কারবালায় ইমাম হোসেইন (আ.)
‘
বিহারুল আনওয়ার’
-এ লেখা হয়েছে যে , উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ (কারবালায়) উমর বিন সা’
আদের কাছে সৈন্য পাঠাতেই থাকে যতক্ষণ পর্যন্তনা অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈান্যর সংখ্যা ত্রিশ হাজারে পৌঁছায়। এরপর উবায়দুল্লাহ উমরের কাছে লিখে পাঠায় ,“
আমি তোমার জন্য সৈন্যদল (এর সংখ্যা) সম্পর্কে কোন অজুহাতের সুযোগ রাখি নি। তাই আমাকে তোমাদের বিষয়ে সংবাদ জানানোর কথা মনে রেখো , প্রত্যেক সকালে ও বিকালে।”
উবায়দুল্লাহ যুদ্ধের জন্য উমরকে উস্কাতে শুরু করে ছয় মহররম থেকে।
হাবীব বিন মুযাহির ইমাম হোসেইন (আ.) এর কাছে এলেন এবং তাকে বললেন ,“
হে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সন্তান , বনি আসাদের একটি শাখা গোত্র কাছেই আছে। যদি আপনি অনুমতি দেন , আমি তাদের কাছে যাবো এবং আপনাকে সাহায্য করার জন্য তাদেরকে আহ্বান জানাবো ; সম্ভবত আল্লাহ তাদের মাধ্যমে আপনাকে রক্ষা করবেন।”
ইমাম তাকে অনুমতি দিলেন এবং হাবীব রাতের অন্ধকারে , ছদ্মবেশ নিয়ে তাদের দিকে গেলেন। তারা তাকে চিনতে পারলো এবং তার কাছে জানতে চাইলো তিনি কী চান। হাবীব বললেন ,“
আমি তোমাদের কাছে শ্রেষ্ঠ উপহার নিয়ে এসেছি। আমি তোমাদের কাছে এসেছি তোমাদেরকে আহ্বান জানাতে রাসূলের নাতিকে সাহায্য করার জন্য। তিনি এখানেই আছেন একদল বিশ্বাসীকে সাথে নিয়ে। তাদের প্রত্যেকে এক হাজার লোকের চাইতে উত্তম এবং তারা তাকে পরিত্যাগ করবে না , বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না এবং তাকে তুলে দিবে না (শত্রুর হাতে) । উমর বিন সা’
আদ তাদেরকে ঘেরাও করে আছে , তোমরা আমার গোত্রের লোক , তাই আমি তোমাদেরকে যুদ্ধের দিকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আজ আমার কথা শোন এবং তাকে সাহায্য করো , যেন পৃথিবীতে ও আখেরাতে সম্মান লাভ করতে পারো। আমি আল্লাহ শপথ করে বলছি , তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহর পথে শহীদ হবে রাসূলুল্লাহর নাতির সাথে থেকে , সে মুহাম্মাদ (সা.) এর বন্ধুদের মাঝে উচ্চ মাক্বাম অর্জন করবে।”
এ কথা শুনে তাদের মাঝে উবায়দুল্লাহ বিন বাশীর নামে এক লোক উঠে দাড়ালো এবং বললো ,“
আমি সর্বপ্রথম এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করছি।”
এরপর সে এ কবিতাটি আবৃত্তি করলো ,“
জাতি জানে অশ্বারোহীরা প্রস্তুত যুদ্ধের জন্য। আমি একজন যোদ্ধা , সাহসী , বনের সিংহের মত।”
তখন গোত্রের লোকেরা জড়ো হলো এবং নব্বই জন প্রস্তুত হলো ইমাম হোসেইন (আ.) কে সাহায্য করতে যাওয়ার জন্য।
সে মুহূর্তে তাদের মাঝে একজন লোক উমর বিন সা’
আদকে গিয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানালো এবং সে ইবনে আযরাক্বকে পাঠালো বনি আসাদের দিকে চারশ অশ্বারোহী সৈন্য দিয়ে। যখন তারা (বনি আসাদ সাহায্য করার জন্য) ইমাম হোসেইন (আ.) এর সৈন্যদলের দিকে আসছিলো তখন উমর বিন সা’
