পরিচ্ছেদ - ৩
‘
বিহারুল আনওয়ার’
-এ আল্লামা মাজলিসির আলোচনা
আল্লামা মাজলিসি‘
বিহারুল আনওয়ার ’ -এ বর্ণনা করেছেন যে মুহাম্মাদ বিন আবু তালিব মুসাউই বলেছেন যে , যখন ওয়ালিদ ইমাম হোসেইন (আ.) কে হত্যা করার জন্য চিঠি পেলো তা তার জন্য অত্যন্ত কষ্টের অনুভূত হলো এবং সে বললো ,
“
আল্লাহর শপথ , আল্লাহ যেন তাঁর নবীর সন্তানকে হত্যা হওয়া আমাকে না দেখান , যদি ইয়াযীদ আমাকে এর বদলে সারা পৃথিবীও দেয় এবং এর ভিতরে যা আছে তাও , তবুও নয়। ”
বলা হয় , এক রাতে ইমাম হোসেইন (আ.) তার বাড়ি থেকে বের হলেন এবং তার নানার কবরের মাথার দিকে গেলেন এবং বললেন ,
“
সালাম আপনার উপর হে আল্লাহর রাসূল। আমি হোসেইন , ফাতিমা (আ.) এর সন্তান। আমি আপনার প্রিয় এবং আপনার প্রিয়র পুত্র সন্তান। আমি আপনার সন্তান যাকে আপনি আপনার উম্মতের ভিতরে আপনার উত্তরাধিকারী হিসেবে রেখে গেছেন। তাই হে রাসূলুল্লাহ , সাক্ষী থাকুন যে এ লোকেরা আমাকে ত্যাগ করেছে এবং আমাকে অবহেলা করেছে এবং আমাকে নিরাপত্তা দিতে অস্বীকার করেছে। আপনার কাছে আসার আগ পর্যন্ত আপনার কাছে এটিই আমার অভিযোগ। ”
এরপর তিনি উঠলেন এবং নামায পড়তে শুরু করলেন , অনবরত রুকু ও সিজদা করে। ওয়ালিদ তার বাসায় গেলো খোঁজ নেয়ার জন্য যে ইমাম মদিনা ত্যাগ করেছেন কি না। যখন সে দেখলো ইমাম সেখানে নেই তখন সে বললো ,“
আল্লাহকে ধন্যবাদ যে সে চলে গেছে এবং আমাকে রক্ষা করা হয়েছে আদালতে হাজির হওয়া থেকে এবং তার রক্ত ঝরানোতে জড়িত হওয়া থেকে। ” এরপর ইমাম তার বাসায় ফেরত গেলেন এবং দ্বিতীয় রাতে আবার রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কবরে গেলেন এবং কয়েক রাকাত নামায পড়লেন। নামায শেষ করার পর তিনি বললেন ,“
হে আল্লাহ , এটি হচ্ছে তোমার রাসূলের কবর এবং আমি তোমার রাসূলের নাতি। তুমি জানো আমার উপর কী আপতিত হয়েছে। নিশ্চয়ই আমি নৈতিক গুণ ও সৎকর্মশীলতাকে ভালোবাসি এবং খারাপকে ঘৃণা করি। হে গৌরব ও সম্মানের প্রভু , আমি এই কবর এবং যিনি এখানে শায়িত আছেন তার অধিকারের মাধ্যমে অনুরোধ করি যেন আপনি আমার জন্য তা বের করে আনেন যা আপনার ও আপনার রাসূল দ্বারা অনুমোদিত। ”
ইমাম কাঁদলেন সকাল পর্যন্ত। এরপর তিনি তার মাথাকে কবরের উপর রেখে অল্প সময়ের জন্য ঘুমালেন। তিনি স্বপ্নে দেখলেন রাসূল (সা.) তার বাম , ডান ও সামনের দিকে ফেরেশতাসহ তার দিকে আসছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) কাছে এলেন এবং ইমাম হোসেইন (আ.) এর মাথাকে তার বুকে চেপে ধরলেন। এরপর তার দুই চোখের মাঝখানে চুমু দিলেন এবং বললেন ,
“
হে আমার প্রিয় হোসেইন , আমি যেন দেখতে পাচ্ছি তুমি রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছো দুঃখ ও পরীক্ষা (কারব ও বালা)-এর স্থানে এবং আমার উম্মতের একটি দল তোমার মাথা কেটে ফেলেছে এবং তুমি পিপাসার্ত অথচ তারা তোমার পিপাসা মেটাচ্ছে না। এ সত্ত্বেও তারা আমার শাফায়াত (সুপারিশ) আশা করে (কিয়ামতের দিন) । আল্লাহ যেন তাদেরকে আমার শাফায়াত থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। হে প্রিয় হোসেইন , তোমার বাবা , মা এবং ভাই আমার কাছে এসেছে এবং তারা তোমার সাথে দেখা করতে চায় এবং তুমি বেহেশতে এমন এক উঁচু সম্মান অর্জন করেছো যে তুমি যদি শহীদ না হও তুমি সেখানে পৌঁছাবে না। ”
