পরিচ্ছেদ - ১২
আল হুর বিন ইয়াযীদ আর-রিয়াহির কাছে সংবাদ , ইমাম হোসেইন (আ.) এর সাথে তার সাক্ষাত এবং তাকে কুফায় যেতে বাধা দেয়া
[‘
ইরশাদ’
, তাবারির গ্রন্থে আছে] এরপর ইমাম হোসেইন (আ.) শারাফ থেকে আরও সামনে এগিয়ে গেলেন দুপুরের পর পর্যন্ত। যখন তারা পথ চলছিলেন তার একজন সাথী উচ্চকণ্ঠে বললেন ,“
আল্লাহু আকবার।”
ইমাম হোসেইন (আ.) তার পুনরাবৃত্তি করলেন এবং তাকে তাকবীর দেয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন , তিনি খেজুর গাছ দেখছেন। তার একদল সাথী বললেন ,“
আল্লাহর শপথ , আমরা এ এলাকায় কখনোই খেজুর গাছ দেখি নি।”
ইমাম তখন তাদের জিজ্ঞেস করলেন তারা কী মনে করছে। এতে তারা বললো ,“
আমাদের অভিমত হলো ওগুলো ঘোড়ার কান।”
ইমাম বললেন ,“
আল্লাহর শপথ , আমিও তা দেখছি।”
এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন ,“
এখানে কি কোন আশ্রয় নেবার জায়গা আছে , যেন আমরা সেদিকে পিঠ রাখি এবং সামনের দিকে তাদের মুখোমুখি হই।”
তারা বললো ,“
জ্বী , যু হুসাম নামে একটি পাহাড় আছে আপনার পাশে , আমরা যদি দ্রুত বাম দিকে যাই তাহলে সেখানে তাদের আগে পৌঁছাবো এবং আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ হবে।”
ইমাম বাম দিকে ঘুরলেন এবং তারাও পিছু পিছু ঘুরলো। কিছু সময় পরে ঘোড়াগুলোর মাথা ও ঘাড় দৃশ্যমান হলো এবং তারা নিশ্চিত হলেন। ইমাম ও তার সাথীরা তাদের দিক বদলালেন এবং তারা তা দেখে ফেললো এবং তাদের দিকে দ্রুত এগোল। তাদের বর্ষা , তরবারিগুলোর তীক্ষ্ণ মাথা মৌমাছির চাকের মত ছিলো এবং তাদের পতাকাগুলো পাখির ডানার মত উড়ছিলো। ইমাম য হুসামের দিকে দ্রুত এগোলেন এবং তাদের আগে পৌঁছালেন। এরপর ইমাম সেখানে তাঁবু গাড়তে আদেশ দিলেন। প্রায় এক হাজার ঘোড়সওয়ারী আল হুর বিন ইয়াযীদ তামিমির অধীনে ইমাম ও তার সাথীদের সামনা সামনি এসে পৌঁছলো।
ইমাম ও তার সাথীরা মাথায় পাগড়ী পড়েছিলেন এবং তাদের তরবারি খাপমুক্ত করলেন ইমাম তখন তার সাথীদের বললেন ,“
তাদেরকে পানি দাও এবং তাদের ঘোড়াগুলোকেও।”
তারা বাটি ও পেয়ালা পানিতে ভরে ঘোড়াগুলোকে পান করতে দিলেন। যখন প্রত্যেকটি ঘোড়া তিন থেকে চার বার পানি পান করলো , এরপর তারা তা সরিয়ে নিয়ে অন্যটিকে দিলেন। তারা এমন করলেন যতক্ষণ না সবকটিকেই পান করালেন।
আলী বিন তা’
আন মুহারাবি বলেন যে , সেদিন আমি আল হুরের সাথে ছিলাম এবং সেখানে পৌঁছেছিলাম সবার শেষে। যখন ইমাম হোসেইন (আ.) আমার ও আমার ঘোড়ার পিপাসা দেখলেন তখন বললেন ,“
তোমার রাওইয়াহকে বসাও।”
আমি ভাবলাম তিনি পানির মশকের কথা বলছেন। যখন ইমাম বুঝতে পারলেন আমি বুঝি নি , তখন বললেন ,“
ঘোড়াকে বসাও।”
যখন আমি তা করলাম তিনি আমাকে পান করতে বললেন । আমি পানি পান করতে চাইলাম কিন্তু পানি মশক থেকে পড়ে গেলো। তখন ইমাম আমাকে বললেন ,“
তোমার মশক বাঁকা করো।”
আমি বুঝতে পারলাম না কী করবো , তখন ইমাম নিজে উঠলেন এবং মশক উঁচু করলেন এবং আমি তা থেকে পান করলাম এবং আমার ঘোড়াকেও পান করতে দিলাম।
আল হুর কাদিসিয়া থেকে এসেছিলো , যেখানে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ হাসীন বিন নামীরকে পাহারায় রেখেছিলো। এরপর সে আল হুর বিন ইয়াযীদকে এক হাজার সৈন্য দিয়ে ইমাম হোসেইন (আ.) এর দিকে পাঠায়। আল হুর ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইলো যোহরের নামাযের সময় পর্যন্ত। ইমাম (আ.) হাজ্জাজ বিন মাসরুক্বকে আযান দিতে বললেন। [ইরশাদ] ইমাম ইকামতের সময় একটি জামা , একটি আবা ও জুতো পরে বেরিয়ে এলেন। তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ করলেন এবং বললেন ,
“
হে জনতা , আমি তোমাদের কাছে আসি নি যতক্ষণ না তোমাদের চিঠি ও দূতরা আমাকে তোমাদের কাছে আসতে আহ্বান করেছে , কারণ তোমাদের কোন ইমাম ছিলো না এবং তোমরা চেয়েছিলে যে আল্লাহ তোমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করবেন আমার মাধ্যমে সঠিক পথ ও সত্যের দিকে। যদি তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার রক্ষা কর , আমি তোমাদের কাছে এসেছি , তাই অঙ্গীকার স্বীকার করো ও সাক্ষ্য দাও যেন আমি স্বস্তিলাভ করি। তারপর যদি তোমরা একমত না হও এবং আমার আগমনকে অপছন্দ কর তাহলে আমি সেখানে চলে যাবো যেখান থেকে এসেছি।”
তাদের মধ্যে থেকে কেউ উত্তর দিলো না। তখন ইমাম মুয়ায্যিনকে বললেন ইকামত দিতে। যখন মুয়ায্যিন তা করলো ইমাম হোসেইন (আ.) আল হুরের দিকে ফিরলেন এবং বললেন ,“
যদি তুমি চাও , তুমি তোমার সাথীদের সাথে নামায পড়তে পারো।”
আল হুর বললেন ,“
না , বরং আমরা চাই আপনি ইমামতি করবেন এবং আমরা নামায পড়বো।”
