হাদীসে দ্বাহদ্বাহ’
র পর্যালোচনা
এটা সুস্পষ্ট হযরত আবু তালিব ঈমানদার ছিলেন। যেসব অন্যায় ও অবৈধ অপবাদ তাঁর ওপর আরোপ করা হয়েছে , সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বনী উমাইয়া ও বনী আব্বাসিদের কিছু শাসকের উস্কানিতে এসব অপবাদ প্রচার করা হয়েছে। বনী উমাইয়া ও বনী আব্বাসি শাসকরা সর্বদা মহান আহলে বাইত ও হযরত আবু তালিবের সন্তানদের সঙ্গে শত্রুতা করে এসেছেন।
তাই এ বিষয়টি স্পষ্ট করা জরুরি। আর তা হলো- রাসূল (সা.)-এর একনিষ্ঠ সাথী হযরত আবু তালিবে’
র ব্যক্তিত্ব খর্ব করার যে অপচেষ্টা শত্রুরা করেছিল সেটা হাদিসে“
দ্বাহদ্বাহ”
নামে পরিচিত। এই হাদিসটি পবিত্র কোরআন ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নানা দলিলের আলোকে ভিত্তিহীন।
কিছু কিছু লেখক যেমন: সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে ,‘
সুফিয়ান ইবনে সাঈদ সুরী’
,‘
আব্দুল মালেক ইবনে উমাইর’
,‘
আব্দুল আযিয ইবনে মুহাম্মাদ দুরাওয়ারদী এবং‘
লাইস ইবনে সাঈদ’
থেকে নিম্নোক্ত দু’
টি কথা রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন ;
ক
তাঁকে (আবু তালিবকে) আগুনের মধ্যে পেলাম অতঃপর তাকে দ্বাহদ্বাহ’
তে স্থানান্তরিত করলাম। (আমার খাতিরেই তাকে আগুনের অগভীর অংশে আনা হয়েছে , তা না হলে তাকে আগুনের সবচেয়ে গভীর অংশে রাখা হত!)
খ
হয়তো বা কেয়ামতের দিন আমার শাফায়াত তাঁর (আবু তালিবের) কাজে আসবে। তাই তাকে জাহান্নামের আগুনের একটি অগভীর গর্তে রাখা হবে যে আগুনের উচ্চতা তাঁর পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পৌঁছাবে কিন্তু এতেই তার মগজ (টগবগ করে) ফুটতে থাকবে।”
উল্লেখিত বর্ণনা দুটি কল্পনা প্রসূত ও আকল বিবর্জিত। কারন আগুন গভীর কিংবা অগভীর যাই হোক না কেন , এতে নিশ্চিত কোনো প্রশান্তি নেই , উপরোন্তু মগজ টগবগের বর্ণনা রয়েছে। আবার বলা হয়েছে , হয়তোবা অর্থাৎ নবী (সা.) তাঁর শাফায়াত সম্পর্কেও নিশ্চিত নন। এত বর্ণনাকারীর জ্ঞানের অসরতাই সুস্পষ্ট। তাহলে নবীজীর নাম করে এমন উদ্ভট কিচ্ছা প্রচারের যৌক্তিকতা কতটুকু পাঠক চিন্তা করুন।
যদিও হযরত আবু তালিব যে ঈমানদার ছিলেন তার সপক্ষে অসংখ্য রেওয়ায়েত ও স্পষ্ট দলিলগুলো হাদীসে দ্বাহদ্বায় আরোপিত অন্যায় অপবাদের ভিত্তিহীনতাই প্রকাশ করেছে , তারপরও আরো বেশি স্পষ্ট করার উদ্দেশ্যে এখানে দু’
টি দৃষ্টিকোণ থেকে হাদিস-এ‘
দ্বাহদ্বাহ’
র পর্যালোচনা তুলে ধরা হল:
1। সনদগত ভিত্তিহীনতা।
2। আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের সঙ্গে এই (মিথ্যা) হাদিসটির বৈপরীত্য।
হাদীসে দ্বাহদ্বাহ’
র সনদগত ভিত্তিহীনতা :
যেভাবে বর্ণিত হয়েছে , হাদিসে দ্বাহদ্বাহ-এর বর্ণনাকারীরা হলেন যথাক্রমে:‘
সুফিয়ান ইবনে সাঈদ সুরী’
,‘
আব্দুল মালেক ইবনে উমাইর’
,‘
আব্দুল আযিয ইবনে মুহাম্মাদ দেরাওয়ারদি’
এবং‘
লাইস ইবনে সাঈদ’
।
আহলে সুন্নাতের রেজাল শাস্ত্রের পণ্ডিত ব্যক্তিত্বদের (যারা হাদিস বর্ণনাকারী রাবী ও মুহাদ্দিসদের সম্পর্কে আলোচনা করে থাকেন) দৃষ্টিতে হাদীসে দ্বাহদ্বাহ’
র রাবীদের অবস্থান :
ক
.
