আধ্যাত্মিক সাধনায় মোহাম্মদ (সা.)
বিবি খাদিজাকে বিবাহের পর নবী (সা.)-এর আর্থিক সঙ্কট মোচন হয়েছিল। তাই সাংসারিক প্রতিকূলতা সামাল দিতে বিবি খাদিজা-ই যথেষ্ট ছিলেন। যে কারণে নবী (সা.) ঐশী চিন্তায় নিমগ্ন হওয়ার অধিক সময় ও সুযোগ পেলেন। আর শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন চিন্তাশীল। মুসলমানদের একটা বিরাট অংশ মনে করেন যে , নবী (সা.) প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়ার পর থেকেই এক অজানা রহস্যলোকের সাথে তাঁর আত্মার সংযোগ ছিল। আধ্যাত্মিক জগতের অনেক দৃশ্য তাঁর মনসপটে ভেসে উঠতে লাগল। মনে হতো কে যেন তাঁর কর্ণকুহরে কি যেন বলে গেল। কে যেন তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে , কে যেন চোখের সামনে এসে আবার মূহূর্তেই হারিয়ে গেল। কখনও কখনও তিনি স্পষ্ট শুনতে পেতেন , কে যেন ডেকে বলছে ,“
মোহাম্মদ আপনি আল্লাহর রাসূল”
। আর স্বপ্নে দেখতে পেতেন , স্বর্গীয় শোভামিশ্রিত অলৌকিক বিষয়াবলি। এভাবে অন্তরের প্রদীপ্ত চেতনায় তিনি অধীর হতে লাগলেন এবং এভাবেই তাঁর 15 বছর অতিবাহিত হলো। এক অজানা শঙ্কা-ভীতি , অস্বস্তি ও উদ্বেগ এবং একই সাথে অজানাকে জানার দূর্জয় কৌতূহল ও জীবন-জিজ্ঞাসা তাঁকে অভিভূত করে তুললো। সংসারের কর্মকোলাহল যেন তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনাকে ব্যর্থ না করে। সমাজ জীবনের পঙ্কিলতা যেন ঐ পবিত্র জ্যোতির গতিস্রোত রুদ্ধ না করে।
আর বাস্তবতা হচ্ছে সহধর্মিণী খাদিজা প্রিয় স্বামীর সকল কর্মকাণ্ডে সার্বিক সহযোগিতা করতে লাগলেন। তিনি নবী (সা.)-কে 2/3 দিনের খাদ্য পানীয় প্রস্তুত করে দিতেন। নবী (সা.) তা নিয়ে হেরা গুহায় গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। খাদ্য পানীয় শেষ হয়ে গেলে নবী (সা.) গৃহে ফিরে আসতেন , আবার যেতেন। কখনও ফিরে আসতে দেরি হলে বিবি খাদিজা নিজেই খাদ্য পানীয় নিয়ে হাজির হতেন অথবা হযরত আলীকে দিয়ে হেরা গুহায় পাঠিয়ে দিতেন। বিবি খাদিজা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর স্বামীর মধ্যে এক অন্তঃবিপ্লব চলছে এবং তা ক্রমশ একটি পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নিশ্চই তিনি আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ , যা তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন।
নবী (সা.)-এর ধ্যানমগ্ন দিনগুলোতে তিনি নিবিড় আত্মতৃপ্তি উপলব্ধি করছিলেন। আর তা সম্ভব হয়েছিল বিবি খাদিজা এবং কিশোর আলীর স্বক্রিয় সহযোগিতার দরুন। তখন রমজান মাস , এক গভীর রাতে নবী (সা.) ধ্যানমগ্ন ছিলেন। হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন কেউ যেন তাঁর নাম ধরে ডাকছেন ,“
হে মোহাম্মদ”
, তিনি চোখ খুললেন , দেখলেন এক জ্যোর্তিময় ফেরেস্তা তাঁর সম্মুখে দণ্ডায়মান। তাঁর জ্যোতিতে গুহা আলোকিত হলো। তিনি বললেন ,“
আমি আল্লাহর বাণী বাহক ফেরেস্তা , জিব্রাইল . হে মোহাম্মদ ,
)
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ(
পাঠ করুন আপনার প্রভুর নামে , যিনি সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন।”
মহা সত্যের প্রথম উপলব্ধিতে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েন। নবী (সা.) ত্বরা করে বিবি খাদিজার কাছে ছুটে গেলেন। বিবি খাদিজা তাঁর অস্থিরতা দেখে বুঝতে পেরে বললেন ,“
