কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্ 7%

কোরআনের মু‘জিযাহ্ লেখক:
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের মু‘জিযাহ্
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 60 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 48484 / ডাউনলোড: 4702
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের মু‘জিযাহ্

কোরআনের মু‘জিযাহ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

আরবী ভাষার শব্দবিবর্তন সম্ভাবনার দৃষ্টান্ত

কোরআন মজীদ যে আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় নাযিল্ হওয়া সম্ভব ছিলো না তা ভালোভাবে বুঝতে হলে আরবী ভাষা ও উন্নত প্রকাশসম্ভাবনা সম্পন্ন অন্যান্য ভাষার প্রকাশক্ষমতার প্রতি তুলনামূলক দৃষ্টিপাত করা অপরিহার্য।

বিষয়টি অত্যন্ত বিরাট ও ব্যাপক। এখানে আরবী ভাষার প্রকাশসম্ভাবনা সম্পর্কে সামান্য আভাস দেয়া যেতে পারে - যার পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত প্রকাশক্ষমতা সম্পন্ন বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার এবং বিশ্বে সর্বাধিক প্রচলিত ইংরেজী ভাষার প্রকাশসম্ভাবনার সাথে তার তুলনা করলেই ভাষাবিদদের নিকট বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।

আরবী ভাষায় বেশীর ভাগ বিশেষ্য-বিশেষণই সুনির্দিষ্ট নিয়মে বিশেষ মূল থেকে নিষ্পন্ন হয় , তেমনি ক্রিয়াপদের রূপান্তরের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা অনুসৃত হয়। যদিও এটা আরবী ভাষার কোনো একক বৈশিষ্ট্য নয় , তবে আরবী ভাষার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এখানে যে , এ ভাষায় বিশেষ্য-বিশেষণের নিষ্পন্নতা ও ক্রিয়াপদের রূপান্তর মাত্রা এতো বেশী যে , অন্য কোনো ভাষার পক্ষে এদিক থেকে আরবী ভাষার ধারেকাছেও আসা সম্ভব নয়।

আরবী ভাষায় ক্রিয়ার কালের প্রধান বিভাগ শুধু অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় , বরং সেই সাথে রয়েছে আদেশ (امر ) , নিষেধ (نهی ) , অস্বীকৃতি (نفی ) , বিরত থাকা (جحد ) ও জিজ্ঞাসা (استفهام ) । অবশ্য ক্রিয়ার এ ভাগগুলো কোনো না কোনো ভাবে অন্য অনেক ভাষাতেই রয়েছে , কিন্তু আরবী ভাষার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এখানে যে , বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই কেবল ক্রিয়াপদের স্বরচিহ্নে পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে , কতক ক্ষেত্রে দু একটি বর্ণ যোগ বা বিয়োগ করে এবং কতক ক্ষেত্রে অব্যয় যোগ করে তাৎপর্যগত পরিবর্তন সৃষ্টি করা হয়। তাছাড়াجحد (বিরত থাকা) ক্রিয়াপদ আরবী ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আছে বলে জানা নেই।

এখানে জাহ্দ্ (جحد ) সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া যেতে পারে।

সে এ কাজটি করে নি। আরবী ভাষায় এ বাক্যটি অতীত কাল হিসেবে বললে একটি সাধারণ নেতিবাচক তথ্য বুঝাবে , কিন্তু জাহ্দ্ হিসেবে বললে বুঝা যাবে যে , এখনো সে কাজটি করে নি বটে , তবে করার সম্ভাবনা অস্বীকৃত নয়।

অনুরূপভাবে আরবী ভাষায় অতীত কালের বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে যার মধ্য থেকে কতক বিভাগ একান্তই আরবী ভাষার নিজস্ব। আরবী ভাষার অতীত কালের বিভাগগুলো হচ্ছে : সাধারণ অতীত , নিকট অতীত , দূর অতীত , ঘটমান অতীত , সম্ভাব্য অতীত ও আকাঙ্ক্ষাবাচক অতীত। শব্দে সামান্য রদবদল করে বা অব্যয়যোগে এ সব পরিবর্তন সাধিত হয়ে থাকে। তেমনি ভবিষ্যত কালের ক্ষেত্রেও অনুরূপভাবে নিকট ও দূর ভবিষ্যত রয়েছে। সেই সাথে আছে জোর দেয়া বা গুরুত্ব আরোপ (تأکيد )। এই তা কীদ আবার সাধারণ তা কীদ্ বেশী তা কীদ এবং অনেক বেশী তা কীদ হতে পারে।

আরবী ভাষায় যে কোনো ক্রিয়াপদের কর্তার সংখ্যা (বচন) ও নারী-পুরুষ ভেদে ১৪টি করে রূপ আছে। কর্মের ক্ষেত্রেও তা-ই। একই কালে প্রতিটি ক্রিয়ারও একই সংখ্যক রূপ আছে। অন্যদিকে ক্রিয়ার তাৎপর্যভেদে একই ক্রিয়ার একই কালে নয়টি প্রধান ও আরো অনেকগুলো অপ্রধান রূপ আছে - যা কেবল মূলক্রিয়াপদের সাথে একটি বা দু টি হরফ যোগ করে তৈরী করা যেতে পারে। এভাবে একটি ক্রিয়াপদ থেকে বিপুল সংখ্যক ক্রিয়ারূপ তৈরী করা সম্ভব।

উদাহরণ থেকে এ বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে অন্য ভাষার তুলনায় আরবী ভাষায় শব্দ ও বাক্যের বিবর্তন ও রূপান্তরের আধিক্য এবং একই সাথে অপেক্ষাকৃত সংক্ষেপে (কম শব্দ ব্যবহার করে) অধিকতর সূক্ষ্ম ও ব্যাপকতর ভাব প্রকাশের বিষয়টি লক্ষণীয়।

প্রথমে আমরা শব্দবিবর্তনের কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করবো এবং এরপর বাক্যবিবর্তনের দৃষ্টান্ত দেবো।

[আরবী ভাষায় আ-কার (া)-এর জন্য যবর এবং তদ্সহ আলেফ (ا ) যোগ হলে উক্ত আ-কার -কে দীর্ঘায়িত করতে হয়। কিন্তু বাংলা ভাষায় তা নির্দেশ করার জন্য কোনো স্বতন্ত্র বর্ণ বা চিহ্ন নেই। তাই অপরিহার্য প্রয়োজনীয় বিবেচনায় নীচের উদাহরণগুলোতে ও আরো কতক ক্ষেত্রে এ ধরনের শব্দের উচ্চারণে ও উচ্চারণ নির্দেশের বেলায় ডবল আ-কার (াা) ব্যবহার করেছি ; অন্যথায় কতক ক্ষেত্রে দু টি ভিন্ন ভিন্ন শব্দের উচ্চারণ নির্দেশ অভিন্ন হয়ে যেতে পারে। তবে বাংলা লেখার মধ্যে ব্যবহৃত আরবী শব্দের বানান নিজস্ব নিয়মে করা হয়েছে , যেমন :عَالِم উচ্চারণনির্দেশে“‘ আালিম্ এবং বাংলা লেখার মধ্যে আলেম । ]

