আহলে বাইত
নবী করিম (সা.)-এর আহলে বাইতকে ভালবাসার ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই । তবে আহলে বাইত কারা–
এ ব্যাপারে যথেষ্ট মতানৈক্য বিদ্যমান । মুসলমানদের কোন এক সম্প্রদায় আহলে বাইত বলতে শুধুমাত্র তার সম্মানীতা স্ত্রীগণকে বুঝিয়ে থাকেন । আবার অন্য এক সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র হযরত ফাতিমা , তার স্বামী ও সন্তানদ্বয়কে রাসুলের সাথে সংযোগ করে থাকেন । আবার নবী (সা.) এর আহলে বাইতের মধ্যে হযরত আব্বাস , আক্বীল ও জাফর তাইয়্যারকেও শামিল করে থাকেন ।
প্রকৃতপক্ষে আহলে বাইতের সদস্যগণ কারা ? এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে আমরা‘
আহল’
ও‘
বাইত’
শব্দদ্বয়ের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থের উল্লেখ করে মূল অর্থের দিকে দৃষ্টিপাত করবো।
আরবী অভিধানে‘
আহল’
এর অর্থ হচ্ছেঃ
اهل الرجال، عشیرته و ذو قرباه، جمع : اهلون و اهلان، و اهل یأهل یأهل اهولا تأهل و اتهل: اتخذ اهلا
অর্থাৎঃ-একটি পুরুষের পরিবার , তার আত্মীয়-স্বজন ,‘
আহল’
এর বহুবচন হচ্ছে‘
আহলুন’
অতীত কাল বুঝানোর জন্য‘
আহালা’
এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালের জন্যে‘
ইয়াহেলুন’
বা‘
ইয়াহালু’
ব্যবহৃত হয়ে থাকে । আর‘
আহুলান’
হচ্ছে মূল ক্রিয়া সূচক শব্দ ।‘
তায়াহহালা’
বা এত্তাহালার অর্থ হচ্ছে পরবিার গঠন করেন ।
و اهل الامر : ولایته وللبیت سکانه و للمذهب من یدیه به، و للرجل زوجته کأهلته. للنبی (ص) ازواجه و بناته و صهره علی (رضی الله عنه) او نسائه، و الرجال الذین هم و لکل نبی امنه
অর্থাৎঃ-কোন কাজের জন্যে আহল বলতে তার কতৃত্ব আর ঘরের জন্যে‘
আহল’
বলতে গৃহবাসীদের বুঝায় । মাযহাবের জন্য‘
আহল’–
এর অর্থ হচ্ছে মাযহাবের পরিচালক । একটা পুরুষের‘
আহল’
বলতে তার স্ত্রীকে বুঝানো হয় । নবী (সা.) এর জন্যে‘
আহল’
বলতে বুঝায় তার স্ত্রীবর্গ কন্যাগণ , তার জামাতা আলী (রাজীঃ) এবং ঘরের মহিলারা অতঃপর নবীদের আহল হচ্ছে তাদের উম্মত…………………
।
‘
আহল’
শব্দটি পবিত্র আল কোরআনে 54 বার ব্যবহার হয়েছে । প্রতিবারে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে এ শব্দটিকে ।‘
আহল’
শব্দের অর্থ কখনো শুধুমাত্র স্ত্রী ও সন্তান উভয়কেই বুঝানো হয়েছে আল-কোরআনে । কোথাও আবার আহল বলতে আত্মীয়-স্বজনকেও বুঝানো হয়েছে ।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ আল-কোরআনে আল্লাহ বলেনঃ
