মাহদী (আঃ) ও যারা তাকে দেখেছে
এ অধ্যায়ে আমরা তিনটি সুন্দর ঘটনা বর্ণনা করবো যা যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করবো না বরং হৃদয়কে প্রশান্ত করার জন্য সেগুলোর উল্লেখ করবো।
প্রথমঃ শেইখ আব্দুল ওয়াহাব শারানী তার কিতাব‘
তাবাক্বাতুল উরাফা’
-তে শেইখ হাসান আরাক্বীর কথা লিখতে গিয়ে বলেন-“
আমি সাইয়্যেদ আবুল আব্বাস হারিমির সাথে গেলাম শেইখ হাসান আরাক্বীর সাথে সাক্ষাত করতে। শেইখ আরাক্বী বললেন ,‘
আমি কি তোমাদেরকে আমার জীবনের কাহিনী শোনাবো এর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ? আমি এমনভাবে তা বর্ণনা করবো যে তোমরা মনে করবে তোমরা আমার অন্ত রঙ্গ বন্ধু ছিলে শৈশব কাল থেকেই। আমি বললাম ,‘
জ্বী আপনি বলতে পারেন।’
তিনি বললেন-“
আমি হস্তশিল্প কর্মীদের মাঝে একজন যুবক ছিলাম। শুক্রবারগুলোতে আমরা খেলাধুলা , মদপান ও জুয়া খেলে কাটাতাম। এক শুক্রবার আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ইলহামের মত কিছু লাভ করলাম যে-‘
তোমাকে কি এ ধরনের কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে ?’
অতএব , আমি এসব কাজ ছেড়ে দিলাম এবং আামর সাথীদের কাছ থেকে পালিয়ে গেলাম। তারা আমার পিছু নিলো কিন্তু আমাকে খুজে পেলো না। আমি বনি উমাইয়্যার মসজিদে প্রবেশ করলাম এবং একজন ব্যক্তিকে মিম্বরে দেখলাম হযরত মাহদী (আঃ) সম্পর্কে কথা বলতে। এর মাধ্যমে আমি মাহদী (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলাম। একটি সিজদাও বাদ যেতো না যে আমি আল্লাহর কাছে তার সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা পুরণ করার জন্য বলতাম না।
একদিন রাতে আমি নফল নামাজ পড়ার সময় হঠাৎ দেখলাম কেউ আমার পিছনে বসা আছেন। তিনি আমার পিঠে তার হাত বুলিয়ে বললেন-‘
হে আমার সন্তান , দয়ালু খোদা তোমার ইচ্ছা পুরণ করেছেন। আমি মাহদী , তুমি কি চাও ?’
আমি বললাম-‘
আপনি কি আমার সাথে আমার বাসায় আসবেন ?’
তিনি বললেন-‘
হ্যা’
, তখন আমরা দুজন একত্রে চললাম এবং তিনি পথে বললেন ,-‘
আমাকে কোন নিজর্ন জায়গায় নিয়ে যাও।’
আমি তাকে নির্জন স্থানে’
নিয়ে গেলাম এবং তিনি সেখানে আমার সাথে সাত দিন থাকলেন।”
দ্বিতীয়ঃ‘
ইয়া নাবিউল মুওয়াদ্দা’
-র লেখক 455 পৃষ্ঠায় (একটি ঘটনা) বর্ণনা করেছেন শেইখ আলী ইবনে ঈসা আরবালী থেকে যিনি শিয়া ও সুন্নী উভয়ের কাছে একজন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। লেখক বলেন-“
জনগণ ইমাম মাহদী (আঃ) এর মোজেযা সম্পর্কে ঘটনা বর্ণনা করে যা বর্ণনা করতে অনেক সময় লাগবে। যাহোক আমি দু’
টো ঘটনার কথা বলবো যা আমাদের সময়ের নিকটবর্তীকালে ঘটেছে এবং একদল নির্ভরযোগ্য ভাই এগুলো বর্ণনা করেছে।
