হযরত আলী (আ.) এর দৃষ্টিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)
মূল আরবী থেকে মোঃ মুনীর হোসেন খান কর্তৃক অনূদিত
মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি , সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)। মহান আল্লাহ যদি তাঁকে সৃষ্টি না করতেন তাহলে তিনি এ বিশাল সৃষ্টি জগৎ এ নিখিল বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড কোন কিছুই সৃষ্টি করতেন না। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
لولاک لما خلقت الافلاک
“
যদি তোমাকে সৃষ্টি না করতাম তাহলে এ নভোমণ্ডলসমূহ সৃষ্টি করতাম না”
।
মহান আল্লাহর মনোনীত এ মহামানব আমাদের নবী , আমাদের পথ-প্রদর্শক। আর আমরা যে তাঁর উম্মত হতে পেরেছি এজন্য মহান আল্লাহর নিকট অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। স্মতর্ব্য যে , সকল নবী ও রাসূল মহান আল্লাহর দরবারে তাঁর উম্মত হবার সৌভাগ্য অর্জনের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। তাঁর আদর্শ শ্রেষ্ঠ আদর্শ , তাঁর সুন্নাত শ্রেষ্ঠ সুন্নাত , তাঁর ধর্ম শ্রেষ্ঠ ধর্ম। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :
)
ل
َقَدْ كانَ لَكُمْ في رَسولِ اللهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ(
‘‘
নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল (মুহাম্মদ)-এর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে সুন্দর আদর্শ।’’
তাঁর অনুসরণেই আমাদের মুক্তি। তাই তাঁর আদর্শ সঠিকভাবে অনুসরণ করতে হলে সর্বাগ্রে তাঁকে সঠিকভাবে জানা প্রয়োজন ; তাঁর সঠিক পরিচয় আমাদের জানা থাকা উচিত। আর যারা তাঁকে চেনেন এবং জানেন তাঁদের মাধ্যমেই আমরা তাঁর সম্যক পরিচিতি লাভ করতে পারব। নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ (যিনি তাঁর স্রষ্টা) , মহানবী (সা.) স্বয়ং নিজেই এবং তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং তাঁর হাতে প্রশিক্ষিত মহান আহলুল বাইতকে তিনি মুতাওয়াতির‘
হাদীসে সাকালাইন’
-এ পবিত্র কোরআনের সমকক্ষ ঘোষণা করেছেন।
তাঁরাই মহানবীর পবিত্র সত্তাকে যথোপযুক্তভাবে ও পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তাই মহানবী (সা.) সম্পর্কে তাঁদের বক্তব্য আমাদের কাছে মহানবীর অত্যুজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্যাবলী নির্ভুলভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হবে। পবিত্র কোরআন , মহানবীর পবিত্র হাদীস , আহলুল বাইতের বক্তব্য বিশেষ করে হযরত আলীর নাহজুল বালাগাহর বিভিন্ন ভাষণ ও খুতবায় মহানবীর প্রকৃত পরিচয় , মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য এবং তাঁর নবুওয়াত ও রিসালতের প্রকৃত রূপ , তাঁর নেতৃত্ব ও হেদায়েত এবং সুন্নাহর গুরুত্ব অত্যন্ত নির্ভুলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কারণ হযরত আলী (আ.) ছিলেন শৈশব থেকে মহানবীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত। মক্কার তীব্র অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে আবু তালিবের সন্তানদের মধ্যে থেকে মহানবী হযরত আলীর দায়িত্বভার নিয়েছিলেন যেহেতু আবু তালিবের পরিবার ছিল অনেক বড়। আর আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব হযরত জাফর ইবনে আবু তালিবের দায়িত্ব নিয়েছিলেন । এ সময় মহানবী (সা.) বলেছিলেন ,
و قد اخترت من اختاره الله لی علیکم علیا
“