)
ف
َلَمَّا قَضَىٰ مُوسَى الْأَجَلَ وَسَارَ بِأَهْلِهِ آنَسَ مِن جَانِبِ الطُّورِ نَارًا قَالَ لِأَهْلِهِ امْكُثُوا إِنِّي آنَسْتُ نَارًا لَّعَلِّي آتِيكُم مِّنْهَا بِخَبَرٍ أَوْ جَذْوَةٍ مِّنَ النَّارِ لَعَلَّكُمْ تَصْطَلُونَ(
অর্থাৎঃ-অতঃপর যখন মূসা (আঃ) তার প্রতিশ্রুত কর্মের সময়সীমা অতিক্রম করেন তখন তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে স্বদেশ পানে যাত্রা করেন । পথিমধ্যে তুর পর্বতের সন্নিকটে আগুন দেখতে পেলেন। তিনি তার স্ত্রীকে বললেন , তোমরা অপেক্ষা কর , আমি আগুন দেখতে পাচ্ছি । সম্ভবতঃ আমি সেখান থেকে তোমাদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসতে পারি অথবা তোমাদের জন্য আগুনের ব্যবস্থা করতে পারি ।
উক্ত আয়াতে আল্লাহ দু’
বার‘
আহল’
শব্দ ব্যবহার করেছেন । এখানে‘
আহল’
শব্দের অর্থ স্ত্রী । উক্ত আয়াতে‘
আহল’
শব্দের উদ্দেশ্য হযরত মুসা (আ.) এর স্ত্রী অন্য কেউ নয় ।
আল-কোরআনে আল্লাহ বলেনঃ
)
إ
ِنَّا مُنَجُّوكَ وَأَهْلَكَ إِلَّا امْرَأَتَكَ كَانَتْ مِنَ الْغَابِرِينَ(
অর্থাৎঃ-“
নিশ্চয় আমি তোমাকে (হযরত লুত আ.) এবং তোমার পরিবারকে নাজাত দিব , তোমার স্ত্রী ব্যতীত , কেননা সে অভিশপ্ত এবং পশ্চাদপদের শিকার ।
উক্ত আয়াতে আল্লাহ পাক‘
আহল’
বলতে স্ত্রী , পরিবার পরিজন , সন্তান-সন্তুতি সকলকে বুঝিয়েছেন । যদিও লুতের স্ত্রীকে আল্লাহ অভিশপ্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন ।
আল্লাহ অন্যত্র হযরত লুত (আ.) সম্পর্কে বলেনঃ
)
و
َنَادَىٰ نُوحٌ رَّبَّهُ فَقَالَ رَبِّ إِنَّ ابْنِي مِنْ أَهْلِي وَإِنَّ وَعْدَكَ الْحَقُّ وَأَنتَ أَحْكَمُ الْحَاكِمِينَ قَالَ يَا نُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ(
অর্থাৎঃ-“
নূহ (আঃ) তাঁর প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করলো-হে আমার প্রতিপালক , আমার পুত্র তো আমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ; আর আপনার ওয়াদাও নিঃসন্দেহে সত্য আর আপনিই সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ ফয়সালাকারী । (আল্লাহ) বলেন , হে নূহ! নিশ্চয় সে (তোমার পুত্র) তোমার পরিবারভুক্ত নয়। নিশ্চই সে অসৎ!