তখন ইমাম নামাযের ইমামতি করলেন এবং তারা অনুসরণ করলো। নামাযের পর ইমাম নিজের তাঁবুতে ফিরলেন এবং তার সাথীরা তার চারদিকে জড়ো হলেন। আল হুরও তাঁবুতে গেলো যা তার সাথীরা তার জন্য খাটিয়েছিলো এবং তার একদল সাথী তার চারদিকে বসলো। আর অন্যরা তাদের সারিতে ফিরে গেলো এবং ঘোড়ার লাগামকে টেনে আরও কাছে এনে এর ছায়াতে বসে পড়লো।
যখন আসরের সময় হলো , ইমাম তার সাথীদেরকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে আদেশ দিলেন এবং তারা রাজী হলো। এরপর তিনি মুয়ায্যিনকে আযান ও ইকামত দিতে বললেন। সে তা করলো। ইমামকে আবার নামাযে ইমামতি করার জন্য আহ্বান করা হলো এবং তিনি করলেন। তিনি সালাম পেশ করে তাদের দিকে ফিরলেন। তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ করে বললেন ,“
আম্মা বা’
আদ , হে জনতা , যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রাপ্য অধিকারের স্বীকৃতি দাও তাহলে আল্লাহ তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন। আর আমরা মুহাম্মাদ (সা.) এর আহলুল বাইত এবং আমরা এ বিষয়ে (খিলাফতে) তাদের চাইতে বেশী অধিকার রাখি যারা এর দাবী করে। তারা তোমাদের মাঝে শত্রুতা ও অত্যাচারের বীজ বপন করেছে। যদি তোমরা আমাদের অপছন্দ কর এবং অধিকারকে স্বীকৃতি না দাও এবং যদি আমার কাছে লেখা চিঠিতে যা লিখেছো এবং তোমাদের দূতদের মাধ্যমে আমার কাছে যে সংবাদ পৌঁছেছো তা থেকে তোমাদের অভিমত ভিন্ন হয় তাহলে আমি তোমাদের কাছ থেকে চলে যাবো।”
আল হুর বললেন ,“
আল্লাহর শপথ , আপনি যে চিঠি ও দূতদের কথা বলছেন তা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।”
তখন ইমাম তার একজন সাথীকে ডাক দিলেন এবং বললেন ,“
হে উতবা বিন সামআন , আমার কাছে তাদের চিঠি ভর্তি বস্তা দুটি নিয়ে এসো।”
তিনি বস্তা ভর্তি চিঠি নিয়ে এলেন এবং তাদের সামনে ছড়িয়ে দিলেন। আল হুর বললো ,“
আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত নই যারা আপনাকে চিঠি লিখেছে। আমাদের আদেশ দেয়া হয়েছে যখন আমরা আপনাকে কুজে পাবো তখন আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন না হতে এবং এরপর আপনাকে কুফাতে উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের কাছে নিয়ে যেতে ।”
ইমাম বললেন ,“
নিশ্চয়ই এর চাইতে মৃত্যু তোমার আরও নিকটে।”
এরপর তিনি তার সাথীদেরকে ঘোড়ায় চড়তে বললেন এবং তারা তা করলো। যখন তারা চলে যেতে শুরু করলো আল হুর তাদের পথ আটকালো। ইমাম বললেন ,“
আল হুর , তোমার মা তোমার মৃত্যুতে শোক পালন করুক , তুমি কী করতে চাও ?”
আল হুর বললেন ,“
আমি চাই আপনাকে সেনাপতি উবায়দুল্লাহর কাছে নিয়ে যেতে।”
ইমাম বললেন ,“
আল্লাহর শপথ , আমি তা করবো না।”
আল হুর বললো ,“
আল্লাহর শপথ , আমিও আপনাকে ছাড়বো না।”
তারা তিন বার তা পুনরাবৃত্তি করলেন এবং তাদের সংলাপ উত্তপ্ত হলো। আল হুর বললেন ,“
আমাকে আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আদেশ দেয়া হয় নি। আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে আপনার সাথে থাকার জন্য যতক্ষণ না আমি আপনাকে কুফায় নিয়ে যাই। তাই এখন যখন আপনি কুফায় যেতে অস্বীকার করছেন এমন এক রাস্তা ধরুন যা কুফায় বা মদীনায় যায় না। আর এটি হলো আমাদের দুজনের মধ্যে সন্ধি। এরপর আমি সেনাপতিকে একটি চিঠি লিখবো এবং আপনি ইয়াযীদ অথবা উবায়দুল্লাহর কাছে লিখবেন এবং আল্লাহ যেন সদয় হন। যেন আমি আপনার বিষয়ে জড়িয়ে না যাই।”
ইমাম তার ঘোড়াকে ক্বাদিসিয়া ও উযাইবের দিকে ঘুরালেন এবং আল হুর ও তার সাথীরা তাদের পাশাপাশি বাম দিকে চললো।
আযদি থেকে তাবারি বর্ণনা করেন যে , উক্ববাহ বিন আবু এইযার বর্ণনা করেছে যে: ইমাম হোসেইন (আ.) বাইযাহতে একটি খোতবা দেন তার ও আল হুরের সাথীদের মাঝে। তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ করলেন এবং বললেন ,
“
হে জনতা , রাসূল (সা.) বলেছেন যে , যখন তোমরা দেখবে কোন অত্যাচারী শাসক আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা হালাল করছে এবং তাঁর সাথে চুক্তি ভঙ্গ করছে এবং নবীর সুন্নাহর বিরোধিতা করছে এবং আল্লাহর বান্দাদের সাথে অন্যায় ও জবরদস্তিমূলক আচরণ করছে এবং তখন যদি কোন ব্যক্তি তার কথা ও কাজের মাধ্যমে তার বিরোধিতা না করে তাহলে আল্লাহর উপর তা বাধ্যতামূলক হয়ে যায় ঐ ব্যক্তিকে ঐ অত্যাচারীর মর্যাদা দেয়া। জেনে রাখো এ শাসকদল (বনি উমাইয়ারা) শয়তানের আদেশ মেনে চলছে এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করছে এবং দুর্নীতিকে প্রতিদিনকার নিয়ম বানিয়েছে। তারা অধিকারসমূহকে এক জায়গায় জমা করেছে এবং মুসলমানদের সম্পদের ভাণ্ডারকে