কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্ 0%

কোরআনের মু‘জিযাহ্ লেখক:
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 46668
ডাউনলোড: 4354

পাঠকের মতামত:

কোরআনের মু‘জিযাহ্
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 60 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 46668 / ডাউনলোড: 4354
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

বক্তব্যের ক্রমবিন্যাসের দৃষ্টিতে

সূরাহ্ আল্-মুদ্দাছছির্-এর উপরোদ্ধৃত 30 ও 31 নং আয়াত ধারাবাহিকভাবে পড়ে এলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে , কাফেররা 19 সংখ্যাটির ব্যাপারে বিস্ময় ও অবিশ্বাস প্রকাশ করেছিলো , কারণ , তাদের ধারণা অনুযায়ী এতো অল্পসংখ্যক ফেরেশতার পক্ষে দোযখের তত্ত্বাবধান সম্ভব নয়। তাছাড়া 31 নং আয়াতেو ما يعلم جنود ربک الا هو (আর আপনার রবের বাহিনীসমূহকে তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না বাক্যটিماذا اراد الله بهذا مثلاً (আল্লাহ্ এ দৃষ্টান্ত দ্বারা কী বুঝাতে চেয়েছেন ?) বাক্যের পরে এসেছে। সুতরাং বাহিনীসমূহের সদস্যসংখ্যার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করায় তাদের পক্ষ থেকে তা অবিশ্বাস করা ও বিশ্বাস করার প্রশ্ন ওঠে না। যদি তা-ই হতো , তাহলে এ আয়াতে বাক্য দু টি অগ্র-পশ্চাত হতো।

শুধু তা-ই নয় , 19 সংখ্যাটির দ্বারা চ্যালেঞ্জ করাই যদি উদ্দেশ্য হতো তাহলেعليها تسعة عشر (তার ওপরে রয়েছে ঊনিশ) আয়াতটিان هذا الا قول البشر (এটা মানুষের কথা বৈ নয়) আয়াতের পর পরই স্থানলাভ করতো , এরপর দোযখের বর্ণনা আসতে পারতো ; মাঝখানে দোযখের বর্ণনা দেয়া প্রয়োজন হতো না , বরং মাঝখানে দোযখের বর্ণনা দেয়ার পরে তাকে চ্যালেঞ্জ করার কথা বলা হলে তা সাহিত্যরীতির বিচারে অসঙ্গত হতো।

এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে , সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর 23 ও 24 নং আয়াতে কোরআন মজীদ তার যে কোনো একটি সূরাহর বিকল্প রচনার চ্যালেঞ্জ দিয়েছে এবং চ্যালেঞ্জ দেয়ার পর বলেছে যে , তারা এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে না ; কেবল এর পরই তাদেরকে দোযখের ভয় দেখিয়েছে। বস্তুতঃ এটাই হচ্ছে বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাত্ তথা সাহিত্যরীতির দাবী অনুযায়ী স্বাভাবিক বিন্যাস। সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর উক্ত আয়াত দু টিতে এরশাদ হয়েছে :

) و ان کنتم فی ريب مما نزلنا علی عبدنا فأتوا بسورة من مثله وادعوا شهداءکم من دون الله ان کنتم صادقين. فان لم تفعلوا و لن تفعلوا فاتقوا النار التی وقودوها الناس و الحجارة اعدت للکافرين( .

আর আমি আমার বান্দাহর ওপর যা নাযিল্ করেছি সে ব্যাপারে যদি তোমরা সন্দেহে থেকে থাকো তাহলে তোমরা এর (এ গ্রন্থের যে কোনো একটি সূরাহর) অনুরূপ সূরাহ্ নিয়ে এসো এবং এ কাজে আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের মধ্যকার (বালাগ্বাত্ ও ফাছ্বাহাতের ক্ষেত্রে) সুদক্ষ সকল ব্যক্তিকে ডেকে নাও , যদি তোমরা (এটি আল্লাহর কালাম্ না হওয়ার মৌখিক দাবীর ব্যাপারে অন্তরে) সত্যবাদী হয়ে থাকো। আর তোমরা যদি তা না পারো - আর (আল্লাহ্ জানেন যে ,) তোমরা কখনোই তা পারবে না। অতএব , তোমরা সেই অগ্নিকে ভয় করো যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর - যা প্রজ্জ্বলিত করা হয়েছে কাফেরদের জন্য।