হিল্লাহ ও ফুরাত শহরের মাঝে (ইরাকে) এক লোক বাস করতো যার নাম ছিলো ইসমাইল ইবনে হাসান। নির্ভরযোগ্য ভাইরা ইসমাইল থেকে বর্ণনা করলো যে , তার বাম উরুতে একটি ফোঁড়া দেখা দিলো যার আকৃতি হলো হাতের তালুর মত । ডাক্তাররা ওই ফোঁড়া দেখে তা সারাতে অপারগতা প্রকাশ করলো। অতএব , ইসমাইল সামাররাতে চলে গেলো এবং ইমাম আলী হাদী ও ইমাম হাসান আসকারী (আঃ)-র মাযার যিয়ারাতে গেলো। এরপর সে ভূগর্ভস্থ ঘরে প্রবেশ করলো। সেখানে দয়ালু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো এবং মাহদী (আঃ)-এর কাছে সাহায্য চাইলো।
এরপর সে দযলা নদীতে নেমে মোস্তাহাব গোসল করলো এবং তার পোষাককে বদলে নিলো। হঠাৎ সে দেখলো চারজন ঘোড়সওয়ার সামাররা শহরের দিক থেকে আসছে। তাদের একজন ছিলো বৃদ্ধ মানুষ যার হাতে একটি বর্শা এবং আরেকজন যুবক যিনি রঙ্গীন পোষাক পরে আছেন। যিনি বর্শা বহন করছিলেন তিনি ছিলেন ডান দিকে এবং অন্য দু’
জন ছিলো বাম দিকে। যে যুবক রঙ্গীন পোষাক পরেছিলেন তিনি ছিলেন মাঝখানে। সেই যুবক ইসমাইলকে জিজ্ঞেস করলেন ,“
তুমি কি আগামীকাল তোমার পরিবারের কাছে যাবে ?”
ইসলাইল বললো- জ্বী। তিনি বললেন ,- আমার কাছে আসো যেন আমি তোমার সমস্যা সম্পর্কে জানতে পারি। ইসমাইল তার কাছে গেলো । তিনি নীচু হয়ে তার উরুতে তার পবিত্র হাত রাখলেন এবং ঘোড়ার জীনে সোজা হয়ে বসলেন। বৃদ্ধ লোকটি যে বর্শা ধরে ছিলো তিনি বললেন-‘
তুমি সুস্থ হয়ে গেছো। তিনি তোমার ইমাম।’
চারজন ঘোড়সওয়ার চলে যেতে লাগলো এবং ইসমাইলও তাদের পিছনে পিছনে চললো।
‘
ইমাম বললেন-‘
ফিরে যাও’
।
ইসমাইল বললো-‘
আমি আপনার কাছ থেকে কখনোই বিচ্ছিন্ন হবো না’
।
ইমাম বললেন ,‘
এটি তোমার নিজের ভালোর জন্যই , ফিরে যাও।’
ইসমাইল বললো-‘
আমি আপনার কাছ থেকে কোন অবস্থাতেই’
বিচ্ছিন্ন হবো না’
।
বৃদ্ধ মানুষটি তখন মাঝখানে হস্তক্ষেপ করলো এবং বললো‘
তোমার কি কোন লজ্জা নেই। তোমার ইমাম তোমাকে দু’
বার আদেশ দিয়েছেন ফিরে যাওয়ার জন্য এরপরও তুমি অবাধ্য হচ্ছো ?’
ইসমাইল থামলো। ইমাম সামনে কয়েক কদম এগিয়ে গেলেন এবং পিছনে ফিরে বললেন-‘
যখন তুমি বাগদাদে পৌছবে খলিফা মোতাসিম বিল্লাহ তোমাকে জোরপূর্বক ডেকে পাঠাবে। যখন সে তোমাকে কিছু দিতে চাইবে তা প্রত্যাখ্যান করো। এছাড়া আমাদের সন্তান রাযীউদ্দীনকে বলো তোমার পক্ষ হয়ে আলী ইবনে আওয়াজকে লিখতে। আমিও তাকে ইশারা করবো তোমাকে দেয়ার জন্য যা তোমার ইচ্ছা।’
এরপর হযরত তার সাথীদেরসহ চলে গেলেন এবং ইসমাইলের দৃষ্টি তাদের উপর নিবদ্ধ থাকলো ঐ সময় পর্যন্ত যতক্ষণ আর সে তাদের দেখতে পেলো না। সে মাটিতে কিছুক্ষণের জন্য বসে রইলো এরপর তাদের সাথে বিচ্ছেদের কারণে কাদতেঁ শুরু করলো।
এরপর সে সামাররাতে গেলো যেখানে লোকজন তাকে ঘিরে ধরে জিজ্ঞেস করলো ,‘
আমরা তোমার মধ্যে এত পরিবতর্ন দেখছি কেন ? কী ঘটেছে ?’