তাদের নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছে এবং আল্লাহর হারামকে অনুমতি দিয়েছে এবং তারহালালকে নিষেধ করে দিয়েছে। সব মানুষের চাইতে আমি সবচেয়ে যোগ্য তাদের বিরোধিতা করাতে। তোমরা চিঠি দিয়েছো আমাকে এবং অঙ্গীকার করেছো যে আমাকে আমার শত্রুর কাছে তুলে দেবে না এবং আমাকে পরিত্যাগ করবে না। যদি তোমরা তোমাদের আনুগত্যের শপথে এখনও দৃঢ় থাকো তাহলে তোমরা সত্যপথে আছো। আমি হোসেইন , আলী ও রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কন্যা ফাতিমার সন্তান। আমার জীবন তোমাদের সাথে সম্পৃক্ত এবং আমার পরিবার তোমাদের (পরিবারের) সাথে। তোমাদের উচিত আমার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া এবং তোমরা যদি তা না কর এবং বিশ্বাস ভঙ্গ করে থাকো এবং তোমাদের ঘাড় থেকে আনুগত্যের শপথ তুলে নিয়ে থাকো তাহলে আমি আমার জীবনের শপথ করে বলছি যে , তা তোমাদের কাছ থেকে নতুন কিছু নয়। তোমরা তাই করেছো আমার পিতা , ভাই এবং চাচাতো ভাই মুসলিম (বিন আক্বীল)-এর সাথে , যে তোমাদের ধোঁকার শিকার হয় সে অসহায় হয়ে যায়। তোমরা তোমাদের হাত থেকে তোমাদের অংশ চলে যেতে দিয়েছো এবং তোমাদের সৌভাগ্য উল্টে ফেলেছো। যে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে সে নিজেই ধোঁকার মুখোমুখি হবে এবং খুব শীঘ্রই আল্লাহ আমাকে তোমাদের কাছ থেকে অমুখাপেক্ষী করে দেবেন। তোমাদের উপর আল্লাহর শান্তি , রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।”
[‘
ইরশাদ’
গ্রন্থে আছে] উক্ববাহ বিন আবু এইযার বলেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.) যী হুসামে থামলেন এবং আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ করে বললেন ,“
আম্মা বা’
আদ , তোমরা দেখেছো কী অসততা এসেছে। পৃথিবীর রং বদলেছে এবং অপরিচিত হয়ে গেছে। এর ধার্মিকতা বিদায় নিয়েছে এবং তা ঐ পর্যন্ত চলেছে যে ভালোর শেষটুকু যা আছে তা পানি পান করার পাত্রের তলায় যে পাতলা ময়লার স্তর জমে তার মত। জীবনের মূল্য কমে এসেছে মৃত্যুর চারণভূমির মত। তোমরা কি দেখছো না যে সত্য অনুসরণ করা হচ্ছে না এবং ভুলকে অনুৎসাহিত করা হচ্ছে না ? ন্যায়পরায়ণ বিশ্বাসী হলো সে যে ন্যায়পরায়ণতা আশা করে। আমি নিজে মৃত্যুকে একটি সমৃদ্ধি ভাবি , আর অত্যাচারীদের সাথে বেঁচে থাকাকে ঘৃণ্য ছাড়া কিছু ভাবি না।”
বর্ণনাকারী বলেন যে , যুহাইর বিন ক্বাইন বাজালি উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন ,“
তোমরা কি কিছু বলতে চাও , নাকি আমাকে অনুমতি দিবে এর জন্য ?”
তারা তাকে বলতে বললো। তখন তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ করলেন এবং ইমামকে উত্তর দিলেন ,“
হে আল্লাহর রাসূলের সন্তান , আপনার আল্লাহ আপনার পথ প্রদর্শক হোন! আপনি যা বলেছেন আমরা শুনেছি। আল্লাহর শপথ , যদি এ পৃথিবীর কোন দিন মৃত্যু না হতো এবং এখানে আমাদের জীবন হতো চিরস্থায়ী , আপনার সাথী হওয়া ও সাহায্যকারী হওয়ার পরিণতিতে যদি আমাদের এ পৃথিবী ত্যাগ করতে হতো , তাতেও আমরা রাজী হতাম এ পৃথিবীতে আপনাকে ছাড়া থাকার চাইতে।”
এ কথা শুনে ইমাম তার প্রশংসা করলেন এবং তার জন্য দোআ করলেন।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে নাফে’
বিন হিলাল বাজালি তার জায়গা থেকে উঠলেন এবং বললেন ,“
আল্লাহর শপথ , আমরা আল্লাহর চিরস্থায়ীত্বকে ঘৃণা করি না এবং আমরা আপনার উদ্দেশ্য ও অন্তর্দৃষ্টির উপর দৃঢ় (আস্থায়) আছি। আমরা তার বন্ধু হবো যারা আপনার বন্ধু হবে এবং শত্রু হবো আপনার শত্রুদের প্রতি।”
বুরাইর বিন খুযাইর উঠলেন এবং বললেন ,“
হে আল্লাহর রাসূলের সন্তান , আল্লাহ আপনার মাধ্যমে আমাদের প্রতি সদয় হয়েছেন , আমরা যেন আপনার সামনে থেকে যুদ্ধ করি এবং আমাদের দেহগুলো টুকরো টুকরো হয়ে যায় , যেন কিয়ামতের দিন আপনার নানা আমাদের জন্য শাফায়াত করেন।”
[‘
কামিল’
,‘
ইরশাদ’
গ্রন্থে আছে] আল হুর , যিনি ইমাম হোসেইন (আ.) এর পাশাপাশি পথ চলছিলেন তার কাছে এসে বললেন ,“
হে হোসেইন , আমি আপনাকে আল্লাহর নামে অনুরোধ করছি আপনার জীবন নিয়ে ভাবার জন্য এবং আমি নিশ্চিত , যদি আপনি যুদ্ধ করেন তাহলে আপনি নিশ্চিতভাবে নিহত হবেন।”
ইমাম বললেন ,“