অতএব , সূরাহ্ আল্-মুদ্দাছছির্-এর উপরোদ্ধৃত 30 নং আয়াতে যে 19 সংখ্যা দ্বারা কাফেরদেরকে চ্যালেঞ্জ করা হয় নি , বরং তাতে দোযখের তত্ত্বাবধায়কের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।

যৌক্তিকতার দৃষ্টিতে

যৌক্তিকতার দৃষ্টিতেও 19 সংখ্যা দ্বারা কাফেরদেরকে চ্যালেঞ্জ করার বিষয়টি ধোপে টেকে না। কারণ , সর্বসম্মত মত অনুযায়ী সূরাহ্ আল্-মুদ্দাছছির্ নাযিল্ হয়েছে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াতের দায়িত্বে অভিষিক্ত হবার পরবর্তী মক্কী যিন্দেগীর প্রথম দিকে। অতএব , ঐ সময় তখন পর্যন্ত কোরআন মজীদের যতোটুকু নাযিল্ হয়েছিলো কেবল ততোটুকুর অথবা তার কোনো একটি সূরাহর বিকল্প আনয়নের জন্য কাফেরদেরকে চ্যালেঞ্জ প্রদান করা সম্ভব ছিলো এবং প্রকৃত পক্ষেও সেভাবেই চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিলো - যে চ্যালেঞ্জের মানদণ্ড ছিলো ভাষার প্রাঞ্জলতা , ওজস্বিতা , সাহিত্যসৌন্দর্য , সংক্ষিপ্ততা ও জ্ঞানগর্ভতা সহ তাৎপর্যের গভীরতা।

এর পরিবর্তে ঐ সময় সমগ্র কোরআন মজীদের সব কিছু 19 সংখ্যা দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য হবার দাবী করা এবং তার ভিত্তিতে 19 সংখ্যার মানদণ্ডে বিকল্প গ্রন্থ রচনার জন্য কাফেরদেরকে চ্যালেঞ্জ প্রদান করা সম্ভব ছিলো না। এরূপ চ্যালেঞ্জ করতে হলে কেবল পুরো কোরআন নাযিল্ হওয়ার পরেই তা সম্ভব ছিলো। কারণ , পুরো কোরআন মজীদ নাযিল্ হওয়ার পূর্বে এ দাবী গ্রহণযোগ্য হতো না যে , তার সব কিছু 19 সংখ্যা দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য হবে।

কাল্পনিক ভিত্তির প্রয়োজন নেই

বস্তুতঃ যারা কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ বা ঐশী কিতাব্ হওয়ার বিষয়টি প্রমাণের লক্ষ্যে তার সব কিছু 19 সংখ্যা দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য হওয়ার ওপরে গুরুত্ব আরোপ করেছেন তা তাঁরা করেছেন কাল্পনিক ভিত্তির ওপরে এবং কোরআন মজীদের সংশ্লিষ্ট আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে অথবা অন্যের কৃত মনগড়া ব্যাখ্যা অন্ধভাবে গ্রহণ করে।

কিন্তু কোনো ভিত্তিহীন বিষয়কে অবলম্বন করে কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ বা অলৌকিকত্ব প্রমাণের আদৌ প্রয়োজন নেই ; এতে কোনো ফায়দাও নেই , বরং এটা পরিণামে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে সন্দেহ নেই। অতএব , এটি অবশ্য পরিত্যাজ্য।

