ইসলামী উম্মাহের মধ্যে মতভেদের কারন
নামায ,যাকাত ,হজ্ব এবং মানুষের প্রায়শই প্রয়োজনীয় অন্যান্য এবাদাত বা পারস্পরিক লেন-দেন সম্পর্কিত ইসলামের এইসব ধর্মীয় ঐশী বিধানাবলীর মৌলিক এবং বুনিয়াদী নীতি-নির্দেশ আল-কোরআনের নির্ভুল ও সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে । রাসুলে (সাঃ) কোরআনে বর্ণিত ঐসব ঐশী বিধানের ব্যাখ্যা এবং বিশদ বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন । তিনি নামায কত রাকাত এবং নামাযে কি কি পড়তে হবে ,কিভাবে পড়তে হবে তা নির্দিষ্ট করেছেন ;সম্পদের যাকাত কি পরিমানে দিতে হবে এবং হজ্ব সম্পাদনের জন্য কি কি আহকাম পালন করতে হবে তা তিনি নির্দিষ্ট করেছেন । ধর্মীয় অন্যান্য আহকামের বিষয় নির্ধারণও রাসূলের (সাঃ) কার্যের আওতাভুক্ত ছিল ।
ফলাফল দাড়ালো এই যে , যদিও ঐশী বিধানাবলীর সকল নীতি-নির্দেশ কোরআনে বর্ণিত আছে , তথাপি সেগুলোর বিশদ বর্ণনা এবং ব্যাখ্যা দিয়েছেন রাসূল (সাঃ) যা হাদিস নামে পরিচিত , এবং উহা অনুসরন করার জন্য আল্লাহ নিজেই নির্দেশ প্রদান করেছেন-বলেছেনঃ“
রাসূল তোমাদিগকে যা দেয় তা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদিগকে নিষেধ করে তা হতে তোমরা বিরত থাক”
(আল-কোরআন ,সুরা হাশরঃ7) ।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো ,কিছু কিছু মানুষ এমনকি রাসূলের (সাঃ) জীবদ্দশাতেই তাঁর প্রতি মিথ্যারোপ করেছে । নবীজির (সাঃ) নামে তারা জাল হাদীস প্রচার করতে থাকে । নাহজুল বালাগায় বর্ণিত ইমাম আলী (আ.)-এর একটি খুতবা থেকে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে তিনি বলেনঃ“
রাসূল (সাঃ) এর জীবদ্দশায় কিছু লোক মিথ্যা হাদিস তৈরী করে তাঁর নামে প্রচার করছিল । (এই অনিষ্ট সম্পর্কে জানতে পেরে) একদা তিনি (রাসূল সাঃ) তাঁর আসন থেকে উঠে দাঁড়ান এবং সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ“
যে ব্যক্তি আমার নামে কোন মিথ্যা বিষয় প্রচার করে সে নিজের জন্য জাহান্নামে স্থায়ী আবাস তৈ্রী করে”
গোলযোগ সৃষ্টিকারী লোকজন নবীজীর ওফাতের পরও জাল হাদিস তৈরী করার অপকর্মটি অব্যাহত রাখে । এভাবে ইসলামের বিধিবিধান নানাবিধ বিচ্যুতি দ্বারা আক্রান্ত হয় ,এবং মুসলমানদের মাঝে মতদ্বৈধতা দেখা দেয় । যেহেতু পবিত্র কোরআনের যেকোন ধরনের পরিবর্তন বা বিচ্যুতি হতে এর হেফাজত ও সংরক্ষনের ব্যাপারে আল্লাহ নিজেই নিশ্চয়তা দিয়েছেন , কাজেই এইসব অনিষ্টকারক লোকেরা তাদের কলুষিত হস্ত প্রসারিত করে পবিত্র কোরআনের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য ব্যাখ্যাকারক এবং বিশদ-অর্থ প্রকাশক রাসূল (সাঃ) এর হাদিসের দিকে । এই লোকেরা বিভিন্ন বিষয়ের উপর বানোয়াট হাদীস তৈরী করতে থাকে এবং রাসূলের (সাঃ) নামে প্রচার করতে থাকে । এই কারনে আমরা দেখতে পাই , কত ব্যাপক পরিমানে বিরোধ ও মতদ্বৈধতা মুসলিম সমাজে সহজ অবস্থান করে নিয়েছে । এর পরিমান এতই বেশী যে ,এমনকি আকিদা-বিশ্বাসের শাখা প্রশাখার মতো মৌলিক বিষয়েও গুরুতর মতবিরোধ দেখা দিয়েছে ।
এই লোকদের অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যে ,তারা আল্লাহর গুনাবলীর বিষয়েও প্রশ্ন/তর্কের অবতারনা করেছিল । তাদের প্রশ্ন ছিলঃ“
আল্লাহর হাত-পা আছে কি-না”
অথবা“
হাশরের ময়দানে তাঁকে দেখা যাবে কি না ? দেখা গেলে ,কিভাবে দেখা যাবে”
?।
তারা আল-কোরআনের ব্যাপারেও বিভিন্ন অভিমত প্রকাশ করতে থাকে এবং বিভিন্ন প্রশ্ন উথাপন করতে থাকে ,যেমন ,“
আল-কোরআন কি আল্লাহর সৃষ্টি ,এবং ইহা কি অপরিবর্তনশীল কিছু নয় ? নাকি ইহা আদি ও চিরন্তন”
?