তুমি কি আমাকে মৃত্যুকে ভয় পাওয়াতে চাও ? এর চেয়ে বড় দুর্যোগ তোমার উপর কী আসতে পারে আমাকে হত্যার চাইতে ? আউস গোত্রের এ ভাইয়ের কথাগুলো আমি পুনরাবৃত্তি করছি যে তার চাচাতো ভাইকে বলেছিলো যখন সে আল্লাহর রাসূল (সা.) কে সাহায্য করতে চেয়েছিলো। তার চাচাতো ভাই তার জন্য শঙ্কিত হলো এবং বললো: কোথায় যাচ্ছো তুমি , কারণ তোমাকে হত্যা করা হবে। এতে সে উত্তর দিয়েছিলো: আমি যাবো , কারণ একজন যুবকের জন্য মৃত্যুতে কোন লজ্জা নেই যখন সে সঠিক (কাজটি) করতে চায় , একজন মুসলমানের মত সংগ্রাম করে , সৎকর্মশীল লোকদের উদ্বুদ্ধ করে তার জীবন দিয়ে এবং অভিশপ্তদের ছত্রভঙ্গ করে এবং অপরাধীদের বিরোধিতা করে। যদি আমি বেঁচে থাকি আমি আফসোস করবো না (সে জন্য যা করেছি) এবং যদি আমি মৃত্যুবরণ করি , আমি কষ্ট পাবো না। তোমার জন্য অপমানের ভেতর ও ঘৃণিত হয়ে বেঁচে থাকা যথেষ্ট হোক।”
যখন আল হুর এ কথাগুলো শুনলেন তিনি ইমাম হোসেইন (আ.) থেকে সরে এসে তার সাথীদের সাথে পথের অপর পাশে হাঁটতে শুরু করলেন এবং ইমাম তার সাথীদের নিয়ে পথের অন্যপাশে চলতে লাগলেন।
[তাবারির ,‘
কামিল’
গ্রন্থে বর্ণিত] উযাইব আল হিজানাতে তারা পৌঁছালেন যা ছিলো নোমানের ঘোড়াসমূহের চারণভূমি। তাই এর নাম ছিলো হিজানাত। হঠাৎ করেই চার জন উট আরোহী (নাফে’
বিন হিলাল , মুজমে বিন আব্দুল্লাহ , উমর বিন খালিদ এবং তিরিম্মাহ বিন আদি) কুফার দিক থেকে হাজির হলেন নাফে’
বিন হিলালির কামিল নামের ঘোড়াটিকে টানতে টানতে। তিরিম্মাহ বিন আদি ছিলেন তাদের নেতা। তারা ইমাম হোসেইন (আ.) এর মুখোমুখি হলেন। যখন তিরিম্মাহর দৃষ্টি ইমাম (আ.) এর উপর পড়লো তিনি নিচের কবিতাটি আবৃত্তি করলেন ,
“
হে আমার উট , আমার হৈচৈ কে ভয় করো না এবং সূর্য উঠার আগেই আমাদের একটি ভালো কাফেলার কাছে নিয়ে চলো , যে শ্রেষ্ঠ ভ্রমণকারী । যতক্ষণ না তুমি একজন দৃঢ় দৃষ্টি সম্পন্ন সাহসী মানুষের কাছে পৌঁছাও , যিনি সম্মানিত ও উদার , যাকে আল্লাহ এনেছেন একটি উত্তম কাজের জন্য এবং তিনি একজন সাহায্যকারী এবং আল্লাহ তাকে জীবিত রাখুন পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত। আল্লাহর রাসূলের পরিবার হলো সম্মান ও মর্যাদার , তারা হচ্ছেন ফর্সা ও আলোকিত চেহারার সর্দার ; যারা তাদের শত্রুদেরকে আক্রমণ করেন বাদামী বর্শা ও ধারালো তরবারি দিয়ে। হে , যার হাতে আছে লাভ ও লোকসানের ক্ষমতা , হোসেইনকে সাহায্য করুন এ রকম বিদ্রোহী লোকজনের বিরুদ্ধে যারা অবিশ্বাসের সর্বশেষ টুকরো , সাখর (আবু সুফিয়ান)-এর দুই সন্তান , ইয়াযীদ , যে মদ পানকারী এবং ইবনে যিয়াদ , যে ব্যাভিচারী ও একজন অবৈধ সন্তান।”
যখন এই ব্যক্তিরা ইমাম হোসেইন (আ.) এর কাছে পৌছলো , আল হুর তাদের দিকে গেলো এবং বললো ,“
এরা কুফার অধিবাসী , আমি তাদের বন্দী করবো অথবা কুফাতে পাঠিয়ে দিবো।”
ইমাম বললেন ,“
আমি আমার জীবন দিয়ে তাদের রক্ষা করবো , কারণ এ লোকগুলো আমার সাথী এবং তারা আমার অন্যান্য সাথীদের মতই অধিকার রাখে। যদি তুমি তাদের সাথে আমাদের চুক্তির বিরোধিতা করো আমি তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো।”
তা শুনে আল হুর সরে গেলেন। ইমাম হোসেইন (আ.) তখন তাদের দিকে ফিরে বললেন ,“
কুফার লোকদের সম্পর্কে আমাকে বলো।”
তাদের মধ্যে একজন মুজমে বিন আব্দুল্লাহ আয়েদি বললেন ,“
তাদের সর্দাররা বিরাট অঙ্কের ঘুষ গ্রহণ করেছে এবং তাদের টাকার থলে পূর্ণ করেছে। শাসক তাদের আত্মা কিনে নিয়েছে এবং তাদেরকে তাদের দৃঢ় সাথী বানিয়ে নিয়েছে এবং সবাই আপনার বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়েছে। আরও কিছু লোক আছে যাদের হৃদয়গুলো আপনার সাথে কিন্তু আগামীকাল তাদের তরবারি আপনার মুখের উপর উম্মুক্ত হবে।”
তখন ইমাম তার দূত ক্বায়েস বিন মুসাহহির সাইদাউই সম্পর্কে খোঁজ নিলেন। তারা বললেন ,“
হাসীন বিন নামীর তাকে গ্রেফতার করে ইবনে যিয়াদের কাছে পাঠিয়েছে এবং সে ক্বায়েসকে আদেশ দিয়েছে আপনাকে ও আপনার পিতাকে অভিশাপ দিতে। ক্বায়েস মিম্বরে উঠেন এবং সালাম পাঠান আপনাকে ও আপনার পিতাকে এবং নিন্দা করেন যিয়াদ ও তার বাবাকে। তিনি জনগণকে আমন্ত্রণ জানান আপনাকে সাহায্য করার জন্য এবং তাদেরকে আপনার আগমন সম্পর্কে সংবাদ দেন। তখন ইবনে যিয়াদ আদেশ দেয় যেন তাকে প্রাসাদের ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয়।”
ইমাম নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কাঁদতে শুরু করলেন এবং কোরআনের এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন ,
)
فَمِنْهُمْ مَنْ قَضَى نَحْبَهُ وَمِنْهُمْ مَنْ يَنْتَظِرُ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيل(
“
তাদের কেউ কেউ অঙ্গীকার পূরণ করেছে , এবং তাদের মধ্যে কেউ আছে অপেক্ষা করছে (অঙ্গীকার পূরণের জন্য) এবং তারা একটুও বদলায়নি ।”
[সূরা আহযাব: ২৩]
“
হে আল্লাহ , আমাদেরকে এবং তাদেরকে বেহেশতে স্থান দিন এবং আমাদের একত্র করুন আপনার দয়া ও পুরস্কারের ভাণ্ডারপূর্ণ বিশ্রামস্থলে।”
তখন তিরিম্মাহ বিন আদি তার কাছে এলেন এবং বললেন ,“