ইসমাইল বললো-‘
তোমরা কি জানো ঘোড়সওয়াররা কারা ছিলো যারা শহর ছেড়ে নদীর দিকে গিয়েছিলো ?’
তারা বললো- তারা মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলো এবং গবাদিপশুর মালিক। ইসমাইল বললো , তারা ছিলো ইমাম ও তার সাথীরা। যিনি রঙ্গীন পোষাক পড়েছিলেন তিনি ছিলেন ইমাম এবং তিনিই তার পবিত্র হাতে আমার জখমে হাত বুলিয়েছিলেন। তারা বললো-‘
আমাদেরকে দেখতে দাও।’
যখন ইসমাইল তাদেরকে তার উরু দেখালো , সেখানে একটা দাগ পর্যন্ত ছিলো না। জনগণ তার জামা ছিড়ঁতে লাগলো তাবাররুকের জন্য এবং পরে অন্যরা যাতে তার কাছে পৌঁছাতে না পারে তাই তাকে ট্রেজারীতে নিয়ে গেলো। এরপর খলিফার প্রতিনিধি এলো এবং তাকে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো । তার পারিবারিক পরিচিতি , তার দেশের বাড়ী , বাগদাদ থেকে প্রথম সপ্তাহে সে কী উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলো সে সম্পর্কে।
পরদিন সকালে ইসমাইল এক বড় ভীড় এর মাঝ দিয়ে তার দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে সামাররা শহর ত্যাগ করলো। পথে সে এক জায়গায় এসে পৌঁছালো যেখানে অনেক লোক জমা হয়েছিলো এবং তারা তার নাম , বংশধারা এবং কোন জায়গা থেকে এসেছে এসব জিজ্ঞেস করলো। যখন তারা তাকে আগে উল্লেখিত নিদর্শন দেখে চিনতে পারলো তারা তার জামা ছিঁড়তে শুরু করলো তাবাররুক হিসেবে নেবার জন্য। খলিফার প্রতিনিধি ঘটনাটির বিশদ বিবরণ লিখে বাগদাদে পাঠিয়ে ছিলো। মন্ত্রী সৈয়দ রাযী উদ্দীনকে ডেকে পাঠালো ঘটনার সত্যতা জানার জন্য। যখন রাযিউদ্দীন (যে ছিলো ইসমাইলের সাথী ও সমর্থকরা ছাড়ার আগে ইসমাইলের মেযবান) এবং অন্যরা ইসমাইলকে দেখলো তারা নেমে এলো। যখন ইসমাইল তাদেরকে তার উরু দেখালো রাযিউদ্দীন প্রায় এক ঘন্টার জন্য অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলো। জ্ঞান ফেরার পর সে ইসমাইলের হাত ধরে তাকে মন্ত্রীর কাছে নিয়ে গেলো। রাযিউদ্দীন কেঁদে বললো-‘
সে আমার ভাই এবং সব মানুষের মাঝে সে আমার সবচেয়ে প্রিয়।’
মন্ত্রী ইসমাইলের কাছ থেকে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলো এবং সেও তার পুরো বর্ণনা দিলো। মন্ত্রী সেই ডাক্তারদের ডেকে পাঠালো যারা আগে ইসমাইলকে দেখেছিলো। যখন তারা এলো জিজ্ঞেস করলো-‘
কখন আপনারা তার জখম শেষবারের মত দেখেছিলেন ? তারা বললো-‘
দশ দিন আগে’
। মন্ত্রী ইসমাইলের উরু দেখলো এবং যখন ডাক্তাররা এর কোন চিহ্ন দেখতে পেলো না তারা বললো-‘
এটিতো মসিহর কাজ।’
মন্ত্রী বললেন ,‘
আমরা জানি কে এ কাজটি করেছেন।’
মন্ত্রী ইসমাইলকে খলিফার সামনে নিয়ে গেলো , খলিফা ইসমাইলকে ঘটনার বর্ণনা দিতে বললো এবং ইসমাইল তার খুটিনাটিু বর্ণনা দিলো যা ঘটেছে। যখন খলিফা ইসমাইলকে এক হাজার দিনার উপহার দিলেন ইসমাইল বললো-‘
কিভাবে আমি এ উপহারের এক অংশও নিতে সাহস করবো ?’