এইসব লোকেরা নবীগনের (আঃ) অবস্থান এবং সত্বার ব্যাপারেও প্রশ্নের অবতারনা করেছিল । তারা জিজ্ঞেস করতোঃ“
নবীগন (আঃ) কি মাসুম(নিষ্পাপ) ?”
তাদের বিশ্বাস হলোঃ শুধুমাত্র ওহী প্রচার সংক্রান্ত ক্ষেত্রে নবীগন মাসুম ,কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের গুনাহ করার অবকাশ আছে । অধিকন্তু , তারা রাসূলের (সাঃ) উপর 1ম ওহী নাজিলের বিষয়েও ভিন্ন ভিন্ন ধারনা পোষন করতো । তারা বলতোঃ”
1ম ওহী নাজিলের সময় রাসূল (সাঃ) কি জীব্রাইল (আঃ) কে শয়তান মনে করেছিলেন , যিনি তাঁর সাথে ঠাট্টা-কৌতুক করতে চেয়েছিলেন”
? অথবা ,“
নবীজী জানতেন যে ,তিনি পবিত্র সত্ত্বা এবং আল-কোরআন নাজিল হচ্ছে ও তাঁর অন্তরে চেতনা সঞ্চার করছে ?”
ইসলামের সম্পুরক বিধি-বিধানের ব্যাপারেও তাদের অভিমত ছিল ভ্রান্ত ;উদাহরন হলোঃ“
ওজুর ক্ষেত্রে কোন লোক কি তার পা মাসেহ করবে , নাকি ধুয়ে পরিস্কার করবে ;অথবা নামাজ আদায়ের শুরুতে কোন লোক যখন সুরা ফাতেহা তেলাওয়াত করবে ,তখন“
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম”
দিয়ে শুরু করবে নাকি“
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম”
ছাড়া শুরু করবে ;অথবা হজ্ব সম্পাদনকালে তাওয়াফুন্নেসা (2য় তাওয়াফ) বাধ্যতামুলক , বা বাধ্যতামুলক নয় ?”
এই অবস্থার কারনে ,ইসলামের সকল আকিদা-বিশ্বাস এবং আইন-বিধান বিভ্রান্তিকর পরিবর্তনের বা রদ-বদলের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে । এই সকল মতদ্বৈধতা ও বৈসাদৃশ্যের মূলকারণ অনুসন্ধ্বান করলে আমরা দেখি যে , বিরোধের সুচনা হয়েছে খলিফাদের (1ম -3য় খলিফা ) সময়ে তাদের ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতিতে । রাজনৈতিক স্বার্থই ছিল তাদের শাসন এবং সিদ্বান্তের চালিকা শক্তি । বিশাল একদল লোক নিয়োগ করা হয়েছিল কোরআনের আয়াতসমুহের ব্যাখ্যা উপস্থাপনের জন্য ;তারা তাদের সধ্যের সবটুকু দ্বারা কোরআনের আয়াতসমুহ এমনভাবে ব্যাখ্যা করতো যাতে উহা শাসকবর্গের ইচ্ছা-আকাংখার অনুকুলে যায়
তারা এই উদ্দেশ্যে রাসূলের (সাঃ) হাদিসেরও উদ্ধৃতি উল্লেখ করতো । ফলতঃ যে সকল নির্দেশ ঐ ব্যক্তিবর্গের দ্বারা সত্যায়িত হতো সেগুলোই হতো আইন । আর জবরদস্তিমুলকভাবে হলেও সেই সকল আইন জনগনকে মানতে বাধ্য করা হতো ;ইসলামের সত্যিকারের স্পিরিটের আলোকে এই আইনগুলো প্রনীত বলে গন্য করানো হতো । অতঃপর স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের আইনের প্রতি যেকোন বিরুপ মতামত তাদের দ্বারা সমর্থনযোগ্য হতোনা । আর তারা কোন আইন-বিধান জারী করার ইচ্ছা করলে ঐ নির্দেশ মানতে কেউ যদি অস্বিকার করতো ,তাহলে তাকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর আচরনের পরিনতি ভোগ করতে হতো । মাঝে মাঝে এই ধরনের প্রতিবাদী ব্যাক্তি মৃত্যুর মুখোমুখি হতো । খলিফাদের কোরআন পরিপন্থি নির্দেশ-এর বিরোধীতাকারীদেরকেও এই ধরনের নিষ্ঠুর পরিনতি ভোগ করতে হতো । এছাড়া শাসকবর্গ তাদের সরকারের অনুকুলে স্বার্থের কারনে শরিয়তী মাসায়েলগত সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে মুসলিম প্রজা কর্তৃক বিবর্ণ সুন্নাহর
