গাদীরেখুমের
ঘটনা
হিজরী দশম বছর । রাসূল ( সা .) বিদায় হজ্ব সম্পন্ন করেছেন । এ নশ্বর পৃথিবী থেকে শেষ বিদায়ের জণ্যে প্রহর গুনছেন । প্রথম থেকে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন এ বৎসর তিনি শেষ হজ্ব সমাপন করবেন । চতুর্দিক থেকে নবীর সাথে হজ্বে অংশগ্রহনের জন্যে অশংখ্য লোকের সমাগম হয়েছিলো । ঐতিহাসকিদের মধ্যে হাজীদের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে । সর্বাপরী 90 হাজার থেকৈ 124 হাজার মানুষের সমাগম ইতিহাসে উল্লেখ আছে । এ বৎসর তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দান করেন যা“
বিদায় হজ্বের ভাষণ”
নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে ।
হজ্ব সমাপ্ত করে তিনি আসহাবকে সাথে নিয়ে মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেছেন । প্রচন্ড গরম , মাটি ফেটে চৌচির । পথিমধ্যে‘
গাদীরে খুম’
নামক চৌরাস্তায় এসে তিনি থেমে গেলেন । এখানেই ঘটেছে সেই ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ গাদীরে খুমের ঘটনা । শীয়া - সুন্নী নির্বিশেষে সকল এতিহাসিক ও হাদীস বিশারদ এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে তাদের স্ব - স্ব গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন ।
নবী করিম ( সা .) তার কয়েকজন ঘনিষ্ট সাহাবীদের নির্দেশ দিলেন এ স্থানে সকলকে সমবেত করতে । যারা এখনো পিছে পড়ে আছে তাদের জন্যে অপেক্ষা করতে বললেন । যারা সিরিয়া ও ইরাক অভিমুখে এ চৌরাস্তা থেকে রওয়ানা হয়ে গেছেন তাদেরকে এ স্থানে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন । উত্তপ্ত বালুকাময় পথঘাট লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল কিছুক্ষনের মধ্যেই ।
নবী ( সা .)- এর জন্যে আসন প্রস্তুত করা হল । আসনের উপর সামিয়ানা টাংগানো হল । আসনটি এমন ভাবে উচু করে নির্মান করা হলো যেন বহুদূর থেকেও সকলে সুন্দরভাবে নবী করিম ( সা .) কে দেখতে পায় ।
এমনকি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার জন্যে নবী ( সা .) আসহাব ও হাজীদের কষ্ট দিবেন ? গাদীরে খুমে অবস্থান এবং ভাষণ দেয়ার জন্যে আসন তৈরী করার যে কারণ নিহিত আছে তাহলো অব্যবহিত পূর্বে অবতীর্ণ হওয়া নিম্ন আয়াত
)
ي
َا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ(
অর্থাৎঃ“
হে রাসূল আপনার রবের নিকট থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা পৌছিয়ে দিন । আর যদি এ কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম না হন তা হলে রেসালাতের দাওয়াত - ই পৌছাতে পারলেন না । আল্লাহ মানুষের অনিষ্ট থেকে আপনাকে রক্ষা করবেন । নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফের জনগোষ্ঠিকে হেদায়েত করবেন না ।
উপরোল্লিখিত আয়াতটিতে রাসূল ( সা .) কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ আয়াতটি অবতীর্ণ করেছেন । নিশ্চয়ই এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা শুধুমাত্র তিনি নবীকেই অবগত করিয়েছেন । আর তা এক্ষনে মানুষের সমক্ষে পেশ করতে হবে ? এমন কি আবতির্ণ করা হয়েছে যা এভাবে ব্যাবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যক্ত করতে হবে ? সূরা মায়েদা হচ্ছে নবী ( সা .) এর উপর অবতীর্ণ সর্বশেষ সূরা । এ সূরাটি নবীর শেষ জীবনে নাযিল হয়েছে । ইতিপূর্বে তৌহীদ , শেরক , রেসালাত , ক্বিয়ামত , নামাজ , রোজা , হজ্ব , যাকাত ইত্যাদি সব ধরণের বিষয়ে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল । এমন কি বিষয় অবশিষ্ট রয়ে গেছে যা কোন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিতে হবে ? রাসূল ( সা .) তো কোন ভীতু ব্যক্তি নন । তিনি কঠোর বিপদেও মু’
মিনদের সান্তনাকারী ছিলেন । তিনি সকল ধরণের বিপদ সংকুল পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন অবশেষে তিনি মক্কা বিজয় করেছেন , বীর দর্পে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেছেন বিজয়ীর বেশে । কাবার মুর্তিগুলোকে তিনি ভেঙ্গে সেখানে নামাজ ক্বায়েম করেছেন ।
আল্লাহ তাকে এ আয়াতে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে দিচ্ছেন , যদি এ কাজটি আঞ্জাম দেয়া না হয় তাহলে রেসালাতের কোন কিছুই পৌছানো হলো না । এটা এমন একটা কাজ যার ফলে রেসালাত পরিপূর্ণ হবে । আর আল্লাহ রাসূলকে অভয় দিয়ে বলছেন“
আল্লাহ তোমাকে মানুষের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন ।”
মুলতঃ একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার জন্যেই প্রিয় নবী ( সা .) সবাইকে গাদীরে খুমে সমবেত হতে বলেছেন । মহানবী ( সা .) তার আসন অলংকৃত করেছেন । তিনি ভাষণ দিচ্ছেনঃ
“………………
হে মানব মন্ডলী । আমি কি সকল মু’
মিনদের চেয়ে সর্বোত্তম নেতানই ?
