আশুরার (দশ মহররম) রাতের ঘটনাবলী
[‘
ইরশাদ’
গ্রন্থে আছে] ইমাম হোসেইন (আ.) তার সাথীদের রাতের বেলা জড়ো করলেন , ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন যে , আমি তাদের কছে গেলাম শোনার জন্য তারা কী বলেন এবং সে সময় আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি শুনলাম ইমাম তার সাথীদের বলছেন ,
“
আমি আল্লাহর প্রশংসা করি সর্বোত্তম প্রশংসার মাধ্যমে এবং তাঁর প্রশংসা করি সমৃদ্ধির সময়ে এবং দুঃখ দুর্দশার মাঝেও। হে আল্লাহ , আমি আপনার প্রশংসা করি এ জন্য যে , আপনি আমাদের পরিবারে নবুয়াত দান করতে পছন্দ করেছেন। আপনি আমাদের কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং ধর্মে আমাদেরকে বিজ্ঞজন করেছেন এবং আমাদেরকে দান করেছেন শ্রবণ শক্তি ও দূরদৃষ্টি এবং আলোকিত অন্তর। তাই আমাদেরকে আপনার কৃতজ্ঞ বান্দাহদের দলে দাখিল করুন। আম্মা বা’
আদ , আমি তোমাদের চেয়ে বিশস্ত এবং ধার্মিক কোন সাথীকে পাই নি , না আমি আমার পরিবারের চাইতে বেশী বিবেচক , স্নেহশীল , সহযোগিতাকারী ও সদয় কোন পরিবারকে দেখেছি। তাই আল্লাহ আমার পক্ষ থেকে তোমাদেরকে উত্তমভাবে পুরস্কৃত করুন এবং আমি মনে করি শত্রুরা একদিনও অপেক্ষা করবে না এবং আমি তোমাদের সবাইকে অনুমতি দিচ্ছি স্বাধীনভাবে চলে যাওয়ার জন্য এবং আমি তা তোমাদের জন্য বৈধ করছি। আমি তোমাদের উপর থেকে আনুগত্য ও শপথের দায়ভার তুলে নিচ্ছি (যা তোমরা আমার হাতে হাত দিয়ে শপথ করেছিলে) । রাতের অন্ধকার তোমাদের ঢেকে দিয়েছে , তাই নিজেদের মুক্ত করো ঘূর্ণিপাক থেকে অন্ধকারের ঢেউয়ের ভেতরে। আর তোমাদের প্রত্যেকে আমার পরিবারের একজনের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ো গ্রাম ও শহরগুলোতে , যতক্ষণ না আল্লাহ তোমাদের মুক্তি দান করেন। কারণ এ লোকগুলো শুধু আমাকে চায় এবং আমার গায়ে হাত দেয়ার পরে তারা আর কারো পেছনে ধাওয়া করবে না।”
এ কথা শুনে তার ভাইয়েরা , সন্তানরা , ও ভাতিজারা এবং আব্দুল্লাহ বিন জাফরের সন্তানরা বললেন ,“
আামরা তা কখনোই করবো না আপনার পরে বেঁচে থাকার জন্য। আল্লাহ যেন কখনো তা না করেন।”
হযরত আব্বাস বিন আলী (আ.) সর্বপ্রথম এ ঘোষণা দিলেন এবং অন্যরা তাকে অনুসরণ করলেন।
ইমাম তখন আক্বীল বিন আবি তালিবের সন্তানদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন ,“
মুসলিমের আত্মত্যাগ তোমাদের জন্য যথেষ্ট হয়েছে , তাই আমি তোমাদের অনমতি দিচ্ছি চলে যাওয়ার জন্য।”
তারা বললেন ,“
