কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্ 5%

কোরআনের মু‘জিযাহ্ লেখক:
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের মু‘জিযাহ্
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 60 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 48458 / ডাউনলোড: 4697
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

আরবী ভাষার লিখন পদ্ধতির বিবর্তন

মানবজাতির সকল ভাষারই লিখিত রূপ ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে গেছে এবং জীবিত ভাষাগুলোর লিখিত রূপে এখনো পূর্ণতার পথে অভিযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। অনুরূপভাবে কোরআন মজীদ যখন নাযিল্ হয় তখনো আরবী ভাষার লিখনপদ্ধতি পূর্ণতা লাভ করে নি। তখনো তা পূর্ণতা অভিমুখী বিবর্তনের পথে ছিলো। ফলে আরবী লিপিতে এ ধরনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে , কিছু কিছু ক্ষেত্রে লিখনে শ্রবণের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে না। তবে আরবদের ভাষার এক অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে , আরব উপদ্বীপের অশিক্ষিত যাযাবর বেদুঈনদের ভাষাই ছিলো প্রকৃত আরবী ভাষা ও এ ভাষার মানদণ্ড ( Standard language)।অন্যদিকে বিজাতীয়দের সাথে মেলামেশার কারণে শহুরে লোকদের ভাষায় অনেক দুর্বলতা প্রবেশ করেছিলো। বস্তুতঃ যাযাবর আরবরা বই - পুস্তক পড়ে ন , বরং পুরুষানুক্রমে শ্রুতির মাধ্যমে শুদ্ধ আরবী ভাষা শিক্ষা করতো ও সে ভাষায় কথোপকথন করতো। পরে আরবদের এ ভাষাকে লিখিত রূপ দানের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং তার লিখিত রূপ ধাপে ধাপে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যায়।

আরবী ভাষার লিখিত রূপে প্রথম দিকে অপূর্ণতা থাকা সত্ত্বেও লেখাপড়া-জানা আরবরা কোনো লিখিত জিনিস পড়তে গিয়ে তা থেকে ভুল তাৎপর্য গ্রহণ করতো না। কারণ , অভ্যাসগত কারণে তারা তা সঠিক উচ্চারণেই পড়তো। ব্যাকরণিক নিয়মগুলোর ব্যাপারে তাদের জ্ঞান ছিলো অভ্যাসগত। প্রকৃত ব্যাপার হলো এই যে , যাযাবর বেদুঈনদের ভাষা ও কোরআন মজীদের ভাষা বিশ্লেষণ করেই পরবর্তীকালে আরবী ব্যাকরণের নিয়মাবলী উদ্ঘাটন করা হয়।

এখানে আরবী লিপির পূর্ণতাভিমুখী অভিযাত্রার কয়েকটি ধাপ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে।

প্রথমে আরবী ভাষার লিপিতে নোকতাহ্ ব্যবহার করা হতো না। ফলে , উদাহরণস্বরূপ , সীন্ (س ) ও শীন্ (ش ) উভয় হরফই (س ) রূপে লেখা হতো। কিন্তু আরবরা অভ্যাসগত কারণেই বুঝতে পারতো কোথায় সীন্ (س ) উচ্চারিত হবে এবং কোথায় শীন্ (ش ) উচ্চারিত হবে। পরবর্তীকালে অনারবদের উচ্চারণের সুবিধার্থে এ ধরনের হরফগুলোতে নোকতাহ্ যোগ করা হয়। ফলে উচ্চারণ অনুযায়ী কতক শব্দে সীন্ (س )কে লেখা হতে থাকলো শীন্ (ش )। কিন্তু মূলতঃ আরবী ভাষায় এ দু টি অভিন্ন হরফ। তাই প্রথমটির নাম দেয়া হলোساء معربة (আরবীকৃত সীন্) এবং দ্বিতীয়টির নাম দেয়া হলোساء معجمة (অনারবীকৃত সীন্)।

[অন্যান্য ভাষায়ও একই বর্ণের শব্দমধ্যে অবস্থানভেদে বা অন্য কারণে একাধিক উচ্চারণ , এমনকি দুই বর্ণের মধ্যে উচ্চারণ বদলের দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন : বাংলা ভাষায় সকাল লেখা হয় , কিন্তু উচ্চারণ করা হয় শকাল , তেমনি বসবাস লিখে বশোবাশ্ উচ্চারণ করা হয়। অন্যদিকে শ্রাবণ লিখে উচ্চারণ করা হয় স্রাবণ বিশ্রী লিখে পড়া হয় বিস্রি । ]

এছাড়া আরবী ভাষায় আলিফ হামযাহ্ দু টি স্বতন্ত্র বর্ণ এবং দু টিতে আসমান-যমীন পার্থক্য। হামযাহ্ বর্ণটি প্রথাগতভাবে আরবী ভাষায় হামযাহ্ (ء ) ও আলিফ্ (ا ) এই দুইভাবে লেখা হয় এবং আলিফরূপে ব্যবহৃত হামযাহকে সাধারণতঃ আলিফ্ বলা হয়। কিন্তু এ রকম লেখা হলেও কার্যতঃ আলিফ্ ও হামযাহ্ স্বতন্ত্র বর্ণ। (অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে হামযাহ্ বুঝানোর জন্য আলিফ্-এর ওপরে বা নীচে ছোট করে হামযাহ্ লেখা হয় (أ/إ ) ।) এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝার জন্যে মনে রাখতে হবে যে , আলিফ হচ্ছে স্বরচিহ্ন। আর যেহেতু তা চিহ্নমাত্র , বর্ণ নয় , সেহেতু শব্দমধ্যে ব্যতীত তার কোনো নিজস্ব ধ্বনি নেই এবং তা কোনো হারাকাত্ (যবর , যের ও পেশ) গ্রহণ করে না , বা তা সাকিন্ও হয় না , তাশদীদযুক্তও হয় না এবং শব্দের শুরুতে বসে না ; আলিফ্ কেবল যবরযুক্ত বর্ণের পরে বসে যবরের তথা আ-কারের উচ্চারণকে দীর্ঘ করে। অতএব ,اَ/ اِ/ اُ আলিফ নয় , হাম্যাহ্ (ء ) ।

এছাড়া আলিফ দুইভাবে লেখা হয় : আলিফ্ (ا ) আকারে ও ইয়া (ی ) আকারে। শেষোক্ত আলিফকে আলিফে মাকসূরাহ্ (الف مکسورة - ভাঙ্গা আলিফ্) বলা হয়। উদাহরণ স্বরূপموسا (মূসা)কেموسی রূপে লেখা হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , যারা কম্পিউটারের সাহায্যে কোরআন মজীদের হরফ সমূহ গণনা করে ১৯ দিয়ে ভাগ করতে চান তাঁরা আলিফ-রূপী হামযাহকে আলিফ থেকে এবং ইয়া-রূপী আলিফকে ইয়া থেকে কীভাবে আলাদা করবেন ?

