হযরত আবু তালিবের নিকট কাফেরদের অভিযোগ
যে মোহাম্মদ (সা.)-এর শিশু-কিশোর ও যৌবনকাল আরবের কাফের-মুশরিক ও আরব অনারবদের মাঝে অতিবাহিত হয়েছে , যারা তাঁর চরিত্রমাধুরীতে মুগ্ধ হয়ে তাঁর নাম রেখেছিল‘
আল-আমিন’
অর্থাৎ সত্যবাদী , যারা মোহাম্মদ (সা.)-এর দেয়া সমাধান মেনে নিত অনায়াসে। মাত্র আট বছর বয়সে যিনি‘
হজরে আসওয়াদ’
নামক কালো পাথর স্থানান্তর নিয়ে উদ্ভূত গোত্রীয় দ্বন্দ্বের শান্তিময় সমাধান করেছিলেন। পাথরটি চাদরের মাঝখানে রেখে চার গোত্রপতিকে চার কোন ধরার মাধ্যমে তা স্থানান্তর ও নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপনের পরামর্শ প্রদান পূর্বক নিষ্পত্তি করেন। এতে সকলে তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট ছিল।
আবার সেই কাফেরাই তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ , কুৎসা রটনা ও অস্ত্রধারণ এমনকি তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনাও গ্রহণ করে , কারণ ছিল মোহাম্মদ (সা.) তাদের বাপ-দাদার ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তিনি একাধিক দেব-দেবীর বিপক্ষে ও এক আল্লাহর পক্ষে কথা বলেন। এটাই মোহাম্মদ (সা.)-এর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথম অভিযোগ
একবার আবু জাহেল , আবু লাহাব , আবু সুফিয়ান , ওৎবা , শাইবা , প্রমুখ কাফের মুশরিক নেতৃবর্গ জনাব আবু তালিবের নিকট উপস্থিত হয়ে অভিযোগ করল যে ,“
আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র মোহাম্মদ আমাদের বাপ-দাদার ধর্মের বিরোধিতা করছে। এমনকি আমাদের পূজনীয় দেব-দেবী লাত , মানাত ও ওজ্জা মূর্তি সম্পর্কে অপমানজনক কথা বলছে”
। হযরত আবু তালিব তাদের অভিযোগ শুনে শুধু এতটুকু তাদের জিজ্ঞেস করলেন ,“
তোমরা কি মোহম্মদকে কখনও মিথ্যে বলতে শুনেছ ?”
সকলে মস্তক অবনত কন্ঠে স্বীকার করেছিল ,“
না আমরা শুনিনি”
। অতঃপর তিনি বললেন ,“
তাহলে মোহাম্মদ যে আল্লাহর কথা বলছে তিনি অবশ্যই এক ও অদ্বিতীয় এবং সর্বশক্তিমান আর আমাদের ও তোমাদের পালনকর্তা।”
হযরত আবু তালিবের এরূপ বক্তব্য শুনে কাফেররা বিরক্ত হয়ে তাৎক্ষণিক বিদায় নিল।
দ্বিতীয় অভিযোগ
যতই দিন যাচ্ছিল একত্ত্ববাদ ততই প্রসার লাভ করছিল। মোহাম্মদ (সা.)-কে তাঁর কাজ থেকে বিরত রাখার সকল প্রচেষ্টা ও অব্যাহত রয়েছে। তবুও ইসলামকে জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণকারী লোকজনের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণনাশের জন্য বিষ প্রয়োগের চেষ্টাও বার বার ব্যর্থ হয়েছে। অবশেষে কাফের সর্দাররা পুনরায় হযরত আবু তালিবের স্মরনাপন্ন হলো। তারা বললো ,“
হে আবু তালিব! আপনার মর্যাদা ও ঐতিহ্যের সম্মানে আমরা এতদিন আপনার ভাতিজা মোহাম্মদের কার্যকলাপ অনেক সহ্য করেছি। কিন্তু আমাদের ধৈর্যেরও একটা সীমা আছে। এখন আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম। কেননা , মোহাম্মদ প্রকাশ্যে আমাদের বাপ-দাদার ধর্মের ও দেব-দেবীর বিরোধিতা করছে। আপনি হয় তাকে একাজ থেকে বিরত রাখুন। না হয় তার পক্ষে অস্ত্রধারণ করুন। তরবারির দ্বারাই বিষয়টির ফয়সালা হোক।”
একথা শুনে হযরত আবু তালিব বললেন ,“
মোহাম্মদ কি মানুষদের মন্দ কাজের দিকে আহবান করছে ?”