সুবহানাল্লাহ , লোকেরা কী বলবে ? তারা বলবে আমরা আমাদের প্রধানকে , অভিভাবককে এবং চাচাতো ভাইকে , যে শ্রেষ্ঠ চাচাতো ভাই , পরিত্যাগ করেছি এবং আমরা তার সাথে থেকে তীর ছুড়িনি , বর্শা দিয়ে আঘাত করি নি এবং তার সাথে থেকে তরবারি চালাই নি এবং তখন আমরা (এ অভিযোগের মুখে) বুঝতে পারবো না কী করবো ; আল্লাহর শপথ , আমরা তা কখনোই করবো না। প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের জীবন , সম্পদ ও পরিবার আপনার জন্য কোরবানী করবো। আমরা আপনার পাশে থেকে যুদ্ধ করবো এবং আপনার পাশে থেকে পরিণতিতে পৌঁছে যাবো। আপনার পরে জীবন কুৎসিত হয়ে যাক (যদি বেঁচে থাকি) ।”
এরপর মুসলিম বিন আওসাজা উঠলেন এবং বললেন ,“
আমরা আপনাকে কি পরিত্যাগ করবো ? তারপর যখন আল্লাহর সামনে যাবো তখন তার সামনে আপনার অধিকার পূরণের বিষয়ে আমরা কী উত্তর দিবো ? না , আল্লাহর শপথ , আমি আমার এ বাঁকা তরবারি শত্রুদের হৃৎপিণ্ডে ঢুকিয়ে দিবো এবং আমি তাদেরকে আমার তরবারি দিয়ে আঘাত করতেই থাকবো যতক্ষণ না এর শুধু হাতলটা আমার হাতে থাকে। আর যদি তাদের সাথে যুদ্ধ করার মতো আমার হাতে কোন অস্ত্র আর না থাকে তাহলে আমি তাদেরকে পাথর দিয়ে আক্রমণ করবো। আল্লাহর শপথ , আমরা আপনার হাত থেকে আমাদের হাত তুলে নিবো না যতক্ষণ না আল্লাহর কাছে প্রমাণিত হয় যে আমরা আপনার বিষয়ে নবীর সম্পর্ককে সম্মান দিয়েছি। আল্লাহ শপথ , যদি এমনও হয় যে , আমি জানতে পারি যে আমাকে হত্যা করা হবে এবং এরপর আমাকে আবার জাগ্রত করা হবে এবং এরপর হত্যা করা হবে এবং পুড়িয়ে ফেলা হবে এবং আমার ছাই চারদিকে ছড়িয়ে দেয় হবে এবং তা যদি সত্তর বারও ঘটে , তারপরও আমি আপনাকে পরিত্যাগ করবো না যতক্ষণ না আপনার আনুগত্যে আমি নিহত হই। তাহলে কিভাবে আমি তা পরিত্যাগ করবো যখন জানি যে মৃত্যু শুধু একবার আসবে যার পরে এক বিরাট রহমত আমার জন্য অপেক্ষা করছে ?”
এরপর যুহাইর বিন ক্বাইন উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন ,“
আল্লাহর শপথ , আমি খুবই ভালোবাসবো যদি আমাকে হত্যা করা হয় এবং এরপর জীবিত করা হয় এবং এরপর আবারও হত্যা করা হয় এবং তা এক হাজারবার ঘটে এবং এভাবে সর্বশক্তিমান ও মহান আল্লাহ যেন আপনাকে ও আপনার পরিবারকে নিহত হওয়া থেকে রক্ষা করেন।”
এরপর অন্যান্য সব সাথীরা তানরপাবি ত্ত করেন , [তাবারি] তারা বললেন ,“
আল্লাহর শপথ , আমরা আপনাকে পরিত্যাগ করবো না , বরং আমাদের জীবন আপনার জীবনের জন্য কোরবানী হবে। আমরা আপনাকে রক্ষা করবো আমাদের ঘাড় , চেহারা ও হাত দিয়ে। এরপর আমরা সবাই মৃত্যুবরণ করবো দায়িত্ব পালন শেষে।”
নিচের যুদ্ধ কবিতাটি তাদের আলোচনাকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলে ,
“
হে আমার অভিভাবক , যদি আমার শ্রেষ্ঠত্বের সিংহাসন আরশ পর্যন্ত পৌঁছায় তবুও আমি আপনার চাকর হয়ে এবং আপনার দরজায় ভিক্ষুক হয়ে থাকবো এবং যদি আমি আমার হৃদয় ও এর ভালোবাসাকে আপনার কাছ থেকে তুলে নিই তাহলে কাকে আমি ভালোবাসবো এবং আমার হৃদয়কে কোথায় নিয়ে যাবো ?”
