি আয়াত থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। সূরাহ্ আল্-মুদ্দাছছির্-এর 8 থেকে 30 নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

) فَإِذَا نُقِرَ فِي النَّاقُورِ. فَذَلِكَ يَوْمَئِذٍ يَوْمٌ عَسِيرٌ. عَلَى الْكَافِرِينَ غَيْرُ يَسِيرٍ. ذَرْنِي وَمَنْ خَلَقْتُ وَحِيدًا. وَجَعَلْتُ لَهُ مَالا مَمْدُودًا. وَبَنِينَ شُهُودًا. وَمَهَّدْتُ لَهُ تَمْهِيدًا. ثُمَّ يَطْمَعُ أَنْ أَزِيدَ. كَلا إِنَّهُ كَانَ لآيَاتِنَا عَنِيدًا. سَأُرْهِقُهُ صَعُودًا. إِنَّهُ فَكَّرَ وَقَدَّرَ. فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ. ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ. ثُمَّ نَظَرَ. ثُمَّ عَبَسَ وَبَسَرَ. ثُمَّ أَدْبَرَ وَاسْتَكْبَرَ. فَقَالَ إِنْ هَذَا إِلا سِحْرٌ يُؤْثَرُ. إِنْ هَذَا إِلا قَوْلُ الْبَشَرِ. سَأُصْلِيهِ سَقَرَ. وَمَا أَدْرَاكَ مَا سَقَرُ. لا تُبْقِي وَلا تَذَرُ. لَوَّاحَةٌ لِلْبَشَرِ. عَلَيْهَا تِسْعَةَ عَشَرَ( .

অতঃপর যখন শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে , সেদিন হবে অত্যন্ত কঠিন দিন ; কাফেরদের জন্য খুবই অস্বস্তিকর। (হে রাসূল!) আমার ওপর ছেড়ে দিন ঐ ব্যক্তির বিষয়টি যাকে আমি অনন্য করে সৃষ্টি করেছি , তাকে বিপুল ধনসম্পদ দিয়েছি ও তার সঙ্গী হিসেবে পুত্রবর্গ দিয়েছি , আর তার জন্য (প্রয়োজনীয় পার্থিব সব কিছুর) ব্যবস্থা করেছি যথাযথভাবে। এরপরও সে লোভ করে যে , আমি তাকে আরো বাড়িয়ে দেই। কক্ষনোই নয় (সে এ সব পেয়ে আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হয় নি , বরং) সন্দেহাতীতভাবেই সে আমার আয়াত সমূহের বিরুদ্ধাচরণকারী। অচিরেই আমি তাকে (শাস্তিতে নিক্ষেপের জন্য) পাকড়াও করে উঁচুতে তুলে ধরবো। নিঃসন্দেহে সে চিন্তা-ভাবনা করেছে ও মনস্থির করেছে। অতএব , সে ধ্বংস হোক সে জন্য যেভাবে সে মনস্থির করেছে , অতঃপর সে ধ্বংস হোক সে জন্য যেভাবে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে , অতঃপর দৃষ্টিপাত করেছে , অতঃপর ভ্রূকুঞ্চিত করেছে ও মুখ বিকৃত করেছে , এরপর পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছে ও অহঙ্কার করেছে। অতঃপর সে বললো : এ তো কারো কাছ থেকে পাওয়া জাদু বৈ কিছু নয় ; এটা মানুষের কথা বৈ নয়। (কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। তাই) অচিরেই আমি তাকে সাক্বারে (দোযখে) নিক্ষেপ করবো। (হে রাসূল!) আর কোন্ জিনিস আপনাকে বুঝিয়ে দেবে যে , সাক্বার্ কী ? তা (তাতে নিক্ষিপ্ত ব্যক্তিকে) না অবশিষ্ট রাখে , না রেহাই দেয় । তা মানুষকে দগ্ধকারী। তার ওপরে রয়েছে ঊনিশ।

