শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)

শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)0%

শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড) লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ: ইতিহাস

শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)

লেখক: আল্লামা আব্বাস বিন মুহাম্মাদ রেযা আল কুম্মি
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ:

ভিজিট: 48986
ডাউনলোড: 4844

পাঠকের মতামত:

শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 90 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 48986 / ডাউনলোড: 4844
সাইজ সাইজ সাইজ
শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)

শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস (প্রথম খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বাংলা

দ্বিতীয় অধ্যায়

ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়া বাইয়াত দাবী করার পূর্ব থেকে

ইমাম হোসেইন (আ.) এর ওপরে কী আপতিত হয়েছিলো

ইমাম হাসান (আ.) এর শাহাদাতের পর ইরাকের শিয়াদের মাঝে একটি আন্দোলন শুরু হয়। মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত করা ও (ইমামকে সমর্থন করা) এবং তাদের প্রস্তুতি ও তার হাতে বাইয়াত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে তারা ইমাম হোসেইন (আ.) এর কাছে একটি চিঠি লেখে। তাদের চিঠির উত্তরে ইমাম হোসেইন (আ.) লেখেন যে তিনি এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেন কারণ , তাদের সাথে মুয়াবিয়ার একটি চুক্তি হয়েছে যা তারা ভঙ্গ করবেন না যতক্ষণ না এর নির্ধারিত কাল অতিক্রম হয় (মুয়াবিয়ার মৃত্যু পর্যন্ত) এবং যখন মুয়াবিয়ার মৃত্যু হবে তখন সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কী করতে হবে।

মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান ৬০ হিজরিতে রজব মাসের মাঝামাঝি মৃত্যুবরণ করে। ইয়াযীদ একটি চিঠি লেখে ওয়ালিদ বিন উতবা বিন আবু সুফিয়ানের কাছে , যাকে মুয়াবিয়া মদীনার গভর্নর নিয়োগ দিয়েছিলো , যেন সে হোসেইন ইবনে আলী (আ.) থেকে তৎক্ষণাৎ বাইয়াত দাবী করে।

পরিচ্ছেদ - ১

মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ানের মৃত্যু সম্পর্কে

মাসউদী এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকরা বর্ণনা করেন যে তার অসুস্থতার (যার কারণে সে মৃত্যুবরণ করে) প্রাথমিক দিনগুলোতে মুয়াবিয়া গোসলখানায় গেলো। যখন সে তার দুর্বল ও শুকনো দেহের দিকে তাকালো সে কাঁদতে শুরু করলো , কারণ সে বুঝতে পারলো তার সময় শেষের নিকটবর্তী এবং সে নিচের কবিতাটি আবৃত্তি করলো ,

আমি দেখতে পাচ্ছি সময় আমাকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য দ্রুত চলে এসেছে এবং আমার কিছু অংশ নিয়ে গেছে ও কিছু রেখে গেছে , দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের বিচ্যুতি তাকে বসিয়ে দিয়েছে , দীর্ঘ একটি সময় ধরে সে দাঁড়িয়ে থাকার পর। ”

আর যখন তার মৃত্যু ও পৃথিবীর সাথে বিচ্ছেদের ক্ষণ নিকটবর্তী হলো এবং তার অসুস্থতা বৃদ্ধি পেলো ও তার আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা কম মনে হলো , সে অনুতপ্ত হয়ে কিছু পঙ্ক্তি আবৃত্তি করলো , হায় যদি আমি এক মুহূর্তের জন্যও স্বাধীন না হতাম। আমি অন্ধও না হতাম পৃথিবীর আনন্দে ডুবে যেয়ে , (হায়) যদি আমি দরিদ্রের মত হতাম , যে শুধু প্রয়োজন মিটিয়ে সস্তুষ্ট থাকে যতক্ষণ পর্যন্তনা সে কবরের লোকদের সাথে মিলিত হয়। ”