আমি আপনার সাথে খুব অল্প কয়েকজন মানুষ দেখতে পাচ্ছি এবং যদি তারা (শত্রুরা) আপনার সাথীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাহলে তারা তাদের জন্য যথেষ্ট হবে। আমি কুফা ত্যাগ করার আগে বিশাল সংখ্যার একদল মানুষকে দেখলাম যা আমি এক জায়গায় জমায়েত হতে আগে কখনো দেখি নি। যখন আমি খোঁজ নিলাম এর পেছনে কী কারণ আমাকে বলা হলো তাদেরকে সাজানো হচ্ছে আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য।
আমি আল্লাহর নামে আপনাকে অনুরোধ করছি তাদের দিকে সামান্যও অগ্রসর না হতে এবং একটি সুরক্ষিত শহরে যান এবং সেখানে অবস্থান করুন আপনি সিদ্ধান্ত নেয়া পর্যন্ত এবং আপনার কর্ম-পরিকল্পনা নিয়ে ভাবুন। আমার সাথে আসুন। আমি আপনাকে আজা পর্বতে নিয়ে যাবো। যা সুরক্ষিত। এ পর্বত আমাদের জন্য ঢালের কাজ করেছে গাসসান ও হামীরের রাজাদের বিরুদ্ধে , নোমান বিন মুনযির এবং লাল চামড়া ও সাদা চামড়ার (বিদেশীদের) বিরুদ্ধে এবং আমরা এতে (সব সময়) আশ্রয় নিয়েছি। আল্লাহর শপথ , আমরা কখনোই অপমানিত হই নি। আমি আপনার সাথে যাবো এবং সেখানে আপনার জন্য জায়গা দিবো। তখন আপনি আপনার দূতদের বনি তাঈ’
র কাছে পাঠাতে পারেন যারা আজা ও সালামি পর্বতে বাস করে , যতক্ষণ না ঘোড়সওয়ার ও পদাতিক সৈন্যরা আপনার চার পাশে জমা হয়। দশ দিন পার হবে না বিশ হাজার (বনি তাঈ’
র) লোক তৈরী হয়ে যাবে এবং তাদের জীবন থাকতে আপনার কাছে কাউকে পৌঁছতে দিবে না।”
ইমাম হোসেইন (আ.) বললেন ,“
আল্লাহ তোমাকে ও তোমার লোকদের উদারভাবে পুরস্কৃত করুন , আমরা এ লোকগুলোর সাথে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি যার কারণে আমি ফিরতে পারি না এবং আমরা জানি না আমাদের ও তাদের কী ঘটবে।”
আবু মাখনাফ বলেন যে , জামীলা বিন মারসাদ বর্ণনা করেছেন তিরিম্মাহ বিন আদি থেকে যে তিনি বলেছেন:“
আমি ইমামকে বিদায় জানালাম এবং বললাম , আল্লাহ আপনাকে খারাপ জিন ও মানুষের কাছ থেকে আশ্রয় দিন। আমি কুফা থেকে আমার পরিবারের জন্য রসদ এনেছি এবং তাদের রিয্ক্ব আমার কাছে। আমি ফেরত যাবো এবং তাদের কাছে তা হস্তান্তর করবো। এরপর আমি আপনার কাছে ফেরত আসবো এবং আপনার সাথীদের সাথে যোগদান করবো।”
ইমাম বললেন ,“
তোমার উপর আল্লাহর রহমত হোক , তাহলে তাড়াতাড়ি যাও।”
আমি অনুভব করলাম তার আরও লোকজনের প্রয়োজন , তাই আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে বললেন। তিরিম্মাহ বলেন , আমি আমার পরিবারের কাছে গেলাম এবং যা আমার কাছে ছিলো তাদের কাছে হস্তান্তর করলাম এবং তাদের কাছে অসিয়ত করে এলাম। তারা আমাকে বললো ,“
আমরা আপনাকে কখনো এত তাড়াহুড়া করতে দেখি নি।”
আমি তাদের কাছে আমার উদ্দেশ্য বর্ণনা করলাম এবং বনি না’
আলের রাস্তা অতিক্রম করলাম এবং উযাইবুল হিজানাতের নিকটবর্তী হলাম। সেখানে আমি সামা’
আহ বিন বাদারের সাক্ষাত পেলাম যে আমাকে ইমাম হোসেইন (আ.) এর শাহাদাতের সংবাদ দিলো , আর তাই আমি ফেরত চলে এলাম।
লেখক (শেইখ আব্বাস কুম্মি) বলেন যে , আবু জাফর তাবারির বর্ণনা অনুযায়ী , যিনি আযদি থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন , এটি প্রমাণ করে যে তিরিম্মাহ বিন আদি কারবালায় উপস্থিত ছিলেন না এবং সেখানকার শহীদদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। বরং যখন তিনি ইমাম হোসেইন (আ.) এর শাহাদাতের সংবাদ শোনেন তখন ফিরে যান। কিন্তু আবু মাখনাফের সুপরিচিত‘
মাক্বতাল’
অনুযায়ী তিরিম্মাহ থেকে বর্ণনা এসেছে যে , তিনি বলেছেন ,“
আমি ভীষণভাবে আহত ছিলাম এবং কারবালার শহীদদের মাঝে পড়েছিলাম। আমি শপথ করছি যে সে সময় আমি ঘুমিয়ে যাই নি। আমি দেখলাম বিশজন ঘোড়সওয়ার আসছে”
ইত্যাদি। তাই এ বর্ণনার উপর নির্ভর করা যায় না এবং তা সংবাদকে দুর্বল করে ফেলে। আল্লাহ তাকে উপযুক্ত পুরস্কার দিন।
ইমাম (আ.) আরও এগিয়ে গেলেন এবং ক্বাসরে বনি মাক্বাতিলে পৌঁছালেন এবং সেখানে থামলেন। তিনি সেখানে একটি তাঁবু খাঁটানো দেখতে পেলেন এবং খোঁজ নিলেন সেটি কার তাঁবু। লোকজন বললো যে তা উবায়দুল্লাহ বিন আল হুর জু’
ফির। ইমাম বললেন যে , তিনি তার সাথে দেখা করতে চান এবং একজনকে পাঠালেন তাকে ডেকে আনতে। [‘
মানাক্বিব’
] ইমামের দূত হাজ্জাজ বিন মাসরুক্ব জু’
ফি তার কাছে গেলেন এবং বললেন ,“
ইমাম হোসেইন (আ.) , আলীর সন্তান , আপনার সাথে দেখা করতে চান।”
সে বললো ,“
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহর শপথ আমি কুফা ছেড়েছি শুধু হোসেইন বিন আলীর সাথে দূরত্ব রাখার জন্য। আমি তার সাথে দেখা করতে চাই না , না আমি চাই তিনি আমাকে দেখতে পান।”
