আরবী ভাষার শব্দবিবর্তন সম্ভাবনার দৃষ্টান্ত
কোরআন মজীদ যে আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় নাযিল্ হওয়া সম্ভব ছিলো না তা ভালোভাবে বুঝতে হলে আরবী ভাষা ও উন্নত প্রকাশসম্ভাবনা সম্পন্ন অন্যান্য ভাষার প্রকাশক্ষমতার প্রতি তুলনামূলক দৃষ্টিপাত করা অপরিহার্য।
বিষয়টি অত্যন্ত বিরাট ও ব্যাপক। এখানে আরবী ভাষার প্রকাশসম্ভাবনা সম্পর্কে সামান্য আভাস দেয়া যেতে পারে - যার পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত প্রকাশক্ষমতা সম্পন্ন বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার এবং বিশ্বে সর্বাধিক প্রচলিত ইংরেজী ভাষার প্রকাশসম্ভাবনার সাথে তার তুলনা করলেই ভাষাবিদদের নিকট বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।
আরবী ভাষায় বেশীর ভাগ বিশেষ্য-বিশেষণই সুনির্দিষ্ট নিয়মে বিশেষ মূল থেকে নিষ্পন্ন হয় , তেমনি ক্রিয়াপদের রূপান্তরের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা অনুসৃত হয়। যদিও এটা আরবী ভাষার কোনো একক বৈশিষ্ট্য নয় , তবে আরবী ভাষার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এখানে যে , এ ভাষায় বিশেষ্য-বিশেষণের নিষ্পন্নতা ও ক্রিয়াপদের রূপান্তর মাত্রা এতো বেশী যে , অন্য কোনো ভাষার পক্ষে এদিক থেকে আরবী ভাষার ধারেকাছেও আসা সম্ভব নয়।
আরবী ভাষায় ক্রিয়ার কালের প্রধান বিভাগ শুধু অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় , বরং সেই সাথে রয়েছে আদেশ (امر
) , নিষেধ (نهی
) , অস্বীকৃতি (نفی
) , বিরত থাকা (جحد
) ও জিজ্ঞাসা (استفهام
) । অবশ্য ক্রিয়ার এ ভাগগুলো কোনো না কোনো ভাবে অন্য অনেক ভাষাতেই রয়েছে , কিন্তু আরবী ভাষার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এখানে যে , বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই কেবল ক্রিয়াপদের স্বরচিহ্নে পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে , কতক ক্ষেত্রে দু’
একটি বর্ণ যোগ বা বিয়োগ করে এবং কতক ক্ষেত্রে অব্যয় যোগ করে তাৎপর্যগত পরিবর্তন সৃষ্টি করা হয়। তাছাড়াجحد
(বিরত থাকা) ক্রিয়াপদ আরবী ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আছে বলে জানা নেই।
এখানে“
জাহ্দ্”
(جحد
) সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া যেতে পারে।
“
সে এ কাজটি করে নি।”
আরবী ভাষায় এ বাক্যটি অতীত কাল হিসেবে বললে একটি সাধারণ নেতিবাচক তথ্য বুঝাবে , কিন্তু“
জাহ্দ্”
হিসেবে বললে বুঝা যাবে যে , এখনো সে কাজটি করে নি বটে , তবে করার সম্ভাবনা অস্বীকৃত নয়।