ইবনে আসীর জাযারি বলেন , মুয়াবিয়া তার অসুস্থতার সময়ে বলেছিলো , আমি হচ্ছি গৃহপালিত পশুর মত যার জবাই নিকটবর্তী হয়েছে। আমার রাজত্ব ও শাসন তোমাদের ওপরে ছিলো দীর্ঘ সময় পর্যন্ত। যার কারণে আমি তোমাদের উপর বিরক্ত এবং তোমরা আমার উপর বিরক্ত। আমি আকাঙ্ক্ষা করি তোমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য এবং তোমরাও তাই চাও , কিন্তু আমি তার চেয়ে উত্তম যে আমার পরে তোমাদের শাসন করবে , যেরকম আমার আগে যারা ছিলো তারা আমার চাইতে ভালো ছিলো। বলা হয় , যে চায় সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে , সর্বশক্তিমান আল্লাহও তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চান। হে আল্লাহ , আমি আপনার সাথে সাক্ষাৎ চাই এবং আমি আপনাকে অনুরোধ করি আমার সাক্ষাৎ পছন্দ করতে এবং এটিকে আমার সমৃদ্ধি ও একটি উসিলা বানাতে। ” কিছু সময় পর মৃত্যুর নিদর্শনগুলো তার উপর সুস্পষ্ট হয়ে গেলো এবং সে যখন বুঝতে পারলো তার মৃত্যু নিশ্চিত সে তার পুত্র ইয়াযীদকে ডাকলো এবং বললো:

মুয়াবিয়ার অসিয়ত তার পুত্র ইয়াযীদের প্রতি

হে আমার প্রিয় সন্তান , আমি ব্যথার বোঝাকে বেঁধে রেখেছি এবং তোমার কাছ থেকে বিদ্রোহকে সরিয়ে দিয়েছি এবং বিষয়গুলোকে সোজা করেছি। আমি শত্রুদেরকে শান্ত করেছি , আরবদের লাগাম তোমার হাতে এনে দিয়েছি এবং তোমার জন্য তা জমা করেছি যা কেউ এর আগে করে নি। তাই হিজাযের জনগণের কথা বিবেচনা করো যারা তোমার ভিত্তি এবং তোমার শিকড়। হিজাযের লোকদের মধ্যে যারা তোমার কাছে আসে তাদের সম্মান দিও এবং তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে থাকো যারা তাদের মধ্যে নেই। এছাড়া ইরাকের লোকদের কথা বিবেচনায় এনো এবং যদি তারা চায় যে তুমি প্রতিদিন একজন গভর্নরকে পদচ্যুত করো , তাহলে তা করতে অস্বীকার করো না , কারণ তোমার বিরুদ্ধে দশ হাজার খোলা তরবারির মুখোমুখি হওয়ার চাইতে একজন গভর্নর বদলানো সহজ। সিরিয়ার লোকদের সুযোগ-সুবিধা দিবে , কারণ তারা তোমার নিকটজন এবং তোমার চৌবাচ্চা এবং যদি কোন শত্রুকে ভয় পাও তাহলে তাদের সাহায্য চাও এবং যখন তুমি তোমার লক্ষ্য অর্জন করবে (শত্রুকে পরাজিত করবে) , তাদেরকে (সিরিয়ার) শহরগুলোতে ফিরিয়ে আনো , কারণ তারা যদি অন্য জায়গায় থাকে তাদের আচরণ বদলে যাবে। খিলাফতের প্রশ্নে তোমার বিরোধিতা ও তোমার সাথে যুদ্ধ করার বিষয়ে চার জন ছাড়া আর কাউকে আমি ভয় করি না। তারা হলো হোসেইন বিন আলী , আব্দুল্লাহ বিন উমর , আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর এবং আব্দুর রহমান বিন আবু বকর।