চার ইমামের কোন একজনকে মেনে চলার বাধ্যবাধকতার আওতায় আনার সিদ্বান্ত গ্রহণ করে । এই ইমামগন হলেন ,আবু হানিফা ,শাফেঈ ,আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং মালেক ইবনে আনাস
ঈমানের মৌ্লিক নীতিমালার (আকিদা) সংক্রান্ত বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে প্রজাগণ আশারীয় মতবাদকে
অনুসরন করতে বাধ্য করা হতো ।
মুসলমানদের এক বড় অংশ অনুসরনের ক্ষেত্রে নিজেদেরকে সিহাহ সিত্তাহ
বিশেষ করে“
সহীহ মুসলিম”
এবং“
সহীহ বুখারীর”
মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলে , এবং হাদিসের বিচার পর্যালোচনা হতে বিরত হয়ে নিজেদের জন্য হাদিস বিজ্ঞানের দরজা রুদ্ব করে দেয় । উল্লেখিত চার ধর্মীয় ইমামের একজনকে অনুসরনের ব্যাপারে তারা বাধ্য হওয়ায় গবেষনার রাস্তা তাদের জন্য বন্ধ হয়ে যায় ।
যখন মুসলমানেরা খলিফার আদেশ পালনের জন্য এমনভাবে নিয়োজিত ছিল যে খলিফাদের পক্ষ হতে কোন হুকুম জারী হলে তাদের নিকট তা ঐশী নির্দেশ (ওহী) হিসাবে গণ্য হতো ,সেই সময় মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এমন কিছু ব্যাক্তি ছিলেন যারা সকল ধরনের অসুবিধা মোকাবেলা করেও অকৃত্তিমভাবে ইসলামের আকিদা-বিশ্বাসকে যথাযথভাবে সংরক্ষনের জন্য উৎসর্গীকৃত ছিলেন এবং আল-কোরআনের নির্দেশনার আলোকে সকল হুকুম-বিধানকে কঠোরভাবে প্রতিপালনের ক্ষেত্রে কোন কষ্টকে তাঁরা কষ্ট মনে করতেন না । ধর্মীয় আহকাম-বিধানকে বিলুপ্তির হাত থেকে সংরক্ষনের কাজে তাঁরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন । রাসূল (সাঃ) এর হাদিসকে কোন ধরনের বিচ্যুতি বা পরিবর্তনের কবল হতে অবিকল সংরক্ষনের ব্যাপারেও তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক । এইসব ব্যাক্তিবর্গ ছিলেন নবী পরিবারের সদস্যবর্গের (আহলুল বায়েত আঃ) এবং তাঁদেরকে যারা আনুগত্য ও অনুসরন করতেন তাঁরা“
শিয়া”
নামে পরিচিত হন । শিয়া আলেমগন নীতিগতভাবে শুধুমাত্র সেইসব হাদিস গ্রহণ করতেন যা ইমামগন (আঃ) বর্ণনা করেছেন । একজন কবি অত্যন্ত সুন্দরভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেনঃ
“
তাদের অনুসরন কর যাদের কথা কোরআন ও হাদিস নির্দেশ করে”
।
“
আমাদের পিতামহ বর্ণনা করেন(যে শব্দাবলী পেয়েছেন) জীব্রাইল হতে এবং জীব্রাইল আল্লাহ হতে”
।