ইমাম তার নানার দিকে তাকালেন এবং বললেন ,
“
হে নানা , আমি এ পৃথিবীতে আর ফেরত যেতে চাই না। দয়া করে আমাকে আপনার সাথে নিয়ে যান এবং আপনার কবরে প্রবেশ করান। ”
রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন ,“
তোমার উচিত ফেরত যাওয়া (পৃথিবীর দিকে) এবং শাহাদাত লাভ করা এবং এভাবে যে মহান পুরস্কার আল্লাহ তোমার জন্য বাছাই করে রেখেছেন তা অর্জন করা। কারণ কিয়ামতের দিন তুমি , তোমার পিতা , তোমার চাচা এবং তোমার পিতার চাচা একটি বিশেষ সম্মানিত দল হিসেবে উত্থিত হবে বেহেশতে প্রবেশ করা পর্যন্ত। ”
ইমাম হোসেইন (আ.)মঘে থকে উঠলে দুশ্চিন্তা যুক্ত হয়ে এবং স্বপ্নটি বর্ণনা করলেন তার পরিবার ও আব্দুল মোত্তালিবের বংশধরদের কাছে। ঐ দিন পৃথিবীতে কেউ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পরিবারের চাইতে বেশী দুশ্চিন্তাযুক্ত ও দুঃখী ছিলো না।
এরপর ইমাম হোসেইন (আ.) যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। মধ্যরাতে তিনি তার মা হযরত ফাতিমা (আ.) এর ও তার ভাই ইমাম হাসান (আ.) এর কবরে গেলেন এবং বিদায় নিলেন। ফজরের সময় যখন তিনি বাসায় ফিরলেন তার ভাই মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া তার কাছে এলেন ও বললেন ,“
হে প্রিয় ভাই , আপনি আর সবার চাইতে আমার কাছে প্রিয় ও ভালোবাসার এবং আমি আপনি ছাড়া কাউকে উপদেশ দিবো না , কারণ আপনি এর যোগ্য , কেননা আপনি আমার থেকে এবং আপনি আমার জীবন , আমার রুহ এবং আমার চোখ এবং আমার পরিবারের গুরুজন। আপনার আনুগত্য আমার উপর বাধ্যতামূলক , কারণ আল্লাহ আপনাকে আমার ওপরে মর্যাদা দিয়েছেন এবং আপনাকে জান্নাতের যুবকদের সর্দার হিসেবে বাছাই করেছেন। ” এরপর তিনি রাসূল (সা.) এর পুরো হাদীসটি বর্ণনা করেন ,
“
হাসান ও হোসেইন জান্নাতের যুবকদের সর্দার।”
এরপর তিনি বললেন ,“
আমি চাই আপনি মক্কা যান , যদি আপনি শান্তি খুঁজে পান , সেখানেই থাকুন কিন্তু যদি ঘটনা ভিন্ন হয়ে দাঁড়ায় তাহলে ইয়েমেনে চলে যান। কারণ সেখানকার জনগণ আপনার নানা ও বাবার সাহয্যকারী ও অনুসরণকারী এবং তারা মানুষের মাঝে খুবই দয়ালু ও করুণাময় , আর তাদের শহর ও মফস্বলগুলো বড়। তখন যদি পারেন সেখানে থেকে যান। যদি তা না হয় তাহলে আশ্রয় নিন মরুভূমিতে অথবা পাহাড়ের গুহায় এবং এক শহর থেকে আরেক শহরে যান যতক্ষণ না আপনি জনসাধারণের অবস্থা বুঝেন। আর আল্লাহ যেন আমাদের মাঝে এবং জালেম দলের মাঝে বিচার করে দেন। ” ইমাম হোসেইন (আ.) উত্তরে বললেন ,
“
হে ভাই , যদিও এ পৃথিবীতে আমাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য এমন কোন জায়গা নেই , আমি কখনোই কোন দিন ইয়াযীদের কাছে আনুগত্যের শপথ করবো না। ”
এটি শুনে মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া তার বক্তব্য শেষ করলেন এবং কাঁদতে শুরু করলেন এবং ইমামও কাঁদলেন। এরপর তিনি বললেন ,“
হে ভাই , আল্লাহ যেন উদারভাবে তোমাকে পুরস্কার দান করেন , কারণ তুমি উপদেশ দিয়েছো এবং সঠিক মতই প্রকাশ করেছো। আর তোমার বিষয়ে , হে প্রিয় ভাই , তুমি মদীনায় থেকে যেতে পারো এবং সতর্ক থেকো এবং আমাকে শত্রুদের বিষয়ে সংবাদ জানাতে থাকো। ”