আমি তাকেই গ্রহণ করেছি যাকে মহান আল্লাহ আমার জন্য তোমাদের উপর উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান সহকারে গ্রহণ ও মনোনীত করেছেন।
এভাবে হযরত আলী (আ.) একেবারে শৈশব থেকেই মহানবীর তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত ও বড় হতে থাকেন। মহানবীকে মহান আল্লাহ পাক যেভাবে শিক্ষা দিয়েছেন ঠিক সেভাবেই তিনি হযরত আলীকেও প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলেন। আর ঐ দিন থেকে হযরত আলী মহানবীর ওফাত পর্যন্ত কখনোই বিচ্ছিন্ন হন নি। প্রচলিত নিয়মানুযায়ী হযরত আলী পিতার তত্ত্বাবধানে পুত্র বা বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে যেমন ছোট ভাই প্রতিপালিত হয় ঠিক সেরকমভাবে প্রতিপালিত হন নি। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়টি উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে , হযরত আলী মহানবীকে এমন কি হেরা পর্বতের গুহায় নির্জনবাসের সময়ও সঙ্গ দিয়েছিলেন। আর এ কারণেই নবুওয়াতের ঘোষণার পূর্বেই মহানবীর যেসব আত্মিক ও চিন্তাগত বিবর্তন হচ্ছিল তা তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। হযরত আলী তাঁর জীবনে এ সকল উজ্জ্বল চিরঞ্জীব দিনগুলো এবং অতি সংবেদনশীল পর্যায়ের কথা এভাবে ব্যক্ত করেছেন :
‘‘
আর তোমরা সবাই মহানবীর কাছে আমার নিকটাত্মীয়তা ও বিশেষ মর্যাদাগত অবস্থান সম্পর্কে অবগত আছ। তিনি আমাকে তাঁর কোলে রাখতেন যখন আমি শিশু ছিলাম। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন এবং তাঁর বিছানায় শুইয়ে রাখতেন। তাঁর পবিত্র দেহ আমার দেহকে স্পর্শ করত এবং তিনি আমাকে তাঁর শরীরের সুগন্ধির ঘ্রাণ নেওয়াতেন। তিনি খাদ্য-দ্রব্য চিবিয়ে আমার মুখে পুরে দিতেন। তিনি আমাকে কখনো মিথ্যা বলতে এবং পাপ করতে দেখেন নি। তিনি প্রতি বছর হেরাগুহায় একান্ত নির্জনে বাস করতেন। আমি তাঁকে দেখতাম। আমি ব্যতীত আর কোন লোকই তাঁকে দেখতে পেত না। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ ও খাদীজাহ্ ব্যতীত কোন মুসলিম পরিবারই পৃথিবীর বুকে ছিল না। আমি ছিলাম তাঁদের পরিবারের তৃতীয় সদস্য। আমি ওহী ও রেসালতের আলো প্রত্যক্ষ করেছি এবং নবুওয়াতের সুবাস ও সুঘ্রাণ অনুভব করেছি।’’
এ বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে , মহানবী (সঃ)-এর সাথে হযরত আলী (আ.)-এর অতি নিবিড় ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক ছিল যা অন্য কোন সাহাবীর সাথে মহানবীর ছিল না। আর এটি হলো মারেফাত অর্থাৎ অধ্যাত্ম জ্ঞানের সর্বোচ্চ পর্যায়। এ কারণেই শৈশব থেকেই হযরত আলী হাকীকতে মুহাম্মদীর সাথে সম্যকভাবে পরিচিত ছিলেন। তাই মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পরই হযরত আলীই সর্বাধিক অগ্রগণ্য ব্যক্তি যিনি মহানবী সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও পরিচিতি প্রদান করতে সক্ষম। তাই আমরা হযরত আলীর ভাষণ , অমিয় বাণী ও (প্রেরিত) পত্রাদির সংকলন নাহজুল বালাগাহর বিভিন্ন ভাষণ , অমিয়বাণী ও চিঠি-পত্রে হযরত আলী মহানবী সম্পর্কে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তা এখানে উদ্ধৃত করব। আশা করা যায় যে , আমরা এ থেকে মহানবী (সা.)-এর অতুলনীয় বিশাল ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জ্ঞাত হতে পারব।
খুতবা 1 থেকে