عَلَمَ ( আলামা) - সে (কোনো কিছুর ওপর) চিহ্ন দিলো।عَلَمَ السنة - সে ঠোঁট ফাঁক করলো।

عَلِمَ ( আলিমা) - সে জ্ঞানী ছিলো ; সে জ্ঞানী হলো ; সে জানলো ; সে জানতো ; সে (কোনো কিছু) লক্ষ্য করলো/ প্রত্যক্ষ করলো ; সে তার ওপরের ওষ্ঠ বিকশিত করলো।عَلَمَ الامرُ - সে কাজটি খুব ভালোভাবে ও পাকাপোক্ত করে আঞ্জাম দিলো।

عَلَم ( আলাম্) - নিদর্শন বা চিহ্ন (যা থেকে কোনো কিছু জানা যায় বা কোনো বিষয়ে জ্ঞান অর্জিত হয়)।

عَالِم ( আালিম্) - যিনি কোনো একটি বিষয় জেনেছেন বা বিভিন্ন বিষয় পৃথক পৃথক ভাবে জেনেছেন (আলেম - জ্ঞানী)।اَعلَم (আ লাম্) - (কারো তুলনায় বা অন্য সকলের তুলনায়) অধিকতর জ্ঞানী।عَلاَّم ( আল্লাাম্) - যিনি অনেক বেশী জানেন - অনেক বড় জ্ঞানী।عَلاَّمَة ( আল্লাামাহ্) - মহাপণ্ডিত ( আল্লামাহ্) ; দার্শনিক।عَليم ( আলীম্) - সদাজ্ঞানময়।

عِلم ( ইল্ম্) - জ্ঞান।مَعلُوم (মা লূম্) - যা জানা হয়েছে ; যে জ্ঞান অর্জিত হয়েছে: যে বিষয় , বস্তু বা ব্যক্তি ইত্যাদি সম্বন্ধে জানা গেছে বা জ্ঞান অর্জিত হয়েছে।

اَعلَم (আ লাম্) - ওপরের ওষ্ঠ বিকশিতকারী ; ওপরের ওষ্ঠ বিকশিতকারী পশু।

اَعلَمَ (আ লামা) - সে জানালো ; সে ঘোষণা করলো ; সে অবগত করলো।

عَلَّمَ ( আল্লামা) - সে শিক্ষা দিলো।

تَعَلَّمَ (তা আল্লামা) - সে (অন্যের দেয়া) শিক্ষা গ্রহণ করলো ; সে পড়া পড়লো।تَعَلَّمَ الامرَ - সে কাজটি পাকাপোক্তভাবে/ খুব ভালোভাবে আঞ্জাম দিলো।

تَعَالَمَ (তা আালামা) - সে (কোনো কিছু) জানতে/ বুঝতে পারলো।

اِستَعلَمَ (ইস্তা লামা) - সে জানতে চাইলো।

العَلَم (আল্- আলাম্)- পোশাকের নকশা ; পতাকা ; গোত্রপতি ; চিহ্ন ; মসজিদের মিনার।

العَلآمَةُ (আল্- আলাামাহ্) - আলামত ; চিহ্ন ; পথনির্দেশক ফলক।

العالَم (আল্- আালাম্) - জগত , বিশ্ব।

العَلاميُّ (আল্- আলাামীয়্যু) - চালাক-চতুর ; সতর্ক।

العَلَمَة (আল্- আলামাহ্)- বর্ম ; জ্ঞানী।

العَيلَم (আল্- আইলাম্) - সমুদ্র ; পানিতে পরিপূর্ণ কূপ ; পুরুষ চিতাবাঘ।

المَعلَم (আল্-মা লাম্)- পথনির্দেশক ফলক।

এর বাইরেعلم মূল থেকে আরো অনেক শব্দরূপ ও ক্রিয়ারূপ নিষ্পন্ন হতে পারে। অনেকগুলো রূপের আদৌ ব্যবহার নেই , কিন্তু কখনো হয়তো কোনো সুলেখক বা সুবক্তা উপযুক্ত বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করার চিন্তা করতে পারেন। অর্থাৎ ব্যবহার না থাকলেও এ ধরনের আরো অনেক রূপের সম্ভাবনা নিহিত আছে।

ওপরে যে সব উদাহরণ দেয়া হলো তার মধ্য থেকে যেগুলো ক্রিয়াপদের উদাহরণ সেগুলো সবই কর্তৃবাচ্যে। এর প্রতিটিরই কর্মবাচ্য আছে যার ফলেعلم মূল থেকে নিষ্পন্ন রূপের সংখ্যা আরো অনেক বেড়ে যায়। সেই সাথে বিভিন্ন কালের কথা চিন্তা করা যেতে পারে ইতিপূর্বে যার উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ , কালভেদে ও কর্তাভেদে ক্রিয়াপদের রূপের পরিবর্তন হয়ে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। সে সব রূপের বিস্তারিত উদাহরণ হবে অনেক দীর্ঘ - এখানে যার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে কর্তৃবাচ্য-কর্মবাচ্য নির্বিশেষে এখানে বিভিন্ন ক্রিয়াপদ থেকে আরো কয়েকটি উদাহরণ দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি যা রূপান্তরের সাথে সাথে অর্থে বিশেষ পরিবর্তন , বিশেষতঃ সূক্ষ্ম পরিবর্তন নির্দেশ করে থাকে। (সেই সাথে কয়েক ধরনের নিষ্পন্ন বিশেষ্যরও উল্লেখ করা হলো।)

نَشَرَ (নাশারা)- সে প্রকাশ করলো।نُشِرَ (নুশিরা) - তা (বই/ পত্রিকা/ ...) প্রকাশিত হলো।اِنتَشَرَ (ইন্তাশারা) - (কেউ প্রকাশ করলো বিধায়) তা প্রকাশিত হলো।

کَسَرَ (কাসারা) - সে (কোনো কিছু) ভেঙ্গে ফেললো ; তা (নিজে নিজে) ভেঙ্গে গেলো।انکَسَرَ (ইনকাসারা) - তা (কেউ ভেঙ্গে ফেলেছে বিধায়) ভেঙ্গে গেলো (নিজে নিজে ভেঙ্গে যায় নি)।

ضَرَبَ (যারাবা) - সে (কাউকে প্রহার করলো/ আঘাত করলো)।ضَارَبَ (যাারাবা) - সে (কারো সাথে) মারামারি করলো (তাকে মেরেছে বলে সে প্রতিপক্ষকে মারলো) ; (তাকে আঘাত করেছে বলে) সে (প্রতিপক্ষকে) আঘাত করলো।اَضرِبُ (আযরিবু) - আমি প্রহার করবো।سَاَضرِبُ (সাআযরিবু) - আমি অচিরেই প্রহার করবো।لاضرِبُ (লাআযরিবু) - আমি অবশ্যই প্রহার করবো।اَضرِبَنَّ (আযরিবান্না)- আমি অবশ্যই প্রহার করবো।لاَضرِبَنَّ (লাআযরিবান্না) - আমি অবশ্য অবশ্যই প্রহার করবো।ضَارِب (যাারিব্) - প্রহারকারী।مَضروب (মাযরূব্) - প্রহৃত।ضَرَّاب (যাররাাব্) - বেশী বেশী আঘাতকারী: অনবরত আঘাতকারী।مِضراب (মিযরাাব্) - মারার উপকরণ , লাঠি , বাদ্যযন্ত্রবিশেষ বাজানোর ক্ষুদ্র উপকরণবিশেষ।

