ইমাম জাওয়াদ (আ.)

ইমাম জাওয়াদ (আ.)0%

ইমাম জাওয়াদ (আ.) লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ইমাম মুহাম্মাদ বিন আলী আল জাওয়াদ (আ.)

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 14 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 5504 / ডাউনলোড: 2395
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম জাওয়াদ (আ.)

ইমাম জাওয়াদ (আ.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

ইহরামেরবিভিন্ন অবস্থায় শিকারের হুকুম নিম্নরূপ

মামুন ইমাম জাওয়াদকে অনুরোধ করল ইহরামের বিভিন্ন অবস্থায় (যা আপনি উপস্থাপন করেছেন) শিকারের যদি বর্ণনা করেন তাহলে বাধিত হব। ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন :

হ্যাঁ ,যদি মোহরেম (যে ইহরাম বেঁধেছে) হিল্লাতে (হারামের বাইরে) শিকার করে থাকে ,আর শিকার যদি বড় পাখি হয় ,তার কাফফারা (ক্ষতিপূরণ) একটি দুম্বা । আর যদি হারামের মধ্যে শিকার করে থাকে কাফফারা দ্বিগুণ হবে অর্থাৎ দু ’ টি দুম্বা। শিকার যদি পাখির বাচ্চা হয় আর তা হারামের বাইরে হয়ে থাকে কাফফারা একটি ভেড়ার বাচ্চা। আর যদি হারামের মধ্যে শিকার করে থাকে তাহলে কাফফারা একটি ভেড়ার বাচ্চা ও ঐ পাখির বাচ্চার যে দাম হয় তা। যদি বন্য পশু হয় যেমন জেব্রা তার কাফ্ফারা একটি গরু। আর যদি উট পাখি হয় তার কাফফারা একটি উট। হরিণ হলে তার কাফ্ফারা একটি দুম্বা। আর এ শিকারগুলো যদি হারামের মধ্যে হয়ে থাকে তাহলে কাফফারা দ্বিগুণ হবে।

ইহরাম যদি হজের হয় তাহলে কাফফারার ঐ পশুকে মিনায় ’ কোরবানী করবে। আর যদি ওমরার ইহরাম হয় তাহলে মক্কায় কোরবানী করবে। উল্লেখ্য যে জ্ঞানী ও মূর্খের (ফতোয়া সম্পর্কে অনবহিত) কাফফারা সমান। ইচ্ছাকৃত ভাবে শিকার করলে সে গোনাহ করেছে এবং তাকে কাফফারা দিতে হবে। অসাবধানতা বসত করে থাকলে সে গোনাহ করেনি তবে তাকে কাফ্ফারা দিতে হবে। স্বাধীন হলে নিজেকেই ঐ কাফফারা দিতে হবে। দাস হলে তার মনিবকে ঐ কাফফারা দিতে হবে। বয়স্কের জন্য কাফফারা ওয়াজিব। বালকের জন্য কাফফারা ওয়াজিব নয়। শিকারী যদি তার এ কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয় তাহলে তার গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। কিন্তু যে অনুতপ্ত নয় ,সে শাস্তি পাবে।

মামুন ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর মনোরম জবাব শুনে তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করল এবং ইয়াহিয়া ইবনে আকসামকে প্রশ্ন করার অনুরোধ জানাল। ইমাম জাওয়াদ (আ.) ইয়াহিয়াকে বলল ,এখন আমি তোমাকে প্রশ্ন করব ?

ইয়াহিয়া যেহেতু পূর্বেই ইমামের জ্ঞানের কাছে পরাজয় বরণ করেছিল নিচু স্বরে বলল : আপনার ইচ্ছা ,যদি পারি তাহলে জবাব দিব ,আর তা না হলে আপনার কাছ থেকে শিখে নিব।

ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন : বলত দেখি ,কিরূপে সম্ভব যে ,একটি লোক সকালে যখন একটি মহিলার দিকে তাকাল তা ছিল হারাম। পূর্বাহ্নে ঐ মহিলা তার জন্য হালাল হয়ে গেল। জোহরের (দুপুরের) সময় হারাম হয়ে গেল। আসরের (বিকালে) সময় আবার হালাল হয়ে গেল। সন্ধ্যায় আবার হারাম হলো। রাত্রে এশার নামাজের সময় পুনরায় হালাল হলো। মধ্য রাত্রে আবার হারাম হয়ে গেল। সকালে আবার তার জন্য হালাল হয়ে গেল। কেন এরূপ হয়েছিল এবং কী কারণে একবার তার জন্য হালাল হচ্ছিল ,আবার হারাম হয়ে যাচ্ছিল ?