আপনার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আল্লাহ কখনও আপনাকে নিরাশ করবেন না , কারণ আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেন না। আপনি অন্যের জন্য নিজে কষ্টের বোঝা বহন করেন। মানুষের দুর্যোগ দূর্বিপাকে সাহায্য সহায়তাকারীর ভূমিকা পালন করেন। দুঃস্থ নিঃস্বদের জন্য উপার্জনের ব্যবস্থা করেন এবং ঘোর বিপদেও সত্য থেকে বিচ্যুত হন না।”
এভাবে স্বামীকে সান্তনা দিলেন।
অতঃপর তাঁর দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই ওরাকা বিন নওফেলের স্মরণাপন্ন হলেন। যিনি ছিলেন ইঞ্জিল কিতাবের অনুসারী একজন জ্ঞানতাপস। বিবি খাদিজা নবী (সা.)-এর বিষয়ে তাকে অবহিত করলেন। ওরাকা কিতাব মিলিয়ে খুশিতে উচ্চারণ করলেন“
কুদ্দুসুন কুদ্দুসুন‘
এটা সেই নিদর্শন যা মূসা ও ঈসার প্রতি প্রেরিত হয়েছিল। তবে মনে রেখো সামনে অনেক বিপদ , সাবধান থেকো”
। আবার বললেন ,“
হায় মোহাম্মদ , তোমার দেশবাসী তোমার ওপর কতই না অত্যাচার করবে। তোমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিবে। তুমি আদম সন্তানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আমি বেঁচে থাকলে তোমাকে সাহায্য করব।”
ওরাকার মুখে এমন সব সংবাদ শুনে বিবি খাদিজার অন্তর তৃপ্ত হলো। তাঁর স্বামী মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দাদের অন্যতম।
তিনি ঘরে ফিরে এসে নবী (সা.)-এর হাতে হাত রেখে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন এবং আল্লাহর দ্বীন গ্রহণের প্রথম স্বাক্ষ্যদাতার গৌরব অর্জন করেন। আর দ্বিতীয় স্বাক্ষ্যদাতা হলেন কিশোর হযরত আলী। মহান সৃষ্টিকর্তার পবিত্র দ্বীন ইসলাম তাঁর প্রিয় নবী (সা.)-এর পর , যাদের সক্রিয় সহযোগিতা ও প্রাণপন ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের নিকট পর্যন্ত এসে পৌঁছিয়েছে। তাঁদের সে অবদানকে যদি কেউ ভুলে যায় কিংবা খাটো করে দেখে তবে তা হবে অকৃজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ নতুবা নিরেট মোনাফেকি।
এখানে আরো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করছি , নবী (সা.) প্রকাশ্যে নবুয়্যত ঘোষণা দেয়ার পূর্বে তিনি তাঁর চাঁচা হযরত আব্বাসের নিকট গিয়ে বলেছিলেন যে ,“
আল্লাহ আমাকে তাঁর হুকুম প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন , সুতরাং এ মর্মে আপনি আমাকে সাহায্য করুন , আমার বাহুকে শক্তিশালী করুন।”
ঐসময় হযরত আব্বাস তাঁর দূর্বলতা প্রকাশ করে বলেছিলেন ,“
হে বৎস! তুমি আমার ভাই আবু তালিবের নিকট এই বক্তব্য উপস্থাপন করো , তিনি আমাদের সকলের বয়োজ্যেষ্ঠ তিনি তোমাকে সাহায্য কিংবা সঙ্গ কোনোটাতেই পিছপা হবেন না।”
অতঃপর উভয়ই হযরত আবু তালিবের সম্মুখে উপস্থিত হলেন এবং হযরত আব্বাস নবী (সা.)-এর বক্তব্য পূনরাবৃত্তি করে নিজের অক্ষমতার কথা প্রকাশ করলেন। হযরত আবু তালিব সমূদয় বক্তব্য শোনার পর নবী (সা.)-কে বুকে টেনে নিলেন। অতঃপর বললেন ,“
হে , মুহাম্মদ! যাও নির্ভয়ে ঘোষণা দাও , তোমার রবের পক্ষ হতে যা তোমাকে বলা হয়েছে। কেউ তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না , অন্তত আমি যতদিন বেঁচে আছি।”
সুহৃদ পাঠক/পাঠিকার জ্ঞাতার্থে যে বিষয়টি উল্লেখ্য তা হচ্ছে , মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর নবী রাসূল ও বান্দাদের প্রতি যে সংবাদ বা মেসেজ প্রেরিত হয় , তা তিনটি মাধ্যমে হয়ে থাকে। যেমন ওহী , ইলহাম ও স্বপ্ন । আর এ তিনটির দুটিই নবী (সা.)-এর শিশু অবস্থা থেকে বিদ্যমান ছিল। শুধু ওহী এসেছে পরিণত বয়সে। যার প্রমাণস্বরূপ বলা চলে , মাত্র আট বছর বয়সে নবী (সা.)‘