مَرِضَ (মারিযা) - সে অসুস্থ হলো।تَمارَضَ (তামাারাযা) - সে অসুস্থতার ভান করলো।

غَرَبَ (গ্বরাবা) - সে চলে গেলো ; সে/ তা দূর হয়ে গেলো ; সে বহু দূরে (সফরে) গেলো ; (চন্দ্র/ সূর্য/ নক্ষত্র) অস্তমিত হলো।مَغرِب (মাগ্বরিব্) - অস্ত যাবার সময় (সন্ধ্যা) ; অস্ত যাবার স্থান ও দিক (পশ্চিম) ; পশ্চিমের দেশ (পাশ্চাত্য)।

حَسُنَ (হাসুনা) - সে সুন্দর ছিলো ; সে সুন্দর হলো।حَسَن (হাসান্) - চির সুন্দর।اَحسَن (আহ্সান্) - অধিকতর সুন্দর।حُسَين (হুসাইন্) - (আকারে) ছোট সুন্দর জিনিস ; (বয়সে) ছোট হাসান (ব্যক্তি) ; দুইজন সুন্দর ব্যক্তির মধ্যে যে বয়সে ছোট।

صَارَ (ছ্বাারা)- সে / তা এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় উপনীত হলো ; যেমন :صار الماءُ سلجاً - পানি বরফে পরিণত হলো।

اَصبَحَ (আছ্ববাহা) - তার সকাল হলো ; বিশেষ এক অবস্থায় তার সকাল হলো ; সকালে তার অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে আরেক অবস্থা হলো ; যেমন :اَصبَحَ مَريضاً - অসুস্থ অবস্থায় তার সকাল হলো ; সে সকাল বেলা অসুস্থ হয়ে পড়লো।

এখানে এলোপাতাড়িভাবে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলো। নচেৎ একই ক্রিয়ামূল থেকে নিষ্পন্ন ক্রিয়াপদ ও বিশেষ্য-বিশেষণের রূপ অনেক। এরপর এগুলোর বচনভেদ , স্ত্রী-পুরুষভেদ , কালভেদ ইত্যাদি তো রয়েছেই। এছাড়া আছে কর্তাবাচক বিশেষ্য , কর্মবাচক বিশেষ্য , কর্মের উপকরণ বাচক বিশেষ্য , স্থান ও কাল বাচক বিশেষ্য , আধিক্যবাচক বিশেষ্য , ক্ষুদ্রতাবাচক বিশেষ্য ইত্যাদি।

৩য় পাঠ

কয়েকটি প্রশ্নের জবাব

কয়েকটি প্রশ্নের জবাব :

নবুয়্যতের অপরিহার্যতা সম্পর্কে যে প্রমাণটি উপস্থাপন করা হয়েছে তার উপর একাধিক প্রশ্ন ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ থাকতে পারে। এখন আমরা সেগুলোর অবতারণা ও উত্তর দানের চেষ্টা করব :

১। যদি মহান আল্লাহর প্রজ্ঞার দাবি এটাই হয় যে,নবীগণের নবুয়্যতের মাধ্যমে সকল মানুষ হিদায়াত প্রাপ্ত হবে,তবে কেন তাদের সকলেই এক বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানে প্রেরিত হয়েছে এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থান এ অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে? বিশেষ করে প্রাচীনকালে যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সংবাদ আদান-প্রদানের মাত্রা ছিল খুবই সীমাবদ্ধ,ধীর গতির এবং সম্ভবতঃ এমন কোন জাতি বা গোষ্ঠী থাকতে পারে যারা নবীগণের আহ্বান সম্পর্কে কোনভাবেই অবগত ছিল না।

জবাব : প্রথমতঃ নবীগণের আবির্ভাব কোন নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ ছিল না এবং পবিত্র কোরানের আয়াত থেকে আমরা এ প্রমাণ পাই যে,প্রতিটি গোত্র ও জাতির জন্যেই কোন না কোন নবী ছিলেন। যেমন :

) وَإِنْ مِنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٌ(

এবং এমন কোন সম্প্রদায় নেই যার নিকট সর্তককারী প্রেরিত হয়নি। (সূরাঃ ফাতির -২৪) অনুরূপ,

) وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ(

এবং আল্লাহর ইবাদত করার ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেয়ার জন্যে আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি। (সূরাঃ নাহল-৩৬)

পবিত্র কোরানে যদিও মুষ্টিমেয় কিছু নবীগণের (আ.) নাম উল্লেখ হয়েছে,তবে তার অর্থ এ নয় যে,নবীগণের সংখ্যাও তা-ই ছিল। বরং স্বয়ং পবিত্র কোরানেই সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়েছে যে,এমন অনেক নবী ছিলেন যাদের নাম এ পবিত্র কিতাবে উল্লেখ হয়নি। যেমন :

) وَرُسُلًا لَمْ نَقْصُصْهُمْ عَلَيْكَ(

এবং অনেক রাসূল যাদের কথা তোমাকে বলিনি। (সূরা : নিসা ১৬৪)

দ্বিতীয়ত : উল্লেখিতি প্রমাণটির দাবি ছিল এই যে,ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধিবৃত্তি বহির্ভূত অপর কোন মাধ্যমও থাকা উচিৎ,যার মাধ্যমে মানুষ হিদায়াত প্রাপ্ত হবে। কিন্তু হিদায়াত প্রাপ্তি দু টি শর্তে কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বাস্তবরূপ লাভ করে থাকে। একটি হল : ব্যক্তি স্বয়ং প্রভু কর্তৃক প্রদত্ত এ নিয়ামত বা অনুগ্রহ থেকে লাভবান হতে চাইবেন। অপরটি হল : অন্যরা এ হিদায়াতের পথে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন না। অধিকাংশ মানুষ স্বেচ্ছাচারিতার কারণে হিদায়াত প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন,তেমনি অপর সিংহভাগ আবার প্রচারের প্রসারে প্রতিবন্ধকতার ফলে বঞ্চিত হয়েছেন। আমরা জানি আল্লাহর প্রেরিত পূরুষগণ এ প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের জন্যে সদা সচেষ্ট ছিলেন এবং আল্লাহর শক্রদের সাথে,বিশেষ করে শক্তিধর ও দাম্ভিকদের সাথে সংগ্রামরত ছিলেন। আর আল্লাহর বাণী প্রচার ও মানুষকে হিদায়াতের পথে নবীগণের মধ্যে অনেকেই নিজ জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছিলেন। কোন কোন ক্ষেত্রে যদি অনুসারী ও সহযোগী সংগ্রহ করতে পারতেন তবে অত্যাচারী ও স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। আর এ অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী শ্রেণীই হল দ্বীনের প্রসারের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক।