ধৃষ্টতামূলক কারণ আবিষ্কার

কোরআন মজীদের বর্ণ , শব্দ , আয়াত , সূরাহ্ , নাম , হুরুফে মুক্বাত্বত্বা আত্ , আল্লাহর নাম ইত্যাদি বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সংখ্যা দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য হতে পারে , অতএব , তার কতক 19 সংখ্যা দ্বারাও নিঃশেষে বিভাজ্য হতে পারে। এ থেকে 19-এর কোনো বিশেষ মাহাত্ম্য প্রমাণিত হয় না। তেমনি 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য হওয়ায় তা থেকে কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ও প্রমাণিত হয় না।

19 সংখ্যা দ্বারা কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ প্রমাণের দাবীদাররা বেছে বেছে ঐ সব বিষয়ের উদাহরণ দিয়েছেন যেগুলোকে তাঁরা 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য মনে করেছেন। তবে এতেও তাঁরা পুরোপুরি সফল হন নি। এ কাজ করতে গিয়ে তাঁরা একদিকে আরবী ভাষা ও কোরআন মজীদের লিপিশৈলী সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন বা অজ্ঞতার ভান করেছেন , অন্যদিকে বহু গোঁজামিলের আশ্রয় নিয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষে তাঁরা কালামুল্লাহ্ মাজীদের শব্দ বা বর্ণের ব্যবহারের পিছনে এমন সব কল্পিত কারণ আবিষ্কার করেছেন যা আল্লাহ্ তা আলা ও কোরআন মজীদের শা নে অত্যন্ত মারাত্মক। 19 সংখ্যার তথাকথিত মু জিযাহ্ প্রমাণের স্বার্থে এ ধরনের ধৃষ্টতা কোরআন মজীদের বর্ণ , শব্দ , বাক্য ও লিপি নির্বিশেষে যেখানেই প্রয়োজন হয়েছে প্রদর্শন করা হয়েছে।

সূরাহ্ আন্-নামল্-এ সাবা -র রাণী (বিলকিস্)কে লেখা হযরত সোলায়মান ( আঃ)-এর পত্র বিসমিল্লাহির্ রাহমানির্ রাহীম্ দিয়ে শুরু হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করার পর এ ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শন করা হয়েছে। এ সম্পর্কে 19 সংখ্যার তথাকথিত মু জিযাহর প্রবক্তারা দাবী করেছেন যে , আল্লাহ্ তা আলা বিসমিল্লাহির্ রাহমানির্ রাহীম্ আয়াতটির সংখ্যাকে 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য করার লক্ষ্যেই সূরাহ্ আন্-নামল্-এর মাঝখানে এ আয়াতটি ব্যবহার করেছেন।

একটি বই-এ তো এতাদূর পর্যন্ত দাবী করা হয়েছে যে , সূরাহ্ আন্-নামল্-এর 30 নং আয়াতটি অর্থাৎ বিস্মিল্লাহ্ র আয়াতটি ছাড়াই ঘটনার বর্ণনা পরিষ্কারভাবে বোঝা যেতো , কিন্তু আল্লাহ্ তা আলা শুধু বিসমিল্লাহির্ রাহমানির্ রাহীম্ আয়াতটির সংখ্যাকে 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য করার লক্ষ্যেই এ আয়াতটি এখানে যোগ করেছেন। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো এই যে , যদি তা-ই হতো তাহলে সাথে সাথেই মক্কার মোশরেকদের মধ্যকার ফাছ্বাহাত্ ও বালাগ্বাতের মহানায়করা এর প্রতিবাদ করতো এবং বলতো যে , শেষ পর্যন্ত 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য করতে অক্ষম হয়ে বেদরকারীভাবে কোরআনে একটি অতিরিক্ত বিস্মিল্লাহ্ ঢুকানো হয়েছে।