শিয়া আলেমগন একেবারে সূচনালগ্ন হতে চলতি সময় পর্যন্ত অত্যন্ত বিচক্ষনতার সাথে নিঃস্বার্থভাবে ইসলামের শিক্ষাকে সংরক্ষন ও প্রচার করেছেন ।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো ,জনগোষ্ঠীর বড় অংশই অনুসরন করতেছিল তাদের শাসকগোষ্ঠী ও রাজন্যবর্গকে । তাদের প্রভু ও রাজন্যবর্গ যা বলতো তাকেই সত্যিকার ইসলাম বলে তারা বিশ্বাস করতো । তাদের শাসকগন যে সকল বিষয় সঠিক বলে রায় দিত বা স্বীকার করতো এইসব লোকেরা সেগুলোকেই আল্লাহর বিধান বলে বিশ্বাস করতো । তাদের কাছে সেই হাদিসগুলোই ছিল একমাত্র সঠিক যা তাদের শাসকগন স্বীকার করতো ।
এই রকম পরিস্তিতিতে ,প্রকৃত ইসলাম হতে ক্রমান্বয়ে দূরে অগ্রসরমান ও প্রকৃত ইমামগনের অনুসরন-বিমুখ শাসকবর্গের অনুগত একদল লোক ইসলামী দুনিয়ায় আবির্ভুত হলো এবং নিজেদেরকে“
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত”
হিসাবে দাবী করলো । আর যারা তৎকালীন শাসকবর্গকে অনুসরন করতে অস্বীকার করে আইন সম্মত ইমামগনের অনুসারী ছিল তাদেরকে“
রাফেজী”
হিসাবে চিহ্নিত করা হলো । এই কারনে তৎকালীন শাসকগন ইমামগনকে , একজনের পর একজন ,সীমাহীন কষ্ট-জুলুম এবং অত্যাচারে জর্জরিত করছিল ,এবং তাদের সমর্থক ও অনুসারীদের উপর নানাবিধ বানানো অভিযোগ দ্বারা দৈহিক ও মানসিক নিপীড়ন চালাচ্ছিল ।
শিয়া মাযহাবের প্রখ্যাত আলেমগন এইসকল অন্যায়ের বিরুদ্বে প্রতিবাদী ছিলেন ,এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নিজেদের যুক্তি-প্রমানের ভিত্তির উপর অবস্থান গ্রহণ করে তার উপর দৃঢ় থাকেন । এভাবে তাঁরা নিজেদের এবং সুন্নীধারার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী বিষয়সমুহ সুষ্পষ্ট করে তোলেন এবং তাঁদের প্রেরনার উৎস প্রানবন্ত শিয়াধারার বিকাশ সাধনে সাফল্য আনয়ন করেন ।
শিয়া আলেমগনের মধ্যে সাম্প্রতিক কালে যারা এই কাজে নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছেন তাঁরা কয়েকজন হলেনঃ
ক) সাইয়েদ মোহসিন আমিন (ইন্তেকালঃ1371 হিজরী) ,“
আইয়ান আল-শিয়া”
গ্রন্থের লেখক ।
খ) শেখ মুহাম্মাদ হুসাইন আল কাশিফ আল-গিতা (ইন্তেকালঃ1373 হিঃ) ,“
আসল আল-শিয়া ওয়া উসুলুহা”
গ্রন্থের লেখক ।
গ) শ্রদ্ধেয় বুজুর্গ তেহরানী(1390 হিঃ) ,“
আল-জারিয়াহ ইলা তাসনিফ আল-শিয়া”
এবং“
তাবাকাত আলম আল-শিয়া”
গ্রন্থদ্বয়ের লেখক । মুহাম্মদ রেজা মোজাফফর ,“
আকায়েদ আল-ইমামিয়া”
গ্রন্থের লেখক ।
ঘ) মুহাম্মদ হুসাইন তাবাতাবাই ,“
শিয়া ইসলাম”
গ্রন্থের লেখক ।
এই আলেমগন অন্যান্যদের সাথে সম্মিলিতভাবে শিয়া ও তাদের বিশ্বাসের নিরাপত্তা বিধানের জন্য বিশেষ ভুমিকা পালন করেছেন । এই মহান ব্যাক্তিবর্গের প্রত্যেকেই তাদের শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমে এই পবিত্র দায়িত্ব পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে সম্পাদন করেছেন ।
