কোরআন কেন আরবী ভাষায় নাযিল্ হলো
কোরআন মজীদ কেন আরবী ভাষায় নাযিল্ হলো
?
অনেক সময় এ ধরনের প্রশ্ন করতে শোনা যায় এবং ঈমানদারদের পক্ষ থেকে নিজ নিজ জ্ঞান মতো এ প্রশ্নের জবাব দিতে দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে এ প্রশ্নের জবাব হয় আত্মরক্ষামূলক
( Defensive)।অর্থাৎ কোরআন মজীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত যে কোনো আপত্তি খণ্ডন করা ঈমানী দায়িত্ব
-
কেবল এ অনুভূতি থেকে জবাব দেয়া হয়। কিন্তু সে জবাব কতোখানি যথার্থ বা তা প্রশ্নকর্তাদের অন্তর থেকে সন্দেহ
-
সংশয়কে অকাট্যভাবে দূর করতে পারবে কিনা সে সম্পর্
কে খুব কমই চিন্তা করা হয়।
অনেক ক্ষেত্রেই এ সব জবাব হয় মনগড়া এবং প্রকৃত অবস্থা ও কোরআন মজীদের চেতনার সাথে সম্পর্কহীন। কিন্তু অ-যথার্থ জবাব দিয়ে কোরআন মজীদের প্রতিরক্ষা করতে হবে - কোরআন মজীদ এহেন দুর্বলতার উর্ধে। তাই এ প্রশ্নের যথার্থ জবাব সন্ধান ও প্রদান অপরিহার্য।
এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে প্রথমেই প্রশ্নকর্তার বা প্রশ্নকর্তাদের উদ্দেশ্য কী দেখতে হবে এবং সেদিকে লক্ষ্য রেখে সঠিক জবাব দিতে হবে।
দায়িত্ব এড়ানোর বাহানা
একদল প্রশ্নকর্তা এ প্রশ্ন করে কোরআন মজীদ অধ্যয়ন ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে যে দুর্বলতা ও আলস্য রয়েছে তার সপক্ষে ছাফাই গাওয়ার উদ্দেশ্যে। তারা বলে , কোরআন মজীদ যদি আরবদের মাতৃভাষায় নাযিল্ না হয়ে আমাদের মাতৃভাষায় নাযিল্ হতো তাহলে আমরা তা পড়ে ও অধ্যয়ন করে সহজেই বুঝতে পারতাম।
তাদের এ বক্তব্য কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তির ওপর ভিত্তিশীল নয়। কারণ , কোরআন মজীদকে প্রশ্নকর্তাদের মাতৃভাষায় নাযিল্ করা হলে অন্য ভাষাভাষীরা একই রকম বাহানা তুলতো। তাছাড়া কোরআন মজীদ যাদের মাতৃভাষায় নাযিল্ হয়েছে সেই আরবদেরও সকলে কোরআনের ওপর ঈমান আনে নি এবং যারা ঈমান আনার দাবী করেছে বা করছে তাদেরও সকলেই যে সঠিক অর্থে কোরআন মজীদ বুঝতে পেরেছে বা বোঝার চেষ্টা করেছে তা নয়।
অবশ্য কোরআন মজীদ অত্যন্ত সহজ-সরল ও গতিশীল প্রাঞ্জল ভাষায় নাযিল্ হয়েছে ; আরবী ভাষাভাষী ও আরবী-জানা লোকদের কাছে এটি মোটেই দুর্বোধ্য মনে হবে না। তা সত্ত্বেও যে সব আরব খুব বেশী চেষ্টাসাধনা না করে কেবল পড়েই কোরআন মজীদকে বোঝার অর্থাৎ এর সঠিক তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করে সঠিকভাবে ও পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারে নি তাদের বুঝতে না পারার কারণ , কোরআন মজীদ কোনো মামূলী গ্রন্থ নয় যে , যে ভাষায় তা নাযিল্ হয়েছে ঐ ভাষাভাষী যে কোনো ব্যক্তি অথবা ঐ ভাষা জানে এমন যে কোনো ব্যক্তি তা পড়লেই তার পুরো তাৎপর্য বুঝতে পারবে।
অবশ্য এ কথার মানে এ নয় যে , কোরআন বিশেষজ্ঞ নয় এমন আরব ব্যক্তি কোরআন পড়ে কিছুই বুঝতে পারবে না। বরং মোটামুটি এর বাহ্যিক তাৎপর্য বুঝতে পারবে ; অনারব লোকেরাও নিজ নিজ ভাষায় কোরআন মজীদের অনুবাদ পড়ে মোটামুটি একই পরিমাণ বা বাহ্যিক তাৎপর্য বুঝতে পারে। কিন্তু বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত স্থান-কাল ও পরিবেশ-পরিস্থিতি নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য পথনির্দেশক হিসেবে নাযিলকৃত গ্রন্থ হিসেবে কোরআন মজীদের ভিতরে যে তাৎপর্য নিহিত রয়েছে তার সাথে ঐ সব ব্যক্তির বুঝা তাৎপর্যের আসমান-যমীন পার্থক্য - তা তাদের মাতৃভাষা আরবীই হোক , বা অন্য কোনো ভাষাই হোক। অবশ্য তারা যা বুঝেছে তা সঠিক এবং নির্ভুলও হতে পারে। কিন্তু কোরআন মজীদ এমন এক ব্যতিক্রমী জ্ঞানসূত্র যে , এর পাঠকের গুণগত ও মানগত স্তরভেদে তার কাছে এর জ্ঞান বিভিন্ন গুণগত মাত্রায় ও ব্যাপকতায় প্রকাশ পায়। [এ প্রসঙ্গে‘