আব্দুল্লাহ বিন উমরের বিষয়ে , (অতিরিক্ত) ইবাদত তাকে ভেঙ্গে ফেলেছে , যদি তাকে সাহায্য করার কেউ না থাকে সে তোমার কাছে আত্মসমর্পণ করবে। হোসেইন ইবনে আলীর বিষয়ে , সে হালকা মনের মানুষ এবং ইরাকের লোকেরা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে যতক্ষণ না তারা তাকে বাধ্য করে বিদ্রোহ করতে। যদি সে বিদ্রোহ করে এবং তুমি তার ওপরে বিজয়ী হও , তাকে ক্ষমা করো ; কারণ সে আত্মীয়তার মাধ্যমে আমাদের সাথে যুক্ত এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে আত্মীয়তা ও নৈকট্যের জন্য সে বেশী অধিকার রাখে। আর আবু বকরের সন্তানের বিষয়ে , সে তা অনুসরণ করে যা তার সাথীরা পছন্দ করে , তার উচ্চাশা হচ্ছে নারী ও খেলাধুলা। আর যে সিংহের মত ওঁৎপেতে থাকে এবং যে খেকশিয়াল তোমার সাথে একটি খেলা খেলছে ও একটি সুযোগের অপেক্ষায় আছে , সে হচ্ছে যুবায়েরের সন্তান ; যদি সে বিদ্রোহ করে , তোমাকে আঘাত করবে এবং তুমি যদি তার উপর বিজয়ী হও , তার প্রত্যেক হাড়ের জোড়া আলাদা করে ফেলো। আমাদের নিজেদের লোকদের রক্তকে নিরাপদ রাখতে চেষ্টা করো।

” বলা হয় যে , তার পিতার অসুস্থতার দিনগুলোতে এবং তার পিতা মুয়াবিয়ার মৃত্যুর সময় ইয়াযীদ সিরিয়াতে ছিলো না। তাইয়ামবিয়া যাহহাক্ বিনা কায়েস এবং মুসলিম বিন উকবা মুররীকে ডেকে পাঠালো এবং তাদেরকে নির্দেশনা দিলো তার অসিয়তকে ইয়াযীদের হাতে দিতে , যা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়।

ইবনে আসীর আরও বলেন , মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান তার অসুস্থতার সময় প্রলাপের মধ্যে ছিলো এবং মাঝে মধ্যে বলতো , আমাদের ও গুটার (সিরিয়ার দক্ষিণে উর্বর মরুদ্যানের মধ্যে দূরত্ব কত ? এগুলো শুনে তার কন্যা উচ্চস্বরে বিলাপ করা শুরু করলো , হায় দুঃখ। ” মুয়াবিয়া জ্ঞান ফিরে পেলো এবং বললো , যদি তোমরা বেসামাল হয়ে থাকো (তোমাদের সে অধিকার আছে) , কারণ তোমরা বেসামাল একজনকে দেখেছো। ”

যখন মুয়াবিয়ার মৃত্যু হলো , যাহ্হাক বিন ক্বায়েস তার বাড়ির বাইরে এলো এবং মিম্বরে উঠলো , তখন মুয়াবিয়ার কাফনের কাপড় তার হাতে ছিলো। সে সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ করলো এবং বললো , নিশ্চয়ই মুয়াবিয়া ছিলেন একজন সহায়তাকারী , সাহসী এবং একজন সৌভাগ্যবান আরব যার হাত দিয়ে আল্লাহ ষড়যন্ত্র ও দুষ্কর্ম দূর করেছেন এবং আল্লাহ তাঁর দাসদের ওপরে তাকে সার্বভৌমত্ব দিয়েছিলেন , শহর ও মফস্বলগুলো তার নিয়ন্ত্রণে ছিলো। কিন্তু এখন সে মারা গেছে এবং এই তার কাফনের কাপড় এবং আমরা তাকে এই কাপড় দিয়ে ঢেকে দিবো এবং তাকে তার কবরে প্রবেশ করাবো এবং আমরা তাকে বারযাখে (পৃথিবী ও আখেরাতের মধ্যবর্তী সময়ে) ছেড়ে দিবো , বিচার দিন পর্যন্ত। তাই যারা তার উপর জানাযার নামায পড়তে চায় তারা যেন এ জন্য যোহরের সময় সমবেত হয়। ” যাহ্হাক নিজেই তার মৃতদেহের জন্য জানাযার নামায পড়লো।