ইয়াহিয়া বলল ,আল্লাহর শপথ! আমি এর উত্তর জানি না এবং জানি না কোন কারণে এরূপ হচ্ছিল। দয়া করে আপনি যদি এর জবাব বলে দেন ,তাহলে বাধিত হব।

ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন : ঐ মহিলাটি এক লোকের দাসী ছিল। ঐ নামাহরাম লোকটি তার দিকে তাকাল এবং সে দৃষ্টি তার জন্য হারাম ছিল। পূর্বাহ্নে লোকটি ঐ দাসীকে তার মনিবের কাছ থেকে কিনে নেয় এবং তার জন্য হালাল হয়ে যায়। দুপুরে ঐ দাসীকে মুক্ত করে দিল এবং তার জন্য হারাম হয়ে গেল। আসরের সময় তার সাথে বিবাহ করল এবং তার জন্য হালাল হয়ে গেল। সন্ধ্যার সময় যিহার ’7 করল এবং তার জন্য হারাম হয়ে গেল। রাত্রে এশার নামাজের পূর্বে কাফফারা দিল এবং পুনরায় তার জন্য হালাল হয়ে গেল। মধ্যরাত্রে তাকে এক তালাক দিল এবং তার জন্য হারাম হয়ে গেল। সকালে প্রত্যাবর্তন করল এবং পুনরায় তার জন্য হালাল হয়ে গেল।

মামুন বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তার আত্মীয়-স্বজনদের দিকে তাকাল এবং বলল : তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে ,যে এভাবে প্রশ্ন করতে পারে ও তার চমৎকার জবাব দিতে পারে ? সকলে বলল : আল্লাহর কসম! আমরা এ বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে অপারগ ও অক্ষম।8

ঐ বৈঠকেই মামুন ইমাম জাওয়াদকে তার (মামুনের) কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব দেয় এবং ইমামকেই বিবাহের খোৎবা পাঠ করার অনুরোধ জানায়। ইমাম জাওয়াদ অনিচ্ছা সত্ত্বেও মামুনের এ প্রস্তাব গ্রহণ করতে বাধ্য হন এবং খোৎবাটি এভাবে শুরু করেন :

الحمد لله اقراراً بنعمته ولا اله الاالله اخلاصاً لوحدانيته و صلى الله على محمّدٍ سيِّد بريته والاصفياء من عترته اما بعد فقد كان من فضل الله على الانام ان اغناهم بالحلال عن الحرام و قال سبحانه : انكحوا الايامي منك والصّالحين من عبادكم وامائكم اِن يكونوا فقراء يغنهم الله من فضله والله واسعٌ عليمٌ

অর্থাৎ আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি তাঁর অসংখ্য নেয়ামতের জন্য। তাঁর একত্ববাদের স্বীকারান্তে ঐকান্তিকতার সাথে কালিমা লা ইলাহা ইল্লাহ পাঠ করছি। আল্লাহর দরুদ বর্ষিত হোক সৃষ্টির সেরা হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর মনোনীত এবং পবিত্র আহলে বাইতের উপর। নিঃসন্দেহে এটা মানুষের প্রতি আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ এবং রহমত যে ,তিনি তাদেরকে হালালের মাধ্যমে হারামের অমুখাপেক্ষী করেছেন এবং বিবাহের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন : এবং তোমাদের মধ্যে অবিবাহিতদের ও তোমাদের দাস-দাসীগণের মধ্যে যারা সৎ ,তোমরা তাদের বিবাহ প্রদান কর। যদি তারা অভাবগ্রস্ত হয় ,তা হলে আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহ দ্বারা তাদেরকে সচ্ছল করবেন। বস্তুত আল্লাহ্ প্রাচুর্যের অধিকারী এবং সর্বজ্ঞানী। ”