আদ তাদেরকে ফোরাত নদীর তীরে থামিয়ে দিলো। তাদের মধ্যে তর্ক শুরুহলো এবং তা ভয়ানক এক যুদ্ধে পরিণত হলো। হাবীব বিন মুযাহির আযরাক্বকে উচ্চ কণ্ঠে ডেকে বললেন ,“
আক্ষেপ তোমার জন্য , আমাদের উপর থেকে হাত সরাও।”
কিন্তু আযরাক্ব তা করতে অস্বীকৃতি জানালো। যখন বনি আসাদ উপলব্ধি করলো যে তারা তাদের প্রতিরোধ করতে অক্ষম , তখন তারা তাদের গোত্রের দিকে ফিরে গেলো। সে রাতে তারা তাদের স্থান ত্যাগ করলো উমর বিন সা’
আদের ভয়ে। হাবীব ইমাম (আ.) এর কাছে ফিরে এলেন এবং তাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানালেন এবং ইমাম বললেন ,“
কোন শক্তি ও ক্ষমতা নেই আল্লাহর সাথে ছাড়া যিনি সর্বোচ্চ সবচেয়ে বড়।”
উমর বিন সা’
আদের লোকেরা পিছনে সরে এলো এবং ইমাম হোসেইন (আ.) ও তার সাথীদের জন্য পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিলো। এতে প্রচণ্ড পিপাসা তাদেরকে কষ্ট দিচ্ছিলো। ইমাম একটি তীর তুলে নিলেন এবং নারীদের তাঁবুর পিছনে চলে গেলেন এবং পশ্চিম দিকে নয় কদম মেপে মাটি খুঁড়তে লাগলেন। মিষ্টি পানি সেখানে বেরিয়ে এলো। যা ইমাম এবং তার সাথীরা পান করলেন এবং তাদের মশকে ভরে নিলেন , এরপর পানি অদৃশ্য হয়ে গেলো এবং আর খুঁজে পাওয়া গেলো না।
যখন এ সংবাদ উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের কাছে পৌছলো সে একজনকে উমর বিন সা’
আদের কাছে পাঠালো এ বলে ,“
আমি সংবাদ পেয়েছি হোসেইন কুয়া খুঁড়ছে এবং তার সাথীদের নিয়ে সেখান থেকে পানি পান করছে। তাই যখন এ চিঠি তোমার কাছে পৌঁছবে , সাবধান হবে এবং যতটুকু সম্ভব তাদের কুয়া খুঁড়তে এবং পানি পান করতে বাধা দিবে। এরপর তাদেরকে কষ্ট দাও যেভাবে (খলিফা) উসমান বিন আফফানকে কষ্ট দেয়া হয়েছিলো।”
যখন এ চিঠি উমর বিন সা’
আদের কাছে পৌঁছালো সে তাদের উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিলো।
মুহাম্মাদ বিন তালহা এবং আলী বিন ঈসা ইরবিলি বর্ণনা করেন যে , যখন পিপাসা বৃদ্ধি পেলো , ইমামের সাথীদের মধ্য থেকে একজন ধার্মিক ব্যক্তি ইয়াযীদ বিন হাসীন হামাদানি , ইমাম হোসেইন (আ.) এর কাছে গেলেন এবং বললেন ,“
হে আল্লাহর রাসূলের সন্তান , আমাকে অনুমতি দিন উমর বিন সা’
আদের কাছে যেতে এবং পানি সম্পর্কে তার সাথে কথা বলতে , সম্ভবত সে তা থেকে বিরত থাকবে।”
ইমাম একমত হলেন এবং ইয়াযীদ বিন হাসীন হামাদানি উমর বিন সা’
দের কাছে গেলেন কিন্তু তাকে সালাম জানালেন না। উমর বললো ,“
হে হামাদানের ভাই , তুমি কি আমাকে মুসলমান মনে করো না , কারণ তুমি আমাকে সালাম দাও নি ?”
ইয়াযীদ বিন হাসীন বললেন ,“
তুমি যদি মুসলমানই হতে , যে রকম তুমি বলছো , তাহলে তুমি তার জন্য , তার ভাইদের জন্য , তার পরিবারের নারী সদস্য ও পরিবারের জন্য ফোরাতের পানি বন্ধ করতে না যেন তারা তৃষ্ণায় মারা যায় , যে পানি শুকর ও বন্য কুকুররা পান করে। তুমি তাদেরকে তা থেকে (পানি) নিতে দিচ্ছো না এবং এরপর দাবী কর যে আল্লাহ ও তার রাসূলকে স্বীকৃতি দাও ?”