আমাদের মতানুসারে ,রাসূলের (সাঃ) নামে বানোয়াট তথাকথিত হাদিসের প্রচলন দ্বারা এবং তাঁর সিরাত লিখনের ক্ষেত্রে তথ্যের সত্য-মিথ্যার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করার কারনে যেহেতু বিরোধ ও মতদ্বৈধতা দেখা দিয়েছে কাজেই যৌক্তিক কারনেই আমাদের উচিৎ হবে এই সমস্ত হাদিস ও তাদের লেখন-উৎসের তথ্যানুসন্ধান ও যাচাই-বাছাই করা ,যাতে প্রবীন পণ্ডিতগনের বক্তব্যের উপর নির্ভরতা ও তাদেরকে অন্ধভাবে মেনে চলার প্রবনতার কারনে সৃষ্ট জড়তার দেয়াল আমরা ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম হই । এভাবে প্রশ্নবিদ্ব কর্তৃত্বশীলদের নিকট বিনম্র বা অপ্রতিবাদী আত্নসমর্পনের কর্দমাক্ত অবস্থা হতে হাদিস ও ইতিহাস লেখকদেরকে আমরা বের করে আনতে পারবো ,এবং আনুপুর্বিক পর্যালোচনা ও গভীর তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে হাদিস ও ইতিহাসের সঠিক জ্ঞানের রাস্তা আমরা উন্মুক্ত করতে সক্ষম হবো ।
এখন , আমাদের কর্তব্য হলো রাসূলের (সাঃ) হাদিস এবং তাঁর ও তাঁর সাহাবীগনের ,বিশেষ করে যারা হাদিস বর্ণনার কাজে জড়িত ছিলেন , তাদের জীবনী সংক্রান্ত তথ্যাবলী প্রজ্ঞা বিচক্ষনতার সাথে পর্যালোচনা করা । তারপর আমরা পর্যালোচনা করবো হাদিস এবং বিভিন্ন মাযহাবের উপর সুচনালগ্ন হতে আজ পর্যন্ত স্ব স্ব অনুসারীদের লিখিত গ্রন্থসমূহ । এটাই হচ্ছে একমাত্র রাস্তা যার মাধ্যমে আমরা সত্যের নিকটবর্তী হতে পারবো , এবং মুসলমানদের মধ্যে বর্তমানে বিরাজিত মতদ্বৈধতা সমুলে উৎপাটন করতে সক্ষম হবো ।
মনীষীগনের মধ্যে যারা এই পথে অগ্রবর্তী ভুমিকা পালন করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেনঃ
ক) আবদ আল হুসাইন শরফুদ্দিন(ইন্তেকালঃ1377 হিজরী) ;“
আবু হোরায়রা”
গ্রন্থের গ্রন্থকার ।
খ)এই গ্রন্থের লেখক(আল্লামা মুরতাজা আসকারী রঃ) ;“
দিরাসাহ ফিল হাদিস ওয়াল তারীখ”
(ষ্টাডিজ ইন হাদিস এন্ড হিষ্টোরী) শিরোনামে ইতিহাস ও হাদিসের উপর তাঁর গবেষনা কর্মের সিরিজ প্রকাশনা রয়েছে । এই সিরিজের আওতায় বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ।
এই বিষয়ে যারা প্রত্যক্ষভাবে জানতে চান ,তাদের উচিৎ ইমাম আলী (আঃ) এর সহিত সুলাইম ইবনে কা’
ইয়েসের বাক্যালাপ অধ্যায়ন করা । সুলাইম বলেনঃ“
আমি আমিরুল মু’
মিনিনকে বললাম ,“
সালমান ,মিকদাদ এবং আবুযর-এর নিকটে আল-কোরআনের উপর কিছু ব্যাখ্যা-টীকা-মন্তব্য শুনলাম । অন্যরা যা বলে তা এগুলো থেকে ভিন্ন ।
অতঃপর আপনার নিকট হতে যা শুনলাম ,তাদের (সালমান ,মিকদাদ এবং আবুযর) নিকট হতে শুনেছি তার সাথে মিলে যায় । উপরন্তু ,আল-কোরআন এবং রাসূলের (সাঃ) হাদিসের অর্থ ও ব্যাখ্যা হিসাবে লোকদের নিকট যা প্রচলিত আছে আপনি সেগুলোর বিরোধিতা করেন এবং সেগুলোকে ভ্রান্ত/মিথ্যা বলে বিবেচনা করেন । আপনি কি মনে করেন যে ,লোকেরা বিশেষ অভিপ্রায়ে উদ্দেশ্যমুলকভাবে নিজেদের মতো আল-কোরআনের ব্যাখ্যা করে রাসূলের (সাঃ) প্রতি মিথ্যারোপ করছে ?“
ইবনে কায়েস বলেন যে ,ইমাম আলী (আঃ) তার দিকে ঘুরে গেলেন এবং বললেন ,“