হজরে আসওয়াদ’
নামক পাথর স্থানান্তর নিয়ে যে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছিল , তিনি তার সুষ্ঠু সমাধান দেন। এর মূলে ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে শিশু নবী (সা.)-এর অন্তরে অলৌকিক মেসেজ প্রেরণ। যাকে‘
ইলহাম’
বলা হয়। যদি তা না হতো তবে ঐ পাথরকে কেন্দ্র করে প্রচুর প্রাণহানী ও গোত্রীয় দ্বন্দ্ব বিদ্যমান থাকত দীর্ঘকাল।
আমরা মুসলমানেরা শুধু নই দুনিয়ার সকল ধর্মের মানুষ এ বিষয়ে একমত যে , নবী (সা.) শিশু , কিশোর , যুবক কিংবা বৃদ্ধ অবস্থায় জীবনে কোনো কালেই কোন মিথ্যা , অশালীন , ইয়ারকী , ধোঁকা , প্রলাপ কিংবা উত্তেজিত হয়ে কোন অনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। উদাহরণস্বরূপ একটি হাদিস উল্লেখ করছি হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত , রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আপনি কখন নবুয়ত লাভ করেছেন ? তিনি বললেন ,“
যখন আদম পানি ও মাটির মাঝে ছিলেন”
। অর্থাৎ আদমের অস্তিত্বের পূর্বেও তিনি নবী ছিলেন। উল্লিখিত হাদীসে এটাই প্রমাণ করে নবী-রাসূলগণ আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত ও নির্ভুল। অর্থাৎ নবী (সা.)-এর বয়স যাই হোক না কেন , তিনি আল্লাহ কর্তৃক পরিচালিত সর্বাবস্থায়। একজন লেখক হিসেবে আমি তাই মনে করি। ইলহাম , স্বপ্ন কিংবা ওহী এর যেকোনোটি নবী (সা.)-এর কাছে আসা খুবই স্বাভাবিক। যেমনটি বলা চলে আল্লাহ পাক বিবি মরিয়মকে কথা না বলার ও রোজা পালনের বিষয় জানালেন এবং কারো কোনো প্রশ্ন থাকলে তার উত্তর লাভের উপায় হিসেবে নিজ শিশুর প্রতি ঈঙ্গিত প্রদানের কৌশল শিখিয়ে দিলেন এবং বাস্তবেও তাই ঘটেছিল। তিন দিনের শিশু ঈসা তৎকালীন বকধার্মিকদের কুরুচিপূর্ণ হীন মন্তব্যের বিরুদ্ধে কঠিন জবাব দিয়ে জানিয়ে দিলেন তাঁর মাতা বিবি মরিয়ম পৃথিবীর পবিত্রতম মহিলাদের অন্যতম।
)
قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا(
“
তিনি আল্লাহর দাস তাঁকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে এবং তাঁকে নবী মনোনীত করা হয়েছে।”
নবী ঈসা (আ.)-এর এই বক্তব্য প্রদানের বিষয়টি ছিল ইলহাম।
আবার কথিত আছে নবী ইব্রাহিম (আ.)-কে আল্লাহ পাক স্বপ্নের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন ,“
তোমার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কোরবানি করো”
। বহু ত্যাগ তিতীক্ষার পর তিনি যখন আপন সন্তান ইসমাইলকে কোরবানি দেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন , তখন তাঁর কোরবানি গৃহীত হলো। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে কোরবানি হলো এক দুম্বা। এভাবে নবী ইব্রাহীমের স্বপ্ন পরিণত হলো বাস্তবে।
আমাদের প্রিয় নবী মোহাম্মদ (সা.)-এর নিকট হযরত জিব্রাইলের আগমণই ছিল ওহী। কারণ তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন না কোনো সংবাদ নিয়েই আগমণ করতেন। উল্লিখিত ঘটনাসমূহের আলোকে এটাই প্রমাণিত যে , আল্লাহর মনোনীত কোন নবী-রাসূলই পূর্বে সাধারণ লোক ছিলেন না এবং 40 বছর পর নবী মনোনীত হয়েছেন এমন ও নয়। কারণ আল্লাহ স্বয়ং পবিত্র ও নির্ভুল এবং তাঁর মনোনীত নবী রাসূল ও ইমামগণ নির্ভুল ও মাসুম সর্বাবস্থায়।