বলা হয় যে , যখন মুয়াবিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লো তখন তার সন্তান ইয়াযীদ হাওয়ারীনে (সিরিয়ার হালাবের একটি শহর) ছিলো। তার কাছে একটি চিঠি পাঠানো হলো যেন সে দ্রুত তার পিতার সাথে দেখা করে। যখন চিঠিটি ইয়াযীদের কাছে পৌঁছালো সে নিচের কবিতাটি আবৃত্তি করলো ,

দূত একটি বন্ধ চিঠি নিয়ে এলো যার কারণে হৃদয় অস্থির হলো , আমরা বললাম আক্ষেপ তোমার জন্য কী আছে তোমার ঐ দলিলে , সে উত্তরে বললো যে খলিফা নিশ্চল , ব্যথায় আছে। ”

যখন ইয়াযীদ সিরিয়াতে পৌঁছালো ততক্ষণে মুয়াবিয়াকে কবর দেয়া হয়ে গেছে। তাই সে জানাযা পড়লো তার কবরের উপর।

পরিচ্ছেদ - ২

মদীনার গভর্নর ও ইমাম হোসেইন (আ.)

[ কামিল ’ গ্রন্থে আছে] যখন ইয়াযীদ জনগণের কাছ থেকে আনুগত্যের শপথ নিলো সে ওয়ালিদ ইবনে উতবার কাছে মুয়াবিয়ার মৃত্যু সংবাদ দিয়ে একটি চিঠি লিখলো। একটি সংক্ষিপ্ত চিঠিতে সে লিখলো , আম্মা বা আদ , আনুগত্যের শপথ চাও হোসেইন , আব্দুল্লাহ বিন উমর এবং আব্দুল্লাহ বিন যুবাইরের কাছ থেকে। আর তাদেরকে অবসর দিও না যতক্ষণ না তারা তা করে। ” যখন ওয়ালিদ মুয়াবিয়ার মৃত্যু সম্পর্কে পড়লো সে শঙ্কিত হয়ে পড়লো এবং সংবাদটি তাকে চিন্তায় ফেলে দিল , তাই সে অনিচ্ছাসহ মারওয়ান বিন হাকামকে ডেকে পাঠালো। মারওয়ান ওয়ালিদের আগে মদীনার গভর্নর ছিলো। তাই যখন ওয়ালিদ গভর্নর হলো সে তাকে ঘৃণা করতে শুরু করলো এবং তাকে গালাগালি করতো এবং নিজেকে দীর্ঘ দিনের জন্য বিচ্ছিন্ন রেখেছিলো যতক্ষণ পর্যন্তনা মুয়াবিয়ার মৃত্যু সংবাদ ও জনগণের কাছ থেকে আনুগত্যের শপথ নেয়ার দাবী তার কাছে পৌঁছালো। যখন মারওয়ান এলো , ওয়ালিদ চিঠির বিষয়বস্তু তাকে পড়ে শোনালো। মারওয়ান তা শুনে বললো নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁর কাছে ফেরত যাবো ” এবং সে মুয়াবিয়ার উপর রহমত হওয়ার জন্য দোআ করলো। যখন ওয়ালিদ বিষয়টি সম্পর্কে তার পরামর্শ চাইলো মারওয়ান বললো , আমার মতে , মুয়াবিয়ার মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করার আগে এই লোকগুলোকে এ মুহূর্তেই ডেকে পাঠাও (এবং ইয়াযীদের কাছে আনুগত্যের শপথ করার জন্য তাদেরকে বলো) । যদি তারা অস্বীকার করে , তাদের মাথা কেটে ফেলো তারা মুয়াবিয়ার মৃত্যু সংবাদ জানার আগেই। যদি তারা এ বিষয়ে সামান্যও জানতে পারে তাহলে তারা প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় চলে যাবে এবং বিদ্রোহ শুরু করবে এবং নিজেদেরকে খিলাফতের জন্য যোগ্য দাবী করবে। ”