এক্ষেত্রে‘
আহল’
অর্থ ঐ ব্যক্তির পদাংক অনুসরণকারী পরিবারের সদস্য । এ কারণে আল্লাহ হযরত নুহ (আ.) এর পুত্রকে তার আহল এর মধ্যে গন্য করেননি । কেননা সে অসৎ কাজে লিপ্ত ।
উপসংহারে বলা যায়‘
আহল’
শব্দের একক কোন অর্থ নেই । স্থান ভেদে এর অর্থ বিভিন্ন হতে পারে ।
আর‘
বাইত’
শব্দও কোরআন ও হাদীসের বহু স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে ।‘
বাইতের’
অর্থও বিভিন্ন ধরণের । কোথাও‘
বাইত’
অর্থ মসজিদুল হারাম আবার কোথাও মসজিদুন্নাবী ইত্যাদি বুঝানো হয়েছে ।
তবে আল-কোরআনের‘
বাইত’
শব্দ‘
আহল’
শব্দের সাথে সংযোগ করে ব্যবহৃত হয়েছে দু’
বার ।
সূরা হুদে আল্লাহ বলেন ,
)
ر
َحْمَتُ اللَّـهِ وَبَرَكَاتُهُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ(
অর্থাৎঃ-আল্লাহর রহমত ও বরকত আহলে বাইতের উপর বর্ষিত ।
সূরা আহযাবে আল্লাহ আরো বলেন ,
)
إ
ِنَّمَا يُرِيدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا(
অর্থাৎঃ-আল্লাহ মনস্থ করলেন তোমাদেরকে সমস্ত প্রকার অপবিত্রতা থেকে দূরে রাখতে হে আহলে বাইত এবং মনস্থ করলেন তোমাদেরকে পুত-পবিত্র করতে ।
মহানবী (সা.) এর হাদীসেও‘
আহলে বাইত’
শব্দটি বহুল ব্যবহৃত হয়েছে । শিয়া-সুন্নি উভয় মাযহাবের বর্ণিত হাদীসগুলোতে প্রায় 80 পন্থায়‘
আহলে বাইত’
শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে । তার পরও মুসলমানদের মধ্যে আহলে বাইতের সংজ্ঞা ও অর্থ এবং সদস্যদের ব্যাপারে যথেষ্ট মতপার্থক্য ও অস্পষ্টতা বিদ্যমান । মুসলমানরা তাদের নিজ নিজ মাযহাবের পক্ষে আহলে বাইতের অর্থ করেই দায়িত্ব সমাপ্ত করে থাকেন । অনেকে বলে থাকেন , তাতহীরের আয়াতে উল্লেখিত আহলে বাইতের উদ্দেশ্য বনি হাশিমের লোকজন । আবার অনেকের মতে বনি হাশিমের মু’
মিন সন্তানগণ অর্থাৎ আব্দুল মুত্তালিবের সন্তান ব্যতীত অন্য কেউ আহলে বাইতের মধ্যে গন্য নয় ।
আবার কেউ কেউ বলেন , আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব ও তার সন্তানরা শুধুমাত্র আহলে বাইতের সদস্য ।
কোন এক মুসলিম সম্প্রদায় বলেন , রাসুলের (সা.) সম্মানিতা স্ত্রীগণ , হযরত আলী ইবনে আবি তালিব , হযরত ফাতিমা , হযরত হাসান ইবনে আলী ও হযরত হুসাইন ইবনে আলী আহলে বাইতের সদস্যবৃন্দ ।
অনেকে বলেন , নবীর স্ত্রীরা শুধুমাত্র আহলে বাইতের মধ্যে গন্য । কেননা আকরামাহ বিন আব্দুল্লাহ নাজদাহ আল হারুরী-যিনি আলীর সাথে শত্রুতার ক্ষেত্রে অন্যান্যদের অতিক্রম করেছে , সে‘
নবীর (সা.) স্ত্রীগণ শুধুমাত্র আহলে বাইতের সদস্য বলে প্রচার করত । সে আরো বিশ্বাস করত খারেজী দল বহির্ভূত সকল মুসলমান কাফের । হজ্বের সময় সে চিৎকার করে বলত ,‘
যদি আমার হাতে শক্তি থাকতো তাহলে আমার ডানে বায়ে যত লোক আছে তাদের সকলকে হত্যা করতাম ।’
সে মসজিদুল হারামে দাড়িয়ে উচ্চস্বরে ধ্বনি দিত ,‘
এখানে কাফের ব্যাতীত অন্য কেউ নেই ।’
তার আক্বিদা-বিশ্বাসের মধ্যে আরেকটি দিক হলো যে সে বিশ্বাস করত ,
انما انزل الله متسابه القرآن لیضل به
অর্থাৎঃ আল্লাহ কোরআনের‘
মুতাশাবেহ’
