ইমাম রেজা (আ.)-এর শাহাদতের সংবাদ
উমাইয়া ইবনে আলী বলেন ,যখন ইমাম রেজা (আ.) খোরাসানে ছিলেন ,আমি তখন মদীনায় ছিলাম এবং ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর সাথে যোগাযোগ রাখতাম। ইমামের আত্মীয়-স্বজনরা প্রায়ই তার সাথে সালাম বিনিময় করতে আসতেন। একদিন তাঁর দাসীকে বললেন ,তাদেরকে (আত্মীয়-স্বজন) শোক পালনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বল। পরের দিন আবারও তাদেরকে শোক পালনের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। তারা (আত্মীয়-স্বজনরা) বললেন : কার জন্যে শোক পালন করতে ? ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন :‘
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষের (ইমাম রেযা) জন্যে শোক পালন করতে। ’
কিছুদিন পর ইমাম রেজা (আ.)-এর শাহাদতের খবর পাওয়া গেল এবং জানা গেল যেদিন ইমাম জাওয়াদ (আ.) বলেছিলেন ,‘
শোক পালনের জন্য প্রস্তুত থাক ’ ঠিক সেই দিনই ইমাম রেযা (আ.) খোরাসানে শহীদ হয়ে ছিলেন (আ ’ লামুল ওয়ারা ,পৃ.334) ।
1 কাজীর স্বীকারোক্তি : কাজী ইয়াহিয়া ইবনে আকসাম নবী পরিবারের ঘোর শত্রু ছিল। সে নিজেই স্বীকার করে যে ,একদা মসজিদে নববীতে ইমাম জাওয়াদকে দেখলাম। তাঁর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক করলাম তিনি সব বিষয়ের যথাযথ জবাব দিয়ে আমাকে তুষ্ট করলেন। বললাম একটি ব্যাপারে আপনাকে প্রশ্ন করব কিন্তু লজ্জা পাচ্ছি কিভাবে তা করব। ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন : তোমার প্রশ্ন করার প্রয়োজন নেই ,আমিই বলে দিচ্ছি তুমি কি প্রশ্ন করতে চাও! তুমি প্রশ্ন করতে চাও যে বর্তমানে ইমাম কে ?
বললাম ,জী হ্যাঁ ,ঠিকই বলেছেন ,আল্লাহর কসম ,আমি এ প্রশ্নই আপনার কাছে করতে চেয়েছিলাম। ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন : আমিই বর্তমান যুগের ইমাম। বললাম : তার প্রমাণ কী ? এমন সময় ইমামের হাতে যে লাঠিটি ছিল তা মুখ খুলল এবং বলল : ইনিই হচ্ছেন আমার মাওলা এবং এই যুগের ইমাম ও আল্লাহর স্পষ্ট দলিল বা হুজ্জাত (উসূলে কাফী ,1ম খণ্ড ,পৃ. 353 ;বিহারুল আনওয়ার ,50তম খণ্ড ,পৃ. 68) ।
2 প্রতিবেশীর মুক্তি : আলী ইবনে জাবির বলেন ,ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর নিকট ছিলাম। ইমামের একটি দুম্বা হারিয়ে যাওয়ায় জনগণ তাঁর এক প্রতিবেশীকে টেনে হেঁচড়ে ইমামের কাছে নিয়ে এল। ইমাম বললেন :‘
তোমাদের কাণ্ড দেখে দুঃখ হয়! তাকে ছেড়ে দাও ,সে দুম্বা চুরি করেনি। বর্তমানে দুম্বাটি অমুকের বাড়িতে আছে যাও ,ওটাকে নিয়ে এস।
ইমাম যার কথা বলেছিলেন ঠিক সে বাড়িতেই দুম্বাটি পাওয়া গেল। ইমাম কর্তৃক আদিষ্টরা বাড়ীর মালিককে চুরির দায়ে মার-ধোর করল এবং তার জামা কাপড় ছিড়ে ফেলল। কিন্তু বাড়ীওয়ালা শপথ করে বলল যে ,সে দুম্বা চুরি করেনি। তাকে ইমামের কাছে ধরে আনল। ইমাম বললেন : তোমাদের জন্য আফসোস হয়! তোমরা ঐ ব্যক্তির উপর অত্যাচার করেছ। দুম্বাটি নিজেই ঐ ব্যক্তির ঘরে ঢুকে পড়ে এবং সে খবরই জানত না।
ফলে ইমাম ঐ ব্যক্তিকে তুষ্ট করার জন্য এবং ক্ষতিপূরণস্বরূপ তাকে কিছু স্বর্ণ মুদ্রা দান করলেন (বিহারুল আনওয়ার ,50তম খণ্ড ,পৃ. 47) ।