অনুরূপভাবে আরবী ভাষায় অতীত কালের বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে যার মধ্য থেকে কতক বিভাগ একান্তই আরবী ভাষার নিজস্ব। আরবী ভাষার অতীত কালের বিভাগগুলো হচ্ছে : সাধারণ অতীত , নিকট অতীত , দূর অতীত , ঘটমান অতীত , সম্ভাব্য অতীত ও আকাঙ্ক্ষাবাচক অতীত। শব্দে সামান্য রদবদল করে বা অব্যয়যোগে এ সব পরিবর্তন সাধিত হয়ে থাকে। তেমনি ভবিষ্যত কালের ক্ষেত্রেও অনুরূপভাবে নিকট ও দূর ভবিষ্যত রয়েছে। সেই সাথে আছে‘
জোর দেয়া’
বা‘
গুরুত্ব আরোপ’
(تأکيد
)। এই“
তা’
কীদ”
আবার“
সাধারণ তা’
কীদ্”
ও“
বেশী তা’
কীদ”
এবং“
অনেক বেশী তা’
কীদ”
হতে পারে।
আরবী ভাষায় যে কোনো ক্রিয়াপদের কর্তার সংখ্যা (বচন) ও নারী-পুরুষ ভেদে 14টি করে রূপ আছে। কর্মের ক্ষেত্রেও তা-ই। একই কালে প্রতিটি ক্রিয়ারও একই সংখ্যক রূপ আছে। অন্যদিকে ক্রিয়ার তাৎপর্যভেদে একই ক্রিয়ার একই কালে নয়টি প্রধান ও আরো অনেকগুলো অপ্রধান রূপ আছে - যা কেবল মূলক্রিয়াপদের সাথে একটি বা দু’
টি হরফ যোগ করে তৈরী করা যেতে পারে। এভাবে একটি ক্রিয়াপদ থেকে বিপুল সংখ্যক ক্রিয়ারূপ তৈরী করা সম্ভব।
উদাহরণ থেকে এ বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে অন্য ভাষার তুলনায় আরবী ভাষায় শব্দ ও বাক্যের বিবর্তন ও রূপান্তরের আধিক্য এবং একই সাথে অপেক্ষাকৃত সংক্ষেপে (কম শব্দ ব্যবহার করে) অধিকতর সূক্ষ্ম ও ব্যাপকতর ভাব প্রকাশের বিষয়টি লক্ষণীয়।
প্রথমে আমরা শব্দবিবর্তনের কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করবো এবং এরপর বাক্যবিবর্তনের দৃষ্টান্ত দেবো।
[আরবী ভাষায় আ-কার (া)-এর জন্য যবর এবং তদ্সহ আলেফ (ا
) যোগ হলে উক্ত‘
আ-কার’
-কে দীর্ঘায়িত করতে হয়। কিন্তু বাংলা ভাষায় তা নির্দেশ করার জন্য কোনো স্বতন্ত্র বর্ণ বা চিহ্ন নেই। তাই অপরিহার্য প্রয়োজনীয় বিবেচনায় নীচের উদাহরণগুলোতে ও আরো কতক ক্ষেত্রে এ ধরনের শব্দের উচ্চারণে ও উচ্চারণ নির্দেশের বেলায় ডবল আ-কার (াা) ব্যবহার করেছি ; অন্যথায় কতক ক্ষেত্রে দু’
টি ভিন্ন ভিন্ন শব্দের উচ্চারণ নির্দেশ অভিন্ন হয়ে যেতে পারে। তবে বাংলা লেখার মধ্যে ব্যবহৃত আরবী শব্দের বানান নিজস্ব নিয়মে করা হয়েছে , যেমন :عَالِم
উচ্চারণনির্দেশে“‘
আালিম্”
এবং বাংলা লেখার মধ্যে“
আলেম”
। ]
عَلَمَ
(‘
আলামা) - সে (কোনো কিছুর ওপর) চিহ্ন দিলো।عَلَمَ السنة
- সে ঠোঁট ফাঁক করলো।
عَلِمَ
(‘
আলিমা) - সে জ্ঞানী ছিলো ; সে জ্ঞানী হলো ; সে জানলো ; সে জানতো ; সে (কোনো কিছু) লক্ষ্য করলো/ প্রত্যক্ষ করলো ; সে তার ওপরের ওষ্ঠ বিকশিত করলো।عَلَمَ الامرُ
- সে কাজটি খুব ভালোভাবে ও পাকাপোক্ত করে আঞ্জাম দিলো।
عَلَم
(‘
আলাম্) - নিদর্শন বা চিহ্ন (যা থেকে কোনো কিছু জানা যায় বা কোনো বিষয়ে জ্ঞান অর্জিত হয়)।
عَالِم
(‘
আালিম্) - যিনি কোনো একটি বিষয় জেনেছেন বা বিভিন্ন বিষয় পৃথক পৃথক ভাবে জেনেছেন (আলেম - জ্ঞানী)।اَعلَم