হাজ্জাজ্ব ফেরত এলেন এবং তার কথাগুলো ইমামকে বললেন। ইমাম উঠলেন এবং তার সাথে সাক্ষাত করতে গেলেন। যখন তিনি উবায়দুল্লাহর কাছে গেলেন তিনি তাকে সালাম দিলেন এবং বসলেন। এরপর ইমাম তাকে আমন্ত্রণ জানালেন সাহায্য করার জন্য । এতে সে আগের কথাই বললো এবং নিজেকে সরিয়ে নিলো। ইমাম বললেন ,
“
এখন যেহেতু তুমি আমাদের সাহায্য করা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছো সেক্ষেত্রে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো না। আল্লাহর শপথ , যে আমাদের ডাক শোনে এবং এতে সাড়া দেয়ার জন্য দ্রুত এগোয় না সে অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাবে।”
উবায়দুল্লাহ বললো ,“
আপনার শত্রুদের পক্ষ নেয়ার বিষয়ে আল্লাহ চাইলে তা ঘটবে না।”
তখন ইমাম হোসেইন (আ.) উঠে দাঁড়ালেন এবং তার তাঁবুর দিকে ফিরে গেলেন।
এখানে উবায়দুল্লাহ বিন আল হুর জু’
ফি সম্পর্কে কিছু বর্ণনা করা প্রাসঙ্গিক হবে। মির্যা (মুহাম্মাদ আসতারাবাদী) তার‘
রিজালে কাবীর’
বইতে নাজাশি থেকে বর্ণনা করেন যে , উবায়দুল্লাহ বিন আল হুর জু’
ফি একজন ঘোড়সওয়ার এবং কবি ছিলো। তার কাছে একটি বই ছিলো বিশ্বাসীদের আমির ইমাম আলী (আ.) থেকে। মির্যা তার বর্ণনাকারীদের ক্রমধারা রক্ষা করে বলেন যে , উবায়দুল্লাহ ইমাম হোসেইন (আ.) কে জিজ্ঞেস করলো কী কলপ তিনি ব্যবহার করেন। ইমাম বললেন ,“
তুমি যা ভাবছো তা নয় , এটি মেহদী ও ওয়াসমাহ।”
এছাড়া‘
ক্বামক্বাম’
-এ বর্ণিত হয়েছে যে , উল্লেখিত উবায়দুল্লাহ ছিলো খলিফা উসমানের শিয়া (অনুসারী)। সে ছিলো আরবদের মাঝে সাহসী ঘোড়সওয়ার যোদ্ধা। সে মুয়াবিয়ার পক্ষে সিফফীনের যুদ্ধে যুদ্ধ করেছে খলিফা উসমানের প্রতি তার ভালোবাসার কারণে। যখন ইমাম আলী (আ.) শহীদ হন সে কুফায় ফেরত আসে এবং সেখানেই বাস করতে থাকে। যখন লোকজন ইমাম হোসেইন (আ.) কে হত্যা করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে , সে কুফা ত্যাগ করে যেন তার হত্যায় তাকে অংশীদার হতে না হয়।
তাবারি বর্ণনা করেন আযদি থেকে , যিনি বর্ণনা করেন আব্দুর রহমান বিন জানদাহ আযদি থেকে যে: ইমাম হোসেইন (আ.) এর শাহাদাতের পর উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ কুফার সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে পরিদর্শন করে। সে উবায়দুল্লাহ বিন আল হুরকে দেখতে পেলো না এবং কিছু দিন পর যখন সে ফিরে এলো সে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের সাথে সাক্ষাত করতে গেলো। উবায়দুল্লাহ (বিন যিয়াদ) তাকে জিজ্ঞেস করলো ,“
হে হুরের সন্তান , তুমি কোথায় ছিলে ?”
সে বললো যে সে অসুস্থ ছিলো। এতে উবায়দুল্লাহ জিজ্ঞেস করলো ,“
তুমি কি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলে , না শারীরিকভাবে ?”
সে বললো ,“
আমার হৃদয় অসুস্থ নয় ; আর শরীরের বিষয়ে , আল্লাহ আমাকে সুস্থতা দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন।”
উবায়দুল্লাহ বললো ,“
তুমি মিথ্যা বলছো , আসলে তুমি আমাদের শত্রুদের সাথে ছিলে।”
উবায়দুল্লাহ (বিন আল হুর) বললো ,“
যদি আমি তোমার শত্রুদের সাথে উপস্থিত থাকতাম তাহলে তা প্রকাশ হয়ে যেতো , কারণ আমার মত একজন লোক দৃষ্টির আড়ালে থাকতে পারে না।”
যখন ইবনে যিয়াদ তার দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিলো সে চুরি করে সরে পড়লো এবং তার ঘোড়ায় চড়ে স্থান ত্যাগ করলো। এরপর উবায়দুল্লাহ ফিরে বললো ,“
আল হুরের সন্তান কোথায় ?”
লোকজন বললো সে এইমাত্র চলে গেলো। সে আদেশ দিলো যে তাকে তার কাছে ফেরত আনতে। রক্ষীরা তার পিছনে ছুটে গেলো এবং তাকে সেনাপতির আহ্বানে সাড়া দিতে বললো। সে বললো ,“
তাকে বলো আমি তার কাছে কখনোই পায়ে হেঁটে আসবো না।”
এ কথা বলে সে ফিরে চললো এবং আহমার বিন যিয়াদ তাঈ’
র বাড়িতে পৌঁছল। সে তার সাথীদের জড়ো করলো এবং তারা কারবালার শহীদদের জায়গায় গেলো। সেখানে সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলো এবং মাদায়েনে গেলো। এ বিষয়ে সে কবিতা লিখলো ,“
প্রতারক , ধোঁকাবাজ সেনাপতি , যে প্রকৃতই একজন ধোঁকাবাজ , বলে যে কেন আমি ফাতিমা (আ.) এর সন্তান হোসেইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি নি , যখন আমি লজ্জিত এবং আফসোস করি কেন আমি তাকে সাহায্য করি নি এবং যে ভালো কাজ করতে অবহেলা করে তার লজ্জিত হওয়া উচিত এবং তওবা করা উচিত।”
তার কবিতা অনুযায়ী সে ইমাম হোসেইন (আ.) কে সাহায্য না করে লজ্জিত ছিলো। সে কিছু কবিতা লিখেছিলো যা এ বইয়ে শোকগাঁথাগুলোর মাঝে উল্লেখ করা হবে।
এছাড়া বর্ণিত হয়েছে যে সে অনুতাপে তার দুটো হাত একত্র করেছিলো এবং বলেছিলো ,“
আমি নিজেকে কী করেছি ?”