সুফিয়ান ইবনে সাঈদ সুরী
আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ ইবনে উসমান যাহাবী আহলে সুন্নাতের রেজাল শাস্ত্রের একজন প্রসিদ্ধ মনিষী। তিনি সুরী সম্পর্কে বলেছেন:“
সুফিয়ান ইবনে সুরী জাল হাদিসগুলোকে দূর্বল রাবী থেকে বর্ণনা করত।”
উক্ত বাক্য থেকে স্পষ্ট যে , সুফিয়ান সুরীর বর্ণনাগুলো প্রতারণামূলক। আর দূর্বল রাবী এবং অপরিচিত ব্যক্তি থেকে হাদিস বর্ণনা করার কারণেই তার বর্ণনা করা সব রেওয়ায়েতই মূল্যহীন।খ
আব্দুল মালেক ইবনে উমাইর
যাহাবী তার সম্পর্কে বলেন ,“
অতি বৃদ্ধ হওয়াতে তার স্মৃতিশক্তি কমে গিয়েছিল।”
আবু হাতেম বলেন ,“
স্মৃতি-বিভ্রাটের কারণে হাদিস সংরক্ষণের শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল এবং তার মুখস্থ শক্তিও লোপ পেয়েছিল”
।
আহমাদ ইবনে হাম্বাল বলেন ,“
আব্দুল মালেক ইবনে উমাইর হলো দূর্বল দূর্বল (রাবীদের অন্যতম) এবং বহু ভুল করত (অর্থাৎ ভিত্তিহীন ও জাল রেওয়ায়েত বর্ণনা করত)”
।
ইবনে মুঈন বলেন ,“
সে সঠিক এবং ভুল হাদীসের মিশ্রণ ঘটাত।”
ইবনে খারাশ বলেন ,“
শো’
বাহও তার ওপর সন্তুষ্ট ছিল না”
।
কুসাজ , আহমাদ ইবনে হাম্বাল থেকে বর্ণনা করেন , আব্দুল মালেক ইবনে উমাইরকে (রেওয়ায়েত বর্ণনাকারী) অত্যন্ত দূর্বল ও যয়ীফ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।”
উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে , আব্দুল মালেক ইবনে উমাইর নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর অধিকারী:
1. দূর্বল স্মৃতিশক্তি ও ভোলা মনের অধিকারী।
2. দূর্বল (রেজালশাস্ত্রের দৃষ্টিতে) অর্থাৎ যে ব্যক্তির রেওয়ায়েতে বিশ্বাস স্থাপন করা যায় না।
3. (তার রেওয়ায়েত) ভুলে পরিপূর্ণ।
4. মিশ্রণকারী (যে ব্যক্তি সঠিক রেওয়ায়েতের সঙ্গে মিথ্যা রেওয়ায়েতের মিশ্রণ ঘটায়)।
এটা স্পষ্ট , যে সব বৈশিষ্ট্য আব্দুল মালেক ইবনে উমাইর সম্পর্কে উল্লিখিত হয়েছে সেগুলোর প্রত্যেকটি তার হাদিসগুলোর ভিত্তিহীনতা প্রমাণে যথেষ্ট। আর ওই সব ত্রুটি সম্মিলিতভাবে তারই মাঝে বিদ্যমান ছিল।
গ. আব্দুল আযিয ইবনে মুহাম্মাদ দুরাওয়ারদি:
রেজাল শাস্ত্রে আহলে সুন্নাতের পণ্ডিতরা তাকে দূর্বল স্মৃতিশক্তি ও ভোলা মনের অধিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং বলেছেন ,“
দুরাওয়ারদি’
র স্মৃতিশক্তি এত দূর্বল যে তার রেওয়ায়েতের ওপর নির্ভর করা যায় না বা সেসবের সহায়তায় কোন যুক্তি প্রদর্শন করা সম্ভব নয়”
।
আহমাদ ইবনে হাম্বাল‘
দুরাওয়ারদি’
সম্পর্কে বলেন ,“
যখনই সে তার স্মৃতিশক্তির সহায়তায় কোন রেওয়ায়েত বর্ণনা করত তখন তা অসংলগ্ন , অপ্রাসঙ্গিক ও বাতিল বা ভিত্তিহীন মনে হতো।”
আবু হাতেম তার সম্পর্কে বলেন ,“
তার কথার ওপর নির্ভর করা যায় না বা তার কথার স্বপক্ষে কোনরূপ যুক্তি প্রদর্শন করা সম্ভব নয়।”
ঘ. লাইস ইবনে সাঈদ :
আহলে সুন্নাতের রেজাল শাস্ত্রের গ্রন্থাবলী অধ্যয়নে এই বিষয়টি স্পষ্ট অনুধাবনীয় যে , লাইস যে সব রাবীর নিকট হইতে হাদীস সংগ্রহ করতেন তারা সবাই অপরিচিত ও দূর্বল তথা যয়ীফ এবং তাদের বর্ণিত হাদীসের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা যায় না।
আর লাইস ইবনে সাঈদও তাদের অন্যতম যয়ীফ ও বেপরোয়া এবং অমনোযোগী রাবী (বর্ণনাকারী) হাদিস শোনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অসাবধান (অর্থাৎ কি শুনতে হবে ও কি বর্ণনা করতে হবে সে বিষয়ে তিনি সুস্থির ছিলেন না)। আর যারা তার থেকে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছে তারাও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।