আল্লাহ তাদেরকে ইমাম হোসেইন (আ.) এর বিষয়ে উদারভাবে দান করুন। এরপর ইমাম হোসেইন (আ.) তার তাঁবুতে ফিরে গেলেন।
“
আল্লাহ সেই যুবকদের পুরস্কৃত করুন যারা ধৈর্যের সাথে সহ্য করেছেন , তারা ছিলেন পৃথিবীর যে কোন জায়গায় অতুলনীয়। তারা ছিলেন উত্তম চরিত্রের প্রতিচ্ছবি এবং বাটির পানি মিশ্রিত দুধ নয় যা পরে পেশাবে পরিণত হয়।”
সাইয়েদ ইবনে তাউস বর্ণনা করেছেন যে , মুহাম্মাদ বিন বাশার হাযরামীকে বলা হলো যে ,“
তোমার ছেলেকে‘
রেই’
শহরের সীমান্তে গ্রেফতার করা হয়েছে।”
তিনি উত্তর দিলেন ,“
আমি তাকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করলাম। আমার জীবনের শপথ , তার গ্রেফতার হওয়ার পর আমি বেঁচে থাকতে চাই না।”
ইমাম হোসেইন (আ.) তার কথাগুলো শুনতে পেলেন এবং বললেন ,“
তোমার আল্লাহ তোমার উপর রহমত করুন , আমি তোমার কাছ থেকে বাইয়াত তুলে নিলাম , তুমি যেতে পারো এবং তোমার ছেলেকে মুক্ত করার চেষ্টা করো।”
তিনি বললেন ,“
আমি যদি আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হই আমি হিংস্র পশুদের শিকার হয়ে যাবো।”
এতে ইমাম বললেন ,“
তাহলে এ ইয়েমেনী পোষাকগুলো দিয়ে তোমার অন্য ছেলেকে পাঠাও , যেন সে তাকে এগুলোর বিনিময়ে মুক্ত করতে পারে।”
তিনি মুহাম্মাদ বিন বাশারকে পাঁচটি পোষাক দিলেন যার মূল্য এক হাজার স্বর্ণের দিনার।
হোসেইন বিন হামদান হাযীনি তার বর্ণনা ধারা বজায় রেখে আবু হামযা সূমালি থেকে বর্ণনা করেন এবং সাইয়েদ বাহরানি বর্ণনার ক্রমধারা উল্লেখ না করেই তার কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন যে , তিনি বলেছেন যে: আমি ইমাম আলী আল যায়নুল আবেদীনকে বলতে শুনেছি , শাহাদাতের আগের রাতে আমার বাবা তার পরিবার এবং সাথীদের জড়ো করলেন এবং বললেন ,“
হে আমার পরিবারের সদস্যরা এবং আমার শিয়ারা (অনুসারীরা) , এ রাতকে ভেবে দেখো যা তোমাদের কাছে বহনকারী উট হয়ে এসেছে এবং নিজেদেরকে রক্ষা করো , কারণ লোকেরা আমাকে ছাড়া কাউকে চায় না। আমাকে হত্যা করার পর তারা তোমারদেরকে তাড়া করবে না। আল্লাহ তোমাদের উপর রহমত করুন। নিজেদেরকে রক্ষা করো। নিশ্চয়ই আমি আনুগত্য ও শপথের দায়ভার তুলে নিলাম যা তোমরা আমার হাতে করেছো।”
এ কথা শুনে তার ভাইয়েরা , আত্মীয়- স্বজন ও সাথীরা একত্রে বলে উঠলো ,“
আল্লাহর শপথ হে আমাদের অভিভাবক , হে আবা আবদিল্লাহ আমরা আপনার সাথে কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করবো না , তাতে লোকেরা বলতে পারে যে আমরা আমাদের ইমামকে , প্রধানকে এবং অভিভাবককে পরিত্যাগ করেছি এবং তাকে শহীদ করা হয়েছে। তখন আমরা আমাদের ও আল্লাহর মাঝে ওজর খুঁজবো। আমরা আপনাকে কখনোই পরিত্যাগ করবো না যতক্ষণ না আমরা আপনার জন্য কোরবান হই।”
ইমাম বললেন ,“
নিশ্চয়ই আগামীকাল আমাকে হত্যা করা হবে এবং তোমাদের সবাইকে আমার সাথে হত্যা করা হবে এবং তোমাদের কাউকে রেহাই দেয়া হবে না।”
তারা বললেন ,“
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যে তিনি আমাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন আপনাকে সাহায্য করার জন্য এবং আমাদেরকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন আপনার সাথে শহীদ হওয়ার জন্য। তাহলে কি আমরা পছন্দ করবো না যে আমরা আপনার সাথে উচ্চ মাক্বামে (বেহেশতে) থাকবো , হে রাসূলুল্লাহর সন্তান ?”
