কাববালায় ইমাম হোসেইন (আ.) এর আগমন , উমর বিন সা’
আদের প্রবেশ ও তখনকার পরিস্থিতি
যখন ইমাম হোসেইন (আ.) কারবালার সমতল ভূমিতে এসে থামলেন , [কামিল] তিনি জায়গাটির নাম জিজ্ঞেস করলেন। লোকজন উত্তর দিলো যে জায়গাটির নাম‘
আক্বার’
। ইমাম বললেন ,
“
হে সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমরা আক্বার (আক্বার শব্দের অর্থ উদ্ভিদশূন্য , বন্ধ্যা) থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চাই।”
সিবতে ইবনে জাওযী তার‘
তাযকিরাহ’
তে লিখেছেন যে ইমাম হোসেইন (আ.) জিজ্ঞেস করলেন জায়গাটির নাম কী। লোকজন উত্তর দিলো যে তা কারবালা এবং একে নাইনাওয়া বলেও ডাকা হয় যা সেখানে একটি গ্রামের নাম। তখন ইমাম (আ.) কাঁদতে শুরু করলেন এবং বললেন , উম্মু সালামা আমাকে জানিয়েছেন: একদিন জিবরাঈল রাসূল (সা.) এর কাছে এলেন এবং তুমি (ইমাম হোসেইন) আমার সাথে ছিলে। হঠাৎ রাসূলুল্লাহ বললেন ,
“
আমার সন্তানকে ছেড়ে দাও।”
এ কথা শুনে আমি তোমাকে ছেড়ে দিলাম এবং রাসূলুল্লাহ তোমাকে তার কোলে বসালেন। জিবরাঈল তাকে জিজ্ঞেস করলেন ,“
আপনি কি এ বাচ্চাকে ভালোবাসেন ? রাসূলুল্লাহ হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলেন। তখন জিবরাঈল বললেন ,“
আপনার উম্মত তাকে হত্যা করবে এবং যদি আপনি চান আমি আপনাকে ঐ জায়গার মাটি দেখাবো যেখানে তাকে শহীদ করা হবে।”
রাসূলুল্লাহ সে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তখন জিবরাঈল তার পাখা কারবালার দিকে প্রসারিত করলেন এবং রাসূলুল্লাহকে জায়গাটি দেখালেন।
তাই ইমাম হোসেইন (আ.) কে যখন বলা হলো জায়গাটির নাম কারবালা তখন তিনি মাটি শুঁকলেন এবং বললেন ,“
এ হলো সেই জায়গা যার কথা জিবরাঈল রাসূলুল্লাহকে জানিয়েছিলেন এবং আমাকে এখানে হত্যা করা হবে।”
এরপর শা’
বি থেকে সিবতে ইবেন জাওযি বর্ণনা করেন যে , যখন ইমাম আলী (আ.) সিফফীনের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি নাইনাওয়ার সামনে উপস্থিত হলেন , যা ছিলো ফোরাত নদীর কাছে একটি গ্রাম। ইমাম সেখানে থামলেন এবং তার সাথীদের মধ্যে যারা অযুর পানি দেয়ার দায়িত্বে ছিলেন তাদের বললেন ,“
আমাকে এ জায়গাটির নাম বলো।”
তারা বললো যে , এটি হলো কারবালা। একথা শুনে তিনি খুব কাঁদলেন এবং তার চোখের পানিতে মাটি ভিজে গেলো , তিনি বললেন , একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে গেলাম যখন তিনি কাঁদছিলেন , আমি জিজ্ঞেস করলাম তিনি কেন কাঁদছেন।
তিনি বললেন ,“