3 কারাবন্দীর নিস্কৃতি : আলী ইবনে খালেদ বলেন : খবর পেলাম এক ব্যক্তিকে মদীনা থেকে ধরে এনে সামাররাতে কারাবন্দী করা হয়েছে। বলছে ঐ ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করেছে।
জেলখানায় গিয়ে তার সাথে দেখা করলাম এবং তাকে একজন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তি বলে মনে হলো। তার কাছে কারারুদ্ধ হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। বলল ,সাইয়্যেদুশ শোহাদা হযরত ইমাম হুসাইনের মাথা মোবারক দাফন করা আছে বলে কথিত শামের ঐ স্থানে ইবাদত করছিলাম।
এক রাত্রে বিশেষ ভাবে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল ছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তিকে আমার সামনে দেখতে পেলাম ;তিনি আমাকে বললেন : ওঠো।
আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং তার সাথে কিছু দূর যাওয়ার পর দেখলাম কুফার মসজিদে অবস্থান করছি। প্রশ্ন করলেন : এটা কোন মসজিদ ,জান কি ? বললাম : জী হ্যাঁ ,এটা কুফার মসজিদ।সেখানে নামাজ পড়ে বাইরে এলাম। পুনরায় কিছু দূর চলার পর দেখলাম মদীনায় মসজিদে নববীতে অবস্থান করছি। রাসূল (সা.)-এর মাজার জিয়ারত করে এবং মসজিদে নামাজ পড়ে বাইরে এলাম। আরো কিছু দূর গিয়ে দেখলাম মক্কায় আল্লাহর ঘরে অবস্থান করছি। তাওয়াফ করে বাইরে এলাম এবং কিছু পথ চলার পর দেখলাম শামে যেখানে ছিলাম সেখানেই পৌঁছে গিয়েছি। আর তখন ঐ মহান ব্যক্তি আমার চোখের আড়াল হয়ে গেলেন।
এই অলৌকিক ঘটনা আমার জন্য খুবই আশ্চর্যজনক ছিল। এভাবে এক বছর কেটে যাওয়ার পর পুনরায় ঐ মহান ব্যক্তির আগমন ঘটে এবং এক বছর পূর্বে যা ঘটেছিল ঠিক তারই পুনরাবৃত্তি ঘটল কিন্তু এবার যখন তিনি চলে যাচ্ছিলেন তখন আমি তাঁকে কসম দিয়ে তাঁর পরিচয় দিতে বললাম। তিনি বললেন ,‘
আমি মুহম্মদ ইবনে আলী ইবনে মূসা ইবনে জাফর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনুল হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবি তালীব ’ (অর্থাৎ ইমাম জাওয়াদ ) ।
এ অলৌকিক ঘটনাকে কারো কারো কাছে বর্ণনা করলাম। এভাবে ঘটনাটি মো ’ তাসেমের উজির মুহাম্মদ ইবনে আবদুল মালেক যিয়াতের কাছে পৌঁছে যায়। যিয়াত আমাকে বন্দী করে কারাগারে নেয়ার নির্দেশ দেয় এবং মিথ্যা প্রচার করে যে আমি নবুওয়াত দাবী করেছি।
আলী ইবনে খালেদ বলেন তাকে বললাম : তুমি কি চাও তোমার এ ঘটনাকে যিয়াতকে বিস্তারিত লিখে জানাব। আর এভাবে যদি সে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকে তাহলে জ্ঞাত হবে। বলল : লিখুন।
ঘটনাটি যিয়াতের কাছে বিস্তারিত লিখলাম। যিয়াত ঐ পত্রের অপর পিঠে জবাব লিখে পাঠাল ,তাকে বল : যে ব্যক্তি তাকে এক রাত্রে কয়েক ঘন্টার মধ্যে শাম থেকে কুফা ,কুফা থেকে মদীনা ,মদীনা থেকে মক্কায় এ সুদীর্ঘ পথ ভ্রমন করিয়েছেন আবার ফিরিয়ে এনেছেন তাকেই মুক্তি দিতে।
যিয়াতের এ জবাবে দুঃখিত হলাম। পরের দিন চিঠির জবাব জানাতে এবং সান্ত্বনা দিতে জেলখানায় গেলাম কিন্তু দেখলাম যে ,জেলার ও প্রহরীরা অস্থির এবং বিচলিত। জানতে চাইলাম ,কী হয়েছে ?