উক্ত বইটির লেখকের মতো মূর্খদের ধারণা কি এই যে , এখানে ঘটনা বর্ণনা করাই একমাত্র উদ্দেশ্য ? তা-ই যদি হতো তাহলে তো কোরআন মজীদে আরো যে সব ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে সে সবের মধ্যে যে সব ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলার গুণবৈশিষ্ট্য ও প্রশংসার উল্লেখ রয়েছে তা থাকতো না। তাছাড়া কোরআন মজীদে হযরত মূসা ( আঃ)-এর ঘটনাবলী একাধিক জায়গায় বর্ণনা করা হতো না।

এ ধরনের লোকদের হয়তো জানাই নেই যে , কোরআন মজীদ হচ্ছে জ্ঞানের অতল মহাসমুদ্র এবং মানুষের জন্য পথনির্দেশ। কবির কবিতায় যেভাবে ছন্দ ও মাত্রা মিলাবার লক্ষ্যে ক্ষেত্রবিশেষে যথোপযুক্ত শব্দ বাদ দিয়ে অর্থের দিক থেকে দুর্বল শব্দ ব্যবহার করা হয় এবং কেবল পঙক্তির জোড়া মিলাবার লক্ষ্যে অপ্রাসঙ্গিক কথা যোগ করা হয় কোরআন মজীদ সে ধরনের দুর্বলতা থেকে মুক্ত।

[বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে , ক্ষেত্রবিশেষে অত্যন্ত বিখ্যাত কবিরাও তাঁদের কোনো কোনো লেখায় এ কাজ করেছেন। যেমন : কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গ্রামছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ গানে মন ভুলিয়ে নিয়ে যায় কোন্ চুলায় রে এবং কবি নজরুল ইসলামের কাজ নেই আর আমার ভালোবেসে , আমি তার ছলনায় ভুলবো না গানে সোজা পথ ছাড়া আর চলবো না ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।]

কিন্তু 19 সংখ্যার তথাকথিত মু জিযাহর প্রবক্তারা তাদের মূর্খতার কারণে আল্লাহ্ তা আলার ওপর এরূপ দুর্বলতা আরোপ করতেও পিছপা হয় নি। যেমন , বলা হয়েছে : ক্বাফ্ (ق ) হরফটিকে 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য করার লক্ষ্যেই সূরাহ্ ক্বাফ্ -এ ক্বাওমে লূত্ব না বলে ইখওয়ানু লূত্ব বলা হয়েছে। অথচ প্রকৃত ব্যাপার তা নয়।

বস্তুতঃ কোরআন মজীদের এক অংশ এর অপর অংশের ব্যাখ্যাকারী - এ হচ্ছে মায্হাব্ ও ফিরক্বাহ্ নির্বিশেষে সকল মুসলিম ওলামায়ে কেরামের দ্বারা সমভাবে স্বীকৃত কোরআন ব্যাখ্যার মূলনীতিসমূহের অন্যতম। এ নীতির আলোকে এ বিষয়ের সবগুলো আয়াতকে পাশাপাশি রেখে দৃষ্টিপাত করলেই একটি আয়াতে ইখওয়ানু লূত্ব্ বলার কারণ সুস্পষ্ট হয়ে যায়।

যেভাবে কোরআন মজীদে ক্বাওমে নূহ্ বলতে সেই ক্বাওম-কে বুঝানো হয়েছে হযরত নূহ্ ( আঃ) যে ক্বাওমে জন্মগ্রহণ করেছিলেন , সেভাবে কোরআন মজীদের যে সব আয়াতে ক্বাওমে লূত্ব্ -এর কথা বলা হয়েছে তাতে হযরত লূত্ব্ ( আঃ) যে ক্বাওম্-এ জন্মগ্রহণ করেন সে ক্বাওম্-এর কথা বুঝানো হয় নি। বরং ক্বাওমে লূত্ব্ বলতে সেই ক্বাওম্-কে বুঝানো হয়েছে হযরত লূত্ব্ ( আঃ)কে যার হেদায়াতের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিলো। কারণ , হযরত লূত্ব্ ( আঃ) ছিলেন হযরত ইবরাহীম্ ( আঃ)-এর ভ্রাতুষ্পুত্র এবং তাঁদের উভয়ই ইরাক্বে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর হযরত লূত্ব্ ( আঃ) ফিলিস্তিনের মৃত সাগরের উপকূলবর্তী একটি ক্বাওমের হেদায়াতের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। এ অর্থেই তাদেরকে ক্বাওমে লূত্ব্ বলা হয়েছে। সূরাহ্ ক্বাফ্-এর আয়াতে ইখওয়ানু লূত্ব্ (লূত্ব্-এর ভ্রাতৃসম্প্রদায়) উল্লেখ থাকায় এটি ক্বাওমে লূত্ব্ কথাটির ব্যাখ্যাকারী হয়েছে।

