কোরআন ও হাদীসের আলোকে মাহে রমজান

কোরআন ও হাদীসের আলোকে মাহে রমজান0%

কোরআন ও হাদীসের আলোকে মাহে রমজান লেখক:
প্রকাশক: ইমামিয়্যাহ্ কালচারাল সেন্টার
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 17 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 14084 / ডাউনলোড: 4785
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআন ও হাদীসের আলোকে মাহে রমজান

কোরআন ও হাদীসের আলোকে মাহে রমজান

লেখক:
প্রকাশক: ইমামিয়্যাহ্ কালচারাল সেন্টার
বাংলা

লাইলাতুল কদর (শবে কদর) প্রসঙ্গে

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ইন্না আনযালনাহু ফী লায়লাতিল কাদরি। ওয়া মা আদরাকা মা লায়লাতুল কাদর। লায়লাতুল কাদরি খায়রুম মিন আলফি শাহর । তানাযযালুল মালাইকাতু ওয়াররুহু ফীহা বিইযনি রাব্বিহিম মিন কুল্লি আমর ; সালামুন হিয়া হাত্তা মাতলাইল ফাজর। - অর্থাৎঃ নিশ্চয় আমি একে (কোরআন) কদরের রাত্রিতে নাযিল করেছি। আপনি কি জানেন কদরের রাত্রি কি ? কদরের রাত্রি হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এই রাত্রে তাদের প্রতিপালকের নির্দেশক্রমে ফেরেশতাগণ ও রুহ (জিবরাঈল) প্রত্যেক মঙ্গলজনক কাজ নিয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়। এই মঙ্গলজনক কাজ ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (সুত্র: আল কোরআন , সুরা আল কদ্বর , আয়াত: 1-5)।

রমজান মোবারকে শবে কদর নামে একটি রাত্রি আছে , যাহা কালামে পাকের ভাষায় সহস্র মাস অপেক্ষা উত্তম। সহস্র মাস তিরাসী বৎসর চার মাসে হয়। এইরাত্রের এবাদত যাহার ভাগ্যে জুটিয়াছে সে বড় ভাগ্যবান। সে যেমন নাকি তিরাশী বৎসর চার মাসেরও অধিক কাল এবাদতে কাটাইল। (সুত্র: ফাজায়েলে আ মাল , (অধ্যায়: ফাজায়েলে রমজান) , দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ , পৃষ্ঠা: 46 ; তাবলীগী কুতুবখানা , 60 চক সার্কুলার রোড , চকবাজার , ঢাকা-1211)।

হজরত আনাস (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে , হুজুর পাক (সাঃ) বলেন , শবে কদর একমাত্র আমার উম্মতকেই দেওয়া হয়েছে। অন্য কাহাকেও নহে। উক্ত সেয়ামতের বারণ স্বরূপ হাদীস বর্ণিত আছে যে , পূর্ববর্তী উম্মতগন দীর্ঘায়ু হওয়ার কারণে অনেক বেশী বেশী এবাদত সক্ষম হইতেন। আর হুজুরের উম্মত স্বল্পায়ু হওয়ার দারুন উহা হইতে বঞ্চিত থাকিবে। ইহাতে হুজুর (সাঃ) মনক্ষুন্ন হইলেন , কাজেই আল্লাহ পাক দয়াপূর্বক এই রাত্র দান করিলেন। যদি কোন ভাগ্যবান এইরুপ দশটি রাত্রও লাভ করেন এবং এবাদতে কাটান তবে আটশত তেত্রিশ বৎসর চারি মাসেরও বেশী সময় এবাদতের সওয়াব প্রাপ্ত হইবেন। (সুত্র: মুয়াত্তা ইমাম মালিক , 1ম খণ্ড , রেওয়ায়ত -775 ; ফাজায়েলে আ মাল , (অধ্যায়: ফাজায়েলে রমজান) , দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ , পৃষ্ঠা: 46 ; তাবলীগী কুতবু খানা , 60 চক সার্কুলার রোড , চকবাজার , ঢাকা-1211)।