বলল : যে লোকটি নবুওয়াত দাবী করেছিল ,সে গত রাতে জেল থেকে পালিয়েছে কিন্তু জানিনা কিভাবে সে পালাতে সক্ষম হলো ? মাটির নীচে চলে গিয়েছে না আকাশে উড়ে গেছে ? অনেক খোঁজা-খোঁজি করেও তার কোন সন্ধান পাওয়া যায় নি।
4. ইমাম রেযা (আ.)-এর নিকটতম ব্যক্তি ,আবা সালত হারুভীকে ইমামের শাহাদতের পর মামুনের নির্দেশে কারাবন্দী করা হয়েছিল। তিনি বলেন :
এক বছর জেলে থাকার পর হতাশায় পড়লাম। রাত্র জেগে ইবাদত বন্দেগী করতে লাগলাম এবং রাসূল (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতকে আমার শাফায়াতকারী হিসাবে প্রার্থনা করলাম। তাঁদের সম্মান ও মর্যাদার বিনিময়ে আল্লাহর কাছে মুক্তি প্রার্থনা করলাম। দোয়া শেষ না হতেই ইমাম জাওয়াদকে জেলখানায় আমার সামনে দেখতে পেলাম।
তিনি বললেন : এই আবা সালত ,তুমি কি অসহায় হয়ে পড়েছ ? সবিনয়ে নিবেদন করলাম : হ্যাঁ আমার নেতা ,আল্লাহর শপথ! আমি অসহায় হয়ে পড়েছি।
ইমাম বললেন : ওঠো। অতঃপর তিনি শিকলে হাত দিলে বন্ধন খুলে গেল এবং আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলেন। প্রহরীরা আমাকে দেখতে পেল কিন্তু ইমামের অলৌকিক ক্ষমতা ও বিরাট ভাবমূর্তি দেখে তারা কিছুই বলতে সাহস করল না। অতঃপর ইমাম বললেন :‘
চলে যাও ,আল্লাহ্ তোমাকে রক্ষা করবেন ,এরপর থেকে কখনোই তুমি মামুনকে দেখতে পাবে না ;আর মামুন ও তোমাকে দেখতে পাবে না। ’ ইমাম যা বলেছিলেন ঠিক তাই হয়েছিল।
5. মো ’ তাসেম আব্বাসীর সভায় : ইবনে আবু দাউদের বন্ধু যারকান বলেন ,একদা দাউদ দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মো ’ তাসেমের সভা হতে ফিরছিল। কারণ জানতে চাইলে বলল : অদ্য আমার মনে হচ্ছিল হায়! যদি বিশ বছর পূর্বে মারা যেতাম ? প্রশ্ন করলাম : কেন ? বলল : মো ’ তাসেমের সভায় আবু জাফর (ইমাম জাওয়াদ) যেভাবে আমাকে কুপোকাত করল সে কারণে। বললাম : ঘটনাটা কী ?