এরপর সে নিচের কবিতা পাঠ করেছিলো ,
“
হায় অনুতাপ , হায় দুঃখ এবং যতদিন আমি বেঁচে আছি এ অনুতাপ আমার আত্মা ও ঘাড়ের উপর থাকবে , যখন হোসেইন আমাকে ক্বাসরে বনি মাক্বাতিলের পথভ্রষ্ট ও মুনাফিক্বদের বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করার জন্য বলেছিলো , যখন বলেছিলো তুমি কি আমাদের পরিত্যাগ করবে এবং চলে যাবে ? তখন যদি আমি মুস্তাফা (সা.) এর সন্তানের প্রতিরক্ষায় আমার জীবন কোরবান করতাম। তাহলে আমি কিয়ামতের দিন সফলতা লাভ করতাম। তিনি (ইমাম) আমার দিকে পিঠ ফিরালেন এবং বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন। যদি অনুতপ্ত হৃদয় চিরে দেখানো যেতো , আমার হৃদয় যেন ছিঁড়ে যায়। এটি অতি সত্য যে যারা হোসেইনকে সমর্থন দিয়েছে এবং সাহায্য করেছে তারা সফলতা অর্জন করেছে এবং তারা সৎকর্মশীল এবং যারা মুনাফিক্ব ছিলো তারা অভিশপ্ত হয়েছে।”
আবু হানিফা দিনাওয়ারি এ কবিতাগুলোর কিছু উল্লেখ করে বলেন যে উবায়দুল্লাহ বিন আল হুর কুফার সম্মানিতদের অন্তর্ভুক্ত এবং একজন যোদ্ধা ছিলেন।
সম্মানিত সাইয়েদ মাহদী বাহারুল উলুম তার‘
রিজাল’
-এ বলেন যে , শেইখ নাজ্বাশি উবায়দুল্লাহ বিন আল হুর জু’
ফিকে আদি শিয়াদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সে হচ্ছে ঐ একই ব্যক্তি যার পাশ দিয়ে ইমাম গিয়েছিলেন আল হুর বিন ইয়াযীদ রিয়াহির সাথে সাক্ষাতের পর এবং তার সাহায্য চেয়েছিলেন , কিন্তু সে অস্বীকার করেছিলো।
শেইখ সাদুক্ব তার‘
আমালি’
তে ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) থেকে বর্ণনা করেন যে , যখন ইমাম হোসেইন (আ.) ক্বাতক্বাতানিয়াতে পৌঁছালেন , তিনি দেখলেন একটি তাঁবু খাঁটানো আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন সেটি কার তাঁবু। লোকজন বললো তা উবায়দুল্লাহ বিন আল হুর হানাফির (বরং সঠিক নাম হলো উবায়দুল্লাহ বিন আল হুর জু’
ফি)। ইমাম তাকে একটি সংবাদ পাঠালেন এ বলে ,“
তুমি একজন খারাপ ও অপরাধী ব্যক্তি। তুমি যা করেছো তার জন্য আল্লাহ তোমাকে হিসাব নেয়ার জন্য ডাকবেন। যদি তুমি আল্লাহর দিকে ফিরে আসো এবং আমাকে সাহায্য কর তাহলে আমার নানা তোমার জন্য আল্লাহর সামনে শাফায়াত করবেন।”
সে বললো ,“
হে আল্লাহর রাসূলের সন্তান , যদি আমি আপনাকে সাহায্য করতে আসি আমি হবো প্রথমদের একজন যে আপনার সামনে আপনার জন্য জীবন কোরবান করবে। আপনি আমার ঘোড়াটি নিতে পারেন। আমি এতে বসে যত কাজ করেছি , তাতে আমি যা চেয়েছি তা অর্জন করেছি এবং কেউ আমার কাছে পৌঁছতে পারে নি। এটি আমাকে রক্ষা করেছে। তাই আমি এটি আপনাকে উপহার দিচ্ছি , তা নিন।”
এ কথা শুনে ইমাম তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেন ,“
তোমাকে অথবা তোমার ঘোড়ার কোনটিরই প্রয়োজন আমার নেই। আমি চাই না আমার দলে পথভ্রষ্ট লোক প্রবেশ করুক। এখান থেকে পালিয়ে যাও এবং আমাদের পক্ষেও এসো না অথবা আমাদের বিপক্ষেও না। কারণ যে ব্যক্তি আমাদের আহলুল বাইতের ডাক শোনে কিন্তু আমাদের সাহায্য করতে দ্রুত এগোয় না , আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুনে মাথা নিচের দিকে দিয়ে ছুঁড়ে ফেলবেন।”
শেইখ মুফীদ তার‘
ইরশাদ’
-এ বলেছেন যে , যখন ইমাম হোসেইন (আ.) ক্বাসরে বনি মাক্বাতিলে পৌঁছালেন , তিনি সেখানে একটি তাঁবু খাটানো দেখতে পেলেন (আগে যা বর্ণিত হয়েছে সে রকমই , শেষ পর্যন্ত)।
সাইয়েদ তাবাতাবাঈ‘
বাহারুল উলূম’
-এ বর্ণনা করেন যে , শেইখ জাফর বিন মুহাম্মাদ ইবনে নিমা তার‘
শারহুস সার ফী ইহওয়ালিল মুখতার’
-এ লিখেছেন যে উবায়দুল্লাহ বিন আল হুর বিন মুজমে’
বিন খুযাইম জু’
ফি কুফার সম্মানিতদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইমাম হোসেইন (আ.) তার কাছে এলেন এবং তাকে তার (ইমামের) দলে যোগ দিতে আহ্বান জানালেন। কিন্তু সে অস্বীকার করলো। পরে সে এমন অনুতপ্ত হলো যে , সে চেয়েছিলো যেন তার মৃত্যু হয় এবং সে কবিতা আবৃত্তি করেছিলো (ওপরে বর্ণিত)। তার অন্যান্য সুপরিচিত কবিতা হলো:
“