সূরাহ্ আল্-আ রাাফ্-এর 69 নং আয়াতেبصطة শব্দেরص হরফের ওপরে ছোট করেس হরফ লেখা সম্পর্কে দাবী করা হয়েছে যে , এটি ভুল বানান এবংص হরফটিকে 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য করার লক্ষ্যেইبسطة শব্দটি এ সঠিক বানানে না লিখে ভুল বানানেبصطة লেখা হয়েছে এবং শব্দটি যে আসলেبسطة তা বুঝাতে তার ওপরে ছোট করেس লেখা হয়েছে।

অথচ প্রকৃত ব্যাপার এরূপ হলে এটা বরং কাফেরদের হাতকেই শক্তিশালী করতো। কারণ , তারা বলতে পারতো : যে কিতাবে শব্দের বানান ভুল তা কী করে আল্লাহর কালাম্ হয় ? আর সত্যি সত্যিই যদি 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য হওয়ার কোনো ব্যাপার থাকতো তাহলে তারা খুব সহজেই বলতে পারতো যে , শব্দের ভুল বানান লিখেص হরফটিকে 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য করার ব্যর্থ প্রয়াস চালানো হয়েছে।

বরং প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে , সব ভাষাতেই বানানরীতি ও উচ্চারণ বিধিতে কতক শব্দের ক্ষেত্রে একাধিক উচ্চারণের ও একাধিক লেখ্য বানানের বৈধতা আছে। হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর যুগে আরবী ভাষায় কম হলেও কতক শব্দের একাধিক উচ্চারণ ও লেখ্য বানান থাকা অসম্ভব কিছু ছিলো না। নিঃসন্দেহে তখন এরূপ প্রচলন ছিলো , নইলে কাফেররা এতে আপত্তি তুলতো। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে আপত্তি তুলেছে বলে কোথাও উল্লেখ পাওয়া যায় না।

বক্তব্যের শ্রবণ ও দর্শনযোগ্য রূপের পার্থক্য

এবার কোরআন মজীদের সব কিছু 19 দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য হবার দাবীদারদের বক্তব্য অন্য এক মানদণ্ডে বিচার করা যেতে পারে। তা হচ্ছে যে কোনো ভাষার শ্রবণযোগ্য ও দর্শনযোগ্য (লিখিত) রূপের মধ্যকার পার্থক্যের মানদণ্ড।

এখানে কোরআন মজীদের নুযূল্ (অবতরণ) প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে , নুযূল্ মানে নীচে নেমে আসা এবং এর তাৎপর্য যা নীচে নেমে আসে তার প্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ত। কারণ , যা নীচে নেমে আসে তার প্রকৃতি অনুযায়ী এ নীচে নামার কাজটি স্থানগত বা গুণগত হতে পারে ; বস্তুগত কিছু হলে তা স্থানগতভাবে উঁচু স্থান থেকে নীচু স্থানে নেমে আসবে এটাই স্বাভাবিক , কিন্তু অবস্তুগত কিছু হলে তার নীচে নামা বা অবতরণ হবে গুণগত বা মানগত দিক থেকে।