ওয়ালিদ তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য ইমাম হোসেইন (আ.) ও আব্দুল্লাহ বিন যুবাইরকে ডেকে আনতে আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন উসমানকে ডেকে পাঠালো যে তখন বালক ছিলো। এটি এমন একটি সময় ছিলো যখন ওয়ালিদ সাধারণত কারো সাথে সাক্ষাৎ করতো না। আব্দুল্লাহ বিন আমর তাদেরকে মসজিদে বসে থাকতে দেখলো এবং তাদের কাছে ওয়ালিদের সংবাদ পৌঁছে দিলো। তারা তাকে ফিরে যেতে বললো এবং শীঘ্রই তারা তাকে অনুসরণ করবে বলে জানালো। আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর ইমাম হোসেইন (আ.) এর দিকে ফিরে বললো , তোমার অভিমত অনুযায়ী আমাদেরকে সাক্ষাতের জন্য এ অসময়ে ওয়ালিদ কেন ডাকবে ? ইমাম বললেন , আমি অনুমান করছি তাদের বিদ্রোহীদের নেতা মারা গেছে এবং আমাদেরকে ডেকেছে ইয়াযীদের কাছে আনুগত্যের শপথ করতে , অন্যান্য লোকের কাছে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার আগেই। ” আব্দুল্লাহও এতে মত দিলো এবং জিজ্ঞেস করলো কী করা যায়। ইমাম বললেন যে তিনি ওয়ালিদের সাথে সাক্ষাতের জন্য যাবেন কিছু যুবক সাথে নিয়ে [ইরশাদ] ।

এরপর তিনি তার আত্মীয়দের মাঝ থেকে একটি দলকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন , তোমাদের অস্ত্র তুলে ধরো , কারণ ওয়ালিদ আমাকে এ সময়ে ডেকে পাঠিয়েছে এবং আমাকে তা করার জন্য বাধ্য করতে পারে যা আমি ঘৃণা করি। আমি তাকে বিশ্বাস করি না। তাই আমার সাথে থাকো। যখন আমি তার সাথে দেখা করতে ভিতরে যাবো তোমরা দরজায় বসে থাকবে এবং যখন তোমরা আমার উচ্চস্বর শুনবে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করবে এবং আমাকে সাহায্য করবে। ”

যখন ইমাম ওয়ালিদের কাছে গেলেন , তিনি দেখলেন মারওয়ান তার সাথে বসে আছে। ওয়ালিদ মুয়াবিয়ার মৃত্যু সংবাদ ইমাম হোসেইন (আ.) কে দিলো এবং বললো , নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয়ই আমরা তার কাছে ফিরে যাবো। ” এরপর ওয়ালিদ ইয়াযীদের চিঠিটি এবং তার প্রতি আনুগত্যের শপথ নেয়ার আদেশ পড়ে শোনালো।

ইমাম বললেন , আমি বুঝতে পারছি যে আমি যদি গোপনে ও ব্যক্তিগতভাবে আনুগত্যের শপথ করি তোমরা তাতে রাজী হবে না যতক্ষণ না আমি তা প্রকাশ্যে করি যেন জনগণ তা জানতে পারে। ”

ওয়ালিদ হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলো। ইমাম হোসেইন বললেন , সে ক্ষেত্রে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করো। ”

ওয়ালিদ বললো , যেভাবে তুমি চাও , তুমি আল্লাহর আশ্রয়ে যেতে পারো যতক্ষণ না জনতাকে সাথে নিয়ে আমার কাছে আসো। ” মারওয়ান বললো , যদি হোসেইন তোমাদের মাঝখান থেকে চলে যায় আনুগত্যের শপথ না করেই , তোমাদের আর কখনোই শক্তি হবে না আনুগত্য চাইতে যতক্ষণ পর্যন্তনা তোমাদের ও তার মাঝে অনেক রক্ত ঝরে। তাই তাকে বন্দী করো যতক্ষণ না সে আনুগত্যের শপথ করে অথবা তার মাথা কেটে নাও। ”