আয়াতগুলো মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য অবতীর্ণ করেছেন ।
সে সমসাময়িক কালে মিথ্যাবাদী বলে খ্যাতি লাভ করেছিল । আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব ও ইবনে মাসউদ বলেছেন ,‘
আকরামার হাদীস জালকারী ও মিথ্যাবাদী বলে কুখ্যাতি আছে ।’
ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল আনসারী তার সম্পর্কে বলেছেন , সে একজন মিথ্যাবাদী ।
আকরামার ন্যায় আরো একজন ব্যক্তি নবীর (সা.) স্ত্রীগণকে শুধুমাত্র আহলে বাইতের মধ্যে শামিল করেছেন । তিনি হচ্ছেন মাক্বাতিল ইবনে সুলাইমান আল-বালখী আল আযুদী আল খোরাসানী । তিনি তৌহিদ ও রেসালাতের ব্যাপারে অনেক আপত্তিমূলক বক্তব্য পেশ করেছেন যা আহলে সুন্নাতের আক্বিদার সম্পূর্ণ পরিপন্থি ।
আকরামাহ ও মাক্বাতিল বিন সুলাইমান সূরা আহযাবের 33 নং আয়াতে উল্লেখিত আহলে বাইতের মধ্যে শুধুমাত্র নবীর (সা.) স্ত্রীগণকে গন্য করেছেন । যদিও আমরা উক্ত আয়াতের পূর্ববর্তী দু’
টি আয়াতে নবীর স্ত্রীগণের ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাবধান বাণী পরিলক্ষিত করি । তাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেননি যে তারা সমস্ত ধরণের অপবিত্রতা থেকে মুক্ত । বরং তিনি আল কোরআনে উল্লেখ করেছেনঃ
)
ي
َا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِّنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُ(
অর্থাৎঃ হে নবীর স্ত্রীগণ , তোমরা তো অন্যান্য নারীদের মত নও যদি আল্লাহকে ভয় কর ।
যদি নবীর (সা.) স্ত্রীরা পবিত্র এবং সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে মুক্ত হতেন তাহলে আল্লাহ কখনো তাদের উল্লেখ করে এ ধরণের বক্তব্য পেশ করতেন না । সাথে সাথে নিম্নের আয়াতটিও যথার্থ বলে পরিগণিত হতো না ।
আল্লাহ বলেনঃ
)
ي
َا نِسَاءَ النَّبِيِّ مَن يَأْتِ مِنكُنَّ بِفَاحِشَةٍ مُّبَيِّنَةٍ يُضَاعَفْ لَهَا الْعَذَابُ ضِعْفَيْنِ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّـهِ يَسِيرًا(
অর্থাৎঃ-হে , নবীর স্ত্রীগণ , তোমাদের মধ্যে যে প্রকাশ্য কোন অপবিত্র কাজে লিপ্ত হয় তার আযাব ও শাস্তি অন্যদের চেয়ে দ্বিগুন পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে এবং আল্লাহর জন্যে এ কাজ খুবই সহজ ।
আর যদি নবীর (সা.) স্ত্রীগণ সকল পাপ-পংকিলতা থেকে মুক্ত হবেন তাহলে নবীকে (সা.) কষ্ট দেয়া কি পবিত্রতার পরিপন্থি নয় ?
আল বুখারী তার স্বীয় সহিহাতে এভাবে বর্ণনা দিচ্ছেন ,
انّ النبی هجر عایشة و حفصة شهرا کاملا و ذلک بسبب افشاء حفصة الحدیث الذی اسراه لها الی عایشة، قالت للنبی: انّک اقسمت ان لا تدخل علینا شهرا ؟
অর্থাৎঃ- নবী (সা.) পূর্ণ এক মাস আয়েশা ও হাফসাকে বয়কট করেছিলেন । এটা এ কারণে যে হাফসা নবীর গোপন কথা আয়েশার কাছে ফাস করে দিয়েছিল । আয়েশা নবীকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ আপনি নাকি প্রতিজ্ঞা করেছেন একমাস আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখবেন না ?