মহান আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে [মানব জাতির কাছে] তাঁর ঐশী ওয়াদা বাস্তবায়ন ও নবুওয়াতের ধারার পূর্ণতা প্রদান করার জন্য প্রেরণ করেছেন। পূর্ববতী সকল নবীর কাছ থেকে তাঁর (মহানবীর) নবুওয়াত ও শরীয়তের অনুসরণের অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে। তাঁর নিদর্শনসমূহ খ্যাতি লাভ করেছে (সকল নবীর কাছে এবং পূর্ববর্তী সকল আসমানী গ্রন্থ ও সহীফাতে)। তাঁর জন্ম অত্যন্ত পবিত্র ও মহান সে দিন (যখন মহানবী প্রেরিত হয়েছিলেন মানবম 6 ণ্ডলীর কাছে) জগতবাসিগণ ছিল বিভিন্ন ধর্ম ও ফিরকায় বিভক্ত। রিপু ও প্রবৃত্তিসমূহ ছিল ব্যাপক প্রসারিত। তাদের মত ও পথসমূহ ছিল বিভিন্ন ধরনের। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল মুশাব্বিহা (মহান আল্লাহকে তাঁরই সৃষ্টির সাথে তুলনা করত) অথবা কেউ কেউ মহান আল্লাহর পবিত্র নামের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ বিষয়কে বৈধ মনে করেছে। (তাঁর পবিত্র নামসমূহ বিকৃত করেছে অথবা পবিত্র নামসমূহকে অস্বীকার করেছে অথবা পবিত্র নামের স্থলে অন্য কোন নাম চালিয়ে দিয়েছে) অথবা কেউ কেউ ছিল গায়রুল্লাহর প্রতি ভক্ত ও অনুরক্ত।
মহান আল্লাহ তাঁর (হযরত মুহাম্মদ) মাধ্যমে মানব জাতিকে পথভ্রষ্টতা থেকে হেদায়েত করলেন। তাঁর মাধ্যমে মানব জাতিকে অজ্ঞতা ও মূর্খতা থেকে মুক্তি দিলেন। এরপর মহান আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে তাঁর নিজ দীদার ও সাক্ষাতে আনার জন্য মনোনীত করলেন। স্রষ্টা তাঁর কাছে যা আছে তা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্য কবুল করে নিলেন। তাঁকে (সা.) পার্থিব জগৎ থেকে সম্মান সহকারে পরপারে নিয়ে গেলেন। তিনি বিপদাপদের পর্যায় থেকে তাঁকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিলেন। এরপর মহান আল্লাহ তাঁকে সম্মান ও মর্যাদাসহকারে নিজের সান্নিধ্যে আনলেন। পূর্ববর্তী সকল নবী তাঁদের উম্মতের মাঝে যা রেখে গিয়েছেন সেটিই তিনিও তোমাদের মাঝে রেখে গেছেন। কারণ মহান নবীগণ কখনোই সুস্পষ্ট পথ ও প্রতিষ্ঠিত হেদায়েতের নিদর্শন ব্যতীত তাদের নিজ নিজ জাতিকে তাদের নিজেদের ঘাড়ে ছেড়ে দিয়ে ইহজগৎ থেকে বিদায় নেন নি।
সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর যাঁর প্রশংসা করতে অক্ষম কথকগণ (প্রশংসাকারিগণ) , আর গণনাকারিগণ যার নেয়ামতসমূহ গণনা করতে অক্ষম , আর যার অধিকার প্রদান করতে অপারগ সকল চেষ্টাসাধনাকারিগণ অর্থাৎ অধিকার আদায়কারিগণ। চিন্তা-ভাবনা দিয়ে ও আকাংখা দিয়ে আর গভীর বুদ্ধিমত্তা দিয়েও যার নাগাল পাওয়া যায় না , যাঁর গুণের কোন সীমা-পরিসীমা নেই , নেই বিদ্যমান কোন বর্ণনা , নেই কোন সংকীর্ণ সংক্ষিপ্ত কাল , ঠিক তেমনি নেই কোন দীর্ঘ সময় ও কাল (যিনি কালের গতি ও সীমারেখার ঊর্ধ্বে) যিনি স্বীয় শক্তি ও মহিমা দিয়ে সৃষ্টিসমূহকে সৃষ্টি করেছেন , স্বীয় করুণা ও দয়া দিয়ে বাতাসকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছেন এবং পৃথিবীর ভূ-ত্বকের গতি স্থানান্তর ও কম্পনকে বৃহদাকার গিরি পর্বতমালা ও পাথরসমূহ দিয়ে গেঁথে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন।
খুতবা 2 থেকে
আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি , হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসূল (প্রেরিত পুরুষ)। তিনি তাঁকে প্রসিদ্ধ ধর্ম (ইসলাম) বর্ণিত নিদর্শন , সুস্পষ্টাক্ষরে লিখিত গ্রন্থ (পবিত্র কোরআন) হেদায়েতের অত্যুজ্জ্বল আলো , ঔজ্জ্বল্য বিচ্ছুরণকারী দ্যুতি ও অকাট্য বিধি-বিধানসহকারে সকল ক্লান্তি নিরসন , ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা পূরণ , নিদর্শনাদি দ্বারা সতর্কীকরণ এবং ইহলৌকিক-পারলৌকিক শাস্তিসমূহের দ্বারা ভীতি-প্রদর্শন করার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে মহান আল্লাহ ঐ অবস্থায় প্রেরণ করেছেন যখন মানুষ এমন সব ফিতনায় নিমজ্জিত ছিল যা ধর্মের রজ্জুকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলেছিল , দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থার সকল স্তম্ভকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল ; তখন মূল পৃথক ও ছিন্ন ভিন্ন এবং একতা (এক-একক বিষয়) টুকরো টুকরো ও বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। নির্গমন পথ সংকীর্ণ এবং উৎসমূল অন্ধত্বের শিকার হয়ে গিয়েছিল। তখন সুপথ অখ্যাত-অজ্ঞাত ও অন্ধত্ব সব কিছূকে ঘিরে ফেলেছিল ; শয়তান সাহায্যপ্রাপ্ত হচ্ছিল ও ঈমানের অবমাননা করা হচ্ছিল ; তাই ঈমানের স্তম্ভসমূহ ধ্বসে গিয়েছিল এবং এর চিহ্ন ও নিদর্শনাবলী উপেক্ষিত হয়েছিল। এর (ঈমানের) পথসমূহ পুরানো এবং নষ্ট ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল মানবমণ্ডলী (বিশেষ করে আরব জাতি) তখন শয়তানের আনুগত্য করত এবং তার পথেই চলত। আর (এভাবে) তারা (মানবমণ্ডলী) তার ভাগ্যস্থলেই প্রবেশ করেছে শয়তানের নিদর্শনাদি তাদের মাধ্যমেই প্রসার লাভ করেছিল , তাদের (অনুসারীদের) মাধ্যমে তার (ইবলিসের) বিজয় পতাকা উত্তোলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারা (মানব জাতি) ছিল এমন সব ফিতনায় (নিমজ্জিত) যা তাদেরকে খুর দিয়ে দলিত-মথিত ও পিষ্ট করেছিল এবং (ফিতনাসমূহ) এর ধারালো পার্শ্বদেশের ওপর ভর করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাই তারা (মানব জাতি) ফিতনাসমূহে অস্থির , বিচলিত , উদ্ভ্রান্ত , পথভ্রষ্ট , অজ্ঞ ও বিপথগামী হয়ে পড়েছিল ; উত্তম কল্যাণকর গৃহে (পবিত্র কাবা) ও নিকৃষ্ট প্রতিবেশীর (মুশরিক কুরাইশ) মধ্যে থেকেও তখন তারা ফিতনাগ্রস্ত ও অপদস্থ হচ্ছিল। তখন তাদের নিদ্রা-অনিদ্রা ও জাগরণে পরিণত হয়েছিল ; আর তাদের চোখের সুরমা হয়ে গিয়েছিল তাদের নয়নাশ্রু ; তারা এমন ভূ-খণ্ডে বসবাস করত যেখানে জ্ঞানীরা ছিল লাগাম পরিহিত (অর্থাৎ তারা ছিল সেখানে অপমানিত ও অসম্মানিত এবং তাদেরকে সত্য কথা বলতে দেয়া হত না) এবং অজ্ঞ-মূর্খরা ছিল সম্মানের পাত্র।
খুতবা 26 থেকে
মহান আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে জগৎসমূহের ভয় প্রদর্শনকারী এবং অবতীর্ণ ওহীর বিশ্বস্ত সংরক্ষক হিসেবে ঐ অবস্থায় প্রেরণ করেছেন যখন হে আরবগণ , তোমরা ছিলে নিকৃষ্ট ধর্মের অনুসারী এবং নিকৃষ্ট বাসগৃহে (বাস করতে) তোমরা কঠিন পাথর ও বধির সর্পকুলের (ঐ সব সর্পকে বধির বলা হয়েছে যেগুলো খুবই ভয়ানক ও অত্যন্ত বিষাক্ত এবং প্রচণ্ড শব্দ ও বিকট আওয়াজেও ভয় পেয়ে পলায়ন করে না যেন এগুলো কালা-বধির এবং শুনতে পায় না।) মধ্যে বসবাস করতে ; তোমরা নোংরা ঘোলা পানি পান করতে ; তোমরা ব্যঞ্জনবিহীন গুরুপাক ও অপবিত্র খাদ্য খেতে ; তোমরা নিজেদের মধ্যে রক্তপাত করতে এবং আত্মীয়তা ও রক্ত সম্পর্ক ছিন্ন করতে. তোমাদের মধ্যে মূর্তি ও প্রতিমাসমূহ (এবং এগুলোর পূজা-উপাসনা) প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং পাপাচার তোমাদেরকে দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল (অর্থাৎ তোমরা সবাই তখন পাপাচারে লিপ্ত ছিলে)।
খুতবা 33 থেকে