ইমাম হোসেইন (আ.) উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন , হে যারক্বার সন্তান , তুমি কি আমাকে হত্যা করতে সাহস করবে ? নিশ্চয়ই তুমি মিথ্যা বলেছো এবং গুনাহ করেছো। ”

এ কথা বলে ইমাম হোসেইন (আ.) বাইরে চলে এলেন এবং তার বাড়িতে ফেরত এলেন তার লোকজনসহ। তখন মারওয়ান ওয়ালিদের দিকে ফিরে বললো , তুমি আমাকে অমান্য করলে ? আল্লাহর ক্বসম , তুমি কখনোই তাকে আর ধরতে পারবে না। ” ওয়ালিদ বললো , আক্ষেপ তোমার সত্তার জন্য যা তোমার নিজেরই শত্রু। হে মারওয়ান , তুমি আমাকে এমন বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছো যা আমার ধর্মকে ধ্বংস করবে। আল্লাহর ক্বসম , আমি ঐ সম্পদ ও রাজ্য চাই না যার ওপরে সূর্য উদয় হয় ও অস্ত যায় যদি তাতে হোসেইনের হত্যা জড়িত থাকে। সুবহানাল্লাহ , আমি হোসেইনকে হত্যা করবো শুধু এ জন্য যে সে আনুগত্যের শপথ করতে অস্বীকার করেছে ? আল্লাহর ক্বসম , আমি নিশ্চিত যে-ই হোসেইন হত্যার সাথে জড়িত হবে , কিয়ামতের দিন তার (কাজের) পাল্লা হালকা হবে আল্লাহর কাছে। ” মারওয়ান বললো , এটিই যদি তুমি চিন্তা কর তাহলে তুমি যা করেছো তা সঠিক। ” এরপর সে তার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেলো।

ইবনে শাহর আশোব মানাক্বিব ’ -এ লিখেছেন যে ইমাম হোসেইন (আ.) ওয়ালিদের সাথে দেখা করতে গেলেন এবং চিঠির বিষয়বস্তু পড়লেন। তিনি বললেন যে , তিনি আনুগত্যের শপথ করবেন না। মারওয়ান , যে সেখানে উপস্থিত ছিলো , সে বললো , আমিরুল মুমিনীনের (অর্থাৎ ইয়াযীদের) প্রতি আনুগত্যের শপথ করো। ” ইমাম হোসেইন (আ.) উত্তরে বললেন ,

আক্ষেপ তোমার জন্য! নিশ্চয়ই তুমি বিশ্বাসীদের প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছো। কে তাকে বিশ্বাসীদের আমির বানালো ?

এ কথা শুনে মারওয়ান উঠে দাঁড়ালো এবং তার তরবারি কোষমুক্ত করে বললো , জল্লাদকে ডাকো এবং তার মাথা কাটতে বলো সে এখান থেকে যাওয়ার আগেই এবং তার রক্তের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে থাকবে। ” যখন কণ্ঠস্বর উঁচু হলো ইমামের পরিবারের উনিশ জন যুবক বড় ছোরা হাতে ধাক্কা দিয়ে প্রবেশ করলো এবং ইমাম হোসেইন (আ.) তাদের সাথে বেরিয়ে গেলেন।

যখন এ সংবাদ ইয়াযীদের কাছে পৌঁছালো সে ওয়ালিদকে পদচ্যুত করলো এবং মারওয়ানকে মদীনার গভর্নর নিয়োগ দিলো। এরপর ইমাম হোসেইন (আ.) ও আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন এবং আব্দুর রহমান বিন আবু বকর ও আব্দুল্লাহ বিন উমরকে কেউ স্পর্শ করলো না।