এ মুহূর্তে জিবরাঈল আমার কাছে এসেছিলো এবং আমাকে জানালো আমার সন্তান হোসেইনকে হত্যা করা হবে কারবালা নামের এক জায়গায় যা ফোরাত নদীর কাছে। এরপর জিবরাঈল এক মুঠো মাটি তুললেন এবং তা আমাকে দিলেন ; আমি তা শুঁকলাম , আর তাই আমি অশ্রু নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না।”
এছাড়া‘
বিহারুল আনওয়ার’
-এ খারায়েজ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে , ইমাম মুহাম্মদ আল বাক্বির (আ.) বলেছেন যে , একদিন ইমাম আলী (আ.) তার সঙ্গীদের সাথে নিয়ে কারবালা থেকে এক বা দুই মাইল দূরে গেলেন। এরপর তিনি আরও এগিয়ে গেলেন এবং মাক্বদাফান নামে এক জায়গায় পৌঁছলেন এবং সেখানে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এরপর বললেন ,
“
দুশ’
নবী ও নবীদের সন্তানদেরকে এখানে শহীদ করা হয়েছে এবং এটি থামার জায়গা , বিরাট প্রশান্তিলাভকারী শহীদদের শহীদ হওয়ার জায়গা , যা প্রাচীন লোকেরা অর্জন করতে পারে নি এবং তাদের পরে যারা আসবে তারাও তাতে পৌঁছতে পারবে না।”
[‘
মালহুফ’
গ্রন্থে আছে] যখন ইমাম হোসেইন (আ.) সে জায়গায় পৌঁছলেন , তিনি জায়গাটির নাম জিজ্ঞেস করলেন। লোকজন উত্তরে বললো তা কারবালা। ইমাম বললেন ,“
হে আল্লাহ , আমি আপনার আশ্রয় চাই কারব (দুঃখ) এবং বালা (মুসিবত) থেকে।”
এরপর তিনি বললেন ,“
এখানে দুঃখ ও মুসিবত বাস করে , তাই এখানে নামো এবং এটি আমাদের থামার জায়গা। এখানে আমাদের রক্ত ঝরানো হবে এবং এখানে আমাদের কবর দেয়া হবে। আমার নানা , আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাকে এ বিষয়ে আগেই বলেছেন।”
সবাই তার আদেশ মানলেন এবং ঘোড়া থেকে নামলেন এবং আল হুরও তার সাথীদের নিয়ে অন্য এক জায়গায় তাঁবু গাড়লেন।
[‘
কাশফুল গুম্মাহ’
গ্রন্থে আছে] সবাই তার আদেশ মানলো এবং ঘোড়া থেকে নেমে তাদের জিনিসপত্র নামালো। আর আল হুর তার সৈন্যদলকে ইমাম হোসেইন (আ.) এর উল্টো দিকে ঘোড়া থেকে নামালেন। এরপর আল হুর উবায়দুল্লাহকে চিঠি লিখলেন এ কথা জানিয়ে যে ইমাম হোসেইন (আ.) কারবালাতে থেমেছেন।
‘
মুরুজুয যাহাব’
-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে , ইমাম হোসেইন (আ.) কারবালার দিকে অগ্রসর হলেন পাঁচ শত ঘোড়সওয়ার এবং আরও একশত পদাতিক বাহিনী নিয়ে যারা ছিলেন তার পরিবার ও সাথীদের অন্তর্ভুক্ত।
‘
মানাক্বিব’
থেকে‘
বিহারুল আনওয়ার’
-এ বর্ণিত হয়েছে যে , যুহাইর বিন ক্বাইন বললেন ,“
আমাদেরকে সাথে নিয়ে যান যেন ফোরাত নদীর তীরে কারবালায় আমরা থামতে পারি এবং আমরা সেখানে তাঁবু ফেলবো। তখন যদি তারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে , আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো এবং আল্লাহর সাহায্য চাইবো।”