জনগনের মাঝে সেই হাদিসগুলো প্রচলিত আছে যেগুলো হক ও বাতিল সংক্রান্ত বিষয় বর্ণনা করে ,সত্য ও মিথ্যা সংক্রান্ত বিষয় ,হারাম ঘোষনা সংক্রান্ত আদেশ বিধান-এর খন্ডন সংক্রান্ত বিষয় ,একই সাথে সার্বজনীন ও সুনিদিষ্ট-নির্ভুল বিষয় ,সুষ্পষ্ট ও প্রতিকী বা রূপক বিষয় ,এবং প্রকৃত ও কাল্পনিক বিষয় । ইহা অনস্বীকার্য সত্য যে ,রাসূল (সাঃ) এর জীবদ্দশাতেই লোকেরা তাঁর প্রতি মিথ্যারোপ করেছে । এর ফলে রাসূল (সাঃ) যখন বিষয়টি জানতে পারেন তিনি তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে যান এবং উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্য করে খুতবা দেন এবং লোকদের মধ্যে এক বিরাট সংখ্যক মিথ্যাবাদীকে সতর্ক করে দেন যে যদি কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর নাম দিয়ে কোন মিথ্যা বিষয় প্রচার করে ,সে জাহান্নামী (“
কাফি”
,ইখতিলাফ আল হাদিস 1/62 থেকে ,হাদিসের পরবর্তী অংশ নাহজুল বালাগা থেকে ,খুতবা 201 ,)। অতঃপর তাঁর ইন্তেকালের পরেও তাঁর নামে মিথ্যাচার চালায় (তিনি বলেন) ,শুধুমাত্র চার ধরনের ব্যক্তি তোমাদের নিকট হাদিস বর্ণনা করে । তারা হলোঃ
1) দু’
মুখো চরিত্রের লোক (মুনাফিক ব্যাক্তি) ,যে ঈমান ও ইসলামী জীবনাচারের প্রদর্শন করে কিন্তু কোনরূপ ভয় বা দ্বিধা ছাড়াই সে পাপকর্মে প্রবৃত্ত হয়ে যায় । এই ধরনের ব্যাক্তি রাসূলের (সাঃ) প্রতি মিথ্যারোপ করে । লোকেরা যদি তাকে মিথ্যাবাদী বা মুনাফিক বলে ঘোষনা দেয় ,তাহলে তার বর্ণিত হাদিস সঠিক বলে গ্রহণ করার কোন সুযোগ থাকেনা এবং সোজা-সাপ্টা তাকে প্রত্যাখ্যান আবশ্যক হয় । কিন্তু এমন লোক আছে যারা বলে ,এই লোক রাসূলের (সাঃ) সাহাবী ;তাঁকে সে দেখেছে এবং তাঁর নিকট হতে হাদিস শ্রবণ করেছে ও পেয়েছে । অতএব লোকেরা তার প্রতি আস্তাশীল থাকে । কিন্তু আল্লাহ দু’
মুখো চরিত্রধারী ,মুনাফিকদের আচরন-স্বভাব উল্লেখ করেছেন এবং তোমাদেরকে সতর্ক করেছেন তাদের থেকে নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখতে ।
রাসূলের (সাঃ) ইন্তেকালের পর মুনাফিকদের মধ্যে যারা বেচে ছিল তারা পথভ্রষ্ট নেতাদের ঘনিষ্ট সহচর হয়ে দাড়ালো ,এবং রাসূলের (সাঃ) প্রতি মিথ্যারোপ করার মাধ্যমে তারা নিজ অনুসারীদেরসহ জাহান্নামে তাদের স্থায়ী নিবাস তৈ্রী করে নিলো । এইসব জাহান্নামী নেতারাই জনগনের শাসনকর্তা হয়ে উঠলো ,তাদের জীবন ও সম্পদের উপর কর্তৃত্বশীল হয়ে উঠলো । যেসব লোক এইসব নেতাদেরকে জনগনের শাসনকর্তার অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করলো তারা পুরস্কার পেলো দুনিয়াবী অজস্র সুবিধাদি ;আল্লাহ যাদের হেফাজত করলেন তারা ছাড়া অন্য লোকেরা দুনিয়া ও রাজন্যবর্গের সাথে আঠার মত লেগে থাকলো । উপরে বর্ণিত মুনাফিকেরা হলো পুর্বোল্লিখিত চার ধরনের ব্যক্তির একজন ।