অতঃপর ইমাম জাওয়াদ (আ.) হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর দেনমোহরের অনুরূপ (পাঁচশত দেরহাম) দেনমোহর ধার্য করে মামুনের কন্যাকে বিবাহ করার সম্মতি জানান। মামুন তার কন্যার পক্ষ থেকে বিবাহের আকদ পড়ে এবং ইমাম জাওয়াদ (আ.) কবুল করেন। অতঃপর মামুনের নির্দেশে উপস্থিত সকলকে পুরস্কৃত করা হয় এবং বিশাল ভোজনেরও আয়োজন হয়।

অবশ্যই লক্ষণীয় যে ,মামুনের এসকল বন্ধুত্বের ভান এবং ভণ্ডামী আর এই বিবাহ শুধুমাত্র রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই। আর এটা বুঝে নেওয়া সম্ভব যে ,মামুন এ বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে বিশেষ করে কয়েকটি উদ্দেশ্য হাসিল করার চেষ্টায় ছিল।

1. নিজ কন্যাকে ইমাম জাওয়াদের ঘরে পাঠিয়ে তাঁকে সর্বক্ষণের জন্য সূক্ষ্ণভাবে নিজের নখদর্পনে রাখা এবং তার কার্যকলাপ সম্পর্কে জ্ঞাত থাকা। মামুনের কন্যাও যে যথারীতি এ গুপ্তচরের দায়িত্ব খুব ভাল ভাবেই সম্পাদন করত ইতিহাস তার চরম সাক্ষী।

2. এ বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে ইমামকে তার আনন্দ-ফূর্তিতে পূর্ণ দরবারের সাথে জড়িত করা এবং খেলাধূলা ,বিলাসিতা ও পাপাচারিতার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া। আর এর মাধ্যমে ইমামের মহত্ত্ব ও মর্যাদার উপর আঘাত হানা। তাছাড়া ইমামকে জনসমক্ষে তাঁর ইসমাত (নিষ্পাপত্বের) ও ইমামতের সমুন্নত মর্যাদা থেকে অবনমিত ,লাঞ্ছিত এবং ঘৃণ্য করা।

মুহাম্মদ ইবনে রিয়ান বলেন : মামুন ইমামকে বিলাসিতার দিকে প্ররোচিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করত কিন্তু কখনই সফল হয়নি। ইমামের বিবাহ উপলক্ষে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল ,মামুন একশত কানিজকে বাধ্য করল যে ,যখন ইমাম জাওয়াদ (আ.) আসন গ্রহণ করবেন ,তোমরা তাকে অভিনন্দন জানাতে যাবে। সুন্দরী কানিজরা তাই করল কিন্তু ইমাম তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপই করলেন না এবং কার্যত বুঝিয়ে দিলেন যে ,তিনি তাদের এ সকল অপকর্ম থেকে খুবই অসন্তুষ্ট।

একই অনুষ্ঠানে মামুন এক নর্তককে গান বাজনা করার জন্যে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু নর্তক যখনই তার গান-বাজনা শুরু করল ইমাম জাওয়াদ (আ.) তাকে এক ধমক দিয়ে বললেন : বেয়াদব আল্লাহকে ভয় কর ’ । নর্তক ইমামের কড়া নির্দেশে (যা আধ্যাত্মিকতা ও খোদায়ী শক্তিতে পূর্ণ ছিল) এতই ভয় পেয়ে গেল যে বাদ্যযন্ত্রটি তার হাত থেকে পড়ে গেল এবং নর্তক তার শেষ জীবন পর্যন্ত ঐ হাত দিয়ে আর বাদ্য বাজাতে পারেনি।9

3. যেমনটি পূর্বেই বলা হয়েছে এ বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে মামুন আলী বংশীয়দেরকে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা থেকে বিরত রাখা এবং নিজেকে তাদের ভক্ত ও অনুরাগী হিসেবে উপস্থাপন করাই ছিল মামুনের প্রধান লক্ষ্য।