আল্লাহ্ তা আলার স্বীয় সত্তার রহস্যলোকে (عالم لاهوت - আালমে লাাহূত্) নিহিত জ্ঞান পার্থিব জগতে (عالم ناسوت - আালমে নাাসূত্) এসে পৌঁছতে একাধিক পর্যায় অতিক্রম করেছে এবং প্রতিটি পরবর্তী পর্যায়েই তা পূর্ববর্তী পর্যায় থেকে গুণগত বা মানগত দিক থেকে নীচে নেমে এসেছে বা নাযিল্ হয়েছে।

আালমে লাহূতে আক্ষরিক অর্থেই সৃষ্টিলোক , তার গতিপ্রকৃতি ও ঘটনাবলীর সমস্ত জ্ঞানই হুবহু নিহিত রয়েছে যাতে সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বস্তুগত - অবস্তুগত সব কিছুর গঠন - উপাদান , গঠন - কাঠামো , সর্বাংশে গঠন - উপাদানের অনুপাত , বর্ণ , গন্ধ , স্বাদ , শব্দ , স্পর্শযোগ্যতা , গতি , অনুভূতি ও সকল মাত্রা ( Dimension)সহ বস্তুগত ও অবস্তুগত রূপ নিহিত রয়েছে - যে জ্ঞানকে ইলমে হুযূরী (علم حضوری - Exact Knowledge)বলা যেতে পারে। আল্লাহ্ তা আলা তাঁর এ জ্ঞান থেকে মানুষকে দেয়ার মতো পুরো জ্ঞানই উপরোক্ত সবগুলো বৈশিষ্ট্য সহকারে , তবে কেবল অবস্তুগত রূপে লাওহে মাহ্ফূযে নাযিল্ করে অর্থাৎ গুণগত ও মানগতভাবে অবতরণ করিয়ে কোরআন মজীদ রূপে সংরক্ষণ করেন। কেবল অবস্তুগত রূপ হলেও এবং দ্বিতীয় স্তরের হলেও এ - ইলমে হুযূরী বটে।

এরপর লাওহে মাহ্ফূযের এ কোরআন লাইলাতুল্ ক্বাদরে হুবহু হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়ে প্রবেশ করে স্থানগ্রহণ করে। অতঃপর তা জিবরাঈল ( আঃ)-এর সহায়তায় আরবী ভাষার শব্দ ও বাক্যের আশ্রয়ে হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষসমূহে স্থানলাভ করে। এভাবে ইলমে হুযূরী রূপ কোরআন মজীদ পুনরায় নাযিল্ হয়ে (গুণগত ও মানগতভাবে নীচে নেমে) ভাষাগত শ্রবণযোগ্য প্রতীকী শব্দ ও বাক্যে পরিণত হয় - যাতে তাঁর হৃদয়স্থ কোরআন মজীদের ইলমে হুযূরী রূপ অনুপস্থিত। এরপর তা হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর কণ্ঠনিঃসৃত শব্দগত কোরআন মজীদ রূপে আরেক ধাপ নীচে নেমে আসে (নাযিল্ হয়) এবং তাঁর নিয়োজিত ওয়াহী-লেখকগণ তা কালির হরফে লিপিবদ্ধ করে নেন যাতে হুযূর (ছ্বাঃ)-এর পবিত্র কণ্ঠের শ্রবণযোগ্য ধ্বনি অনুপস্থিত ; এ আরেক ধরনের নুযূল্ বা অবতরণ। এরপর কোরআন মজীদ ছ্বাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে উচ্চারিত ও লিখিত রূপে পরবর্তী প্রজন্মসমূহ হয়ে বর্তমান প্রজন্মসমূহ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে এবং ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকবে।