এছাড়া আরবী ভাষায় কোনো শব্দের মাঝে বা শেষে কোনো বর্ণ পর পর দুই বার থাকলে এবং প্রথমটি সাকিন্ হলে তা এক বার লেখা হয় এবং বর্ণটির দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়। লেখায় একটি থাকলেও প্রকৃত পক্ষে সেখানে বর্ণ হচ্ছে দু টি। যদিও পরবর্তীকালে আরবী লিপিতে ই রাব্-চিহ্ন যোগ করার সময় একটি দ্বিত্বচিহ্ন (তাশদীদ)ও যোগ করা হয় , কিন্তু মূল আরবীতে হরফ একটিই। প্রশ্ন হচ্ছে , কম্পিউটারের সাহায্যে গণনার ক্ষেত্রে সেটিকে দু টি গণনা করা হবে , নাকি একটি ধরা হবে ? এটা একটা বিচার্য বিষয় বটে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে , বিশেষভাবে কোরআন মজীদের লিপিতে কতক আলিফ বাদ দেয়া হয়েছে। শ্রুতির ভিত্তিতে পুরুষানুক্রমে চলে আসা পঠনে তা উচ্চারিত হচ্ছে , কোরআন ভিন্ন অন্যান্য লেখায়ও তা লেখা হচ্ছে , কিন্তু কোরআন মজীদের ঐতিহ্যিক লিপিতে তা নেই , যদিও তা না থাকার কারণে কোরআন পাঠের ক্ষেত্রে উচ্চারণে ভুলের কোনো কারণ নেই। কারণ , কোরআন পাঠ শিক্ষকের কাছ থেকে শেখা হয় অথবা তার প্রস্তুতিপর্বের অধ্যয়ন থেকে জেনে নেয়া হয় যে , ঐ সব ক্ষেত্রে আলেফ উহ্য রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপرحمان শব্দটি কোরআন মজীদের লিপিতেرحمن রূপে লেখা হয় , কিন্তু লেখায় আলিফ বাদ গেলেও কোরআন তেলাওয়াতে আলিফ উচ্চারিত হয় অর্থাৎم হরফটি দীর্ঘায়িত করে উচ্চারণ করা হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে , কম্পিউটার কি এ সব ক্ষেত্রে আলিফকে গণনা করবে , নাকি করবে না ?

[অবশ্য বিশেষ করে অনারবদের জন্যে কোরআন মজীদের অনেক লিপিতেই এ ধরনের ক্ষেত্রে বিলোপকৃত আলিফের পূর্ববর্তী বর্ণের ওপরে (যেমন :رحمان শব্দের বেলায়م বর্ণের ওপরে) ছোট করে আলেফ লেখা হয় ; বাংলাভাষীদের নিকট এটি খাড়া যবর নামে পরিচিত। কিন্তু আসলে তা আলেফ।]

এছাড়া আরবী ভাষায় তানভীনের ব্যবহার কম্পিউটার-গণনার জন্য আরেকটি সমস্যা। আরবী ভাষায় বিশেষ্য ও বিশেষণের শেষে যে তানভীন্ যুক্ত হয় তা মূলতঃ একটি সাকিন্ নূন্ (ن ) এবং বাক্যের শেষে ব্যতীত সব ক্ষেত্রেই উচ্চারিত হয়। যেমন :کتابٌ (কিতাাবুন্)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে , তানভীনগুলোকে কি নূন্ (ن )-এর সাথে গণনা করা হবে , নাকি হবে না ? বিশেষ করে যেহেতু বাক্যশেষের তানভীন্ উচ্চারিত হয় না , এমতাবস্থায় তা কি গণনা করা হবে , নাকি হবে না ?

এছাড়া কোরআন মজীদের লেখ্য রূপে বিভিন্ন হরফ দ্বারা যতিচিহ্ন ও উচ্চারণ-নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে , কম্পিউটার কি সেগুলোকে গণনা করবে , নাকি করবে না ? গণনা করলে তা কি সংশ্লিষ্ট হরফ সমূহের প্রকৃত সংখ্যায় পরিবর্তন ঘটাবে না ?

কোরআন মজীদের লিপিতে বর্ণবিলুপ্তি (حذف ) ও শব্দমিলন (ادغام ) আরো দু টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন :الله শব্দের আগেلِ শব্দ (স্মর্তব্য ,ل একটি প্রতীকী হরফ হলেও - যার কোনো নিজস্ব অর্থ নেই - এখানে এটি একটি শব্দও (অব্যয়) বটে যার মানে -এর/-এর জন্য ) যোগ হলে তাلله রূপে লেখা হয় ,لالله রূপে নয়। এখানেالله শব্দেরال বিলুপ্ত হয়েছে। এ ধরনের বিলুপ্তি আরো বহু ক্ষেত্রে রয়েছে। তেমনি কোরআন মজীদের বিসমিল্লাহির্ রাহমানির রাহীম্ আয়াতে সবখানেইبسم الله লিখতেاسم শব্দের আলিফ (ا = প্রকৃত পক্ষে হামযাহ্) বিলুপ্ত করা হয়েছে। এ ধরনের বিলোপকে বহু ব্যবহার (کثرة الاستعمال ) জনিত বিলোপ বলা হয়। কিন্তু এ বিলোপ সত্ত্বেও সর্বাবস্থায়ইاللهاسم আলিফ/ হামযাহ্ (ا ) দ্বারা সূচিত শব্দ। সূরাহ্ আল্- আলাক্ব-এর প্রথম আয়াতেباسم লিখতে আলিফ (ا ) বিলুপ্ত করা হয় নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে , কম্পিউটার এ বিলুপ্ত হরফগুলো কীভাবে গণনা করবে ?

এছাড়া কোরআন মজীদে যেভাবেلِ শব্দالله শব্দের সাথে যুক্ত হয়েلله হয়েছে এবংب শব্দاسم শব্দের সাথে যুক্ত হয়েبسم হয়েছে সেভাবে আরো অনেক শব্দই অন্য শব্দের সাথে যুক্ত হয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কম্পিউটার এ ধরনের যুক্ত শব্দগুলোকে কীভাবে গণনা করবে - এক শব্দ হিসেবে , নাকি দুই শব্দ হিসেবে ?