ইয়াহইয়া ইবনে মুঈন তার সম্পর্কে বলেন ,“
লাইস ইবনে সাঈদ যাদের কাছ থেকে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছে (তাদের চেনার ক্ষেত্রে) এবং হাদিস শোনার ক্ষেত্রে অসাবধান ছিল , অর্থাৎ কার কাছ থেকে এবং কোন বিষয়ের বা কোন ধরনের হাদিস বর্ণনা করতে হবে সে ব্যাপারে তিনি সাবধান ছিলেন না।”
‘
নাবাতী’
তাকে দূর্বলদের অন্যতম বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি নিজ গ্রন্থ‘
আত্ তাযলীল আলাল কামেল’
-এ তার (লাইস ইবনে সাঈদ) নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি এ বইটি শুধু দূর্বল রাবীদের পরিচয় তুলে ধরার জন্যই লিখেছেন ।
এ পর্যন্ত যা কিছু বলা হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট হয় যে ,‘
হাদীসে দ্বাহদ্বাহ’
-এর প্রধান বা মূল রাবীরাই ছিলেন যয়ীফ তথা দূর্বল। আর এ কারণেই তাদের হাদিসে বিশ্বাস করা যায় না।
হাদীসে দ্বাহ্দ্বাহ্ কোরআন ও সুন্নাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় :
উল্লিখিত হাদিসটিকে রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে এভাবে সম্পৃক্ত করা হয়েছে যে , তিনি হযরত আবু তালিবকে দোযখের বৃহৎ অগ্নিকুণ্ড বা ব্যাপক আগুনের স্তর থেকে বের করে কম আগুনের একটি গর্তে স্থানান্তরিত করলেন। আর এভাবে তার আযাবে হরাস ঘটানো হলো। অথবা কেয়ামতের দিন তাকে শাফায়াত করার ইচ্ছা পোষণ করলেন। অথচ পবিত্র কোরআন ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত একমাত্র মু’
মিন ও মোত্তাকী মুসলমানদের জন্যই শাস্তি হরাস ও শাফায়াতের বিষয়টিকে সমর্থন করে। অতএব , যদি আবু তালিব‘
কাফের’
হয়ে থাকে তবে আল্লাহর রাসূল (সা.) কখনই তার আযাব কমাতে অথবা তাকে‘
শাফায়াত’
করতে সক্ষম নন। কারণ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক তাঁর নবীকে কাফেরদের বিষয়ে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন , শাফায়াত নয়।
এভাবেই‘
হাদিসে দ্বাহদ্বাহ’
-এর বক্তব্য বা বিষয়বস্তুর ভিত্তিহীনতা ও যারা হযরত আবু তালিবকে কাফের জ্ঞান করেন তাদের দাবির অসারতা প্রমাণিত হয়। তাছাড়া উক্ত হাদীসের সহীত পবিত্র কোরআনের কোন সম্পৃক্ততা নেই , উপরন্ত সাংঘর্ষিক। যেমন মহান আল্লাহপাক এমন নন যে , কারো সৎ কাজের বিনিময়ে তাঁকে জাহান্নামে প্রেরন করবেন। হযরত আবু তালিব নবী (সা.)-এর লালন-পালন ও হেফাজত করে ইসলামের মূল ভীত রচনায় , সৎকাজের যে অপরিশোধিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার বিনিময়ে এ পুরস্কার দ্বাহদ্বাহ ? (নাউজুবিল্লাহ) পাঠক বিবেচনা করুন।
বনী উমাইয়া শাসকদের দরবারে রচিত হাদীসের আলোকে মুসলমান আজ নানা মত ও পথে দ্বিধা বিভক্ত। যে কারনে দ্বীন ইসলামের পৃষ্ঠপোষক হযরত আবু তালেবকে কাফের আখ্যা দিতে ঐ সকল মুসলমানের আকল জ্ঞান ও বুদ্ধি বিবেচনার কোনো উন্মেষ ঘটেনি। নিম্নে আমি মহানবী (সা.)-এর দুজন বিখ্যাত সহাবীর উদ্ধৃতি তুলে ধরছি।
হযরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন হযরত আবু তালিব ইন্তেকালের সময় পাঠ করেছেন ,“
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূল্লাহ”
অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নাই , মোহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন , হযরত আবু তালিব ইন্তেকালের পূর্বে বলেছেন ,“
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মহাম্মাদুর রাসূল্লাহ”
অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নাই , মোহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।”