ইমামের চোখ থেকে অশ্রুগড়িয়ে পড়লো এবং তিনি বললেন ,
“
হে আল্লাহ , আমি আপনার কাছে কারব (দুঃখ) ও বালা (মুসিবত) থেকে আশ্রয় চাই।”
ইমাম সেখানে থামলেন এবং আল হুরও এক হাজার সৈন্যসহ তার মুখোমুখি হয়ে ঘোড়া থেকে নামলেন। তখন ইমাম কাগজ ও কলম আনার জন্য আদেশ করলেন এবং কুফার ভদ্র সর্দারদের কাছে একটি চিঠি লিখলেন ,
“
হোসেইন বিন আলী থেকে , সুলাইমান বিন সুরাদ , মুসাইয়্যাব বিন নাজাবাহ , রুফা’
আহ বিন শাদ্দাদ , আব্দুল্লাহ বিন ওয়া’
আল এবং বিশ্বাসীদের দলের প্রতি। আম্মা বা’
আদ , তোমরা ভালো করেই জানো যে , রাসূলুল্লাহ (সা.) বেঁচে থাকতে বলেছিলেন যে , যদি কোন ব্যক্তি দেখতে পায় শাসক নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী (শেষ পর্যন্ত)।”
যা আগে তার খোতবাতে উল্লেখ করা হয়েছে তার নিজের সাথী ও আল হুরের সাথীদের উপস্থিতির আলোচনায়। এর পর তিনি কাগজটি ভাঁজ করলেন এবং তার ওপরে নিজের সীল এঁটে দিলেন এবং তা ক্বায়েস বিন মুসাহ্হার সাইদাউইকে দিলেন ( শেষ পর্যন্ত) , যা ইতোমধ্যেই বর্ণনা করা হয়েছে।
যখন তিনি ক্বায়েসের শাহাদাতের সংবাদ পেলেন তাঁর চোখ থেকে অশ্রুঝরে পড়লো এবং তিনি বললেন ,“
হে আল্লাহ , আমাকে এবং আমার শিয়াদের (অনুসারীদের) জন্য আপনার কাছে সুউচ্চ মর্যাদা দিন এবং আমাদের জড়ো করুন আপনার রহমতের বিশ্রামস্থলে , কারণ আপনি সব কিছুর উপর শক্তি রাখেন।”
তখন তার শিয়াদের (অনুসারীদের) মধ্য থেকে হিলাল বিন নাফে’
বাজালি লাফ দিয়ে সামনে এগুলেন এবং বললেন ,“
হে আল্লাহর রাসূলের সন্তান , আপনার নানা রাসূলুল্লাহ (সা.) সব মানুষের অন্তরে তার ভালোবাসা জোর করে প্রবেশ করাতে পারেন নি , না তিনি পেরেছিলেন তার আদেশের অনুগত করতে ; কারণ তাদের মাঝে ছিলো মুনাফিক্বরা , যারা বলতো তারা তাকে সাহায্য করবে কিন্তু তারা তাদের অন্তরে চেয়েছিলো তাকে ধোঁকা দিতে। তার সামনে তাদের মনোভাব ছিলো মধুর চেয়ে মিষ্টি এবং তার পিছনে মাকাল ফলের চাইতে তিতা , ঐ সময় পর্যন্ত যখন আল্লাহ তার নবীকে নিজের কাছে ডেকে নিলেন। আর আপনার বাবা ছিলেন তার মতই। একদল একত্র হলো তাকে সাহায্য করার জন্য কিন্তু তাকে যুদ্ধ করতে হলো নাকেসীন , অত্যাচারী ক্বাসেতীন এবং বিকৃত মন মারেক্বীনদের বিরুদ্ধে। এরপর ইমাম আলী (আ.) এর সমাপ্তি এলো এবং তিনি বেহেশতের প্রশান্তির দিকে চলে গেলেন। আর আজ এখন যারা আমাদের সাথে আছে তারাও সেদিনের লোকদের মতই এবং লোকজন তাদের অঙ্গীকার ও আনুগত্যের শপথ ভঙ্গ করে আর কারও ক্ষতি করে নি , শুধু নিজেদেরই ক্ষতি করেছে এবং আল্লাহ আমাদেরকে তাদের কাছে অমুখাপেক্ষী করেছেন। আপনি সহনশীলতা