এখানে স্মরণযোগ্য যে,মানবীয় উৎকর্ষের পথ স্বাধীন নির্বাচনাধীন হওয়ার অপরিহার্য অর্থ হল : এ সকল ঘটনাগুলো এমনভাবে রূপ পরিগ্রহ করবে যে,সুপথ ও কুপথের নির্বাচনের ক্ষেত্রে সত্যপন্থী ও মিথ্যাপন্থীদের জন্যে উম্মুক্ত থাকবে। তবে স্বৈরাচারী ও মিথ্যাবাদীর প্রভাব যদি এমন স্থানে পৌছে যে,অপরের হিদায়াতের পথ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায় এবং কোন সমাজে সত্যের আলোকবর্তিকা সম্পূর্ণরূপে নির্বাপিত হয়ে যায় তবে ঐ অবস্থায় মহান আল্লাহ কোন না কোন অদৃশ্য উপায়ে ও অসাধারণ পথে সত্যের অনুসারীগণকে সাহায্য করে থাকেন।

সিদ্ধান্ত : যদি এ ধরনের কোন প্রতিবন্ধকতা নবীগণের (আ.) প্রচারের পথে না থাকত তবে তাদের আহ্বান সকল বিশ্ববাসীর কর্ণগোচর হত এবং ওহী ও নবুয়্যতের মাধ্যমে এ হিদায়াতের ঐশী অনুগ্রহ থেকে উপকৃত হত। অতএব অধিকাংশ মানুষের হিদায়াত প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার অপরাধ তাদের উপরই বর্তায়,যারা নবীগণের আহ্বানের এবং প্রচার ও প্রসারের পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল।

২। যদি নবীগণ মানব সম্প্রদায়ের উৎকর্ষের পথকে সুগম করার জন্যে নবুয়্যত লাভ করে থাকেন তবে কেন তাদের আগমন সত্বেও এত অপরাধ ও অনাচারের উদ্ভব হয়েছে এবং অধিকাংশ মানুষ অধিকাংশ সময়ই কুফর ও গুণাহে লিপ্ত হয়েছে;এমনকি ঐশী ধর্মসমূহের অনুসারীদের পরস্পরের মধ্যেও শত্রুতা ও বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে এবং রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্বক যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে? মহান প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি কি এটা ছিল না যে,মহান আল্লাহ অন্য কোনভাবে এ সকল অনাচার ও বিশৃংখলার পথ রোধ করবেন যাতে ন্যূনতমপক্ষে ঐশীধর্মসমূহের অনুসারীগণ পরস্পর কলহে লিপ্ত না হয়?

জবাব : মানুষের স্বাধীন বিশেষত্বযুক্ত উৎকর্ষের উপর চিন্তা করলে উপরোক্ত প্রশ্নের জবাব স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। কারণ,যেমনটি বলা হয়েছে যে,প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি হল স্বাধীনভাবে (বাধ্যতামূলক নয়) উৎকর্ষ লাভের সকল ক্ষেত্র ও শতের্র যোগান দিবেন যাতে সত্যানুসন্ধিৎসুগণ সত্যপথ শনাক্ত করতঃ সে পথ পরিক্রমণের মাধ্যমে উৎকর্ষ ও সৌভাগ্য লাভ করতে পারে। কিন্তু এ ধরনের উৎকর্ষের জন্যে শর্ত ও কারণের উপস্থিতির অর্থ এ নয় যে,সকল মানুষ ঐগুলোর সদ্ব্যবহার করে বাধ্যতামূলক সঠিক পথ বেছে নিবে। পবিত্র কোরানের ব্যাখ্যানুসারে,মহান আল্লাহ মানব সম্প্রদায়কে সঙ্গত শর্তেই এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন যে,তাদের মধ্যে কারা উত্তম কর্ম সম্পাদন করে তা পরীক্ষা করবেন। অনুরূপ পবিত্র কোরানে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে যে,যদি মহান আল্লাহ চাইতেন তবে সকলকেই সরল পথে পরিচালনা করতে পারতেন এবং বিচ্যুতি ও বক্রতার পথকে সম্পূর্ণরূপে রোধ করতে পারতেন। কিন্তু এ অবস্থায় নির্বাচনের কোন সুযোগই অবশিষ্ট থাকত না এবং মানুষের আচরণ মানবিক মূল্যবোধ বর্জিত হত। আর সেই সাথে স্বাধীন ও নির্বাচন ক্ষমতার অধিকারী মানব সৃষ্টির পথে প্রভুর উদ্দেশ্য ব্যাহত হত।

সিদ্ধান্ত : অন্যায়,ব্যভিচার,কুফর ও গুণাহের প্রতি মানুষের ঝোঁক হল ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারিতারই প্রমাণবহ। আর এ ধরনের অসদাচরণের ক্ষমতা তার সৃষ্টি রহস্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে এবং ঐগুলোর আনুসঙ্গিক ফলাফল,তাদেরই অনুগামী। প্রভুর ইরাদা মূলতঃ মানুষের উৎকর্ষকেই সমন্বিত করলেও,যেহেতু এ সমন্বয় স্বাধীনতার শর্তাধীন,সেহেতু স্বেচ্ছাচারিতা থেকে উৎসারিত অধঃপতন ও বিচ্যুতিকে প্রতিহত করে না। সর্বোপরি প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি এ নয় যে,চাক বা না চাক স্বীয় চাওয়া পাওয়া ও ইরাদার বিরুদ্ধে সঠিক পথে পরিচালিত হবে ।

৩। প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি হল এই যে,মানব সম্প্রদায় অধিকতর ও উত্তমরূপে উৎকর্ষ ও সৌভাগ্যের দিকে এগিয়ে যাবে। তাহলে এটাই কি শ্রেয়তর নয় যে,মহান আল্লাহ প্রকৃতির রহস্যসমূহকে ওহীর মাধ্যমে মানুষের নিকট প্রকাশ করবেন যাতে বিভিন্ন প্রকার নেয়ামত লাভ করে মানুষ স্বীয় উৎকর্ষের পথে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে? যেমনকরে গত কয়েক শতাব্দীতে অনেক প্রাকৃতিক শক্তি,কারণ ও দৈনন্দিন সামগ্রীর আবিষ্কার সভ্যতার বিকাশে বিস্ময়কর ভূমিকা পালন করেছে এবং শারীরিক সুস্থতা ও বিভিন্ন ব্যাধির বিরুদ্ধে সংবাদ বিনিময়,যোগযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও অমূল্য পরিবর্তন এনেছে। এটা অনস্বীকার্য যে,নবীগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কারের মাধ্যমে ও সুখ-শান্তির উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে যদি মানুষকে সাহায্য করতেন তবে নিজেদের সামাজিক প্রভাব ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উত্তমরূপে তাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছতে পারতেন।