সব কিছু ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়

এবার ১৯ সংখ্যার তথাকথিত মু জিযাহর প্রবক্তাদের দাবীকে প্রায়োগিক দিক থেকে ও বাস্তব বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যাক।

দাবী করা হয়েছে যে ,بسم الله الرحمن الرحيم আয়াতে ১৯টি বর্ণ রয়েছে। অথচ প্রকৃত পক্ষে এতে বর্ণসংখ্যা তাদের দাবীর তুলনায় বেশী। কারণ , মূলতঃ বাক্যটি হচ্ছে :باسم الله الرحمان الرحيم এবং এতে বর্ণসংখ্যা ২১টি। আরالله শব্দটি মূলতঃالاِلاه (আল্-ইলাাহ্) ; সে হিসেবে বর্ণসংখ্যা ২৩টি ।

১৯ সংখ্যার তথাকথিত মু জিযাহর প্রবক্তাদের পক্ষ হতে দাবী করা হয়েছে যে , কোরআন মজীদের সর্বপ্রথম নাযিলকৃত আয়াত সমূহ অর্থাৎ সূরাহ্ আল্- আলাক্ব-এর প্রথম পাঁচ আয়াতের শব্দ ও বর্ণ সমূহ ১৯ সংখ্যা দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা নয়। বরং এ পাঁচটি আয়াতে শব্দসংখ্যা ২৫ ও বর্ণসংখ্যা তাশদীদযুক্ত হরফকে এক হরফ ধরলে ৭৮ এবং দুই হরফ ধরলে ৮৪ - যা ১৯ সংখ্যা দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য নয়।

আয়াতগুলো হচ্ছে :

) اقرأ باسم ربک الذی خلق. خلق الانسان من علق. اقرأ و ربک الاکرم. الذی علم بالقلم. علم الانسان ما لم يعلم( .

এবার এ আয়াতসমূহের শব্দগুলো গুণে দেখা যাক :

(১)اقرأ (۲) ب (٣) اسم (٤) رب (۵) ک (٦) الذی (٧) خلق (٨) خلق (۹) الانسان (۱۰) من (۱۱) علق (۱۲) اقرأ (۱٣) و (۱٤) رب (۱۵) ک (۱٦) الاکرم (۱٧) الذی (۱٨) علم (۱۹) ب (۲۰) القلم (۲۱) علم (۲۲) الانسان (۲٣) ما (۲٤) لم (۲۵) يعلم

এখানে ২৫টি শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এই সাথে ২ বারانسان শব্দে , ১ বারاکرم শব্দে ও ১ বারقلم শব্দে যুক্ত আলিফ-লাম্ (ال ) কে আলাদা শব্দ হিসেবে গণ্য করলে মোট শব্দসংখ্যা দাঁড়ায় ২৯টিতে , আরال -কে শব্দ হিসেবে গণ্য না করলে শব্দসংখ্যা দাঁড়ায় ২৫টিতে।

১৯ সংখ্যার তথাকথিত মু জিযাহর প্রবক্তারা সম্ভবতঃ তাঁদের গণনা থেকে দু টিب , দু টিک ও একটিلم বাদ দিয়ে থাকবেন। কিন্তু আরবী ভাষায় এর সবগুলোই শব্দ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। কারণک হচ্ছেماالذی -এর ন্যায় সর্বনাম এবংب হচ্ছেمِن -এর ন্যায় অব্যয়। এমতাবস্থায় একটিকে গণনা করা ও একটিকে গণনা না করা সম্ভব নয়। তবে এগুলো গণনা না করলেও শব্দসংখ্যা দাঁড়ায় ২০টি। তাঁরা আর কোন্ শব্দ বাদ দিয়েছেন বোঝা মুশকিল।

গোঁজামিলের আশ্রয়গ্রহণ

কোরআন মজীদের সূরাহ্-সংখ্যা ১১৪টি যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য। [তবে আমরা যেন ভুলে না যাই যে , এ সংখ্যাটি একই সাথে ২ , ৩ ও ৬ দ্বারাও নিঃশেষে বিভাজ্য।] ১১৪টি সূরাহর মধ্যে সূরাহ্ আত্-তাওবাহ্ বাদে বাকী ১১৩টি সূরাহর শুরুতেبسم الله الرحمن الرحيم রয়েছে এবং সূরাহ্ আন্-নামল্-এর মাঝখানে আরো একবার এ আয়াতটি রয়েছে। ফলে এর সংখ্যা দাঁড়ালো ১১৪তে যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য। এখানে ১৯ সংখ্যার তথাকথিত মু জিযাহর প্রবক্তারা সবগুলো বিসমিল্লাহ্ কে হিসাব করেছেন। কিন্তু এ আয়াতে ব্যবহৃতاسم, الله, الرحمنالرحيم - এই চারটি শব্দ সমগ্র কোরআন মজীদে যতোবার ব্যবহৃত হয়েছে তাকে ১৯ দিয়ে ভাগ করতে গিয়ে তাঁরা সূরাহ্ আল্-ফাাতেহাহ্ ব্যতীত বাকী সূরাহ্গুলোর (১১২টি সূরাহর) শুরুতে ব্যবহৃতبسم الله الرحمن الرحيم কে হিসাব থেকে বাদ দিয়েছেন। কারণ , অন্যথায় তা ১৯ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য হয় না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাঁরা একই আয়াত একবার হিসাব করেন এবং একবার হিসাব থেকে বাদ দেন কোন্ যুক্তিতে ?

১৯ সংখ্যার তথাকথিত মু জিযাহর প্রবক্তাদের বক্তব্যে এ ধরনের গোঁজামিল আরো অনেক রয়েছে। যেমন : কোরআন মজীদে ১৪টি হরফ দিয়ে ১৪ ধরনের হুরূফে মুক্বাত্বত্বা আত্ তৈরী করা হয়েছে এবং তা ২৯টি সূরাহর শুরুতে ব্যবহৃত হয়েছে। বলা হয়েছে যে , এ তিনটি সংখ্যা যোগ করলে হয় ৫৭ - যা ১৯ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য। প্রশ্ন হচ্ছে , তিনটি বিষয়ের সংখ্যা একত্রিত করে কেন ভাগ করতে হবে ? প্রতিটি বিষয় স্বতন্ত্রভাবে কেন ১৯ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য নয় ?

১৯ সংখ্যার তথাকথিত মু জিযাহর প্রবক্তারা স্বীকার করেছেন যে ,الله, الرحمنالرحيم - এই তিনটি নাম বাদে কোরআন মজীদে আল্লাহ্ তা আলার আর যে সব গুণবাচক নাম উল্লিখিত হয়েছে তার কোনোটিই ১৯ সংখ্যা দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য নয়। প্রশ্ন করা যেতে পারে : কেন ? ১৯ সংখ্যার মু জিযাহর দাবী সত্য হলে অবশ্যই আল্লাহ্ তা আলার প্রতিটি গুণবাচক পবিত্র নামই স্বতন্ত্রভাবে ১৯ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য হওয়া উচিত ছিলো। আর প্রকৃত পক্ষে উক্ত তিনটি পবিত্র নামও ১৯ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য নয় - তা আমরা পূর্বেই প্রমাণ করেছি।

সংখ্যা কলুষিত!