ইমাম বললেন ,“
আল্লাহ তোমাদের উদারভাবে পুরস্কৃত করুন।”
এরপর তিনি তাদের জন্য দোআ করলেন। যখন সকাল হল , তাদের সবাইকে শহীদ করে ফেলা হল।
তখন ক্বাসিম বিন হাসান (আ.) জিজ্ঞেস করলেন ,“
আমি কি শহীদদের তালিকায় আছি ?”
তা শুনে ইমাম আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন এবং বললেন ,“
হে আমার প্রিয় সন্তান , তুমি মৃত্যুকে তোমার কাছে কিভাবে দেখো ?”
ক্বাসিম বললেন ,“
মধুর চেয়ে মিষ্টি।”
ইমাম বললেন ,“
নিশ্চয়ই , আল্লাহর শপথ , তোমার চাচা তোমার জন্য কোরবান হোক , তুমি তাদের একজন যাদেরকে শহীদ করা হবে আমার সাথে কঠিন অবস্থার শিকার হওয়ার পর এবং আমার (শিশু) সন্তান আব্দুল্লাহকেও (আলী আসগার) শহীদ করা হবে।”
এ কথা শুনে ক্বাসিম বললেন ,“
হে চাচাজান , তাহলে কি শত্রুরা মহিলাদের কাছে পৌঁছে যাবে দুধের শিশু আব্দুল্লাহকে (আলী আসগারকে) হত্যা করতে ?”
ইমাম বললেন ,“
আব্দুল্লাহকে হত্যা করা হবে তখন , যখন আমি প্রচণ্ড পিপাসার্ত হয়ে ফিরে আসবো তাঁবুতে এবং পানি অথবা মধু চাইতে , কিন্তু কিছুই পাওয়া যাবে না। তখন আমি অনুরোধ করবো আমার সন্তানকে আমার কাছে আনার জন্য যেন আমি তার ঠোঁটে চুমু দিতে পারি (এবং এর মাধ্যমে স্বস্তিপাই) । সন্তানকে আনা হবে এবং আমার হাতে দেয়া হবে এবং একজন (শত্রুদের মাঝ থেকে) জঘন্য ব্যক্তি একটি তীর ছুঁড়বে তার গলায় এবং বাচ্চাটি চিৎকার করে উঠবে। তখন তার রক্ত আমার দুহাতে ভরে যাবে এবং আমি আমার হাত দুটো আকাশের দিকে তুলে বলবো: হে আল্লাহ , আমি সহ্য করছি এবং হিসাব নিকাশ আপনার কাছে ছেড়ে দিচ্ছি। তখন শত্রুদের বর্শা আমার দিকে দ্রুত ছুঁড়ে দেয়া হবে এবং তাঁবুর পেছনে খোড়া গর্তের ভিতর আগুন গর্জন করতে থাকবে। এরপর আমি তাদেরকে আক্রমণ করবো। সে সময়টি হবে আমার জীবনের সবচেয়ে তিক্ত সময়। এরপর আল্লাহ যা চান তাই ঘটবে।”
এ কথা বলে ইমাম কাঁদতে লাগলেন এবং আমরাও অশ্রু নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। আল্লাহর রাসূল (সা.) এর সন্তানের তাঁবু থেকে কান্নার সুর উঠলো।
আবু হামযা সুমালি থেকে কুতুবুদ্দীন রাওয়ানদি বর্ণনা করেন যে , ইমাম আলী আল যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেছেন যে: আমি আমার বাবার (ইমাম হোসেইনের) সাথে ছিলাম তার শাহাদাতের আগের রাতে। তখন তিনি তার সাথীদের সম্বোধন করে বললেন:“
এ রাতকে তোমাদের জন্য বর্ম মনে করো কারণ এ লোকগুলো আমাকে চায় এবং আমাকে হত্যা করার পর তারা তোমাদের দিকে ফিরবে না , এখন তোমাদেরকে ক্ষমা করা হচ্ছে এবং (এখনও) তোমরা সক্ষম।”
তারা বললো ,“
আল্লাহর শপথ , তা কখনোই ঘটবে না।”
ইমাম বললেন ,“
আগামীকাল তোমাদের সবাইকে হত্যা করা হবে এবং কাউকে রেহাই দেয়া হবে না।”
তারা বললো ,“
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন আপনার সাথে শহীদ হওয়ার জন্য।”