জবাব : ওহী ও নবুয়্যতের মূল প্রয়োজন ঐ সকল ক্ষেত্রেই,যেখানে মানুষ পরিচিতির সাধারণ মাধ্যম দ্বারা ঐগুলোকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয় এবং ঐগুলো সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার ফলে প্রকৃত উৎর্ষের পথ নির্ধারণ করে সে পথ পরিক্রমণে অপারগ হয়। অন্যকথায় : নবীগণের (আ.) মূল দায়িত্ব এই যে,মানব সম্প্রদায়কে সঠিক দিকনির্দেশনা পাবার ও উৎকর্ষ লাভের পথে সহায়তা করা যাতে সর্বাবস্থায় স্বীয় কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারে এবং কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছতে তাদের সকল শক্তি ও সামর্থ্য ব্যয় করতে সক্ষম হয় -হোক সে যাযাবর সম্প্রদায় ও খিমাবাসী কিংবা হোক মহাসাগর অভিযাত্রী ও মহাকাশচারী। কিন্তু তাদেরকে মানুষের প্রকৃত মূল্যবোধসমূহ সম্পর্কে জানতে হবে। জানতে হবে মহান আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে তাদের কী কর্তব্য বয়েছে,কী দায়িত্ব রয়েছে তাদের পরস্পরের প্রতি কিংবা স্বগোত্রের ও অন্য গোত্রের সৃষ্টের প্রতি,যাতে ঐ কর্তব্যগুলো যথাস্থানে সম্পাদনের মাধ্যমে প্রকৃত উৎকর্ষ ও অনন্ত সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারে। অপরদিকে শক্তি ও সামর্থ্যরে বিভিন্নতা,প্রাকৃতিক ও প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা কোন বিশেষ সময়ে বা বিভিন্ন কালে,কোন বিশেষ কারণানুসারে প্রকাশ লাভ করে এবং প্রকৃত উৎকর্ষ ও চিরন্তন ভাগ্যলিপির ক্ষেত্রে কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে না। যেমন : আজকের যুগের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি বস্তুগত ও পার্থিব উন্নয়নের কারণ হলেও,মানুষের আধ্যাত্মিক ও মানসিক উৎকর্ষের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলেনি। বরং নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে,এ কথা বললেও অত্যুক্তি হবে না।

সিদ্ধান্ত : প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি হল এই যে,মানব সম্প্রদায় বস্তুগত বৈভবসমূহকে ব্যবহার করে পার্থিব জীবন নির্বাহ করবে এবং বুদ্ধিবৃত্তি ও ওহীর মাধ্যমে স্বীয় পরিক্রমণের পথকে প্রকৃত উৎকর্ষ ও চিরন্তন সৌভাগ্যের দিকে পরিচালিত করবে। কিন্তু শারীরিক ও আত্মিক সামর্থের বিভিন্নতা;অনুরূপ প্রাকৃতিক ও সামাজিক শর্তসমূহের বৈচিত্রময়তা;তদনুরূপ জ্ঞান ও বিজ্ঞান থেকে লাভবান হওয়ার ক্ষেত্রে সাতন্ত্রিকতা ইত্যাদি একাধিক কারণ ও সুনিদিষ্ট শর্তের অধীন,যা কার্যকারণ বিধি মোতাবেক উৎপত্তি লাভ করে। আর এ বিভিন্নতা,মানুষের চিরন্তন ভাগ্যলিপি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা পালন করে না । বরং তা কতইনা উত্তম যে,কোন ব্যক্তি বা সমষ্টি এক অনাড়ম্ভর জীবনাতিবাহিত করেছেন এবং বৈষয়িক ও পার্থিব বৈভব থেকে ন্যূনতম স্বাদ গ্রহণ করেছেন। আর এমতাবস্থায় উৎকর্ষ ও সৌভাগ্যের সমুন্নত শিখরে স্থান লাভ করেছেন। অপরদিকে কতইনা হতভাগ্য সে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর,যারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও জীবন উপকরণের অধিকারী হওয়া সত্বেও অকৃতজ্ঞতা,দাম্ভিকতা ও অপরের প্রতি অত্যাচার ও অন্যায়ের ফলে নিকৃষ্টতম নরকে পতিত হয়েছে।

তবে আল্লাহ প্রেরিত পূরুষগণ মূল দায়িত্ব পালন (অর্থাৎ প্রকৃত উৎকর্ষ ও অনন্ত সৌভাগ্যের পথে পরিচালনা) ব্যতীত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় পার্থিব জীবন-যাপনের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিলেন এবং যেখানেই প্রভুর প্রজ্ঞা প্রয়োজন মনে করেছে সেখানেই কিছুটা হলেও অজ্ঞাত বাস্তবতা ও রহস্যের পর্দা উম্মোচন করেছে,যেমনটি হযরত দাউদ (আ.),সোলায়মান (আ.) ও যুলক্বারনাইনের (আ.) জীবদ্দশায় পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া আল্লাহর নবীগণ সমাজের তত্ত্বাবধান ও সফলভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রেও সচেষ্ট ছিলেন -যেমনটি হযরত ইউসূফ (আ.) মিশরে সম্পাদন করেছিলেন। কিন্তু এ সমুদয় কর্মের সবগুলোই ছিল তাদের মূল দায়িত্ব ভিন্ন বাড়তি খেদমত ।

অনুরূপ আল্লাহর নবীগণ তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে কোন বৈজ্ঞানিক,অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রয়োগ করেননি সেক্ষেত্রে বলতে হয় : নবীগণের (আ.) মূল লক্ষ্য (যেমনটি ইতিপূর্বেও একাধিকবার বলা হয়েছে) সচেতন ও স্বাধীনভাবে নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। আর যদি বল প্রয়োগের মাধ্যমে বিপ্লব করতে চাইতেন তবে মানুষের স্বাভাবিক আধ্যাত্মিক বিকাশলাভ ও স্বাধীনভাবে উৎকর্ষ লাভ ঘটত না। বরং জনগণ শক্তি ও চাপের নিকট আত্মসমর্পণ করে তাদের অনুসরণ করত -- প্রভুর প্রতি অনুরাগবশতঃ ও স্বাধীন নির্বাচনের মাধ্যমে নয়। আমীরুল মু'মেনীন আলী (আ.) এ প্রসঙ্গে বলেন :