আর আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের , যখন সে ওয়ালিদের সংবাদ পেলো , সে উত্তরে বললো সে শীঘ্রই আসবে। এরপর সে বাসায় গেলো এবং নিজেকে লুকিয়ে রাখলো। ওয়ালিদ তাকে অনুসরণ করলো এবং দেখলো যে সে তার বন্ধুদের জড়ো করেছে এবং নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে। ওয়ালিদ তাকে চাপ প্রয়োগ করলো কিন্তু আব্দুল্লাহ বললো যে সে কিছু সময় চায় ভাবার জন্য। তখন ওয়ালিদ তার দাসদেরকে আব্দুল্লাহর কাছে পাঠালো , তারা গেলো এবং তাকে ধমক দিয়ে বললো , তোমাকে আমাদের কাছে আসতে হবে নয়তো সে তোমাকে হত্যা করবে। ” আব্দুল্লাহ বললো , আমি তোমাদের জবরদস্তির কারণে চিন্তিত। আমাকে একটু সময় দাও যেন আমি আমার একজন লোককে গভর্নরের কাছে পাঠাতে পারি জিজ্ঞেস করতে যে তিনি আমার কাছে কী চান। ” এরপর সে তার ভাই জাফর বিন যুবাইরকে পাঠালো। জাফর ওয়ালিদের কাছে গেলো এবং বললো , আপনার উপর আল্লাহর রহমত হোক , আব্দুল্লাহকে ছেড়ে দিন , কারণ আপনি তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। আগামীকাল ইনশাআল্লাহ সে আপনার কাছে আসবে , তাই আপনার দূতদের আদেশ করুন ফেরত আসতে। ”

ওয়ালিদ কোন একজনকে পাঠালো তার দূতদের ফেরত ডাকতে , তারা ফেরত এলো। একই রাতে আব্দুল্লাহ তার ভাই জাফরকে সাথে নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন ফারার রাস্তা দিয়ে এবং তাদের সাথে আর কেউ যায় নি।

[ ইরশাদ ’ গ্রন্থে আছে] যখন তার পালানোর খবর সকালে ওয়ালিদকে জানানো হলো সে আশি জন ঘোড়সওয়ারসহ বনি উমাইয়ার এক দাসকে পাঠালো যারা তার পিছু ধাওয়া করলো , কিন্তু তাকে খুঁজে পেলো না। আর তাই ফেরত আসলো এবং সেদিন তারা ব্যস্ত ছিলো ইমাম হোসেইন (আ.) এর বিষয় নিয়ে এবং রাত পর্যন্ত তার সাথে যোগাযোগ রাখলো।

সকালে ইমাম হোসেইন (আ.) তার বাসা থেকে বেরিয়ে এলেন জনতার কাছ থেকে সংবাদ শোনার জন্য , তখন তিনি মারওয়ানের দেখা পেলেন। মারওয়ান বললো , হে আবা আবদিল্লাহ আমি আপনার ভালো চাই , তাই আমি যা বলি তা গ্রহণ করুন যতক্ষণ না আপনি সৎকর্মশীলদের রাস্তায় পৌঁছান। ” ইমাম তাকে বলতে বললেন সে যা বলতে চায়। মারওয়ান বললো , আমি বলছি আপনি ইয়াযীদের প্রতি আনুগত্যের শপথ করুন , কারণ তা আপনার জন্য এ পৃথিবীর জীবনে ও আখেরাতে ভালো হবে। ” ইমাম হোসেইন (আ.) উত্তরে বললেন ,

নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর ও নিশ্চয়ই আমরা তার কাছেই ফেরত যাবো। ইসলামের বিদায় হয়ে যাবে যদি উম্মাত ইয়াযীদের নেতৃত্বের ফাঁদে পড়ে। কারণ আমি আমার নানাকে বলতে শুনেছি খিলাফত আবু সুফিয়ানের সন্তানের উপর নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ”