প্রকৃতপক্ষে ইহা একটি আল্লাহর অপূর্ব নেয়ামত। উহাতে আমল করা আল্লাহর তওফীকেই সম্ভব। কত বড় সৌভাগ্যের অধিকারী ঐসব আওলিয়ায়ে কেরাম , যাহারা সারা জীবন শবে কদর প্রাপ্ত হইয়াছেন। কোন রাত্রে উহা সংঘটিত হয় ঐ সম্পর্কে হাদীস ও দলীল বর্ণিত আছে। উহার ফজীলত সম্পর্কে পবিত্র কালামে পাকে সূরায়ে ইন্না আনযালনা অবতীর্ণ হইয়াছে।

আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত । নবী (সাঃ) বলেছেন , যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের নিয়তে রমযানের রোযা রাখল , তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের নিয়তে কদরের রাত্রিতে (ইবাদতে) দাঁড়াল , তার আগেরকার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (সুত্র: সহীহ আল বুখারী , 2য় খণ্ড , কিতাবুয সাওম , পৃষ্ঠা: 261 , হাদীস: 1871 , আধুনিক প্রকাশনী , সন- 1986 ; ফাজায়েলে আ মাল , পৃষ্ঠা: 49)।

আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত । রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন , তোমরা লাইলাতুল কদরকে রমযানের শেষ দশ দিনের বিজোড় রাত্রিতে তালাশ কর। (সুত্র: সহীহ আল বুখারী , 2য় খণ্ড , কিতাবুয সাওম , পৃষ্ঠা: 262 , হাদীস: 1874 , 1876 , 1877 আধুনিক প্রকাশনী , সন- সেপ্টেম্বার 1986)।

ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত । নবী (সাঃ) বলেছেন , তোমরা লাইলাতুল কদরকে রমযানের শেষ দশ দিনে খোঁজ কর। লাইলাতুল কদর এসব রাত্রিতে আছে-যখন (রমযানের) 9 ,7 কিংবা 5 রাত বাকী থেকে যায় (অর্থাৎ 21 , 23 ও 25 তারিখে)। (সুত্র: সহীহ আল বুখারী , 2য় খণ্ড , কিতাবুয সাওম , পৃষ্ঠা: 263 , হাদীস: 1878 , আধুনিক প্রকাশনী , সন- সেপ্টেম্বার 1986)।

ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেছেন , রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন , তা (শবে কদর) শেষ দশদিনে আছে। যখন নয় রাত অতীত হয়ে যায় কিংবা সাত রাত বাকী থাকে । (সুত্র: সহীহ আল বুখারী , 2য় খণ্ড , কিতাবুয সাওম , পৃষ্ঠা: 263 , হাদীস: 1880 , আধুনিক প্রকাশনী , সন- সেপ্টেম্বার 1986)।

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) বর্ণনা করেছেন , রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রমযানের শেষ দশদিনে ই তেকাফে বসতেন। (সুত্র: সহীহ আল বুখারী , 2য় খণ্ড , কিতাবুয সাওম , পৃষ্ঠা: 264 , হাদীস: 1883 , আধুনিক প্রকাশনী , সন -1986)।

আল্-কানাবী (র) আবু সাঈদ খুদরী হতে বর্ণিত । তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম সাধারণত রমযানের মধ্যম দশ দিনে ইতিকাফ করতেন। এরূপে তিনি (সাঃ) এক বছর ইতিকাফ করবার সময় রমযানের 21শে রাতে , অর্থাৎ যে রাতে তিনি ইতিকাফ শেষ করেন সেদিন তিনি (সাঃ) ইরশাদ করেনঃ যে ব্যক্তি আমার সাথে ইতিকাফে শরীক হয়েছে সে যেন রমযানের শেষ দশ দিন ও ইতিকাফ করে এবং আমি লায়লাতুল-কদর দেখেছি , কিন্তু তা আমাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি নিজেকে শবে কদরের সকালে কাদামাটির মধ্যে সিজদা করতে দেখেছি। তোমরা তা (শবে কদর) রমযানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতে অন্বেষণ করবে। (সূত্র: আবুদাউদ শরীফ , দ্বিতীয় খণ্ড , পৃষ্ঠা: 278 , হাদীস: 1382 , ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)।