(আ‘
লাম্) - (কারো তুলনায় বা অন্য সকলের তুলনায়) অধিকতর জ্ঞানী।عَلاَّم
(‘
আল্লাাম্) - যিনি অনেক বেশী জানেন - অনেক বড় জ্ঞানী।عَلاَّمَة
(‘
আল্লাামাহ্) - মহাপণ্ডিত (‘
আল্লামাহ্) ; দার্শনিক।عَليم
(‘
আলীম্) - সদাজ্ঞানময়।
عِلم
(‘
ইল্ম্) - জ্ঞান।مَعلُوم
(মা‘
লূম্) - যা জানা হয়েছে ; যে জ্ঞান অর্জিত হয়েছে: যে বিষয় , বস্তু বা ব্যক্তি ইত্যাদি সম্বন্ধে জানা গেছে বা জ্ঞান অর্জিত হয়েছে।
اَعلَم
(আ‘
লাম্) - ওপরের ওষ্ঠ বিকশিতকারী ; ওপরের ওষ্ঠ বিকশিতকারী পশু।
اَعلَمَ
(আ‘
লামা) - সে জানালো ; সে ঘোষণা করলো ; সে অবগত করলো।
عَلَّمَ
(‘
আল্লামা) - সে শিক্ষা দিলো।
تَعَلَّمَ
(তা‘
আল্লামা) - সে (অন্যের দেয়া) শিক্ষা গ্রহণ করলো ; সে পড়া পড়লো।تَعَلَّمَ الامرَ
- সে কাজটি পাকাপোক্তভাবে/ খুব ভালোভাবে আঞ্জাম দিলো।
تَعَالَمَ
(তা‘
আালামা) - সে (কোনো কিছু) জানতে/ বুঝতে পারলো।
اِستَعلَمَ
(ইস্তা‘
লামা) - সে জানতে চাইলো।
العَلَم
(আল্-‘
আলাম্)- পোশাকের নকশা ; পতাকা ; গোত্রপতি ; চিহ্ন ; মসজিদের মিনার।
العَلآمَةُ
(আল্-‘
আলাামাহ্) - আলামত ; চিহ্ন ; পথনির্দেশক ফলক।
العالَم
(আল্-‘
আালাম্) - জগত , বিশ্ব।
العَلاميُّ
(আল্-‘
আলাামীয়্যু) - চালাক-চতুর ; সতর্ক।
العَلَمَة
(আল্-‘
আলামাহ্)- বর্ম ; জ্ঞানী।
العَيلَم
(আল্-‘
আইলাম্) - সমুদ্র ; পানিতে পরিপূর্ণ কূপ ; পুরুষ চিতাবাঘ।
المَعلَم
(আল্-মা‘
লাম্)- পথনির্দেশক ফলক।
এর বাইরেعلم
মূল থেকে আরো অনেক শব্দরূপ ও ক্রিয়ারূপ নিষ্পন্ন হতে পারে। অনেকগুলো রূপের আদৌ ব্যবহার নেই , কিন্তু কখনো হয়তো কোনো সুলেখক বা সুবক্তা উপযুক্ত বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করার চিন্তা করতে পারেন। অর্থাৎ ব্যবহার না থাকলেও এ ধরনের আরো অনেক রূপের সম্ভাবনা নিহিত আছে।
ওপরে যে সব উদাহরণ দেয়া হলো তার মধ্য থেকে যেগুলো ক্রিয়াপদের উদাহরণ সেগুলো সবই কর্তৃবাচ্যে। এর প্রতিটিরই কর্মবাচ্য আছে যার ফলেعلم
মূল থেকে নিষ্পন্ন রূপের সংখ্যা আরো অনেক বেড়ে যায়। সেই সাথে বিভিন্ন কালের কথা চিন্তা করা যেতে পারে ইতিপূর্বে যার উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ , কালভেদে ও কর্তাভেদে ক্রিয়াপদের রূপের পরিবর্তন হয়ে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। সে সব রূপের বিস্তারিত উদাহরণ হবে অনেক দীর্ঘ - এখানে যার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে কর্তৃবাচ্য-কর্মবাচ্য নির্বিশেষে এখানে বিভিন্ন ক্রিয়াপদ থেকে আরো কয়েকটি উদাহরণ দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি যা রূপান্তরের সাথে সাথে অর্থে বিশেষ পরিবর্তন , বিশেষতঃ সূক্ষ্ম পরিবর্তন নির্দেশ করে থাকে। (সেই সাথে কয়েক ধরনের নিষ্পন্ন বিশেষ্যরও উল্লেখ করা হলো।)