এভাবে তারা পরস্পরের সাথে কথা শুরু করে এবং তাদের তর্ক বির্তক বৃদ্ধি পায়। শেষ পর্যন্ত মারওয়ান অপমানিত হয়ে স্থান ত্যাগ করে।

একই দিন ওয়ালিদ কিছু লোককে ইমাম হোসেইন (আ.) এর কাছে পাঠায় যেন তিনি গিয়ে আনুগত্যের শপথ করেন। ইমাম বললেন , সকাল আসুক এবং আমরা দেখবো এবং তোমরাও দেখবে। ”

যখন তারা এ কথা শুনলো তারা তার উপর চাপ প্রয়োগ না করে ফিরে গেলো। সে রাতেই তিনি মদীনা ত্যাগ করলেন এবং তা ছিলো আটাশ রজবের রাত। তিনি তার পুত্র সন্তানদের , ভাইদের , ভাতিজা , ভাগ্নে এবং তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রওনা দিলেন শুধু মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া ছাড়া। মুহাম্মাদ জানতো না তিনি কোথায় যাবেন এবং তাই বললেন , হে ভাই , আপনি আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং আমার ভালোবাসার সবচেয়ে নিকটবর্তী এবং তাই আপনি উপদেশ উপহার পাওয়ার সবচেয়ে যোগ্য। ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়া থেকে এবং সুপরিচিত শহরগুলো থেকে দূরে থাকুন যতটুকু পারেন। আপনার দূতদের ছড়িয়ে দিন এবং লোকদেরকে আপনার দিকে আহ্বান করুন। যদি জনগণ আপনার আদেশ মানে এবং আপনার প্রতি আনুগত্যের শপথ করে তাহলে আল্লাহর প্রশংসা করুন এবং যদি তারা আপনাকে ছেড়ে যায় এবং অন্যের চারদিকে জড়ো হয় এতে আপনার বুদ্ধি ও ধর্ম কমে যাবে না এবং আপনার সাহস ও দয়ার কমতি হবে না। আমি আশংকা করছি আপনি হয়তো কোন সুপরিচিত শহরে যাবেন যেখানে একদল আপনাকে সমর্থন করবে এবং অন্যরা বিদ্রোহ করবে এবং এভাবে আপনি হয়তো তাদের বর্শার শিকার হবেন। তখন জনগণের মধ্যে যে নিজের পিতা-মাতার প্রতি সবচেয়ে ভালো ব্যক্তি হয়তো তার রক্ত ঝরবে এবং তার পরিবার অপমানিত হবে। ”

ইমাম হোসেইন (আ.) বললেন , হে প্রিয় ভাই , আমি কোথায় যাবো ?

মুহাম্মাদ বললেন , মক্কায় যান এবং সেখানে থাকুন। যদি আপনি স্বস্তিপান সেখানেই থেকে যান , কারণ সেটিই আপনি খুঁজছেন এবং যদি আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে না পারেন তবে ইয়েমেনের দিকে চলে যান। যদি আপনি সেখানে নিরাপত্তা পান তবে থেকে যান অথবা মরুভূমিতে অথবা পাহাড়ে আশ্রয় নিন। এরপর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যান যতক্ষণ না আপনি জনগণের অবস্থা বোঝেন। সে সময় আপনার সিদ্ধান্ত হবে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। ” ইমাম হোসেইন (আ.) বললেন , হে ভাই , তুমি যথাযথ উপদেশ দিয়েছো এবং আশা করি তোমার উপদেশ দৃঢ় ও বিজয়ী হবে। ”

এরপর তিনি মসজিদে গেলেন এবং ইয়াযীদ বিন মুফাররির কবিতাটি আবৃত্তি করলেন , আমি সকালের ঘাস খেতে থাকা গবাদি পশুকে ছত্রভঙ্গ করে দিবো না , না আমাকে ডাকা হবে ইয়াযীদ বলে। সেই দিন কখনো আসবে না যেদিন আমি আত্মসমর্পণ করবো এবং মৃত্যু আমাকে দেখবে পিছিয়ে যেতে। ”