১৯ সংখ্যার তথাকথিত মু জিযাহর প্রবক্তাদের পক্ষ থেকে ১৯ সংখ্যাটি গ্রহণের পক্ষে একটা উদ্ভট যুক্তি পেশ করা হয়েছে। তা হলো , অন্যান্য মৌলিক সংখ্যা বিভিন্ন ধরনের ভুল অর্থ আরোপের দ্বারা কলুষিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ তারা উল্লেখ করেছে যে , ১৩ সংখ্যাকে দুর্ভাগ্যজনক মনে করা হয় , কিন্ত ১৯ সংখ্যাটি নিষ্কলুষ রয়ে গেছে। [স্মর্তব্য , এটা পুরোপুরি বাহাইদের যুক্তি। কারণ , তারা ১৯ সংখ্যকে পবিত্র গণ্য করে থাকে।]

প্রশ্ন হচ্ছে , কোনো সংখ্যাকে কি কলুষিত করা যায় ? কোনো সংখ্যার কলুষিত হওয়ার বিষয়টি কি বিচারবুদ্ধি গ্রহণ করে ? পাশ্চাত্য জগতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তাধারার কারণে লোকেরা ১৩ সংখ্যাকে দুর্ভাগ্যজনক মনে করে এবং অনেক ক্ষেত্রে নাকি ১৩তম ক্রমিক খালি রাখা হয় অর্থাৎ ক্রমিক নং ১২-র পরেই ১৪ আসে বা ১২-র পরে ১২-এ এবং তার পরে ১৪ ব্যবহার করা হয়। প্রকৃত পক্ষে এর কোনো মূল্য আছে কি ? বিশেষ করে কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে এ ধরনের কুসংস্কারের কোনো মূল্য আছে কি ? যদি তা-ই থাকতো তাহলে কোরআন মজীদে ১৩তম ক্রমিকে কোনো সূরাহ্ থাকতো না।

আমরা যদি যুক্তির খাতিরে স্বীকার করে নেই যে , সংখ্যা কলুষিত হতে পারে বা সংখ্যাকে কলুষিত করা যেতে পারে , তাহলে বলবো যে , ১৯ সংখ্যাও কলুষিত হয়েছে। কারণ , সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সৃষ্ট বাহাই ধর্মে ১৯ সংখ্যাটি পবিত্র ; তাদের সপ্তাহ্ ৭ দিনে নয় , ১৯ দিনে এবং এ ধরনের ১৯ সপ্তাহে মাস ও ১৯ মাসে বছর। এমতাবস্থায় ১৯ সংখ্যার কলুষিত হয়ে পড়ার ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ থাকে কি ?

এ থেকে প্রায় নিশ্চয়তার সাথে বলা যেতে পারে যে , ১৯ সংখ্যা দ্বারা কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ প্রমাণ করা সম্ভব বলে যে তত্ত্ব প্রচার করা হয়েছে তার উদ্ভবের পিছনে অবশ্যই বাহাইদের ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র কার্যকর রয়েছে।

১৯ সংখ্যার মু জিযাহ্ স্বীকারের বিপদ

অনেকে মনে করেন যে , ১৯ সংখ্যার দ্বারা কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ প্রমাণের তত্ত্বটি ঠিক না হলেও এটিকে যেহেতু কোরআন মজীদের সপক্ষে ব্যবহার করা হচ্ছে সেহেতু এর দ্বারা অনেকের মনে , বিশেষ করে আধুনিক শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের মনে কোরআনের ওপর বিশ্বাস মযবূত হবে। অতএব এটি ভুল হলেও এটিকে খণ্ডন করা ঠিক নয়।

এ এক ধরনের বিপজ্জনক প্রবণতা। প্রথমতঃ অন্ধ বিশ্বাস ভিত্তিক ধর্মসমূহের ন্যায় ইসলাম কোনো অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন পন্থায় নিজেকে গ্রহণ করানোর পক্ষপাতী নয় , বরং এর বিরোধী। দ্বিতীয়তঃ এ ধরনের অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন পন্থা সাময়িকভাবে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি ও তার প্রচারের জন্য সহায়ক হিসেবে দেখা গেলেও চূড়ান্ত পরিণতিতে তা ইসলামের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হিসেবে প্রমাণিত হতে বাধ্য।

১৯ সংখ্যার মু জিযাহর তত্ত্ব যদি গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায় তাহলে লোকেরা কোরআন মজীদের সব কিছুকেই ১৯ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বসবে। অতঃপর তারা যখন দেখবে যে , কোরআন মজীদের অনেক কিছুই ১৯ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য নয় ( আর আমরা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছি যে , কোরআন মজীদের অনেক কিছুই ১৯ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য নয় ) , তখন পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব্ সমূহের ন্যায় কোরআন মজীদও বিকৃত হয়েছে বলে তাদের মনে ধারণা সৃষ্টি হবে। এর ফলে তাদের ঈমান ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই এ ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা তত্ত্বের প্রচার বন্ধ করা এবং যেহেতু ইতিমধ্যেই তা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে সেহেতু তার ভিত্তিহীনতার বিষয়টি তুলে ধরা অপরিহার্য।

অকাট্য তথ্য উপস্থাপনে কোরআন মজীদ

কোরআন মজীদ বহু বিষয়ে আলোকপাত করেছে এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছে। কোরআন মজীদ আল্লাহর পরিচয় সহ বিচারবুদ্ধির আওতাভুক্ত বিভিন্ন বিষয়ে (علوم عقلی - Intellectual or Rational Sciences)বক্তব্য উপস্থাপন করেছে , সৃষ্টির সূচনা ও বিকাশ , পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ - নক্ষত্র এবং মৃত্যুর পরে পুনর্জীবন সম্পর্কে কথা বলেছে , অতিপ্রাকৃতিক বিষয়াদি , মানুষের ব্যক্তিসত্তা বা আত্মা , ফেরেশতা , জ্বিন্ , শয়তান ইত্যাদি সম্পর্কে কথা বলেছে। এছাড়া কোরআন মজীদ অতীতের ইতিহাস বর্ণনা করেছে ; বিভিন্ন নবী - রাসূল ( আঃ ) ও তাঁদের অনুসারীদের অবস্থা তুলে ধরেছে।

কোরআন মজীদ অনেক ক্ষেত্রে উপমা উপস্থাপন করেছে , কখনো বা বিচারবুদ্ধির দলীল-প্রমাণ তথা অকাট্য যুক্তি পেশ করেছে , কখনোবা নৈতিক-চারিত্রিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেছে , কখনোবা ব্যক্তি ও পরিবারের অধিকার নির্ধারণ করে দিয়েছে , কখনোবা অন্য মানুষের পরিচালনা ও সমাজব্যবস্থা এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত আইন-বিধান সম্পর্কে কথা বলেছে। কখনোবা ইবাদত-উপাসনা , বেচাকেনা , লেনদেন , সামাজিক সম্পর্ক ও বিয়েশাদীর ক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিকল্পনা পেশ করেছে। তেমনি উত্তরাধিকার বণ্টন , বিচার , শাস্তি এবং এ সবের বাইরে আরো বহু বিষয়ে আইন-কানূন্ ও বিধি-বিধান প্রণয়ন করেছে।