এটা অনস্বীকার্য যে , শ্রবণযোগ্য কোরআন লাওহে মাহ্ফূয ও হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়স্থ ইলমে হুযূরী রূপ কোরআন মজীদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতীকী রূপ মাত্র - যা মানুষের প্রতীকী ভাষার শ্রবণযোগ্য ও দর্শনযোগ্য শব্দাবলী থেকে মুক্ত। অবশ্য লাওহে মাহ্ফূযে বা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়স্থ ইলমে হুযূরী রূপ কোরআন মজীদে বিভিন্ন মানুষের যে সব উক্তি অন্তঃকর্ণে শ্রবণযোগ্য (বস্তুগত কর্ণে নয়) ধ্বনি রূপে সংরক্ষিত রয়েছে সেগুলোর স্বরূপ পাখীর গান ও ঝর্ণার কলকাকলীর সমপর্যায়ভুক্ত অর্থাৎ প্রকৃতিতে নিহিত শব্দ বা ধ্বনির অংশ মাত্র - যা উদ্ধৃতি রূপে পরিগণিত নয়। অনুরূপভাবে এতে নিহিত লিখিত বস্তুর দৃশ্যাবলী প্রাকৃতিক দৃশ্যের সমপর্যায়ভুক্ত ; প্রাকৃতিক বিষয়াদি বা ঘটনাবলীর প্রতীকী ভাষার বর্ণনা থেকে মুক্ত। অন্যদিকে কালির হরফে লিখিত কোরআন মজীদ হচ্ছে কণ্ঠনিঃসৃত শ্রবণযোগ্য কোরআন মজীদের প্রতীকী রূপ।

বলা বাহুল্য যে , উচ্চারিত ও লিখিত ভাষিক শব্দমালা হচ্ছে এক ধরনের আপেক্ষিক অস্তিত্ব (وجود اعتباری ) মাত্র এবং খোদা-প্রদত্ত প্রতিভা বলে মানুষের দ্বারা সৃষ্ট। কিন্তু যেহেতু হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) ছাড়া অন্য মানুষের হৃদয় ইলমে হুযূরী রূপ কোরআন মজীদ ধারণ করার জন্য প্রয়োজনীয় শারীরিক ও আত্মিক তথা সত্তাগত (نفسانی ) পরিপক্বতা ও পবিত্রতার অধিকারী নয় , সেহেতু তাদের কাছে স্থানান্তরের জন্য কোরআন মজীদকে উচ্চারিত ও লিখিত ভাষিক শব্দমালার আপেক্ষিক অস্তিত্বে নামিয়ে আনা (নাযিল্ করা) ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। অতএব , শ্রবণযোগ্য ও পঠনযোগ্য প্রতীকী কোরআন মজীদে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়স্থ কোরআন মজীদ ততোখানিই প্রতিফলিত হয়েছে যতোখানি মানুষের শ্রেষ্ঠতম ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভবপর ছিলো ।

নিঃসন্দেহে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়ে কোরআন মজীদের যে প্রকৃত রূপ (حقيقت قرآن ) বিদ্যমান তথা ইলমে হুযূরী রূপ কোরআন মজীদ , তা কোনো সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য হতে পারে না। কারণ , তা প্রতীকী বর্ণ , শব্দ ও বাক্য থেকে মুক্ত। অন্যদিকে এর নিম্নতর (নাযিলকৃত) দু টি রূপ অর্থাৎ শ্রবণযোগ্য ও পঠনযোগ্য প্রতীকী কোরআন মজীদের মধ্যে শ্রবণযোগ্য প্রতীকী কোরআন পর্যায়গত ও মানগত উভয় দিক থেকেই পঠনযোগ্য প্রতীকী কোরআনের তুলনায় অগ্রবর্তী ও অগ্রাধিকারী।

এটা কেবল এ কারণে নয় যে , পঠনযোগ্য লিখিত কোরআনে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর কণ্ঠে উচ্চারিত কোরআনের ধ্বনিব্যঞ্জনা ও আবেগ-আন্তরিকতার সংমিশ্রণ অনুপস্থিত এবং আমরা আমাদের প্রত্যেকের আবেগ-আন্তরিকতার স্বতন্ত্র মাত্রা নিয়ে তা পাঠ করে থাকি , বরং এই সাথে এ বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ যে , মানুষের উচ্চারিত ভাষাকে স্থানগত ও কালগত ব্যবধানে - যেখানে তার কণ্ঠস্বর পৌঁছে না , সেখানে পৌঁছানোর প্রয়োজনে প্রতীকী লিখিত ভাষার উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। আর স্বাভাবিকভাবেই লিখিত ভাষায় উচ্চারিত বাণীর অনেক আনুষঙ্গিক দিকের প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব নয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মানগত দিকের বিচারে কণ্ঠে উচ্চারিত বাণী লিখিত বাণীর তুলনায় অগ্রবর্তী ও অগ্রাধিকারী।