4. জনগণকে প্রবঞ্চণা করার জন্যে সে কখনো কখনো বলত : আমি এ কারণে এ বিবাহ সম্পন্ন করেছি যে ,আবু জাফরের সন্তান আমার কন্যা গর্ভে ধারণ করবে। আর আমি এমন শিশুর নানা হবো যে হচ্ছে রাসূল (সা.) ও আলী (আ.)-এর বংশের।10 কিন্তু সৌভাগ্যবশত মামুনের এ প্রতারণাও নিস্ফল রইল। কেননা মামুনের কন্যার গর্ভে ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর কোন সন্তানই জন্ম গ্রহণ করেনি। ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর সন্তানরা (দশম ইমাম হযরত ইমাম হাদী সহ মূসা মোবারকা ’ হুসাইন ,ইমরান ,ফাতেমা ,খাদিজা ,উম্মে কুলসুম ,হাকিমাহ) সকলেই ইমামের অন্য স্ত্রী ,সম্মানিতা ও আদর্শ দাসী সামানা মাগরেবিয়ার ’ গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন।11

সব মিলিয়ে এ বিবাহ যার জন্যে মামুন উঠেপড়ে লেগেছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ছিল। সুতরাং যদিও এ বিবাহ আড়ম্বরপূর্ণ ছিল কিন্তু ইমামের কাছে তার বিন্দুমাত্র মূল্য ছিল না। কেননা তিনিও তার মহান ও পুণ্যবান পূর্বপুরুষদের ন্যায় দুনিয়ার প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই করতেন না বরং নীতিগতভাবে মামুনের সাথে জীবন যাপন ইমামের জন্য চাপিয়ে দেওয়া এক কঠিন ভোগান্তি ছিল।

হুসাইন মাকারী বলেন : বাগদাদে গিয়ে ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর সাক্ষাৎ পেয়ে ধন্য হলাম। দেখলাম ইমাম জাওয়াদ (আ.) বেশ সাচ্ছন্দ্যে আছেন। মনে মনে ভাবলাম ইমাম যে প্রাচুর্যের মধ্যে আছেন ,আর হয়ত নিজ বাসস্থান মদীনায় ফিরে আসবেন না। ইমাম জাওয়াদ ক্ষণিকের জন্যে অবনত মস্তকে থাকার পর যখন মাথা উঠিয়ে বসলেন তখন তাঁর চেহারা হলুদ হয়ে গিয়েছিল এবং ঐ অবস্থায় বললেন :

হে হুসাইন ,আমাকে যে অবস্থায় (প্রাচুর্যের মধ্যে) দেখছ ,তার চেয়ে রাসূল (সা.)- এর রওজার নিকট শুকনো রুটি আর লবণ ভক্ষণ আমার কাছে অধিক প্রিয়।*

সে কারণেই ইমাম জাওয়াদ (আ.) বাগদাদে না থেকে স্ত্রীকে (উম্মুল ফাযল) নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন এবং 220 হিজরি পর্যন্ত তিনি মদীনাতেই অবস্থান করেন।

বর্ণিত আছে যে ,ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর সাথে মামুনের কন্যার বিবাহ হওয়ার পর ঐ জলসাতেই যেখানে ইমাম জাওয়াদ (আ.) মামুন ,ইয়াহিয়া এবং আরও অনেকে উপস্থিত ছিল ইয়াহিয়া তাঁর কাছে প্রশ্ন করল : রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে ,জিব্রাইল (আ.) রাসূল (সা.)-এর উপর নাজিল হলেন এবং বললেন : হে মুহাম্মদ (সা.)! আল্লাহ্ আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং বলেছেন আমি আবু বকরের উপর সন্তুষ্ট ,তাকে জিজ্ঞেস কর সেও কি আমার প্রতি সন্তুষ্ট ? এ হাদীস সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী ?12

ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন : আমি আবু বকরের ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। কিন্তু যে এই হাদীস বর্ণনা করেছে তাকে রাসূল (সা.)-এর বিদায় হজে পেশ কৃত হাদীসের প্রতিও বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন : আমার প্রতি মিথ্যারোপ কারীদের সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আমার পরে এদের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে আমার প্রতি মিথ্যারোপ করবে তার স্থান হবে জাহান্নামের আগুনে। সুতরাং আমার নামে কোন হাদীস বর্ণিত হলে তা আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নতের সাথে মিলিয়ে দেখবে। যদি তা আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নতসম্মত হয় তাহলে তা গ্রহণ করবে আর যদি কিতাব ও সুন্নতের খেলাফ হয় তাহলে তা বর্জন করবে। ’ ইমাম জাওয়াদ (আ.) আরও বলেন : এই রেওয়ায়েত (আবু বকর সম্পর্কে) আল্লাহর কিতাব ও সুন্নতের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। কেননা আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন :

) و َلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ ۖ وَنَحْنُ أَقْرَ‌بُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِ‌يدِ(

“এবং নিশ্চয় আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার আত্মা তাকে যা কিছু প্ররোচনা দেয় তাও আমরা অবগত আছি এবং আমরা (তার) জীবন-শিরা অপেক্ষাও তার অধিকতর নিকটে আছি (সূরা ক্বাফ : 16) । ”

তুমি কি বলতে চাও আবু বকরের সন্তুষ্টি অথবা অসন্তুষ্টি আল্লাহর নিকট লুকায়িত আছে যে তিনি ঐ বিষয়ে রাসূলকে প্রশ্ন করবেন ? এটা বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব।

ইয়াহিয়া আবারও প্রশ্ন করল : রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে ,আবু বকর এবং ওমর জমিনের বুকে আসমানে জিব্রাইল (আ.) ও মিকাইল (আ.)-এর অনুরূপ ;এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী ? ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন : এই হাদীসের ব্যাপারেও যথেষ্ট সতর্ক মনোযোগের প্রয়োজন রয়েছে। কেননা জিব্রাইল ও মিকাইল (আ.) আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত দুই ফেরেশতা ,তারা কখনোই গোনাহ করেনি এবং এক মুহুর্তের জন্যেও আল্লাহর অবাধ্য হননি। কিন্তু আবু বকর ও ওমর পূর্বে মুশরিক ছিল। যদিও ইসলামের আগমনের পর মুসলমান হয়েছিল কিন্তু তাদের জীবনের অধিকাংশ সময়কেই শিরক ও মূর্তিপূজার মাধ্যমে অতিবাহিত করেছিল।

সুতরাং এটা একান্তই অসম্ভব যে ,আল্লাহ্তায়ালা তাদেরকে জিব্রাইল ও মিকাইল (আ.)-এর সাথে তুলনা করবেন।

ইয়াহিয়া বলল : অনুরূপ অপর এক হাদিসে বলা হয়েছে যে ,আবু বকর ও ওমর বেহেশতের বৃদ্ধদের সর্দার। এ হাদিস সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী ?

ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন : এ হাদীস কোন ক্রমেই সঠিক হতে পারে না। কেননা বেহেশত বাসীরা সকলেই যুবক এবং সেখানে বৃদ্ধদের কোন স্থানই নাই। অতএব ,আবু বকর ও ওমরকে তাদের সর্দার হওয়ার কোন প্রশ্নই আসতে পারে না। বনি উমাইয়ারা এই হাদীসকে রাসূল (সা.)-এর ঐ হাদীসের মোকাবেলায় জাল করেছে যাতে13 রাসূল (সা.) বলেছেন :

الحسن والحسين سيد الشباب اهل الجنة

হাসান ও হুসাইন বেহেশতের যুবকদের সর্দার

ইয়াহিয়া আবারও প্রশ্ন করল : হাদীসে আছে ওমর বেহেশতের প্রদীপ। ইমাম জাওয়াদ (আ.) জবাবে বললেন : ইহাও অসম্ভব। কেননা বেহেশতে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণ ,আদম (আ.) ,রাসূল (সা.) এবং সকল নবিগণ উপস্থিত থাকবেন ,তবে বেহেশত তাঁদের নূরে নূরানী না হয়ে ওমরের নূরে নূরানী হবে ,কিরূপে সম্ভব ?!