[এখানে যে ওয়ালীদ্ বিন্ মুগ্বীরাহর কথা বলা হয়েছে আয়াতে ব্যবহৃত অনন্য (وحيداً ) শব্দে তার আভাস রয়েছে। কারণ , তৎকালীন আরবদের মধ্যে ওয়ালীদ বিন্ মুগ্বীরাহ্ ছিলো শ্রেষ্ঠতম বালীগ্ব ও ফাছ্বীহ্ , আর সে নিজেই তা সগর্বে ঘোষণা করেছিলো এবং কেউ তার এ দাবীর বিরোধিতা করে নি।]

ব্যাকরণের দৃষ্টিতে

উক্ত সূরাহটি শুরু থেকে পাঠ করলে সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে , সূরাহটির 8 থেকে 10 নং আয়াতে কাফেরদের (বহু বচনে) সম্পর্কে এবং 11 থেকে 26 নং আয়াতে তাদের মধ্যকার একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে। এখানে যে ব্যক্তি সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে সে হচ্ছে এক ব্যক্তি এবং একজন পুরুষ মানুষ (مذکر مفرد ) । উক্ত আয়াত সমূহে বহু বার ব্যবহৃত একবচন নির্দেশক পুরুষবাচক সর্বনাম হে (ه ) থেকে তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত।

অন্যদিকে 26 নং আয়াতে উল্লিখিতسقر (দোযখ) শব্দটি স্ত্রীবাচক ও একবচন (مفرد مونث ) ।

[স্মর্তব্য , আরবী ভাষায় অপ্রাণী বাচক বিশেষ্য সমূহও স্ত্রীবাচক বা পুরুষবাচক হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে এবং তদনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিশেষ্যের জন্য স্ত্রী বা পুরুষ বাচক সর্বনাম ও বিশেষণ ব্যবহৃত হয় এবং কর্তা পদের দৃষ্টিতে ক্রিয়া পদের স্ত্রী বা পুরুষ বাচক সংযুক্ত সর্বনাম ব্যবহৃত হয়ে থাকে।]

অতএব , 28 নং আয়াতের স্ত্রীবাচক ক্রিয়াপদتبقیتذر এবং 29 নং আয়াতের স্ত্রীবাচক ও কর্তাবাচক বিশেষ্যلواحة যে এই দোযখ সম্পর্কেই ব্যবহৃত হয়েছে সে ব্যাপারে বিতর্কের কোনোই অবকাশ নেই।

অতঃপর এসেছে 30 নং আয়াতعليها تسعة عشر (তার ওপরে রয়েছে ঊনিশ)। এ আয়াতেরعليها কথাটিরها সর্বনামটি স্ত্রীবাচক ও একবচন (مؤنث مفرد ) । অতএব , নিঃসন্দেহে তাسقر (দোযখ) সম্বন্ধে ব্যবহৃত হয়েছে , উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয় নি - যে পুরুষ ও এক ব্যক্তি।

এ আয়াতটি প্রথমে উল্লিখিত কাফেরদের সম্পর্কেও বলা হয় নি - যারা এক ব্যক্তি নয় , বরং বহু। আরکافرين শব্দে নারী-পুরুষ উভয়ই শামিল থাকলেও আরবী ব্যাকরণিক রীতি অনুযায়ী শব্দটি পুরুষবাচক এবং তা দ্বারা শুধু পুরুষ বা স্ত্রী-পুরুষ একত্রে - যা-ই বুঝানো হোক না কেন , এ শব্দের জন্য কেবল পুরুষবাচক সর্বনাম , বিশেষণ ও ক্রিয়া পদ ব্যবহার করতে হবে ; স্ত্রীবাচক পদ ব্যবহার করা ছ্বহীহ্ হবে না।