বলল : এক ব্যক্তি চুরি করে তা স্বীকার করেছিল ;ফলে সে মো ’ তাসেমের কাছে তার উপর আল্লাহর হুকুম জারী করে তাকে পবিত্র করার অনুরোধ করল। খলিফা সকল দরবারি ফকীহদেরকে একত্র করল এবং মুহাম্মদ ইবনে আলী ইমাম জাওয়াদকেও ডেকে পাঠাল। আমাদেরকে প্রশ্ন করল : চোরের হাত ,কোথা থেকে কাটতে হবে ?
আমি (দাউদ) বললাম : হাতের কব্জি থেকে।
বলল : তার দলিল কি ?
বললাম : কেননা তায়াম্মুমের আয়াতে হাত বলতে হাতের কব্জি পর্যন্ত বুঝানো হয়েছে।
)
ف
َامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ(
অর্থাৎ তোমরা যদি পানি না পাও ,তাহলে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর এবং তোমাদের মুখ মন্ডল ও হস্তদ্বয়কে মাছেহ কর (মুছিয়া ফেল) । (সূরা নিসা : 43)
কিছু সংখ্যক ফকীহ আমার এ যুক্তির সমর্থন করলেন। কিন্তু কিছু সংখ্যক বললেন ,না ,কনুই পর্যন্ত কাটতে হবে। মো ’ তাসেম বলল তার দলিল কি ? তারা বলল : ওজুর আয়াতে হাত বলতে হাতের কনুই পর্যন্ত বোঝান হয়েছে।
)
ف
َاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ(
অর্থাৎ তোমাদের মুখমণ্ডল এবং হস্তসমূহকে কনুই পর্যন্ত ধৌত কর (সূরা মায়িদাহ : 6) ।
অতঃপর মো ’ তাসেম মুহাম্মদ ইবনে আলী ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করল : এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী ?
ইমাম বললেন : এরাতো বললই ,আমি আর কিছু বলতে চাচ্ছি না। মো ’ তাসেম পীড়াপীড়ি করতে লাগল এবং কসম খেল অবশ্যই আপনাকে মতামত দিতে হবে।
মুহাম্মদ ইবনে আলী আল জাওয়াদ (আ.) বললেন : যেহেতু কসম খেয়েছ তাই আমার মতামত বলছি। এরা সকলেই ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছে কেননা চোরের শুধুমাত্র আঙ্গুল কাটা যাবে ,আর সমস্ত হাত অবশিষ্ট থাকবে।
মো ’ তাসেম বলল : তার দলিল কী ?
ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন : যেহেতু রাসূল (সা.) বলেছেন ,যুগপৎভাবে সাতটি অঙ্গের মাধ্যমে সিজদা সম্পাদিত হয় - কপাল ,দুই হাতের তালু ,দুই হাঁটু এবং পায়ের দুই বৃদ্ধাংগুলি। সুতরাং যদি চোরের হাতের কব্জি অথবা কনুই থেকে কেটে ফেলা হয় তাহলে সিজদার জন্য হাতই অবশিষ্ট থাকে না। এ ছাড়াও আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন :
)
و
َأَنَّ الْمَسَاجِدَ لِلَّـهِ فَلَا تَدْعُوا مَعَ اللَّـهِ أَحَدًا(
অর্থাৎ এবং নিশ্চয় সকল মসজিদ (সাতটি অঙ্গ যার উপর সিজদা ওয়াজেব)
আল্লাহর জন্য ,সুতরাং তোমরা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাহাকেও (মা ’ বুদরূপে) ডাকিও না (সূরা জিন : 18) । ”
সুতরাং যা আল্লাহর জন্য তা কাটা যাবে না।
ইবনে আবি দাউদ বলে : মো ’ তাসেম ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর দলিলকে যুক্তিযুক্ত মনে করে তা গ্রহণ করেছিল। আর সে মোতাবেক চোরের আঙ্গুল কেটে ফেলার নির্দেশ দেয়। আমরা যারা ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাম ,উপস্থিত জনগণের সামনে অপমানিত হলাম। আর আমি এতই লজ্জিত হয়েছিলাম যে ,সেখাইে নিজের মৃত্যু কামনা করি (তাফসীরে আইয়াশী ,1ম খণ্ড ,পৃ. 319 ,বিহারুল আনওয়ার ,50তম খণ্ড ,পৃ. 5) ।