সহি আল-বুখারীতে অন্যত্র এভাবে উল্লেখ আছে যে , ইবনে আব্বাস বলেছেনঃ
ابن عباس یقول: لم ازل حریصا علی ان عمر بن خطاب عن المراتین من ازواج النبی (ص) التین قال الله تعالی فیها: ان تتوبا الی الله فقدصغت قلوبکما
অর্থাৎঃ-আমি ওমর বিন খাত্তাবকে সে দু’
জন নবীপত্নীর ব্যাপারে প্রশ্ন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছিলাম , যাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেনঃ যদি তারা দু’
জন আল্লাহর কাছে তওবা করে তাহলে সে কাজটিই সঠিক হবে । কেননা তোমাদের দু’
জনের অন্তর (বাতিলের দকে) ঝুকে গিয়েছিল ।
অতঃপর আল-বুখারী এভাবে বর্ণনা দিচ্ছেনঃ
حتی حج و حججت معه.....................حنی قال ابن عباس، فقلت للخلیفه: من المراتین؟ فقال عمر بن خطاب:و اعجب لک یا ابن عباس ! هما عایشة و حفصة
অর্থাৎঃ- (ইবনে আব্বাস বলেন) ইতিমধ্যে তিনি (হযরত ওমর) হজ্জ সম্পন্ন করেন আর আমিও তার সাথে হজ্জ আদায় করি ।………
.ইবনে আব্বাস বলেনঃ আমি খলিফাকে জিজ্ঞেস করলাম ঐ দু’
জন মহিলা কারা ছিলেন ? ওমর বিন খাত্তাব উত্তর দিলেনঃ আশ্চর্য তো , তুমি তা জান না হে ইবনে আব্বাস ! তারা হলেন আয়েশা ও হাফসা…………………
.
বিখ্যাত সুন্নী আলেম ও তাফসীরকারক আল্লামা ফাখরে রাযী তার তাফসীর গ্রন্থ‘
তাফসীর আল-কাবির’
-এ সূরা তাহরীমের চতুর্থ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন যে , এ আয়াতটি হযরত আয়েশা ও হাফসাকে সম্বোধন করে নাযিল হয়েছে ।
অন্যত্র এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে ,
ها هی عایشة تعقبها للنبی (ص) بعد ما فقدته فی لیالی نوبتها و قوله (ص) لها ما لک یا عایشة ! اغرت ؟ فقالت: و ما لی ان لا یغار مثلی علی مثلک ؟ فقال لها افاخذک شیطانک ؟ !
অর্থাৎঃ- যখন আয়েশা কয়েক রাত্র নবী (সা.) এর অনুপস্থিতি ও তার পালা অতিক্রম হওয়ায় চুপিসারে হযরতের পিছু লেগেছিল তখন মহানবী (সা.) তাকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ তোমার কি হয়েছে হে আয়েশা ? তুমি কেন আমাকে শুধু তোমার জন্য মনে করছো ? আয়েশা বলেনঃ আমার মত মানুষ কি আপনার মত ব্যক্তির ব্যাপারে ইর্ষা করতে পারে না ? অতঃপর নবী (সা.) তাকে বললেনঃ তোমাকে কি তোমার শয়তানে ধরেছে ?
এভাবে প্রিয় নবী (সা.) এর পিছু লাগা এবং মহানবীর (সা.) উক্তি‘
তোমাকে কি তোমার শয়তান ধরেছে ?’