দোযখের 19 জন ফেরেশতা

আলোচ্য সূরাহ্ আল্-মুদ্দাছছিরের 30 নং আয়াতের পরবর্তী আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে , আলোচ্য আয়াতে দোযখের 19 জন তত্ত্বাবধায়কের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ঐ ব্যক্তি যেন মনে না করে যে , সে কোনো না কোনোভাবে দোযখ থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে। তা সে পারবে না। কারণ , দোযখ কোনো অরক্ষিত জায়গা নয়। বরং দোযখের তত্ত্বাবধানের জন্য আল্লাহ্ তা আলা 19 জন তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত রেখেছেন। কিন্তু এই 19 জন তত্ত্বাবধায়কের তথ্য কাফেরদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়।

মুফাসসিরগণের বক্তব্য অনুযায়ী , এতে বরং কাফেররা নবী-করীম (ছ্বাঃ)-এর উদ্দেশে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে থাকে। কারণ , কোটি কোটি দোযখবাসীর তত্ত্বাবধান মাত্র 19 জন তত্ত্বাবধায়ক করবে এটা তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। কারণ , তারা এই 19 জন তত্ত্বাবধায়ককে তাদের নিজেদের ন্যায় সীমিত ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করেছিলো। তাই 31 নং আয়াতে তাদের এ ধারণার ভ্রান্তি স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। এটি একটি দীর্ঘ আয়াত যাতে এরশাদ হয়েছে :

) وَمَا جَعَلْنَا أَصْحَابَ النَّارِ إِلا مَلائِكَةً وَمَا جَعَلْنَا عِدَّتَهُمْ إِلا فِتْنَةً لِلَّذِينَ كَفَرُوا لِيَسْتَيْقِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَيَزْدَادَ الَّذِينَ آمَنُوا إِيمَانًا وَلا يَرْتَابَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْمُؤْمِنُونَ وَلِيَقُولَ الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ وَالْكَافِرُونَ مَاذَا أَرَادَ اللَّهُ بِهَذَا مَثَلا كَذَلِكَ يُضِلُّ اللَّهُ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَمَا يَعْلَمُ جُنُودَ رَبِّكَ إِلا هُوَ وَمَا هِيَ إِلا ذِكْرَى لِلْبَشَرِ( .

আমি ফেরেশতা ছাড়া কাউকে দোযখের তত্ত্বাবধায়ক বানাই নি , আর আমি তাদের সংখ্যাটিকে তো কাফেরদের জন্য একটি পরীক্ষা স্বরূপ বানিয়েছি - যাতে কিতাবের অধিকারীরা দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারী হতে পারে ও ঈমানদারদের ঈমান বৃদ্ধি পায় , আর যাতে কিতাবধারীরা ও ঈমানদারগণ সন্দেহ-সংশয়ে নিপতিত না হয় এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা ও কাফেররা বলে : আল্লাহ্ এ দৃষ্টান্ত দ্বারা কী বুঝাতে চেয়েছেন ? বস্তুতঃ এভাবেই (অভিন্ন বিষয় দ্বারা) আল্লাহ্ যাকে চান পথভ্রষ্ট করেন ও যাকে চান পথপ্রদর্শন করেন। আর (হে রাসূল!) আপনার রবের বাহিনী সমূহ সম্পর্কে তিনি ছাড়া আর কেউ অবগত নয়। আর এ (কোরআন) তো মানুষের জন্য (প্রকৃত সত্যকে) স্মরণে করিয়ে দেয়ার মাধ্যম বৈ নয়।

এ আয়াতে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে যে , আল্লাহ্ তা আলা ফেরেশতাদের সংখ্যাটিকে অর্থাৎ পূর্ববর্তী আয়াতে উল্লিখিত দোযখের তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতার সংখ্যা মাত্র ঊনিশ জন হওয়ার বিষয়টিকে কাফেরদের জন্য ফিতনাহ্ বা পরীক্ষা বানিয়েছেন। এখানে বলা হয় নি যে , 19 সংখ্যাটিকে সংখ্যা হিসেবে কোরআন মজীদের সব কিছুর গাণিতিক বিভাজক হিসেবে কাফেরদের জন্য পরীক্ষা বানানো হয়েছে। বরং সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে তাদের সংখ্যাটিকে (عدة هم )।