তখন ইমাম তাদের জন্য দোআ করলেন এবং তাদের মাথা তুলতে বললেন। তারা তাই করলেন এবং বেহেশতে তাদের মর্যাদা দেখতে পেলেন এবং ইমাম তাদের প্রত্যেককে সেখানে তাদের স্থান দেখালেন। এর ফলে প্রত্যেকে তাদের চেহারা ও বুক তরবারির দিকে এগিয়ে দিচ্ছিলেন বেহেশতের সেই মর্যাদায় প্রবেশ করার জন্য।
শেইখ সাদুক্বের‘
আমালি’
তে ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে , তিনি বলেছেন যে: সাথীদের সাথে ইমামের আলোচনার পর তিনি আদেশ দিলেন তার সেনাদলের চারদিকে একটি গর্ত খোঁড়ার জন্য। গর্ত খোঁড়া হলো এবং তা জ্বালানী কাঠ দিয়ে পূর্ণ করা হলো। এরপর ইমাম তার ছেলে আলী আকবার (আ.) কে পানি আনতে যেতে বললেন ত্রিশ জন ঘোড়সওয়ার ও বিশ জন পদাতিক সৈন্যসহ। তারা বেশ ভীতির ভিতর ছিলেন এবং ইমাম নিচের কবিতাটি আবৃত্তি করতে লাগলেন ,
“
হে সময় , বন্ধু হিসেবে তোমার লজ্জা হওয়া উচিত , প্রভাত হওয়ার সময় ও সূর্যাস্তের সময় , কত সাথী অথবা সন্ধানকারী লাশে পরিণত হবে , সময় এর পরিবর্তে অন্য কাউকে নিয়ে সন্তুষ্ট হবে না , বিষয়টি ফায়সালার ভার থাকবে সর্বশক্তিমানের কাছে এবং প্রত্যেক জীবিত প্রাণীকে আমার পথে ভ্রমণ করতে হবে।”
এরপর তিনি তার সাথীদের আদেশ করলেন ,“
পানি পান করো , যা এ পৃথিবীতে তোমাদের শেষ রিয্ক্ব এবং অযু করো এবং গোসল করে নাও। তোমাদের জামা কাপড়গুলো ধুয়ে নাও , কারণ সেগুলো হবে তোমাদের কাফন।”
[‘
ইরশাদ’
গ্রন্থে আছে] ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেছেন যে , আমার বাবার শাহাদাতের আগের রাতে আমি জেগে ছিলাম এবং আমার ফুপু হযরত যায়নাব (আ.) আমার শুশ্রূষা করছিলেন। আমার বাবা তার তাঁবুতে একা ছিলেন এবং আবু যার গিফারীর দাস জন তার সাথে ছিলো এবং সে উনার তরবারি প্রস্তুত করছিলো ও মেরামত করছিলো। আমার বাবা এ কবিতাটি আবৃত্তি করছিলেন ,“
(হে) সময় , বন্ধু হিসেবে তোমার লজ্জা হওয়া উচিত প্রভাত হওয়ার সময় এবং সূর্যাস্তের সময় , কত সাথী অথবা সন্ধানকারীই না লাশে পরিণত হবে , সময় এর বদলে অন্য কাউকে নিয়ে সন্তুষ্ট হবে না , বিষয়টির ফায়সালার ভার থাকবে সর্বশক্তিমানের কাছে এবং প্রত্যেক জীবিত প্রাণীকে আমার পথে ভ্রমণ করতে হবে।”
তিনি তা দুবার অথবা তিন বার বললেন এবং বুঝতে পারলাম তিনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন এবং আমি শোকার্ত হলাম কিন্তু নীরবে তা সহ্য করলাম এবং বুঝলাম যে আমাদের উপর দুরযোগ নেমে এসেছে। আমার ফুপু যায়নাব ও (আ.) তা শুনতে পেয়েছিলেন। অনুভূতি এবং দুশ্চিন্তা নারীদের বৈশিষ্ট্য , তাই তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। তিনি নিজের পোষাক ছিড়ে মাথার চাদর ছাড়া আমার বাবার দিকে দৌড়ে গেলেন এবং বললেন: আক্ষেপ এ মর্মান্তিক ঘটনার জন্য , আমার যেন মৃত্যু হয়ে যায়। আজ আমার মা ফাতিমা (আ.) , আমার বাবা আলী (আ.) এবং আমার ভাই হাসান (আ.) আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। হে তাদের উত্তরাধিকারী , যারা বিদায় নিয়েছে , হে জীবিতদের আশা।