রাবী আবু সাঈদ (র) বলেনঃ উক্ত একুশের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল এবং তখন মসজিদের ছাদ খেজুর পাতার থাকায় পানি পড়েছিল। রাবী আবু সাঈদ (রা) আরো বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ (স)-এর চেহারা মোবারকে , নাক ও চোখে 21 তারিখের সকালে কাদামাটির চিহ্ন দেখতে পাই। (সূত্র: বুখারী , মুসলিম , ইবনে মাজা ; আবু দাউদ শরীফ , দ্বিতীয় খণ্ড , পৃষ্ঠা: 278 , হাদীস: 1382 , ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)।

আব্দুল্লাহ্ ইবনে উনায়স জুহানী (রা) হইতে বর্ণিত তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খিদমতে আরজ করিলেনঃ আমি এমন এক ব্যক্তি যাহার বাড়ি অনেক দূরে অবস্থিত , তাই আমাকে আপনি একটি রাত বলিয়া দিন যেই রাত্রিতে আমি (ইবাদতের জন্য এই মসজিদে) আগমন করিব। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁহাকে বলিলেনঃ তুমি রমযানের তেইশে রাত্রিতে আগমন কর। (সূত্র: মুয়াত্তা ইমাম মালিক (র) , প্রথম খণ্ড , পৃষ্ঠা: 260 , রেওয়ায়ত -772 , তৃতীয় সংস্করণ: মার্চ 1995 ; ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)।

আবু সালামা (রা:) বলেছেন , আমি আবু সঈদকে- যিনি আমার বন্ধু ছিলেন- এক প্রশ্ন করলাম। তিনি জবাব দিলেন , আমরা নবী (সাঃ) -এর সঙ্গে রমযানের দশ দিনে ইতেকাফে বসলাম। অতঃপর বিশ তারিখের ভোরে নবী (সাঃ) বেরিয়ে আসলেন , আমাদের সামনে ভাষণ দিলেন এবং বললেন , আমাকে শবে কদর দেখান হয়েছে। তারপর আমি তা ভুলে গিয়েছি। কিংবা তিনি বলেছেন , আমাকে ভুলিয়া দেয়া হয়েছে। অতএব , তোমরা (রমযানের) শেষ দশদিনের বেজোড় ও অযুগ্ম তারিখে (অর্থাৎ 21 , 23 , 25 , 27 ও 29) লাইলাতুল কদর তালাশ কর , কেননা আমি দেখতে পেয়েছি যে , আমি স্বয়ং পানি ও কাদায় সিজদা করছি। এ জন্য যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর সাথে ইতেকাফে বসেছে সে যেন ফিরে চলে যায়। সুতরাং আমরা ফিরে চলে গেলাম। আমরা আকাশে একখণ্ড মেঘও দেখলাম না। হঠাৎ একখণ্ড মেঘ দেখা দিল এবং বর্ষণ শুরু হল। এমনকি মসজিদের ছাদ ভেসে গেল। এ ছাদ খেজুরের ডালে নিমিত ছিল। অতঃপর নামায পড়া হল। তখন আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -কে পানি ও কাদায় সিজদা করতে দেখলাম। এমনকি আমি তাঁর কপালে কাদার চিহ্ন দেখতে পেলাম। (সুত্র: সহীহ আল বুখারী , 2য় খণ্ড , কিতাবুয সাওম , পৃষ্ঠা: 262 , হাদীস: 1873 , আধুনিক প্রকাশনী , সন -1986)।

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন , রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাহে রমযানের মধ্যের দশদিনে ইতেকাফে বসতেন। যখন বিশ তারিখ অতীত হত এবং 21 তারিখ এসে যেত তখন তিনি ¯ গৃহে ফিরে আসতেন। আর যারা তার সাথে ইতেকাফে বসতো তারাও ফিরে যেতো। একবার রমযানে তিনি সেই রাত্রে ইতেকাফে ছিলেন যে রাত্রে সাধারণত: তিনি ফিরে চলে যেতেন। তারপর তিনি মানুষের সামনে ভাষণ দান করলেন এবং আল্লাহ যা চেয়েছেন সে মতে তিনি নির্দেশ দিলেন। (সুত্র: সহীহ আল বুখারী , 2য় খণ্ড , কিতাবুয সাওম , পৃষ্ঠা: 263 , হাদীস: 1875 , আধুনিক প্রকাশনী , সন -1986)।