কোনক্রমেই সূরা আহযাবের 33 নং আয়াতে উল্লিখিত‘
আহলে বাইতকে আল্লাহ সমস্ত প্রকার অপবিত্রতা থেকে তুরে রেখেছেন এবং তাদেরকে পুত পবিত্র করেছেন ;- উক্তির সাথে সংগতিপূর্ণ হতে পারে না ।
হযরত আয়েশা নবী করিম (সা.) এর অমীয় বাণী ও ঐতিহাসিক নির্দেশ অমান্য করে‘
হাওয়াব’
নামক স্থান অতিক্রম করে আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন । ইতিহাসে এ যুদ্ধ“
জঙ্গে জামাল”
বা“
উষ্টের যুদ্ধ”
নামে অভিহিত । এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের বহু সাহাবী তাবেয়ীন ও হাফেজ-ক্বারী হতাহত হন । এ যুদ্ধের কারণ উদঘাটন করলেই বিবেকবান মানুষ মাত্রই উপলদ্ধি করতে পারবেন যে মা আয়েশা যদি কোরআনের পরিভাষায়‘
রেজস’
বা অপবিত্রতা থেকে মুক্ত থাকতেন তাহলে কখনো এ যুদ্ধ সংঘটিত হত না । এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ সম্বন্ধে অবগত হবার জন্য পাঠকদের নিম্নলিখিত পুস্তকগুলো অধ্যায়নের অনুরোধ করছি ।
1. কামেল ফি আত তারিখ , খণ্ড-3 , পৃঃ-107 ।
2. আল ফুতুহ , খণ্ড-1 , অধ্যায়-2 , পৃঃ-456 ও 457 ।
3. আনসাব আল আশরাফ , খণ্ড-2 , পৃঃ-228 , কায়রো ।
4. আত তাবাক্বাত আল কোবরা , খণ্ড-3 , পৃঃ-31 , বৈরুত ।
5. কানযুল উম্মাল , খণ্ড-3 , পৃঃ-161 ।
6. মুসনাদে আহমাদ , খণ্ড-6 , পৃঃ-97 , রৈুত ।
7. মাজমুআ আয-যাওয়ায়েদ , খণ্ড-7 , পৃঃ-34 ।
8. সহি আল বুখারী , কিতাব বিদয় আল খালক ।
9. সহি আল বুখারী , কিতাব আল জিহাদ ওয়াল মিযার বাবে আয়ওয আন নাবী , খণ্ড-4 , পৃঃ-46 ; খণ্ড-2 , পৃঃ-125 ।
10. সহি মুসলিম , খণ্ড-2 , পৃঃ-560 ; খণ্ড-8 , পৃঃ-181 , মিশর , শেবকাত এলাহিয়া , শারহেন নাবাবী ।
তাছাড়াও হযরত আয়েশা হযরত ওসমানকে কাফের ফতোয়া দিয়ে জনগণকে নির্দেশ দিয়েছিলেন খলিফাকে হত্যা করতে । তার ঐতিহাসিদ ফতোয়া ইতিহাস গ্রন্থসমূহে এভাবে উল্লেখ আছে যে তিনি বলেছেন ,
اقتلو نعثلا فقد کفر
অর্থাৎঃ- না’
সালকে হত্যা কর সে কাফের হয়ে গেছে ।
তিনি হযরত ওসমানকে না’
সাল বলে একজন ইয়াহুদী বৃদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন ।
আবার কোন কোন ইতিহাস গ্রন্থে এভাবে বর্ণীত আছে যে , তিনি ওসমানকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন ,
اقتلو نعثلا فقد فجر
অর্থাৎঃ- না’
সালকে হত্যা কর সে ফাজের হয়ে গেছে ।
এত কিছুর পর কি করে তাতহীরের পবিত্র আয়াতটিতে উল্লেখিত আহলে বাইতের মধ্যে নবী (সা.) এর স্ত্রীগণও গণ্য হতে পারেন ?