এখানে সুস্পষ্ট যে , কাফেররা দোযখের তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাদের সংখ্যা মাত্র 19 জন শুনে এটাকে অবিশ্বাস করবে। কারণ , তাদের মনে হবে যে , বিশালায়তন দোযখের তত্ত্বাবধান মাত্র 19 জন ফেরেশতার পক্ষে অসম্ভব , আর , তাদের ধারণা অনুযায়ী , এরূপ অসম্ভব ও অবাস্তব তথ্য উপস্থাপনকারী ব্যক্তি নবী হতে পারেন না। অন্যদিকে ঈমানদারগণ (ও প্রকৃত আহলে কিতাব্গণ) মাত্র 19 জন ফেরেশতা বিশালায়তন দোযখের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করবে শুনে উক্ত ফেরেশতাদের কল্পনাতীত রকমের বেশী শক্তি-ক্ষমতা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা করতে সক্ষম হবে এবং এহেন সৃষ্টির (ফেরেশতার) স্রষ্টা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা আলার শক্তি-ক্ষমতা সম্পর্কে চিন্তা করে ভক্তি ও বিস্ময়ে তাঁর বরাবরে মাথা নত করে দেবে।

তবে এভাবে ঈমানদারগণ ফেরেশতাদের , বিশেষ করে দোযখের তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাদের সম্পর্কে যে ধারণার অধিকারী হবে তা একটি মোটামুটি ধারণা ; প্রকৃত ধারণা নয়। কারণ , ফেরেশতাদের স্বরূপ ও প্রকৃতি এবং তাদের প্রকৃত শক্তি ও ক্ষমতা সম্বন্ধে একমাত্র আল্লাহ্ তা আলা ছাড়া আর কেউই পুরোপুরি অবগত নন।

এখানেও 19 সংখ্যার মু জিযাহর প্রবক্তাদের কেউ কেউو ما يعلم جنود ربک الا هو - আর (হে রাসূল!) আপনার রবের বাহিনী সমূহ সম্পর্কে তিনি ছাড়া আর কেউ অবগত নয়। - এ আয়াতাংশের অর্থ করতে গিয়ে দাবী করেছেন যে , আল্লাহর সেনাবাহিনীর সংখ্যাশক্তি সম্পর্কে কেউ অবগত নয়। এরপর তাঁরা বলেন , অতএব , 30 নং আয়াতে উল্লিখিত 19 সংখ্যাটি ফেরেশতা সম্পর্কিত নয়।

তাঁদের ভ্রান্তি এখানে যে , সেনাবাহিনী সমূহকে জানে না (ما يعلم جنود ) বলতে তাঁরা সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা জানে না অর্থ গ্রহণ করেছেন। অথচ এ আয়াতাংশের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে : আর (হে রাসূল!) আপনার রবের বাহিনী সমূহের প্রকৃতি ও শক্তি-ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি ছাড়া আর কেউ অবগত নয়। কারণ , যদি বলা হয় :لا يعلم زيد هذا القوم (যায়েদ এ জনগোষ্ঠীটিকে জানে না) , তখন কি এর অর্থ হবে যায়েদ এ জনগোষ্ঠীটির জনসংখ্যা কতো তা জানে না ? নাকি এর অর্থ হবে যায়েদ এ জনগোষ্ঠীটির পরিচয় (তারা কোত্থেকে এসেছে , কোন্ জাতি বা গোত্রের লোক , তাদের প্রধান চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি) জানে না ?

আল্লাহ্ তা আলার ফেরেশতাদের সংখ্যা যে তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না - এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আলোচ্য আয়াতে তা বলা উদ্দেশ্য নয়। কারণ , আল্লাহর বাহিনীসমূহকে তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। বললে তা শোনামাত্রই যে তাৎপর্য শ্রোতার মস্তিষ্কে জাগ্রত হবে তা হচ্ছে আল্লাহর বাহিনীসমূহের স্বরূপ ও প্রকৃতি তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। এখানে কোনো রকম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিদর্শন না থাকলে বাহিনীকে জানা বলতে বাহিনীর সদস্যসংখ্যা জানা অর্থ গ্রহণের সুযোগ নেই। এমনকি যদি এ ক্ষেত্রে সংখ্যা শব্দটিকে উহ্য হিসেবে ধরা হয় সে ক্ষেত্রে এ আয়াতাংশের অর্থ হবে আল্লাহর বাহিনীসমূহের সংখ্যা তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। এ অবস্থায়ও বাহিনীসমূহের সদস্যসংখ্যা বুঝাবে না।