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত: যখন একুশ তারিখের রাত আসল এটি ওই রাত ছিল যে রাতে কদরের রাত দেখানো হয়েছে। (সুত্র: সহীহ আল বুখারী , 2য় খণ্ড , কিতাবুয সাওম , পৃষ্ঠা: 263 , হাদীস: 1885 , আধুনিক প্রকাশনী , সন -1986)।

এখানে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে আমরা যতগুলো হাদীস পেয়েছি প্রায় প্রত্যেকটিতেই দেখা যাচ্ছে যে লাইলাতুল কদরকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তালাশ করতে বলেছিলেন শেষের দশ দিনের বেজোড় রাতে। ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত : লাইলাতুল কদর তোমরা পাবে 9 ,7 কিংবা 5 রাত বাকী থাকতে (অর্থাৎ 21 , 23 ও 25 তারিখে)। রাবী আবু সাঈদ (র) বলেনঃ উক্ত একুশের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল এবং তখন মসজিদের ছাদ খেজুর পাতার থাকায় পানি পড়েছিল। আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর চেহারা মোবারকে , নাক ও চোখে 21 তারিখের সকালে কাঁদামাটির চিহ্ন দেখতে পাই । রাসূলে খোদা (সাঃ) নিজেই বলেছেন আমি লায়লাতুল-কদর দেখেছি , আমি নিজেকে শবে কদরের সকালে কাদামাটির মধ্যে সিজদা করতে দেখেছি। এখানে অধিকাংশতেই 21-এর রাতকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়েতে 9 রাত বাকী থাকতে কদরের রাত হয় অর্থাৎ হয়ত 21-এর রাত্রে অথবা 7 রাত বাকী থাকতে অর্থাৎ 23-এর রাতে। আবার আব্দুল্লাহ্ ইবনে উনায়স জুহানী (রা)-কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্পষ্ট উল্লেখ করে বলেই দিয়েছেন যে , 23 -এর রাতে। তাই শবে কদরকে 23-এর রাতেই উদযাপন করা উচিত।

মানুষের ঝগড়া-বিবাদের কারণে লাইলাতুল কদরের পরিচিতি বিলীন হল। (সুত্র: সহীহ আল বুখারী , 2য় খণ্ড , কিতাবুয সাওম , পৃষ্ঠা: 263 , হাদীস: নিচের অনুচ্ছেদ , আধুনিক প্রকাশনী , সন -1986)।

উবাদা ইবনে সামেত (রাঃ) বর্ণনা করেছেন , নবী (সাঃ) (একদা) আমাদেরকে লাইলাতুল কদর (এর সঠিক তারিখ) সম্বন্ধে অবহিত করার জন্য বেরিয়ে এসেছিলেন। এমনি সময় দুজন মুসলমান বিবাদ করতে লাগল। তখন তিনি বললেন আমি বের হয়েছিলাম। তোমাদেরকে লাইলাতুল কদর (এর সঠিক তারিখ সম্বন্ধে) খবর দেওয়ার জন্য। কিন্তু অমুক অমুক ব্যক্তি ঝগড়ায় লিপ্ত হল। (তাই এর এলম আমার থেকে) উঠিয়ে নেয়া হল। সম্ভবত: এর মধ্যেই তোমাদের কল্যাণ নিহিত ছিল। অতএব , তোমরা লাইলাতুল কদরকে শেষের দশ দিনে , নবম , সপ্তম ও পঞ্চম রাত্রিতে তালাশ কর। (সুত্র: সহীহ আল বুখারী , 2য় খণ্ড , কিতাবুয সাওম , পৃষ্ঠা: 263 , হাদীস: 1885 , আধুনিক প্রকাশনী , সন -1986)।