হযরত আবু তালিবের এমন কথায় কাফেরেরা হতভম্ব হয়ে ফিরে গেল। আবার হাশেমিদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারনের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ভেবে তারা অগ্রসর হতে সাহসী হলো না।
তৃতীয় প্রচেষ্টা
বহু বাধা বিপত্তি ও গোপণ ষড়যন্ত্র করেও যখন ইসলামের ক্রমাগত অগ্রযাত্রা ঠেকানো গেল না , তখন কাফের সর্দারেরা লোভ-লালসা ও প্রলোভনের পথ বেছে নিল। আবার তারা হযরত আবু তালিবের স্মরণাপন্ন হলো এবং বলল ,“
হে আবু তালিব! আমরা আপনার ভাতিজার সাথে এ পর্যন্ত অনেক ভাল ব্যবহার করেছি , আমরা তাকে সমগ্র আরবের নের্তৃত্ব কর্তৃত্ব ও সবচেয়ে সুন্দরী নারী এবং অজস্র ধন-সম্পদ দেয়ারও প্রস্তাব করেছি। বিনিময়ে সে আমাদের বাপ-দাদার ধর্মকে মেনে নিবে। কিন্তু সে আমাদের উপহার ও প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। শুধু তাই নয় এখন সে আরও জোরেশোরে প্রকাশ্যে দেব-দেবীর বিরুদ্ধে অপমানজনক কথা বলছে এবং আমাদের বাপ-দাদার ধর্মকে ভ্রান্ত বলে আখ্যায়িত করছে। এ অবস্থা আমরা আর চলতে দিতে পারি না। এর পূর্বেও আমরা আপনাকে এ বিষয়ে নালিশ করেছিলাম কিন্তু আপনি আমাদের কথা গ্রাহ্য করেননি। সুতরাং আজই এর সুরাহা করতে হবে। হয় আপনার ভাতিজা মোহম্মদের ধর্ম প্রচার বন্ধ করুন , না হয় তাকে আমাদের হাতে সোপর্দ করুন।”
কাফের সর্দারদের এরূপ বক্তব্যে হযরত আবু তালিব গর্জে উঠে বললেন ,“
হে সর্দারগণ সুস্পষ্ট ভাবে জেনে রাখো , মোহাম্মদকে সোপর্দ করা তো দূরের কথা কেউ তার চুল পরিমাণ ক্ষতির চিন্তাও করো না। অন্তত আমি যতদিন বেঁচে আছি। আর যদি তা তোমাদের কারো হতে প্রকাশ পায় , তবে তার দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করা হবে।”
মোহাম্মদ (সা.)-এর জন্য হযরত আবু তালিবের এরূপ দৃঢ় কঠিন অবস্থান কাফেরদের নিরাশ করে দিল। আর ভাতিজাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন ,“
হে মোহাম্মদ! আজ থেকে তুমি একাগ্রচিত্তে আল্লাহর বিধান ও বিষয়াবলির কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে চালিয়ে যাও। আমি কখনও তোমাকে বিচলিত হতে দেব না এবং তোমাকে কাফেরদের হাওলাও করব না। আল্লাহর কসম আমি জানি তোমার দাওয়াত সত্য , তুমি ঐ রবের পক্ষ থেকে পরিপূর্ণ নসিহতকারী ও বিশ্বস্ত। আমি বেঁচে থাকতে কেউ তোমাকে কষ্ট দিতে পারবে না।”
এখন প্রশ্ন হচ্ছে উল্লিখিত উক্তির পরেও কি হযরত আবু তালিবের ঈমান আনার প্রয়োজন রয়েছে ? আর যাদের তা প্রয়োজন , তারা কি ভেবে দেখেছেন ? যে ঈমানী দায়িত্ব হযরত আবু তালিব নবী ও তাঁর ইসলামের জন্য সম্পন্ন করে গেছেন এর কোটি ভাগের এক ভাগও তাদের পক্ষে করা সম্ভব কি ?
আমি এখন আমার প্রিয় নবী (সা.)-এর স্পর্শকরা‘
হযরে আসওয়াদ’
পাথরের অন্ত:নিহীত তথ্য মুমেনীনদের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করছি। উক্ত পাথর নিয়ে চৌদ্দ’
শ বছর পূর্বে যে দ্বন্দের উদ্ভব হয়েছিল , নবী (সা.) তা মিটিয়েছিলেন কিশোর বয়সে। আর মহান আল্লাহ পাক তাঁর নবী (সা.)-এর স্পর্শের কারণে এই পাথরকে যে মর্যাদা দান করলেন তা হচ্ছে , সে কেয়ামত পর্যন্ত হাজীদের পাপ মোচন করে যাবে। আফসোস! ঐসকল মুসলমানের প্রতি যারা ভুলে গেলেন আমার নবী (সা.)-এর আট বছর বয়স থেকে শুরু করে পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত হযরত আবু তালিবের দেহ , মন , প্রাণ ও সমাজ সংসারে নবী (সা.)-এর স্পর্শ কিংবা ছোঁয়া রয়েছে কত শত কোটি ? তাহলে সেই মহান আবু তালিবের মর্যাদা কত উর্দ্ধে তাকি নির্ণয়যোগ্য ?