ইয়াহিয়া আবারও বলল : ওমর যা বলে তা ফেরেশতাগণের পক্ষ থেকে বলে। ইমাম জাওয়াদ (আ.) উত্তরে বললেন : আমি ওমরের ব্যপারে কিছু বলতে চাচ্ছিনা কিন্তু যেহেতু তোমাদের দৃষ্টিতে ওমরের থেকে শ্রেষ্ঠ বলে পরিগণিত আবু বকর মিম্বরের উপরে বলত :

انّ لي شيطاناً يعتريني

আমার ঘাড়ে একটা শয়তান আছে,স ে আমাকে বিচ্যুত করে।

যখনই দেখবে যে ,আমি সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছি আমাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। ’ তাছাড়া ইতিহাসে এর কোন দৃষ্টান্তও পাওয়া যায়না যে ,ওমর ফেরেশতাদের পক্ষ হতে কথা বলত ,এটি নিছক দাবী বৈ কিছুই নয়।

ইয়াহিয়া বলল : হাদীসে পাওয়া যায় যে ,রাসূল (সা.) বলেছেন : যদি আমি নবুওয়াত প্রাপ্ত না হতাম তাহলে ওমর নবুওয়াত প্রাপ্ত হতো। 14 ইমাম জাওয়াদ (আ.) জবাবে বললেন : আল্লাহর কিতাব এই হাদীস অপেক্ষা অধিক সত্য। আল্লাহ্তায়ালা কোরআনে কারিমে বলেছেন :

) و َإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّينَ مِيثَاقَهُمْ وَمِنكَ وَمِن نُّوحٍ وَإِبْرَ‌اهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَى ابْنِ مَرْ‌يَمَ ۖ وَأَخَذْنَا مِنْهُم مِّيثَاقًا غَلِيظًا(

“এবং (স্মরণ রাখ) যখন আমরা নবীদের নিকট হতে তাঁদের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম এবং তোমার নিকট হতেও এবং নূহ , ইবরাহীম ,মূসা এবং মারিয়ামের পুত্র ঈসার নিকট হতেও বস্তুতঃ আমরা তাদের সকলের নিকট হতেই এক দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম (সূরা আহযাব : 7) । ”

এই আয়াত থেকে স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান হয় যে ,আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাঁর নবীদের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন ,এমতাস্থায় কিরূপে সম্ভব যে তারা অঙ্গীকার ভঙ্গ করবেন ? তাছাড়া কোন নবীই চোখের পলক পড়ার ন্যায় সামান্যতম শিরকও করেননি। কিরূপে সম্ভব যে ,মহান আল্লাহ্ এমন ব্যক্তিকে নবুওয়াত দান করবেন যে জীবনের অধিকাংশ সময়কেই শিরকের মাধ্যমে অতিবাহিত করেছে ?!

রাসূল (সা.) আরও বলেছেন : যখন আদম (আ.) মাটি ও পানির মধ্যে ছিলেন (অর্থাৎ যখন আদম সৃষ্টিই হননি) আমি তখনও নবী ছিলাম। ”

পুনরায় ইয়াহিয়া প্রশ্ন করল : হাদীসে আছে রাসূল (সা.) বলেছেন : সাধারণত আমার কাছে ওহী আসা বন্ধ হতো না ,তবে যদি তেমনটি ঘটত তবে মনে করতাম খাত্তাব পরিবারের উপর ওহী নাযিল হয়েছে। অর্থাৎ নবুওয়াত আমার কাছ থেকে তাদের কাছে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে ।

ইমাম জাওয়াদ (আ.) জবাবে বললেন : এটাও অসম্ভব। কেননা এটা হতেই পারেনা যে ,রাসূল (সা.) তাঁর নবুওয়াতের প্রতি সন্দেহ করবেন। আল্লাহ্তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন :

) الل َّـهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُ‌سُلًا وَمِنَ النَّاسِ ۚ إِنَّ اللَّـهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ(

“ আল্লাহ্তায়ালা মনোনীত করে থাকেন রাসূলগণকে ফেরেশতাগণের মধ্য হতে এবং মানুষের মধ্য হতেও। নিশ্চয় আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা,সর ্বদ্রষ্টা (সূরা হজ্ব : 75) । ”