যদি মহান আল্লাহ চাইতেন তবে নবীগণের আবির্ভারের সময় তাদের জন্যে স্বর্ণ-রৌপ্য ও মণিমুক্তার ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দিতেন,ফল-মূলে পরিপূর্ণ বাগান তাদের অধিকারে প্রদান করতেন এবং আকাশে উড্ডয়নরত পক্ষীকুল ও ভূমিতে বিচরণরত সকল কিছুকেই তাদের সেবায় নিয়োজিত করতেন। আর যদি তা-ই করতেন তবে পরীক্ষা ও পুরস্কারের ক্ষেত্র ব্যাহত হত এবং যদি চাইতেন নবীগণকে এমন দুর্লভ ক্ষমতা ও অটুট সম্মান,রাজ্য ও শাসনক্ষমতার অধিকারী করতেন যে,অন্যান্যরা লোভ ও ভীতির বশবর্তী হয়ে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করবে এবং দাম্ভিকতা ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে দূরে থাকবে,তবে ঐ অবস্থায় প্রবৃত্তি ও মূল্যবোধসমূহ এক সমান হত। কিন্তু মহান আল্লাহ এমনটি চেয়েছেন যে,নবীগণের (আ.) অনুসরণ,তাদের কিতাবসমূহকে স্বীকার করা ও তাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ নিখুতভাবে ও একমাত্র খোদাপ্রীতির ফলেই ঘটবে। আর পরীক্ষা যত বৃহত্তর হবে,প্রভু কর্তৃক প্রদত্ত পুরস্কার ও প্রতিদানের পরিমাণও ততবেশী বৃদ্ধি পাবে। তবে যদি কোন জনসমষ্টি স্বাধীন নির্বাচন ও অনুরাগের বশবর্তী ও সত্য ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আল্লাহর অনুগত সমাজ প্রতিষ্ঠা করে এবং ঐশী উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্যে বিশেষ করে অন্যায়,অত্যাচার নির্মূল করার জন্য ও মু'মেনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্যে বিভিন্ন শক্তি ও প্রতিপত্তির আশ্রয় নেয়,তবে তা অনাকাংখিত হবে না;যার উদাহরণ হযরত সোলায়মানের (আ.) শাসন ব্যবস্থায় পরিলক্ষিত হয়।

৩য় পাঠ

কয়েকটি প্রশ্নের জবাব

কয়েকটি প্রশ্নের জবাব :

নবুয়্যতের অপরিহার্যতা সম্পর্কে যে প্রমাণটি উপস্থাপন করা হয়েছে তার উপর একাধিক প্রশ্ন ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ থাকতে পারে। এখন আমরা সেগুলোর অবতারণা ও উত্তর দানের চেষ্টা করব :

১। যদি মহান আল্লাহর প্রজ্ঞার দাবি এটাই হয় যে,নবীগণের নবুয়্যতের মাধ্যমে সকল মানুষ হিদায়াত প্রাপ্ত হবে,তবে কেন তাদের সকলেই এক বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানে প্রেরিত হয়েছে এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থান এ অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে? বিশেষ করে প্রাচীনকালে যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সংবাদ আদান-প্রদানের মাত্রা ছিল খুবই সীমাবদ্ধ,ধীর গতির এবং সম্ভবতঃ এমন কোন জাতি বা গোষ্ঠী থাকতে পারে যারা নবীগণের আহ্বান সম্পর্কে কোনভাবেই অবগত ছিল না।

জবাব : প্রথমতঃ নবীগণের আবির্ভাব কোন নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ ছিল না এবং পবিত্র কোরানের আয়াত থেকে আমরা এ প্রমাণ পাই যে,প্রতিটি গোত্র ও জাতির জন্যেই কোন না কোন নবী ছিলেন। যেমন :

) وَإِنْ مِنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٌ(

এবং এমন কোন সম্প্রদায় নেই যার নিকট সর্তককারী প্রেরিত হয়নি। (সূরাঃ ফাতির -২৪) অনুরূপ,

) وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ(

এবং আল্লাহর ইবাদত করার ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেয়ার জন্যে আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি। (সূরাঃ নাহল-৩৬)

পবিত্র কোরানে যদিও মুষ্টিমেয় কিছু নবীগণের (আ.) নাম উল্লেখ হয়েছে,তবে তার অর্থ এ নয় যে,নবীগণের সংখ্যাও তা-ই ছিল। বরং স্বয়ং পবিত্র কোরানেই সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়েছে যে,এমন অনেক নবী ছিলেন যাদের নাম এ পবিত্র কিতাবে উল্লেখ হয়নি। যেমন :

) وَرُسُلًا لَمْ نَقْصُصْهُمْ عَلَيْكَ(

এবং অনেক রাসূল যাদের কথা তোমাকে বলিনি। (সূরা : নিসা ১৬৪)

দ্বিতীয়ত : উল্লেখিতি প্রমাণটির দাবি ছিল এই যে,ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধিবৃত্তি বহির্ভূত অপর কোন মাধ্যমও থাকা উচিৎ,যার মাধ্যমে মানুষ হিদায়াত প্রাপ্ত হবে। কিন্তু হিদায়াত প্রাপ্তি দু টি শর্তে কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বাস্তবরূপ লাভ করে থাকে। একটি হল : ব্যক্তি স্বয়ং প্রভু কর্তৃক প্রদত্ত এ নিয়ামত বা অনুগ্রহ থেকে লাভবান হতে চাইবেন। অপরটি হল : অন্যরা এ হিদায়াতের পথে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন না। অধিকাংশ মানুষ স্বেচ্ছাচারিতার কারণে হিদায়াত প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন,তেমনি অপর সিংহভাগ আবার প্রচারের প্রসারে প্রতিবন্ধকতার ফলে বঞ্চিত হয়েছেন। আমরা জানি আল্লাহর প্রেরিত পূরুষগণ এ প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের জন্যে সদা সচেষ্ট ছিলেন এবং আল্লাহর শক্রদের সাথে,বিশেষ করে শক্তিধর ও দাম্ভিকদের সাথে সংগ্রামরত ছিলেন। আর আল্লাহর বাণী প্রচার ও মানুষকে হিদায়াতের পথে নবীগণের মধ্যে অনেকেই নিজ জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছিলেন। কোন কোন ক্ষেত্রে যদি অনুসারী ও সহযোগী সংগ্রহ করতে পারতেন তবে অত্যাচারী ও স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। আর এ অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী শ্রেণীই হল দ্বীনের প্রসারের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক।

এখানে স্মরণযোগ্য যে,মানবীয় উৎকর্ষের পথ স্বাধীন নির্বাচনাধীন হওয়ার অপরিহার্য অর্থ হল : এ সকল ঘটনাগুলো এমনভাবে রূপ পরিগ্রহ করবে যে,সুপথ ও কুপথের নির্বাচনের ক্ষেত্রে সত্যপন্থী ও মিথ্যাপন্থীদের জন্যে উম্মুক্ত থাকবে। তবে স্বৈরাচারী ও মিথ্যাবাদীর প্রভাব যদি এমন স্থানে পৌছে যে,অপরের হিদায়াতের পথ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায় এবং কোন সমাজে সত্যের আলোকবর্তিকা সম্পূর্ণরূপে নির্বাপিত হয়ে যায় তবে ঐ অবস্থায় মহান আল্লাহ কোন না কোন অদৃশ্য উপায়ে ও অসাধারণ পথে সত্যের অনুসারীগণকে সাহায্য করে থাকেন।