ও হিতাকাঙ্ক্ষার সাথে যেখানে ইচ্ছা আমাদের নিয়ে যান - তা পূর্ব অথবা পশ্চিমে হোক। আল্লাহর শপথ , আমরা আল্লাহর সিদ্ধান্তকে ভয় করি না , না আমরা তার সাথে মোলাকাত অপছন্দ করি। আমরা দৃঢ়তা ও দূরদৃষ্টির সাথে সুযোগ গ্রহণ করবো এবং আপনার বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব করবো এবং আপনার শত্রুদের বিরুদ্ধে শত্রুতা রাখবো।”
তখন বুরাইর বিন খুযাইর হামাদানি উঠলেন এবং বললেন ,“
আল্লাহর শপথ , হে আল্লাহর রাসূল (সা.) এর সন্তান , আল্লাহ আপনার মাধ্যমে আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যেন আমরা আপনার সামনে টুকরো টুকরো হতে পারি এবং কিয়ামতের দিন আপনার নানা আমাদের জন্য সুপারিশ করেন। যারা তাদের নিজেদের নবীর নাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তারা মুক্তি পাবে না। ধিক তাদের ওপর , তারা সামনে কিয়ামতে যা দেখবে সে জন্য এবং তারা সেখানে গোঙাবে এবং আর্ত চিৎকার করবে জাহান্নামে।”
এরপর ইমাম হোসেইন (আ.) তার সন্তানদের , ভাইদের ও আত্মীয়দেরকে নিজের চারদিকে জড়ো করলেন এবং কিছু সময়ের জন্য কাঁদলেন ও বললেন ,“
হে আল্লাহ , আমরা আপনার রাসূলের বংশধর। লোকজন আমাদেরকে আমাদের বাড়িঘর থেকে টেনে বের করেছে এবং আমাদেরকে তাড়া করেছে এবং আমাদেরকে আমাদের নানার জায়গা (মদীনা) থেকে চাপ প্রয়োগ করে বের করে দিয়েছে। বনি উমাইয়া আমাদের উপর অত্যাচার করেছে। হে আল্লাহ , আমাদের অধিকারকে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিন এবং এ অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।”
এরপর তিনি সেখান থেকে অগ্রসর হলেন এবং বুধবার অথবা মঙ্গলবার ৬১ হিজরির ২রা মহররমের দিন কারবালায় প্রবেশ করলেন। এরপর তিনি তার সাথীদের দিকে ফিরে বললেন ,“
লোকজন পৃথিবীর দাস এবং ধর্ম শুধু তাদের মুখের কথা এবং তারা এর যত্ন নিবে যতক্ষণ তা তাদের জন্য আনন্দদায়ক এবং যখন পরীক্ষার উত্তপ্ত পাত্র এসে যায় তখন থাকে শুধু গুটিকয়েক ধার্মিক ব্যক্তি।”
এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন ,“
এটি কি কারবালা ?”
লোকজন উত্তর দিলো , হ্যাঁ। তিনি বললেন ,“
এ জায়গা হলো দুঃখ ও মুসিবতের জায়গা এবং এ জায়গা আমাদের উটগুলোর বিশ্রামস্থান , আমাদের থামার জায়গা , আমাদের শাহাদাতের জায়গা , যেখানে আমাদের রক্ত ঝরানো হবে।”
তখন তারা সেখানে ঘোড়া থেকে নামলেন এবং আল হুর এক হাজার সৈন্যের সাথে ঘোড়া থেকে নামলেন মুখোমুখি হয়ে। এরপর তিনি উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের কাছে লিখলেন যে , হোসেইন কারবালায় শিবির গেড়েছে।