2) কোন ব্যক্তি রাসূলের (সাঃ) নিকট হতে কোন কিছু শুনেছে কিন্তু এর ভাববস্তু আত্মস্থ করে নি ,সেই ব্যক্তি হাদিস বর্ণনা করলে তার বর্ণনা ভুল বলে পরিগনিত হবে । সে উদ্দেশ্য প্রনোদিত হয়ে মিথ্যা বলে না ,কিন্তু হাদিস সম্পর্কে যা সে স্মরন করতে পারে তাই বর্ণনা করে এবং নিজে তা আমল করে ,এই ধারনায় যে সে হাদিসটি শুনেছে রাসূলের (সাঃ) কাছ থেকে । এখন ,মুসলমানরা যদি জানতে পারতো যে , সে নিজেই হাদিসটি যথাযথভাবে বুঝতে পারে নি তাহলে তারা গ্রহণ করতো না । যদি (হাদিস বর্ণনাকারী) জানতো যে সে হাদিসটি ভুল বুঝেছে , তাহলে সেও নিজে থেকেই উহা বাতিল বলে ঘোষনা করতো এবং উহা কখনো বর্ণনা করতো না ।
3) রাসূল (সাঃ) কোন একটি বিষয়ে আমল করার জন্য আদেশ করলেন এবং কোন লোক উহা জানতে পারলো । পরবর্তী সময়ে রাসূল (সাঃ) উক্ত আদেশ বাতিল করলেন ও লোকদেরকে উহা আমল করতে নিষেধ করলেন ,কিন্তু লোকটি (হাদিস বর্ণনাকারী) এই পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে পারলো না । অথবা সে কোন কিছু করার ক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ) এর কোন নিষেধাজ্ঞা জানলো অথচ পরবর্তী সময়ে রাসূল (সাঃ) উহা করার জন্য আদেশ দান করলেন । এই লোক (হাদিস বর্ণনাকারী) পুনরায় কৃত এই পরিবর্তন জানতে পারলো না ,সুতরাং তার মনে থাকলো বাতিল আদেশ এবং ঐ বাতিল্করন সম্পর্কে অবহিত থাকলো না । যদি সে জানতো যে হাদিসটি বাতিল করা হয়েছে ,সে উহা বর্ণনা করতো না ,এবং আমলের আদেশ বাতিল হওয়ার কারনে সে বাতিল আদেশের উপর নিজেও আমল করতো না ।
4) এমন একজন লোক যিনি আল্লাহ ও রাসূলের (সাঃ) উপর কখনো মিথ্যাচার করেননি ;আল্লাহ-ভীতির (তাকওয়া)কারনে এবং রাসূলের (সাঃ) প্রতি গভীর শ্রদ্বার কারনে তিনি মিথ্যাকে ঘৃ্না করতেন । তিনি ভুল কোন কিছু বর্ণনা করেন নি এবং তাঁর বর্ণিত হাদিসের ব্যাপারে কোন রূপ সন্দেহও ছিলনা ;কিন্তু তিনি যা কিছুই শ্রবন করতেন উহার প্রকৃ্ত রুপেই আত্নস্থ করতেন এবং উহা বর্ণনা করতেন । তিনি উহার সাথে কিছু যোগও করতেন না ,কোন কিছু উহা হতে বাদও দিতেন না । তিনি আদেশের রদকরনের বিষয় যথাযথভাবে স্মরন রাখতেন এবং তিনি উহার উপর নিজেও আমল করতেন ,কিন্তু যেহেতু রদকৃ্ত বিষয়টি তিনি মনে রাখতেন কাজেই তিনি ঐ কাজ নিজে করতেন না । সাধারন বা সার্বজনীন এবং সুনির্দিষ্ট আদেশ সম্পর্কে তাঁর ছিল পূর্ণ জ্ঞান এবং তিনি যথাস্থানে উহাদের প্রয়োগ করতেন । সুষ্পষ্ট-সুনির্দিষ্ট ও রুপক হুকুম সম্পর্কে তার পুঙ্খানুপুংখ জ্ঞান ছিল ।
কোন কোন সময় রাসূল (সাঃ) কোন বিষয় বলতেনঃযার দ্বিবিধ অর্থ হতো ,একটি বক্তব্য কোন নির্দিষ্ট সময়ের প্রেক্ষিতে কোন সুনির্দিষ্ট বিশেষ বিষয়কে নির্দেশ করে এবং অন্যটি সকল কিছুকে সকল সময়ের জন্য নির্দেশ করে । সুতরাং আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ) ঐ নির্দেশ দ্বারা প্রকৃ্ত অর্থে কি হুকুম করেছিলেন যে ব্যক্তি তা জানতো না ,এবং সময়ের অভাবের কারনে সে একে নিজে থেকে ব্যাখ্যা করলো উহার ঘোষনাকারীর প্রকৃত হুকুমের বিপরীতে (কোন কোন সময় রাসূল (সাঃ) কোন নির্দিষ্ট সময়ের প্রেক্ষিতে কোন নির্দেশ প্রদান করেছেন । অর্থাত সেই নির্দিষ্ট সময়েই সেই আদেশ প্রতিপালন করার বিষয়টি জড়িত ,কিন্তু কোন সময়ে নয়) ।