এরপর ইমাম হোসেইন (আ.) একটি কাগজ ও কলম চাইলেন এবং তার ভাই মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়ার জন্য পরামর্শ লিখলেন ,
“
আল্লাহর নামে যিনি সর্বদয়ালু , সর্ব করুণাময়। এটিতে তা-ই আছে যা হোসেইন বিন আলী অসিয়ত করেছেন তার ভাই মুহাম্মাদের জন্য যে ইবনে হানাফিয়া নামে সুপরিচিত। নিশ্চয়ই হোসেইন সাক্ষ্য দেয় যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং সে সাক্ষ্য দেয় যে মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর দাস ও রাসূল যাকে তিনি যথাযথভাবে বাছাই করেছেন এবং জানাত ও জাহান্নাম সত্য এবং কোন সন্দেহ নেই কিয়ামতের দিন আসবে এবং কবরে যারা আছে আল্লাহ তাদের সবাইকে উত্থিত করবেন।
আমি উঠে দাঁড়িয়েছি অন্যায় ছড়িয়ে দেয়া বা লোক দেখানোর জন্য নয় ; না অনৈতিকতা ও নিপীড়ন ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। বরং আমি বের হয়েছি আমার নানার উম্মতের সংস্কারের জন্য এবং আমি চাই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করতে , এভাবে আমি অনুসরণ করবো আমার নানা ও বাবা আলী ইবনে আবি তালিব (আলাইহিম সালাম)-কে। যে ব্যক্তি সত্যকে গ্রহণ করবে আমার মাধ্যমে সে আল্লাহর কাছ থেকে সত্য পাবে। আর যে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে , তাহলে আমি ধৈর্য ধরবো যতক্ষণ না আল্লাহ আমার মাঝে ও অত্যাচারী সম্প্রদায়টির মাঝে বিচার করে দেন এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ সবচেয়ে ভালো বিচারক। এটি আমার পক্ষ থেকে তোমার কাছে সাক্ষ্য , হে ভাই , এবং আমার পুরস্কার শুধু আল্লাহর কাছে যাঁর ওপরেই শুধু আমি নির্ভর করি এবং তাঁর কাছেই আমার প্রত্যাবর্তন। ”
এরপর তিনি চিঠিটি ভাঁজ করলেন এবং এর ওপরে তার নিজের সীলমোহর দিলেন ও তার ভাই মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়াকে দিলেন এবং তাকে বিদায় জানালেন এবং রাতের অন্ধকারের ভেতর স্থান ত্যাগ করলেন।
মুহাম্মাদ বিন আবু তালিব বলেন যে , মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব‘
ওয়াসায়েল ’ -এ বর্ণনা করেছেন মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াহইয়া থেকে এবং তিনি মুহাম্মাদ বিন হোসেইন থেকে এবং তিনি আইয়ুব বিন নূহ থেকে , তিনি সাফওয়ান থেকে এবং তিনি মারওয়ান বিন ইসমাইল থেকে , তিনি হামযা বিন হুমরান থেকে বর্ণনা করেছেন যে , আমরা ইমাম জাফর আস সাদিক্ব (আ.) এর কাছে ইমাম হোসেইন (আ.) এর আন্দোলন এবং মদীনাতে মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়ার থেকে যাওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম , ইমাম উত্তরে বললেন ,
হে হামযা , আমি তোমাকে এমন এক সংবাদ দিবো যার পরে আর কোনদিন তুমি এ ধরনের প্রশ্ন কোন জমায়েতে করবে না। যখন ইমাম হোসেইন (আ.) মদীনা ছেড়ে যেতে চাইলেন তিনি কাগজ চাইলেন এবং সেখানে লিখলেন ,“
আল্লাহর নামে যিনি সর্বদয়ালু ও সর্বকরুণাময়। এটি হোসেইন বিন আলী বিন আবি তালিব থেকে বনি হাশেমের প্রতি। আম্মা বা’
আদ , যে আমার সাথে আসবে সে শহীদ হয়ে যাবে , আর যে আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে সে সফলতা ও শান্তি লাভ করবে না। ওয়াসসালাম।”