বস্তুতঃ যদি আমারা তাফসীর ও হাদীস গ্রন্থাবলী পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখতে পাবো যে , সেখানে আহলে বাইত বলতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত আলী ইবনে আবি তালিব , হযরত ফাতিমা , হযরত হাসান ইবনে আলী ও হযরত হুসাইন ইবনে আলীকে বোঝানো হয়েছে । এ ধরণের হাদীসের সংখ্যা প্রচুর । তথাপি আমার সংক্ষিপ্ততার প্রতি দৃষ্টি রেখে নিম্নে বহুল উল্লেখিত ও প্রচারিত কয়েকটি হাদীস সম্মানিত পাঠকবৃন্দের জন্য উপস্থাপন করলাম । নিরপেক্ষ মন ও মুক্ত চিন্তা নিয়ে বিবেচনা করার অনুরোধ রইল ।
একঃ
নবী পত্নী উম্মে সালমা থেকে বর্ণীত আছে যে তিনি
)
إ
ِنَّمَا يُرِيدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا(
আয়াতটির শানে নুযুল বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন ,“
এ আয়াতটি আমার গৃহে অবতীর্ণ হয়েছে । তখন আমার গৃহে সাতজন লোক ছিলেন । তারা হলেনঃ জিবরাইল (আ.) , মিকাইল (আ.) , নবী (সা.) , আলী , ফাতিমা , হাসান ও হুসাইন । আর আমি ছিলাম দরজার মুখে । আরজ করলাম , ইয়া রাসুলুল্লাহ আমি কি আহলে বাইতের মধ্যে গন্য নই ? উত্তরে তিনি বললেনঃ (না , এরকম নয়) নিশ্চয় তুমি মঙ্গল পথের যাত্রী , তুমি আমার স্ত্রীদের মধ্যে গণ্য ।
দুইঃ
আব্দুল্লাহ বিন জা’
ফর বিন আবি তালিব থেকে বর্ণীত আছে যে তিনি বলেছেন ,
کما نظر رسول الله (ص) الی رحمه هابطه، قال: ادعو لی، ادعو لی ! فقالت صفیحه- بنت حیی بن اخطب زوجه رسول الله (ص): من یا رسول الله ؟ قال (ص): اهل بیتی: علیا و فاطمة و الحسن و الحسین
অর্থাৎঃ একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) জিবরাইল (আ.) এর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন । তিনি বলেন , তাদেরকে আমার নিকট ডেকে আন , তাদেরকে আমার নিকট ডেকে পাঠাও ! সাফিয়্যা (নবী পত্নী , হুয়িয়্যা বিন আখতারের কন্যা) প্রশ্ন করলেনঃ কাদের কথা বলছেন হে আল্লাহর রাসুল ? প্রতিত্তোরে তিনি বললেনঃ তারা আমার আহলে বাইত-আলী , ফাতিমা , হাসান ও হুসাইন ।
তিনঃ
আনাস বিন মালেক থেকে বর্ণীত হেয়েছে যে তিনি বলেছেন ,“
রাসুলুল্লাহ (সা.) ছয় মাস পর্যন্ত ফজর নামাজের সময় ফাতিমার গৃহের নিকট থেকে অতিক্রম করতেন এবং বলতেনঃ
الصلاة یا اهل البیت،)
إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا
(
অর্থাৎঃ-হে আহলে বাইত , সালাম ও দরুদ তোমাদের উপর । নিশ্চয় আল্লাহ মনস্থ করেছেন তোমাদের কাছ থেকে সকল প্রকার অপবিত্রতা দূরীভূত করতে হে আহলে বাইত এবং মনস্থ করেছেন তোমাদেরকে পুত-পবিত্র করতে ।
চারঃ
মুসলিম তার সহিহাতে এভাবে লিপিবদ্ধ করেছেনঃ যখন অবতীর্ণ হল নিম্নলিখিত আয়াতটি
)
ف
َقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنفُسَنَا وَأَنفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَل لَّعْنَتَ اللَّـهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ(