সুতরাং আল্লাহর মনোনয়নের পর কোন নবীর জন্য তার স্বীয় নবুওয়াতের প্রতি কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ থাকেনা।

ইয়াহিয়া পুনরায় প্রশ্ন করল : হাদীসে আছে যে ,রাসূল (সা.) বলেছেন : যদি আজাব নাজিল হতো ওমর ভিন্ন আর কেউই তা থেকে পরিত্রাণ পেত না। ”

ইমাম জাওয়াদ (আ.) জবাব দিলেন : এটাও অসম্ভব। কেননা আল্লাহ্তায়ালা তাঁর রাসূলকে বলেছেন :

) و َمَا كَانَ اللَّـهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنتَ فِيهِمْ ۚ وَمَا كَانَ اللَّـهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُ‌ونَ(

“ এবং আল্লাহ্ এমন নন যে,ত িনি তাদেরকে আযাব দিবেন এমতাবস্থায় যে ,তুমি তাদের মধ্যে রয়েছ এবং আল্লাহ্ এমনও নন যে ,যখন তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে তখন তিনি তাদেরকে আযাব দিবেন (সূরা আনফাল : 33) ।

অতএব ,যতক্ষণ পর্যন্ত রাসূল (সা.) জনগণের মধ্যে থাকবেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানেরা ক্ষমা প্রার্থনা করবে ততক্ষণ আল্লাহ্তায়ালা তাদেরকে আজাব দিবেন না।15

ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর শাহাদাত

মামুন 218 হিজরীতে মারা গেলে তার ভাই মো ’ তাসেম তার স্থলাভিষিক্ত হয়। সে ইমাম জাওয়াদকে নিকট থেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য 220 হিজরীতে ইমামকে পুনরায় বাগদাদ নিয়ে আসে। যেমনটি পূর্বেই বলা হয়েছে ,চোরের হাতের কোন অংশ কাটা হবে তা নির্ধারনের জন্য যে বৈঠকের আয়োজন করা হয় ইমাম জাওয়াদও (আ.) তাতে উপস্থিত ছিলেন। বাগদাদের কাজী ইবনে দাউদ সহ অন্যান্যরা ইমাম জাওয়াদের কাছে পরাজিত হয়ে লজ্জিত হয়। তার কিছুদিন পর ইবনে আবি দাউদ ঈর্ষা এবং প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে মো ’ তাসেমের কাছে গিয়ে বলল :

শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে ,কিছুদিন পূর্বে যা ঘটে গেল তা আপনার হুকুমতের জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়। কেননা আপনি সকল জ্ঞানী ও রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের সামনে আবু জাফর অর্থাৎ ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর ফতোয়াকে (যাকে অধিকাংশ মুসলমানেরা ইসলামের খলিফা এবং আপনাকে হকের আত্মসাৎকারী মনে করে) অন্যদের উপর প্রাধান্য দিলেন। এ খবর জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তা শিয়াদের জন্য প্রত্যক্ষ প্রমাণ স্বরূপ।

ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর সাথে চরমভাবে শত্রুতা পোষণকারী মো ’ তাসেম ,ইবনে আবি দাউদের বক্তব্য দ্বারা পুলকিত হলো এবং ইমামকে শহীদ করতে প্রয়াসী হলো। অতঃপর 220 হিজরীর যিলকদ মাসের শেষের দিকে ইমাম জাওয়াদকে শহীদ করে স্বীয় জঘন্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সক্ষম হয়।

ইমাম আবু জাফর আলী আল জাওয়াদ (আ.)-এর পবিত্র দেহ মোবারককে বাগদাদের কুরাইশ সমাধিস্থলে তাঁর পিতামহ হযরত ইমাম মূসা ইবনে জাফরের মাজারের পাশে সমাহিত করা হয়।16 তাঁর এবং তাঁর বংশধরের উপর আল্লাহর দরুদ বর্ষিত হোক। এ দু ’ মহামানবের মাজার শরীফ বর্তমানে কাযেমাইন ” নামে সুপরিচিত এবং যুগ যুগ ধরে তা মুসলমানদের পবিত্র স্থান ও যিয়ারতগাহ হিসাবে পরিগণিত হয়ে আসছে।