উমর বিন সা’
আদ তার মাথা নিচু করলো (লজ্জায়) এবং বললো ,“
হে হামাদানের ভাই , আমি ভালো করেই জানি যে তাদের উপর অত্যাচার করা অবৈধ। কিন্তু উবায়দুল্লাহ , সমস্ত সমাজকে বাদ দিয়ে আমাকে একটি কঠিন কাজের জন্য বাছাই করেছে এবং আমি তা করার জন্য তৎক্ষণাৎ রওনা করেছি। আল্লাহর শপথ , আমি বুঝতে পারছি না এবং এক বিপজ্জনক বাঁকে আমি থেমে আছি , যা আমি পছন্দ করছি না। আমি কি রেই-এর শাসকের পদ পরিত্যাগ করবো যা আমি চাই অথবা আমি ফিরে যাবো ইমামের রক্ত আমার ঘাড়ে নিয়ে। তার হত্যা হবে (জাহান্নামের) আগুনে প্রবেশ করার একটি কারণ , যা এড়ানো যাবে না। কিন্তু রেই-এর রাজ্য আমার চোখের শীতলতা।”
আবু জাফর তাবারি এবং আবুল ফারাজ ইসফাহানি বলেন যে: যখন ইমাম হোসেইন (আ.) ও তার সাথীদের পিপাসা বৃদ্ধি পেলো , তিনি তার ভাই আব্বাস বিন আলী (আ.) কে ডাকলেন এবং তাকে ত্রিশ জন অশ্বারোহী এবং বিশ জন পদাতিক সৈন্য ও বিশটি মশক দিয়ে নদীতে পাঠালেন। তারা নদীতে পৌঁছলো রাতের বেলা এবং নাফে’
বিন হিলাল বাজালি একদম সামনে ছিলেন একটি পতাকা নিয়ে। আমর বিন হাজ্জাজ যুবাইদি তাকে দেখলো এবং তাকে জিজ্ঞেস করলো তিনি কে। নাফে’
তার পরিচয় প্রকাশ করলেন। এতে আমর বললো ,“
স্বাগতম হে ভাই , কেন এখানে এসেছো ?”
নাফে’
বললো ,“
আমি পানি নিতে এসেছি যা তোমরা আমাদের জন্য অবরোধ করে রেখেছো।”
আমর বললো ,“
যাও তৃপ্তিসহ পান করো।”
নাফে’
বললেন ,“
আল্লাহর শপথ , আমি এ থেকে এক ফোঁটাও পান করবো না যতক্ষণ না ইমাম এবং তার সাথীরা পান করেন , যারা তৃষ্ণার্ত।”
এ কথা শুনে আমর বিন হাজ্জাজের সাথের লোকেরা তাদের দিকে ফিরলো এবং আমর বললো ,“
কোন পথ নেই , আমাদেরকে নিয়োগই করা হয়েছে যেন আমরা তাদেরকে পানির কাছে পৌঁছতে বাঁধা দেই।”
যখন নাফে’
র লোকেরা কাছাকাছি এলো , তিনি পদাতিক সৈন্যদের বললেন মশক ভরে নিতে। তারা মশকগুলো দ্রুত ভরে নিলো এবং আমর বিন হাজ্জাজ এবং তার সাথীরা তাদেরকে আক্রমণ করলো। তখন আব্বাস বিন আলী (আ.) এবং নাফে’
বিন হিলাল তাদেরকে আক্রমণ করলেন এবং তাদেরকে তাদের সারিতে ফেরত পাঠালেন। তখন তারা বললো ,“
যাও , আমরা তাদের থামিয়ে দিয়েছি।”
আমর বিন হাজ্জাজ এবং তার লোকেরা ফিরে এলো এবং তাদের কিছু সংখ্যক পিছন দিকে বিতাড়িত হলো। আমরের লোকদের মধ্যে সাদা’
নামে এক ব্যক্তি নাফে’
র বর্শার আঘাতে আহত হলো। সে আঘাতকে সামান্য মনে করে এর প্রতি কোন মনোযোগ দিলো না , কিন্তু পরে তার ক্ষত বেড়ে গেলো এবং এতে সে মৃত্যুবরণ করলো। এভাবে ইমামের সাথীরা তার কাছে মশকগুলো নিয়ে গেলেন।
[তাবারীর গ্রন্থে আছে] ইমাম হোসেইন (আ.) আমর বিন ক্বারতাহ আনসারীকে উমর বিন সা’
আদের কাছে বলে পাঠালেন ,“
আমার সাথে দেখা করার জন্য আজ রাতেই সৈন্যদলের মাঝখানে আসো।”