খলিফা বললেন-‘
কাকে তুমি ভয় পাও ?’
সে বললো-‘
যিনি আমাকে সুস্থ করেছেন তাকে , কারণ তিনি আমাকে নিষেধ করেছেন আপনার কাছ থেকে কিছু নিতে।’
এ কথা শুনে খলিফা কাদতেঁ শুরু করলো।
আলী ইবনে ঈসা বলেন- আমি একবার এ ঘটনা বর্ণনা করছিলাম একটি দলের কাছে যারা আমার চারদিকে বসে ছিলো। ইসমাইলের ছেলে শামসুদ্দিনও সেখানে উপস্থিত’
ছিলো কিন্তু তখন আমি তাকে চিনতাম না। শামসুদ্দিন বললো‘
আমি ইসমাইলের ছেলে।’
আমি বললাম-‘
তুমি কি তোমার বাবার উরুতে জখমটি দেখেছিলে ?’
সে বললো-‘
সে সময় আমি শিশু ছিলাম। কিন্তু আমি আমার বাবা-মা , আত্মিয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের কাছে এ বিষয়ে শুনেছি এবং জায়গাটি দেখেছি তা সুস্থ হয়ে যাবার পর। আমি কোন জখমের চিহ্ন সেখানে দেখি নি এবং সেখানে লোম গজিয়ে গেছে।
আলী ইবনে ঈসা আরও বললেন- আমি এ ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম সাইয়্যেদ সাফিউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ এবং নাজমুদ্দীন হায়দার ইবনে আমিরের কাছেও এবং তারা আমাকে এ সম্পর্কে জানিয়েছে এবং বলেছে-‘
আমরা ইসমাইলকে আগেও দেখেছি এবং তার সস্থতার পরও দেখেছি।’
এছাড়া তার ছেলে আমাকে বলেছে যে তার পিতা তার সুস্থতার পরে সামাররাতে 40 বার গিয়েছিলো এ আশায় যে হয়তো সে আবার তার সাক্ষাত লাভ করবে।
দ্বিতীয়ঃ সাইয়্যেদ বাক্বী আসওয়া আলাউই হাসানী আমাকে বলেছেন যে তার বাবা আসওয়া মাহদীর অস্তিত্ব স্বীকার করতো না। তিনি মাঝে মাঝেই বলতেন ,‘
যখন মাহদী আসবেন এবং আমাকে সুস্থ করবেন আমি লোকজনের কথায় (মাহদী সম্পর্কে) সাক্ষী দিবো।’
আমরা যখন সবাই এশার নামাজের জন্য একত্র হলাম আমরা আমাদের বাবার কাছ থেকে একটি চীৎকার শুনতে পেলাম। আমরা তার কাছে গেলাম এবং তিনি বললেন-‘
এই এখন ইমাম এ জায়গা দিয়ে গেছেন , তার খোঁজ কর!’
আমরা সবাই তার খোঁজে বের হলাম কিন্তু কাউকে খুঁজে পেলাম না। আমরা যখন ফিরে আসলাম তখন আমাদের বাবা বললেন-
‘
কেউ একজন আমার কাছে এলো ও বললো-‘
হে আসওয়াহ’
। আমি বললাম-‘
আপনার সেবায়’
। তিনি বললেন ,‘
আমি মাহদী। আমি এসেছি তোমাকে সুস্থ করতে।’
তিনি তার হাত লম্বা করে দিলেন এবং আমার উরুতে চাপ দিলেন এবং এরপর চলে গেলেন।”
বর্ণনাকারী বলেন-‘
এ ঘটনার পর সে হরিণের মত দৌড়াতো এবং কোন চিহ্নই আর দেখা যায় নি।’
আলী ইবনে ঈসা বলেন , আমি এ ঘটনা সম্পর্কে সাইয়্যেদ বাক্বীর ছেলের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম এবং সেও তা স্বীকার করেছে।