কোরআন ও নুযূলে কোরআন’
শীর্ষক আলোচনায় বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তির মানব প্রজাতির ইতিহাস সংক্রান্ত জ্ঞানের মধ্যকার পার্থক্য সংক্রান্ত যে উপমা দেয়া হয়েছে তা স্মর্তব্য।]
কোরআন মজীদ হচ্ছে , তার নিজের ভাষায় ,تبيانا لکل شيء
(সকল কিছুর সুবর্ণনা) অর্থাৎ সৃষ্টিলোকের সূচনা থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত সব কিছু ; যা কিছু ঘটেছে তার সব কিছুই এবং ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে যা কিছুর ঘটা অনিবার্য হয়ে আছে তার সব কিছু এবং যা কিছুর ঘটা ও না-ঘটা সমান সম্ভাবনাযুক্ত বা শর্তাধীন রয়েছে তা সেভাবেই , আর যা অনিশ্চিত বা অনির্ধারিত উন্মুক্ত সম্ভাবনার ক্ষেত্র তা-ও সেভাবেই এতে নিহিত রয়েছে।
এখানে প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে , ঘটা ও না-ঘটার সমান সম্ভাবনাযুক্ত বা শর্তাধীন ক্ষেত্র এবং উন্মুক্ত ভবিষ্যতের ক্ষেত্র সম্পর্কে কোরআন মজীদে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমোক্ত ক্ষেত্র সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘
আলা এরশাদ করেন :
)
يمحوا الله ما يشاء و يثبت و عنده ام الکتاب(
-“
তিনি যা ইচ্ছা নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং (যা ইচ্ছা) বহাল রাখেন। আর তাঁর নিকটই রয়েছে গ্রন্থজননী।”
(সূরাহ্ আর্-রা‘
দ্ : 39) আর দ্বিতীয়োক্ত ক্ষেত্রের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে এই যে , আল্লাহ্ তা‘
আলা সদাই নব নব সৃষ্টি করে চলেছেন। এমনকি মানুষের ভবিষ্যতও এর আওতার বাইরে নয়। কারণ , এরশাদ হয়েছে :
)
إِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ وَيَأْتِ بِخَلْقٍ جَدِيدٍ(
-“
(হে মানবমণ্ডলী!) তিনি যদি চান তাহলে তোমাদেরকে সরিয়ে দেবেন এবং (তোমাদের পরিবর্তে) নতুন কোনো সৃষ্টিকে নিয়ে আসবেন। আর আল্লাহ্ এ কাজে পুরোপুরি সক্ষম।”
(সূরাহ্ ইবরাহীম্ : 19) অর্থাৎ ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত ধরণীর বুকে আল্লাহর খলীফাহ্ হিসেবে মানুষই থাকবে , নাকি আল্লাহ্ তার পরিবর্তে অন্য কোনো নতুন সৃষ্টিকে অস্তিত্ব দান করবেন - এ বিষয়টি তিনি অনিশ্চিত ও অনির্ধারিত রেখে দিয়েছেন।
অন্য কথায় বলা চলে যে , কোরআন মজীদ হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে মানুষকে দেয়ার উপযোগী সকল জ্ঞানের এক সুকৌশল ও সুনিপুণ সমাহার। তাই কোরআন মজীদের নির্ভুল ও মোটামুটি ন্যূনতম প্রয়োজনীয় তাৎপর্য গ্রহণের জন্য এক ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে যাদের মাতৃভাষা আরবী ও যাদের মাতৃভাষা আরবী নয় তাদের জন্য প্রয়োজনীয় চেষ্টাসাধনার মধ্যে খুব সামান্যই পার্থক্য ঘটে। অন্যথায় যাদের মাতৃভাষা আরবী তাদের সকলেই কোরআন মজীদের তাৎপর্য ভালোভাবে (অন্ততঃ একটি ন্যূনতম মাত্রায়) অবগত থাকতো। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তা থেকে স্বতন্ত্র । কোরআন মজীদের ন্যূনতম তাৎপর্য অনুধাবন করার জন্য চেষ্টাসাধনা করা তো দূরের কথা , আমরা মুসলমানরা (আরব-অনারব নির্বিশেষে) কোরআন মজীদের নিয়মিত তেলাওয়াত্ ক’
জন করে থাকি ?