লালসাপূর্ণ বনি উমাইয়াহ শান্তিতে ঘুমায় , অথচ তাফের নিহতদের পরিবার তা থেকে বঞ্চিত। ইসলাম মূর্খ লোকদের গোত্রের হাতে ছাড়া আর কোথাও ধ্বংস হয় নি , যাদের সেনাপতি বানানো হয়েছে এবং তাদের ঠাট-বাট প্রকাশ্য , ধর্মের বর্শা অত্যাচারীদের হাতে , যখন এর এক অংশ বেঁকে যায় , তা তারা সোজা করে না। আমি শপথ করেছি যে আমার আত্মা সব সময় শোকাভিভূত থাকবে , দুঃখিত থাকবে এবং আমার চোখ থাকবে অশ্রুতে পূর্ণ। যা আমার জীবন কালে কখনো শুকোবে না , যতক্ষণ না বনি উমাইয়াহর সর্দাররা অপমানিত হয় তাদের মৃত্যু পর্যন্ত।”
এরপর তিনি আরও বলেন যে , এ উবায়দুল্লাহ মুখতারের বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো এবং ইবরাহীম বিন মালিক আশতারের সাথে ছিলো উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। ইবরাহীম অস্বস্তিতে ভুগছিলেন এবং মুখতারকে বললেন ,“
আমি আশঙ্কা করছি প্রয়োজনের মুহূর্তে সে আমাদের ধোঁকা দিতে পারে।”
মুখতার বললেন ,“
তাকে সম্পদ দাও এবং তার চোখ অন্ধ করে দাও।”
তখন ইবরাহীম এগিয়ে গেলেন উবায়দুল্লাহকে সহ এবং তিফরিত পৌঁছে সেখানে থামলেন। তিনি কর সংগ্রহ করলেন এবং তা তার সাথীদের মাঝে বন্টন করলেন। তিনি উবায়দুল্লাহকে পাঁচ হাজার দিরহাম পাঠালেন। এতে সে ক্রোধান্বিত হয়ে বললো ,“
তুমি নিজের জন্য দশ হাজার দিরহাম রেখেছো অথচ আমি (মর্যাদায়) তোমার চাইতে কম নই।”
এবং ইবরাহীম যতই শপথ করে বললেন যে এর চাইতে সে বেশী রাখে নি , সে তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলো। ইবরাহীম তাকে নিজের অংশটিও দিলেন কিন্তু এতেও সে সন্তুষ্ট হলো না। এরপর সে মুখতারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলো এবং তার সমর্থনের অঙ্গীকার ভঙ্গ করলো। সে কুফার কিছু গ্রাম লুট করলো এবং মুখতারের কিছু লোককে হত্যা করলো এবং লুটকৃত সম্পদের পুরোটা নিয়ে বসরাতে মুস’
আব বিন যুবাইরের কাছে গেলো। মুখতার তার সৈন্যদেরকে তার পিছনে পাঠালো যারা তার বাড়ি ধ্বংস করে দিলো।
পরে উবায়দুল্লাহ অনুতপ্ত হয়েছিলো যে কেন সে ইমাম হোসেইন (আ.) কে সাহায্য করে নি এবং কেন সে মুখতারের সাথে থাকে নি এবং বলেছিলো ,“
যখন মুখতার জনগণকে প্রতিশোধের জন্য আহ্বান করলো , আহলুল বাইতের অনুসারীরা এগিয়ে এলো। যারা তাদের বর্মের ওপরে হৃদয় সাজিয়েছিলো ; তারা প্রত্যেক মৃত্যুর নদীতে ও যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিলো এবং তারা নবীর দৌহিত্রকে এবং তার পরিবারকে সাহায্য করেছিলো , তাদের লক্ষ্য রক্তের প্রতিশোধ নেয়া ছাড়া আর কিছু ছিলো না। এভাবে তারা বেহেশতে ও এর সুবাসের ভেতরে প্রবেশ করলো। আর তা সব সোনা ও রূপার চাইতে উত্তম। হায় যদি আমিও ভারতীয় ও পূর্ব দেশীয় তরবারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতাম। আফসোস , যদি আমি আপনার সমর্থকদের দলে প্রবেশ করতাম তাহলে আমি প্রত্যেক বিদ্রোহী ও সীমালঙ্ঘনকারীকে হত্যা করতাম।”
এ কবিতাগুলো উদ্ধৃত করার পর সাইয়েদ বাহারুল উলূম বলেন যে , আমার মতে , এত কিছুর পরও আল হুর জু’
ফি ছিলো একজন বিশ্বাসী , কিন্তু অপরাধী। আপনারা দেখেছেন সে ইমাম হোসেইন (আ.) কে সাহায্য করতে অস্বীকার করেছিলো এবং দেখেছেন মুখতারের প্রতি তার মনোভাব। কিন্তু সে অনুতাপ করেছিলো ও তওবা করেছিলো , আমরা আশ্চর্য হয়েছি যে নাজ্জাশি তাকে ধার্মিকদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং তাকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তার বইয়ের শুরুতে তাকে স্থান দিয়েছেন। (ওপরে যা বলা হয়েছে) এ অনুযায়ী আমি ইমাম হোসেইন (আ.) এর করুণা আশা করি , যিনি তাকে আদেশ করেছিলেন পালিয়ে যেতে , যেন সে ডাক শুনতে না পায় , যাতে জাহান্নামে মুখ নিচু করে নিক্ষিপ্ত হতে না হয় , এবং তিনি আল্লাহর কাছে কিয়ামতের দিন তার জন্য শাফায়াত করবেন। কারণ সে অনেক অনুতপ্ত হয়েছিলো এবং তওবা করেছিলো সে যা করেছিলো তার জন্য। আল্লাহ ভালো জানেন তার অবস্থা সম্পর্কে এবং তার শেষ সম্পর্কে (এখানেই আল্লামা তাবাতাবাঈর‘
বাহারুল উলূম’
- এর আলোচনা শেষ হয়েছে)।
লেখক (শেইখ আব্বাস কুম্মি) বলেন , যে আল হুর জু’
ফির বংশধর ছিলো শিয়া , যার মাঝে ছিলো আদীম , আইউব ও যাকারিয়া , যারা ইমাম জাফর আস সাদিক্ব (আ.) এর সাথী ছিলেন। নাজ্জাশি তাদের বিষয়ে উল্লেখ করেছেন এবং বলেন যে আদীম ও আইউব নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং তিনি একটি বইকে যাকারিয়ার লেখা বলে উল্লেখ করেছেন।