উপরে উল্লেখিত সকল হাদিসে যদিও শবে কদরের রাত স্পষ্ট আকারে উল্লেখ রয়েছে। এবং সেটা এমন একটি দিন ছিল যে রাতে রাসূল এতই ইবাদত করেছেন এমনকি প্রচুর বর্ষনের ফলেও তিনি ইবাদত ছাড়েননি পানি ও কাদায় সিজদা করলেন আর এটা ছিল 21-এর রাত। কিন্তু একটি অদ্ভুদ বাক্য এখানে দেখতে পাওয়া যায় যেমন: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সবাইকে শবে কদরের প্রকাশ্য ঘোষনা দেওয়ার পরও নাকি বলেছেন: তারপর আমি তা ভুলে গিয়েছি । (হয়ত কোন ঝগড়াটে দুইজন ব্যক্তির জন্য) । কিংবা তিনি বলেছেন , আমাকে ভুলিয়া দেয়া হয়েছে। (এটা আবার কার জন্যে ?)। তোমরা শবে কদরকে আবার তালাশ কর ? এখানেকি লুকুচুরি খেলা হচ্ছিল যে আবার তালাশ করতে হবে আর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এত সহজেই আল্লাহর সেই ওহী-কে ভুলে গিয়েছেন ?

হে মুসলমানের নামধারী ব্যক্তিবর্গ! একথা অবশ্যই সরণ রাখবেন যে , রাসূলের দ্বারা কোন ভুল হয় না। কারণ আল্লাহ কোরআনের স্পষ্ট বলেছেন যে: তারকার কসম , যখন উহা অস্ত যাইতে থাকে , তোমাদের প্রতিবেশী সাক্ষী মোহাম্মদ পথভ্রষ্টও হয় নাই , ভুলেও যায়নাই , আর সে নিজের ইচ্ছামত কোন কথা বলে না। (সুত্র: আল কোরআন , সুরা নাজম , আয়াত: 1-3 , শুরা: 53)।

এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কখনো ভুলেও যান না ও কারো উপর নির্ভরও করেন না (নিজের ব্যক্তিবর্গ ছাড়া) কারণ আল্লাহ কোরআনে বলেছেন যে: তিনিই (আল্লাহ) অদৃশ্য জগতের (জ্ঞানের একক) জ্ঞানী , তাঁর সে অদৃশ্য জগতের কোনো কিছুই তিনি কারো কাছে প্রকাশ করেন না। একমাত্র তাঁহার মনোনীত কোন রাসূলের নিকটে ভিন্ন ইহা প্রকাশ করেন না। (সুত্র: আল কোরআন সূরা জ্বিন , আয়াত: 26-27 , শুরা নং: 72)।

তুমি কখনও মনে করিও না যে আল্লাহ তাঁহার রাসূলগনের প্রতি প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভগ্ন করেন। আল্লাহ পরক্রমশালী , বিচার গ্রহণকারী। (সুত্র: আল কোরআন , সুরা ইব্রাহীম , আয়াত: 47 , শুরা নং: 210)।

ইহা এক উপদেশ , অতএব যাহারা অভিরুচি সে তাহার প্রতিপালকের পথ অবলম্বন করুক। (সুত্র: আল কোরআন , সুরা মুযযামমীল , আয়াত: 19)।

আশুরার রোযা প্রসঙ্গে

পবিত্র মহররম মাস হচ্ছে আরবী সনের প্রথম মাস। ইহা একটি শোকের মাস। মহররম মাসের দশ তারিখ হলো আশুরা। সারা বিশ্বের মুসলমানের জন্য ইহা একটি শোকের দিন। এই মহররম মাসে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাবলী ইতিহাসে রয়েছে। তবে সবচেয়ে মর্মদায়ক ঘটনা হচ্ছে কারবালার আশুরার দিন 10ই মহররম। পবিত্র মহররমের চাঁদ উদিত হলে বিশ্বের মুসলমানদের হৃদয় পটে ভেসে উঠে কারবালার সেই ইতিহাসের ঘটনা। এটি হল বাতিলের বিরুদ্ধে হক প্রতিষ্ঠার নজিরবিহীন এক অসম যুদ্ধের ইতিহাস। যে যুদ্ধে রাসূল (সাঃ) এর পরিবারের নারী , পুরুষ ও শিশুর হকপন্থি কিছু মুজাহিদ ইসলামের জন্য তাদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। পাপিষ্ঠ ইয়াজিদ বাহিনী নারীদের উপর চালিয়েছে বর্বরচিত অত্যাচার। ইয়াজিদ বাহিনী ইমাম হোসাইন (আঃ) ও তার সঙ্গী সাথীদের ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্থ অবস্থায় 10ই মহররম কারবালায় নির্মমভাবে হত্যা করে। এ অত্যাচার ও নির্যাতন ইসলামের কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