এতদসত্ত্বেও তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয় যে , এ আয়াতাংশে সেনাবাহিনীসমূহের সদস্যসংখ্যার কথা বলা হয়েছে সে ক্ষেত্রেও 19 সংখ্যাটি যে দোযখের তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাদের সংখ্যা সম্পর্কিত তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ , আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিজগতের ব্যবস্থাপনায় সর্বত্র ফেরেশতা নিয়োজিত রয়েছে। কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে জিবরাঈল্ , মিকাইল্ , আযরা ঈল ও ইসরাফীল্ ফেরেশতার কথা এবং বহুবচনে মৃত্যুর ফেরেশতাদের (সূরাহ্ আল্-আন্ আাম্ : 61) কথা উল্লিখিত আছে।

এমতাবস্থায় উক্ত আয়াত (সূরাহ্ আল্-মুদ্দাছছির্ : 30) দৃষ্টে কোরআন মজীদের মতে আল্লাহ্ তা আলা কেবল দোযখের তত্ত্বাবধানের জন্য ফেরেশতা নিয়োজিত রেখেছেন , অন্য কোনো কাজে তাঁর পক্ষ থেকে আর কোনো ফেরেশতা নিয়োজিত নেই - মুসলমান ও কাফের নির্বিশেষে কোনো কোরআন-পাঠকের মনেই এ ধারণা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই। কেবল দোযখের তত্ত্বাবধান ছাড়া অন্য কোনো কাজে ফেরেশতা নিয়োজিত নেই ধরে নেয়া হলেই 19 জন ফেরেশতা ফেরেশতাদের সংখ্যা কেউ জানে না কথা দু টির মধ্যে পরস্পর বিরোধিতা দেখা যেতো।

অন্যদিকে 19 সংখ্যাটিকে কোরআন মজীদের বর্ণ , শব্দ , আয়াত , সূরাহ্ , নাম ইত্যাদির বিভাজক হিসেবে ধরা হলে কাফেরদের পক্ষ থেকে তা অবিশ্বাস করার প্রশ্ন উঠতো না এবং অবিশ্বাস করে তারা এই বলে বিস্ময় প্রকাশ করতো না :ماذا اراد الله بهذا مثلاً (আল্লাহ্ এ দৃষ্টান্ত দ্বারা কী বুঝাতে চেয়েছেন ?!)। কারণ , 19 সংখ্যাটি দ্বারা চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়ে থাকলে তা বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের প্রশ্ন উঠতো না , বরং তা হতো মোকাবিলা করার বিষয়। অন্যদিকে 19 যদি দোযখের তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাদের সংখ্যা হয় কেবল তখনই তা বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের ও বিস্মিত হওয়ার প্রশ্ন ওঠে।

এ প্রসঙ্গে সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর 26 নং আয়াতের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। এ আয়াত অনুযায়ী যে কালামে মশা-মাছির ন্যায় ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ প্রাণীর উপমা বা দৃষ্টান্ত ব্যবহৃত হয়েছে সে কালাম্ আল্লাহর কালাম্ হওয়ার বিষয়টি কাফেরদের কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়েছে। সেখানেও কাফেরদের প্রতিক্রিয়া অভিন্ন :ماذا اراد الله بهذا مثلاً (আল্লাহ্ এ দৃষ্টান্ত দ্বারা কী বুঝাতে চেয়েছেন ?!)। একইভাবে দোযখের ফেরেশতাদের সংখ্যার বিষয়টিও তাদের কাছে অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়ের ব্যাপার মনে হয়েছে।