উমর বিশ জন অশ্বারোহী নিয়ে এলো এবং ইমামও একই সংখ্যায় সাথী নিয়ে গেলেন। যখন তারা মুখোমুখি হলেন , ইমাম তার সাথীদের দূরে সরে যেতে বললেন এবং উমরও তার সাথীদের তাই করতে বললো। দুদলই দূরে সরে গেলো এবং তারা কথা বলতে লাগলেন পরস্পরের সাথে এবং রাতের এক অংশ পার হয়ে গেলো। এরপর তারা তাদের সৈন্যদলের কাছে ফিরে গেলেন এবং কেউ জানে না তাদের মাঝে কী আলোচনা হয়েছিলো। কিন্তু সুস্থ মস্তিস্কের লোকেরা বলে যে ইমাম উমর বিন সা’
আদকে বললেন ,“
ইয়াযীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে আমার সাথী হও এবং তার দল ত্যাগ করো।”
উমর বললো ,“
আমার বাড়ি ধ্বংস করা হবে (যদি আমি তা করি) ।”
ইমাম বললেন ,“
আমি তা (আবার) তৈরী করে দিবো তোমার জন্য।”
সে বললো ,“
আমার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।”
ইমাম বললেন ,“
আমি তোমাকে আমার হিজাযের সম্পত্তি থেকে তার চেয়ে ভালো কিছু দিবো।”
কিন্তু উমর তা নিয়ে সন্তুষ্ট হলো না। এ ধরনের সংবাদ লোকজনের ভেতর আলোচিত হতো , কিন্তু তারা কিছু শোনে নি ও জানতো না।
শেইখ মুফীদ বর্ণনা করেন যে , ইমাম একজনকে উমর বিন সা’
আদের কাছে বলে পাঠালেন যে , তিনি তার সাথে কথা বলতে চান। এরপর তারা রাতে দেখা করেন এবং পরস্পরের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। এরপর উমর বিন সা’
আদ তার জায়গায় ফেরত এসে উবায়দুল্লাহকে লিখলো ,“
আম্মা বা’
আদ , আল্লাহ (ঘৃণার) আগুনকে নিভিয়ে দিয়েছেন এবং জনগণকে একমতে উপস্থিত করেছেন এবং উম্মতের বিষয়গুলো ঠিক করে দিয়েছেন। হোসেইন আমার কাছে অঙ্গীকার করেছে যে , সে যে জায়গা থেকে এসেছে সে জায়গায় ফিরে যাবে অথবা কোন ইসলামী সীমান্ত শহরে চলে যাবে এবং অন্যান্য সাধারণ মুসলমানের মতই জীবন যাপন করবে। অথবা সে ইয়াযীদের কাছে যাবে এবং তার হাতে হাত রাখবে এবং তাদের ভিতর মতপার্থক্য দূর হবে এবং এ প্রস্তাব হলো তাই যা আপনি পছন্দ করেন এবং যাতে উম্মতের সোজা পথ নিহিত আছে।”
আবুল ফারাজ লিখেছেন যে , উমর একজন দূতকে এ প্রস্তাব দিয়ে উবায়দুল্লাহর কাছে পাঠালো এবং তাকে জানালো যে ,“
যদি কোন দায়লামি তা আপনার কাছে চাইতো এবং আপনি তাতে রাজী না হতেন , সেক্ষেত্রে আপনি অবিচার করতেন।”
তাবারি এবং ইবনে আসীর বর্ণনা করেন , উক্ববা বিন সাম’
আন থেকে যে , তিনি বলেছেন: আমি ইমাম হোসেইন (আ.) এর সাথে মদীনা থেকে মক্কায় এলাম এবং মক্কা থেকে ইরাক এবং তার একটি খোতবাও নেই যা আমি শুনি নি , হোক তা মদীনাতে , মক্কায় অথবা ইরাকের পথে এবং তার সৈন্যদলের মাঝে , তার শাহাদাত পর্যন্ত। আল্লাহর শপথ , যে সংবাদটি মানুষের কাছে সুপরিচিত যে , ইমাম হোসেইন (আ.) সিরিয়া যেতে এবং ইয়াযীদের হাতে হাত দিতে একমত হয়েছিলেন অথবা ইসলামী সীমান্ত শহরে চলে যেতে চেয়েছিলেন , তা কখনোই তিনি বলেন নি , বরং তিনি বলেছিলেন যে ,“
আমাকে যেতে দাও যেন আমি এ প্রশস্ত পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে পারি যতক্ষণ পর্যন্তনা আমি জনগণের অবস্থা কোথায় গিয়ে পৌঁছায় তা দেখি।”