[অবশ্য কোরআন মজীদ শুরু থেকেই নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর কণ্ঠ থেকে ছ্বাহাবায়ে কেরামের কণ্ঠে এবং এভাবে আমাদের কাল পর্যন্ত চলে এসেছে - যাতে নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর কণ্ঠে উচ্চারিত কোরআনের আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রতিফলিত হচ্ছে।]

মানুষের প্রতিটি ভাষায়ই শ্রবণযোগ্য ভাষার লিখিত রূপে তার শ্রবণযোগ্য রূপের তুলনায় সীমাবদ্ধতা থাকে। আরবী ভাষার লিখিত রূপে এ সীমাবদ্ধতা সর্বনিম্ন মাত্রায় হলেও তা এ থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়। আরবী ভাষার লিখিত রূপের ক্রমোন্নতি তথা পরবর্তী কালে নোকতাহ্ , স্বরচিহ্ন , ই রাাব্ চিহ্ন ও যতিচিহ্ন সংযোজন এ কারণেই করতে হয়েছিলো। কিন্তু শ্রবণযোগ্য কোরআনে কোরআন-পাঠকের কণ্ঠস্বর ও আবেগানুভূতির পার্থক্য ঘটলেও নোকতাহ্ , স্বরচিহ্ন , ই রাাব্ চিহ্ন ও যতিচিহ্ন সংক্রান্ত কোনো ঘাটতি কখনোই ছিলো না। এছাড়া অন্য সমস্ত ভাষার ন্যায় আরবী ভাষায়ও শ্রবণযোগ্য শব্দের লিখিত রূপে কতক ক্ষেত্রে একাধিক রূপ থাকতে পারে বা বর্ণগত পরিবর্তনের বৈধতা থাকতে পারে। এ ধরনের পরিবর্তনের ফলে কন্ঠ থেকে কণ্ঠে স্থানান্তরিত শ্রবণযোগ্য বাণীতে কোনোরূপ পরিবর্তন ঘটে না।

মোদ্দা কথা , মানুষের মাঝে প্রচলিত কথার ক্ষেত্রে যেমন , তেমনি কোরআন মজীদের ক্ষেত্রেও শ্রবণযোগ্য বাণী ও তার শব্দাবলীই হচ্ছে প্রকৃত বাণী ও শব্দাবলী - লিখিত রূপ তার সীমিত প্রতিনিধিত্ব করছে মাত্র। আর যেহেতু লিখিত রূপে কালের প্রবাহে কিছু পরিবর্তন ঘটতে পারে , এমনকি অন্য বর্ণমালায়ও তা লেখা যেতে পারে এবং তা-ও সমভাবেই শ্রবণযোগ্য বাণীর প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হতে পারে , সেহেতু কোনো বাণীর বর্ণ (হরফ) ও শব্দ ( word) নির্ধারণে তার শ্রবণযোগ্য রূপকেই বিবেচনা করতে হবে। অতএব , প্রচলিত রেওয়াজের কারণে কোনো শব্দের লিখিত রূপে কোনো বর্ণ বাড়ানো বা কমানো হয়ে থাকলে অথবা রূপ পরিবর্তিত হয়ে থাকলে সে কারণে ধারাবাহিকভাবে চলে আসা অপরিবর্তিত শ্রবণযোগ্য বাণীর শব্দের বর্ণ বা বর্ণসমষ্টিতে কোনোরূপ পরিবর্তন ঘটার কোনো সুযোগ নেই।