ইমাম তার বোনের দিকে ফিরলেন এবং বললেন ,“
হে প্রিয় বোন , শয়তান যেন তোমার সহনশীলতা কেড়ে না নেয়।”
তার চোখ অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে গেলো এবং এরপর তিনি বললেন ,“
যদি মরুভূমির পাখিকে রাতে মুক্তি দেয়া হয় তাহলে সে শান্তিতে ঘুমাবে।”
তখন তিনি (যায়নাব) বললেন ,“
আক্ষেপ , তাহলে কি আপনি নৃশংসভাবে এবং অসহায়ভাবে নিহত হবেন ? তা আমার হৃদয়কে আহত করছে এবং তা আমার জীবনের উপর অত্যন্ত কঠিন।”
এরপর তিনি (যায়নাব) তার চেহারায় আঘাত করতে শুরু করলেন , জামার কলার ছিঁড়ে ফেললেন এবং অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। তখন ইমাম উঠে দাঁড়ালেন এবং তার চেহারায় পানি ছিটিয়ে দিয়ে এবং বললেন ,“
হে প্রিয় বোন , নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করো এবং একমাত্র আল্লাহর কাছে সান্তনা চাও এবং জেনো যে পৃথিবীর ওপরে যারা আছে তারা সবাই মৃত্যুবরণ করবে এবং আকাশের বাসিন্দারাও ধ্বংস হয়ে যাবে শুধু আল্লাহর সূরত (সত্তা) ছাড়া। আল্লাহ যিনি তার ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন , আবার তাদেরকে জীবিত করবেন এবং তারা সবাই তার কাছে ফেরত যাবে। আর আল্লাহ অদ্বিতীয়। আমার নানা আমার চাইতে উত্তম ছিলেন। আমার বাবা আমার চেয়ে উত্তম ছিলেন এবং আমার মা আমার চেয়ে উত্তম ছিলেন। প্রত্যেক মুসলমানের ওপরে বাধ্যতামূলক যে সে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উদাহরণ অনুসরণ করবে।”
এরপর তিনি একই ধরনের কথাবার্তা দিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিলেন এবং বললেন ,“
হে প্রিয় বোন , আমি তোমাকে শপথের মাধ্যমে অনুরোধ করছি যখন আমি শহীদ হয়ে যাবো তখন নিজের (জামার) কলার ছিঁড়ো না , চেহারায় আঘাত করো না অথবা আমার জন্য বিলাপ করো না।”
এরপর তিনি হযরত যায়নাব (আ.) কে নিয়ে এলেন এবং তাকে আমার কাছে বসালেন , তারপর নিজের সাথীদের কাছে গেলেন। এরপর তিনি তাদেরকে আদেশ দিলেন তাদের তাঁবুগুলোকে পরস্পরের কাছে বাঁধার জন্য এবং খুঁটিগুলো এক সাথে বাঁধার জন্য যেন তাদের দিকে তা বৃত্ত হয়ে দাঁড়ায় এবং তিন দিক থেকে শত্রুদের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়ার জন্য যেন তারা সামনের দিকেই শুধু তাদের মোকাবিলা করতে পারে।
এরপর ইমাম তার তাঁবুতে ফেরত গেলেন এবং সারারাত আল্লাহর কাছে ইবাদত , দোআ এবং তওবায় কাটালেন এবং তার সাথীরাও তার অনুসরণ করলেন এবং দোআ শুরু করলেন ।
বর্ণনা করা হয়েছে যে , তাদের দোআর আওয়াজ মৌমাছিদের গুনগুনের মত শোনা যাচ্ছিলো। তারা রুকু ও সিজদায় , দাঁড়িয়ে ও বসে ইবাদতে ব্যস্তছিলেন। প্রচুর নামায এবং শ্রেষ্ঠ নৈতিকতা ছিলো ইমাম হোসেইন (আ.) এর জন্য সাধারণ বিষয়। ইমাম ছিলেন সে রকম যেমন ইমাম মাহদী (আ.) যিয়ারতে নাহিয়াতে উল্লেখ করেছেন ,