نَشَرَ
(নাশারা)- সে প্রকাশ করলো।نُشِرَ
(নুশিরা) - তা (বই/ পত্রিকা/ ...) প্রকাশিত হলো।اِنتَشَرَ
(ইন্তাশারা) - (কেউ প্রকাশ করলো বিধায়) তা প্রকাশিত হলো।
کَسَرَ
(কাসারা) - সে (কোনো কিছু) ভেঙ্গে ফেললো ; তা (নিজে নিজে) ভেঙ্গে গেলো।انکَسَرَ
(ইনকাসারা) - তা (কেউ ভেঙ্গে ফেলেছে বিধায়) ভেঙ্গে গেলো (নিজে নিজে ভেঙ্গে যায় নি)।
ضَرَبَ
(যারাবা) - সে (কাউকে প্রহার করলো/ আঘাত করলো)।ضَارَبَ
(যাারাবা) - সে (কারো সাথে) মারামারি করলো (তাকে মেরেছে বলে সে প্রতিপক্ষকে মারলো) ; (তাকে আঘাত করেছে বলে) সে (প্রতিপক্ষকে) আঘাত করলো।اَضرِبُ
(আযরিবু) - আমি প্রহার করবো।سَاَضرِبُ
(সাআযরিবু) - আমি অচিরেই প্রহার করবো।لاضرِبُ
(লাআযরিবু) - আমি অবশ্যই প্রহার করবো।اَضرِبَنَّ
(আযরিবান্না)- আমি অবশ্যই প্রহার করবো।لاَضرِبَنَّ
(লাআযরিবান্না) - আমি অবশ্য অবশ্যই প্রহার করবো।ضَارِب
(যাারিব্) - প্রহারকারী।مَضروب
(মাযরূব্) - প্রহৃত।ضَرَّاب
(যাররাাব্) - বেশী বেশী আঘাতকারী: অনবরত আঘাতকারী।مِضراب
(মিযরাাব্) - মারার উপকরণ , লাঠি , বাদ্যযন্ত্রবিশেষ বাজানোর ক্ষুদ্র উপকরণবিশেষ।
مَرِضَ
(মারিযা) - সে অসুস্থ হলো।تَمارَضَ
(তামাারাযা) - সে অসুস্থতার ভান করলো।
غَرَبَ
(গ্বরাবা) - সে চলে গেলো ; সে/ তা দূর হয়ে গেলো ; সে বহু দূরে (সফরে) গেলো ; (চন্দ্র/ সূর্য/ নক্ষত্র) অস্তমিত হলো।مَغرِب
(মাগ্বরিব্) - অস্ত যাবার সময় (সন্ধ্যা) ; অস্ত যাবার স্থান ও দিক (পশ্চিম) ; পশ্চিমের দেশ (পাশ্চাত্য)।
حَسُنَ
(হাসুনা) - সে সুন্দর ছিলো ; সে সুন্দর হলো।حَسَن
(হাসান্) - চির সুন্দর।اَحسَن
(আহ্সান্) - অধিকতর সুন্দর।حُسَين
(হুসাইন্) - (আকারে) ছোট সুন্দর জিনিস ; (বয়সে) ছোট হাসান (ব্যক্তি) ; দুইজন সুন্দর ব্যক্তির মধ্যে যে বয়সে ছোট।
صَارَ
(ছ্বাারা)- সে / তা এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় উপনীত হলো ; যেমন :صار الماءُ سلجاً
- পানি বরফে পরিণত হলো।
اَصبَحَ
(আছ্ববাহা) - তার সকাল হলো ; বিশেষ এক অবস্থায় তার সকাল হলো ; সকালে তার অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে আরেক অবস্থা হলো ; যেমন :اَصبَحَ مَريضاً
- অসুস্থ অবস্থায় তার সকাল হলো ; সে সকাল বেলা অসুস্থ হয়ে পড়লো।
এখানে এলোপাতাড়িভাবে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলো। নচেৎ একই ক্রিয়ামূল থেকে নিষ্পন্ন ক্রিয়াপদ ও বিশেষ্য-বিশেষণের রূপ অনেক। এরপর এগুলোর বচনভেদ , স্ত্রী-পুরুষভেদ , কালভেদ ইত্যাদি তো রয়েছেই। এছাড়া আছে কর্তাবাচক বিশেষ্য , কর্মবাচক বিশেষ্য , কর্মের উপকরণ বাচক বিশেষ্য , স্থান ও কাল বাচক বিশেষ্য , আধিক্যবাচক বিশেষ্য , ক্ষুদ্রতাবাচক বিশেষ্য ইত্যাদি।