আর এ সমস্ত বিষয়েই কোরআন মজীদ সর্বোত্তম ও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য সত্যসমূহ তুলে ধরেছে। কোরআন মজীদ এমন সব সত্য তুলে ধরেছে যা ভুল বা মিথ্যা প্রমাণিত হবার সুযোগ নেই এবং যাতে কোনোদিনই সামান্যতম ত্রুটি পরিদৃষ্ট হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। আর এ হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা মানবীয় জ্ঞানের ক্ষেত্রে স্বভাবতঃই একেবারেই অসম্ভব।

কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় যে , ছোট-বড় প্রতিটি বিষয়ে আইন-কানূন্ প্রণয়ন করবে অথচ সে সব আইন-কানূন্ সব সময়ের জন্য - মানব প্রজাতির অস্তিত্বের শেষ দিন পর্যন্ত ত্রুটিমুক্ত বলে প্রমাণিত হবে। বিশেষ করে আইন প্রণয়নকারী ব্যক্তি যদি কোনো সভ্যতাবিবর্জিত ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্করহিত কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে আবির্ভূত হন - যে জনগোষ্ঠী এ জাতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নিগূঢ় সত্যের সাথে আদৌ পরিচিত নয় , সে ক্ষেত্রে তাঁর প্রণীত আইন-বিধান অকাট্য ও নির্ভুল হওয়ার কথা চিন্তাও করা যায় না।

বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমরা দেখতে পাই যে , কোনো ব্যক্তি যদি মানবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোনো শাখার ওপরে একটি গ্রন্থ রচনা করেন , সে ক্ষেত্রে উক্ত গ্রন্থ রচনার পর বেশীদিন না যেতেই তাঁর গ্রন্থে প্রকাশিত মতামতের বেশীর ভাগই ভুল-ভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়। কারণ , মানবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যই এই যে , এ সম্পর্কে যতো বেশী চিন্তা-গবেষণা ও আলোচনা-পর্যালোচনা করা হবে ততোই অনেক বেশী পরিমাণে সত্য - যা পূর্বে জানা ছিলো না - প্রকাশিত হয়ে পড়বে এবং এর ফলে অতীতের জ্ঞানী-গুণীদের প্রকাশিত মতামতের ভুল-ত্রুটি সমূহ সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। তাই যথার্থই বলা হয়েছে : সত্য হচ্ছে চিন্তা-গবেষণা ও আলোচনা-পর্যালোচনার ফসল।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের অসংখ্য অজ্ঞাত বিষয় ও অস্পষ্ট বিষয়ের সমাধানের ভার অতীতের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ পরবর্তী বংশধরদের জন্য রেখে গেছেন। তেমনি অতীতের দার্শনিকগণ দর্শনের ওপর বহু গ্রন্থ রচনা করে রেখে গেছেন , পরবর্তীকালের জ্ঞানী-গুণী-দার্শনিকগণ যার সমালোচনা করেছেন ও ভুলত্রুটি নির্দেশ করেছেন। এমনকি অতীতের জ্ঞানী-গুণী , বিজ্ঞানী ও দার্শনিকগণ তাঁদের আলোচনার যে সব অংশ দলীল-প্রমাণের দ্বারা প্রমাণ করেছেন বলে মনে করেছিলেন ও অভ্রান্ত বলে ধারণা করেছিলেন , সে সবেরও অনেক কিছু পরবর্তীকালীন আলোচনা-পর্যালোচনা ও চিন্তা-গবেষণায় ভিত্তিহীন ধারণা-কল্পনা বলে প্রমাণিত হয়েছে।

কিন্তু কোরআন মজীদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অসংখ্য দিক-বিভাগের ওপর আলোচনা করা সত্ত্বেও এবং এর আলোচনার অনেক বিষয় খুবই উঁচু স্তরের হওয়া সত্ত্বেও এ মহাগ্রন্থ নাযিল্ হবার পর সুদীর্ঘ কাল অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এতে সামান্যতম ভুলত্রুটিও প্রমাণিত হয় নি বা তা সমালোচনাযোগ্য বলে প্রতিপন্ন হয় নি। বস্তুতঃ এ পর্যন্ত কোরআন কর্তৃক উপস্থাপিত আইন-কানূন্ , বিধি-বিধান ও সত্যসমূহে সামান্যতম ভুলত্রুটি ও ব্যতিক্রম পরিদৃষ্ট হয় নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না তা নিশ্চয়তার সাথে বলা চলে।

অবশ্য সঙ্কীর্ণ দৃষ্টির অধিকারী লোকেরা কেবল অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন কল্পনার ভিত্তিতে কোরআন মজীদের কোনো কোনো বিষয় সম্পর্কে আপত্তি তুলেছে। আমরা তাদের এ সব আপত্তি নিয়ে পরে আলোচনা করবো ও তাদের মতামতের ভিত্তিহীনতা প্রমাণ করবো।

কোরআন মজীদের ভবিষ্যদ্বাণী

কোরআন মজীদের কিছু সংখ্যক আয়াতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে এবং সেগুলো বাস্তবে প্রতিফলিত হয়েছে। কোরআন মজীদ যে সব ঘটনা সংঘটিত হবার ভবিষ্যদ্বাণী করেছে সে সবের মধ্য থেকে একটিরও অন্যথা হয় নি। বলা বাহুল্য যে , যেহেতু এগুলো খোদায়ী ওয়াহীর ভবিষ্যদ্বাণী সেহেতু তার অন্যথা হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

এখন আমরা এ জাতীয় ভবিষ্যদ্বাণী থেকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ কয়েকটি সম্পর্কে উল্লেখ করবো।

বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের আগাম বার্তা

কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) و اذ يعدکم الله احدی الطائفتين انها لکم و تودون ان غير ذات الشوکة تکون لکم و يريد الله ان يحق الحق بکلماته و يقطع دابر الکافرين( .