সিদ্ধান্ত : যদি এ ধরনের কোন প্রতিবন্ধকতা নবীগণের (আ.) প্রচারের পথে না থাকত তবে তাদের আহ্বান সকল বিশ্ববাসীর কর্ণগোচর হত এবং ওহী ও নবুয়্যতের মাধ্যমে এ হিদায়াতের ঐশী অনুগ্রহ থেকে উপকৃত হত। অতএব অধিকাংশ মানুষের হিদায়াত প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার অপরাধ তাদের উপরই বর্তায়,যারা নবীগণের আহ্বানের এবং প্রচার ও প্রসারের পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল।

২। যদি নবীগণ মানব সম্প্রদায়ের উৎকর্ষের পথকে সুগম করার জন্যে নবুয়্যত লাভ করে থাকেন তবে কেন তাদের আগমন সত্বেও এত অপরাধ ও অনাচারের উদ্ভব হয়েছে এবং অধিকাংশ মানুষ অধিকাংশ সময়ই কুফর ও গুণাহে লিপ্ত হয়েছে;এমনকি ঐশী ধর্মসমূহের অনুসারীদের পরস্পরের মধ্যেও শত্রুতা ও বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে এবং রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্বক যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে? মহান প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি কি এটা ছিল না যে,মহান আল্লাহ অন্য কোনভাবে এ সকল অনাচার ও বিশৃংখলার পথ রোধ করবেন যাতে ন্যূনতমপক্ষে ঐশীধর্মসমূহের অনুসারীগণ পরস্পর কলহে লিপ্ত না হয়?

জবাব : মানুষের স্বাধীন বিশেষত্বযুক্ত উৎকর্ষের উপর চিন্তা করলে উপরোক্ত প্রশ্নের জবাব স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। কারণ,যেমনটি বলা হয়েছে যে,প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি হল স্বাধীনভাবে (বাধ্যতামূলক নয়) উৎকর্ষ লাভের সকল ক্ষেত্র ও শতের্র যোগান দিবেন যাতে সত্যানুসন্ধিৎসুগণ সত্যপথ শনাক্ত করতঃ সে পথ পরিক্রমণের মাধ্যমে উৎকর্ষ ও সৌভাগ্য লাভ করতে পারে। কিন্তু এ ধরনের উৎকর্ষের জন্যে শর্ত ও কারণের উপস্থিতির অর্থ এ নয় যে,সকল মানুষ ঐগুলোর সদ্ব্যবহার করে বাধ্যতামূলক সঠিক পথ বেছে নিবে। পবিত্র কোরানের ব্যাখ্যানুসারে,মহান আল্লাহ মানব সম্প্রদায়কে সঙ্গত শর্তেই এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন যে,তাদের মধ্যে কারা উত্তম কর্ম সম্পাদন করে তা পরীক্ষা করবেন। অনুরূপ পবিত্র কোরানে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে যে,যদি মহান আল্লাহ চাইতেন তবে সকলকেই সরল পথে পরিচালনা করতে পারতেন এবং বিচ্যুতি ও বক্রতার পথকে সম্পূর্ণরূপে রোধ করতে পারতেন। কিন্তু এ অবস্থায় নির্বাচনের কোন সুযোগই অবশিষ্ট থাকত না এবং মানুষের আচরণ মানবিক মূল্যবোধ বর্জিত হত। আর সেই সাথে স্বাধীন ও নির্বাচন ক্ষমতার অধিকারী মানব সৃষ্টির পথে প্রভুর উদ্দেশ্য ব্যাহত হত।

সিদ্ধান্ত : অন্যায়,ব্যভিচার,কুফর ও গুণাহের প্রতি মানুষের ঝোঁক হল ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারিতারই প্রমাণবহ। আর এ ধরনের অসদাচরণের ক্ষমতা তার সৃষ্টি রহস্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে এবং ঐগুলোর আনুসঙ্গিক ফলাফল,তাদেরই অনুগামী। প্রভুর ইরাদা মূলতঃ মানুষের উৎকর্ষকেই সমন্বিত করলেও,যেহেতু এ সমন্বয় স্বাধীনতার শর্তাধীন,সেহেতু স্বেচ্ছাচারিতা থেকে উৎসারিত অধঃপতন ও বিচ্যুতিকে প্রতিহত করে না। সর্বোপরি প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি এ নয় যে,চাক বা না চাক স্বীয় চাওয়া পাওয়া ও ইরাদার বিরুদ্ধে সঠিক পথে পরিচালিত হবে ।

৩। প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি হল এই যে,মানব সম্প্রদায় অধিকতর ও উত্তমরূপে উৎকর্ষ ও সৌভাগ্যের দিকে এগিয়ে যাবে। তাহলে এটাই কি শ্রেয়তর নয় যে,মহান আল্লাহ প্রকৃতির রহস্যসমূহকে ওহীর মাধ্যমে মানুষের নিকট প্রকাশ করবেন যাতে বিভিন্ন প্রকার নেয়ামত লাভ করে মানুষ স্বীয় উৎকর্ষের পথে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে? যেমনকরে গত কয়েক শতাব্দীতে অনেক প্রাকৃতিক শক্তি,কারণ ও দৈনন্দিন সামগ্রীর আবিষ্কার সভ্যতার বিকাশে বিস্ময়কর ভূমিকা পালন করেছে এবং শারীরিক সুস্থতা ও বিভিন্ন ব্যাধির বিরুদ্ধে সংবাদ বিনিময়,যোগযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও অমূল্য পরিবর্তন এনেছে। এটা অনস্বীকার্য যে,নবীগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কারের মাধ্যমে ও সুখ-শান্তির উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে যদি মানুষকে সাহায্য করতেন তবে নিজেদের সামাজিক প্রভাব ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উত্তমরূপে তাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছতে পারতেন।

জবাব : ওহী ও নবুয়্যতের মূল প্রয়োজন ঐ সকল ক্ষেত্রেই,যেখানে মানুষ পরিচিতির সাধারণ মাধ্যম দ্বারা ঐগুলোকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয় এবং ঐগুলো সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার ফলে প্রকৃত উৎর্ষের পথ নির্ধারণ করে সে পথ পরিক্রমণে অপারগ হয়। অন্যকথায় : নবীগণের (আ.) মূল দায়িত্ব এই যে,মানব সম্প্রদায়কে সঠিক দিকনির্দেশনা পাবার ও উৎকর্ষ লাভের পথে সহায়তা করা যাতে সর্বাবস্থায় স্বীয় কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারে এবং কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছতে তাদের সকল শক্তি ও সামর্থ্য ব্যয় করতে সক্ষম হয় -হোক সে যাযাবর সম্প্রদায় ও খিমাবাসী কিংবা হোক মহাসাগর অভিযাত্রী ও মহাকাশচারী। কিন্তু তাদেরকে মানুষের প্রকৃত মূল্যবোধসমূহ সম্পর্কে জানতে হবে। জানতে হবে মহান আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে তাদের কী কর্তব্য বয়েছে,কী দায়িত্ব রয়েছে তাদের পরস্পরের প্রতি কিংবা স্বগোত্রের ও অন্য গোত্রের সৃষ্টের প্রতি,যাতে ঐ কর্তব্যগুলো যথাস্থানে সম্পাদনের মাধ্যমে প্রকৃত উৎকর্ষ ও অনন্ত সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারে। অপরদিকে শক্তি ও সামর্থ্যরে বিভিন্নতা,প্রাকৃতিক ও প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা কোন বিশেষ সময়ে বা বিভিন্ন কালে,কোন বিশেষ কারণানুসারে প্রকাশ লাভ করে এবং প্রকৃত উৎকর্ষ ও চিরন্তন ভাগ্যলিপির ক্ষেত্রে কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে না। যেমন : আজকের যুগের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি বস্তুগত ও পার্থিব উন্নয়নের কারণ হলেও,মানুষের আধ্যাত্মিক ও মানসিক উৎকর্ষের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলেনি। বরং নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে,এ কথা বললেও অত্যুক্তি হবে না।