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রেরণের অন্তর্নিহিত কারণ ও প্রজ্ঞা : নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে ঐ অবস্থায় প্রেরণ করেছিলেন যখন কোন আরবই গ্রন্থ পাঠ করতে জানত না এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ নবুওয়াতের দাবীও করেনি। মহানবী (সা.) জনগণকে পথ প্রদর্শন করে তাদেরকে নিজ নিজ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং তাদেরকে তাদের নাজাতের (মুক্তির) স্থানে পৌঁছে দিলেন। এর ফলে তাদের শক্তি , ক্ষমতা ও রাষ্ট্র দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল এবং তাদের সার্বিক অবস্থা ও চারিত্রিক গুণাবলীও স্থিরতা লাভ করল।
খুতবা 72 থেকে
হে আল্লাহ , আপনার (মনোনীত) শ্রেষ্ঠ মর্যাদাসম্পন্ন সালাম ও সালাত (দরুদ) এবং অধিক অধিক বরকত ও কল্যাণ আপনার বান্দা ও রসূল হযরত মুহাম্মদের (সা.) ওপর প্রেরণ করুন যিনি ছিলেন পূর্ববর্তী সকল নবুওয়াতের পরিসমাপ্তকারী (সর্বশ্রেষ্ঠ নবী) এবং যা আবদ্ধ ও তালাবদ্ধ ছিল তা উন্মুক্তকারী।(হেদায়েত অর্থাৎ সুপথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার মাধ্যমে মানব মনের দরজাসমূহ তালাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল , কিন্তু মহানবী (সা.) তাঁর নবুওয়াতের উজ্জ্বল নিদর্শনাদির মাধ্যমে সেসব তালাবদ্ধ হৃদয়কে উন্মুক্ত করেছিলেন।)তিনি (সা.) সত্য দিয়েই সত্যের ঘোষণা দিয়েছেন এবং বাতিল পথভ্রষ্টদের সকল সেনাবাহিনীকে তিনি প্রতিহত করেছেন। তিনি পথভ্রষ্টদের সমুদয় প্রভাব-প্রতিপত্তি ধ্বংস
করেছেন ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছেন। যেভাবে তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ঠিক সেভাবেই তিনি তা দৃঢ়তার সাথে পালন করেছেন। তিনি (সা.) আপনার নির্দেশ পালন করেছেন এবং আপনার সন্তুষ্টি (অর্জনের) ক্ষেত্রে ত্বরা করতেন। তিনি (সা.) রণাঙ্গনের উদ্দেশে যাত্রা করার ক্ষেত্রে কখনো কাপুরুষতা ও ভীরুতা প্রদর্শন করেন নি এবং দৃঢ় সংকল্প ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও কোন দুর্বলতা দেখান নি। তিনি আপনার ওহী পূর্ণরূপে আত্মস্থ ও হৃদয়ঙ্গম করে তা হেফাযত করেছেন এবং আপনার প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন। তিনি আপনার আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়ন করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন যার ফলে তিনি হেদায়েতের আলোক শিখা প্রজ্জ্বলিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং (আঁধার) রাতে অস্পষ্ট অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে চলাচলকারী পথিকের চলার পথ আলোকোজ্জ্বল করেছিলেন। ফিতনা ও পাপাচার প্রশমিত হওয়ার পর তাঁর দ্বারা অন্তঃকরণসমূহ সুপথপ্রাপ্ত হয়েছিল। তিনি (সা.) হেদায়েতের স্পষ্ট নিদর্শনাদি ও আলোকোজ্জ্বল বিধিবিধানসমূহ সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই তিনি আপনার একান্ত বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বান্দা , আপনার সংরক্ষিত জ্ঞানের ধারক (মহান আল্লাহ এই সংরক্ষিত জ্ঞান থেকে বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তাকে বিশেষভাবে দান করেন।) এবং শেষ বিচার দিবসে আপনার সাক্ষী(মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জাতির ওপর তিনি (সা.) সাক্ষী। এতদ্প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে ,“
অতঃপর তখন অবস্থা কেমন হবে যখন আমরা প্রতিটি জাতি অর্থাৎ উম্মাত থেকে একজন করে সাক্ষী আনয়ন করব এবং আপনাকে এদের সকলের ওপর সাক্ষী হিসেবে নিযুক্ত করব ?”
)