ইমাম হোসাইন (আঃ) ও তার পরিবার পরিজনের এই শাহাদাত ভুলে যাবার মত নয়। মুহররমে ঘটে যাওয়া এই নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিক ঘটনাকে স্মরণ করে মুসলমানদের একটি দল মাস ব্যাপি শোক পালন করে থাকে। তখন ইয়াজিদ অনুসারিরা ফতুয়া দিতে থাকেন শিরিক আর বেদাত না করে রোযা রাখো। কেন উনারা কি ভুলে গেছেন যে , শরিয়তে আশুরার দিন রোযা রাখা বাতিল হয়ে গেছে। দুঃখের বিষয় যে , প্রসিদ্ধ কিতাব সহী আল বোখারী , সহী মুসলিম শরীফ , মুসনাদ ইমাম ইবনে হাম্বাল , মুয়াত্তা ইমাম মালেকি ও আরো গ্রন্থ বোধ হয় দেখেন নাই। এ পুস্তকগুলোর মর্যাদা অনেক এবং উহাতেই প্রত্যেক মাযহাবের দ্বীনি আকায়েদ ও মাজহাবের ভিত্তি নিহিত।

রমজান শরীফের রোযা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার দিন রোযা রাখা হত। কিন্তু যখন হতে রমজানের রোযা ফরজ করা হয় তারপর হতেই আশুরার রোযা পরিত্যাগ করা হয়। (সূত্র: মুয়াত্তা ইমাম মালেকি (রাঃ) , প্রথম খণ্ড , পৃষ্ঠা: 247 , হাদীস: 726 ,ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)।

আব্দুর রহমান হতে বর্ণিত : আশআস আশুরার দিন আব্দুল্লাহর নিকট উপস্থিত হয়ে দেখেন যে , তিনি খাওয়ায় রত , ইহাতে আশআস বলেন যে , আজতো আশুরার দিন আপনি কি রোযা নহেন ? আব্দুল্লাহ বলেন , তুমি কি জাননা যে , আশুরার রোযা তখন পর্যন্ত জায়েজ ছিল যখন রমজান মাসের রোযা ফরয করা হয় নাই। আর যখন হতে রমজান মাসের রোযা ফরজ করা হয়েছে তখন হতে মহররমের আশুরার রোযা ছেড়ে দেওয়া হয়। (সূত্র: বুখারী , পৃষ্ঠা: 646 ; সহীহ মুসলেম , 1ম খণ্ড , পৃষ্ঠা: 358 , লা: 17)

উম্মুল মোমেনীন হযরত আয়েশা হতে বর্ণিত যে , অসভ্যতার যুগে বা ইসলাম প্রচারের পূর্বে কোরইশগন ও স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আশুরার দিন রোযা রাখতেন। এমনকি হিজরতের পরেও মদীনায় রোযা রাখা প্রচলন ছিল। কিন্তুরমজান মাসের রোযা ফরজ হওয়ায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আশুরার রোযা পরিত্যাগ করেন। (সূত্র: সহী আল বুখারী , পৃষ্ঠা: 257 , 2য় খণ্ড , হাদীস: 1861 ; মুসনাদে ইমাম হাম্বাল , 6ষ্ঠ খণ্ড , পৃষ্টা: 30)

হুমায়ূন ইবনে আবদূর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে , তিনি হজ্জের সালে (হজ্জের সাল -44 হিজরীতে আমীর মুয়াবিয়া তাঁহার শাসনামলে প্রথমবার যে হজ্জ করেন উহাকে হজ্জের সাল বলা হইয়াছে) আশুরার দিবসে মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান কে মিম্বরের উপরে বলিতে শুনিয়াছেন , হে মদীনাবাসী! তোমাদের আলেমগন কোথায় ? আমি এই দিবস সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -কে বলিতে শুনিয়াছি , ইহা আশুরা দিবস ; তোমাদের উপর এই (দিবসের) রোযা ফরয করা হয় নাই। আমি রোযা রাখিয়াছি , তোমরা যে ইচ্ছা কর রোযা রাখিতে পার , আর যাহার ইচ্ছা রোযা ছাড়িয়া দাও। (সূত্র: মুয়াত্তা ইমাম মালেকি (রাঃ) , প্রথম খণ্ড , পৃষ্ঠা: 248 রেওয়ায়ত-727 , ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ; সহীহ আল বুখারী , 2য় খণ্ড , পৃষ্ঠা: 257 , হাদীস: 1862 , আধুনিক প্রকাশনী , সন -1986)।