যাদের মাতৃভাষা আরবী নয় তাদের পক্ষেও কোরআন মজীদের তেলাওয়াত্ আয়ত্ত করা কোনো কঠিন ও দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার নয়। তা সত্ত্বেও আমরা সকল মুসলমানই কি কোরআন তেলাওয়াত্ আয়ত্ত করেছি ? এমনকি যারা কোরআন মজীদের তেলাওয়াত্ আয়ত্ত করেছে তারাও কি সকলেই নিয়মিত তেলাওয়াত্ করে ? যদি না করে তাহলে তা কি কোরআন মজীদের প্রতি মহব্বতের পরিচায়ক ? তেলাওয়াত্ জানা থাকা সত্ত্বেও যারা নিয়মিত তেলাওয়াত্ করে না এ মহাগ্রন্থ তাদের মাতৃভাষায় নাযিল্ হলেই যে তারা তার তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা করতো তার কী নিশ্চয়তা আছে ?
কেউ যদি সত্যি সত্যিই আল্লাহর কালামের প্রকৃত তাৎপর্য জানতে আগ্রহী থাকে তাহলে তার জন্য আরবী ভাষা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জ্ঞান আয়ত্ত করাই স্বাভাবিক। বিদেশে চাকরি করার জন্যে অনেকেই তো বিদেশী ভাষা আয়ত্ত করে থাকে ; শুধু ইউরোপীয় দেশসমূহের ভাষা নয় , চীনা , জাপানী ও কোরিয়ান ভাষা পর্যন্ত লোকেরা শিক্ষা করছে , মধ্যপ্রাচ্যে চাকরির জন্য আরবী ভাষাও শিক্ষা করছে। এমতাবস্থায় যে ব্যক্তি কোরআনের তাৎপর্য বুঝতে চায় সে কেন আরবী ভাষা শিখবে না ? এ জন্য বেশী বয়সে মাদ্রাসায় ভর্তি হবারও প্রয়োজন নেই ; একটু চেষ্টা করলে এবং কষ্ট স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকলেই শেখা যায়।
অতএব , এ ধরনের প্রশ্নকারীদের বাহানা পুরোপুরি অযৌক্তিক।
কোরআন বর্জনের বাহানা
কোরআন মজীদ কেন আরবী ভাষায় নাযিল্ হলো ? আমাদের মাতৃভাষায় নাযিল্ হলো না কেন ? এ প্রশ্ন যারা করে তাদের মধ্যকার আরেক দলের উদ্দেশ্য হচ্ছে এ বাহানায় কোরআন মজীদকে পরিত্যাগ করা। তাদের দাবী হচ্ছে , যেহেতু সব নবী-রাসূল (‘
আঃ)ই তাঁদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় ওয়াহী লাভ করেছেন এবং একই ভাষাভাষী সমগোত্রীয় লোকদের হেদায়াতের দায়িত্ব পালন করেছেন , অতএব , নবী করীম (ছ্বাঃ) যেহেতু আরবদের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং কোরআন মজীদ আরবী ভাষায়ই নাযিল্ হয়েছে , সেহেতু তিনি ছিলেন শুধু আরবদের নবী এবং কোরআন শুধু আরবদের জন্যই নাযিল্ হয়েছে।
এভাবে তারা নিজ ভাষায় নিজ জাতির জন্য নতুন নবী আবির্ভূত হওয়ার দাবী তোলার পক্ষে অথবা তারা তাদের জীবন ও আচরণে যে ধর্মসম্পর্কহীনতার পথ
( Secularism)অবলম্বন করেছে তা অব্যাহত রাখার পক্ষে একটা যৌক্তিক ভিত্তি দাঁড় করাবার চেষ্টা করে।
মজার ব্যাপার হলো এই দ্বিতীয় আপত্তিকারী দলের লোকেরা কিন্তু কোরআন মজীদের সাথে পুরোপুরি অপরিচিত নয় ; বরং তাদের অনেকে আরবী ভাষার সাথে পরিচিত এবং আরবী কোরআন পড়ে মোটামুটি বুঝতে পারে , অথবা তারা নিজ নিজ মাতৃভাষায় বা তৃতীয় কোনো ভাষায় , যেমন : বর্তমান যুগের আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজীতে কোরআন মজীদের অনুবাদ পাঠ করেছে ; বরং বেশ মনোযোগ দিয়েই পাঠ করেছে। এ কারণেই তারা তাদের দাবীর সপক্ষে স্বয়ং কোরআন মজীদের আয়াতকেই ব্যবহার করার অপচেষ্টা করেছে।
কোরআন মজীদ যে শুধু আরবদের জানা-বুঝা ও হেদায়াতের উদ্দেশ্যেই আরবী ভাষায় নাযিল্ হয়েছে - এটা প্রমাণ করার জন্য তারা এর বেশ কিছু আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা করে থাকে যে সব আয়াতে আল্লাহ্ তা‘
আলা কোরআন মজীদকে আরবী ভাষায় নাযিল্ করার কথা বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু এ সব আয়াতের উদ্দেশ্য তারা যা দাবী করেছে আদৌ তা নয়। তবে এ সব আয়াত নিয়ে আলোচনার পূর্বে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াতের ও কোরআন মজীদের বিশ্বজনীনতা ও সর্বজনীনতার ওপরে সংক্ষেপে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি।