শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)

শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)5%

শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড) লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ: ইতিহাস

শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 90 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 51353 / ডাউনলোড: 5497
সাইজ সাইজ সাইজ
শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)

শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বাংলা

1

2

3

4

আমর বিন হুমাক্বের শাহাদাত

আমর বিন হুমাক্ব (যেমনটি আগে বলা হয়েছে যে তিনি হুজর বিন আদির সাথে মসজিদে উপস্থিত ছিলেন) রুফা আহ বিন শাদ্দাদের সাথে কুফা থেকে পালিয়ে যান এবং মাদায়েনে পৌঁছান এবং সেখান থেকে মসূল যান। সেখানে তারা এক বড় পর্বতে আশ্রয় নেন। যখন এ সংবাদ মসূলের গভর্নর উবায়দুল্লাহ বিন বালতা ’ আহ হামাদানির কাছে পৌঁছল সে কিছু অশ্বারোহী সৈনিক ও শহরের একদল মানুষ নিয়ে তাদের দিকে অগ্রসর হলো। আমরের শরীরে পানি এসেছিল (একটি রোগ) , তাই তার সাহস হলো না তাদের মুকাবিলা করার। কিন্তু রুফা ’ আহ , যে ছিলো শক্তিশালী যুবক , তার ঘোড়ায় চড়লো এবং আমরকে বললো তাকে সে রক্ষা করবে। আমর বললেন , কী লাভ ? নিজেকে রক্ষা করো এবং এদের মাঝ থেকে পালাও। ” ঘোড়সওয়াররা তাকে ধাওয়া করলো কিন্তু সে তাদেরকে তীর দিয়ে আঘাত করলো , তাই তারা ফিরে গেলো।

তারা আমরকে গ্রেফতার করলো এবং তাকে জিজ্ঞেস করলো সে কে। তিনি উত্তর দিলেন , এমন একজন যাকে মুক্ত করে দিলে তোমাদের জন্য ভালো হবে এবং যদি আমাকে হত্যা কর তাহলে তোমরা খুব বড় ক্ষতিতে পড়বে। ” কিন্তু তিনি তার পরিচয় প্রকাশ করলেন না। তারা তাকে মসূলের শাসনকর্তা আব্দুর রহমান বিন উসমান সাক্বাফির কাছে নিয়ে গেলো , যে ছিলো মুয়াবিয়ার ভাগ্নে এবং পরিচিত ছিলো ইবনে উম্মুল হাকাম নামে। সে তার সম্পর্কে মুয়াবিয়ার কাছে লিখলো। মুয়াবিয়া উত্তর দিলো , সে সেই লোক যে স্বীকার করেছে যে সে উসমানকে একটি বর্শা দিয়ে নয় বার আহত করেছে। তাই এখনও তাকে শাস্তি দাও নি ? তাকে একটি বর্শা দিয়ে নয় বার আহত করা উচিত। ” তারা তাকে বের করে আনলো এবং বর্শার নয়টি আঘাত করলো এবং আমর সম্ভবত প্রথম বা দ্বিতীয় আঘাতেই মৃত্যুবরণ করলেন , পরে তার মাথা কেটে ফেলা হয় এবং মাথাটি মুয়াবিয়ার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ইসলামে তার মাথাই প্রথম যা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠানো হয়।

লেখক বলেন যে , ইসলামের ইতিহাসের বইগুলোতে বিষয়টি ঐতিহাসিকরা (যারা শিয়া নয়) এভাবে বর্ণনা করেছেন শুধু মুয়াবিয়া যে তাকে খুন করেছিলো তা জায়েয করার জন্য। আর বিশিষ্ট শিয়া বর্ণনাকারী শেইখ কাশশি বর্ণনা করেছেন যে , একবার নবী (সা.) এক দল লোককে পাঠালেন এ আদেশ দিয়ে যে , রাত্রির এ রকম সময়ে তোমরা পথ হারিয়ে ফেলবে। তখন বাম দিকে যাবে এবং তোমরা এক ব্যক্তির সাক্ষাৎ পাবে যার এক পাল ভেড়া থাকবে। তোমরা তাকে পথের দিশা জিজ্ঞেস করবে কিন্তু সে তোমাদের পথ দেখাবে না যতক্ষণ না তোমরা তার সাথে খাবার খাও। এরপর সে একটি ভেড়া জবাই করবে এবং তোমাদের জন্য কাবাব তৈরী করবে এবং তোমাদের সাথে খাবে। এরপর সে তোমাদের পথ দেখাবে। তোমরা আমার সালাম তার কাছে পৌঁছে দিও এবং তাকে জানিও মদীনায় আমার উপস্থিতি সম্পর্কে। ”

তারা যাত্রা করলেন এবং ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী তাদের পথ হারিয়ে ফেললেন। তাদের একজন বললেন , নবী কি আমাদের বলেন নি বাম দিকে যেতে ? তারা বাম দিকে গেলেন এবং এক লোকের সাক্ষাৎ পেলেন যার সম্পর্কে নবী (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং তাকে পথের কথা জিজ্ঞেস করলেন। লোকটি আমর বিন হুমাক্ব ছাড়া আর কেউ ছিলো না। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন , নবী কি মদীনায় উপস্থিত হয়েছেন ? তারা হ্যা-সূচক উত্তর দিলেন এবং তিনি তাদের সাথে রইলেন এবং নবীর (সা.) কাছে গেলেন এবং সেখানেই রইলেন আল্লাহ যতক্ষণ চাইলেন। এরপর নবী (সা.) তাকে বললেন , সে জায়গায় ফেরত যাও যেখান থেকে তুমি এসেছো , যখন বিশ্বাসীদের আমির আলী কুফার দায়িত্ব পাবে , তার কাছে যেও। ”

আমর ফেরত চলে গেলেন। যখন ইমাম আলী (আ.) কুফার খলিফা হলেন তখন তিনি তার কাছে এলেন এবং সেখানেই বাস করতে লাগলেন। ইমাম আলী (আ.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন , এখানে কি তোমার কোন বাড়ি আছে ? এতে তিনি হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলেন।

ইমাম বললেন , তাহলে তোমার বাড়ি বিক্রি করে দাও এবং আযদি (গোত্র)-এর মাঝে একটি বাড়ি কিনো। কারণ আগামীকাল যখন আমি তোমাদের মাঝ থেকে চলে যাবো তখন কিছু লোক তোমার পিছু ধাওয়া করবে , আযদি গোত্রের লোকেরা তোমাকে রক্ষা করবে যতক্ষণ না তুমি কুফা ত্যাগ কর এবং মসূলের দুর্গে হাজির হও। তুমি একটি পক্ষাঘাতগ্রস্থ লোকের পাশ দিয়ে যাবে , তুমি তার পাশে বসবে এবং পানি চাইবে। সে তোমাকে পানি দিবে এবং তোমার বিষয়ে খোঁজ- খবর দিবে। তখন তুমি তোমার অবস্থা তার কাছে বর্ণনা করো এবং তাকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিও। সে ইসলাম গ্রহণ করবে এবং এরপর তুমি তোমার হাত দুটো তার উরুদুটোর উপর রাখবে এবং আল্লাহ তাকে তার রোগ থেকে মুক্তি দিবেন। এরপর ওঠো এবং হাঁটো যতক্ষণ না একজন অন্ধ লোকের পাশ দিয়ে যাবে , যে পথের উপর বসে থাকবে। তুমি পানি চাও সে তোমাকে তা দিবে এবং এরপর সে তোমার সম্পর্কে জানতে চাইবে , তখন তুমি তোমার অবস্থার কথা তাকে বর্ণনা করো এবং তাকে ইসলামের দাওয়াত দিও। সে ইসলাম গ্রহণ করবে এবং এরপর তোমার দুহাত তার দুচোখের উপর রেখো। আল্লাহ , যিনি সম্মানিত ও প্রশংসিত তাকে দৃষ্টি দান করবেন। সেও তোমার সাথে সাথে আসবে এবং নিশ্চয়ই এ দুব্যক্তি হবে তারা যারা তোমাকে কবর দিবে। এরপর কিছু অশ্বারোহী ব্যক্তি তোমার পিছু ধাওয়া করবে এবং যখন তুমি অমুক সময়ে অমুক জায়গায় দুর্গের কাছে পৌঁছবে তারা তোমার কাছে আসবে। তখন তুমি ঘোড়া থেকে নেমে গুহায় প্রবেশ করো। নিশ্চয়ই মানুষ ও জীনদের মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্টরা তোমাকে হত্যার জন্য একত্র হবে। ”

ইমাম আলী (আ.) যা কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তা ঘটলো এবং আমর তাই করলেন যা তাকে করতে বলা হয়েছিলো। যখন তারা দুর্গে পৌঁছল আমর ঐ দুই লোককে বললেন ওপরে যেতে এবং তাকে বলতে বললেন তারা কী দেখছে। তারা ওপরে উঠলো এবং বললো যে তারা কিছু অশ্বারোহীকে দেখছে তাদের দিকে আসতে। তা শুনে আমর তার ঘোড়া থেকে নেমে গুহায় প্রবেশ করলেন এবং তার ঘোড়া পালিয়ে গেলো। যখন তিনি গুহায় প্রবেশ করলেন তখন একটি কালো সাপ , যেটি সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলো , তাকে কামড় দিলো। যখন অশ্বারোহীরা কাছে পৌঁছল তারা দেখলো তার ঘোড়া দৌড়াচ্ছে এবং বুঝতে পারলো যে আমর কাছে ভিতরেই আছে। তারা তার খোঁজ করতে লাগলো এবং তাকে গুহার ভিতরে দেখতে পেলো। তারা তার শরীরের যেখানেই স্পর্শ করলো তার মাংস খুলে এলো (প্রচণ্ড বিষের কারণে) । তখন তারা তার মাথা কেটে ফেললো এবং তার মাথাকে মুয়াবিয়ার কাছে নিয়ে গেলো , যে আদেশ দিলো তার মাথাকে বর্শার আগায় রাখতে ; ইসলামে এটিই হলো প্রথম মাথা যা বর্শার আগায় রাখা হয়েছিলো।

পরে বর্ণনা করা হবে যে জাহির , যিনি ইমাম হোসেইন (আ.) এর সাথে কারবালায় শহীদ হন , আমর বিন হুমাকের শিষ্য ছিলেন এবং তিনিই তাকে কবর দেন। ক্বামক্বাম ’ -এ বর্ণিত হয়েছে যে , আমর বিন হুমাক্ব ছিলেন কাহিন বিন হাবীব বিন আমর বিন ক্বাহিন বিন যাররাহ বিন আমর রাবি ‘ আ খুযাইর সন্তান। তিনি নবী (সা.) এর কাছে আসেন হুদাইবিয়ার সন্ধির পর। অন্যরা বলেন যে , তিনি বিদায় হজ্বের বছরে ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রথম বর্ণনাটি আরও নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয়। (ক্বামক্বাম) বইয়ের লেখক আমর বিন হুমাক থেকে বর্ণনা করেন যে , তিনি নবী (সা.) এর পিপাসা মিটিয়েছিলেন , যিনি তার জন্য দোআ করেছিলেন , হে রব , তাকে যৌবনপূর্ণ জীবন দাও। ” আর এভাবে তিনি আশি বছরে পৌঁছালেন কিন্তু তার চুল ও দাড়ি একটিও সাদা হলো না। তিনি ইমাম আলী (আ.) এর শিয়াদের একজন ছিলেন এবং তার সাথে থেকে জামাল , সিফফীন ও নাহরেওয়ানের যুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। এছাড়া তিনি ছিলেন তাদের একজন যারা হুজর বিন আদিকে সমর্থন করতে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তার সাথীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

তিনি ইরাক ত্যাগ করেন যিয়াদের ভয়ে এবং মসূলের গুহায় আশ্রয় নেন। মসূলের গভর্নর তাকে গ্রেফতার করার জন্য তার সৈন্যদের পাঠায়। যখন তারা গুহায় প্রবেশ করলো , তারা তাকে মৃত দেখতে পেলো , কারণ তাকে সাপে কামড় দিয়েছিলো। তার কবর মসূলে সুপরিচিত এবং তা যিয়ারতের তীর্থস্থান এবং বিরাট মর্যাদা রাখে। তার কবরের উপর একটি গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছে। সাইফুদ দৌলা ও নাসিরুদ দৌলার চাচাত ভাই আবু আব্দুল্লাহ সাঈদ বিন হামাদান এটির সংস্কার কাজ শুরুকরেন ৩৩৬ হিজরির শা বান মাসে। সেখানে মাযার নির্মাণ নিয়ে শিয়া ও সুন্নিদের মাঝে সংঘর্ষ হয়। শেইখ কাশশি বর্ণনা করেন যে , তিনি (আমর) ইমাম আলী (আ.) এর শিষ্যদের একজন ছিলেন এবং যারা তার দিকে রুজু করতো তাদের মধ্যে ছিলেন প্রথম।

ইখতিসাস বইতে ইমাম আলী (আ.) এর ঘনিষ্ঠ সাথীদেরকে গণনা করা হয়েছে। জাফর বিন হোসেইন বর্ণনা করেন মুহাম্মাদ বিন জাফর মুয়াদ্দাব থেকে যে , তিনি বলেছেন , রাসূল (সা.) এর সাহাবীদের মাঝ থেকে ইমাম আলী (আ.) এর চারটি স্তম্ভ ছিলো , যারা হলেন- সালমান , মিকদাদ , আবুযার এবং আম্মার। তাবেঈনদের মাঝে ওয়াইস বিন আনীস ক্বারানী (যিনি কিয়ামতের দিন রাবি ’ আ ওযামর গোত্রের সমান সংখ্যক লোকের জন্য সুপারিশ করবেন) এবং আমর বিন হুমাক্ব। জাফর বিন হোসেইন বলেন যে , আমর বিন হুমাক্ব ইমাম আলী (আ.) এর কাছে ঐ মর্যাদা রাখতেন যেমন সালমান রাখতেন রাসূল (সা.) এর কাছে। এরপর আছে রুশাইদ আল হাজারি , মেইসাম আত-তাম্মার , কুমাইল বিন যিয়াদ নাখা ঈ , ইমাম আলী (আ.) এর মুক্ত দাস ক্বামবার , মুহাম্মাদ বিন আবু বকর , ইমাম আলী (আ.) এর মুক্ত দাস মুযরে এবং আব্দুল্লাহ বিন ইয়াহইয়া , যার সম্পর্কে জামালের দিন ইমাম বলেছিলেন ,

হে ইয়াহইয়ার সন্তান , আমি সুসংবাদ দিচ্ছি যে তুমি এবং তোমার বাবা শারতাতুল খামীস-এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তোমাদেরকে আরশে নির্বাচন করেছেন। ”

এরপর আছে , জানাদ বিন যুহাইর আমিরি এবং আমিরের সব সন্তান ইমাম আলী (আ.) এর শিয়া ছিলো , হাবীব বিন মুযাহির আসাদি , আল হারস বিন আব্দুল্লাহ আ ওয়ার হামাদানি , মালিক বিন হুরেইস আশতার , আলাম আযদি , আবু আব্দুল্লাহ জাদালি , জুয়েইরাহ বিন মুসাহহির আবাদি।

একই বইয়ে বর্ণিত আছে যে , আমর বিন হুমাক্ব ইমাম আলী (আ.) কে বলেছিলেন যে , আমি আপনার কাছে সম্পদের বা এ পৃথিবীর সম্মানের খোঁজে আসি নি কিন্তু আমি আপনার কাছে এসেছি যেহেতু আপনি নবীর চাচাতো ভাই এবং সব মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং নারী জাতির সর্দার ফাতিমা (আ.) এর স্বামী এবং নবীর চিরঞ্জীব বংশধরের পিতা এবং মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে আপনার অবদানই সবচেয়ে বেশী। আল্লাহর শপথ , যদি আপনি আমাকে আদেশ করেন পর্বতগুলোকে তাদের জায়গা থেকে সরিয়ে দিতে এবং সমুদ্রের গভীর থেকে পানি তুলে আনতে আমি আপনার আদেশ মেনে চলবো যতক্ষণ না আমার মৃত্যু হয়। আমি সব সময় আপনার শত্রুদের আঘাত করবো আমার হাতের তরবারি দিয়ে এবং আপনার বন্ধুদের সাহায্য করবো এবং আল্লাহ যেন আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন এবং আপনাকে বিজয় দান করেন। এরপরও আমি বিশ্বাস করি না যে , আমি তা সম্পন্ন করতে পেরেছি যা আপনার প্রাপ্য। ” ইমাম আলী (আ.) তার জন্য দোআ করলেন ,

হে আল্লাহ , তার অন্তরকে আলোকিত করুন এবং তাকে সঠিক পথ দেখান। আমার ইচ্ছা হয় তোমার মত যদি একশ ’ জন আমার শিয়াদের মধ্যে থাকতো। ”

একই বইতে আছে ইসলামের শুরুতে আমর বিন হুমাক্ব ছিলেন তার গোত্রের একজন উট রক্ষক। তার গোত্র রাসূল (সা.) এর সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলো। একবার নবী (সা.) এর কিছু সাহাবী তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করলো যাদেরকে নবী পাঠিয়েছিলেন ধর্ম প্রচার করতে। তারা নবীকে বলেছিলেন যে তাদের কাছে ভ্রমণের রসদ ছিলো না এবং তারা পথও চিনতো না। নবী (সা.) বললেন ,

পথে তোমরা একজন সুঠাম সুন্দর পুরুষের সাক্ষাৎ পাবে যে তোমাদের খাওয়াবে। তোমাদের পানির পিপাসা মেটাবে এবং পথ দেখিয়ে দিবে এবং সে বেহেশতের অধিবাসীদের একজন হবে।

তারা আমরের কাছে পৌঁছালেন , যে তাদেরকে উটের গোশত ও দুধ খাওয়ালেন এবং তিনি নবীর কাছে এলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন , ঐ সময় পর্যন্ত যখন খিলাফত মুয়াবিয়ার কাছে পৌঁছলো (যা ইতোমধ্যেই আলোচিত হয়েছে) ।

এরপর তিনি মসূলের যূও নামে এক জায়গায় লোকজনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে রইলেন। মুয়াবিয়া তাকে লিখলো , আম্মা বা আদ , আল্লাহ যুদ্ধের আগুন নিভিয়ে দিয়েছেন এবং ফাসাদ ঠাণ্ডা করে দিয়েছেন এবং আল্লাহ ধার্মিকদের সফলতা দান করেছেন। তুমি তোমার বন্ধুদের চাইতে কম দূরে নও বা কম অপরাধীও নও। তারা আমার আদেশের সামনে মাথা নত করে দিয়েছে এবং আমাকে দায়িত্ব পালনে সাহায্য করতে দ্রুত এগিয়ে এসেছে। কিন্তু এখনও তুমি নিজেকে সরিয়ে রেখেছো ; তাই আমার কাজে সাহায্য করতে আসো যেন তোমার পিছনের গুনাহগুলো এর মাধ্যমে ক্ষমা করে দেয়া হয়। সম্ভবত আমি আমার পূর্বসূরীদের মত খারাপ নই। যদি তুমি আত্মসম্মানবোধ রাখো ও রোযাদার , অনুগত এবং ভালো ব্যবহারের লোক হও তাহলে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের নিরাপত্তায় আমার কাছে আশ্রয় নাও। তোমার হৃদয়কে হিংসা থেকে এবং তোমার নফসকে ঘৃণা থেকে পরিষ্কার করো এবং আল্লাহ সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট। ”

আমর মুয়াবিয়ার কাছে যেতে অস্বীকার করলেন , তাই সে কিছু লোককে পাঠালো যারা তাকে হত্যা করলো এবং তার মাথাকে মুয়াবিয়ার কাছে আনলো। তারা তার মাথাকে তার স্ত্রীর কাছে পাঠালো। তিনি তা তার কোলে রেখে বললেন , দীর্ঘদিন তাকে তোমরা আমার কাছ থেকে দূরে রেখেছো এবং এখন তাকে হত্যা করেছো ও তাকে আমার কাছে এনেছো উপহার হিসেবে। কত সদয় না এ উপহার , যা আমার আনন্দ এবং যে নিজেও আমাকে পছন্দ করতো। হে দূত , আমার সংবাদ মুয়াবিয়ার কাছে পৌঁছে দাও এবং তাকে বল যে আল্লাহ অবশ্যই তার রক্তের প্রতিশোধ নিবেন এবং শীঘ্রই তাঁর ক্রোধ ও অভিশাপ আসবে। তুমি একটি গুরুতর অপরাধ করেছো এবং হত্যা করেছো একজন ধার্মিক সাধক ব্যক্তিকে। হে দূত , মুয়াবিয়াকে পৌঁছে দিও আমি যা বলেছি। ” দূত তার সংবাদ মুয়াবিয়ার কাছে পৌঁছে দিলে মুয়াবিয়া মহিলাকে ডাকলো এবং তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো , “ তুমি কি এ শব্দগুলো উচ্চারণ করেছো ? সে উত্তর দিলো , হ্যাঁ , আমি সেগুলো বলেছি এবং না আমি এর জন্য আফসোস করি , আর না আমি এর জন্য দুঃখিত। ” মুয়াবিয়া তাকে বললো তার শহর থেকে চলে যেতে। উত্তরে সে বললো , আমি অবশ্যই তা করবো , কারণ তোমার শহর আমার জন্মস্থান নয় এবং আমি একে কারাগার মনে করি , এবং আমার হৃদয়ে এর কোন স্থান নেই। এখানে অনেক সময় গেছে যে আমি ঘুমাই নি এবং আমার অশ্রুক্রমাগত ঝরেছে। এখানে আমার ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এখানে আমি এমন কিছু পাই নি যা আমার চোখকে আলোকিত করবে। ”

আব্দুল্লাহ বিন আবি সারহ কালবি মুয়াবিয়াকে বললো , হে আমিরুল মুমিনীন , সে এক মুনাফিক্ব মহিলা। তাকে তার স্বামীকে অনুসরণ করতে দিন। ” যখন মহিলা এ কথা শুনলো সে তার দিকে তাকিয়ে বললো , হে ব্যাঙের পেটের ঘা , তুমি কি তাকে হত্যা কর নি যে তোমাকে পোষাক দিয়েছিলো দয়া করে এবং তোমাকে একটি আবা (লম্বা পোষাক) দান করেছিলো ? নিশ্চয়ই তুমি ধর্ম ত্যাগ করেছো এবং নিশ্চয়ই মুনাফিক্ব হলো সে যে অন্যায়ভাবে পিছু ধাওয়া করে এবং আল্লাহর দাস হিসাবে নিজেকে দাবী করে ; আর তার কুফুরীকে আল্লাহ কোরআনে নিন্দা জানিয়েছেন। ” তা শুনে মুয়াবিয়া তার কুলীকে বললো তাকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে। মহিলা বললো , হিন্দের সন্তানের বিষয়ে আশ্চর্য হই , যে তার আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করেছে এবং আমাকে কঠোর ভাষা ব্যবহার করতে বাধা দিয়েছে! আল্লাহর শপথ , আমি আমার ধারালো লোহার মত কঠোর ভাষা দিয়ে তার পেট চিরে ফেলবো , আমি যদি রাশীদের কন্যা আমিনা হয়ে থাকি। ”

আবু আব্দুল্লাহ ইমাম হোসেইন (আ.) মুয়াবিয়াকে চিঠি লিখলেন , তুমি কি রাসূল (সা.) এর সাহাবী আমর বিন হুমাক্বের হত্যাকারী নও , যে ছিলো একজন ধার্মিক মানুষ , যার দেহ চিকন হয়ে গিয়েছিলো ও তার রঙ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিলো অতিরিক্ত ইবাদতের কারণে ? কোন চেহারা নিয়ে তুমি তাকে নিরাপত্তা (-এর অঙ্গীকার) দিয়েছিলে এবং আল্লাহর নামে শপথ করেছিলে ? যদি কোন পাখিকে একই অঙ্গীকার দেয়া হতো তাহলে তা পাহাড় থেকে নেমে তোমার কোলে আসতো। আর তুমি আল্লাহর মুখোমুখি হয়েছো এবং অঙ্গীকারকে তুচ্ছ মনে করেছো ?

ইমাম হোসেইন (আ.) এর প্রতি কুফাবাসীদের চিঠি

আল্লাহর নামে যিনি সর্বদয়ালু , সর্বকরুণাময়। হোসেইন বিন আলীর (আ.) প্রতি , সুলাইমান বিন সুরাদ , মুসাইয়াব বিন নাজাবাহ , রুফা আ বিন শাদ্দাদ , হাবীব বিন মুযাহের এবং কুফা শহরের অধিবাসীদের মধ্যে থেকে অনুসারী , বিশ্বাসী ও মুসলমানদের পক্ষ থেকে। আপনার উপর শান্তিবর্ষিত হোক , আমরা আপনার আগে আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ করছি যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। আম্মা বা আদ , প্রশংসা আল্লাহর যিনি আপনার একগুঁয়ে শত্রুকে ধ্বংস করেছেন। যে (মুয়াবিয়া) ইসলামী জাতির ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো এবং তাদের বিষয়গুলোকে ছিনিয়ে নিজের হাতে নিয়েছিলো এবং তাদের গণিমত কেড়ে নিয়েছিলো এবং এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিলো তাদের সম্মতি ছাড়াই। সে ধার্মিকদের হত্যা করেছে এবং খারাপদের বাঁচিয়ে রেখেছিলো এবং সে আল্লাহর সম্পদকে অত্যাচারী ও ধনীদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলো। এ জন্য তাকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে যেভাবে সামূদ জাতিকে ধ্বংস করা হয়েছিলো এবং আমাদের এখন কোন ইমাম নেই (আপনি ছাড়া) । আমরা আপনাকে অনুরোধ করি আমাদের কাছে আসার জন্য যেন আল্লাহ আমাদেরকে সত্যের উপর একতাবদ্ধ করেন। নোমান বিন বাশীর এখন প্রাসাদে একা উপস্থিত , কিন্তু আমরা তার সাথে শুক্রবার দিন (জুম আর নামাযে) একত্র হই না। না আমরা ঈদের দিনও তার কাছে যাই। যদি আমরা জানতে পারি আপনি রওনা করেছেন আমাদের কাছে আসার জন্য আমরা তাকে এখান থেকে বের করে দিবো এবং তার পিছু ধাওয়া করে সিরিয়া পর্যন্ত নিয়ে যাবো , ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর শান্তিও রহমত আপনার ওপরে বর্ষিত হোক।

তারা এ চিঠি দিলো উবায়দুল্লাহ বিন মুসমে হামাদানি এবং আব্দুল্লাহ বিন ওয়াল তাইমিকে এবং তাদেরকে দ্রুত যেতে বললো। তারা দ্রুত গেলো যতক্ষণ না তারা দশই রমযান মক্কাতে পৌঁছালো। এরপর কুফার লোকেরা দুদিন অপেক্ষা করলো এবং ক্বায়েস বিন মুসাহ্হার সাইদাউই এবং আব্দুর রাহমান বিন আব্দুল্লাহ বিন শাদ্দাদ আরহাবি এবং আম্মারাহ বিন আব্দুল্লাহ সালুলিকে আবার পাঠালো একশত পঞ্চাশটি চিঠি দিয়ে যা এক , দুই , তিন অথবা চারজন লিখেছিলো।

এরপর আবার দুদিন পর তারা হানি বিন হানি সাবেঈ এবং সাঈদ বিন আব্দুল্লাহ হানাফিকে দিয়ে একটি চিঠি পাঠালো যার বিষয়বস্তু ছিলো এ রকম:

আল্লাহর নামে যিনি সর্ব দয়ালু , সর্ব করুণাময়। হোসেইন বিন আলী (আ.) এর প্রতি তার অনুসারীদের , বিশ্বাসীদের এবং মুসলমানদের পক্ষ থেকে। আম্মা বা আদ , লোকজন আপনার জন্য অপেক্ষা করছে এবং আর কোন মত পোষণ করবেন না , তাই দ্রুত আসুন , দ্রুত আসুন। আপনার উপর শান্তিবর্ষিত হোক। ”

আরেকটি চিঠি লিখেছিলো শাবাস বিন রাব ঈ , হাজ্জার বিন আবজার আজালি , ইয়াযীদ বিন হুরেইস বিন রুয়েইম শাইবানি , উরওয়া বিন ক্বায়েস আহমাসি , আমর বিন হাজ্জাজ যুবাইদি এবং মুহাম্মাদ বিন আমর তামিমি , যার বিষয় ছিলো এরকম:

আম্মা বা আদ , বাগানগুলো সবুজ রং ধারণ করেছে এবং ফলগুলো পেকেছে। যদি আপনি চান , এখানে আসতে পারেন , সেনাদল আপনাকে রক্ষায় প্রস্তুত। ”

যখন এ পত্রবাহকরা সবাই একত্র হলো , ইমাম চিঠিগুলো পড়লেন এবং তাদের কাছে জনগণ সম্পর্কে জানতে চাইলেন।

সাইয়েদ ইবনে তাউস বলেন , ইমাম হোসেইন (আ.) উঠে দাঁড়ালেন এবং রুকন ও মাক্বামের মাঝখানে নামায পড়লেন এবং আল্লাহর কাছে কল্যাণ ভিক্ষা চাইলেন। এরপর তিনি মুসলিম বিন আকীল ¡বিন আবি তালিবকে ডাকলেন এবং তা কে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানালেন এবং জবাবে কুফার লোকদের কাছে একটি চিঠি লিখলেন।

শেইখ মুফীদ বলেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.) নিচের উত্তরটি পাঠান হানি বিন হানি সাবেঈ ও সাঈদ বিন আব্দুল্লাহ হানাফির মাধ্যমে , যারা ছিলো (কুফা থেকে আসা) শেষ পত্রবাহক।

আল্লাহর নামে যিনি সর্ব দয়ালু , সর্ব করুণাময় , হোসেইন বিন আলী থেকে মুসলমান ও বিশ্বাসীদের মাঝে মর্যাদাসম্পন্ন লোকদের কাছে। আম্মা বা আদ , হানি এবং সাঈদ তোমাদের চিঠিগুলো আমার কাছে নিয়ে এসেছে , তারা তোমাদের শেষ পত্রবাহক। আমি তাদের মাধ্যমে তোমাদের মতামত বুঝেছি এবং তোমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে আমাদের উপর কোন ইমাম নেই। আপনি আমাদের দিকে আসুন , সম্ভবত আল্লাহ আপনার মাধ্যমে আমাদেরকে সত্য ও সৎকর্মশীলতায় একত্রিত করবেন। ’ আমি আমার চাচাত ভাই , আমার ভাই এবং পরিবারের একজন বিশ্বস্তলোক মুসলিম বিন আক্বীলকে তোমাদের কাছে পাঠাচ্ছি। আমি তাকে দিক নির্দেশনা দিয়েছি তোমাদের বিষয়ে খোঁজ নেয়ার জন্য এবং এ বিষয়ে আমাকে লেখার জন্য এবং যদি সে লিখে যে তোমাদের প্রবীণরা , বিজ্ঞরা এবং জ্ঞানী ব্যক্তিরা একই অভিমত পোষণ করে যেভাবে তোমাদের পত্রবাহকরা আমাকে জানিয়েছে এবং যেভাবে তোমাদের চিঠিতে লেখা আছে , তখন আমি তোমাদের কাছে দ্রুত আসবো ইনশাআল্লাহ। আমি আমার জীবনের ক্বসম দিয়ে বলছি যে , কোন ব্যক্তি ইমাম ও পথপ্রদর্শক নয় সে ব্যক্তি ছাড়া যে আল্লাহর কিতাব দিয়ে ফায়সালা করে , ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে এবং সত্য ধর্ম প্রচার করে এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। সালাম। ”

এরপর ইমাম হোসেইন (আ.) মুসলিম বিন আক্বীল বিন আবি তালিব (আ.) কে ডাকলেন এবং তাকে ক্বায়েস বিন মুসাহ্হার সাইদাউই , আম্মারা বিন আব্দুল্লাহ আরজী এবং আব্দুর রাহমান এবং আব্দুল্লাহ বিন শাদ্দাদ আরহাবির সাথে কুফায় পাঠালেন। তিনি তাদেরকে আদেশ করলেন আল্লাহকে ভয় করার জন্য এবং তাদের উদ্দেশ্য গোপন রাখার জন্য , এছাড়া তাদেরকে দয়াপূর্ণ উপদেশ দিলেন এবং বললেন যদি তারা জনগণকে দৃঢ় ও শক্তিশালী হিসেবে দেখতে পায় তাহলে যেন তারা তাকে দ্রুত জানায়।

পরিচ্ছেদ - ৫

মাসউদীর বর্ণনা অনুযায়ী মুসলিম বিন আক্বীলের মধ্য রমযানে মক্কা ত্যাগ

[ ইরশাদ ’ গ্রন্থে] মাসউদীর বর্ণনা অনুযায়ী , মুসলিম বিন আক্বীল মদীনা পৌঁছালেন এবং মসজিদে নববীতে নামায পড়লেন এবং পরিবারকে বিদায় জানালেন। তিনি বনি ক্বায়েস থেকে দুজন লোককে পথ প্রদর্শক হিসেবে সাথে নিলেন এবং রওনা দিলেন। তারা একটি ভুল রাস্তা ধরলেন এবং পথ হারিয়ে ফেললেন। তারা তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লেন এবং আর হাঁটতে পারছিলেন না। যে দুব্যক্তি মুসলিমের সাথে এসেছিলো তারা পানির অভাবে মারা গেলো কিন্তু মৃত্যুর আগে তারা মুসলিমকে পথের নিশানা বলে দিলো। মুসলিম আরও এগিয়ে গেলেন এবং মাযীক্ব নামে সুপরিচিত বিশ্রাম স্থলে থামলেন এবং ক্বায়েস বিন মুশীর সাইদাউইকে একটি চিঠি দিয়ে ইমাম হোসেইন (আ.) এর কাছে পাঠালেন , যা ছিলো এরকম:

আম্মা বা আদ , আমি মদীনা ছেড়ে এসেছিলাম দুজন পথ প্রদর্শকের সাথে , কিন্তু আমরা পথ হারিয়ে ফেলি এবং ভীষণ তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ি এবং ঐ দুজন সহযোগী এ কারণে মৃত্যুবরণ করে। আমরা আরও এগিয়ে গেলাম পানি পাওয়া পর্যন্ত এবং এভাবে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারলাম এবং এ জায়গাটি বাতনে জান্নাতে মাযীক্ব হিসেবে পরিচিত। আমি এ ঘটনাকে একটি অকল্যাণের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছি , যদি আপনি মনে করেন তা যথাযথ হবে তাহলে আমাকে অবসর দিন এবং অন্য কাউকে পাঠান এ কাজে , সালাম। ”

ইমাম হোসেইন (আ.) উত্তরে লিখলেন ,

আম্মা বা আদ , আমি আশঙ্কা করছি যে , যে দায়িত্ব দিয়ে তোমাকে পাঠিয়েছি তা থেকে তোমার মুক্তি চাওয়ার কারণ হচ্ছে ভয়। অতএব যে কারণে তোমাকে পাঠিয়েছি সেদিকে তুমি এগিয়ে যাও। সালাম। ”

যখন মুসলিম চিঠিটি পড়লেন , তিনি বললেন যে তিনি নিজের জন্য কোন কিছুকে ভয় করছেন না এবং আরও এগিয়ে গেলেন। তিনি একটি পানির জায়গায় পৌঁছালেন যা ছিলো বনি তাঈ গোত্রের। তিনি সেখানে ঘোড়া থেকে নামলেন এবং এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ মুসলিম দেখলেন একজন শিকারী একটি বড় হরিণের দিকে তীর ছুঁড়লো এবং তাকে হত্যা করলো। মুসলিম বললেন , আল্লাহ চাইলে আমরাও আমাদের শত্রুদের এভাবে হত্যা করবো ” । এরপর আরও এগিয়ে গেলেন।

মুরুজুয যাহাব ’ -এ এভাবে লেখা আছে যে , মুসলিম কুফাতে প্রবেশ করলেন শাওয়াল মাসের পাঁচ তারিখে। তাবারির বর্ণনা অনুযায়ী তিনি মুখতার বিন আবি উবাইদার বাসায় ছিলেন এবং শিয়ারা তার সাথে সাক্ষাৎ করতে এলো। যখন একদল জমা হলো তিনি ইমাম হোসেইন (আ.) এর চিঠিটি তাদেরকে পড়ে শোনালেন , তারা তা শুনে কাঁদতে শুরু করলো । তখন আবিস বিন আবি শাবীব শাকিরি উঠে দাঁড়ালেন এবং আল্লাহর হামদ ও তাসবীহ করে বললেন ,

আম্মা বা আদ , আমি জনগণের পক্ষ থেকে বলছি না , না আমি খবর রাখি কী তাদের অন্তরে আছে এবং এভাবে আমি আপনাকে ধোঁকা দিতে চাই না। আল্লাহর শপথ , আমি শুধু তাই বলছি যা আমার অন্তরে রয়েছে। আল্লাহর শপথ , আমি আপনার ডাকে সাড়া দিবো যখনই আপনি ডাক দিবেন এবং আপনাদের পাশে থেকে আপনাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো এবং আপনার উপস্থিতিতে আমি তাদেরকে তরবারি দিয়ে আঘাত করবো যতক্ষণ না আমি আল্লাহর সাক্ষাতে মিলিত হই ; আর আমি (এর বদলে) আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া আর কিছু চাই না। ”

এরপর হাবীব বিন মুযাহির ফাক্বা ’ সি উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন , আল্লাহর রহমত হোক তোমার ওপরে , তুমি সংক্ষেপে তাই প্রকাশ করেছো যা তোমার মনে ছিলো। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি , যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই , আমি এ লোকটির (আবিসের) বিশ্বাসের মতই বিশ্বাস রাখি ” এবং তিনি আবিস যা বলেছিলেন তাই বললেন।

হাজ্জাজ বিন আলী বলেন যে আমি মুহাম্মাদ বিন বিশরকে জিজ্ঞেস করলাম , আপনি কি তাকে (মুসলিমকে) কোন উত্তর দেন নি ? তিনি বললেন , আমি চেয়েছি আল্লাহ আমার বন্ধুদের সফলতা ও সম্মান দান করুন , কিন্তু আমি নিহত হতে চাই নি এবং না আমি মিথ্যা বলতে চেয়েছি। ”

[ ইরশাদ ’ গ্রন্থে আছে] আঠারো হাজার লোক মুসলিমের কাছে আনুগত্যের শপথ করলো। তাই তিনি ইমাম হোসেইন (আ.) কে তাদের শপথের কথা জানালেন এবং তাকেফকা আসতে আমন্ত্রণ জানালেন। মুসলিম এ চিঠিটি লিখেছিলেন তার শাহাদাত বরণের সাতাশ দিন আগে। শিয়ারা (অনুসারীরা) ঘন ঘন মুসলিমের সাথে সাক্ষাৎ করতে লাগলো এবং মুসলিমের অবস্থান জানাজানি হয়ে গেলো।

নোমান বিন বাশীর কুফার জনগণকে সতর্ক করে দিলো

এ খবর নোমান বিন বাশীরের কাছে পৌঁছে গেলো , যাকে মুয়াবিয়া কুফার গভর্নর করেছিলো , এবং ইয়াযীদও তাকে তার পদে রেখে দিয়েছিলো। সে মিম্বরে উঠলো এবং আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহর পর বললো ,

আম্মা বা আদ , হে আল্লাহর বান্দাহরা , আল্লাহকে ভয় করো এবং ফাসাদ ও বিভেদ ছড়ানোর উদ্দেশ্যে তাড়াহুড়ো করো না। কারণ তার পরিণতি হবে মানুষের হত্যা , রক্ত ঝরানো ও সম্পদ দখল হওয়া। আমি তার সাথে যুদ্ধ করি না যে আমার মুখোমুখি হয় না , না আমি তার দিকে অগ্রসর হই যে আমার দিকে অগ্রসর হয় না। আমি তোমাদের সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করি না , না আমি কাউকে হিসাব দিতে বলি শুধুমাত্র সন্দেহ ও অভিযোগের কারণে। কিন্তু যদি তোমরা আমার দিক থেকে চেহারা ঘুরিয়ে নাও এবং আনুগত্যের শপথ ভঙ্গ করো অথবা তোমাদের ইমামের বিরোধিতা করার চেষ্টা করো তাহলে আল্লাহর শপথ , যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই , সেক্ষেত্রে আমি আমার তরবারি দিয়ে আঘাত করতে থাকবো যতক্ষণ এর হাতল আমার হাতে থাকবে। এমনও যদি হয় তোমাদের মাঝে আমার কোন সমর্থক আর না থাকে। তারপরও আমি আশা করি যে , তোমাদের মধ্যে যারা সত্য জানে তাদের সংখ্যা বেশী , তাদের চাইতে , যাদেরকে মিথ্যা (শেষ পর্যন্ত) ধ্বংস করে দিবে। ”

আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম বিন রাবি আ হাযরামি , যে বনি উমাইয়ার একজন মিত্র ছিলো , সে উঠে দাঁড়ালো এবং বললো , এ ফাসাদ যা আপনি এখন দেখছেন তা শক্তি প্রয়োগ ছাড়া থামবে না এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে আপনার এ মনোভাব দুর্বলদের মনোভাব। ” নোমান বললো , আমি যদি দুর্বল থাকি এবং আল্লাহকে মেনে চলি তাহলে তা আমি পছন্দ করি তার চাইতে বেশী যখন আমি শক্তিশালী থাকবো অথচ আল্লাহর অবাধ্য হব। ” এ কথা বলে সে মিম্বর থেকে নেমে চলে গেলো। আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম বেরিয়ে আসলো এবং এরপর একটি চিঠি লিখলো ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়াকে এ বলে যে , মুসলিম বিন আক্বীল কুফাতে এসেছে এবং শিয়ারা হোসেইন বিন আলীর প্রতি আনুগত্যের শপথ করেছে। যদি আপনি চান কুফা আপনার রাজত্বের অধীনে থাকুক তাহলে একজন শক্তিশালী লোককে পাঠান যে আপনার আদেশ বাস্তবায়িত করবে এবং আপনার আদেশ অনুযায়ী কাজ করবে। কারণ নোমান বিন বাশীর একজন দুর্বল লোক অথবা ইচ্ছা করে দেখাচ্ছে সে দুর্বল। ”

আম্মারাহ বিন উক্ববাহ এবং উমর বিন সা আদ বিন আবি ওয়াক্কাস একই ধরনের চিঠি লিখলো ইয়াযীদের কাছে। যখন এ চিঠিগুলো ইয়াযীদের কাছে গেলো সে সারজুনকে ডাকলো , যে মুয়াবিয়ার কৃতদাস ছিলো এবং বললো , হোসেইন মুসলিম বিন আক্বীলকে কুফাতে পাঠিয়েছে এবং জনগণ তার কাছে আনুগত্যের শপথ নিতে শুরু করেছে। আর নোমান হচ্ছে দুর্বল লোক এবং তার সম্পর্কে অন্যান্য খারাপ অভিযোগ আছে। তোমার অভিমত অনুযায়ী তার বদলে কাকে আমি কুফার গভর্নর করবো ? সে সময়ে ইয়াযীদ উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলো। সারজুন বললো , যদি মুয়াবিয়া আজ জীবিত হয়ে যেতেন আপনি কি তার পরামর্শ শুনতেন ? ইয়াযীদ হ্যাঁ-বোধক উত্তর দিলো। সারজুন মুয়াবিয়ার একটি চিঠি বের করলো যাতে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদকে কুফার গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো , এরপর বললো , এটি হচ্ছে মুয়াবিয়ার উপদেশ। কারণ যখন তিনি প্রায় মৃত্যুর মুখে তিনি চেয়েছিলেন কুফা ও বসরা উভয়ের গভর্নর পদটি উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে দিতে। ” ইয়াযীদ একমত হলো এবং উবায়দুল্লাহর কাছে খবর পাঠালো। এরপর সে কুতাইবাহর পিতা মুসলিম বিন আমর বাহিলীকে ডাকলো এবং উবায়দুল্লাহর নামে একটি চিঠি হস্তান্তর করলো , যার বিষয়বস্তু ছিলো এরকম: আম্মা বা আদ , কুফাতে আমার অনুসারীরা লিখেছে যে আক্বীলের সন্তান সৈন্যদল জোগাড় করছে মুসলমানদের ভিতরে বিদ্রোহ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। তাই যখন তুমি আমার চিঠি পড়বে কুফাতে দ্রুত চলে যাবে এবং আক্বীলের সন্তানকে খুঁজবে , যেন তুমি একটি পুঁতি খুজছো , যতক্ষণ না তাকে খুঁজে পাও। এরপর তাকে বাধো (শিকলে) , হয় তাকে হত্যা করো অথবা শহর থেকে বহিষ্কার করো। সালাম। ” ইয়াযীদ তাকে কুফার শাসনকর্তার পদটিও দিল। মুসলিম বিন আমর রওনা হলো এবং বসরায় উবায়দুল্লাহর কাছে পৌঁছালো। আদেশ ও ক্ষমতার অনুমোদন পাওয়ার সাথে সাথে উবায়দুল্লাহ পর দিন যাত্রা শুরুর আদেশ দিলো।

নোমান বিন বাশীরের ব্যক্তিত্বের ওপরে একটি বর্ণনা

নোমান বিন বাশীর সম্পর্কে এখানে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যথাযথ হবে। তার নাম ছিলো নোমান বিন বাশীর বিন সা আদ বিন নসর বিন সা লাবাহ খাযরাজি আনসারি। তার মা ছিলো উমরাহ বিনতে রুয়াহাহ , যে ছিলো আব্দুল্লাহ বিন রুয়াহাহ আনসারির বোন , যিনি শহীদ হয়েছিলেন জাফর বিন আবু তালিব (আ.) এর সাথে মুতাহর যুদ্ধে। বলা হয় যে নোমান ছিলো আনসার (মদীনার সাহায্যকারী)-দের মাঝে প্রথম জন্মগ্রহণকারী সন্তান , মদীনায় নবী (সা.) প্রবেশ করার পর , ঠিক যেভাবে আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর ছিলো মুহাজিরদের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী প্রথম সন্তান , মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রবেশের পর। তার বাবা বাশীর বিন সা আদ ছিলো প্রথম ব্যক্তি যে সাক্বিফাতে আবু বকরের কাছে প্রথম আনুগত্যের শপথ করে এবং এভাবে আনসাররা তা অনুসরণ করে। আইনুত তামার ’ -এর যুদ্ধে বাশীর এবং খালেদ বিন ওয়ালিদ নিহত হয়। নোমান ছিলো কবিদের পরিবারের একজন এবং খলিফা উসমানের অনুসারী। সে কুফাবাসীদের ঘৃণা করতো যেহেতু তারা ইমাম আলী (আ.) কে ভালোবাসতো। সে ছিলো একমাত্র আনসার যে সিফফীনের যুদ্ধে মুয়াবিয়ার সাথে ছিলো। সে মুয়াবিয়ার দৃষ্টিতে ছিলো সম্মানিত ও মর্যাদাবান। তাই ইয়াযীদ তাকে পছন্দ করতো।

নোমান জীবিত ছিলো মারওয়ান বিন হাকামের খিলাফত পর্যন্ত এবং হামাসের গভর্নর ছিলো। যখন জনগণ মারওয়ানের প্রতি আনুগত্যের শপথ করা শুরু করলো সে লোকজনকে আব্দুল্লাহ বিন যুবাইরের দিকে আহ্বান করলো এবং মারওয়ানের বিরোধিতা করলো এবং এ ঘটনা ঘটলো যখন যাহহাক ইবনে ক্বাইসকে মারজে রুহিতে হত্যা করা হয়েছিলো কিন্তু হামাসের লোকেরা তার ডাকে কান দেয় নি , তাই সে সেখান থেকে পালিয়ে গেলো এবং তারা তাকে পিছু ধাওয়া করলো এবং তাকে খুঁজে পেয়ে হত্যা করলো। ৬৫ হিজরিতে এ ঘটনা ঘটেছিলো।

ইয়াযীদ তাকে দুর্বল ও কুৎসা রটনাকারী বলার কারণ হলো , ইবনে কুতাইবাহ দীনাওয়ারি তার বই আল ইমামাহ ও সিয়াসাহতে বলেছেন যে নোমান বিন বাশীর বলেছিলো যে , নবীর নাতি আমার কাছে বাহদুলের নাতির চাইতে প্রিয়। ” বাহদুলের নাতি আর কেউ ছিলো না ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়া ছাড়া , যার মা মায়সুন ছিলো বাহদুল কালবিয়াহর কন্যা। ইবনে কুতাইবাহ হলেন আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম বিন কুতাইবাহ বিন মুসলিম বিন আমর বাহিলী এবং এ মুসলিম বিন আমর হলেন সেই একই ব্যক্তি যাকে ইয়াযীদ উবায়দুল্লাহর কাছে পাঠিয়েছিলো কুফার গভর্নর নিয়োগ করে।

পরিচ্ছেদ - ৬


7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35