“
পবিত্র কোরআন যিনি পৌঁছে দেন
এবং উম্মতের যিনি অস্ত্র
এবং যিনি আল্লাহর আনুগত্যের পথে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন
শপথ ও ঐশী চুক্তি রক্ষাকারী
আপনি সীমা অতিক্রমকারীদের পথকে ঘৃণা করতেন
বিপদগ্রস্তদের প্রতি দানশীল
যিনি রুকু ও সিজদাকে দীর্ঘ করতেন
(আপনি) পৃথিবী থেকে বিরত ছিলেন
আপনি এটিকে সব সবসময় দেখেছেন তার দৃষ্টিতে যাকে তা শীঘ্রই ছেড়ে যেতে হবে।”
‘
ইক্বদুল ফারীদ’
-এ আবু আমর আহমেদ বিন মুহাম্মাদ কুরতুবি মারওয়ানি বর্ণনা করেছেন যে , লোকজন ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন (আ.) কে জিজ্ঞেস করলো কেন তার বাবার এত অল্প সংখ্যক সন্তান ছিলো। এতে ইমাম বললেন ,“
আমি এতেও আশ্চর্য হই যে তার এ অল্প সংখ্যক সন্তানও জন্ম নিয়েছিলো কারণ তিনি প্রতিদিন এক হাজার রাকাত নামায পড়তেন। কোথায় তিনি স্ত্রীদের সাথে সাক্ষাতের সময় পেতেন ?”
[‘
মানাক্বিব’
-এ] বর্ণিত আছে যে , যখন সেহরীর সময় হলো তখন ইমাম হোসেইন (আ.) একটি বিছানায় শুলেন এবং তন্দ্রায় গেলেন। তারপর তিনি জেগে উঠলেন এবং বললেন ,“
তোমরা কি জানো আমি এখন স্বপ্নে কী দেখলাম ?”
লোকজন বললো ,“
হে আল্লাহর রাসূলের সন্তান , কী দেখেছেন ?”
ইমাম বললেন ,“
আমি দেখলাম কিছু কুকুর আমাকে আক্রমণ করেছে এবং একটি সাদাকালো কুকুর তাদের মধ্য থেকে আমার প্রতি বেশী হিংস্রতা দেখাচ্ছে এবং আমি ধারণা করছি , যে আমাকে হত্যা করবে সে এ জাতির মধ্যে একজন কুষ্ঠরোগী হবে। এরপর আমি আমার নানা আল্লাহর রাসূল (সা.) কে দেখলাম তার কিছু সাথীর সাথে। তিনি আমাকে বললেন ,‘
হে আমার প্রিয় সন্তান , তুমি মুহাম্মাদ (সা.) এর বংশের শহীদ , বেহেশতের অধিবাসীরা ও আকাশের ফেরেশতারা তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছে , আজ রাতে তুমি আমার সাথে ইফতার করবে। তাই তাড়াতাড়ি করো , আর দেরী করো না। এ ফেরেশতারা আকাশ থেকে এসেছে তোমার রক্ত সংগ্রহ করতে এবং একটি সবুজ বোতলে তা সংরক্ষণ করতে।’
নিশ্চয়ই আমি বুঝতে পারছি যে আমার শেষ অতি নিকটে এবং এখন সময় হয়েছে এ পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার এবং এতে কোন সন্দেহ নেই।”
আযদি থেকে তাবারি বর্ণনা করেছেন , তিনি আব্দুল্লাহ বিন আল-আসিম থেকে , তিনি যাহহাক বিন আব্দুল্লাহ বিন মাশরিক্বি থেকে , যিনি বলেন যে: আশুরার (দশই মহররম) রাতে ইমাম হোসেইন (আ.) এবং তার সব সাথীরা সারা রাত নামায , তওবা , দোআ ও কান্নায় কাটালেন। তিনি বলেন যে , একদল রক্ষী আমাদের পাশ দিয়ে গেল যখন ইমাম হোসেইন (আ.) কোরআন এর এ আয়াত তেলাওয়াত করছিলেন ,
)
لِيَزْدَادُوا إِثْمًا وَلَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ ( ১ ৭ ৮ ) مَا كَانَ اللَّهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ حَتَّى يَمِيزَ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ(