আর স্মরণ কর সেদিনের কথা যখন আল্লাহ্ প্রতিশ্রুতি দিলেন যে , তোমরা দু টি দলের মধ্যে যে কোনো একটির সাথে মুখোমুখি হবে , আর তোমরা কামনা করছিলে যে , দুর্বল দলটির সাথে মোকাবিলা করবে। কিন্তু আল্লাহ্ চান যে , (তোমরা শক্তিশালী দলটির সাথে মোকাবিলা করবে এবং তার মাধ্যমে তিনি) সত্যকে সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করবেন ও কাফেরদের শক্তিকে খর্ব করে দেবন। (সূরাহ্ আল্-আনফাাল্ : 7)

উক্ত আয়াতটি বদর যুদ্ধের আগে নাযিল্ হয়েছিলো। আল্লাহ্ তা আলা উক্ত আয়াতে এ যুদ্ধে মু মিনদের বিজয় ও কাফেরদের বিপর্যয়ের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন এবং অচিরেই তা বাস্তব রূপ লাভ করে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে , কাফেরদের দু টি কাফেলার মধ্যে একটি ছিলো বাণিজ্যিক কাফেলা , অপরটি ছিলো সামরিক কাফেলা। কাফের ও মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিলো বিধায় প্রতিপক্ষের বাণিজ্যিক কাফেলাও সামরিক গুরুত্বের অধিকারী ছিলো। তাছাড়া তৎকালে আরবরা সর্বাবস্থায় অস্ত্র বহন করতো এবং বাণিজ্যিক কাফেলায়ও দস্যুহামলা মোকাবিলা করার জন্য কিছু সংখ্যক শক্তিশালী যোদ্ধা রাখা হতো। তা সত্ত্বেও মুসলমানরা কাফেরদের বাণিজ্যিক কাফেলার ওপর হামলা চালালে তার বিরুদ্ধে বিজয় হতো সহজতর। কিন্তু তা গৌরবজনক হতো না। কাফেলা দু টি মদীনার কাছে এসে পৌঁছার আগেই আল্লাহ্ তা আলা তাঁর রাসূলের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে এর খবর জানিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা কাফেরদের সামরিক কাফেলার সাথে যুদ্ধ করে এবং তাতে গৌরবময় বিজয়ের অধিকারী হয়।

ঐ সময় মুসলমানরা সংখ্যাশক্তি ও সামরিক উপকরণাদির দিক থেকে কাফেরদের তুলনায় খুবই দুর্বল ছিলেন। এ যুদ্ধে মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা ছিলো মাত্র 313 জন , অন্যদিকে কাফেরদের সৈন্যসংখ্যা ছিলো এক হাজার। মুসলমানদের মধ্যে হযরত মিক্ব্দাদ্ ও হযরত যুবাইর্ বিন্ আওয়াম - মাত্র এই দু জন অশ্বারোহী সৈন্য ছিলেন , বাকী সবাই ছিলেন পদাতিক। অন্যদিকে কাফেররা সংখ্যাশক্তিতেও বেশী ছিলো এবং সামরিক সরঞ্জামের দিক থেকেও শক্তিশালী ছিলো । কোরআন মজীদেও উল্লেখ করা হয়েছে যে , মুসলমানদের তুলনায় কাফেররা এতোই শক্তিশালী ছিলো যে , মুসলমানরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই-এর ব্যাপারে রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।

কিন্তু আল্লাহ্ তা আলা উক্ত আয়াতের মাধ্যমে আগেই মুসলমানদেরকে তাঁর আসমানী ফয়সালার কথা জানিয়ে দেন যে , তিনি চান , সত্যকে মিথ্যার ওপর বিজয়ী করবেন। আল্লাহ্ তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী (বলা বাহুল্য যে , তিনি কখনোই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না) মুসলমানদেরকে তাঁদের দুশমনদের ওপর বিজয়ী করে দেন এবং কাফেরদেরকে পর্যুদস্ত করে দেন।

কাফেরদের চূড়ান্ত বিপর্যয়ের আগাম বার্তা

কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) فاصدع بما تؤمر و اعرض عن المشرکين. انا کفيناک المستهزءِين الذين يجعلون مع الله الهاً آخر. فسوف يعلمون( .

অতএব , (হে রাসূল!) আপনাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দিন এবং মুশরিকদেরকে চ্যালেঞ্জ করুন। নিঃসন্দেহে সেই বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে আমি আপনাকে যথেষ্ট সামর্থ্যবান করে দেবো যারা আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহ্ বানিয়ে নিয়েছে। অতঃপর তারা (তাদের কাজের অশুভ পরিণতি) জানতে পারবে। (সূরাহ্ আল্-হিজর : 94-96)

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) মক্কায় ইসলাম প্রচার শুরু করার পর প্রথম দিকেই এ আয়াত ক টি নাযিল্ হয়। বাযযাায্ ও ত্বিবরাানী প্রমুখ মুফাসসিরে কোরআন এ আয়াত নাযিলের উপলক্ষ্য সম্পর্কে হযরত আনাস বিন মালেক থেকে বর্ণিত একটি হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। এতে বলা হয়েছে : একদিন হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) যখন মক্কায় কিছু লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তারা তাঁর প্রতি উপহাস ও বিদ্রুপ করে এবং বলে : এই হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে ধারণা করছে যে , সে একজন নবী এবং জিবরাঈল তার সাথে রয়েছে। (لباب النقئل: جلال الدين سيوطی- ١٣٣ ) অতঃপর এ আয়াত ক টি নাযিল্ হয় এবং এতে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর বিজয় ও অদৃশ্য ঐশী সাহায্য লাভ এবং তাঁর প্রতি বিদ্রুপকারীদের অপমান-লাঞ্ছনা ও পর্যুদস্ত হবার ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়।

এ আয়াত ক টি এমন এক সময় নাযিল্ হয় যখন কল্পনা করাও সম্ভবপর ছিলো না যে , এমন এক সময় আসবে যখন ক্বুরাইশরা তাদের শৌর্য-বীর্য ও ইজ্জত-সম্ভ্রম হারিয়ে ফেলবে এবং হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর বিজয়ের মাধ্যমে তাদের শক্তি ও আধিপত্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

এই একই প্রসঙ্গে মক্কায় নাযিলকৃত অপর একটি আয়াত হচ্ছে :

) هو الذی ارسل رسوله بالهدی و دين الحق ليظهره علی الدين کله و لو کره المشرکون( .

তিনিই আল্লাহ্ যিনি তাঁর রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীন সহ পাঠিয়েছেন যাতে তিনি এ দ্বীনকে সামগ্রিকভাবে সকল দ্বীনের ওপর বিজয়ী ও সমুদ্ভাসিত করে দেন। (সূরাহ্ আছ্ব্-ছ্বাফ্ : 9)

কোরআন মজীদে আরো এরশাদ হয়েছে :

) ام يقولون نحن جميع منتصر. سيهزم الجمع و يولون الدبر(.

তারা কি বলছে : আমরা অপরাজেয় দল। ? এ দল অচিরেই পরাজিত হবে ও পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে। (সূরাহ্ আল্-ক্বামার : 44-45)

এ আয়াতদ্বয়েও মোশরেকদের পরাজয় ও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। আর অচিরেই বদর যুদ্ধের মাধ্যমে এ ভবিষ্যদ্বাণী কার্যকর হয়।

এ যুদ্ধে মোশরেকদের নেতা আবূ জেহেল তার ঘোড়া নিয়ে সামনে এগিয়ে আসে এবং স্বীয় সেনাবাহিনীর সম্মুখভাগে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে : আজ আমরা মুহাম্মাদ ও তার সহচরদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করবো। কিন্তু আল্লাহ্ তা আলার ইচ্ছা অনুযায়ী সে নিহত হয় এবং তার সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

এভাবে আল্লাহ্ তা আলা সত্যকে সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরেন এবং সত্যের বাণীর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য প্রতিপন্ন করেন। আর এ ঘটনা এমন এক সময় সংঘটিত হয় যখন মুসলমানরা ছিলেন সংখ্যায় অল্প এবং সামরিক শক্তিতে খবই দুর্বল। তখন কারো পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভবপর ছিলো না যে , মাত্র দু টি অশ্ব ও সত্তরটি উট (যাতে তাঁরা পালাক্রমে সওয়ার হতেন) সম্বলিত মাত্র তিনশ তেরো জন লোকের এক বাহিনী - যারা যুদ্ধসরঞ্জামে সুসজ্জিত ছিলেন না , তাঁরা বিপুল যুদ্ধাস্ত্র ও অন্যবিধ সামরিক উপকরণে সুসজ্জিত এক বিরাট বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ী হবেন এবং তাদের শক্তিকে খর্ব করে দেবেন , তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে দেবেন , আর তাদের সম্মান , আধিপত্য ও গৌরবকে নস্যাৎ করে দেবেন।

রোমানদের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী

কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) غلبت الروم. فی ادنی الارض و هم من بعد غلبهم سيغلبون(

রোম পরাজিত হয়েছে (আরব থেকে) নিকটতর ভূখণ্ডে , কিন্তু তাদের এ পরাজয়ের পর অচিরেই তারা বিজয়ী হবে। (সূরাহ্ আর্-রূম্ : 2-3)

কোরআন মজীদের উপরোক্ত আয়াত দু টি পারস্য সামরাজ্যের নিকট রোম সামরাজ্যের পরাজয়ের অব্যবহিত পরেই নাযিল্ হয়। এতে অচিরেই পারস্যের বিরুদ্ধে রোমের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। এ ভবিষ্যদ্বাণী দশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে কার্যকরী হয় এবং রোম সমরাটের সেনাবাহিনী পারস্যে প্রবেশ করে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে , 614 খৃস্টাব্দে রোমান সামরাজ্য পারস্য সামরাজ্যের নিকট শোচনীয় পরাজয় বরণ করে এবং ঐ বছরই আরব উপদ্বীপ সংলগ্ন সিরিয়া ও ফিলিস্তিন রোমানদের হাত থেকে পারস্যের হাতে চলে যায়। যদিও অগ্নিপূজারী পারস্য সামরাজ্য ও খৃস্টান রোমান সামরাজ্য উভয়ই ছিলো অমুসলিম , কিন্তু এ সত্ত্বেও খৃস্টানরা আহলে কিতাব্ ও তাওহীদবাদী হিসেবে পরিচিত হওয়ার কারণে মুসলমানরা অগ্নিপূজারীদের মোকাবিলায় তাদের প্রতি নৈতিক সমর্থন ব্যক্ত করতেন , অন্যদিকে মক্কাহর মুশরিকরা অগ্নিপূজারী পারসিকদের সমর্থন করতো।

এমতাবস্থায় রোমান সামরাজ্য পরাজিত হলে মুশরিকরা মুসলমানদেরকে এই বলে উপহাস করতে থাকে যে , তোমাদের দাবী অনুযায়ী খোদা যদি মাত্র একজন হবেন এবং দেবদেবী সব মিথ্যা হবে তাহলে সে খোদা অগ্নিপূজারী পারসিকদের মোকাবিলায় তাওহীদবাদী আহলে কিতাব্ রোমান খৃস্টানদের পরাজয় ঠেকাতে পারলেন না কেন ?

যদিও এটা ছিলো একটা অপযুক্তি , কারণ , আল্লাহ্ তা আলার এটা নীতি নয় যে , পার্থিব কার্যকারণ বিধিকে অকার্যকর করে সর্বাবস্থায় তাওহীদবাদীদের বিজয়ী করে দেবেন , তা সত্ত্বেও কালোর্ধ পরম জ্ঞানী আল্লাহ্ তা আলা অচিরেই রোমানদের বিজয়ী হবার তথ্য জানিয়ে দিয়ে মুসলমানদেরকে সান্ত্বনা দেন এবং নয় বছরের মধ্যে তা বাস্তবে রূপায়িত হয় - যা কোরআন মজীদের ঐশিতাও প্রমাণ করে।

আবূ লাহাব ও তার স্ত্রীর পরিণতি

আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) تبت يدا ابی لهب و تب. ما اغنی عنه ماله و ما کسب. سيصلی ناراً ذات لهب و امرأته. حمالة الحطب. فی جيدها حبل من مسد( .

আবূ লাহাবের দুই হাত ধ্বংস হোক (তার শক্তি খর্ব হোক) আর সে নিজেও ধ্বংস হোক। তার ধনসম্পদ এবং সে যা উপার্জন করেছে তা তাকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে পারবে না। অচিরেই সে লেলিহান শিখা বিশিষ্ট অগ্নিতে (দোযখে) প্রবেশ করবে। আর তার জ্বালানী কাষ্ঠ বহনকারিনী স্ত্রী-ও (অচিরেই সে লেলিহান শিখা বিশিষ্ট অগ্নিতে প্রবেশ করবে) - এমন অবস্থায় যে , তার গলায় খেজুর পাতায় তৈরী রশি থাকবে। (সূরাহ্ লাহাব্ : 1-5)

এ সূরাহটি আবূ লাহাবের জীবদ্দশায় মক্কায় নাযিল্ হয় এবং এতে তার ও তার স্ত্রীর অচিরেই জাহান্নামে প্রবেশের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় যার মানে হচ্ছে এরা দু জন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করবে না , বরং ইসলামের বিরুদ্ধে অন্ধ বিরোধিতা অব্যাহত রাখবে। কার্যতঃও তা-ই হয় এবং তারা উভয়ই কাফের অবস্থায়ই মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে চিরদিনের জন্য জাহান্নামী হয়।

উল্লেখ্য , এ সূরাহ্ নাযিল হওয়ার সময় মক্কার অধিকাংশ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিই ছিলো ইসলামের ঘোরতর বিরোধী। তাই তাদের মধ্যে পরবর্তীতে কে ইসলাম গ্রহণ করবে এবং কে ইসলাম গ্রহণ করবে না তা মানবীয় বিচারবুদ্ধির পক্ষে বলা সম্ভব ছিলো না। উদাহরণস্বরূপ , তাদের মধ্য থেকে আবূ সুফিয়ান পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় সুস্পষ্টভাবে আবূ লাহাবের জাহান্নামী হওয়ার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা কেবল খোদায়ী ওয়াহীর পক্ষেই সম্ভব ছিলো।