অর্থাৎঃ বল (হে নবী)-এসো , আমরা আমাদের সন্তানদের , মহিলাদের এবং নিজেদেরকে ডেকে আনি আর তোমারাও তাই কর । অতঃপর (এসো) চ্যালেঞ্জ করি আর মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষন করি ।
তখন মহানবী (সা.) আলী , ফাতিমা , হাসান ও হুসাইনকে ডেকে আনলেন । তিনি বললেনঃ
الهی هولاء اهلی
অর্থাৎঃ হে আল্লাহ এরা আমার আহলে বাইত ।
পাঁচঃ
সহি তিরমিযি গ্রন্থে নিম্নলিখিতভাবে বর্ণীত আছেঃ
তাতহীরের আয়াত নাযিল হবার পর থেকে ছয় মাস পর্যন্ত প্রতিদিন যোহর নামাজের সময় আল্লাহর রাসুল ফাতিমার গৃহে আগমন করে উক্ত আয়াত পাঠ করতেন । প্রিয় নবী (সা.) উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময় বলেছেনঃ
اللهم اهل بیتی و خاصتی فاذهب عنهم الرجس و طهرهم تطهیرا
অর্থাৎঃ হে আল্লাহ আমার আহলে বাইত থেকে তুমি সকল অপবিত্রতা দূরীভূত কর এবং পূত-পবিত্র কর ।
ছয়ঃ
সহি মুসলিম ও জামেয় উসূল গ্রন্থদ্বয়ে এভাবে বর্ণীত আছে যে , হাসীন বিন সামারাহ যায়েদ বিন আরকামকে জিজ্ঞেস করলেন , নবীর পত্নীগণও কি আহলে বাইতের মধ্যে গণ্য ? তিনি উত্তরে বললেন , আল্লাহর শপথ , না এরকম নয় । কেননা স্ত্রী জীবনের কিছু সময় স্বামীর সাথে অবস্থান করে । অতঃপর স্বামী তালাক দিয়ে দিলে সে তার পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজনের কাছে প্রত্যাবর্তন করে এবং স্বামী থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক হয়ে যায় । কিন্তু রাসুলের আহলে বাইত এমন সব ব্যক্তিবর্গ যাদের জন্য সাদকা গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে , তারা যেখানেই যান না কেন কখনো পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারেন না ।
সাতঃ
অন্যত্র এরূপ উল্লেখ আছে যে , তাতহীরের আয়াত পাঁচজন তথা নবী (সা.) , হযরত আলী ইবনে আবি তালিব , হযরত ফাতিমা , হযরত হাসান ইবনে আলী ও হযরত হুসাইন ইবনে আলীর জন্য অবতীর্ণ হয়েছে ।
আটঃ
বুখারী ও মুসলিম উভয়েই হযরত আয়েশার সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে , মুসআব বিন শাইবাহ তার বোন সাফিয়্যা থেকে বর্ণনা করেছেন , তিনি হযরত আয়েশা থেকে বর্ণনা করেছেনঃ‘
একদা রাসুল (সা.) একটি কালো আ’
বা পরিধান করে গৃহের বাইরে আসলেন । পথিমধ্যে হাসান ইবনে আলীর সাথে দেখা হল । তিনি হাসানকে স্বীয় আ’
বার ভিতর প্রবেশ করালেন । অতঃপর হুসাইন ইবনে আলী আগমন করলে তাকেও পূর্বানুরূপভাবে তার আ’
বার ভিতরে নিয়ে নিলেন । অতঃপর ফাতিমা ও আলী ইবনে আবি তালিব আগমন করলে তারাও নবীর আ’
বার ভিতরে প্রবেশ করলেন । আর পরক্ষণে তিনি নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করেনঃ
)
إ
ِنَّمَا يُرِيدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا(
অর্থাৎঃ-নিশ্চিয়ই আল্লাহ মনস্থ করলেন তোমাদের নিকট থেকে সমস্ত প্রকার অপবিত্রতা থেকে দূরীভূত করতে হে আহলে বাইত এবং মনস্থ করলেন তোমাদেরকে পুত-পবিত্র করতে ।