এবং রেওয়াতে বর্ণিত রয়েছে যে , মুয়াবিয়ার সময় সে আনেক জাল হাদীস প্রচলন করে এবং সম্পূর্ণ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। ইমাম ইসহাক বিন ইব্রাহীম আনযালী (রাঃ) বলেন , ফজিলতে মাবিয়ার কোন হাদীসই সহী নহে। (সুত্র: রউফল হেযাব , পৃষ্ঠা: 119-120)।

আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ুতী বলেন , মাবিয়ার ফজিলতে প্রচলন হাদীসগুলো মওযু। (সুত্র: তায্কেরাতুল মওযুআত , শরহে সাপারুস সা আদ ইত্যাদি গ্রন্থ)

ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন , ইয়াহুদীরা আশুরার দিনকে ঈদ হিসেবে গণ্য করত। (সুত্র: সহীহ আল বুখারী , 2য় খণ্ড , পৃষ্ঠা: 258 , হাদীস: 1864 , আধুনিক প্রকাশনী , সন -1986)।

রোযা অবশ্যই একটি খুশির পয়গাম। রোযার বিনিময়ে আমরা আমাদের মহান রাব্বুল আলামিনের দরবার থেকে পুরুস্কার প্রাপ্ত হই। স্বয়ং রাসূলে খোদা (সাঃ) -ও এর জন্য আমাদের উপর রাযি থাকেন। যেমন আমরা রমজানে 30টি রোযা শেষ করে খুশি মনে ঈদ উদযাপন করি , সেমাই , পোলাও , কোরমা ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। এই সব কিছুইতো একটি খুশির বিনিময়ে তাইনা ? কিন্তু আশুরা এমন একটি দিন যে দিনে আমাদের মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের প্রিয় নবী রাসূলে খোদা (সাঃ) -এর পুত্র (কোরআন পাকে আয়াতে মোবাহেলা দেখুন) ইমাম হোসাইন (আঃ)-কে নির্মমভাবে স্ব-পরিবার সহ মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানের পাপিষ্ঠ ও নেশাখোর পুত্র ইয়াজিদ (লাঃ) ইবনে মুয়াবিয়া হত্যা করেছিল। জবাইকৃত পশুরমত কুরবানী করেছিল ইমাম হোসাইন (আঃ)-কে কারবালা প্রান্তরে। কিন্তু তখন ইয়াজিদের পক্ষবাদী কোন মুসলমান সেই মাজলুম ব্যক্তিটির পক্ষে সাক্ষ দেয় নাই। ইমাম হোসাইন রাসূলের কষ্টের গড়া দ্বীনে ইসলাম ও তার শরিয়তকে চিৎকার দিয়ে দিয়ে সেই নামধারী মুসলমানদের সামনে প্রকাশ্য ঘোষনা দিচ্ছিলেন। কিন্তু হায়! সেই দিন কেউ মানেনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর সেই শরিয়ত। আর ইমাম হোসাইন (আঃ) বিনা দোষে শহীদ হয়ে যান। পূর্বে বহু রেওয়াতের তারিখ ছিলো এই দিনটি। কিন্তু কারবালার ঘটনার পর থেকে আশুরার এই দিনটি ইসলামের ইতিহাসের পাতায় একটি শোকের দিন হিসাবে পালন করা হয় । যত নবী রাসূলগনের ইতিহাসে তাঁদের জন্ম , নাযাত , খুশি , আমেজ-ফূর্তি ছিল সব থমকে যায় শুধু রয়ে যায় রাসূলের পরিবারের সেই শোক। তাই আমাদেরকে আশুরার দিন সকল প্রকার খুশি বর্জন করে শোক পালন করতে হবে ও তাদের উসিলায় নিজেদের জন্য দোয়া খায়ের চাইতে হবে। দোয়া তাঁদের (ইমাম হোসাইনের) জন্য নহে। আমরা তাঁদের শাফায়াত আশা করি , তাঁরা আমাদের নহে।