…
.. তোমরা কি জানোনা আমি প্রতিটি মু’
মিনের প্রানের চেয়েও প্রিয় নেতা……
..?
”
তখন সকলে সমস্বরে বলে উঠলো , জ্বি ইয়া রাসূল আল্লাহ”
!…
. অতঃপর তার পার্শ্বে উপবিষ্ট হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের হাত সকলের সম্মুখে উচু করে তুলে ধরলেন । ঐতিহাসিকগণ বলেন , নবী ( সা .) হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের হাত এমনভাবে উচুতে তুলে ধরেছিলেন যে তাদের উভয়ের বাহুমুলদ্বয় সবাই দেখতে পেয়েছেন ।
অতঃপর মহানবী ( সা .) বললেনঃ
”
ایها الناس! الله مولای و انا مولاکم، فمن کنت مولاه فهذا علی مولاه، اللهم وال من والاه و عاد من عاداه و انصر من نصره و اخذل من خذله............."
অর্থাৎঃ“
হে লোকসকল ! আল্লাহ আমার প্রভূ ও নেতা , আর আমি তোমাদের নেতা বা মওলা । সুতরাং আমি যার মওলা বা অভিভাবক আলীও তার মওলা বা অভিভাবক । হে আল্লাহ যে আলীকে ভালবাসে তুমিও তাকে ভালবাস , যে আলীর সাথে শত্রুতা পোষণ করে তুমিও তাকে শত্রু গণ্য কর । আর যে তাকে সাহায্য করে তুমিও তাকে সহায়তা দান কর এবং যে তাকে ত্যাগ করে তুমিও তাকে পরিত্যাগ কর…………
.।”
পরক্ষণই অবতীর্ণ হলো নিন্মোক্ত আয়াতটিঃ
)
ال
ْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا(
অর্থাৎঃ“
আজকে তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং দ্বীন ইসলামের ব্যাপারে সন্তুষ্ট হলাম ।
সাথে সাথে রাসূল (সা .) বলেনঃ
الله اکبر علی اکمال الدین و اتمام النعمة و رضا الرب بر سالتی و الولایه لعلی
অর্থাৎঃ“
আল্লাহু আকবার , দ্বীন পরিপূর্ণতা লাভ করেছে এবং নেয়ামত সম্পূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে । আমার রব আমার রেসালাত ও আলীর বেলায়াতের ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়েছেন ।”
অতঃপর সকলে পর্যায়ক্রমে আলীকে অভিন্দন জ্ঞাপন করতে লাগলেন । ইত্যবসরে হযরত ওমর বলে উঠেলেন ,
هنیئا لک یا ابن ابی طالب اصبحت و امسیت مولی کل مؤمن و مؤمنه.
অর্থাৎঃ“
শুভ হোক আপনার জন্যে হে আলী বিন আবি তালিব । আজ থেকে আপনি সকল মুমিন নর নারীদের মওলা হিসেবে পরিগণিত হলেন ।”
অন্য রেওয়ায়েত এরূপ আছে যে , হযরত ওমর বলেছেন ,
بخ بخ لک یا ابن ابی طالب
অর্থাৎঃ মারহাবা , ,মারহাবা হে আবু তালিবের পুত্র ।
গাদীরে খুমের এ ঐতিহাসিক ঘটনাটি 110 জন সাহাবী , 10জন সর্বজন শ্রদ্ধেয় তাবেয়ী এবং 360 জন বিশিষ্ট ওলামা ও ইসলামী চিন্তাবিদ সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন । এ ঘটনাটির বর্ণনা সর্বস্তরের ইতিহাসবেত্তাগণ তাদের স্ব -স্ব পুস্তকে সহি হাদীস বলে আখ্যায়িত করেছেন । ইয়াক্বুবী এটাকে সুস্পষ্ট সহি হাদীস হিসাবে উল্লেখ করেন । পাঠকের গবেষণার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিম্নে কয়েকটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি মাত্র ।