সিদ্ধান্ত : প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি হল এই যে,মানব সম্প্রদায় বস্তুগত বৈভবসমূহকে ব্যবহার করে পার্থিব জীবন নির্বাহ করবে এবং বুদ্ধিবৃত্তি ও ওহীর মাধ্যমে স্বীয় পরিক্রমণের পথকে প্রকৃত উৎকর্ষ ও চিরন্তন সৌভাগ্যের দিকে পরিচালিত করবে। কিন্তু শারীরিক ও আত্মিক সামর্থের বিভিন্নতা;অনুরূপ প্রাকৃতিক ও সামাজিক শর্তসমূহের বৈচিত্রময়তা;তদনুরূপ জ্ঞান ও বিজ্ঞান থেকে লাভবান হওয়ার ক্ষেত্রে সাতন্ত্রিকতা ইত্যাদি একাধিক কারণ ও সুনিদিষ্ট শর্তের অধীন,যা কার্যকারণ বিধি মোতাবেক উৎপত্তি লাভ করে। আর এ বিভিন্নতা,মানুষের চিরন্তন ভাগ্যলিপি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা পালন করে না । বরং তা কতইনা উত্তম যে,কোন ব্যক্তি বা সমষ্টি এক অনাড়ম্ভর জীবনাতিবাহিত করেছেন এবং বৈষয়িক ও পার্থিব বৈভব থেকে ন্যূনতম স্বাদ গ্রহণ করেছেন। আর এমতাবস্থায় উৎকর্ষ ও সৌভাগ্যের সমুন্নত শিখরে স্থান লাভ করেছেন। অপরদিকে কতইনা হতভাগ্য সে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর,যারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও জীবন উপকরণের অধিকারী হওয়া সত্বেও অকৃতজ্ঞতা,দাম্ভিকতা ও অপরের প্রতি অত্যাচার ও অন্যায়ের ফলে নিকৃষ্টতম নরকে পতিত হয়েছে।

তবে আল্লাহ প্রেরিত পূরুষগণ মূল দায়িত্ব পালন (অর্থাৎ প্রকৃত উৎকর্ষ ও অনন্ত সৌভাগ্যের পথে পরিচালনা) ব্যতীত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় পার্থিব জীবন-যাপনের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিলেন এবং যেখানেই প্রভুর প্রজ্ঞা প্রয়োজন মনে করেছে সেখানেই কিছুটা হলেও অজ্ঞাত বাস্তবতা ও রহস্যের পর্দা উম্মোচন করেছে,যেমনটি হযরত দাউদ (আ.),সোলায়মান (আ.) ও যুলক্বারনাইনের (আ.) জীবদ্দশায় পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া আল্লাহর নবীগণ সমাজের তত্ত্বাবধান ও সফলভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রেও সচেষ্ট ছিলেন -যেমনটি হযরত ইউসূফ (আ.) মিশরে সম্পাদন করেছিলেন। কিন্তু এ সমুদয় কর্মের সবগুলোই ছিল তাদের মূল দায়িত্ব ভিন্ন বাড়তি খেদমত ।

অনুরূপ আল্লাহর নবীগণ তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে কোন বৈজ্ঞানিক,অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রয়োগ করেননি সেক্ষেত্রে বলতে হয় : নবীগণের (আ.) মূল লক্ষ্য (যেমনটি ইতিপূর্বেও একাধিকবার বলা হয়েছে) সচেতন ও স্বাধীনভাবে নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। আর যদি বল প্রয়োগের মাধ্যমে বিপ্লব করতে চাইতেন তবে মানুষের স্বাভাবিক আধ্যাত্মিক বিকাশলাভ ও স্বাধীনভাবে উৎকর্ষ লাভ ঘটত না। বরং জনগণ শক্তি ও চাপের নিকট আত্মসমর্পণ করে তাদের অনুসরণ করত -- প্রভুর প্রতি অনুরাগবশতঃ ও স্বাধীন নির্বাচনের মাধ্যমে নয়। আমীরুল মু'মেনীন আলী (আ.) এ প্রসঙ্গে বলেন :

যদি মহান আল্লাহ চাইতেন তবে নবীগণের আবির্ভারের সময় তাদের জন্যে স্বর্ণ-রৌপ্য ও মণিমুক্তার ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দিতেন,ফল-মূলে পরিপূর্ণ বাগান তাদের অধিকারে প্রদান করতেন এবং আকাশে উড্ডয়নরত পক্ষীকুল ও ভূমিতে বিচরণরত সকল কিছুকেই তাদের সেবায় নিয়োজিত করতেন। আর যদি তা-ই করতেন তবে পরীক্ষা ও পুরস্কারের ক্ষেত্র ব্যাহত হত এবং যদি চাইতেন নবীগণকে এমন দুর্লভ ক্ষমতা ও অটুট সম্মান,রাজ্য ও শাসনক্ষমতার অধিকারী করতেন যে,অন্যান্যরা লোভ ও ভীতির বশবর্তী হয়ে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করবে এবং দাম্ভিকতা ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে দূরে থাকবে,তবে ঐ অবস্থায় প্রবৃত্তি ও মূল্যবোধসমূহ এক সমান হত। কিন্তু মহান আল্লাহ এমনটি চেয়েছেন যে,নবীগণের (আ.) অনুসরণ,তাদের কিতাবসমূহকে স্বীকার করা ও তাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ নিখুতভাবে ও একমাত্র খোদাপ্রীতির ফলেই ঘটবে। আর পরীক্ষা যত বৃহত্তর হবে,প্রভু কর্তৃক প্রদত্ত পুরস্কার ও প্রতিদানের পরিমাণও ততবেশী বৃদ্ধি পাবে। তবে যদি কোন জনসমষ্টি স্বাধীন নির্বাচন ও অনুরাগের বশবর্তী ও সত্য ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আল্লাহর অনুগত সমাজ প্রতিষ্ঠা করে এবং ঐশী উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্যে বিশেষ করে অন্যায়,অত্যাচার নির্মূল করার জন্য ও মু'মেনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্যে বিভিন্ন শক্তি ও প্রতিপত্তির আশ্রয় নেয়,তবে তা অনাকাংখিত হবে না;যার উদাহরণ হযরত সোলায়মানের (আ.) শাসন ব্যবস্থায় পরিলক্ষিত হয়।


8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38