“
যারা অবিশ্বাস করে তারা যেন মনে না করে যে আমরা তাদের যে সময় দিচ্ছি তা তাদের জন্য ভালো , আমরা তাদের সময় দিচ্ছি শুধু এজন্যে যেন তারা গুনাহতে বৃদ্ধি পায় এবং তাদের জন্য রয়েছে অপমানকর শাস্তি। আল্লাহ বিশ্বাসীদের সে অবস্থায় ফেলে রাখবেন না যে অবস্থায় তোমরা আছো , যতক্ষণ পর্যন্তনা ভালোর কাছ থেকে খারাপকে আলাদা করবেন।”
[সূরা আলে ইমরান: ১৭৮-১৭৯]
যখন প্রহরীদের মধ্যে একজন অশ্বারোহী এ আয়াত শুনলো সে বললো ,“
কা‘
বার রবের শপথ , নিশ্চয়ই আমরা (আয়াতে উল্লেখিত) ভালো দল যাদেরকে তোমাদের কাছ থেকে আলাদা করা হয়েছে।”
যাহ্হাক বলেন যে , আমি লোকটিকে চিনতে পারলাম এবং তখন বুরাইর বিন খুযাইরকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি তাকে চিনেছেন কিনা। তিনি উত্তরে‘
না’
বললেন। আমি বললাম , সে আবু হারব সাবী’
ই আব্দুল্লাহ বিন শাহর। সে বিদ্রূপকারী , একজন সীমালঙ্ঘনকারী , যদিও ভালো বংশের লোক , সাহসী ও খুনী। সাঈদ বিন ক্বায়েস তাকে তার কোন অপরাধের কারণে গ্রেফতার করেছিলো। বুরাইর বিন খুযাইর তার দিকে ফিরলেন এবং বললেন ,“
হে বদমাশ , (তুমি কি মনে করো) আল্লাহ তোমাকে ভালোদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন ?”
সে জিজ্ঞেস করলো তিনি কে , এতে বুরাইর তার পরিচয় দিলেন। সে বললো ,“
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন , হে বুরাইর আমি তাহলে ধ্বংস হয়ে গেলাম ?”
বুরাইর বললেন ,“
তুমি কি তোমার বড় গুনাহর জন্য তওবা করছো ? আল্লাহর শপথ , আমরা সবাই ভালোর দল , আর তোমরা সবাই খারাপ দল।”
সে বললো ,“
আমিও তোমার কথার সত্যতার সাক্ষী দিচ্ছি।”
যাহহাক বলেন , তখন আমি তাকে বললাম ,“
তাহলে কি বুদ্ধিমত্তা তোমার কল্যাণে আসবে না ?”
সে বললো ,“
আমি তোমার জন্য কোরবান হই , (যদি আমি তা করি) তাহলে কে ইয়াযীদ বিন আযরাহ আনযীর সাথে থাকবে যে বর্তমানে আমার সাথে আছে।”
এ কথা শুনে বুরাইর বললেন ,“
আল্লাহ তোমার অভিমত ও তোমার নীতি নষ্ট করুন , কারণ নিশ্চয়ই তমিু সব কিছুতে ব্যর্থ এক ব্যক্তি।”
যাহহাক্ বলেন যে , তখন আবু হারব ফেরত গেলো এবং সেই রাতে আমাদের প্রহরী ছিলেন আযরাহ বিন ক্বায়েস আহমাসি , যিনি অশ্বরোহীদলের অধিনায়ক ছিলেন।
সাইয়েদ ইবনে তাউস বলেন যে , সে রাতে উমর বিন সা’
আদের দল থেকে বাইশ জন ইমাম হোসেইন (আ.) এর সাথীদের সাথে যোগ দিয়েছিলো।
‘
ইক্বদুল ফারীদ’
-এ বর্ণিত হয়েছে যে উমর বিন সা’
আদের কাছে ইমাম হোসেইন (আ.) এর তিনটি প্রস্তাবের যে কোন একটি গ্রহণের অনুরোধের কথা শুনে উমর বিন সা’
আদের পক্ষের বত্রিশজন কুফাবাসী তাকে বললো ,“
আল্লাহর রাসূলের সন্তান তোমাকে তিনটি প্রস্তাবের একটি গ্রহণ করতে বলছেন , আর তুমি এতে একমত হচ্ছো না।”
এ কথা বলে তারা তাদের দল ত্যাগ করে ইমামের কাছে চলে এলো এবং তার পাশে থেকে যুদ্ধ করলো যতক্ষণ না তারা সকলে শহীদ হয়ে গেল ।