বর্ণিত আছে , আবূ লাহাবের স্ত্রী জ্বালানী কাষ্ঠ সংগ্রহ করে তার বোঝা খেজুর পাতার রশি দিয়ে বেঁধে সে রশির মধ্যে গলা প্রবেশ করিয়ে বোঝাটি পিঠের ওপর নিয়ে বহন করতো। এটা ছিলো তার নিয়মিত অভ্যাস। ঘটনাক্রমে একদিন তার পিঠের বোঝা ঘুরে গিয়ে তার গলার রশিতে টান পড়ে রশিটি শক্তভাবে তার গলায় এঁটে যায়। এর ফলে সে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। এভাবেই বিশেষভাবে উক্ত সূরাহর শেষ আয়াতের ভবিষ্যদ্বাণী কার্যকরী হয়।

মক্কাহ্ বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী

কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

) انا فتحنا لک فتحاً مبيناً( .

(হে রাসূল!) অবশ্যই আমি আপনার জন্য এক সুস্পষ্ট বিজয় এনে দিয়েছি। (সূরাহ্ আল্-ফাত্হ্ : 1)

এ আয়াতটি দিয়ে সূচিত সূরাহ্ আল্-ফাত্হ্ হুদায়বীয়াহর সন্ধির পর পরই নাযিল্ হয়।

ষষ্ঠ হিজরীতে রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নেতৃত্বে মুসলমানরা কা বাহ্ শরীফের উমরাহ্ করতে যান। কিন্তু জাহেলীয়্যাতের যুগেও হজ্ব ও উমরাহর মাসগুলো এমনকি মোশরেকদের কাছেও পবিত্র ও সম্মানার্হ গণ্য হওয়া এবং এ সব মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ গর্হিত কাজ বলে পরিগণিত হওয়া সত্ত্বেও মক্কার কাফেররা মুসলমানদের উমরাহ্ করতে আসার খবর জানতে পেরে তাঁদেরকে মক্কায় আসতে বাধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ও তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধপ্রস্তুতি গ্রহণ করে।

রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) মোশরেকদের এ যুদ্ধপ্রস্তুতির মুখে রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে মক্কা নগরীর অদূরে হুদায়বীয়াহ্ নামক স্থানে স্বীয় অনুসারীদের নিয়ে যাত্রাবিরতি করেন। শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনার পর বাহ্যতঃ মুসলমানদের জন্য অপমানজনক এমন কতক শর্তে , বিশেষ করে মুসলমানরা ঐ বছরের মতো উমরাহ্ না করে মদীনায় ফিরে যাবেন এ শর্তে , দু পক্ষের মধ্যে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

মুসলমানদের সকলেই প্রয়োজনে ইসলামের জন্য যুদ্ধ করে শহীদ হবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তাই তাঁদের প্রায় সকলেই এ ধরনের সন্ধির বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু আল্লাহ্ তা আলার নির্দেশে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) কাফেরদের দেয়া সকল শর্ত মেনে নিয়ে সন্ধি করেন। এতে মুসলমানদের অনেকেই দুঃখিত হন। এমতাবস্থায় মুসলমানদের মদীনায় ফিরে আসার পথে উক্ত সূরাহ্ নাযিল্ হয় এবং তাঁদেরকে জানিয়ে দেয়া হয় যে , এ সন্ধি বাহ্যতঃ অপমানজনক হলেও এর চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে সুস্পষ্ট বিজয়। কার্যতঃও তা-ই হয়েছিলো।

উক্ত সন্ধির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুফল ছিলো এই যে , এর মাধ্যমে মক্কাহর কাফেররা মুসলমানদেরকে - যাদেরকে তারা এর আগে ধর্মত্যাগী ও গোত্রত্যাগী বলে গণ্য করতো - নিজেদের সমকক্ষ একটি পক্ষ ও শক্তি হিসেবে মেনে নেয়। দ্বিতীয়তঃ মক্কার কাফেরদের সাথে যুদ্ধের সম্ভাবনা না থাকায় মুসলমানদের জন্য আরব উপদ্বীপের সর্বত্র ও এর বাইরে ইসলামের ব্যাপক প্রচারের সুযোগ সৃষ্টি হয়। তৃতীয়তঃ মক্কাহ্ ও মদীনার লোকদের মধ্যে যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় গোপনে মক্কায় ইসলামের যথেষ্ট বিস্তার ঘটে ও বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করে। এর ফলে , দুই বছরের মধ্যে মক্কার কাফেরদের পক্ষ থেকে সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করার কারণে হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ) যখন আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ধিচুক্তি বাতিল করে দেন এবং এরপর মক্কা বিজয়ের জন্য অভিযান চালান তখন পুরোপুরি বিনা রক্তপাতে মক্কাহ্ বিজয় সম্ভবপর হয়।

দলে দলে ইসলাম গ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণী

) اذا جاء نصر الله والفتح و رأيت الناس يدخلون فی دين الله افواجاً( .

যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও বিজয় এসে যাবে এবং (হে রাসূল!) আপনি লোকদেরকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন , ...। (সূরাহ্ আন্-নাছ্বর্ : 1-2)

উক্ত আয়াতদ্বয়ে শুধু ইসলামের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণীই করা হয় নি , বরং লোকদের দলে দলে ইসলাম গ্রহণেরও ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। আর ইতিহাস তা-ই প্রত্যক্ষ করেছে।

এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে , কোনো শক্তি যুদ্ধে বিজয়ী হলেই যে পরাজিত পক্ষের লোকেরা অতি দ্রুত দলে দলে তার ধর্ম গ্রহণ করবে এর কোনো দৃষ্টান্ত ইতিহাসে দেখা যায় না। অবশ্য ইতিহাসে কতক ক্ষেত্রে বিজয়ীদের দ্বারা জবরদস্তিমূলকভাবে পরাজিতদের ধর্মান্তরকরণের দৃষ্টান্ত রয়েছে (যেমন স্পেনে ও ফিলিপাইনে মুসলমানদেরকে খৃস্টধর্মে ধর্মান্তর)। কিন্তু ইসলাম জবরদস্তি ধর্মান্তরের ঘোরতর বিরোধী এবং ইসলামের ইতিহাসে এ ধরনের ধর্মান্তরের নযীর নেই। তা সত্ত্বেও হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর জীবদ্দশায় দলে দলে গোত্রের পর গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে। এভাবে কোরআন মজীদের উক্ত ভবিষ্যদ্বাণী কার্যকরী হয়।


22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38