বিষয়টি এমন ছিল না যে সকল সাহাবীই রাসূল (সাঃ) কে কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিল এবং উহা অনুধাবন করার জন্য তারা সকলেই তাদের প্রজ্ঞা প্রয়োগ করেছিল ,যাতে রাসূলের (সাঃ) নিকট কোন প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য তাদের কোন বন্দ্বু বা অন্য কেউ(যাদের অধিকাংশই মরুবাসী)দীর্ঘ পথ ভ্রমন করে এলে তারা(সাহাবীরা) উহাদের জবাব এমন সন্তোষজনকভাবে দিচ্ছিল যেন তারা মনোযোগ ও আগ্রহ সহকারে শ্রবন করছিল । এই ধরনের কিছুই আমার ব্যাপারে ঘটেনি । আমার ক্ষেত্রে আমি রাসূল (সাঃ) কে কোন বিষয়ে প্রশ্ন করতাম এবং তার উত্তরে তিনি যা বলতেন আমি উহা মুখস্ত করে নিতাম ।
এগুলোই হলো বিচ্যুতির কারন যা মানুষের মধ্যে মতদ্বৈধতা সৃষ্টি করেছে । হাদিসের বিভিন্ন ধরনের নননার কারনে সৃষ্ট এই অসঙ্গতি এবং বিরোধ মারাত্মক সমস্যা তৈ্রী করেছে (এই ব্যাপারে আরো জানার জন্য পড়ুনঃ‘
মিন তারিখ আলা হাদিসঃ’
মুরতাযা আশকারী রঃ ;শেখ মাহমুদ আবু রিয়া-এর‘
আজোয়া আলা সুন্নাহ আল মুহাম্মাদিয়াহ’
;সাইয়েদ আব্দ আল হোসায়েন শরফুদ্দিন-এর”
আবু হোরায়রা । )
আমরা ইমাম আলী (আঃ) এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছি যে ,ইহা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীকে সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করে ,এবং গবেষনা ও তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে রাসূলের (সাঃ) হাদিসের প্রকৃ্ত অর্থ ও তার মমার্থ উদ্বারের জন্য দৃঢ়তার সাথে আমাদের আশু করনীয় সম্পর্কে উল্লেখ করে ,যাতে সকল বিরোধ-মতপার্থক্য নির্মুল হয় এবং সকল সন্দেহের অপনোদন ঘটে । হে আল্লাহ! এই ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করুন ,
“
মুহাম্মাদ একজন রাসূল মাত্র ;তার মত অনেক রাসূল গত হয়েছে । সুতরাং যদি সে মারা যায় বা নিহত হয় ,তবে তোমরা কি পৃষ্ট প্রদর্শন করবে ?এবং কেউ পৃষ্ট প্রদর্শন করলে সে কখনো আল্লাহর ক্ষতি করতে পারবে না ;বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃ্তজ্ঞদিগকে পুরস্কৃত করবেন”
। (আল-কোরআন ,আলে-ইমরানঃ144) ।
“
রাসূল তোমাদিগকে যা দেয় তা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদিগকে নিষেধ করে তা হতে তোমরা বিরত থাক এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর”
(সুরা হাশরঃ59)”
।
“
এবং সে মনগড়া কথাও বলে না । এটা তো ওহী ,যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়”
(সুরা নাজমঃ3-4) ।